#তোমার_জন্য_সিন্ধুর_নীল
#পর্ব_৩১
#সারিকা_হোসাইন
*********
সময় বহমান,নদীর স্রোত যেমন ধীরে ধীরে বয়ে চলে ঠিক সেভাবেই সময় চলে যায় সকলের অলক্ষে।বিভিন্ন ব্যাস্ততায় মানুষ তা ঠাহর করতে পারেনা।যে সময় একবার চলে যায় তাকে আর কখনো ফিরিয়ে আনা যায় না শুধু থেকে যায় আফসোস।
ঠিক সেভাবেই প্রত্যেকের জীবন থেকে হারিয়ে গিয়েছে দীর্ঘ একটি বছর।
এই এক বছরে মুহিত তার জীবনের সকল ঝামেলা উৎপাটন করতে সক্ষম হয়েছে।শুধু তাই নয় তার বাবার তৈরি পুরাতন বাসটাকে সু সজ্জিত করে দিয়েছে নতুন রূপ।
স্বর্গ এখন একজন মিলিটারি ফিজিসিয়ান ক্যাপ্টেন,নিজের দায়িত্ব কর্তব্যে এক চুল গাফিলতি তার পছন্দ নয়।
নামিরার ছেলেটা এখন সাড়ে চৌদ্দ মাসে পা দিয়েছে।আধো আধো বুলিতে নানান ধরনের শব্দ আওড়ায় সে আর থপ থপ করে ঘুরে বেড়ায় সারা বাড়ি।
সোহাগ তার পূর্বের ভার্সিটিতে আবার ইংলিশ প্রভাষক হিসেবে যোগদান করেছে।
ধরতে গেলে মিসেস তারিনের পরিবার অনেকাংশেই সুখী সমৃদ্ধি পরিবার।
সব কিছুই আছে মিসেস তারিনের সংসারে শুধু নেই আদরের ছোট পুত্র মুকিত আর ভালোবাসার মানুষ টা।
――――――
মিসেস তারিন ,মুহিত,সোহাগ আর নামিরা বসে আছে নাফিজ মাহমুদ এর ড্রয়িং রুমে।
একটু আগে বিভিন্ন নাস্তার পসরা সাজিয়ে দিয়ে গিয়েছেন বাড়ির হেল্পিং হ্যান্ড ফতেমা।
মুহিত চোরের মতো গোপনে গোপনে খুঁজে চলেছে তার মনের রাজ্যের রাজকুমারী কে।কিন্তু কোথাও তাকে দেখা যাচ্ছে না।
মুহিতের ধৈর্য্যের বাঁধ যেনো ভেঙে যাচ্ছে,বুক ধুকপুক করছে।
দীর্ঘ ছয়মাস ধরে সে তার প্রিয়তমা কে দেখতে পারছে না।
মুহিত,সৌম্য আর আদ্রিয়ান নিজেদের পদমর্যাদা বাড়াতে কঙ্গো তে গিয়েছিলো ছয়মাসের একটা মিশনে ।
সেখানে মুহিতের কাজ ছিলো বিভিন্ন ডিভাইস এর উপর।সারাক্ষন স্ক্রিনে নজর রাখতে হতো।
যার জন্য মুহিত বাসার কারো সাথেই খুব একটা যোগাযোগ রাখতে পারেনি।
মাঝে মাঝে দুই তিন মিনিটের জন্য কথা বলার সুযোগ পেতো।আর নেটওয়ার্ক এর অবস্থা এতো বাজে, ভিডিও কলে কথা বলার সৌভাগ্য হয়নি কারো সাথেই মুহিতের।
এজন্য মিশন থেকে ফিরেই পরিবার নিয়ে এসেছে নাফিজ মাহমুদ এর বাড়িতে।
আজই সে আংটি পরিয়ে রাখবে এবং মিশনের সকল কাজ অফিসিয়াল সাবমিট করে এক সপ্তাহের মধ্যে স্বর্গকে নিজের ঘরে তুলবে।
স্বর্গ অবশ্য জানেনা আজ মুহিত আসবে,তনুজাও জানতেন না হুট করে মুহিত তার ফ্যামিলি নিয়ে চলে আসবে।
মুহিত কিছুক্ষন উশখুশ করে নামিরাকে চিমটি কাটলো।
নামিরা চোখ গরম করে মুহিতের দিকে তাকাতেই অসহায় এর মত ফেস করে মুহিত বলে উঠলো
―মামী কে জিজ্ঞেস কর না আমার বউটা কোথায়?
নামিরা কটমট করে বললো এতো নির্লজ্জ কেনো তুই?বিয়েটা আগে হতে দে, পরে না হয় সারাক্ষন বউ বউ করিস।
মুহিত দাঁত পিষে বললো
“যেটা করতে বলেছি সেটা কর না হলে তোর ছেলের কান মলে দিব আমি।”
ছেলের কান মলার কথা শুনতেই ছেলের দিকে তাকালো নামিরা,দেখতে পেলো মুহিত অলরেডি তার ছেলে ‘শুদ্ধর ” কান ধরে আছে।
বাসায় গিয়ে তোকে দেখছি বলেই নামিরা ইতস্তত করে বলে উঠলো
―মামী স্বর্গকে কোথাও দেখছি না,
তনুজা স্মিত হেসে বললেন
“আসলে তোমরা আসবে এটা স্বর্গ জানতো না,ও সিএমএইচ এ গেছ। ইমারজেন্সি কল করেছে ওখান থেকে”
মিসেস তারিন বলে উঠলো
“আসলে আজ শুক্রবার এজন্য আমরা ভেবেছি ও হয়তো বাসাতেই আছে!তাই সারপ্রাইজ দিতে এলাম!
“সারপ্রাইজ দিতে এসে নিজেই সারপ্রাইজড হয়ে গেলাম ”
মিনমিন করে বলে উঠলো মুহিত।
একটু পর হন্তদন্ত হয়ে নাফিজ মাহমুদ বাসায় ফিরে মিসেস তারিনের সাথে কুশল বিনিময় করে মুহিত কে নিয়ে ব্যাস্ত হয়ে গেলেন।
“তা বাবা মুহিত ওখানে কি অনেক পরিশ্রম হয়েছিল নাকি?একদম শুকিয়ে কালো হয়ে গেছো!”
“”আসলে স্যার প্রচুর ঘুম কামাই করতে হয়েছে,দিনে রাতে মিলিয়ে আমি সাড়ে তিন ঘণ্টার মতো সময় পেয়েছি ঘুমানোর জন্য।”
“আর তাছাড়া পার্সোনাল কিছু দুশ্চিন্তা ও ছিলো।এজন্য নিজের ঠিকঠাক যত্ন নিতে পারিনি”
হঠাৎই নাফিজ মাহমুদ তনুজাকে ডেকে স্বর্গ কোথায় জানতে চাইলেন।
“বাপী আমি এখানে”
ক্লান্ত স্বরে জবাব দিলো স্বর্গ।
স্বর্গের আকস্মিক জবাবে বসা থেকে দাঁড়িয়ে গেলো মুহিত।বুকে তার তোলপাড় শুরু হয়েছে।শূন্য বুক খাঁখাঁ করছে।হৃদয়ের অলিন্দ বারবার আন্দোলন করে যাচ্ছে স্বর্গকে জড়িয়ে ধরার জন্য।
ড্রয়িং রুমে মুহিতকে দেখে থমকে দাঁড়ালো স্বর্গ।
শ্বাস রোধ হয়ে আসছে এমন অনুভূতি হচ্ছে থেকে থেকে।বুকের ছাতিতে কে যেনো জোরে জোরে হাতুড়ি পেটাচ্ছে শুধু।
এতোগুলো দিন মুহিতকে না দেখে কিভাবে থেকেছে স্বর্গ এই কথা সে ছাড়া আর কেউ জানে না।
মাঝে মাঝে ইচ্ছে হয়েছে পাখি হয়ে মুহিতের কাছে চলে যেতে।কিন্তু তা কি আর সম্ভব?
মুহিতের বুকে হামলে পরে শান্তির শ্বাস নিতে ইচ্ছে করছে স্বর্গের।কিন্তু বাবা আর ফুপির সামনে সম্মান বিসর্জন দিবে কিভাবে?
“ফুপি তুমি বসো আমি ফ্রেস হয়ে আসছি”
বলেই এক প্রকার দৌড়ে নিজের কক্ষে চলে আসলো স্বর্গ।
এই মুহিত টা তাকে ভীষন ভাবে কাবু করেছে তার প্রতি ।ভালোবাসা হীন এক দন্ড তার সামনে দাঁড়ানো যায়না।সারাক্ষন মাথায় চুমু,হাগ,কামড় দেয়া এসব ঘুরে বেড়ায়।
“এ কেমন অসভ্য ইচ্ছে??
মুহিত তার বুকের তোলপাড়ের কারনে বসে থাকতে পারছি না।”
“এখনই স্বর্গের কাছে যাওয়া চাই”
হঠাৎই দাঁড়িয়ে গেলো মুহিত,অনুরোধের স্বরে নাফিজ মাহমুদ কে উদ্দেশ্য করে বললো
“স্যার আমি কি একবার একান্তে ওর সাথে কথা বলতে পারি”?
প্রাণ খুলে হেসে উঠলেন নাফিজ মাহমুদ।মুহিত কে তিনি ছোটবেলা থেকে দেখে আসছেন।যেমন ভদ্র তেমন শান্তশিষ্ট ব্যাক্তিত্ব সম্পন্ন একটি ছেলে ।ঠিক যেনো বাপের কার্বন কপি।
চোখ বন্ধ করে এই ছেলেকে বিশ্বাস করা যায়।
আর যাই হোক কারো কোনো ক্ষতি এই ছেলের দ্বারা সম্ভব নয়।
মাথা ঝাকিয়ে নাফিজ মাহমুদ বলে উঠলেন
“হপ ব্যাটা,এটা আবার অনুমতি নেবার কি আছে?তোমার ই তো হবু বউ,যাও কথা বলে এসো।আমরা অপেক্ষা করছি”
মুহিত দৌড়ে সিঁড়ি বেয়ে স্বর্গের কক্ষের সামনে দাঁড়িয়ে আছে।
স্বর্গ ঝটপট শাওয়ার নিয়ে কোনো রকমে এলোমেলো করে একটা বেগুনি রঙের জামদানি পরে টাওয়েল দিয়ে চুল মুছতে মুছতে বেরিয়ে এলো।
মুহিত আস্তে করে দরজায় নক করলো।
স্বর্গ ভেবেছে তনুজা এসেছে বোধ হয় তাই গলার আওয়াজ উঁচু করে বলে উঠলো
“দরজা খোলাই আছে ,ভেতরে এসো”
মুহিত দুই হাতের ধাক্কায় সপাটে দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করে দরজা ভিড়িয়ে দিলো।
আয়নার দিকে তাকিয়ে চুল মুছতে মুছতে হঠাৎ ই আয়নার প্রতিবিম্বে মুহিতের অবয়ব দেখে ঈষৎ কেঁপে উঠে স্বর্গ।
মুহিত দ্রুত পায়ে পেছন থেকে কোমর জাপ্টে ধরে থুতনি গুঁজে দেয় স্বর্গের কাঁধে।
আবেশে চোখ বন্ধ করে ফেলে স্বর্গ।হাত থেকে পরে গেলো ভেজা টাওয়েল।
শক্ত পুরুষালী হাতের সহায়তায় স্বর্গকে নিজের দিকে ফেরালো মুহিত।
এলোমেলো শাড়ি,ভেজা চুল, স্নিগ্ধ মুখ সব মিলিয়ে মুহিত কে বেসামাল করে দিচ্ছে।ধবধবে সাদা অঙ্গে বেগুনি পাতলা জামদানি টি জলজল করছে।
মুহিতের মনে হচ্ছে এই শাড়িটি স্বর্গের জন্যই আলাদাভাবে তৈরি মরা হয়েছে।
স্বর্গের এহেন আগুন ঝরা রূপে ঝলসে গেলো মুহিত।মাথা ফাঁকা হয়ে গেলো তার।
এসেছিলো অনেক কথাই বলতে,কিন্তু এখন কিছুই মনে নেই তার।
নিজের একান্ত ব্যাক্তিগত মানুষের এমন রূপ কোনো প্রেমিক পুরুষ সহ্য করতে পারবে?
মনের সাথে মুহিতের কিছুক্ষণ নীরব যুদ্ধ চললো।এর পর করে ফেললো এক পাগলামি।
শাড়ির ফাক গলিয়ে স্বর্গের মেদহীন তলপেট মুচড়ে ধরলো মুহিত,
স্বর্গ নিজেকে সামলাতে না পেরে খামচে ধরলো মুহিতের চুল।
নেশাতুর চোখে স্বর্গের পানে তাকিয়ে স্বর্গের লাল ঠোঁট দুটো দুই আঙুলের সহিত টেনে টিপে ধরলো।
হঠাৎই দরজায় করাঘাত এর আওয়াজ পাওয়া গেলো।
স্বর্গ ওয়াশরুমে ঢুকে গেলো মুহিত পাশে থাকা চেয়ারে ঝিম মেরে বসে গেলো।
রুমে প্রবেশ করে উৎসুক হয়ে নামিরা জানতে চাইলো
“কি করছিস তুই?স্বর্গ কোথায়?
আর এই শীতের মধ্যে এভাবে এতো ঘামছিস কেনো ?
মুহিত আমতা আমতা করে কিছু বলার আগেই ঠিকঠাক ভাবে নিজেকে পরিপাটি করে বেরিয়ে এলো স্বর্গ।
নামিরা স্বর্গের হাত ধরে টেনে নিয়ে বললো
“এসো সবাই অপেক্ষা করছে”
নামিরা চলে যেতেই কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে চোখ বন্ধ করে ফুঁস করে নিশ্বাস নিলো মুহিত।এরপর নিজেকে স্বাভাবিক করে বাইরে বেরিয়ে এলো।
ড্রয়িংরুমে সকলেই বসে আছেন,গল্প গুজব করছেন।একটু পর মুহিত এসে সেই আড্ডায় সামিল হলো।
সকলের মাঝে হঠাৎই মিসেস তারিন বলে উঠলো
“আমি যদি আজকে আমার আম্মাকে আংটি পরিয়ে যাই কারো কোনো আপত্তি আছে?”
নাফিজ আর তনুজা মুখ চাওয়া চাওয়ি করে বলে উঠলেন
“কি বলিস আপা আপত্তি কেনো থাকবে?”
মিসেস তারিন খুশি মুখে আবার বলে উঠলেন
“”আজকে আম্মাকে আংটি প্রিয় যাবো,আগামী সপ্তাহে বিয়ের ডেট ফেলতে চাচ্ছি”
“তোরা কি তোদের মেয়েকে আগামী সপ্তাহে আমার ঘরে দিবি নাকি আরো কিছুদিন তোদের কাছে রাখতে চাস?”
মায়ের মুখের এমন কথায় ধক করে উঠলো মুহিতের বুক।কি পরিয়ে নিয়ে এলো আর এই মহিলা বলছে কি?
“এখন যদি মামা মশাই বলে ফেলে আরো কয়েকদিন যাক?
“তাহলে তো কচু গাছের সাথে ফাঁস নেয়া ছাড়া কোনো উপায় থাকবেনা মুহিতের।
বিয়ে করা বউকে কাছে পাওয়া যাচ্ছে না সময় মতো এর চাইতে বড় কষ্ট আর কি আছে এই নশ্বর দুনিয়াতে??””
“মুহিত মনে মনে আল্লাহ মাবুদ জপতে থাকলো।
একটু পর নাফিজ মাহমুদ বলে উঠলো মেয়েকে কাছে রাখার কিছুই নেই আপা, তোর বাসা আমার বাসা থেকে দশ মিনিটের রাস্তা।চাইলেই যখন তখন মেয়েকে দেখতে পাবো,আর মেয়েতো অন্য কারো ঘরে যাচ্ছে না।
নিজের ফুপুর কাছে যাচ্ছে।
“”যেখানে তুই আছিস,মুহিত নামিরা আছে সেখানে আমার চিন্তা করা বা দুঃখ পাবার কিছুই নেই।
মুহিতের ও বিয়ের বয়স হয়ে গেছে অনেক আগেই,আর ওদের বিয়েটাও অনেক দিন ই হলো ঠিক হয়েছে।
আমার মনে হয় এখন বিয়েটা হয়ে যাওয়াই ভালো
“কি বলো তনুজা??
তনুজা মধুর হাসি ঝুলিয়ে বলে উঠলো
“আপনার ভাই ঠিকই বলেছে আপা, আগামী সপ্তাহেই আমরা বিয়ের তারিখ ফেলতে চাই।
আলহামদুলিল্লাহ বলে হ্যান্ড ব্যাগ থেকে একটি বক্স বের করলেন মিসেস তারিন।
স্বর্গকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো
“আম্মা আমার পাশে এসে বসো তো দেখি”
স্বর্গ লাজুক ভঙ্গিতে মাথা নিচু করে মিসেস তারিনের পাশে বসলেন।
একটি ডায়মন্ড এর আংটি মুহিতের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে উঠলেন
“এটা তোমার পাপা ভালোবেসে আমাকে দিয়েছিলো, ব্যাবহার করলে নষ্ট হবে ভেবে আমি কোনদিন হাতে তুলিনি এই আংটি।
মানুষটা আজ নেই,দুদিন পরে আমিও থাকবো না,
“তোমার পাপা বেঁচে থাকলে হয়তো আরো সুন্দর সুন্দর জিনিস তোমার বউয়ের জন্য খুশি হয়ে কিনতো।
মানুষটা কতো সৌখিন ছিলো এটা তোমাদের কারোর ই অজানা নয়।
কিন্তু আল্লাহ তাকে নিয়ে গিয়েছে।মনকে সবর দেয়া ছাড়া আমাদের আর কিছুই করার নেই।
তোমার পাপার পক্ষ থেকে বাড়ির প্রথম ছেলের বউ হিসেবে স্বর্গের জন্য এই ছোট উপহার।
পরে তুমি তোমার মন মতো যা খুশি কিনে দিও।
বলেই মুহিতের দিকে আংটি টি বাড়িয়ে দিলেন।
সকলের চোখ ভিজে উঠলো মিসেস তারিনের আক্ষেপে।
মুহিত বারবার পলক ঝাপটে অশ্রু লুকিয়ে মায়ের হাত থেকে আংটি নিয়ে স্বর্গের হাতে পরিয়ে দিলো।
মিসেস তারিন মুহিত আর স্বর্গের মাথায় হাত বুলালেন।
স্বর্গের নরম হাত তুলে নিয়ে অনামিকা আঙুলে চুমু খেয়ে বললেন
“আম্মা আংটি সুন্দর মানিয়েছে তোমার সুন্দর হতে।
বিয়ের যা যা কেনাকাটা দুজন মিলে করে নিও,ফুপি আর ডিস্টার্ব করবো না।
স্বর্গ আহ্লাদী হয়ে মিসেস তারিনের হাত জড়িয়ে ধরে বললো
আংটি অনেক পছন্দ হয়েছে আমার,এটা আর জীবনেও ফেরত পাবে না তুমি।আর তোমার পছন্দ অনেক সুন্দর।
আমার বিয়ের সব কেনাকাটা তুমি আমার সাথে গিয়ে কিনবে।
বলেই মিসেস তারিনের কাঁধে মাথা রেখে চোখ বুঝলো স্বর্গ।
মিসেস তারিন স্বর্গের গালে মমতার হাত বুলালেন।
নাফিজ মাহমুদ ক্যালেন্ডার দেখে সকলের উদ্দেশ্যে বললেন
আগামী শুক্রবার বিয়ে।সকলেই প্রস্তুতি নাও।কেনাকাটা তে লেগে যাও।
আমি উঠলাম আজ আমার অনেক কাজ আছে।একমাত্র মেয়ের বিয়ে বলে কথা।
#চলবে।
#তোমার_জন্য_সিন্ধুর_নীল
#পর্ব_৩২
#সারিকা_হোসাইন
★★★
ডিসেম্বর মাস,ঢাকায় একটু একটু শীত পড়তে শুরু করেছে।শীতের আমেজ চার পাশে পরিলক্ষিত।সন্ধ্যা নামতেই হালকা ধোয়ার মতো কুয়াশা জাল বিছিয়ে দিচ্ছে সর্বত্র।
আজ স্বর্গের গায়ে হলুদ।বিয়ে নিয়ে প্রতিটা মেয়ের অনেক কল্পনা জল্পনা থাকে।স্বর্গ ও তার ব্যাতিক্রম নয়।গায়ে হলুদ থেকে শুরু করে রিশিপশন পর্যন্ত সব কিছু মন মতো হওয়া চাই।
নাফিজ মাহমুদ এর বাড়ী আত্মীয় স্বজনে গিজগিজ করছে।বড় বড় আর্মি অফিসারের ছোট ছোট বাচ্চাগুলো ঘরময় দৌড়ো দৌড়ি করে এই সন্ধাটাকে আরো চাঞ্চল্যকর করে তুলেছে।
ছোট বড় প্রত্যেকে আজ কাজে ব্যাস্ত।কেউবা ফল ডেকোরেশন করছে,কেউবা পায়েস এর থাল সাজাচ্ছে কেউবা আবার গার্ডেন এর পাশে হলুদের স্টেজ সাজাতে ব্যাস্ত।
আজকের এই মধুমাখা হলুদ সন্ধ্যায় স্বর্গ গায়ে জড়িয়েছে কাঁচা হলুদ রঙের জামদানি সাথে গোলাপি রঙের জারবেরা আর জুঁই ফুলের অধফোটা কুঁড়ির তৈরি গহনা।
মুখমন্ডলে হালকা মেকআপের টাচ,তরতরে সোজা সিল্কি বাদামি চুলগুলো আজ সে কার্ল করেছে।ঠোঁটে গ্লোসি হালকা গোলাপি রঙের লিপস্টিক।
পার্লার থেকে হেনা আর্টিস্ট এসে দুপুরেই খুব সুন্দর করে মেহেদী পরিয়ে দিয়ে গেছে
মুহিত পই পই করে বলেছে দুই হাতের তালুতেই ডিজাইনের ভীড়ে তার নামের অক্ষর থাকা চাই ই চাই।
স্বর্গ হেনা আর্টিস্ট কে বার বার বলে দিয়েছে ডিজাইনের প্রত্যেকটা ফাঁকা জায়গায় যেনো সে “M” লিখে দেয়।
স্বর্গের এহেন পাগলামি কাণ্ডে হেনা আর্টিস্ট ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি অবস্থা।
পিউ এসে স্বর্গকে খুটিয়ে খুটিয়ে দেখছে,কোথাও কোনো সাজে ভুল আছে কি না।
নাহ সেরকম কিছুই দৃষ্টিগত হলো না।
“তোকে আজ রূপকথার রাজকুমারী দের মতো লাগছে ”
বলেই চোখের নিচে থেকে কাজল এনে স্বর্গের গ্রীবাদেশে লাগিয়ে দিলো পিউ।
“আজ মেজর মুহিত তোকে দেখে জ্ঞান হারাবে”
বলেই কুনুই দিয়ে স্বর্গের হাতে গুঁতো দিলো পিউ।
আচানক কোথায় থেকে যেনো সুখ এসে ঢুকে পড়লো স্বর্গের কক্ষে।
কোমরে হাত দিয়ে বিজ্ঞের ন্যায় ঠোঁট ফুলিয়ে কিছু ভাবলো।
এর পর গমগমে কণ্ঠে বলে উঠলো
একটা সত্যি কথা বলবো?
পিউ মনে মনে ভাবছে এখনই লাগবে দুটোর ঝগড়া আর সেই ঝগড়ায় নষ্ট হবে সাজ।
কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে সুখ বলে উঠলো
“তোকে আজ অনেক সুন্দর লাগছে”
“আচ্ছা থাক আমি চলি বলেই দরজার কাছে এসে দাড়ালো সুখ।
স্বর্গের পানে দৃষ্টি বুলিয়ে হো হো করে হেসে উঠলো এর পর চিল্লিয়ে বলে উঠলো
“তোকে আস্ত একটা ডাইনি লাগছে,পিশাচিনি।জিজু দেখলে নির্ঘাত হার্ট এট্যাক করবে”
বলতেই পায়ের স্যান্ডেল ছুড়ে মারলো স্বর্গ।
হাসতে হাসতে সুখ দৌড়ে পালালো।
নাফিজ মাহমুদ এর বাংলোর সামনের গার্ডেন এর পাশে বিশাল এক খোলা জায়গা।সেখানেই সুন্দর করে গায়ে হলুদের স্টেজ সাজানো হয়েছে।
হলুদ গোলাপ আর সাদা রজনী গন্ধ্যার মিশ্রনে তৈরি হয়েছে স্টেজ টি।রাখা হয়েছে সোফা আর সেন্টার টেবিল।
বিভিন্ন ধরনের সুসজ্জিত খাবারের পসরা সাজানো হয়েছে সেই টেবিলে।
একটু পর নামিরা আর সোহাগ এলো বিশাল বড়ো এক আকর্ষণীয় কেক নিয়ে।
নামিরা আজকে হলুদ লেহেঙ্গা আর জলপাই রঙের ওড়না পড়েছে সাথে হালকা মেকআপ।
সোহাগ মুগ্ধ নয়নে দেখে যাচ্ছে নামিরাকে।
এই দীর্ঘ সাড়ে সাত বছর সোহাগ নামিরাকে কখনো সাজতে দেখেনি।হয়তো সাজার মতো কোনো অবস্থাই তৈরি হয়নি এই কয়েক বছরে।
“কে বলবে এই মেয়ের একটা দেড় বছরের বাচ্চা আছে?.”
নামিরার সৌন্দর্য সোহাগের মনে হিংসের সৃষ্টি করে।
আবার মনে মনে নিজেকে বুঝ দেয়
“এই অতীব সুন্দরী রমণীটি তাকে পাগলের মতো ভালোবাসে এবং তার সন্তানের মা ।
এসব ভাবনা ভাবতেই সোহাগের বুকে হিমশীতল বাতাস প্রবাহিত হয়।
“কি দেখছো এমন ছ্যাবলার মতো?
“কখন থেকে ডেকে যাচ্ছি সারা দিচ্ছনা শুধু দেখেই যাচ্ছ!
নামিরার তেজ পূর্ন স্বরে ধ্যান ভাঙলো সোহাগের।নিজেকে ধাতস্থ করে মিনমিন করে বলে উঠলো
“তোমাকে অনেক সুন্দর লাগছে নামিরা।
বলেই তড়িঘড়ি করে অন্যকাজে লেগে গেলো।
সকল কাজ কমপ্লিট, এখনই স্বর্গকে স্টেজে আনা হবে।মৃদু শব্দে হলুদের গান বাজছে,ছোট ছোট বাচ্চারা বক্সের সামনে বিভিন্ন ভঙ্গিতে নেচে যাচ্ছে।
লাল রঙের সামিয়ানা যা গোল্ডেন জরি সুতায় কারুকাজ খচিত ।সেই সামিয়ানার চারকোনা ধরেছে চারজন মেয়ে।
স্বর্গ আগে আগে যাচ্চে পিছনে তার বান্ধবীরা গানের তালে তালে নেচে চলছে।
নাচতে নাচতে তারা স্বর্গকে এনে স্টেজে পাতা সোফায় বসালো।
এবার হলুদ ছোয়ানোর পালা।
প্রথমে মিসেস তারিন একটু হলুদ ছুইয়ে মাথায় হাত দিয়ে দোয়া করলেন।এরপর তনুজা,নাফিজ মাহমুদ হলুদ ছুঁইয়ে কপালে চুমু দিয়ে সোফায় এসে বসলেন।
ধীরে ধীরে নামিরা,পিউ,সুখ সবাই হলুদ ছোয়ালো।
হঠাৎই ক্যাপ্টেন সৌম্য এসে মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে বলে উঠলো
“হ্যালো,চেক ,ওয়ান,টু,থ্রি।
“এবার আপনাদের সামনে একটা ধামাকা হতে যাচ্ছে,সেই ধামাকা না আগে কেউ দেখেছে না শুনেছে।”
এবার মেজর আদ্রিয়ান মাইক্রোফোন কেড়ে নিয়ে সৌম্যের গলাগলি ধরে বলে উঠলেন,
সবাই ধামাকা দেখার জন্য রেডি?
সকলেই সমস্বরে বলে উঠলো
“ইয়েস”
প্রত্যেকের সমর্থন পাবার সাথে সাথেই নিভে গেলো সকল লাইটস।জলে উঠলো ফোকাস লাইট।
একটি উঁচু টুলে গিটার হাতে একটি ছেলে বসে আছে।
অন্ধকারে তার মুখ অস্পষ্ট।
কিন্তু স্বর্গের একমুহূর্ত সময়ও লাগলো না ঠাহর করতে মানুষটা কে?
“মানুষটা তার একান্ত ব্যাক্তিগত সম্পত্তি।
ধীরে ধীরে স্পষ্ট হলো মুহিতের পুরা অবয়ব।
মুহিত পড়েছে সাদা পাঞ্জাবি আর সাদা পায়জামা সাথে স্বর্গের শাড়ির সাথে ম্যাচিং করে কাঁচা হলুদ কুটি।হাতে ব্রাউন ফিতার নেভিফোর্স ঘড়ি।
স্বর্গ মোহনীয় দৃষ্টিতে দেখে যাচ্ছে মুহিত কে।
স্বর্গের কাছে মনে হচ্ছে মুহিত পরিবীর সবচেয়ে স্নিগ্ধ আর শুদ্ধতম পুরুষ।
যেই পুরুষকে কেউ ছুঁয়ে দেখেনি, যেই পুরুষের প্রীতিময় সান্নিধ্য একমাত্র স্বর্গ ছাড়া কেউ পায়নি।
নিজেকে পৃথিবীর সবচাইতে ভাগ্যবতী মনে হচ্ছে তার নিজের কাছে।
গিটারের টুংটাং শব্দে ধ্যান ভাঙলো স্বর্গের।
নামিরা দুই হাতের সহিত ঢেকে ফেললো তার মুখ।
কোনোভাবেই নামিরা তার কান্না চেপে রাখতে পারছে না।
“এটাই তো সেই আগের মুহিত,যেই মুহিত দীর্ঘ সাড়ে সাত বছর ধরে হারিয়ে গিয়েছিলো।”
“এটাই তার আদরের সেই চঞ্চল হাসিখুশি ভাই”
মিসেস তারিন চশমা খুলে চোখ থেকে গড়িয়ে পড়া জ্বল নীরবে মুছে নিলেন।
তনুজা মিসেস তারিন কে জড়িয়ে ধরে পিঠে হাত বুলালেন।
“মুহিত গুনে গুনে আট বছর পর গিটার হাতে ধরলো”
মুহিতের গিটারের সুরের সাথে বেজে উঠলো মিউজিশিয়ান দের সফট মিউজিক।
মুহিত গাইতে শুরু করলো
“তোমার জন্য সিন্ধুর নীল
“আরো হবে সপ্নীল।
উদাস দুপুরে রাগ বসন্তে গাইবে সোনালী চিল
তোমার যতো ভুল সব
নিমিষেই হবে ফুল।
তবু ভালোবাসি শুধু তোমায়
নিশিদিন সারা বেলা,,,,,,
তোমার জন্য সিন্ধুর নীল আরো হবে স্বপ্নীল।
মুহিত গান শেষ করতেই সকলের করতালিতে মুখরিত হলো চারপাশ।
গিটার ছেড়ে মুহিত এগিয়ে আসলো স্বর্গের কাছে।
হলুদের বাটি থেকে হলুদ নিয়ে নিজের গালে মেখে সেই গাল ছোয়ালো স্বর্গের গালে,নাকে।
সকলেই হাত তালি দিয়ে বলে উঠলো আমরা মুহিত আর স্বর্গের ডান্স পারফর্ম দেখতে চাই।
নিমিষেই সকলে এক যোগে বলা শুরু করলো
“মুহিত,স্বর্গ।”মুহিত -স্বর্গ”
মুহিত মাথা নিচু করে এক হাত বুকে রেখে আরেক হাত বাড়িয়ে দিলো স্বর্গের পানে।
স্বর্গ মুহিতের আহ্বানে সায় দিয়ে আলতো করে চেপে ধরলো মুহিতের হাত।
উঠে দাঁড়ালো স্বর্গ।
ফাঁকা করা হলো স্টেজ।
বক্সে বেজে উঠলো সিলেক্টেড গান।
প্রথমে ছেলেদের দল উঠে গেলো স্টেজে।
সালামে ইস্ক সালামে ইস্ক গানে নাচবে সবাই।
গানের মিউউজিক এর তালে তালে নেচে উঠলো
মুহিত সৌম্য আর আদ্রিয়ান এর দল।
এক ঝাঁক তরুণ আর্মি অফিসার নিখুঁত ভাবে নেচে যাচ্ছে
সবাই হাত তালি দিয়ে উৎসাহ প্রদান করছে আর নাচছে।
মেয়েরাও উঠে গেলো স্টেজে।
কেউ কারো থেকে কম যাচ্ছে না।
পারফরম্যান্স শেষ হতেই সকলেই করতালিতে তাদের প্রশংসা জানালো।
সকল আচার অনুষ্ঠান মেনে আনন্দ ফুর্তিতে শেষ হলো গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান।
――――
রাত প্রায় একটার কাছাকাছি।
স্বর্গ নিজ রুমে এসে শাড়ি গহনা খোলার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
হঠাৎ করেই কক্ষে মুহিত প্রবেশ করে দুম করে দরজা আটকে দিলো।
স্বর্গ উঠে দাঁড়াতেই মুহিত শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো স্বর্গকে।
“অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে রেখেছি বউ।
“এমন ঘায়েল করা রূপ দিয়ে মেরে ফেলতে চাও নাকি আমাকে?
“এই দেখো বুকের এই জায়গাটায় চিনচিনে ব্যাথা হচ্ছে বলে আঙ্গুলি দিয়ে নির্দেশ করলো।
ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে স্বর্গ জিজ্ঞেস করলো
“তার জন্য কি করতে আমাকে ফটাফট বলে কেটে পড়ো।
আমার ঘুম পেয়েছে।
কালকে বিয়ে অনেক ধকল যাবে।
ঠোঁটে একটা মিষ্টি দিয়ে দাও চলে যাচ্ছি বউ।
কন্ঠে সিরিয়াস ভাব এনে বলে উঠলো মুহিত―
“আমাকেও ঘুমুতে হবে বউ কাল থেকে তো আর ঘুমানো যাবে না।
স্বর্গ টুপ করে চুমু খেয়ে সরে দাঁড়ালো।
“হয়েছে দিয়েছি যাও এখন!
মুহিত আহত স্বরে জিজ্ঞেস করলো
“এটা কি দিলি বউ?
“কি আবার? চুমুই তো চাইলে”
“আমি কি ফকির ?চুমু ভিক্ষে চাইতে এসেছি?
ভালো করে দেহ!
“মেজর মুহিত কালকে মজা বোঝাবো তোমাকে তুমি এখন ভাগো এখান থেকে।
বলে বেলকনিতে টেনে এনে পাইপ নির্দেশ করে বলে উঠলো নেমে যাও।
অসহায় মুহিতকে বারান্দায় ফেলে মুখ টিপে হেসে বেলকনির দরজা আটকে দিলো স্বর্গ।
মুহিত সহসাই মেসেজ পাঠালো স্বর্গের ফোনে
“আমাকে দূর দূর করে তাড়িয়ে দেয়া?
কালকে এর শোধ তুলবো
রেডি থাকবেন মিসেস ওয়াসিফ।
#চলবে