#তোর_মনপাড়ায়
#ইফা_আমহৃদ
#পর্ব: ১০
— “ওথেলো সিন্ড্রোম নাম শুনেছেন কখনো। আমার ধারণা আপনি ওথেলো সিন্ড্রোমে আক্রান্ত। আপনার সব রিপোর্ট দেখে বুঝলাম, গাইনি বিষয়ে প্রবলেম নেই।”(টেবিলের উপর দুহাত ভাঁজ করে অথৈ)
ঈর্ষার মুখটা তখন ডাঃ অথৈর মাঝে বন্দী। ওথেলো সিন্ড্রোম সম্পর্কে তার তেমন ধারণা না থাকলেও মোটামুটি আছে। জিভ দিয়ে অধর ছুয়ে নিজেকে সামলে বলল.
— “যদি একটু খুলে বলতেন?”
মৃদু হেসে বললেন অথৈ.
— “এটাই আমাদের কাজ। তাহলে মেন কথায় আসা যাক..! গতদিন আপনার দেওয়া ইনফর্মেশন অনুযায়ী আমার মাথায় একটা জিনিস ঘুড়ছিলো। সিউর হতে, সাধারণ কিছু টেস্ট করতে দিয়েছিলাম। রিপোর্টে আপনার গাইনি বিষয়ে কোনো প্রবলেম পেলাম না। যতটুকু বুঝলাম, আপনি ওথেলো সিন্ড্রোমে আক্রান্ত। ওথেলো সিনড্রোম(ইংরেজি: Othello syndrome) এক ধরনের মনোরোগ যা মনোবিদ্যায় প্যাথলজিক্যাল জেলাসি বা ডিলুশনাল জেলাসি বা মরবিড জেলাসি নামে পরিচিত। অতিরিক্ত সন্দেহপরায়ণতার এই মানসিক ব্যাধির নাম প্যাথোলজিকাল জেলাসি (Pathological Jealousy), যার অর্থ হলো বিকারগ্রস্ত ঈর্ষা বা সন্দেহপরায়ণতা (Morbid Jealousy)। এর আরেক নাম ওথেলো সিনড্রোম (Othello Syndrome)।
এই রোগে কোনো প্রমাণ ছাড়াই ব্যক্তির মনে বদ্ধমূল ধারণা জন্মে যে তার সঙ্গী বা সঙ্গিনী অন্য কারো সাথে সম্পর্ক করছে।[১] এবং এই সন্দেহের বশবর্তী হয়ে তারা নানারকম অস্বাভাবিক ও সামাজিকভাবে অগ্রহণযোগ্য আচরণ করতে থাকে। [১] এটাকে ডিলুশনাল ব্যাধির একটি রূপ বলা যায়।
এই সিন্ড্রোমের পুরুষের প্রতি বেশি আকর্ষণ করে। মহিলার মধ্যেও ‘ওথেলো সিনড্রোম’ দেখা যায়। ওথেলো সিন্ড্রোম নামটি এসেছে উইলিয়াম শেক্সপিয়রের নাটক ‘ওথেলো’ থেকে। ওথেলো সিনড্রোমের রোগী চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে চান না। নিজেকে সবসময় সুস্থ মনে করেন। নিজের ধারণাটিকে প্রবলভাবে বিশ্বাস করেন। এই মিথ্যা অলীক বিশ্বাসের কারণে অনেক সময় এসব রোগী তাদের স্ত্রীকে হত্যা পর্যন্ত করেন।
ঈর্ষা মানুষের খুব স্বাভাবিক একটি অনুভূতির নাম। ঈর্ষার বদৌলতেই মানুষ নিজের সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করতে পারে যেমন, একইভাবে ঈর্ষার জন্য মানুষ নিজের এবং তার আশপাশের মানুষের জীবনকেও বিষিয়ে তুলতে পারে।
১৬০৪ সাল। প্রথম মঞ্চস্থ করা হয় উইলিয়াম শেকসপিয়রের নাটক ‘ওথেলো’। নাটকের কেন্দ্রীয় চরিত্র ছিল ‘ওথেলো’ যে তার স্ত্রীকে হারিয়ে ফেলার ভয়ে থাকত সবসময় এবং ধীরে ধীরে এই ভয়ের পরিণতিটা গিয়ে ঠেকল সন্দেহে। তার স্ত্রী ছিল অত্যন্ত রূপবতীদের একজন। সে আস্তে আস্তে তার স্ত্রীকে অসতী হিসেবে সন্দেহ করতে থাকলেন। মূলত নাটকের কাহিনীটা শর্টকার্টে এরকমই ছিল। আর গল্পের শেষে ওথেলোর হাতেই মৃত্যু হয়েছিল তার স্ত্রীর। শেকসপিয়রের এই গল্পের ঘটনাটা শুধুই একটি গল্প নয়। এটা ভয়ানক একটি রোগ। শেকসপিয়রের নাটকের সঙ্গে মিল রেখেই এর নাম রাখা হয়েছিল ‘ওথেলো সিনড্রোম’ বেশিরভাগ সময় পুরুষরা এই রোগে আক্রান্ত হয়। জীবনসঙ্গীকে হারিয়ে ফেলার ভয় থেকে শুরু হয় সন্দেহ। নেশাগ্রস্তরা সহজেই এই রোগে আক্রান্ত হয়। একপর্যায়ে স্ত্রীর জীবন পর্যন্ত দিতে হয়। এমন ঘটনা এখন ঘরে ঘরে। এমনই এক পরিস্থিতির শিকার হয়েছিল রায়হান পরিবার।
রায়হান কবির ব্যবসায়ী। ব্যবসা সংক্রান্ত কাজের চাপে রাত করে তাকে বাসায় ফিরতে হয়। ঘরে সুন্দরী স্ত্রী লুনা স্বামীর অপেক্ষায় জেগে থাকেন ততক্ষণ। প্রায় দেড় বছর ওদের বিয়ে হয়েছে। এখনো সন্তান নেননি ওরা। রায়হান বেশির ভাগ সময় মদপান করেই বাসায় আসেন। স্বামী বলতে অজ্ঞান লুনা। স্বামীর এ দোষটিকে তাই তিনি মেনেই নিয়েছেন। সেদিন ছিল লুনার জন্মদিন। ভেবেছিলেন স্বামী তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরবেন। দুজনে একসঙ্গে বাইরে গিয়ে চাইনিজ খাবেন। সন্ধ্যা থেকেই সাজতে বসেছিলেন লুনা। এমনিতেই তিনি যথেষ্ট সুন্দরী, সাজগোজ করার পর তাকে স্বর্গের অপ্সরি বলে মনে হলো। স্বামীর জন্য অপেক্ষা করতে লাগলেন তিনি। অপেক্ষা করতে করতে সময় বয়ে গেল। নিজের অজান্তে ঘুমিয়ে পড়লেন সাজগোজ করা অবস্থাতেই। মাঝরাতে ফিরলেন রায়হান। অনেকক্ষণ ধরে কলিং বেল টেপার পর ঘুম ভাঙল লুনার। দরজা খুললেন। স্ত্রীকে এমন সাজগোজ করা অবস্থায় দেখে এবং দরজা খুলতে দেরি হওয়ার কারণে রায়হান চেঁচিয়ে বাড়ি মাথায় তুললেন। তার ধারণা হলো এতক্ষণ লুনা কোনো পরপুরুষের সঙ্গে শুয়েছিলেন, দরজা খুলতে দেরি হওয়ার সেটাই কারণ। লুনাকে পেটাতে লাগলেন। অনেক দিন ধরেই লুনাকে সন্দেহ করছিলেন। আজ প্রমাণ পেয়েছেন, যদিও পুরুষটিকে হাতেনাতে ধরতে পারেননি। ধরতে পারেননি তো কী হয়েছে, লুনার সাজগোজ এবং বিলম্বে দরজা খোলাটাই সবচেয়ে বড় প্রমাণ। পেটানোর একপর্যায়ে লুনা অজ্ঞান হয়ে গেলেন। মাথা কেটে গেল, রক্তে মেঝে ভিজতে লাগল। তাতেও ক্ষান্ত হলেন না রায়হান। লুনার কাপড়চোপড় খুলে ফেললেন। লুনার নগ্ন শরীরটা খুঁটিয়ে পরীক্ষা করতে লাগলেন, সেখানে পুরুষের আদরের কোনো চিহ্ন আছে কি না। এরপর থেকে প্রায় প্রতিদিন লুনাকে নির্যাতন করতেন রায়হান। কার সঙ্গে স্ত্রীর সম্পর্ক রয়েছে তা জানার জন্য ক্ষিপ্ত হয়ে উঠতেন। জোর করে মিথ্যা স্বীকারোক্তি আদায় করতে চাইতেন দৈহিক নির্যাতনের মাধ্যমে। একদিন লুনা একজন চিকিৎসককে ফোন করে তার স্বামীর ব্যাপারটি জানালেন। চিকিৎসক সব শুনে তাকে জানান যে, রায়হান ‘ওথেলো সিনড্রোমের’ শিকার হয়েছেন। দ্রুত চিকিৎসা দরকার। অবশ্যই রায়হানকে মানসিক বিশেষজ্ঞের কাছে নিয়ে যেতে হবে, নইলে ‘ওথেলো সিনড্রোম’ আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করবে।
চিকিৎসা বিজ্ঞানের মতে স্ত্রীর সতীত্বের প্রতি সন্দেহ থেকে এবং সেগুলো বিশ্বাস করাকেই ‘ওথেলো সিনড্রোম’ বলে। ”
এইটুকু বলে থামলেন ডাঃ অথৈ। ঈর্ষা এক ধ্যানে মাটির দিকে তাকিয়ে আছে। চোখের সামনে মায়ের সাথে ঘটা ঘটনাগুলো পূর্ণাবৃত্তি হচ্ছে তার। ছোটবেলায় কাটানো দিনগুলোর কথা মনে পড়ছে। কতোদিন কেঁদে কেঁদে বালিশ ভিজিয়েছে ঈর্ষা, তার হিসেব নেই। রিপোর্ট গুলো হাতের মুঠোয় নিয়ে নিঃশব্দে চেম্বার ছেড়ে বেরিয়ে এলো ঈর্ষা। নয়ন যুগল অশ্রুতে পূর্ণ হয়ে আছে। পড়নের ওরনাটার খানিকটা অংশ ইতিমধ্যে মাটিয়ে পড়ে আছে। হাঁটার তালে তালে পড়ন্ত অবস্থায় সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। নিজের অজান্তেই হাত থেকে রিপোর্ট খানা খসে পড়লো নিচে।
.
আকাশের কোণে কালো মেঘের ভেলা জমে আছে। যখন তখন আকাশ কাঁপিয়ে তুমুল বেগে বৃষ্টির ধারা ঝড়ে পড়তে পারে। চারদিকে অন্ধকার করে এসেছে। রাস্তা ঘাট নিরব হয়ে আছে। কোনো গাড়ি দেখা যাচ্ছে না। হসপিটাল থেকে বেরিয়েছে মিনিট পাঁচেক হয়েছে। গাড়ির অভাব এখনো দাঁড়িয়ে আছে ঈর্ষা। আজকে তাড়াহুড়ো করে আসাতে স্কুটি নিয়ে আসে নি সে। তার অপেক্ষার মাঝেই পাশ থেকে পুরুষালী কন্ঠস্বর ভেসে এলো.
— “ভুল করে তোমার কাগজপত্র করিডোরে ফেলে এসেছো? নাও ধরো।”
কন্ঠস্বর চিনতে সময় নিল না ঈর্ষা। তবুও ঘাড় কাত করে পাশে চেয়ে দেখলো না। নিচে তাকিয়ে শক্তি বিহীন ডান হাতটা সাদাফের দিকে এগিয়ে দিলো সে। রিপোর্ট খানা হাতে না দিয়ে ঈর্ষার মুখোমুখি হয়ে দাঁড়ালো সে। ততক্ষণে ঝুমঝুম করে বৃষ্টির ফোঁটা গুলো ঝড়ে পড়ছে। ঈর্ষার বাড়িয়ে দেওয়া হাতটার উপর নিজের হাত রাখল, অন্যহাত বাহুর মাঝে বন্দি করলো। ঈর্ষাকে অস্বাভাবিক অবস্থায় দেখে কিছুটা বিচলিত হয়ে পড়লো সাদাফ। আশ্বাসে জড়ানো কন্ঠে বলল.
— “ঈর্ষা, এই ঈর্ষা! কি হয়েছে তোমার। তোমাকে এমন উদ্ভর লাগছে কেন? রিপোর্ট কি সিরিয়াস কিছু এসেছে। প্লীজ স্পীক আপ.”
শেষের কথাটা এক জোরেই উচ্চারন করলো সাদাফ। কিন্তু বৃষ্টির আওয়াজে ততটা স্পষ্ট শোনা গেল না। বাহুতে থাকা সাদাফের হাতের উপর হাত রেখে ফুঁপিয়ে উঠলো ঈর্ষা। সামলে রাখা অম্বু ধারা আর সংযত করতে পারলো না। তার আগেই গাল গড়িয়ে নিয়ে গড়িয়ে পড়লো।
বুকে চিনচিন ব্যাথা অনুভব করলো সাদাফ। কখনো যেই মেয়েটাকে সামান্যতম ভেঙ্গে পড়তে দেখে নি, সে আজ কাঁদছে। অশ্রু মুছিয়ে দিয়ে চুলের ভাঁজে হাত রেখে বলল.
— “ঈর্ষা, এভাবে কেঁদো না। আমাকে বলো.
সাথে সাথে গর্জে উঠলো ঈর্ষা। এক ঝাটকায় সাদাফের থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিল সে। রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বলল.
— “কে! কে আপনি? কে হই আমি আপনার? কিসের এতো অধিকার আমার প্রতি? আমি কারো কিছু হইনা। আমি এই গোলাকার পৃথিবীতে একা, নিঃস্ব একজন মানুষ। যার আপন বলতে কেউ নেই। সবাই শুধু স্বার্থের পেছনে ছুটে। আশে পাশে অবুঝ বাচ্চাদের কেউ দেখে না, আদর করে না, ভালোবাসে না।”
সময় অবিলম্ব না করে চপল পায়ে হেঁটে বৃষ্টির মাঝে বেড়িয়ে গেল ঈর্ষা। ঈর্ষার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে তব্ধ নিঃশ্বাস ছাড়ল সাদাফ। হঠাৎ মেয়েটার এমন আপনি করে সম্মোধন মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছিলো সাদাফের।
(চলবে)