তোর মনপাড়ায় পর্ব-১৩

0
1215

#তোর_মনপাড়ায়
#_ইফা_আমহৃদ
পর্ব:: ১৩

— “তোমরা সবাই খেতে বসো আমি সবাইকে সার্ভ করে দিচ্ছি। আদাফ ফোন রেখে খেতে বসো। আন্টি স্যরি মা তুমি আমাকে বলে দাও কোনটা আগে দিতে হবে।” ( সাবিহার দিকে তাকিয়ে ঈর্ষা)

ঈর্ষার কথা শেষ হওয়ার আগেই শব্দ করে হেঁসে উঠল সাদাফ। একহাত টেবিলের উপর রেখে তার উপর ভড় দিয়ে চিন্তার ভঙ্গিতে বলল.

— “ঈর্ষা তোমার কি আরো হাত আছে? আই মিন এই দুটো ছাড়া এক্সটা হাত আছে? দু-হাতে তো মেহেদী পড়েছ? সার্ভ করবে কিভাবে।”

সাদাফের কথা শেষ হওয়ার আগেই নিজের হাতের দিকে তাকালো ঈর্ষা। মিনিট দশেক আগে ঈর্ষার দুহাতে নিজের মতো মেহেদী দিয়েছে সাবিহা‌। শুধু মেহেদীতেই থেমে থাকে নি। ঈর্ষার অগোছালো চুলগুলোতে তেল দিয়ে হাত খোঁপা করে দিয়েছে সাবিহা। এতোটা ডিপলি ভাবে তেল মাথার গোড়ায় পৌঁছে দিয়েছে, যতোটা ধরা ছোঁয়ার বাইরে।
মন খারাপ করে মৃদু হেসে বলল.

— “ঠিক আছে; তোমরা বসো। আমি পাঁচ মিনিটের ভেতরে হাত পরিষ্কার করে আসছি।”

বেসিনের হাত ধোয়ার আগেই সাবিহা ঈর্ষার হাত ধরে টেবিলের বসিয়ে দিল। এঁকে এঁকে সবার প্লেটে খাবার সাজিয়ে দিল। গ্লাসে পানি ঢালতে ঢালতে বললেন.

— “পাগল মেয়ে। আমি এতো যত্ন করে মেহেদী পড়িয়ে দিয়েছি, তুই কি-না হাত ধুয়ে ফেলতে চাইছিস! আমি আছি না, আমি থাকতে আমার ঊষা কেন খাবার সার্ভ করবে?”

তবুও স্বাভাবিক হতে দেখা গেল না ঈর্ষাকে। দুহাতে মেহেদী পড়া। যদি হাত না ধুয় তাহলে খাবে কিভাবে। মেহেদী সমেত তো আর খাওয়া যাবে না। আমতা আমতা করে বলল.

— “আন্টি আপনিও বসুন। আমি হাত ধুয়ে আসছি। আসলে.

মৃদু হাসলো সাবিহা। ঈর্ষার ঠিক পাশের চেয়ারটা টেনে বসে পড়লেন। ঈর্ষার খাবার হাতে নিয়ে মেখে লোকমা এগিয়ে দিলেন ঈর্ষার দিকে। ব্যস্ততার কন্ঠে বললেন.– “তাড়াতাড়ি হা কর.

স্তব্ধ হয়ে সাবিহার দিকে তাকিয়ে আছে ঈর্ষা। ভাবতেই পারে নি তিনি এমন বিহেবিয়ার করবে ঈর্ষার সাথে। লোকমা মুখে তুলতেই ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো ঈর্ষা। সাবিহার মাঝে নিজের মাকে খুঁজে পাচ্ছে ঈর্ষা। চোখ মুছতে চাইলে পূর্ণরায় অম্বুতে পরিপূর্ণ হয়ে উঠলো। ঈর্ষাকে এমন অবস্থা দেখে ধমকে উঠলেন সাবিহা.

— “ঊষা তোর কাঁদতে ইচ্ছে করছে‌। ঠিক আছে বেশী করে কাঁদ। আমি তোকে আর খাইয়ে দিবো না। (চোখ মুছিয়ে দিয়ে ) আরে পাগলী কাদছিস কেন? আমিও তো তোর মা হই। মা কি তার সন্তান কে খাইয়ে দিতে পারে না।”

সময় অবিলম্ব না করে সাবিহাকে জরিয়ে ধরল ঈর্ষা। কাঁদতে কাঁদতে বলল.

— “আমার মায়ের মৃত্যুর পর কেউ আমাকে খাইয়ে দেয় নি। সবাই বলত, আমাকে শক্ত হতে হবে, নিজেকে সব কিছু করতে হবে।”

— “আরে তখন তোর মা ছিলো না, তাই সবকিছু তোকে করতে হতো! এখন তো আমি আছি। এবার থেকে সবকিছু আমি করে দিবো। কেমন।”

— “কি বলছো, তুমি এসব? ঈর্ষার নাম পাল্টে ঊষা করেছ; মেনে নিলাম। তাই বলে মেয়েও বানিয়ে ফেললে! প্রতি বেলায় আমাদের কে ছেড়ে ওকে খাইতে দিচ্ছো। বাবারে কি ডেঞ্জারাস মেয়ে, আসতে না আসতেই আমার পরিবার-কে হাত করে ফেলেছে‌‌। বাবাকে সাবধান হতে বলবো..!!

সাথে সাথে কান টেনে ধরলো সাবিহা। কোনো মতে ছাড়িয়ে নিল সাদাফ। মুখ ফুলিয়ে বসে রইল সে। কারণ কান ছাড়লেও খাবারের প্লেট নিয়ে গেছে সাবিহা।
_______________

গাড়ি ছুটে চলেছে গতির তালে তালে। সূর্য ডুবে গেছে বেশ কিছুক্ষণ আগে। শহর জুড়ে সন্ধ্যা নেমে গেছে। মৃদু মৃদু আলোর রশ্মি দেখা যাচ্ছে রাস্তার মোড়ে মোড়ে ল্যাম্প পোস্টের থেকে। সূর্যের তীব্র আলো না থাকলেও চাঁদের স্নিগ্ধ আলো যোগ হয়েছে সেই সাথে। সেই আলোর সাথে তাল মিলিয়ে ছুটে চলেছে দু’জন মানুষ। সাদাফ আর ঈর্ষা। ড্রাইভ করার ফাঁকে ফাঁকে ঈর্ষার হাসৌজ্জ্বল মুখটার দিকে তাকাচ্ছে সে। এতোটা খুশি হতে কখনো দেখেনি সে। ভারী নিঃশ্বাস ছেড়ে গাড়ি থামালো সাদাফ। দরজায় ফাঁক দিয়ে বাইরে তাকিয়ে বলল.

— “ঈর্ষা। স্যরি ঊষা। আমরা চলে এসেছি।”

সাদাফের দৃষ্টি অনুসরণ করে বাইরে তাকালো সে। এই বাড়িটায় যতক্ষন থাকে পুরোটা সময় দম বন্ধ হয়ে আসে তার। আবার সেখানে যেতে হচ্ছে তাকে। তবে আজকে দিনটাকে কখনও ভুলতে পারবে না সে।
স্টেয়ারিং এর উপর থাকা সাদাফের হাতের উপর হাত রাখল ঈর্ষা। দৃষ্টি তখন কাঁচ বেধ করে ফাঁকা রাস্তার মাঝে। মুখে এক চিলতে হাসি ফুটিয়ে বলল.

— “সাদাফ; আপনাকে ধন্যবাদ জানানোর মতো ভাষা আমার কাছে নেই। আমি সত্যিই স্পীচ ল্যাস। আমার জীবনে বেস্ট দিন ছিল এটা। একটা পরিবার। যদি কখনো সম্ভব হয়, তাহলে নিজের সবটা দিয়ে আপনার প্রতিদান দেওয়ার চেষ্টা করবো।
এরপর আবার সেই পুরোনো ঈর্ষা হয়ে যাবো। সত্যি বলছি, আমার আগের আমিটাকে একদম পছন্দ নয়। বর্তমানের আমিটাকে খুব পছন্দ। যদি পারতাম, তাহলে সারাজীবন এভাবেই কাটাতাম।”

কোনো সাড়া শব্দ পাওয়া গেল না সাদাফের। সে গাড়িতে হেলান দিয়ে হাতের দিকে তাকিয়ে আছে। হুট করে ঈর্ষার কোমড় জড়িয়ে নিজের কাছে নিয়ে এলো। গালে হাত রেখে কপালে কপাল ঠেকিয়ে ঘনঘন শ্বাস নিয়ে লাগল। উদাসীন কন্ঠে বলল.

— “কে বলেছে; তোমাকে আগের ঈর্ষা হতে। তুমি এমনই থাকো। চোখ বন্ধ কর একটু আগের মুহূর্তটাকে ভাবো। যখন তুমি মায়ের হাতে খেয়েছিলে, হাতে মেহেদী পড়েছিলে, মাথায় তেল দিয়েছিলে। ভাবো…

সাথে সাথে নয়ন যুগল বন্ধ করে নিলো ঈর্ষা। ভেসে গেল সেই চির পরিচিত অতীতে। বেশ কিছুক্ষণ সময় ওভাবেই অতিবাহিত হলো দুজনের। তৎক্ষণাৎ শোনা গেল সাদাফের কন্ঠ.

— “এখন থেকে তুমি শুধু ঊষা। ঈর্ষা নামক কাউকে চেনো না। সুন্দর একটা পরিবার আছে তোমার। আমার পরিবারই তোমার নিজের পরিবার। বুঝতে পারছ তুমি।”

ধক করে আঁখি জোড়া খুলে তাকালো ঈর্ষা। কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল সাদাফের মুখপানে। সাদাফ আগের মতোই চোখ বন্ধ করে কপাল ঠেকিয়ে আছে। এতো কাছ থেকে কেমন অদ্ভুত লাগছে সাদাফকে। নিজেকে গুটিয়ে সাদাফের থেকে সরে এলো সে। তখনও নির্বিকার ভাবে বলে চলেছে সাদাফ। কিন্তু তা কান পর্যন্ত পৌঁছাচ্ছে না ঈর্ষার। সে অদ্ভুত ভাবে সাদাফকে দেখতে ব্যস্ত। হঠাৎ ই খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো সে। হাসির শব্দে তাকালো সাদাফ। সাথে সাথে দ্রুত বজায় রাখলো দুজনের মাঝে খানিকটা। ভ্রু নাচিয়ে বলল.

— “ওয়াট্!”

— “আপনাকে কাছ থেকে দেখতে একদম রাক্ষসের মতো। কপাল আর চুল ছাড়া কিছু নজরে এলো না। হালকা সাদা দাঁত দেখা যাচ্ছিলো, সেটাও রাক্ষসের মতো।”

বলেই মুখ চেপে ধরলো ঈর্ষা। কি বলতে কি বলে ফেলেছে। সামান্য এগিয়ে এলো সাদাফ। হালকা ঝুঁকে ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বলল.– “আমি কি দেখলাম জানো?”

ভেংচি কেটে বলল.

— “তুমি কি দেখলে, না বললে জানবো কিভাবে?”

— “আমি দেখলাম! (ফিসফিস করে) আমি দেখলাম! আমি দেখলাম। তুমি আমার মায়ের শাড়ি চুড়ি করে নিয়ে এসেছো! এটা তোমার কাছে আশা করিনি। চাইলে মা নিজেই শাড়ি দিতো!”

বলেই অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো সাদাফ। রাগে নাক ফুলিয়ে চলেছে ঈর্ষা। এদিকে সাদাফের হাসি থামার নামই নিচ্ছে না। রাগে দাঁতে দাঁত চেপে উরুম ধুরুম কিল ঘুষি দেওয়া শুরু করলো। সাদাফ থামানোর চেষ্টা করেও পারছে না। অনেক চেষ্টার পর ঈর্ষার হাতজোড়া ধরতে সক্ষম হলো। হাতজোড়া ধরে হালকা উঁচু করে দরজার সাথে একহাত দিয়ে চেপে ধরলো। অন্যহাতে ছোট ছোট চুলগুলো সরিয়ে দিল। বাঁকা হেসে কানের কাছে ফিসফিস করে বলল.

— “এতো রেগে যেও না ঊষুরানী। রেগে গেলে তোমাকে ভয়ংকর সুন্দর লাগে। ইচ্ছে করে তোমার সাথে অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু করে ফেলি। কিন্তু আমি মোটেও তা করতে চাইছি না। বুঝতে পারছ তুমি??”

(চলবে)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে