#তোর_মনপাড়ায়
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব:: ০২
সেই কখন থেকে একপায়ে ভর করে কান ধরে দাঁড়িয়ে আছে ঈর্ষা। মাঝে মাঝে শরীরের ভারসাম্য বজায় রাখতে এদিক ওদিক হেলে পড়ছে সে। তবুও শাস্তির কমতি হচ্ছে না। হাত পা ব্যাথায় টনটন করছে। সামনে দিকে তাকিয়ে মামা শাহিনুজ্জামানের দৃষ্টি অনুসরণ করল। সে মাঝরাতে পেপার খুলে পড়ছে আর মাঝে মাঝে চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছে। নিজের উপর নিজেরই বিরক্ত ঈর্ষা। আজকে তার মামা দেশে ফিরবে, কথাটা কিভাবে ভুলে গিয়েছিলো। মনে থাকলে পাইপ বেয়ে উপরে উঠত সে। হিরোগিরি দেখাতে সদর দরজা দিয়ে ঢুকতে হলো, তার ফলস্বরূপ পাঁচ মিনিট ধরে এভাবে দাড় করিয়ে রেখেছেন তিনি।
ধীরে ধীরে গুটিয়ে রাখা বামপা নামিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালো। নিঃশব্দে রুমের দিকে দৌড়ে দেওয়ার আগেই ডাক পড়লো শাহিনুজ্জামানে।
তলায় জমে থাকা চায়ের কাপে শেষ চুমুক দিয়ে খবরের কাগজ ভাঁজ করে টেবিলের উপর রাখলেন। তার উপরে শূন্য চায়ের কাপ রেখে বললেন.
— “তোর শাস্তি তো এখনো শেষ হয়নি। বাঘের মতো এসে বিড়ালের মতো পালাচ্ছিস কেন?”
পেছনে না ফিরে যেভাবে রুমের দিকে যাচ্ছিল, সেভাবে পূর্বের স্থানকে ফিরে এলো। হালকা ভাব নিয়ে বলল.
— “মামা তুমি ভুল করছো।আমি বাঘ নয়; বাঘিনী। আমার গর্জনে পুরো এলাকা থরথর করে কেঁপে উঠে।”
শব্দ করে হেঁসে উঠলেন শাহিনুজ্জামান। পায়ের উপরে পা তুলে বললেন.
— “সেটাই তো দেখতে পারছি। তা দুদিন পর বাঘিনীকে থানায় কেন ডাকা হয় শুনি; আপ্যায়ণ করতে।
একটু আগে ফোন এসেছিল, কেউ একজন তোর নামে কমপ্লেন্ট করেছে।”
মুখের হাসি উবে গেল ঈর্ষার। একটু আগে কতোটা ভাব নিয়ে, কথা বলছিলি। নিমিষেই গুটিয়ে গেল। কিছু বলার আগেই মুখ খুললেন শাহিনুজ্জামান.
— “একটু আগে কোন ছেলের থেকে হাইজ্যাক করেছিস তুই। সেই ছেলে থানায় অভিযোগ করেছে। মাত্র পনেরো দিন আমি দেশে ছিলাম না; তার মধ্যে তোর এমন অধঃপতন ঘটেছে। এই সপ্তাহের মাঝেই আমি তোকে দেশের বাইরে পাঠিয়ে দেবো। তোর জ্বালায় আমি একদন্ড শান্তিতে থাকতে পারছি না।”
সাথে সাথে বাচ্চাদের মতো ফ্যাচফ্যাচ করে কেঁদে উঠলো ঈর্ষা। নাক টেনে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলল.
— “এখন তো পাঠিয়ে-ই দেবো। আমাকে তো আর আগের মতো ভালোবাসা না..! থাকবো না আমি তোমার সাথে, কিছু খাবো না!”
কাঁদতে কাঁদতে রুমে চলে গেল ঈর্ষা। ইচ্ছে করতে সাদাফের মাথার চুলগুলো টেনে ছিঁড়তে। কি কিপ্টা, পাঁচ হাজার টাকার জন্য অভিযোগ করেছে। পুলিশ-কেও একটা শিক্ষা দিতে হবে। কিছু হলেই মামাকে জানায়।
কপালে চিন্তার ভাঁজ ফুটে উঠলো শাহিনুজ্জামানের। মা-বাবা হীন মেয়েটাকে এতোটা না বকলেও চলতো। না খেয়ে থাকলে ঈর্ষার শরীর খারাপ করে।
অনুসূচনা করতে করতে কিচেনে ছুটলেন তিনি।
.
আলোকশূন্যতায় গিজগিজ করছে চারদিক। আঁধারের মাঝে বেডের উপর কিছু একটা গুটিয়ে আছে। আলো জ্বালিয়ে খাবারটা টেবিলের উপর রাখল। বেডের উপর কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে ঈর্ষা। দুহাতে কাঁথা টেনে সরানোর চেষ্টা করলেন তিনি। মিষ্টি কন্ঠে বলল..
— “ঈর্ষা প্রিন্সেস উঠ। দেখ, আমি তোর জন্য গরম গরম চিকেন কাটলেট বানিয়ে এনেছি। উঠ সোনা।”
ভেতর থেকে কোনো শব্দ এলো না। শাহিনুজ্জামান এক টানে ঈর্ষার থেকে কাঁথা সরিয়ে নিল। ঈর্ষা তখন ভেতরে শুয়ে শুয়ে চিকেন কাটলেট খাচ্ছে। শাহিনুজ্জামান উঠে দাঁড়িয়ে চোখ রাঙিয়ে বললেন.
— “তোর এই অভ্যস-টা জীবনেও যাবে না ঈর্ষা। এরজন্যই আমি কাটলেট ফ্রাই করছি আর উধাও হয়ে যাচ্ছে। তোকে তো ..
— আরে মামা হ্যাভ এ রিলেক্স, সি ইউ নট ফর মাইন্ড । আমি তোমার উপর রাগ করছি, খাবারের উপর নয়। সো ডোন্ট ডিস্টার্ব; খেতে দাও
খিলখিল করে হেসে উঠলো ঈর্ষা। সাথে যোগ দিল তার মামা। মেয়েটাকে হাসতে দেখে, বুক থেকে বোঝা নেমে গেল তার।
___________________________
থানায় বসে আছে সাদাফ। বিরক্তি-তে একটু পর পর কপাল কুঁচকে আসছে। বারবার হাতে থাকা সিলভার ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে সময় দেখছে। তার সামনে বসে ক্রমাগত বক্তিতা দিচ্ছে থানার এসআই শফিক। সকাল সকাল অফিসে যাওয়ার আগে থানায় এসেছে। সাদাফ আশে পাশে তাকিয়ে কিছুটা রুদ্র কন্ঠ বলল.
— “চুপ করবেন আপনি। কোথায় আসামি। আমার পার্সোনাল কাজ রেখে সারাদিন নির্দিধায় এখানে বসে থাকতে পারব না।”
শফিক ফোনটা তুলে ঈর্ষা নাম্বারে ডায়াল করলো। বাজতে বাজতে কেটে গেলো ফোন। ফোনটা ফাইলের উপর রেখে নড়েচড়ে বসে বলল.
— “এখনো সময় আছে, মামলাটা তুলে নিল।”
শফিক কে থামিয়ে চুলে হাত বুলাতে বুলাতে সাদাফ বলল.
— “সেটা সম্পূর্ণ আমার ব্যাপার। আপনার কাজ আপনি করুন।”
গালে হাত রেখে গভীর ভাবতে লাগল শফিক। এবার নির্ঘাত তালগাছে ঝুলিয়ে রাখবে তাকে। প্রথমবার সাহস দেখিয়ে ঈর্ষাকে এরেস্ট করে থানায় এনেছিল বটে। ঘন্টা পেরুবার আগেই জামিন মঞ্জুর করে আবার ছাড়িয়ে নিয়ে গেছে তার মামা। তখন ছিল ডিসেম্বর মাস। সারারাত পঁচা পানিতে চুবিয়ে রেখেছে তাকে ঈর্ষা। পরেরবার যখন এরেস্ট করা হয়, তখন ব্যস্ত রাস্তায় সর্ট প্যান্ট পড়িয়ে যোদ্ধাদের পাশে দাঁড় করিয়ে রেখেছিল। তা-ও আবার মুখে কালি লাগিয়ে। ভাগ্যিস কালি লাগানো হয়েছিল নাহলে সবাই ছিঃ ছিঃ করতো! সেই ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় আপলোড করে দিবে বলে এখনো তাকে থ্রেট করে। এখন আবার সাদাফের ঝামেলা। এমনিতে-ই বাঁশ আছে, তার উপর আরো একটা।
পদধ্বনিতে হুস ফিরলো শফিকের। এঁটো পানি না ফেলে তাতেই চুমুক দিল। আওয়াজ করতে করতে ঈর্ষা এসেছে। ফোঁস করে দম ছাড়লো সে। দেখার পালা কি হয়।
ঈর্ষা এসে পা দিয়ে রকিং চেয়ার পেছনে ঠেলে টেবিলের মুখোমুখি করে বসলো। যেন কোনো রাজা এসেছে, আদেশ করতে। টেবিলের উপর রাখা শো পিস টা ঘুড়াতে ঘুড়াতে স্বাভাবিক কন্ঠে বলল..
— “হঠাৎ এতো জরুরি তলব। কেন ডাকা হয়েছি শুনি।”
ললাটের কোণে চিকন ঘাম জমতে দেখা গেল শফিকের। পকেট থেকে টিস্যু পেপার বের করে সূক্ষ্ম ঘামগুলো বন্দী করে নিল। ঠোঁট প্রশস্ত করে মৃদু হাসির রেখা ফুটিয়ে বলল..
— “আসলে অনেকদিন হয়েছে তোমার দেখাই পাওয়া যাচ্ছে না। তাই একটু দাওয়াত করলাম।”
সাদাফের দিকে তাকিয়ে বাঁকা হাসলো ঈর্ষা। হাই তুলে চেয়ার ঘুড়াতে ঘুড়াতে বলল..
— “যখন দাওয়াত দিয়েছেন, দুপুরে দিতেন। মাংস ভাত খেয়ে যেতাম। শুধু শুধু সকালের ঘুম নষ্ট করে এখানে এসেছি।
সামনের টং দোকান থেকে কড়া লিকার দিয়ে এক-কাপ করে আনুন তো। মাথাটা ধরে আছে; আর আমার মাথা ধরে থাকলে কি হতে পারে।”
ঈর্ষার কথা শেষ হওয়ার আগেই হাবিলদার কে চা আনার হুকুম দিলো শফিক। মিনিট দশেক পর একহাতে প্রিজে দু’টো বিস্কিট আরেক হাতে এক-কাপ চা নিয়ে হাজির হলো। ঈর্ষা চায়ের কাপে বিস্কিট ভিজিয়ে মুখে পুড়ে নিল। কাপটা এগিয়ে দিয়ে বলল..
— “আপনারা কাজটা ঠিক করলেন না। দুজনের মাঝে এক-কাপ চা খাওয়া যায়।”
ভেতরে ভেতরে ক্ষোভে ফুঁসতে লাগল সাদাফ। ঈর্ষার সেবায় এতোটাই নিয়োজিত যে, তার কথা ভুলে গিয়েছিলো। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে টেবিলের উপর জোরে আঘাত করে গম্ভীর গলায় বলল
— “প্লীজ টক, ওয়াট দা স্যোরি ওফ দেম বিগ প্যাপিস। ইন্সটেড ওফ এরেস্টটিং ওন একিউস, ইউ আর ইনটাটাইন্ট গেস্ট। আই উইল কমপ্লেইন ইউর নেইম।”
এসেছে ইংরেজি স্যার। এখন ইংরেজি বলতে বলতে কানের পোকাগুলো বের করে দিবে। ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে সাদাফের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তুরি বাজিয়ে বলল.
— “কোন প্রমাণের ভিত্তিতে আমাকে এরেস্ট করা হবে, একটু বলবেন প্লীজ। না আছে সাক্ষী, না প্রমাণ।
এই সামান্য বিষয় নিয়ে সময় নষ্ট করার মতো সময় আমার নেই। আপনার মতো হার্ট সার্জেন্টের আছে। জানা ছিলো না।”
পকেট থেকে টাকা বের করে এগিয়ে দিয়ে বলল.
— “পুরো ২০ আছে। গাড়ির কাঁচ-টা ঠিক করে নিবেন। বাকিটা আপনার।”
ঘাড় বাঁকিয়ে সবার দিকে তাকিয়ে একটা মেকি হাসি দিয়ে শব্দ করে হেঁটে বেরিয়ে গেল ঈর্ষা। সাথে সাথে শান্ত হয়ে গেলো পরিবেশ।
ঈর্ষা যেতেই বুকে ফুঁ দিয়ে বসে পড়লো শফিক। দুজনের জাতা কলে নিজের চাকরী হারিয়ে যেতে বসেছিল। গলা খাঁকারি দিয়ে বলল.
— “আমার মনে হয়, ঈর্ষার এগেস্টে আপনার কোনো অভিযোগ নেই। ওনি সবটা টাকা পরিশোধ করে গেছে।”
— “সে হলেই যেন আপনার ভালো হয়। প্রয়োজনে আমি কমিশনারের কার্যালয় যাবো। আমার ক্ষমতা সম্পর্কে আপনার কোনো ধারণা নেই।
এবার আসছি।”
পেছনে না তাকিয়ে হনহনিয়ে বেরিয়ে গেল সাদাফ।
(চলবে)