#তোর_মনপাড়ায়
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব:: ১২
একে একে শাড়ির কুচি গুলো গুছিয়ে নিচ্ছে ঈর্ষা। এক পার্ট গোছাচ্ছে তো আরেকটা পার্ট খুলে যাচ্ছে। চরম রুদ্র হলো ঈর্ষা। সামান্য একটা শাড়ি কন্ট্রোল করতে পারছে না। প্রচন্ড ক্ষোভে শাড়ির আঁচলটা ছুড়ে ফেলে দিলো নিচে। মধ্যবয়স্ক মহিলারা কিভাবে শাড়ি সামলায় যেটাই মাথায় ঢুকছে না তার। রাতে সাবিহা জ্ঞানহীন অবস্থায় শাড়িটা ভালো ভাবে গুছিয়ে পড়িয়ে দিতে পারে নি। সকালে উঠেই বাড়ি ফিরতে চেয়েছিলো ঈর্ষা। কিন্তু সাবিহা কিছুতেই ঈর্ষাকে যেতে দেয়নি। তার কথা আজকে সারাদিন ঈর্ষাকে এখানে থাকতে হবে। তাই না করতে পারে নি। চাপের মুখেও হলে রাজি হয়েছে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে বিরবির করে বলল.
— “ঈর্ষা; এটা কি তোর কাজ। তুই ছেলেদের ধরে আচ্ছা করে বানাবি, জিন্স টফ্স পড়ে ছেলে স্টাইলে ঘোড়াঘুড়ি করবি, ভাব নিয়ে চলাফেরা করবি। এইসব তোকে মানায়। এইসব ন.
— “তা কোন সবে মানায়, জানতে পারি। মেয়ে হয়ে শাড়ি তো পড়ছো না, মনে হচ্ছে বাঁশের সাথে পতাকা পেচাচ্ছো। (দরজায় হেলান দিয়ে সাদাফ)
সাদাফের কন্ঠস্বর শুনে পেছনে ফিরলো ঈর্ষা। বুকে হাত গুজে ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বলল.
— “এতোই যখন জ্ঞান আছে। ডাক্তারী ছেড়ে পার্লার খুলে নিয়ে। ইউ নো দ্যাট, হাফ লেডিস তো হাফ লেডিসই।”
ধীরে ধীরে দরজা ছেড়ে ভেতরে প্রবেশ করলো সাদাফ। সামান্য ঝুঁকে ফ্লোরে ছড়িয়ে থাকা শাড়িটখ তুলে নিল হাতে। ভড়কে গেল ঈর্ষা। আমতা আমতা করে বলল.
— “ক-কি ক-করছেন টা কি? শাড়ি ছাড়ুন।”
ছাড়লো না সাদাফ। শাড়ির আঁচলটা ঘুড়িয়ে এনে ঈর্ষার কাঁধে রাখলো। হাঁটু গেড়ে নিচে বসে পড়লো। অতঃপর ধীরে ধীরে ওগোছালো কুচিগুলো গুছিয়ে নিল। প্রতিটা ভাঁজ স্বযত্নে গুছিয়ে ঈর্ষার দিকে এগিয়ে দিলো।
ঈর্ষা আগের মতোই সাদাফের দিকে স্বল্প হা করে তাকিয়ে আছে। তবে হাতের দিকে নয়; মুখের দিকে। ঈর্ষার রেসপন্স না পেয়ে নিজেই কোমড়ে গুঁজে দিল। সাথে সাথে গ্রথণ করে নিল ঈর্ষার আঁখি জোড়া। হাত দিয়ে ঠেকলো সাদাফের হাতের উপর। হাত সরালো না সাদাফ। ধীরে ধীরে উঠে ঈর্ষার মুখোমুখি দাঁড়ালো সাদাফ। হালকা ফুঁ দিয়ে স্লো কন্ঠে বলল.
— “যদি পারতাম, তাহলে আগেই পার্লার খুলে বসতাম। কিন্তু সবাই তো আর আমার বাঁকা স্পর্শ পছন্দ করবে না। তাই নয় কি?”
সাদাফের স্পর্শে আগেই শরীরে বিদ্যুৎ খেলে গেছিলো ঈর্ষা। সাথে উষ্ণ গরম হাওয়ায় কম্পনের মাত্রা আগের তুলনায় গভীর হয়ে উঠলো। ঘনঘন শ্বাস নিতে নিতে জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিল। হুট করেই আয়নার দিকে ঘুড়িয়ে দাড় করিয়ে দিল সাদাফ। ঈর্ষার এলোমেলো চুলগুলোতে হাত বোলালো সে। ড্রেসিং টেবিলের উপর থেকে হেয়ার ব্রাশ নিয়ে ধীরে ধীরে চুলগুলোর জট ছাড়িয়ে নিল। বাহুতে হাত রেখে মোহনীয় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। কাঁধ থেকে আঁচলের গোছা ছাড়িয়ে মেলে দিল সে। শাড়ির ফাঁক দিয়ে কোমড়ে হাত রেখে আয়নার দিকে তাকিয়ে বলল.
— “তোমার এই খানটায় একটা কালো কুচকুচে তিল আছে। সবসময় ঢেকে রাখবে। ভুলেও আমার নজরে যাতে না পড়ে। নেক্সাস টাইম যদি আমার নজরে পড়ে কি হবে আমি নিজেই জানি না। সো বি কেয়ারফুল.”
বলেই সেখানটায় স্লাইড করলো সাদাফ। সাথে সাথে আঁচল টেনে নিজেকে ঢেকে নিল ঈর্ষা। কয়েকপা ফেলে নিজেকে গুটিয়ে নিল সাদাফের থেকে। ড্রেসিং টেবিলের সাথে ঠেসে দাঁড়ালো সাদাফ। দুহাত বুকে গুজে নিল। ঠোঁট কামড়ে হাসলো সাদাফ। এই মেয়েটার এটিটিউট দেখে প্রথমদিন বিরক্ত হয়েছিল সে। ভেবেছিলো, মেয়েটা বড্ড অহংকারী, উশৃঙ্খল, অভদ্র টাইপের। কিন্তু এতোটা হেয়ালে বুঝতে পারেনি, একদম অবুঝ। অবশ্য তার এমন হওয়ার পেছনেও কারণ রয়েছে। ঠাস করে কিছু পড়ার শব্দে হুঁশ ফিরল দুজনের। দরজার দিকে তাকাতেই আদাফকে নজর এলো তার। সামনে সাবিহা দাঁড়িয়ে বিরক্তিকর চোখে তাকিয়ে আছে আদিফের দিকে। আদাফ ইনোসেন্স ফেস করে মায়ের দিকে তাকিয়ে ইশারায় স্যরি বলল!
ফোঁস করে দম ছাড়লো সাদাফ। সে তার মা আর ভাইকে খুব ভালো ভাবেই চেনে। এখানে কি হচ্ছে, সেটা জানার জন্য উঁকি ঝুঁকি মারছিলো রুমে।
.
মার্টান কষা আর ডিমের কোরমা রান্না করছে সাবিহা। দরজার সামনে মুগ্ধ নয়নে সেই দৃশ্য দেখছে ঈর্ষা। ছোট বেলায় তখন ঈর্ষার মা রান্না করতো তখনও ঠিক এভাবে বাইরে দাঁড়িয়ে দেখতো সে। মাঝে মাঝে বায়না ধরতো এটা ওটা বানিয়ে দেওয়ার জন্য। তখন ঈর্ষার মা শুধু খাবার বানিয়েই দিতো না, বরং নিজের হাতে খাইয়েও দিতো। সেই দিনগুলোর কথা অজান্তেই মনে পড়ে গেল ঈর্ষা। হঠাৎই ঈর্ষার পাশ কাটিয়ে রান্না ঘরে ঢুকে গেল আদাফ। ছোট বাটি নিয়ে প্যান থেকে দুই টুকরো মার্টান তুলে নিল। তাকের উপর পা দুলিয়ে খাচ্ছে। খাওয়া শেষ করে বেশিনের মাঝে বাটি রেখে হাত ধুয়ে নিল। অতঃপর সাবিহা আঁচলে মুখ মুছে ঈর্ষাকে টেনে ভেতরে নিয়ে এলো। বলল.
— “দেখো মা; তুমি এখানে একা একা রাধছ আর ইনি ওখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সব শিখে নিচ্ছে। পরে দেখবে অনেক ভালো রান্না শিখে ফেলছে। তাই বলছি, যখন রান্না করবে পর্দা ব্যবহার করবে।”
সময় অবিলম্ব না করে সাবিহা কান টেনে ধরলো আদাফের। মজার ছলে বলল.
–” তুই যাবি এখান থেকে। না-হলে”
আদাফ সাবিহার হাত ছাড়িয়ে দৌড়ে চলে গেল। সাথে সাথে হেঁসে উঠল দুজনে। পূর্ণরায় সাবিহা রান্নায় মন দিলেন এবং বললেন.
— “জানো, আমার একটা মেয়ের ইচ্ছে ছিলো। ভেবেছিলাম আদাফের জায়গায় আদিবা হবে। নামও ঠিক করে রেখেছিলাম। আমাকে মা মা বলে ডাকবে। ছোট মেয়েটা পুরো বাড়ি আলোকিত করে রাখবে। আমি তার মাথায় বড় বড় চুল রাখবো, আঁচড়ে দিবো। কিন্তু আমার ইচ্ছেটা পূরণ হলো না। তাই বলে এমন নয় যে, আদাফকে আমি ভালোবাসি না। ওকেও ভালোবাসি। তবে আশাটা পূর্ণ হলো না। তাতে কি? আদাফ আর সাদাফের বউকে দিয়ে সেই ইচ্ছেটা পূরণ করে নিবো। ওদের আমি আমার মেয়ের চেয়েও বেশি ভালোবাসবো। তুই করে সম্মোধন করব। তুই শব্দটা মা ও মেয়ের মাঝে বেশ মৌধূর্য হয়।”
নিজের মধ্যে অনাকাঙ্ক্ষিত একটা ইচ্ছে জাগলো ঈর্ষার। সাবিহার থেকে তুই সম্মোধন পাওয়ার। আঙুলের ডগায় আঁচলের খানিকটা পেচাতে পেচাতে বলল.
— “আন্টি আপনি যদি চান, তাহলে আমাকে আদিবা বলে ডাকতে পারেন, তুই বলে সম্মোধন করতে পারেন। আপনার অপূর্ণ ইচ্ছেগুলো আমার মাঝে পূর্ণ করে নিতে পারেন।”
এতোক্ষণ যেন সাবিহা ঈর্ষার থেকে এমন উত্তরে আশায় ছিলেন। কিছুটা রেগে বললেন.
— “আমি তোকে আদিবা বলে ডাকতে পারবো না। এটা আমার কাছে থাক। তোকে আমি আজ থেকে উষা বলে ডাকবো। তুই আমার জীবনের উষা হয়ে থাকবি।”
কদাচিৎ হাসি দেখা গেল ঈর্ষার চোখে। ছলছল চোখে বলল.
— “আন্টি; আপনাকে বলে বোঝাতে পারবো না। আমি কতোটা খুশি হয়েছি।”
সাথে সাথে চপল পড়ল ঈর্ষার পিঠে। কপাট রাগ দেখিয়ে বললেন.
— “আমি তোকে আমার মেয়ে হিসেবে মনে করছি। তুই বলে সম্মোধন করছি আর তুই আমাকে আন্টি, আপনি বলে কেন ডাকছিস। মা বলে ডাক।”
বাঁধা দেওয়ায় আগেই অম্বু ধারা গড়িয়ে পড়লো নয়ন যুগল থেকে। সাবিহা আলতো হাতে ঈর্ষার চোখে মুছিয়ে দিয়ে বুকে টেনে নিলেন। মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন.
— “পাগল মেয়ে আমার! এভাবে কাদার কি আছে? আমি কি তোকে বকেছি? একদম কাদবি না, সবসময় হাসি মুখে থাকবি, আর কারণে অকারণে প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে যখন ইচ্ছে হবে তোর এই মায়ের কাছে চলে আসবি। মনে থাকবে.
মাথা না তুলে হ্যা বোধক সেখানে থেকেই নাড়িয়ে সায় দিলো ঈর্ষা। ঈর্ষা কান্ডে হাসলো সাবিহা। তখনই নাকে পুড়ে যাওয়ার গন্ধ ভেসে এলো। দ্রুত ঈর্ষাকে সরিয়ে তরকারি নাড়তে ব্যস্ত হয়ে গেল সাবিহা। বেশ খানিকটা পুড়ে গেছে। প্যানের দিকে তাকিয়ে ঈর্ষার দিকে তাকিয়ে শব্দ করে হেসে উঠলো সাবিহা। দুই মা মেয়ের চক্করে তরকারি পুড়ে গেছে। সাবিহা বললেন.
— “উষা; যা ফ্রিজারেটর থেকে পাঁচটা ডিম নিয়ে আয় আবার ডিমের কোরমা রান্না করতে হবে।”
— “ইয়েস বস.!
স্যালুট করে ডিম আনতে গেল ঈর্ষা। কিছু কিছু সুখের মাঝে দুঃখটাও আনন্দময় লাগে। যেমন টা এখন লাগছে ঈর্ষার কাছে। এই দিনটার জন্য সারাজীবন সাদাফের কাছে ঋনি থাকবে সে।
(চলবে)