#তোমার_জন্য_সিন্ধুর_নীল
#পর্ব_৬
#সারিকা_হোসাইন
●●
ঘড়িতে সময় রাত দশ টা বেজে পঁচিশ মিনিট।বাইরে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে সেই সাথে জোরে শো শো শব্দে বাতাস প্রবাহিত হচ্ছে,আকাশ কালো মেঘে ঢেকে গেছে।একটু আগে যেই চাঁদটা আলো ছড়াচ্ছিলো সেই চাঁদকে এখন এই মেঘ গুলো গ্রাস করে ফেলেছে পুরোদমে।যে কোনো মুহূর্তে ঝড় আসবে এমন অবস্থা।
আজ দ্বিতীয় বারের মতো স্বর্গ নাফিজ মাহমুদের স্টাডি রুমে উপস্থিত হয়েছে সাথে রয়েছে তনুজা মাহমুদ।
■■দুপুরে
পিউ এর কথা শুনে মুহিতের মায়ের কেবিন তল্লাশি চালাতে গিয়ে কাঙ্খিত রুমের সামনে দাঁড়িয়ে আছে স্বর্গ।
দরজা ঠেলে যেই ভিতরে ঢুকবে অমনি পরিচিত কন্ঠস্বর শুনে পায়ের তলার মাটি সরে যায় স্বর্গের।
―আপা চোখ খুলো, আর কতোদিন এভাবে মরার মতো পরে থাকবে আপা?আমরা কেউ ভালো নেই আপা, মুহিত উপরে শক্ত থাকলেও ভিতরে চুরমার হয়ে গেছে,সে তোমাকে আকড়ে ধরে কোনো মতে বেঁচে থাকতে চাইছে তুমি ই যদি এমন করো মুহিত কি করে বাঁচবে আপা?
নামিরা আর সোহাগ ভালো আছে আপা, আমি কিচ্ছু হতে দেইনি ওদের।
―জানো আপা তুমি নানী হবে,নামিরার ঘরে ছোট্র মুকিত আসবে ,
চোখ খুলো না আপা!ও আপা।
বলে কান্নায় ভেঙে পড়লেন নাফিজ মাহমুদ।
বাবার মুখে মুহিতের মাকে আপা সম্বোধনে অবাকের চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে গেলো স্বর্গ।
সে জানতো তার একজন বড় ফুপি আছে,সেই ফুপি যে মুহিতের মা সেটা সে কল্পনাও করতে পারেনি।
ফ্যামিলি এলবামে নাফিজ মাহমুদ এর সাথে একজন কিশোরীকে দেখে যেদিন স্বর্গ প্রথম জিজ্ঞেস করেছিলো
― উনি কে বাপী?
―উনি তুমার ফুপি কিন্তু সে হারিয়ে গেছে
সাত বছরের অবুঝ স্বর্গ তখন কি এতোকিছু বুঝতো নাকি?
এতো বছর পর সেই ফুপির সন্ধান এভাবে পাবে ভাবতেও পারেনি স্বর্গ।
দরজা ঠেলে রুমের ভেতরে প্রবেশ করলো স্বর্গ,
সন্তপর্নে নাফিজ মাহমুদ এর পিঠে হাত রেখে ডেকে উঠলো ―
―বাপী!
পিছন ফিরে স্বর্গকে রুমে দেখে হতবাক হয়ে যান নাফিজ মাহমুদ
★বর্তমান
স্বর্গ বাসায় এসে তনুজাকে সব জানালে তনুজা কান্নায় ভেঙে পড়েন।এতদিনের সংসার জীবনে তার মনে হচ্ছে নাফিজ মাহমুদ জীবনে প্রথম আজ তার মন ভেঙেছে।তার বোন এমন অবস্থায় পরে রয়েছে একথা তনুজা জানলে কি এমন ক্ষতি হতো,মুহিত তো বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কাজে এবাড়িতে অনেক বার এসেছে তখন কোনো বলেনি সে যে,মুহিত তার আপন ভাগ্নে?
আর মুহিত?
মুহিত ও তো বলতে পারতো যে নাফিজ তার মামা!মুহিত কেনো সব চেপে গিয়েছে?
―শুধু বাসায় ই নয় বাইরেও কেনো মুহিত স্যার সম্বোধন করে অপরিচিতের ন্যায় থাকে?
প্রশ্নবিদ্ধ নয়নে নাফিজ মাহমুদ এর দিকে তাকিয়ে আছে স্বর্গ এবং মিসেস তনুজা।
দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে মাথা নিচু করে বসে আছেন নাফিজ মাহমুদ।হঠাৎই মুখ তুলে স্বর্গ আর তনুজার পানে চাইলেন নাফিজ মাহমুদ।পাশে থাকা কর্নার টেবিল থেকে পানির গ্লাস তুলে নিয়ে এক দমে ঢকঢক করে গিলে ফেললেন সবটুকু।এর পর বলতে শুরু করলেন―
~আপা আর আমি গুনে গুনে পাঁচ বছরের ছোট বড় ছিলাম,আপা ছিলো আমাদের বংশের প্রথম কন্যা সন্তান।আপাকে আব্বা অনেক স্নেহ করতেন।আপাই যেনো আব্বার জীবনের সকল আশা ভরসা ছিলো।আমাদের গ্রামে সুন্দরী বলতে আপাই ছিলেন সবার শীর্ষে।
আপাকে নিয়ে আব্বার অনেক স্বপ্ন ছিলো, যেখানে পরিবারে ছেলেরা বেশি আদর পায় সেখানে আপাকে সবাই বেশি আদর করতো।আপা ছিলো হলুদ ফর্সা এজন্য অবশ্য এলাকার মহিলারা আপাকে হলুদ পাখি বলে ডাকতো।
আপা লেখা পড়াতেও ছিলো অত্যন্ত মেধাবী, আব্বার স্বপ্ন আপা জীবনে অনেক বড় কিছু হবে।আব্বা আপাকে ঢাকায় পাঠালেন পড়াশোনার জন্য।আমিও ঢাকায় থাকতাম।আপা যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেলো আব্বা সারা গ্রামে সাত টা গরু জবাই দিয়ে লোক খাওয়ালেন।
আমি ইন্টার পাশ করে কমিশন্ড অফিসার হিসেবে আবেদন করেছি কেবল।হঠাৎ চিঠি মারফত আব্বা আমাকে গ্রামে যেতে বললেন,আপাকেও বললেন।
আমি আর আপা রাতের ট্রেন ধরে গ্রামে ফিরলাম।গিয়ে দেখি আব্বা তার বন্ধুর ছেলের সাথে আপার বিয়ের কথা বলছেন।ছেলে বিয়ের পর আপাকে বিদেশ নিয়ে চলে যাবে ওখানেই তার ব্যাবসা।ছেলে দেখতেও মাশাআল্লাহ।সবাই খুশি।
কিন্তু আমি আপার দিকে তাকিয়ে দেখি আপার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেছে।
আমি রাতে সবাই ঘুমানোর পর আপার রুমে গেলাম
―আপা শুয়ে পড়েছিস?
আপার সাড়াশব্দ না পেয়ে রুমে ঢুকে দেখি বালিশে মুখ গুজে আপা কাঁদছে।কারন জানতে চাইলে আপা যা বলে তা শুনে আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে।
―কি বলছিস তুই এসব আপা?
―হ্যা নাফিজ আমি পালিয়ে বিয়ে করে ফেলেছি,বাবা জানলে অনেক কষ্ট পাবেরে বলেই কান্নায় ভেঙে পড়লেন আপা।
আপা তার তিন বছরের সিনিয়র এক ছেলেকে বিয়ে করেছেন।
আপার কান্নায় আমার কষ্ট হচ্ছিলো, কিন্তু আব্বার মান সম্মান খোয়ানোর ভয়ে আমি সেই কষ্টও প্রকাশ করতে পারছিলাম না।
যেই ছেলেকে আপা বিয়ে করেছেন ছেলে প্রচুর মেধাবী ছিলো কিন্তু তখন সে ছিলো বেকার।আপাই তাকে চাপ দিয়েছিলো পালিয়ে বিয়ে করার।চাকরি পেলে তিনি যেনো আব্বার কাছে আপাকে চায়।
কিন্তু আব্বা এতো দ্রুত আপাকে তার পছন্দের ছেলের সাথে বিয়ে দিতে চাইবে এটা আপা স্বপ্নেও ভাবেনি।
আপা ভেবেছিলো আপার কোনো আবদার আব্বা আজ পর্যন্ত ফেলেনি,আপা যাকে ভালোবাসে তার কথা যেকোনো ভাবে আব্বাকে বলে আপা রাজি করাতে পারবে।
কিন্তু আপার সমস্ত ধারণাকে ভুল প্রমাণিত করে আব্বা রুমে প্রবেশ করে আপার উদ্দেশ্যে বলে উঠলেন
―তোমার ব্যাগপত্র গুছিয়ে এবাড়ি থেকে বেরিয়ে যাও তারিন।
আব্বার আকস্মিক আগমনে আমি আপা দুজনেই চমকে উঠে দিশাহীন হয়ে যাই।
আপা আব্বার পায়ে ধরে অনেক ক্ষমা চেয়ে কাকুতি মিনতি করে কাঁদলেন
কিন্তু আব্বার কঠিন ইস্পাতের মতো মন গললোনা।
আব্বা মাধুর্যহীন কণ্ঠে আরো বলেন,
―আমি আজ থেকে জানবো আমার মেয়ে মৃত,
কোনোদিন এবাড়ির ত্রি সীমানায় ঘেঁষতে পারবে না তুমি।আমার সকল স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি থেকেও তুমি বঞ্চিত।
আব্বাকে এমন কঠিন অবস্থায় আমরা সেই দিন ই প্রথম দেখেছিলাম।আম্মা গত হয়েছিলেন আপা যখন ক্লাস নাইনে পড়ে তখন।ক্যানসার নামক ব্যাধি আম্মার সবকিছু গ্রাস করে ফেলেছিলো।আপার পাশে দাঁড়ানোর মতো কেউ ছিলো না সেদিন।
আপাকে বের হয়ে যেতে বলে আব্বা ঘরে খিল দিলেন।
আমি ভোর রাত্রের দিকে আপাকে নিয়ে ঢাকায় রওনা দিলাম,আপাকে হলে পৌঁছে দিয়ে আবার বাড়ি ফিরলাম।আব্বার হাতে পায়ে ধরে হলেও যেনো আব্বাকে নরম করতে পারি।
―তুমি যদি তোমার বোনের হয়ে এখানে দালালি করতে এসে থাকো তাহলে তুমাকে ও সবকিছু থেকে বঞ্চিত করা হবে।
আব্বার হুমকিতে আমি ভয় পেয়ে গেলাম,চাকরি নেই,বয়স ও কম মাত্র আঠারো,আব্বা সবকিছু থেকে সত্যি ই মুখ ফিরিয়ে নিলে কোথায় যাবো?
আর্মিতে চান্স পেলাম ,সবকিছু ভালোই চলছিলো।আপার সাথে আমার যোগাযোগ অব্যাহত ছিলো।কিন্তু গ্রামে গেলে কথা বলতে পারতাম না।
আমি যখন সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট তখন আপা একদিন ক্যান্টনমেন্ট এ এলেন কিছু ফল আর মিষ্টি নিয়ে।সেদিন আমি আপাকে অনেক খুশি দেখে ছিলাম
―তুই মামা হতে চলেছিস আর তোর দুলাভাই এখন একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট।কথাটা বলতেই আপা কেঁদে দিলেন,খুব কাঁদলেন।আমিও কাঁদতে দিলাম,কাঁদলে মন হালকা হয়।
আপাকে আশ্বস্ত করলাম যেই ভাবেই হোক আব্বাকে রাজি করাবো যাতে আপাকে মেনে নেয়।
শীতের শেষে দুই মাসের ছুটি নিয়ে গ্রামে গেলাম,গিয়ে ব্যাগ পত্র রেখেই আব্বার পায়ে পরে গেলাম
―আপনি নানা হবেন আব্বা,আপাকে ওই নিষ্পাপ বাচ্চার উছিলায় মাফ করে দেন।
সেদিনও আব্বা আমাকে ভুল প্রমাণ করে উঠে গেলেন।
খুজ নিয়ে জেনেছিলাম আব্বার বন্ধু আপাকে কেন্দ্র করে আব্বাকে অনেক অপমান আর নোংরা কথা শুনিয়ে ছিলেন।আমার নরম আব্বা এক নিমিষেই পাথরে পরিণত হলো।
আপার কোল আলো করে নামিরা এলো,নামিরা দেখতে ঠিক হুবুহু আপার কার্বন কপি।
আমি মনে আবার আশার আলো জ্বালালাম।এবার হয়তো আব্বা মানবে।
আপা, দুলাভাই আর দেড় মাসের ছোট নামিরাকে নিয়ে রওনা হলাম মিহিপুর গ্রামে।এবার আমি একশ ভাগ নিশ্চিত আব্বা নামিরাকে দেখে ফিরাতে পারবেন না।
হাসি মুখে গাড়ি থেকে নেমে ভ্যানে করে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হলাম,বাড়ির কাছে আসতেই দেখি মানুষের জটলা।মনটা কু ডাক ডেকে উঠলো।অজানা ভয়ে কলিজায় মোচড় দিলো।
ছোট নামিরা হঠাৎই কেঁদে উঠলো।কোনো ভাবেই আপা সেই কান্না থামাতে পারছে না।
জটলা ভেদ করে গিয়ে দেখি আব্বা ইহজগতের মায়া ত্যাগ করেছে।মোবাইলের বহু ব্যাবহার না থাকায় কেউ আমাদের সাথে যোগাযোগ করতে পারেনি আব্বা গত হবার খবর ও দিতে পারেনি।বাড়িতে আব্বার দেখাশোনা কারী আলীম জানায় সকালে আব্বাকে নামাজের জন্য ডাকতে আসলে আব্বার সাড়া শব্দ না পেয়ে বাড়ির আরো মানুষের সহযোগীতায় আলীম দরজা ভেঙে আব্বাকে মৃত অবস্থায় উদ্ধার করে।
সেদিন আপার কান্না দেখে কে? গ্রামের মানুষ আপাকে যা নয় তাই বলে অপমান করলেন।এমনকি আব্বার মৃত্যুর দায় ও আপার উপর চাপিয়ে দিলেন।সেদিন আপা আর নিজেকে ক্ষমা করতে পারলেন না। আব্বার দাফন কাজ শেষ হতেই সেই যে আপা ঢাকা ফিরলেন আর কোনো দিন কোনো আত্মীয়ের সাথে যোগাযোগ কিংবা গ্রামে পর্যন্ত বেড়াতে এলেন না।
তনুজাকে যখন বিয়ে করি খুব আশা নিয়ে আপাকে আনতে গেলাম।আপা খুশি হলেন আমার বিয়ের কথা শুনে,কিন্তু কোনো ভাবেই এলেন না।আপা ততোদিনে নিজেকে অপয়া,খুনি হিসেবে বরণ করে নিয়েছিলেন।
আপার কিছু গহনা আমাকে দিয়ে বললেন এগুলো তোর বউয়ের জন্য আমার পক্ষ থেকে উপহার।মুহিত তখন আপার পেটে।
সেদিন মন খারাপ করে চলে এলাম,মুহিত,মুকিত দুনিয়ায় এলো আর আপা নিজেকে আস্তে আস্তে আড়ালে নিয়ে গেলো, আপা আর আমার সাথে বেশি যোগাযোগ করতেন না।মাঝে মাঝে সুখ স্বর্গের খবর নিতেন।কিন্তু দুলাভাইয়ের সাথে আমার সকল যোগাযোগ অব্যাহত ছিলো।লোকটি খুবই সৎ আর ভালো মানুষ
ছিলেন।
একদিন আপা খুব খুশি আর উচ্ছসিত হয়ে ফোন করলেন যে,মুহিত মিলিটারি একাডেমিতে চান্স পেয়েছে,সেদিন আপার খুশি দেখে কে?
তখন টুকটাক কথা বলা শুরু করলো আবার,ছেলে মেয়েদের সাফল্যে হয়তো আপা পূর্বের কষ্ট গুলো একটু ভুলতে বসেছিলেন।
কিন্তু তনুজার সাথে কথা বলতে বললেই আপা এটা সেটা বলে ফোন রেখে দিতেন।আর বলতেন উনার কথা কাউকে না বলতে।উনার ইচ্ছে ছিলো সব কিছু ঠিকঠাক থাকলে একদিন হুট করে আমার বাসায় এসে সবাইকে চমকে দিবেন।
আপা একদিন হুট করে ফোন করে বললেন তোর দুলাভাই কেমন মন মরা হয়ে থাকে তোর সাথে যেহেতু অনেক ফ্রি ,জিজ্ঞেস করে দেখিস তো কি হয়েছে উনার?
সময় করে আপার বাড়িতে গেলাম,দুলাভাইকে চেপে ধরতেই দুলাভাই হুহু করে কেঁদে দিলেন।আমি হতবাক হয়ে গেলাম
দুলাভাই একজন শক্ত মনের মানুষ উনি এভাবে কেন কাঁদবে?
―নাফিজ আমার লাইফ হেল হয়ে যাচ্ছে ওই আহমেদ খান আর আসলাম চৌধুরীর জন্য।
সবিস্তারে ঘটনা জানতে চাইলে দুলাভাই যা বললেন তাতে গায়ের লোমকূপ পর্যন্ত দাঁড়িয়ে গেলো।
―কোনো এক অজ্ঞাত ব্যাক্তির কল পেয়ে আমি আশরাফ চৌধুরীর পণ্যবাহী কার্গো রাস্তায় আটকাই, সাথে আরো পুলিশ অফিসার ছিলো।
গাড়ির ড্রাইভার পুলিশের সামনেই আমাকে বন্দুক তাক করেছে,পুলিশ সাময়িক ভাবে তাদের আটক করে , আমি গাড়ির তালা খুলি।খুলে শুধু বাইশ তেইশ বছরের কিশোরীকে অজ্ঞান অবস্থায় পাই।এই নিয়ে কিছু বলতে যাবো―
হঠাৎই ডিউটি অফিসার এর ফোনে কল আসে,তার সাথে কি কথা হয়েছে আমি জানিনা।জি স্যার বলে সে কল কেটে ড্রাইভার গুলো কে ছেড়ে দেয় এমনকি মেয়ে গুলোকে পর্যন্ত উদ্ধার করে না।
আমি অনেক চেষ্টা করেছি,আদালতে কেস ফাইল ও করেছি,সামনের মাসে কোর্টে যেতে হবে সাক্ষী দিতে।যেই পুলিশ অফিসার ওখানে উপস্থিত ছিলো তাকে এক রাতের ব্যাবধানে অন্য থানায় ট্রান্সফার করা হয়েছে।সে সাক্ষী দিতেও অনাগ্রহী।
আমাকে কেউ একজন দিনে রাতে ফোনে কেস না তুললে খু*ন করে দেবে সেই হুমকি দিয়েই যাচ্ছে।এই অবস্থায় কি করতে পারি?
―আপনি চাইলে আমি হেল্প করবো,আমার টিম মেম্বার নিয়ে তদন্ত করে অপরাধী কে শাস্তি দেব।আপনি ভয় পাবেন না দুলাভাই।
দুলাভাই কে আশ্বস্ত করে সেদিন আপাকে কিছু না বলেই বেরিয়ে এলাম।
এক সপ্তাহ পর দুলাভাই জানালেন নামিরার বিয়ে,আংটি বদল হবে আমাকে যেতে।কিন্তু ওইদিন আর্মি হেড কোয়ার্টার এ মিটিং থাকায় আমি যেতে পারিনি।
দুলাভাই দুদিন পর আবার আমাকে যেতে বললেন,গিয়ে দেখি মুহিত বাড়িতে।মুহিত ,নামিরা,মুকিত শুরু থেকেই জানতো আমি তাদের মামা।কিন্তু তোমাদের চিনতো না।কারন ওদের সাথে তোমাদের কখনো দেখাই হয়নি।শুধু জানতো ওদের ছোট মামাতো ভাই বোন আছে।অনেক দিন পর আমার দেখা পেয়ে তিন ভাই বোন আমার উপর আনন্দে হামলে পড়লো,কিন্তু দুলাভাই কেন ডেকেছে সেই চিন্তায় ওদের ভালোবাসা বিনিময় না করেই দুলাভাই এর রুমে গেলাম।
দুলাভাই আমার হাত ধরে অনুরোধ করে বললেন
– শুনেছি তনুজার ভাইয়েরা অস্ট্রেলিয়া তে থাকে,আমার মেয়ে আর মেয়ের জামাই এর একটা ব্যাবস্থা করে দাও নাফিজ।ওরা আমার মেয়ে ,মেয়ের জামাইকেও পেলে মেরে ফেলবে।ওরা বলেছে কাউকে বাঁচতে দেবেনা।
ভাবলাম দুলাভাই অযথাই হয়তো ভয় পাচ্ছে।মানুষ মানুষকে মে*রে ফেলবে এতো সহজ কথা নাকি?
দুলাভাই এর মিনতিতে তনুজার বড় ভাই সাঈম এর সহযোগিতায় সোহাগের সকল কাগজ পত্র সিডনি সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি তে পাঠালাম,সাঈম ও ওই ভার্সিটির ম্যাথম্যাটিক্স লেকচারার।
সাইমের কঠিন চেষ্টায় সপ্তাহের ব্যাবধানেই সোহাগের জব হলো ওই ভার্সিটিতে।
যেই বিয়ে ধুমধামের সহিত হবার কথা ছিলো ,দুলাভাই তা দ্রুত ঘরোয়া ভাবে শেষ করলেন।
কাউকে নিমন্ত্রণ করলেন না।আমারও আর পরিবার নিয়ে যাওয়া হলো না।
এর মধ্যে দুলাভাই এর ফোনে হুমকি জনক কলে ভরে গিয়েছে।
মুহিত কে দুলাভাই কিছুই জানালেন না, আমাকেও কঠিন নিষেধ দিলেন।আপা তো আব্বার জন্য আগেই নিজেকে অপয়া,অলক্ষী অপবাদ দিয়ে বসে আছেন,
আপা যাতে আর কোনো চিন্তা মাথায় না নেন সেজন্য দুলাভাই আপার কাছেও সব চেপে গেলেন।
চৌকষ মুহিত কিছুটা হয়তো আঁচ করতে পেরেছিলো।
এজন্য দুলাভাই মুহিতকেও দ্রুত ক্যান্টনমেন্ট এ পাঠিয়ে দেন।
সোহাগের ভিসা হলো,টিকিট এলো,দুলাভাই আমার সহায়তায় আর্মি জিপ দিয়ে ওদের এয়ারপোর্ট পাঠালেন।নিজেও গেলেন না আপাকেও যেতে দিলেন না।মুকিত অনেক কাঁদলো ,হাত পা ছুড়ে ছুড়ে কাঁদলো নামিরার সাথে এয়ারপোর্ট যাবে বলে।তবুও সেদিন দুলাভাই আদরের মুকিতের আবদার রাখতে পারেন নি।
অসহায় নামিরা জানতেও পারেনি সেদিন কেনো এতো দ্রুত তাদের দেশ ছাড়া করা হচ্ছে।
মুকিত কে তোমরা দেখোনি, এতো খানি সুন্দর একটা বাচ্চা ,আপার ওখানে গেলেই মামা,মামা করে পাগল করে ফেলতো বলেই নাফিজ মাহমুদ কান্নায় ভেঙে পড়লেন।
তনুজা নাফিজ মাহমুদ এর পাশে বসে তাকে শান্ত করার চেষ্টা করলেন।
স্বর্গের পুরো পৃথিবী যেনো দুলে উঠলো।তার মনে হচ্ছে তার পায়ের তলায় মাটি নেই,সে শূন্যে ভাসছে।
কান্না মুছে নাফিজ মাহমুদ আবার বলতে শুরু করলেন
যেদিন কোর্টে দুলাভাই এর স্বাক্ষী হবে তার আগের দিন দুলাভাই আমাকে ফোন করলেন।তিনি আপাকে নিয়ে আমার বাসায় আসছেন।আপা আর মুকিত আমার বাসায় থাকবে।কখন রওনা হবেন সেটাও আমাকে জানালেন।
আমি দ্রুত ডিউটি শেষ করে রাত আটটা নাগাদ দুলাভাই কে ফোন করলাম,দুলাভাই ফোন তুললেন না।আপাকে কল দিলাম আপাও তুললো না।ভয়ে বুকে কাঁপন ধরলো আমার।
ইউনিফর্ম না পাল্টেই দুজন সোলজার নিয়ে আপার বাসার উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে পড়লাম।
যেতে যেতে আপার বাসা পর্যন্ত গেলাম,যেই বাসার বাইরে পর্যন্ত বাতি জ্বালানো থাকে প্রতিদিন, সেই বাসাটা আজকে ভুতের বাড়ি লাগছে,এদিকে মুহিত বারবার আমাকে কল করে যাচ্ছে আমি তুলতে পারছি না।
সোলজার দুটোকে নিয়ে টর্চ জ্বালিয়ে আপার বাসার গেট পার হলাম,আঙিনায় এসে দেখি মেইন দরজা খোলা,ভয়ে আমি দৌড়ে রুমে ঢুকতে নিলে পিচ্ছিল কিছুর সাথে স্লিপ খেয়ে পরে যাই।
কেউ ইচ্ছে করেই বৈদ্যুতিক লাইন কেটে দিয়েছিলো যার জন্য হাজার বার সুইচ টিপেও বাতি জ্বালানো যাচ্ছিলো না।
টর্চের আলো ফেলে আমি দেখি দুলাভাই কে কে যেনো মনের ঝাল মিটিয়ে কু*পি*য়ে*ছে।সারা ফ্লোর লাল র*ক্তে ভেসে গিয়েছে।
আর মুকিত !
মুকিতের মুখে সাদা স্কচটেপ মারা ছিলো, ওকে শ্বাসরুদ্ধ করে হ*ত্যা করা হয়েছে।ধবধবে সাদা ফর্সা মুকিত কুচকুচে কালো হয়ে সোফার চিপায় বিলীন হয়ে পরে আছে।
আমি এসব দেখে দিশেহারা হয়ে যখন আপাকে খুঁজি,আপা কোথাও ছিলেন না।আমার মাথা কাজ করা বন্ধ করে দেয়।
আমি পুলিশে কল করি,দেড় ঘন্টা পার হলেও পুলিশ আসে না।ততক্ষনে মুহিত আর্মি জিপ নিয়ে কুমিল্লা থেকে ঢাকা আসে।
এসেই দৌড়ে রুমে আসে।আর মুকিত মুকিত করে চিল্লিয়ে উঠে।
আমাকে দেখে কান্নায় ভেঙে পড়ে মুহিত।
দুই ঘন্টা পর পুলিশ এসে বাসার কারেন্ট এর লাইন ঠিক করে। আপাকে আমরা বাথরুমে বাথ টাবের ভেতর পাই।ঠান্ডা পানিতে হাত পা বেধে,মুখে টেপ লাগিয়ে ডুবিয়ে রাখা হয়েছিলো আপাকে।আপার শরীর ততক্ষনে ফ্যাকাশে বর্ন ধারণ করেছে।
আপাকে দ্রুত হসপিটালে নিয়ে যাওয়া হয় ।
মুকিত আর দুলাভাইয়ের লা*শ পুলিশ নিয়ে যায় পোস্ট মর্টেম করতে।
মুহিতের কাছে জানতে পারি মুহিত আর মুকিত ভিডিও কলে কথা বলছিলো ।দুলাভাই আর মুকিত বসে আপার জন্য অপেক্ষা করছিলো।আপা জীবনে প্রথম আমার বাসায় আসবে বলে মনের মতো করে রেডি হচ্ছিলেন।হঠাৎই কারেন্ট চলে যাওয়ায় লাইন কেটে যায়।মুহিত আবার অডিও কল করে -সেটা মুকিত কেবলই রিসিভ করেছে
―হ্যালো বলার আগেই কয়েকজন কালো কাপড় পরিহিত এবং চোখ মুখ ঢাকা আগন্তুক বাসায় প্রবেশ করে।বাসার কেউ তাদের চেহারা দেখতে পায়নি।
দুলাভাই চকিতেই প্রশ্ন করে
―কে ওখানে?
ভরাট কন্ঠে কেউ বিদঘুটে হাসতে হাসতে উত্তর দিলো
–পুরোনো লেনদেন পরিশোধ করতে এলাম আদনান সাহেব।কতো করে বললাম সাক্ষী দিলে প্রাণবায়ু বাঁচবে না।শুনলে না তো?এবার তাহলে চড়া দাম চুকাও বলেই এলোপাতাড়ি কো*পা*নো শুরু করে।
মুকিত পাপা বলে চিল্লিয়ে কাঁদতে থাকে মুহিত পুরোটাই ফোনে শুনেছে।
মুহিত পাগলের মতো লাইনে থেকে শুধু প্রশ্ন করেই যাচ্ছে মুকিত ,মুকিত?
―কি হয়েছে ওখানে?কে পাপাকে মারছে?
―ভাইয়া পাপাকে কেউ মে*রে ফেলছে।আমার ভয় লাগছে বাঁচাও ভাইয়া।ভাইয়া!ভাইয়া!পাপা!
এরপর মুকিতের উম উম করা আওয়াজ পাওয়া গিয়েছে আর কোনো শব্দ পাওয়া যায়নি।আর লাইনটা কেটে গিয়েছে।মুহিত বারবার ফোন করে লাইন বন্ধ পেয়েছে।
মুহিত দ্রুত দৌড়ে তার ডিউটি অফিসারের কাছে সব ঘটনা খুলে বলে জিপ নিয়ে বেরিয়ে পড়ে।কিন্তু শেষ রক্ষা করতে পারেনি।পারেনি দুলাভাই আর মুকিত কে বাঁচাতে।
এরপর আপাকে চিকিৎসা করে প্রাণে বাঁচানো গেলেও স্বাভাবিক জীবনে আর ফেরানো যায় নি।
আপা হুঁশে ফিরলে শুধু মুকিত মুকিত করে কেঁদে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে।এভাবেই চলছে আপার ছয় বছর ধরে জীবন যুদ্ধ।আর মুহিতের কাঠিন্যতার ভান।যেই মুহিত আগে হাসি দুস্টুমিতে হট্রগোল করে সারা বাড়ি মাতাতে সেই মুহিত এখন সময়ের ব্যাবধানে পরিস্থিতির চাপে হয়ে গেছে নিশ্চুপ,গম্ভীর,রাগী।
মুহিত কে ঢাকা ট্রান্সফার করাতে আমার বহুত কাট খড় পোড়াতে হয়েছে।মুহিত দুলাভাই এর ডেইলি রাইটিং ডায়েরি এর সন্ধান পায়।সেখানে দুলাভাইয়ের হাতের লিখা ছিলো আমার পরিচিত বা রক্তের যাকে পাবে তাকেই শেষ করে দেবে।
সেই ভয় থেকে মুহিত সব কিছু চেপে গেছে,আর মুহিত চায়না ডিপার্টমেন্ট আমার দিকে আঙ্গুল তুলুক যে―
মামা মেজর জেনারেল বলে ভাগিনা সুযোগ লুটছে।
―মুহিত যখন আমাকে মামা না বলে ,স্যার বলে ,আপনি বলে সম্বোধন করে তখন এই বুকে কেমন চিনচিনে ব্যাথা হয় তনুজা আমি তোমাকে বলে বুঝাতে পারবো না
#চলবে।