#তোর_মনপাড়ায়
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব:: ১৭
ব্রীজের উপর কান ধরে উঠবস করছে সাদাফ। সাদাফের এমন উদ্ভট পাগলামীতে তিল পরিমাণ গলছে না ঈর্ষার মন। সে ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে পানির দিকে তাকিয়ে আছে। তার পাশে সাদাফ নামের কারো অস্তিত্ব আছে, ঈর্ষাকে দেখে বোঝা যাচ্ছে না। কান ছেড়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালো সাদাফ।ঈর্ষার পাশে বসে পড়লো। বুকে হাত রেখে বার কয়েক শ্বাস নিয়ে বলল.
— “তুমি কেমন গো! কতোক্ষণ যাবত কান ধরে উঠবস করছি আর তুমি পাষাণের মতো মজা নিচ্ছ। একবারও থামানোর প্রয়োজন বোধ করছো না।”
পকেট থেকে একটা চুইংগাম বের করে চিবুতে চিবুতে বলল.
— “তোমার শরীরে মেদ জমেছে তাই তুমি এক্সারসাইজ করছ! আমি কেন তোমাকে থামাতে যাবো? হোয়াই.
তাছাড়া আমি তোমাকে মাঝরাস্তায় সার্কাস দেখাতে বলি নি।”
মুখ কালো হয়ে উঠলো সাদাফের। মেয়েটার তার উপর অভিমান করে আছে। ব্রীজের উপর রাখা হাতটার উপর নিজের হাত রাখল। ঈর্ষা নিজের হাত ছাড়িয়ে নিতে চাইলেও সক্ষম হলো না। ব্যর্থ হয়ে এমন একটা ভাব নিলো, যেন হাত না থাকলেও তার কিছুই যায় আসেনা। নিজের ব্যবহৃত রুমটা বের করে দৃঢ় বাঁধনে বেষ্টিত করে নিল চোখ জোড়া। ঈর্ষা হাত ঠেকিয়ে আটকাতে চাইলে পারলো না। তার পূর্বেই নয়ন যুগল অন্যকারো দখলে চলে গেল। সাদাফ নিজের কাধ ব্যাগ থেকে একটা প্যাকেট বের করে নিজের কোলের উপর রাখলো। সেই চির পরিচিত ব্রেসলেটটা স্বযত্নে ঈর্ষার হাতের পড়িয়ে দিলো। প্রতিটি আঙুলের ভাজে নিজের আঙুল গুঁজে স্বদৃঢ় অধর ছুয়ে দিলো হাতের গহিনে।
আচম্বিতে মৃদু কম্পিত হলো ঈর্ষা। হাত ছাড়িয়ে নিল সে। বিপরীত হাতে নিজের ব্রেসলেটময় হাতটা ছুঁতে অম্বুধাড়া গড়িয়ে পড়লো নয়ন যুগল থেকে। এই ব্রেসলেট টা তার অতি পরিচিত। যেটা দূরে থাকলেও অনুভব করতে পারে। নিজের ধারণার সত্যতা প্রমাণ করতে আঁখি মেলে চাইলো। একের পর এক অধর ছুয়ে যাচ্ছে, সেই প্রাণ ভোমড়াতে। আঁখি নীর আর অধর জোড়ার যেন থেমে নেই।
চুলগুলো কানের পেছনে গুঁজে অশ্রুগুলো মুছে দিল। সাদাফের অনাকাঙ্ক্ষিত স্পর্শে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো ঈর্ষা। কেশের ভাঁজের হাত রেখে ব্রক্ষতালু নিজের বক্কে নিয়ে এলো। আশ্বাসের কন্ঠে বলল.
— “কাঁদছো কেন ঊষা। তুমি প্লীজ এভাবে কেঁদো না। আ’ম স্যরি আমি আর কখনো তোমাকে বকবো না। বিলিভ মিঃ”
কান্নার গতি অতিশয় বেড়ে গেল ঈর্ষার। ফোপাতে ফোপাতে বলল.
— “তু-তুমি জা-জানো না সাদাফ। এই ব্রেসলেট টা আমার কাছে কতোটা প্রিয়। আমার মায়ের শেষ স্মৃতি এটা। ”
অনুসূচনা পূর্ণ হলো সাদাফ। প্রথমে মনে করেছিল, ডায়মন্ডের হারিয়ে যাওয়া ব্রেসলেটটা দেখে কেঁদে উঠেছিল ঈর্ষা। পরক্ষণে নিজের বিত্তহীন ভাবনার জন্য, নিজেকে কথা শুনিয়ে দিল সে। ততক্ষণে ঈর্ষার কান্নার মাত্রা কমে এসেছে। তাকে স্বাভাবিক করতে বলল.
— “এবার বলো; এতোবড় একটা জিনিস ফিরিয়ে দেওয়া জন্য আমাকে ক্ষমা করেছ তো।”
বক্ক থেকে মাথা তুললো না ঈর্ষা। সেখান থেকেই মাথা নামিয়ে সায় দিলো সে। এবার গলা খাঁকারি দিয়ে বলল.
— “সেট না-হয় বুঝলাম ক্ষমা করেছ? কিন্তু এতোক্ষণ কেঁদে কেটে আমার শার্ট যে কান্দিত মহাসাগর বানিয়ে ফেলেছ, তার বেলায়। তার উপর নাকও মুছছো। আমার কি শুরসুড়ি লাগে না।🌚”
ক্ষীন ধাক্কা সাদাফকে সরিয়ে দিলো ঈর্ষা। ভেংচি কেটে খানিকটা দূরত্ব নিলো দুজনের মাঝে। সাদাফ একটু সেটে গেল ঈর্ষার দিকে। একটু একটু করে একদম কাছাকাছি। অবশেষে কাঁধে মাথা রাখলো। কটমট লোচণে সাদাফের পানে চেয়ে আঙুল তুলে বলল.
— “আয়! আরো কাছে আয়। একদম কোলের উপরে উঠে ফুটবল খেল।”
সাদাফ ঈর্ষার হাত টেনে নিজের কোলের উপর বসিয়ে দিল। আলতো কোমড় জড়িয়ে নিলো। কানে কাছে মুখ এনে ফিসফিসিয়ে বলল.
— “তুমি তো একদম পুঁটি মাছ। আমি কোলে উঠলে তুমি শুঁটকি মাছ হয়ে যাবে। তারচেয়ে বরং আমার কোলেই বসো।”
__________________
সন্ধ্যা এমন একটা সময় যখন সারাদিন যে সূর্যালোক রাজত্ব করেছে- সে স্তিমিতি হতে হতে অন্ধকারকে জায়গা করে দেয়। বিদায়ের অন্তিম মুহূর্তে সূর্য যেন রক্তিম বর্ণ ধারণ করে। পশ্চিম আকাশকে লালাভ করে দিয়ে অন্ধকার যেন ধীরে ধীরে সমগ্র চরাচরকে গ্রাস করে নেয়। শুরু হয় রাত্রির রাজত্ব। সন্ধ্যা হলো এমন এক সময় যখন ডানার রৌদ্রের গন্ধ মুছে ফেলে চিল। সন্ধ্যা নিমজ্জিত মাঝে রাস্তার উপর দাঁড়িয়ে আছে দুজন মানব। রাস্তাঘাট পানি দিয়ে ধুয়াতে ভিজে আছে। সামান্য নিচু নিচু গর্তে পানি জমে আছে। সেই পানির পাশ দিয়ে ছোট ছোট যানবাহন চলাচল করছে। তার পাশের রয়েছে বিশাল একটি বাড়ি। সাদাফ বিরক্ত হয়ে সাহেলকে ধাক্কা দিয়ে ঢুকিয়ে দিল সেই বাড়িতে। সাহেল দুকদম এগিয়ে পূর্ণরায় ফিরে এলো সে। সাদাফের সামনে দাঁড়িয়ে বলল.
— “দোস্ত তুই চল আমার সাথে। আমি প্রচন্ড নার্ভাস। এতো দিন পর নিজের বাবাকে দেখবো। বিলিভ মি:। আ’ম রিয়েলি নার্ভাস।”
সাহেলের কথায় বেশ ক্ষুব্ধ হলো সাদাফ। কান ধরে বলল.
— “চুপ করবি সালা। এটা তোর বাড়ি। বেড়ালের মতো মিউ মিউ না করে যা তো।”
সাদাফের হাত ছাড়িয়ে শার্টের কলার টেনে ঠিক করলো সাহেল। এটা তার বাড়ি, সো এতো ভয় পেলে চলবে না।
দুজনের ঝামেলার মাঝেই পাশ কাটিয়ে একটা স্কুটি চলে গেল বাড়ির ভেতরে। যাওয়ার আগে গর্তে থাকা নোংরা পানিগুলো সাদাফের শরীরে দিয়ে গেছে। এতোক্ষণ সাদাফ ভেতরে যেতে চায়নি। এবার অন্তত মেয়েটাকে শিক্ষা দেওয়ার জন্য হলেও সে ভেতরে যাবে। সাহেলের দিকে না তাকিয়ে হনহনিয়ে ভেতরে ঢুকে গেল। সাদাফ স্কুটির কাছে পৌঁছানোর আগে সে বাড়ির ভেতরে চলে গেছে। তাই সাদাফও বাড়ির ভেতরে ছুটল।
.
.
শাহিনুজ্জামান তখন আপন মনে টিভিতে খবর দেখছিলেন। হঠাৎ নিজের বাড়ির ভেতরে দু’জন অপরিচিত ছেলে দেখে উঠে বসলেন। রিমোটের বাটন চেপে টিভি অফ করে দিলেন। চোখ মুছে টেবিলের উপর থেকে চশমাটা চোখে পড়ে নিলেন তিনি। ছেলে দুটিকে উদ্দেশ্য করে সোফায় বসতে বললেন। সাদাফ বসলো না। বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো শাহিনুজ্জামানের দিকে। তাকে কোথাও একটা অতি পরিচিত লাগছে তার কাছে। কিন্তু তারচেয়েও সাহেলের সাথে আলাদা করে কথা বলার দরকার। তাছাড়া শার্টের ময়লা নিয়েও থাকা যায় না। হালকা কেঁশে বলল.
— “আঙ্কেল এখানে ওয়াশরুমটা কোথায়?”
শাহিনুজ্জামান উচ্চ গলায় কড়িকে ঠেকে উঠলেন। কড়ি আসতেই সাদাফকে ওয়াশরুমে নিয়ে যেতে বললেন। কড়িকে বাঁধা দিলো সাদাফ। জেনে নিজেই সেদিকে পা বাড়ালো।
সিঁড়ি পেরিয়ে পরের দরজাটা স্পর্শ করতেই আধ খোলা হয়ে গেল দরজাটা। মাথা হেলিয়ে হালকা উঁকি দিতেই অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু নজরে এলো তার। ঈর্ষা ক্ষান্ত মনে প্রিন্ট কার্লার শাড়ি পড়ছে। এই শাড়ি গতকাল রাতে ঈর্ষাকে দিয়েছিল সাদাফ। প্রিন্স কার্লার শাড়ি, চুড়ি। ভেতরে প্রবেশ করলো সাদাফ। দরজাটা হালকা ভিড়িয়ে দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়ালো। গভীর দৃষ্টিতে ঈর্ষার শাড়ি পড়া দেখছে।
বেশ খানিকটা সময় অতিবাহিত হওয়ার পর আয়নাতে তাকালো ঈর্ষা। সাদাফ কে নিজের রুমে দেখে বিচলিত হলো না সে। যেন এটাই রোজকার নিয়ম। আয়ানাতে ভেংচি কাটলো সে। সাদাফও জিভ দেখিয়ে ভেংচি দিল। ঈর্ষা কিছু বললো। শাড়ির কুচিগুলো গুছাতে ব্যস্ত হয়ে গেল। গুছানো ফাঁকে আয়নাতে একবার তাকালো সে। পেছনে ফিরে সাদাফ কে উদ্দেশ্য করে বলল.
— “তুমি এখনো নির্লজ্জের মতো দাঁড়িয়ে আছো? দেখতে পারছো না শাড়ি পড়ছি। কেবলার মতো দাঁড়িয়ে না থেকে যাও।”
এবার মুখ খুললো সাদাফ। ধীরে ধীরে এগিয়ে আসতে আসতে বলল.
— “আমি ওয়াশরুমে যেতে এসেছি! দেখছো না একটু আগে তুমি আমার শার্টের কি অবস্থা করেছ? সেটাই পরিষ্কার করতে এসেছি।”
বিষয়টা ভাবল না ঈর্ষা। বেডের উপর রাখা ভেজা টাওয়াল-টা ছুঁড়ে মারলো সাদাফের দিকে। বলল.
— “তুমি আমাকে বোকা পেয়েছ? তোমার বাড়িতে ওয়াশরুম থাকতে আমার বাড়িতে আসবে? হাউ ফানি তাই না। তোমার চালাকি আমি বুঝি।”
টাওয়াল ক্যাচ ধরলো সাদাফ। গলায় পেঁচিয়ে ওয়াশরুমের দিকে যেতে যেতে বলল.
— “আমি তোমার বাড়িতে আসলে শুধু ওয়াশরুমে যেতে আসবো কেন? তোমাকে একদম নিয়ে যেতে আসবো।”
ঠাস করে দরজা আটকানো শব্দ এখনো রুমের ভেতরে ঘুরপাক খাচ্ছে। সেই সাথে ঈর্ষার মনের কোণে সাদাফের ব্যাপারটা ঘুরপাক খাচ্ছে। দ্রুত ওয়াশরুমে দরজার কাছে গিয়ে খোলার চেষ্টা করলো। কিন্তু সক্ষম হলো না। দরজা ভেতরে থেকে বন্ধ।
(চলবে)