তোর মনপাড়ায় পর্ব-১৬

0
1167

#তোর_মনপাড়ায়
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব:: ১৬

সবকিছু খুব ঘোলা দেখা যাচ্ছে। ঘাসকে ভিজিয়ে রাখা শিশিরগুলো, সূর্য উঠায় পর মুক্তোর মতো ঝরঝরে দেখা যাচ্ছে। সকাল এগারোটা পেঁচিয়ে গেছে বেশ কিছুক্ষণ পূর্বে। এখনো সূর্যের দেখা নেই বললেই চলে। অনেকে অঙ্গে মোটা মোটা শাল জড়িয়েছে। তার একটা বিদ্যমান ঈর্ষারে শরীরে। প্রোফেসর কিছু একটা বোঝাচ্ছে, সেটা মন দিল শুনছে ঈর্ষা। মাঝে মাঝে পেন কামড়ে বোঝার চেষ্টা করছে আবার ক্ষনেক্ষনে খাতায় লিখে রাখছে। তার পাশে বন্ধুরা আঁখি ললাটে তুলে ঈর্ষার কান্ড দেখছে। লিখতে গিয়ে হঠাৎ পেন বেঞ্চিতে ঢুকে গেল। নিচে তাকিয়ে খাতা নজরে এলো না তার। স্পৃহার দিকে নজরে দিতেই দেখলো, সে ঈর্ষার খাতা মন দিয়ে দেখছে। ভেংচি কেটে খাতা নিয়ে গেল সে। ঈর্ষাকে এতো মন দিয়ে পড়াশোনা করতে দেখে ওরাও সবাই মন দিলো।

দরজা নক করার শব্দের ব্যাঘাত ঘটলো সবার। সাহেল অসন্তোষ নিয়ে দরজার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে উঠলো। সাদাফ এসেছে। আজ ব্লু কালারের শার্ট আর ব্ল্যাক জিন্স। হাতে ব্যান্ডের ঘড়ি, ব্লু কেজ সু। চুলগুলো কার্ল করা।
এদিকে সাদাফকে নীল শার্টে দেখে কয়েকদফা ক্রাশ খেলো চৈত্রী। মেয়েরা রীতিমত বুকে হাত দিচ্ছে কেউ আবার অজ্ঞান হওয়ার অভিনয় করছে। চৈত্রী গালে হাতে রেখে বলল.

— ‘দেখ! দেখ। আমার ক্রাশ এসেছে! কতোটা হ্যান্ডসাম লাগছে তাকে। (সবার দিকে তাকিয়ে)
ইচ্ছে করে সবার চুলগুলো টেনে ছিঁড়ে দিতে। একটা ছেলেকে এভাবে হাঁ করে দেখার কি আছে?’

ঈর্ষা চৈত্রীর ভাব দেখে গালে থাকা হাতটা সরিয়ে দিল। সাথে সাথে চিবুক গিয়ে ঠেকলো বেঞ্চির উপর। সবার দিকে রক্তচক্ষু দিয়ে তাকিয়ে চিবুক ঘসতে লাগলো সে। শব্দ করে হেসে উঠলো ক্লাসে অবস্থিত সকলে। অট্টহাসির শব্দে সাহেল বেঞ্চিতে আঘাত করে সাইলেন্ট বলে সাদাফের দিকে এগিয়ে গেলেন। হাত ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে বললেন.

— “মামা! তুই আসার সময় পেলি না। আর পাঁচ মিনিট অপেক্ষা কর। আমি ক্লাসটা শেষ করে আসছি।”

শব্দহীন চপল মারলো সাহেলের পিঠে। শেষ বেঞ্চিতে বসে থাকা ঈর্ষার দিকে তাকিয়ে বলল.

— “তোর আসতে হবে না। আমি ঈর্ষাকে নিতে এসেছি।”

শব্দহীন রুমে ঈর্ষার নামটা উচ্চারিত হতেই সকলের দৃষ্টি সাদাফের থেকে সরে ঈর্ষার উপর গেল। এভাবে সকলে তাকিয়ে থাকাতে বেশ বিরাগী হলো ঈর্ষা। আঙুলের ইশারায় সবাইকে দৃষ্টি সরাতে বলল। ফট করে উঠে দাঁড়িয়ে বলল.

— “স্যরি, মিঃ সাদাফ। আমি আপনার সাথে যেতে পারবো না।”

আপনি শব্দটা ভারী লাগলো সাদাফের কাছে। কালকের করা দুর্ব্যবহারের জন্য মেয়েটা তার উপর বড্ড অভিমান করে আছে, বুঝতে অসুবিধে হলো না তার। ঈর্ষা এখন যেতে চাইবে না এটা স্বাভাবিক! কিন্তু ঈর্ষাকে যে তার চাইই চাই‌।

মাথা নিচু করে মলিন কন্ঠে বলল.

— “কাল থেকে মা আমার উপর রেগে আছে? কোনো কথা বলছে না। এদিকে আদাফেরও একই অবস্থা। ও কালকের ঘটনার পর প্রচন্ড আতঙ্কে আছে? তুমি না গেলে ওরা ঠিক হবে না। প্লীজ চলো।”

নিচের দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ গভীর ভাবে ভাবতে লাগলো ঈর্ষা অতঃপর সাদাফের সাথে বেরিয়ে এলো।
.
.

পাশাপাশি হেটে চলেছে দুজন মানুষ। দুজনের মুখে কোনো কথা নেই। পায়ের শব্দের নিচে চাপা পড়ে গেছে মুখের ভাষা। বেশ খানিকটা সময় অতিবাহিত হওয়ার পর মুখ খুললো সাদাফ.

— “আজ আমার সাথে হেঁটে যাচ্ছ, স্কুটি কোথায়?”

ঈর্ষার মধ্যে উত্তর দেওয়ার মতো কোনো ভাবাবেগ দেখা গেল না। সে নিজের মতো হেঁটে যাচ্ছে। ঈর্ষার এমন ভাব দেখে অসন্তুষ্ট হলো সাদাফ। বাহু ধরে নিজের কাছে নিয়ে এলো। ঝাকাতে ঝাকাতে বলল.

— “কথা কানে যাচ্ছে না তোমার। আমি কিছু একটা জিজ্ঞাসা করছি!”

নিজেকে ছাড়ানোর প্রয়োজন বোধ করলো না ঈর্ষা। গা ছাড়া ভাব নিয়ে বলল.

— “রিপেয়ারিং এ দিয়েছি। দুদিন লাগবে।”

— “সেই কথা বলতে এতো সময় লাগছে কেন?”

সময় অবিলম্ব না করে ঈর্ষাকে ছেড়ে দিল সাদাফ। পা চালিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে গেল সে। ঈর্ষাও টু শব্দটি উচ্চারণ না করে সাদাফের পিছু পিছু হাঁটতে লাগল।

— “ইর্ষা তুমি কি আমার উপর অভিমান করে আছো? বিলিভ মি: আদুর ওমন অবস্থা দেখে ঘাবড়ে গিয়েছিলাম আমি। কন্ট্রোল ল্যাস হয়ে তোমাকে যা নয় তাই বলে ফেলেছি।”

— “আমাদের মতো মেয়েদের অভিমান করতে নেই সাদাফ। কারণ, আমরা রাগ কিংবা অভিমান করলে ভাঙানোর মতো কেউ নেই। ছোট বেলায় থেকে নিজের সাথে যুদ্ধ করে বড় হয়েছি তো। মানুষ তখন অভিমান করে, যখন তার নিজের বলে কেউ থাকে!”

পূর্ণরায় নিরিবিলি হয়ে গেল রাস্তা ঘাট। যানবাহন আর পায়ের শব্দে হারিয়ে গেছে। সাদাফ ঈর্ষার অভিমান ধরতে পড়েছে আরো আগেই। হয়তো এটাই তার প্রাপ্ত ছিলো। অকট্ট কন্ঠে বলল.

— “তোমার কি শীত করছে ঈর্ষা। এতো মোটা শাল জড়িয়ে রেখেছ? আমার আজ কাঠি আইসক্রিম খেতে ইচ্ছে করছিলো।”

রাস্তার অপর পাশে ছোট ছোট বাচ্চা ছেলে মেয়েরা আইসক্রিম কিনছে। তবে বরাবারের মতো খাওয়া ইচ্ছে নেই তার। তবুও সে খাবে, কারণ অন্যকারো ইচ্ছে ভেঙ্গে গেলে কতোটা কষ্ট হয়। তা জানা আছে ঈর্ষার। শরীর থেকে শাল খুলে কনুইয়ের ভাঁজে নিলে বলল.

— “বাকী সব দিনের তুলনায় আজকে ঠান্ডা একটু বেশিই পড়েছে। আমি শাল নিয়ে আসতে চাইনি। সামিরা জোর করে দিয়েছে। (একটু থেমে আবার) চলুন তাহলে ঐদিকে যাওয়া যাক‌।”

ঈর্ষার কথা শেষ হওয়ার আগেই সেদিকে ছুটে গেল সাদাফ। যাওয়ার আগে ঈর্ষাকে দাঁড়িয়ে থাকতে বলেছে। মিনিট পাঁচেক পর দুহাতে আইসক্রিম নিয়ে ফিরে এলো সে। পায়ের গতি বাড়িয়ে একটা ঈর্ষার হাতে দিয়ে নিজের টার খোসা ছাড়িয়ে খেতে ব্যস্ত হয়ে গেল।

সাময়িক সময়ের ব্যবধানে আইসক্রিমের কিছু অংশ গলে গলে হাত ছাড়িয়ে গেল ঈর্ষার। চুপসে চুপসে রাস্তায় গড়িয়ে পড়ছে তা। সামান্য মুখে পুড়াতে এমন অবস্থা। পূর্ণরায় মুখের দিতেই গাল মেখে ফেললো সে। মৃদু হাসলো সাদাফ। ঈর্ষাকে নিজের দিকে ফিরিয়ে একহাত গালে ঠেকালো। নয়নে নয়ন যুগল রেখে বললেন.

— “সামান্য আইসক্রিম খেতেও বাচ্চাদের মতো মাখিয়ে ফেলছো তুমি! নাও আমার চোখে নিজেকে দেখে মুছে নাও। ”

সাদাফের চোখে চোখজোড়া রাখার আগেই সরিয়ে নিল সে। আজ তার চোখে অপরাধ ছাড়া কিছু নজরে এলো না। নত কন্ঠে বলল. — “থাক মুছতে হবে না। ”
শুনলো না সাদাফ। গালে রাখা হাতটা নামিয়ে নিল। বুক পকেট থেকে টিস্যু পেপার বের করে স্বযত্নে আইসক্রিমের গলিত অংশ টুকু মুছে নিল। সাথে সাথে পিছিয়ে গেল ঈর্ষা। হাত ফসকে আইসক্রিম টা মাটি স্পর্শ করলো। এই মানুষটার স্পর্শ গুলো অতি যন্ত্রনাদায়ক। যখন সন্নিকটে থাকে তখন দূরে সরিয়ে দিতে ইচ্ছে হয়। আর যখন বহুদূরে থাকে তখন কাছে চায়। একদম কাছে, হৃদমাঝারে চায়।

সাদাফ কিছু বলতে নিয়েও বললো না। হাতে আইসক্রিমটা এগিয়ে দিয়ে বলল.

— “তুমি চাইলে খেতে পারো। আমি বেশী এঁটো করিনি!”

— “আপনি খান! এমনিতেও আমার খেতে ইচ্ছে করছে না। ”

সাদাফের এক কথা ঈর্ষা না খেলে সে খাবে না। বাধ্য হয়ে দুজনে একইটা শেয়ার করলো। খাওয়া শেষ করে আইসক্রিমের কাঠিটা ফেলতে চাইলে ঈর্ষা নিয়ে গেল। ব্যাগ থেকে পেন বের করে কিছু একটা লিখলো সেই কাঠির মাঝে। অতঃপর পেনের সাথে কাঠিটাও ব্যাগে ঢুকিয়ে রাখলো। ঈর্ষার এমন কান্ডে ভ্রু কুঁচকালো সাদাফ। কৌতূহলী কন্ঠে বলল.

— এই কাঠি গুলো দিয়ে তুমি কি করবে? যদি প্রয়োজন হতো তাহলে রাস্তায় কতো গুলো পড়ে আছে। সেগুলোও নিয়ে আসতাম।

— সাদাফ; এই সামান্য কাঠিগুলো ভ্যালু হয়তো আপনার কাছে নেই। কিন্তু আমার কাছে আছে! এগুলো আমার জীবনের সাক্ষী। আমি যখন বুড়ো হয়ে যাবো, তখন এই কাঠি আমাকে স্বরণ করিয়ে দিবে এই দিনটা। ভাবছ কিভাবে তাই তো?
আমার জ্ঞান হওয়ার পর থেকে আমি কখনো কিছু ফেলে দেইনি। একটা কলম থেকে শুরু করে প্রয়োজনীয় সবকিছু রেখে দিয়েছে। আসলে মানুষ বিভিন্ন ভাবে বাঁচতে চায়। কেউ বেশী টাকা উপার্জন করে আয়েশবহুল জীবন কাটিয়ে বাঁচতে চায়। কেউ ক্ষমতার জোর দেখিয়ে সবার উপরে থেকে বাঁচতে চায়। আর আমি বাঁচতে চাই, জীবনে কতো কষ্ট পেতে পারি সেগুলো বুঝতে বুঝতে। তাই প্রতিটি দিনকে আমি সুন্দর ভাবে গুছিয়ে রাখি! যাতে যখন চাই, অতীতে ঘুড়ে আসতে পারি।

(চলবে)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে