তোমার_স্পর্শে পর্বঃ ১০(শেষ পর্ব)
– আবির খান
আজ এই দরজা পাড় হলেই শুরু হবে নতুন এক জীবন। যেখানে থাকবে শুধু মায়ার স্পর্শ। আমি মহান আল্লাহ তায়ালার নাম নিয়ে ভিতরে ঢুকি। ঢুকে দরজাটা লাগিয়ে ঘুরতেই দেখি মায়া আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। তবে ঘোমটা দেওয়া। তাই ওর বঁধু সাজে মুখখানা দেখতে পাচ্ছি না। ও হঠাৎ আমাকে সালাম করতে নিলে আমি ওকে থামিয়ে দিয়ে বলি,
আমিঃ তোমার জায়গা ওখানে না আমার বুকে।
আমি ভাবলাম মায়া হয়তো আমাকে খুব সুন্দর করে বুকে জড়িয়ে ধরবে। কিন্তু একি, মায়া যা করলো আমিতো পুরোই হতভম্ব হয়ে গেলাম। মায়া মাথা উঠিয়েই আমার কলার ধরে আর বলে,
মায়াঃ এখন বাজে কয়টা?? রাগী ভাবে।
আমি অনেক ভয় পেয়ে যাই। তাই ভীতু কণ্ঠে বলি,
আমিঃ ১১.৪৮ মিনিট।
এবার মায়া আরো রেগে গিয়ে বলল,
মায়াঃ সেই কবে থেকে তোমার জন্য অপেক্ষা করে আছি আর তুমি কই ছিলা?? বলো কোন মেয়ের সাথে ছিলা এতোক্ষণ?? কি হলো বলো??
আমি বুঝলাম, বউ আমার অভিমান করেছে। আজ ভালো মজা করা যাবে ওর সাথে। হিহি। আমি মজা করে বললাম,
আমিঃ ছিলাম আমার গার্লফ্রেন্ডের সাথে। আমাকে শেষ বারের মতো অনেক আদর আর অনেক গুলা চুমু দিয়ে দিলো। মজা করে।
হায়রে কথাগুলো বলতে দেরি হইছে কিন্তু মায়ার তান্ডব শুরু করতে দেরি হয়নি। মায়া আমাকে ছেড়ে বিছানায় গিয়ে বসে সেকি কান্না আর বলছে,
মায়াঃ হায়রে… আমার স্বামী অন্য মেয়ের সাথে কি কইরা আসছে?? আমার কপাল শেষ। হায়রে…আমার জীবন শেষ…এখন আমার কি হবে??
মায়ার এই অবস্থা দেখে আমি প্রচন্ড ভয় পেয়ে যাই। আর অস্থির হয়ে বলি,
আমিঃ আরে আরে থামো সোনা। আমিতো মজা করছি তোমার সাথে। তুমি ছাড়া আমি আর কারো কথা ভাবতে পারি বলো?? প্লিজ থামো। এই যে কান ধরছি। আচ্ছা এই যে উঠ বসও করছি দেখো। আর এমন মজা করবো না। প্লিজ কান্না করো না।
বলেই আমি উঠ বস শুরু করে দেই। কয়েকটা করার পরই মায়ার সেকি হাসি। ঘোমটার কারণে আমি ওর হাসি দেখতে পারছি না।
মায়াঃ কি মনে থাকবে তো?? আর করবা কখনো এমন মজা??
আমিঃ তুমি মজা করছিলে??
মায়াঃ তা নয়তো কি। তুমি করতে পারলে আমি বুঝি করতে পারবো না।
আমিঃ তুমি আগে কি অভিনয় করতে নাকি?? আমিতো ভয়ই পেয়ে গিয়েছিলাম।
মায়াঃ স্বামীকে ঠিক রাখতে হলে বউরা সব করতে পারে। এখন হয়েছে আর উঠ বস করতে হবে না। বসতো।
আমি মায়ার কাছে গিয়ে বসলাম। আর বললাম,
আমিঃ তোমার ঘোমটা’টা তুলতে পারি??
মায়াঃ আমার সবইতো তোমার। তোমার ইচ্ছা। লজ্জাসিক্ত কণ্ঠে।
আমি বুঝলাম মায়া সম্মতি দিয়েছে। বাসর রাতে প্রতিটি পদক্ষেপ বউয়ের সম্মতি নিয়ে এগোতে হয়। তাহলে সব কিছু ভালো থাকে। আর স্বামী স্ত্রীর সম্পর্কও খুব ভালো থাকে সবসময়।
এবার আমি আস্তে করে মায়ার মুখের উপর থেকে ঘোমটা তুললাম। ঘোমটা তুলে যেন আমি ৫১২ ভোল্টেজের সক খেলাম। ঘোমটার আড়ালে যে একটা পরী বসে আছে আমি তা বুঝতেই পারিনি। আমি রীতিমতো হা করে আছি মায়াকে দেখে। এত্তো বেশি সুন্দরী লাগছিল মায়াকে যে আমি ভাষায় প্রকাশ করতে পারবো না। ওর চোখ দুটো আহ। আমি বারবার সেখানে হারিয়ে যাচ্ছিলাম। আর ওর ঠোঁট, যেন গোলাপের পাপড়ি। আর তিলটাতো আছেই। আমি মায়ার মাঝে হারিয়ে গিয়েছি। সত্যিই আমার মায়া মানে আমার বউয়ের চেয়ে দুনিয়াতে আর কেউ সুন্দরী হতেই পারে না।
মায়াঃ এভাবে হা করে কি দেখছো?? মাছি ঢুকবে তো। মজা করে।
মায়ার কথায় আমার ঘোর ভাঙে। আমি ওকে বলি,
আমিঃ মায়া, আজ তোমাকে এতোটা অপরূপা লাগছে যে আকাশের ওই সুন্দর চাঁদটাও তোমাকে দেখে লজ্জায় মেঘের আড়ালে চলে যাবে৷ আর কবিরা তোমাকে নিয়ে কবিতা লিখতে বেকুল হয়ে যাবে। সত্যিই মহান আল্লাহ তায়ালার কাছে কোটি কোটি শুকরিয়া জানাই তোমাকে আমার স্ত্রী হিসেবে দিয়েছেন বলে৷
মায়াঃ আমিও শুকরিয়া জানাই। চলো দুই রাকাআত নামাজ আদায় করে আল্লাহ তায়ালার কাছে শুকরিয়া আদায় করি।
আমিঃ অবশ্যই। চলো।
এরপর আমরা দুজনে ফ্রেশ হয়ে জামা চেঞ্জ করে ওযু করে দু রাকাআত নামাজ পড়ে মহান আল্লাহ তায়ালার কাছে শুকরিয়া আদায় করি।
আমিঃ মায়া, চলো বারান্দায় গিয়ে বসি।
মায়াঃ আমি কিন্তু তোমার কোলে বসবো।
আমিঃ আচ্ছা।
আমি আর মায়া বারান্দায় গিয়ে বসলাম। মায়া আমার কোলে বসে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমার কেন জানি লজ্জা লাগছে ওর চাহনি দেখে।
আমিঃ কি দেখছো এভাবে??
মায়াঃ তোমাকে। তুমিতো সবসময় আমার রূপের বর্ননা করো, আজ আমি তোমার রূপের বর্ননা করতে চাই।
আমিঃ ও বাবা তাই নাকি। আচ্ছা করো আমিও শুনি আমি দেখতে কেমন।
মায়াঃ তুমি দেখতে একদম আমার স্বপ্নের রাজকুমারের মতো। ফর্সা মুখ, বড় ঘন কালো চুল, শান্ত চোখ, চাপ দাড়ি আর খাড়া নাক। একদম নায়কের মতো। তবে শুধুই আমার। জানো তুমি কতটা ভালো??
আমিঃ কতটা??
মায়াঃ অনেক অনেক অনেককক বেশি। কারণ অনেক ছেলেই বাসর রাতের অপেক্ষায় থাকে তার স্ত্রীর সতিত্ব হরনের জন্য। কিন্তু তুমিই হয়তো প্রথম পুরুষ যে তার স্ত্রীকে এসব কষ্ট না দিয়ে তাকে খুশী করছে, তাকে সময় দিচ্ছে নিজেকে রেডি করার। সত্যিই তুমি অনেক ভালো।
আমিঃ স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক একদিন দুদিনের জন্য না। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত। তাই আজ আমাদের প্রথম রাতে তোমাকে কষ্ট দিয়ে আমি নিজের চাহিদা পূরণ করতে চাইনা। ঠিক যখন তোমার সম্পূর্ণ সম্মতি থাকবে তখনই তোমাকে আমার একদম আপন করে নিবো। তোমার মতের বাইরে আমি কখনোই তোমার সাথে জোরজবরদস্তি করবো না। কারণ তাহলে তোমার কাছে আমার সম্মানটা কমে যাবে। আর সম্মান একবার কমে গেলে ভালোবাসাটাও ধীরে ধীরে কমে যায়। তাই এখন ভালোবাসছি তোমাকে।
মায়া আস্তে করে আমার কানের কাছে এসে বলল,
মায়াঃ আমার একটা ছেলে চাই ঠিক তোমার মতো দিবে কি?? লজ্জাসিক্ত কণ্ঠে।
বলেই ও লজ্জায় একদম গোলাপি হয়ে গিয়েছে।
আমি ওর কথা শুনে নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিনা। মানে ও সম্মতি দিচ্ছে। আমি ওকে বললাম,
আমিঃ আমারতো ঠিক তোমার মতো মায়াবতী একটা মেয়ে চাই। যার মুখে মায়া থাকবে তোমার থেকেও অনেক বেশি। বলো, দিবে কি??
মায়া লজ্জাসিক্ত কণ্ঠে বলে,
মায়াঃ তুমি নিয়ে নেও।
বলেই লজ্জায় আমার কাঁধে মাথা লুকায়। আমি আস্তে করে ওকে কোলে তুলে নিয়ে ভিতরে আসি। আর এরপর কি হয়েছে তা না শুনলেও হবে। তবে এতোটুকু বলতে পারি আজ রাতে দুটি মন আর দেহ এক হয়ে গিয়েছে তাদের পবিত্র বন্ধনে।
পরদিন সকালে,
গতরাতটা ছিল আমার জন্য একটা মধুর রাত। জীবনে কোনো দিন ভুলতে পারবো না এই রাতের কথা। কারণ মায়াকে এই রাতে খুব কাছ থেকে দেখেছি। মায়ার কথা ভাবতেই ওকে হাত দিয়ে খুঁজছি। কিন্তু হাতড়ে পাচ্ছি না। চোখ খুলে তাকিয়ে দেখি আমি একা বিছানায় শুয়ে আছি। তাহলে মায়া কই?? একলাফে উঠে বসি। আশেপাশে তাকিয়ে দেখি কোথাও মায়া নেই। হঠাৎই সেদিনের মতো মায়া চা হাতে আমার রুমে আসে।
মায়াঃ কি ঘুম ভাঙলো?? নেও উঠে ফ্রেশ হয়ে চা’টা খাও।
আমিঃ তুমি এতো তাড়াতাড়ি উঠলে কিভাবে?? অবাক হয়ে।
মায়াঃ আমি এখন এ বাড়ির বউ। এতো বেলা করে ঘুমালে আমাকে শ্বাশুড়ি মা ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিবে। বুঝলে?? মজা করে।
আমিঃ এহহ আসছে। আমার মা কখনই এমন করবে মা। তুমিতো জানোই না, বাবা আমাদের হানিমুনে যাওয়ার ব্যবস্থাও অলরেডি করে ফেলেছে। এখন এদিকে আসোতো। মায়ার হাত থেকে চা’টা নিয়ে পাশে রেখে ওকে একটানে বিছানায় আমার কাছে নিয়ে আসি। তারপর ওকে অনেক আদর করি। আর ও লজ্জায় লাল হয়ে যায়।
এভাবেই আদর, সোহাগ আর ভালোবাসায় আমাদের দেড় বছর কেটে যায়। আজ আমি হাসপাতালে বসে আছি। খুব চিন্তা আর কষ্ট হচ্ছে মায়ার জন্য। আজ আমি আর মায়া বাদে আরেক জন আমাদের পরিবারের সদস্য হয়ে আসছে এ দুনিয়াতে। সে আর কেউ নয় আমাদের প্রথম সন্তান। মায়ার প্রচন্ড ব্যাথা হচ্ছে। আমি, রাফি মায়ার মা আর আমার বাবা-মা বাইরে বসে আছি। হঠাৎ মনটা কেমন জানি করছে। সব কেমন জানি অন্ধকার হয়ে আসছে। মায়ার ব্যাথায় চিৎকার আমাকে প্রতিনিয়ত দূর্বল করে দিচ্ছে। মায়ার কষ্টে আমার চোখ থেকে অঝোরে অশ্রু ঝরছে। হঠাৎই ওটি থেকে ডাক্তার বেরিয়ে এসে আমাকে যা বলল আমার দুনিয়া যেন ঘোর অন্ধকার হয়ে গেলো। ডাক্তার আমাকে এসে বলে,
ডাক্তারঃ দেখুন মায়ের অবস্থা খুব খারাপ। পুরো শরীরে পানি এসে পরেছে। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। জানি না আমরা কাকে বাঁচাতে পারবো। এখন সব আল্লাহর হাতে। সবাই দোয়া করুন।
আমি ঠাস করে মাটিতে পরে যাই। আমার বাবা-মা আর মায়ার মা কান্নায় ভেঙে পরে। রাফি আমাকে সামলানোর অনেক চেষ্টা করছে। কিন্তু পারছে না। আমি হাউমাউ করে কান্না করছি। আমার মায়া নাকি আর পারছে না। আমার মায়া। আমার সন্তান। আল্লাহ। মায়া….
শেষ। ৩/৪ ঘন্টা যুদ্ধ করেও ডাক্তাররা মায়াকে আর বাঁচাতে পারেনি। শেষমেশ দমটা ছেড়েই দিলো আমার মায়া। আমি সেদিন কতটা কেঁদেছি আমি নিজেও বলতে পারবো না। আমি হয়তো সেদিন ওর স্পর্শ ছাড়া মরেই যেতাম। কিন্তু ও চলে গেলেও আমাকে দিয়ে যায় ওর স্পর্শ। ঠিক যেমনটা আমি চেয়ে ছিলাম ওর কাছে। তেমনটাই ওর চেয়েও অনেক বেশি মায়াবী হয়েছে আমার মেয়েটা। তাকে যখন ডাক্তার আমার কোলে দিলো সেও তার ডান হাত আমার দাড়িতে রাখলো। ঠিক যেমনটা মায়া রেখেছিল। সেই প্রথম স্পর্শ। আমার মেয়ের এই স্পর্শে আমি মায়ার স্পর্শ খুঁজে পেয়েছি। মায়াতো চলে গেলো কিন্তু যাওয়ার আগে আমাকে বাঁচার জন্য ওর মতোই ওর স্পর্শ দিয়ে গেল। আমি আজও আমার মেয়েকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে বলি,
– দেখ, আমি বেঁচে আছি মায়া, #তোমার_স্পর্শে।
— ” ঠিক এভাবেই মায়ার মতো হাজারো মা প্রতিদিন আমাকে আপনাকে জন্ম দিতে গিয়ে দম ছেড়ে দেয় কষ্টে আর ব্যাথায়। তারা এই জেনেও আমাদের জন্ম দেয়, যে তার মৃত্যুও হতে পারে। কিন্তু তারপরও জীবনে একবার মাতৃত্বের স্বাদ গ্রহণ করার জন্য এই মা আমাদের জন্ম দেন। এই মাই আমাদের ছোট থেকে বড় করে তুলেন। তার দুগ্ধ ছাড়া আমাদের পেট ভরে না। তার স্পর্শ ছাড়া আমাদের ঘুম আসে না। তার মুখ না দেখলে আমাদের কিছুই ভালো লাগে না। এটাই মা। সেই মাকেই আমরা অনেকে কষ্ট দি। খারাপ আচরণ করি, অপমান করি আর সবচেয়ে কষ্টের বিষয় হলো এই মা যখন বৃদ্ধ হয়ে যায় তখন আমরা তাকে রাস্তায় ছুড়ে ফেলে দি!! যে মা আমাদের জন্ম দিতে গিয়ে মারা যেতে পারে তা জেনেও শুধুমাত্র আমাদের এই সুন্দর পৃথিবীটাকে একবার দেখানের জন্য আমাদের জন্ম দেয়। সেই মাকেই আমরা কষ্ট দি কিভাবে?? মা যদি পাগলও হয় তারপরও তার সন্তানকে সে নিজের সাথে বেঁধে রাখে এই ভয়ে, যাতে সে হারিয়ে না যায়। এটাই মা। আর সেই মা যখন আমাদের বড় করতে করতে পাগল হয়ে যায় তখন আমরা তাকে রাস্তায় ফেলে দি!! কোথায় হারিয়ে গিয়েছে আমাদের মানবতা আর মনুষ্যত্ব?? কোথায়?? তাই সবশেষে আমি বলতে চাই, শুধু মাকেই না বাবাকেও কোনো প্রকার কষ্ট দেওয়া যাবে না। আমাদের যৌবনকালে বাবা-মা যেমন আমাদের শেষ সম্বল ঠিক তেমনি তাদের বৃদ্ধকালে আমরাই তাদের শেষ সম্বল। তারাই আমাদের সব।
আজকের এই পর্বটি পৃথিবীর সকল মাকে উৎসর্গ করে আমি আবির শেষ করছি। ধন্যবাদ সবাইকে। ”
পুরো গল্পটি কেমন লেগেছে তা জানিয়ে একটি গঠনমূলক মন্তব্য আশা করছি আমার প্রিয় পাঠকদের কাছে। আর এতোটা সময় জুড়ে যারা সাথে ছিলেন তাদেরকে জানাই অসংখ্য ধন্যবাদ।
– সমাপ্ত।
© আবির খান।
মায়ার জন্য আমারও চোখের নোনা জল পরেছে। ?