#তোর_মনপাড়ায়
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব:: ১৮
গোল সভায় বসে আছে সবাই। কারো মুখে কোনো রুপ ভাষা নেই। সাহেলের মা এসে উপস্থিত হয়েছে ঈর্ষাদের বাড়িতে। তা নিয়ে ইতিমধ্যে অনেক ঝামেলার সৃষ্টি হয়েছে। ঈর্ষা, সাদাফ, সাহেল, সামিরা গুটি শুটি মেরে এককোণে দাঁড়িয়ে আছে। প্রায় বিশ মিনিটের আলোচনার পর রীতি মুখ খুললেন। টেবিলে আঘাত করে চেঁচিয়ে বললেন.
— “আমি আমার ছেলেকে তোমার মতো ইরেন্সপন্সেবল একটা মানুষের কাছে কিছুতেই রেখে যেতে পারবো না। তুমি অন্যের মেয়ের জন্য আমাদের অস্বীকার করেছিলে!”
শাহিনুজ্জামান এবার বেশি রেগে গেলেন। ধমকের সুরে বললেন..
— “আমি কখনো আমার পরিবারের প্রতি দায়িত্ব অবহেলা করি নি। তুমি আমার ছেলেকে একা মানুষ করতে চেয়েছিলে, তাই আমার থেকে তাকে সরিয়ে রেখেছিল।
আমি আমার বোনের শেষ ইচ্ছেটা পূরণ করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তুমি ঈর্ষাকে আমাদের সংসারে এলাউড করো নি। সবসময় মেয়েটাকে অপমান করতে। তাই আমি ওকে নিয়ে দেশে ফিরে এসেছি। আসার আগে আমি তোমাদের কেও আসতে বলেছিলাম, আমার ছেলেকে নিয়ে আসতে চেয়েছিলাম। দিয়েছিলে কি তাকে? দাও নি।”
অনিক আহসান উঠে দাড়ালেন সেখান থেকে। সেখান থেকে কিছুটা দূরে গিয়ে দাঁড়ালেন সে। নিজের মেয়ের দিকে তাকিয়ে শাহিনুজ্জামানের দিকে তাকালেন তিনি। চোখের কোণে অশ্রুতে পূর্ণ হয়ে আছে। চোখের উপর মোটা ফ্রেমের চশমা খুলে নিলেন। অনাকাঙ্ক্ষিত অশ্রুটুকু মুছে পূর্ণরায় চোখে পড়ে নিলেন। ঈর্ষা তার আদরের মেয়ে ছিলো। ছোট বেলায় ঈর্ষার সাথে কাটানো হাসিতে পরিপূর্ণ দিনগুলো নয়নজুড়ে ভেসে উঠলো তার। সে তার মেয়ের প্রতি অবহেলা, অবিচার করেছে। নিজের সুখের জন্য মেয়েটাকে ছুড়ে ফেলে দিয়েছে। আদোও কি অর্থ বিত্তে সে প্রয়োজনটা মিটে যায়। আর এদিকে ঈর্ষার সুখের জন্য নিজের পরিবার ছেড়েছেন শাহিনুজ্জামান। সত্যি দুজন মানুষের মাঝে আকাশ পাতাল তফাৎ।
রীতি শাহিনুজ্জামানকে কিছু বলতে নিয়েও বললেন না। তার আগেই নজরে এলো ঈর্ষা। একবার নিজের ছেলের দিকে তাকিয়ে ঈর্ষার দিকে তাকালেন তিনি। মনে মনে গভীরতম ভাবে ভাবলেন তিনি। মুখশ্রী ভঙ্গিমা আগের তুলনায় অনেকটাই বদলে গেল। ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল ঈর্ষার দিকে। ঈর্ষার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। নিজের গলায় থাকা ডায়মন্ডের লকেটটা খুলে ঈর্ষার গলায় পড়িয়ে দিলেন। কৃত্রিম হেসে উচ্চারণ করলেন..– “মাশাআল্লাহ! খুব সুন্দর লাগছে তোমাকে। আমার ছেলের জন্য এমন একটা মেয়ে খুঁজছিলাম।”
বিষয়টা বোধগম্য হলো না ঈর্ষা। কৌতূহলী চোখে তাকিয়ে রইলো রীতির দিকে।
____________
জ্যোৎস্না রাত আলােকময় প্রকৃতির এক বৈচিত্র্যময় উপহার। ভরা পর্ণিমার রাতে নিটোল চাদ তার ঝলমলে আলাের পসরা নিয়ে উপর আকাশে আবির্ভূত হয়। রুপালি জ্যোৎস্নার অনিন্দ্য সৌন্দর্যে অনবদ্যরূপে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে সমগ্র নিস নয়। চাদনি রাত প্রকৃতিপ্রেমী মানুষের মনে বিচিত্র ভাব ও উদ্দাম আনন্দের সঞ্চার করে। চাদনি রাতের নৈসগিক পরিবেশ যেমন দৃষ্টিনন্দন, চিত্তাকর্ষক তেমনি উপভােগ্য। এ রাতে প্রকতি মায়াবী রূপ-মাধুর্যে ভরে ওঠে। পূর্ণিমা নিশিতে নির্জন অরণ্যের আলো-ছায়া জড়ানাে থাকে পথে পথে। এই জ্যোৎস্নাময় রাতে চাঁদের এক প্রান্তে নিশ্চুপ বসে আছে ঈর্ষা। নিদ্রার গহীন তলে তলিয়ে যাওয়ার আকাঙ্ক্ষায় যতবারই নয়নজোড়া গ্ৰথণ করে, ততবারই সাহেলের মায়ের ছবি ভেসে উঠছে। তার বলা কথাগুলো তাড়া করে বেড়ায় ঈর্ষাকে। অন্যমানে নেই তো। ছিটকিনি আটকানোর শব্দে ভাবনার জগৎ থেকে ফিরল ঈর্ষা। তার থেকে দুকদম পেছনে দাঁড়িয়ে আছে সাদাফ। সাদাফ বাড়িতে ফিরতে চেয়েছিলো, কিন্তু শাহিনুজ্জামান তাকে যেতে দেয়নি। এতো রাতে ছাদে সাদাফকে দেখে চমকানোর কথা থাকলেও চমকালো না সে। হাত দিয়ে ছাদের রেলিং এ ইশারা করে বসতে বলল। সাদাফ বসলো না। বরংচ ঈর্ষাকে কোলে তুলে নিলো। ছাদের দোলনায় বসিয়ে নিজেও তার পাশে বসলো। পকেট থেকে একজোড়া ঝুমকো বের করে এগিয়ে দিল ঈর্ষার দিকে। অতৃপ্ত কন্ঠে বলল.
— “হসপিটালের যাওয়ার সময় দূর থেকে ঝুমকো জোড়া দেখেছিলাম। আমার মতে, তোমাকে বেশ মানাবে। দেখার তীব্র ইচ্ছে দমাতে না পেরে কিনে নিয়ে এলাম। মূলত, সেই রুপে দেখার জন্যই তোমাদের বাড়িতে রয়ে গেলাম।”
টু শব্দটি উচ্চারণ করলো না ঈর্ষা। মনের মাঝের কষ্টটা চাড়া দিয়ে উঠলো তার। সাদাফের উপহার দেওয়া শাড়িটা পড়ে আছে সে, সাদাফ একবারো তাকে মন দিয়ে দেখলো না। রাগে দুঃখে অভিমানে ঝুমকো জোড়া নিল না সে। মুখ ফুলিয়ে অন্যদিক ফিরে বসে রইলো সে। মন খারাপ করে বলল.
— “তোমার ঝুমকো আমার লাগবে না। তুমি নিজের কানে দিয়ে বসে থাকো!”
তৃপ্তিকর হাসি হাসলো সাদাফ। একহাটু গেড়ে ঈর্ষার সামনে বসে পড়লো সে। ঈর্ষাকে টেনে হাঁটুর উপর বসিয়ে নিল। উঠে যেতে চাইলে কোমড় জড়িয়ে কাঁধে মাথা হেলিয়ে দিল। স্বযত্নে ঝুমকো জোড়া শ্রবণপথে পড়িয়ে দিতে দিতে বলল.
— “সকালময়ী! কি মনে হয়, আমি তোমাকে এই অপরুপ সাজে দেখি নি। এটা কখনো হতে পারে। আমি এই মুহূর্তটার অপেক্ষায় ছিলাম। কখন গভীর নিদ্রায় তলিয়ে যাবে সকলে। আর সকালময়ী ছাদে আমার জন্য অপেক্ষা করবে। আমি সেই অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে একজোড়া ঝুমকো নিয়ে আসবো। সেই ঝুমকো জোড়া অতি যত্নে পড়ি দেবো তার কর্ণে।”
অতি লজ্জায় মাথা নুইরে নিল ঈর্ষা। সাদাফ কোমড় থেকে হাত সরিয়ে জুমকো জোড়া পড়িয়ে দিলো। দীর্ঘদিন কানে ইয়ারিং ব্যবহার না করাতে ব্যাথা অনুভব করলো সে। অধর চেপে আর্তনাদ করে উঠলো সে।
মৃদু শব্দে স্যরি উচ্চারণ করলো সাদাফ। ব্যাথার্থ স্থানে অধর ছুয়ে দিল। কম্পিত হলো ঈর্ষা। সাদাফের অনাকাঙ্ক্ষিত স্পর্শ পেয়ে মুঠোয় চেপে ধরলো সাদাফের শার্টের কিছুটা অংশের। কানের কাছে ফিসফিস করে বলল.
— “তো ঊর্ষাময়; রাগ কমলো আমার উপর থেকে! যদি না কমে থাকে তাহলে বলে দাও। অন্যউপায়ে রাগ ভাঙিয়ে নেবো কি বলো।”
শার্ট ছেড়ে সাদাফের পেটের উপর ধাক্কা দিলো ঈর্ষা। সাদাফ নিজেকে সামলাতে গিয়েও, সামলাতে ব্যর্থ হলো। ঈর্ষার কোমড় জড়িয়ে তাকে নিয়েই নিচে পড়লো। সাদাফ নিচে ঈর্ষা উপরে। মেলে রাখা চুলগুলো সরিয়ে দিলো সে। বাঁকা হেসে বলল.
— “আমাকে এভাবে ফেলে দেওয়ার জন্য একটা শাস্তি হলেও তোমার প্রাপ্ত। এখন বলো, কি শাস্তি নিতে চাও।”
ভেংচি কাটলো ঈর্ষা। সাদাফ কে সরাতে সরাতে বলল.– অসভ্য।
— “হ্যা সকালময়ী; আমি অসভ্য। তোমার সাথে অসভ্যেতামো করায় দোষের কি আছে?
তুমি জানো? আমি কতোটা তোমার প্রতি দূর্বল। তোর ঐ “মন পাড়ায়” আমি নামক মানুষটার একটুখানি জায়গা হবে।”
থমথমে হয়ে গেল পরিবেশ। সাদাফও ঈর্ষাকে আটকে রাখলো না। ছেড়ে দিলো। ঈর্ষা উঠে ছাদের অন্যপ্রান্তের দিকে এগিয়ে গেল। কিছুটা গম্ভীর হয়ে বলল.
— “সাদাফ! আমি ওতোটাও ছোট নয় যে, তোমার কথার মানে বুঝতে পারবো না। তবে একটা কথা তোমাকে জানিয়ে রাখা ভালো। আমি প্রেম, ভালোবাসা, বিশ্বাসে বিশ্বাসী নই। এগুলো মানুষের মোহ। আর এই মোহ বেশিদিন থাকে না। তাছাড়া তোমাকে আমি বন্ধুর মতো মনে করি। আশা রাখছি, নেক্সাস টাইম থেকে এমন কিছু বলবে না।
আমি আমার মায়ের মতো কাদতে চাইনা..
ততক্ষণে সাদাফ এসে পৌঁছেছে ঈর্ষার পেছনে। আশাহত কন্ঠে বলল.
— “ঈর্ষা। আমাকে কি তোমার বিশ্বাস হয় না। আমি কি তোমার ভালোবাসা পাওয়া যোগ্য নই। আমাকে দেখে প্রতারক, বিশ্বাসঘাতক মনে হয়।”
— “প্লীজ সাদাফ এভাবে বলো না। তোমাকে আমি বিশ্বাস ঘাতক কিংবা প্রতারক মনে করি না। তুমি আমার অবস্থা-টা একটু বোঝার চেষ্টা করো। প্লীজ।”
দুহাত জোর করে নতজানু হয়ে সাদাফের পায়ের কাছে বসে পড়লো ঈর্ষা। অনুতপ্ত হলো সাদাফ। কিভাবে পারল, হুট করে এমন একটা কথা ঈর্ষাকে বলতে? তার অসুখের কথাটা ভুলে যেতে! পুরোটা না জানলেও স্বল্প কিছু তো সে জানতো।
দুজনের ভাবনার মাঝেই ছাদের দরজায় নক পড়লো। চমকে উঠলো দুজনে। এতো রাতে দুজনকে একসাথে দেখলে অঘটন ঘটে যাবে। তখনই সাদাফের কন্ঠস্বর ভেসে এলো ঈর্ষার কানে.
— “ঊষা ডোন্ট ক্রাই। বাইরে সামিরা নক করেছে। তুমি তো রাতে কিছু খাওনি। তাই সামিরাকে খাবার নিয়ে আসতে বলেছিলাম। হয়তো ও এসেছে।”
কথাগুলো বলে ধপাধপ পায়ে হেঁটে দরজার দিকে এগিয়ে গেল সাদাফ। সামিরা ভেতরে প্রবেশ না করেই বাইরে থেকে ট্রে-টা এগিয়ে দিল। বাই বলে চলে গেল সেখান থেকে। সাদাফ পূর্ণরায় দরজা বন্ধ করে দোলনার উপরে খাবার রেখে ঈর্ষাকে ডাক দিলো। আনন্দের অশ্রুস্রোত দেখা গেল ঈর্ষার চোখে। একটা মানুষ কতোটা কেয়ারিং হলে এতোটা করতে পারে। এতো বছরে অভিজ্ঞতা তাহলে কি আজ ভুল প্রমাণিত হলো।
(চলবে)