তোর মনপাড়ায় পর্ব-০১

0
2437

#তোর_মনপাড়ায়
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব::০১

মাঝ রাতে নিরিবিলি জায়গায় গাড়ি থামিয়ে, চোখ বন্ধ করে, হাত ভাঁজ করে, হুডের উপর বসে আছে সাদাফ। তখনই আশ-পাশ থেকে একটা মেইলি কন্ঠস্বর ভেসে এলো তার কানে.

— “এক্সিকিউজ মি! হাজার পাঁচেক টাকা হবে। আমার দরকার ছিল।”

আবৃত লোচন যুগল খুলে অবলোকন করলো সাদাফ। শুনশান নিরিবিলি জায়গায় দ্যুতির ব্যবস্থা না থাকলেও চন্দ্র প্রভায় মেয়েটাকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। পড়নে লং শার্ট, ব্ল্যাক জিন্স টাকনুর উপরে ভাঁজ করা। হাতের ডায়মন্ডের ব্রেসলেট। যেটা অন্ধকারে চকচক করছে। চুলগুলো ক্যাপ দিয়ে ঢাকা। মেয়েটার ভেতরে কোনো মেইলি ব্যাপার নেই তাই বেশ কিছুক্ষণ সময় নিয়ে বুঝতে সক্ষম হলো সে। মেয়েটার দিকে তাকিয়ে অস্বাভাবিক কন্ঠে বলল.

— “সরি!”

তব্ধ নিঃশ্বাস ছাড়ল মেয়েটি। সাদাফের কথায় সামান্যতম বিরক্ত হয়েছে মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে। তবুও স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলল.

— “আমার পাঁচ হাজার টাকার খুব প্রয়োজন। যদি টাকা-টা দিতে আমার খুব উপকার হতো। চিন্তা করো না, টাকাগুলো ঠিক সময়ে তোমার কাছে পৌছে দেবো।”

উত্তর-টা মোটেও পছন্দ হলো না সাদাফের। চেনা নেই, জানা নেই হুট করে টাকা চেয়ে বসলো। হাতের করতলের উপর ভর করে উঠে দাড়ালো। দুহাতের ময়লাগুলো দূর করে গা ছাড়ানো ভাব নিয়ে মেয়েটির পাশ কাটিয়ে গাড়িতে উঠে বসলো। কাঁচ খুলে মেয়েটির দিকে একবার তাকিয়ে গাড়ি স্টার্ট দিয়ে চলে গেল সে।

চারপাশে কৌতূহলী চোখে তাকিয়ে কাউকে নজরে এলো না তার। ঠোঁট কামড়ে তর্জনীতে চাবি ঘুরাতে ঘুরাতে স্কুটিতে উঠে বসলো। পেছন থেকে সাদাফের গাড়ি ফলো করে সামনের দিকে এগিয়ে গেল।

আচম্বিতে গাড়ির সামনে স্কুটি এসে থামতেই চমকে উঠলো সাদাফ। দ্রুত ব্রেক কষে গাড়ি থামিয়ে দিল। অকস্মাৎ গাড়ি থামাতে খানিকটা সামনে হেলে পড়লো সাদাফ। গাড়ির স্টেয়ারিং এ হাত রেখে বার কয়েক শ্বাস নিয়ে সামনের দিকে তাকালো। একটু আগের মেয়েটাকে দেখে ক্ষুব্ধ হলো সাদাফ। সময় অবিলম্ব না করে গাড়ি প্রবেশদ্বার খুলে বেরিয়ে এলো। মেয়েটার মুখোমুখি হয়ে বুকে হাত গুজে দাঁতে দাঁত চেপে বলল.

— “কি হলো এটা! তোমার ধারণা আছে, একটু হলে আমার গাড়িটা তোমাকে চাপা দিয়ে চলে যেত। তখন লোকে দেখতে আসতো না, কার দোষ আছে আর কার নয়। সবাই ভাবত আমি ইচ্ছে করেই তোমার এক্সিডেন্ট করেছি।”

হাই তুলে সাদাফের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ভ্রু কুঁচকে বলল.

— “এটা কি হলো, তা তোমাকে না ভাবলেও চলবে। কে কি ভাবল ঈর্ষা তার ধার ধারে না। টাকা-টা দিয়ে তুমি যেথায় খুশি সেথায় যাও, আটকাবো না। কিন্তু তার আগে নয়।”

প্রচন্ড রাগে শরীরটা মৃদু কাঁপছে সাদাফের। ছোট একটা মেয়ে তাকে থ্রেট করছে মানা যায়। এক-পা এগিয়ে ঈর্ষার দিকে একটু ঝুঁকে বেবী ফেস করে বলল.

— “ওমারে ভয় পাইছি আমি। আমি টাকা দেবো না। দেবো না মানে দেবো না। আমাকে খুন করবে না-কি অন্যকিছু?
আমিও দেখি; তুমি কিভাবে আমার কাছ থেকে টাকা নাও।”

কিছুক্ষণ গভীর ভাবে ভাবল ঈর্ষা। সাদাফের দিকে আরেকটু ঝুঁকে বলল.

— “আমি অতোটা নিচ নই যে, সামান্য কিছু টাকার বিনিময়ে..! টাকা কিভাবে আদায় করতে হয় আমার জানা আছে। ওয়েট”

রাস্তার পাশে পড়ে থাকা অর্ধ ভাঙ্গা ইট নিয়ে গাড়ির দিকে এগিয়ে গেল ঈর্ষা। সাদাফের দিকে ভ্রু তাকিয়ে কাঁচে আঘাত করল। প্রথমবার কাঁচের উপর কোনো প্রভাব না পড়লে পূর্ণরায় আঘাত করল সে।

কাঁচ ভাঙ্গার শব্দে নয়নজোড়া গ্ৰথণ করে নিল সাদাফ। দ্বিতীয়বার আওয়াজে হুশ ফিরল তার। অন্য কাঁচে আঘাত করতে নিলে হাত ধরে থামিয়ে দিল সাদাফ।

— “আর ইউ ক্র্যাজি। ডু ইউ হেভ অ্যানি আইডিয়া, হাউ মাস ইজ দিস গ্লাস।”

— “এসব ননসেন্স আইডিয়া আমার দরকার নেই। তারচেয়ে বরং আপনি আমার টাকা দিয়ে দিন আর যেথায় খুশি যান।”

— “তোমার টাকা মানে! কোনটা তোমার টাকা? কাজ করে আমার কাছে রাখতে দিয়ে গেছিলেন বুঝি, আশ্চর্য!
মাত্র পাঁচ হাজার টাকার জন্য আমার দামী গাড়িটার কাঁচ তুমি.”

ইটটা ডানহাত থেকে ছুঁড়ে বাম হাতে ক্যাচ নিল ঈর্ষা। ইটের এক কোণ দিয়ে কপালের কোণে স্লাইড করতে করতে বলল.

— “মাত্র একটা ভাঙলাম। যদি টাকা না পাই সবগুলো তো ভাঙবোই, না আপনার গাড়ি স্বাভাবিক অবস্থায় থাকবে।”

ফোঁস করে দম ছাড়লো সাদাফ। ঈর্ষা নামক মেয়েটা যে, টাকা না পেলে তার গাড়ি স্বাভাবিক অবস্থায় রাখবে না। এই নিয়ে বিন্দু পরিমান সন্দেহ নেই। মাঝখান দিয়ে পাঁচ হাজার টাকার জন্য লক্ষ পাঁচেক টাকা নষ্ট হবে।
মুখের জিও-গ্ৰাফি চেন্জ করে দাঁতে দাঁত চেপে বলল.

— “ভাঙতে হবে না, আমি টাকা দিচ্ছি।”

সাদাফের থেকে হাত ছাড়িয়ে ইটটা ঝোপের মাঝে ফেলে দিল ঈর্ষা। শার্টের কলার টেনে ঠিক করে নিল। দ্রুত শার্টের হাতা ফোল্ড করে সাদাফের দিকে হাত মেলে দিল। তৃক্ষ্ম চোখে ঈর্ষার হাতের দিকে তাকিয়ে পকেট থেকে ওয়ালেট বের করলো। হাজার টাকার দুটো নোট বের করে তর্জনী আর মধ্যমার ফাঁকে নিয়ে নিলো। অতঃপর আবার টাকা বের করতে নিলে ওয়ালেট টেনে নিয়ে গেল ঈর্ষা। নিজের কাঙ্খিত টাকা নিয়ে পূর্ণরায় সাদাফের হাতে ধরিয়ে দিল। ফুঁ দিয়ে সামনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ছোট ছোট চুলগুলো উড়িয়ে দিয়ে বলল.

— “ধন্যবাদ তোমাকে! টাকাগুলো সত্যি আমার প্রয়োজন ছিল। চিন্তা করো না, ঠিক সময়ে টাকাগুলো পৌঁছে দিবো। তবে আজ আসছি.

সামান্য কিছু সময়ের জন্য ঈর্ষা নামক মেয়েটির মায়াবী হাসিতে নিজেকে জড়িয়ে ফেলেছিল সাদাফ। পরক্ষণে নিজের সামলে পেছন থেকে বলল.

— “হয়তো আবার কারো টাকা ছিনতাই করে, আমার টাকা ফিরিয়ে দিবে। তোমাদের মতো মেয়েদের থেকে এর বেশী কিছু আশা করা যায় না।
আচ্ছা তোমাদের পরিবারের কোনো শিক্ষা নেই না-কি? একটা প্রাপ্ত বয়স্ক মেয়েকে এভাবে রাস্তায় ছেড়ে রেখেছে।”

থেমে গেল ঈর্ষার চরণ। কিছুক্ষণ একই ভঙ্গিতে স্থীর হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। ঘাড় বাঁকিয়ে সামান্যতম পেছনে ফিরে ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বলল.

— “আমার পরিবারের না-হয় শিক্ষা নেই, তাই আমাকে রাস্তায় ছেড়ে রেখেছে কিন্তু তোমাকে? এতোবড় একটা দামড়া ছেলেকে কিভাবে রাস্তায় ছেড়ে দিলো হ্যাঁ?”

গিল্টি ফিল হলো সাদাফের। সে তো কখনো কারো সাথে দুর্ব্যবহার করে নি। কিন্তু আজ অহেতুক কারণে ঈর্ষার পরিবারকে টেনে না আনলেই ভালো হতো। পরের কথাটা কানে যেতেই রক্তচক্ষু নিয়ে বলল..

— “হু কেয়ারস..

সাদাফের কথায় উত্তর দেওয়ার মতো কোনো ভাবাবেগ দেখা গেল না ঈর্ষার ভেতরে। বরংচ আশে পাশে কাউকে খোঁজার চেষ্টা করল। দাঁত কেলিয়ে বলল.

— “দামড়া বলতে ইগোতে বাঁধছে।
এখানে‌ আপনি আর আমি ছাড়া কাউকে দেখতে পারছি না। যদি চিনতে অসুবিধা হয়, আয়না দেবো।”

ঈর্ষার দৃষ্টি অনুসরণ করে তাকালো সাদাফ।‌ ঈর্ষা ছাড়া কাউকে গোচরে এলো না তার। রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বলল.– “ইউ!”

— “আর এক মিনিট যদি এখানে থাকো যে কাজটা অসম্পূর্ণ রেখেছি, সেটা সম্পূর্ণ করবো। দা অপশন ইজ মাই এন্ড দা চয়েজ আর ইউ!”

বাক্য সম্পূর্ণ করতে না দিয়ে মুখ খুললো ঈর্ষা। বিরূপ চোখে ঈর্ষার দিকে তাকিয়ে হনহন করে গাড়িতে উঠে স্টার্ট দিয়ে চলে গেল।

সেপ্টেম্বরের অন্তিম সময়। শীতল আবহাওয়া বিরাজ করার বদলে সূর্যের তীব্র ঝলকানিতে উত্তপ্ত হয়ে আথে। এমনকি অম্বুধারা পর্যন্ত তপ্ত হয়ে ধোঁয়া ছড়িয়ে দিচ্ছে। আবার রাতের শান্ত পরিবেশে হিম আবরন তৈরি করছে। হসপিটালের কাজের চাপে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল সাদাফ। বাড়ি ফেরার পথে নিরিবিলি পরিবেশে ক্লান্তিত্ব দূর করার চেষ্টা করছিল। তখনই অজানা অচেনা মেয়ের আবির্ভাব ঘটে। যদি ঘুনাক্ষরেও টের পেত, এখানে আসলে মন ভালো হওয়ার বদলে খারাপ হয়ে যাবে। তাহলে আড় চোখেও তাকাতো না।

.
— “ঈর্ষা! কাজটা কি ঠিক হলো?” (পেছন থেকে মাহিন)

সাদাফের গাড়ি আড়াল হতেই বন্ধুদের দিকে তাকালো ঈর্ষা। ততক্ষণে ঈর্ষার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে মাহিন, রবিন, চৈত্রী, স্পৃহা। হাত বাড়িয়ে টাকাটা রবিনের দিকে এগিয়ে দিল। রবিন টাকাটা ছুঁতেই চরণে ভর করে ঝিলের দিকে এগিয়ে গেল ঈর্ষা। বেশ কিছুক্ষণ সময় নিয়ে দুহাত ঘসে ঘসে পরিস্কার করে নিল। যেন সাদাফের অপ্রত্তাশিত ছোঁয়ার মাঝে অদৃশ্য বিষাক্ত কিছু মিশে আছে। রুমালে হাত মুছে সম্মুখে অগ্রসর হতে হতে বলল.

— “এমন কাজ করা ছাড়া আমার কোনো উপায় ছিল না। যে-করেই হোক রবিনের মা-কে বাঁচাতে হবে। আপাতত আমার কাছে এক টাকাও নেই। কারো কাছে সাহায্য চেয়ে পাচ্ছি না।
চিন্তা করিস না, নেক্সাস টাইম দেখা হলে টাকা দিয়ে দিব।”

সবার দৃষ্টি তখন রবিনের দিকে। মলিন চেহারার মাঝে কোথাও এক চিলতে হাসি ফুটে আছে। হয়তো শেষ মুহূর্তে মায়ের টাকা জোগাড় করাতে। ধরা গলায় বলল.

— “তবুও! তুই ওনাকে চিনিস না। কতোটা ডেন্জারাস তোর ধারণা নেই।”

— “জানি, আব্রাহাম আহম্মেদ সাদাফ। এর থেকে বেশী জানার প্রয়োজন নেই। অলরেডি অনেকটা লেট হয়ে গেছে। চল এবার..

ঈর্ষা স্কুটিতে উঠে হাতের ইশারা করলো সবাইকে। অতঃপর সবাই ছুটল হসপিটালের উদ্দেশ্য।

(চলবে)

(ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন,)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে