#তোর_মনপাড়ায়
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব:: ০৪
একের পর এক দরজায় আঘাত করে ভাঙ্গতে ফেললো সাদাফ। এক পা ভেতরে ফেলতেই কেউ একজন ছিটকে এসে পায়ের কাছে পড়লো তার। দুহাতে পা জড়িয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলল.
— “প্লীজ বাঁচান আমাকে। আমাকে ঐ মেয়েটা মেরে ফেলল। ”
গলার আওয়াজে চিনতে সময় লাগলো না সাদাফের। তার পায়ের কাছে ডাঃ নিহাল পড়ে আছে। গায়ের সাদা এপ্রোন টা বিভিন্ন জায়গায় ছেঁড়া। মানুষটাকে দেখার জন্য সামনে তাকাতেই মেজাজ চড়ে গেল সাদাফের। আবার ঈর্ষা নামক মেয়েটা। ঈর্ষা তখন পায়ের উপর পা ফেলে ভাব নিয়ে টেবিলের উপর বসে আছে। চেম্বারের অবস্থা বিধ্বস্ত। চেয়ার ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে আছে। যেটা দিয়ে ইচ্ছে মতো ডাক্তারকে পিটিয়েছে। তাছাড়া ফাইল পত্র, সো-পিস বিভিন্ন জিনিস ফ্লোরের উপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।
বর্তমানে ডাঃ নিহালের অবস্থা দেখে সামনে এগোনোর চেষ্টা করল না সাদাফ। একটু ঝুঁকে নেহাল-কে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলো। দরজার সামনের বন্ধিতে বসিয়ে দিল। শরীরের মাঝে মাঝে কালো আর লাল হয়ে আছে ।
চেম্বারে ভেতরে গিয়ে গ্লাস ভর্তি করে পানি এনে নেহালের সামনে ধরলো। নেহাল হাতের কাছে গ্লাস পেয়ে ঢকঢক করে পুরোটা শেষ করে নিল। ঘনঘন শ্বাস নিয়ে বন্ধিতে গা হেলিয়ে দিল। একটুর জন্য বেঁচে গেছে সে। না-হয়ে আজ নির্ঘাত এই হসপিটালে ভর্তি হতে হতো। ভর্তির চেয়ে কোনো অংশে মার কম দেয়নি।
— “ওনাকে আমার চেম্বারে নিয়ে যান। আমি আসছি!”
তৃক্ষ্ম চোখে সবার দিকে তাকিয়ে ভেতরে ঢুকে গেল সাদাফ। ঠাস করে দরজা বন্ধ করে দিয়ে ঈর্ষার দিকে এগিয়ে গেল। আজ একটা শাস্তি না দেওয়া পর্যন্ত থামবে না।
প্রথমে ডোন্ট ভাব নিয়ে বসে থাকলেও ধীরে ধীরে নেতিয়ে গেল ঈর্ষা। ধীরে ধীরে সাদাফের এগিয়ে আসাতে ভরকে গেল সে। নিজেকে সামলে চোখের দৃষ্টি সরিয়ে নিল। কলার টেনে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য পাশ বাড়ালো।
সাদাফের পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সময় ঈর্ষার হাত ধরে টেনে দাঁড় করিয়ে দিলো। শক্ত করে হাত দেয়ালের সাথে চেপে ধরল। স্বল্প পরিমানে অগ্ৰসর হলো ঈর্ষার দিকে। শক্ত করে গাল চেপে ধরল।
এক ঝটকায় হাত সরিয়ে দিল ঈর্ষা। ধাক্কা দিয়ে দুজনের মাঝে খানিকটা ফাঁকা জায়গায় তৈরি করে নিল। রাগে চেঁচিয়ে বলল..
— “হাউ ডেয়ার ইউ বাই টু টাস মি ইডিয়েট। হাউ..? ”
ঈর্ষার মুখে আঙ্গুল দিয়ে থামিয়ে দিল সাদাফ। জোরে গলা চেপে ধরলো। দাঁতে দাঁত চেপে বলল..
— “হুস। ডোন্ট টক। আই ডোন্ট ডেয়ার টু সাউট এট মি। সাহস কি করে হয় তোমার, হসপিটালে এসে ডাক্তারদের গায়ে হাত তোলার। তোমার যেখানে যা ইচ্ছে তাই করবে আর কেউ তোমাকে কিছু বলবে না। তাহলে ভুল ভাবছ? এটা তোমার কেনা থানা নয়, হসপিটাল। এখানে উশৃঙ্খল, অভদ্র লোকের থাকার পার্মিশন নেই।”
ইতিমধ্যে বোধশক্তি হারিয়ে ফেলেছে ঈর্ষা। ক্রমশ শরীরটা দূর্বল হয়ে আসছে। আস্তে আস্তে দম বন্ধ হয়ে আসছে নিঃশ্বাস আটকে আসছে। মুহুর্তের মাঝে চোখের মনি জোড়া জ্বলে উঠলো। ভেতরে থেকে তিতগুটে ঢেকুর আর কাশি গলায় এসে আটকে গেল। বাম হাতে মুখ চেপে নিজের থেকে সাদাফকে সরাতে চেষ্টা করলো। শক্তিহীন শরীর নিয়ে সাদাফকে সরাতে ব্যর্থ হলো সে। তবুও হাল ছাড়ল না। হাতের পাতা দিয়ে উল্টোভাবে আয়াতের হাঁটুতে আঘাত করলো। সামান্য হাঁটু ভাঁজ হয়ে গেল তার। সাথে সাথে ঈর্ষার গলা থেকে বলিষ্ঠ হাত সড়ে গেল।
দ্রুত মুখ চেপে ওয়াশরুমে ঢুকে গেল। মাথা নিচু করে বেসিনে বমি করে ভাসিয়ে দিল। চোখ বন্ধ করে দেয়ালে হেলান দিয়ে হাঁপানি রোগীদের মতো শ্বাস নিতে ব্যস্ত হয়ে গেল।
ওয়াশরুমের দিকে এগিয়ে গেল সাদাফ। ভেতরে তৃষ্ণাকে ওমন অবস্থায় দেখে অস্থির হয়ে পড়ল। রাগের বশে তৃষ্ণার গলা চেপে ধরছিলো দেয়ালের সাথে। যার পরিনতি টা বেমালুম ভুলে গিয়েছিলো সাদাফ। ঈর্ষা না-হয় ওমন টাইপের মেয়ে কিন্তু সে তো ওমন নয়। তাহলে কিভাবে পারল এমন কাজ করতে। সাদাফ তো সামান্য ভয় দেখাতে চেয়েছিল। চেহারায় অপরাধ বোধ ফুটে উঠলো। সামনে এগিয়ে যাওয়ার মতো সাহসে কুলাচ্ছে না তার।
বেশ কিছুক্ষণ সময় অতিবাহিত হওয়ার পর ট্যাপ ছেড়ে বেসিন পরিস্কার করে নিল ঈর্ষা। দু-হাতে পানি নিয়ে কুলি করে নিল। পুরো মুখশ্রীতে পানি ছিটিয়ে নিল। মাথাটা হালকা ঝুঁকিয়ে কিছুক্ষণ পানি দিয়ে নিল। মাথার ভেতরটা হালকা ঝিমঝিম করছে। ওয়াশরুমের ভেতরে ঝুলিয়ে রাখা টাওয়াল টা নিয়ে মাথাসহ মুখ পরিষ্কার করে নিল। টাওয়াল টা পূর্বের স্থানে রেখে এলোমেলো পায়ে হেঁটে বেরিয়ে এলো। বেন্ধিতে টানটান হয়ে শুয়ে পড়লো। চুলগুলো তখন বেন্ধির দুরন্ত অতিক্রম করে মাটি স্পর্শ করেছে। ভেজা শরীরে সামান্য ঘাম ফুটে রয়েছে। শরীরটার ভেতরে অস্থিরতা বিরাজ করছে। ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ছে। হাত বাড়িয়ে ফিল্টার থেকে একগ্লাস পানি নিল। আংশিক মাথা তুলে পানি থেকে নিল। গ্লাসটা টেবিলের উপর রাখতে নিলে হাত ফসকে গ্লাসটা নিচে পড়ে গেল। গ্লাস ভাঙার শব্দ যেন ঈর্ষার মাথায় আঘাত করলো। দুহাতে মাথা চেপে সহ্য করে নিল। পকেট থেকে রুমাল বের করে ভেজা মাথায় পেঁচিয়ে নিল। হাত খোঁপা করে উঠে দাড়ালো। দেয়াল ধরে হাতরিয়ে হাতরিয়ে নিচে পড়ে থাকা ক্যাপটা তুলে মাথা পড়ে নিল। ক্লান্ত রক্তিম চোখে সাদাফের দিকে তাকিয়ে দরজার দিকে এগিয়ে গেল।
ঈর্ষা পদধ্বনিতে হুস ফিরলো সাদাফের। মলিন সুরে, ঈর্ষা উচ্চারণ করার পর আর কিছু বলার মতো সুযোগ দিল না ঈর্ষা।
উল্টো ঘুরে হাতের করতল দেখিয়ে থামিয়ে দিল। তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলল..
— “সরি বলার দরকার নেই। বলতে পারেন, ” সরি আর থেংকিউ ” শব্দ দুটিতে আমার চরম এলার্জি।”
ছিটকিনি খুলে কাতর পায়ে হেঁটে বেরিয়ে গেল ঈর্ষা। একদম মাতাল দের মতো। বাইরে আগে থেকেই রবিন, মাহিন, চৈত্রী আর স্পৃহা দাঁড়িয়ে ছিল। ঈর্ষাকে বিধ্বস্ত অবস্থায় বেরিয়ে আসছে দেখে এগিয়ে গেল। দৃষ্টি মাটিতে স্থীর রেখে মলিন কন্ঠে বলল..
— “আজ শরির টা একদম ভালো নেই। বাড়িতে যাবো। একটু ধর।”
সকলে এগিয়ে এলো বটে কিন্তু ঈর্ষাকে ধরলো না। পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়ল.
— “এই ঈর্ষা কি হয়েছে তো? চোখ মুখের এই অবস্থা কেন? শার্ট চুলগুলো ভেজা কেন? কিরে কি হয়েছে বলবি তো?”
চোখ তুলে রক্তচক্ষু নিয়ে তাকালো ঈর্ষা। তার এমন বিহেবিয়ার সাথে কম পরিচিত নয়। ভয় পাওয়ার বদলে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। ঈর্ষা তেজ দেখিয়ে বলল..
— “ধরতে পারবি কি-না সোজাসুজি বল। ঠিক আছে, তোদের ধরতে হবে না। আমি নিজেই পারবো। ”
বলেই হাঁটতে লাগল ঈর্ষা। বাহু ধরে থামিয়ে দিল চৈত্রী। উল্টো রাগ নিয়ে বলল.
— “সবসময় এতো রাগ দেখাস কেন? তোর রাগ-কে কি আমরা ভয় পাই। কখন বললাম, ধরতে পারবো না। সবসময় তোর এক লাইন বেশী না বুঝলে হয়না; তাই না।”
সময় না নিয়ে ঈর্ষা বাহু নিয়ে কাঁধে নিল চৈত্রী। অন্য বাহু স্পৃহা ধরে সামনে দিকে এগিয়ে গেল। পেছন পেছন রবিন আসতে নিলে ইশারা করে থামিয়ে দিল ঈর্ষা। সোজা সাপ্টা বলে দিল.– “আন্টির কাছে থাক।”
আবার পা চালিয়ে বন্ধুদের নিয়ে সামনে এগিয়ে গেল। পেছনে দাঁড়িয়ে বন্ধুদের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইল রবিন। একদিকে বন্ধুত্ব অন্যদিকে মা।
________________
নির্বিকার ভাবে হুতুম পেঁচা ডেকে চলেছে। তার ডাকের সাথে সায় দিয়ে পাশের রুমে থেকে গানের আওয়াজ ভেসে আসছে। দুটোতে বিরক্ত সাদাফ। মনে হচ্ছে মাথার ভেতরে আওয়াজ গুলো গেঁথে আছে। বুক সেল্ফ থেকে একটা বই বের করে মুখ গুঁজে নিল সে। বইয়ের পাতায় পাতায় ঈর্ষার আতঙ্কিত মুখটা ভেসে ভেসে উঠলো। চোখ মুখ কুঁচকে বইটা ছুড়ে ফেললো বেডের উপর। পুরো বেড জুড়ে ঘুড়ে দেয়ালের সাথে ধাক্কা লেগে থেমে গেছে। তখনই রুমে প্রবেশ করলো সাবিহা। ছেলের এমন অবস্থা দেখে চমকে উঠলেন তিনি। সাদাফের পাশে বসে শান্ত কন্ঠে বলল..
— “কি হয়েছে সাদাফ! এভাবে বই ছোড়াছুড়ি করছিস কেন? তুই তো কখনো এমন করিস না!”
মায়ের কন্ঠস্বর শুনে পাশে তাকালো সাদাফ। মাথাটা সাবিহার কোলে রাখল। সাবিহা স্বযত্নে চুলগুলো টেনে দিতে দিতে বললেন
— “তুই তো কখনো বই ছোড়াছুড়ি করতিস না। তাহলে আজ কি হলো তোর।”
— “আজ আমার জন্য একটা মেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েছে মা। মেয়েটা কেমন আছে জানি না। বারবার মেয়েটার চেহারা চোখের সামনে ভেসে উঠছে। কিছুতেই মন বসাতে পারছি না।”
(চলবে)