#তোমার_জন্য_সিন্ধুর_নীল
#পর্ব_২৯
#সারিকা_হোসাইন
রাত বারোটা বাজতে আর দু মিনিট বাকী।তৈরি হচ্ছে সৌম্য আর আদ্রিয়ান।মুহিত আগেই চলে গিয়েছে সেই জায়গায়।চারপাশে খুজ লাগানো ভীষন জরুরী।
এতোটা রাত হবার পরেও চারিপাশে অন্ধকার রাতের পরিবর্তে আলোর রোশনাইয়ে ঝা চকচক করছে সব কিছু।
কালো শার্ট,কালো প্যান্ট কালো বুটস আর কালো ক্যাপে নিজেদের আবৃত করেছে আজকে তিন জন যুবক।
মুহিতের পাঠানো লোকেশন গুগল ম্যাপ এ সার্চ দিয়ে হোটেল থেকে বেরিয়ে এলো সৌম্য আর আদ্রিয়ান।
মুহিত বারের সামনে দাঁড়িয়ে আছে।বারের ফ্রন্ট এরিয়াতে তেমন লোক সমাগম নেই।সন্ধ্যার দিকে এই জায়গাটা লোকে লোকারণ্য হয়ে থাকে।ব্লুটুথ ডিভাইসে ক্লিক করে সৌম্য আর আদ্রিয়ান এর উদ্দেশ্যে বলে উঠলো
―অল ওকে।
মুহিত ধীরে ধীরে ভেতরে প্রবেশ করলো।চার পাশে মানুষ নেশায় বুদ হয়ে পড়ে আছে।কিছু মানুষ ফ্লোরে চিৎ হয়ে পড়ে আছে।হুশ নেই বললেই চলে।
মুহিত কোনো রকমে তাদের পাশ কাটিয়ে কটেজের রাস্তা ধরলো।
সামনেই টহল রত সিকিউরিটি দেখে একটি বড় পিলারের পেছনে লুকিয়ে পড়লো মুহিত।সিকিউরিটি সরে যেতেই হনহন করে হাঁটা ধরলো মুহিত।
কাঙ্ক্ষিত রুমের সামনে এসেই কোমরে গুঁজে রাখা রিভলবার বের করে পজিশন নিলো।
এরপর দরজা তে নক করলো।দরজা কেউ খুলছে না এদিকে বাইরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করার মতো সময় মুহিতের কাছে নেই।সপাটে লাথি দিতেই খুলে গেলো দরজা।কক্ষে প্রবেশ করলো মুহিত।
ঘুটঘুটে অন্ধকার কক্ষ,কিছুই দেখা যাচ্ছে না।ফোনের ফ্লাশ জ্বালিয়ে সুইচ বোর্ড খুঁজে লাইট জ্বালাতেই চোখ চড়ক গাছ।
কক্ষ পুরো খালি।ছোট একটা কক্ষ যার একপাশে একটা বেড পাতা আর কর্নারে দুটো সোফা বসানো।আর কিছুই নেই।
লাইটস নিভিয়ে ধীরে ধীরে মুহিত কক্ষ ত্যাগ করে বেরিয়ে এলো।
এর পর সৌম্য আর আদ্রিয়ান কে নিয়ে চলে গেলো ফোর জিরো ফোর এর সামনে।
তিনজনেই বন্দুক তাক করে অতর্কিত ভাবে ঢুকে পড়লো কক্ষে।
সেটাও খালি।
কারোর ই বোধগম্য হলো না ঘটনা টা।
রুমের বাইরে এসে মুহিত দৌড়ে সেই ফুলদানির কাছে গিয়ে দেখতে পেলো ক্যামেরাটা সেখানে নেই।
ক্যামেরার পরিবর্তে সেখানে একটা চিরকুট রাখা হয়েছে।
দ্রুত চিরকুট পকেটে ঢুকিয়ে বার থেকে বেরিয়ে এলো ওরা তিনজন।
বার থেকে একটু নিরাপদ জায়গায় বসে চিরকুট টি পকেট থেকে বের করলো মুহিত।
গোটা গোটা অক্ষরে লিখা
―এতো সহজেই ধরে ফেলবি ভেবেছিলি?
দিলাম তো ডজ।কেমন লাগলো মেজর?
আমি জানতাম আমার নিমকহারাম ছেলে তোকে সব বলে দিবে।
আর তুই ও ঈগলের মতো চলে আসবি শিকার খুঁজতে।
এরকম হাইড এন্ড সিক আর ভালো লাগছে না।
চল সামনা সামনি বসে তোর সাথে কথা বলি।
নিম্নলিখিত ঠিকানায় কাল বিকেল পাঁচটায় চলে আয়।
আর হ্যা নিজের সাঙ্গপাঙ্গ দের রেখে আসবি।
জানিস ই তো ক্যাপ্টেন সৌম্যের বউ টা এতিম!
রাগে চোয়াল শক্ত হয়ে গেলো মুহিতের।চিঠিটা একে একে প্রত্যেকে উল্টে পাল্টে পড়লো।
সৌম্য আর আদ্রিয়ান এর এক জেদ তারা মুহিত কে একা ছাড়বে না।
কিছুক্ষন মৌন রইলো মুহিত।এরপর তিনজন মিলে এক দুর্দান্ত ফন্দি আটলো।
ক্রুর হাসলো মুহিত ।
অপেক্ষা আগামী দিনের সূর্য ওঠার।
――――
আশরাফ চৌধুরী একটি আরাম কেদারায় পায়ের উপর পা তুলে ভ্যাপ এর ধোয়া ফুকছেন আর রাগে ফুঁসছেন।
ওই মেজর এখান পর্যন্ত চলে এসেছে এতো দ্রুত?
তার এখানের খবর আহিয়ান ছাড়া কেউ জানবার কথা নয়।তার মানে জানোয়ারটা এতদিন ভং ধরে ছিলো?আহমেদ কসাই এর নাকের ডগায় বসে এতো নিখুঁত অভিনয় করে গেলো যে সে ধরতেই পারলো না?
কতোবার মন চেয়েছে হাজতের ভেতরই ঝুলিয়ে দিতে।কেন যে দিলো না তখন ভাবতেই ছুড়ে মারলো ভ্যাপারের পাইপ খানা।
কোথাও গিয়ে দুদন্ড শান্তিতে থাকা যাচ্ছে না,কি মুসিবত।
কাল দেখিয়ে দেবো মেজর কে আমার সাথে লাগতে আসার ফল।বাপ ভাইয়ের পরিণতি দেখেও যার শিক্ষা হয়নি তাকে আর কিভাবে শিক্ষা দেবে আশরাফ চৌধুরী?
ভাবনা ফেলে দুই হাতের সহায়তায় জোরে তালি দিতেই বাধ্য দাসের ন্যায় আটজন ছেলে সারি বদ্ধ ভাবে আশরাফ চৌধুরীর দুই পাশে দাঁড়ালো।
মুহিতের বর্ননা দিয়ে আশরাফ চৌধুরী ছেলে গুলোকে উদ্দেশ্য করে থাই ভাষায় বলে উঠলো
―দেখা মাত্র হাত পা ভেঙে মাটির সাথে মিশিয়ে দেবে।
ছেলেগুলো দুই হাত বুকে ভাঁজ করে মাথা নিচু করে এক যোগে বলে উঠলো
-ওকে।
চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন আশরাফ চৌধুরী।কাল তার অনেক কাজ।ওই মেজর কে একটা চূড়ান্ত সত্য জানানো বাকি আছে এখনো।ওই সত্যের ধাক্কাটা আগে দিয়ে একদম কাবু করে ফেলবে।বলেই কিটকিটিয়ে হেসে উঠলো এবং হনহন করে কক্ষ ছেড়ে বেরিয়ে গেলো।
*****
আজ সেই অপেক্ষাকৃত দিন।
ঘড়ির ঘন্টা কাটা চারের ঘরে ঠেকতেই ঢং ঢং করে আওয়াজ তুলে জানান দিলো এখন চারটা বাজে।
মুহিত দ্রুত তৈরি হয়ে হোটেল থেকে বেরিয়ে এলো।
এখান থেকে গুগল ম্যাপ লোকেশন আধা ঘন্টার রাস্তা দেখাচ্ছে।
মুহিত কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর একটা বাইক রাইড বুক করে ড্রাইভার কে লোকেশন সেন্ড করলো।
একক ভাবে প্রভাবশালী কোনো পরিবহনের প্রচলন না থাকায় এবং রাস্তায় বহু ক্যাটাগরির যানবাহনের জন্য জ্যামে পরিপূর্ণ এই শহর।
মুহিত ঘড়িতে বার বার শুধু সময় দেখে যাচ্ছে আর বিরক্তিতে মুখে চ সূচক শব্দ করছে।
দীর্ঘ পঞ্চান্ন মিনিটের যাত্রা শেষ করে মুহিত এখন উপস্থিত হয়েছে ফুকেট ফাইট ক্লাব এর সামনে।
জায়গাটা মেইন শহর থেকে একটু দূরে জনমানব সংখ্যা খুবই কম এমন একটি জায়গায়।
নিজেকে স্বাভাবিক করে মুহিত ভেতরে ঢোকার উদ্দেশ্যে পা বাড়ালো।
দরজা তে নক করতেই একটি ছোট বাচ্চা ছেলে দরজা খুলে দিয়ে মাথা নিচু করে স্বাগত জানালো।
কাঠের বড় পাল্লার দরজা পার হতেই ছেলেটি হাতের ইশারায় বাম পাশের রাস্তা নির্দেশ করলো।
মুহিত ছেলেটির দেখানো পথে চারপাশে চোখ বুলিয়ে হাটতে লাগলো।
জায়গা টা বাহির থেকে দেখলে বোঝার কোনো উপায় নেই যে ,ভিতরে বিশাল খোলা জায়গা আছে।
ক্লাবের ভিতরে ফাইটিং এর সকল জিনসে পরিপূর্ণ।
মুহিত মনে মনে ভাবছে এমন জায়গায় তাকে ডাকার কি কারন থাকতে পারে আশরাফ চৌধুরীর?
চলতে চলতে একটি বড় দরজা দেখতে পেলো মুহিত।কিছুক্ষন ভেবে হাতের মুঠের সাহায্যে ঠক ঠক শব্দ করলো।
নিমিষেই দুই পাশ থেকে দুজন ব্যাক্তি দরজার পাল্লা সরিয়ে মুহিত কে ভেতরে ঢুকতে দিলো।
মুহিত ভেতরে প্রবেশ করতেই আশরাফ চৌধুরী খুশিতে গদ গদ হয়ে বললো
― এসো মেজর এসো।
―স্বাগতম তোমাকে আমার মেহমান খানায়।
আশরাফ চৌধুরীর এতো সমাদর মুহিতের কাছে ভালো ঠেকছে না।
কথায় বলে অতি ভক্তি চোরের লক্ষণ।
মুহিত চুপ করে সব কিছু পর্যবেক্ষণ করে যাচ্ছে শুধু।
নীরবতা ভেঙে আবারো আশরাফ চৌধুরী বলে উঠলো
―তোমার জন্য কোথাও তো শান্তিতে টেকা যাচ্ছে না মেজর।নিজেও শান্তিতে থাকছো না অন্যকেউ দিচ্ছ না।
―তারচেয়ে বরং চলো আজকে তোমাকে শান্ত করে দেই।
বলেই হাত তালি দিয়ে উঠলো আশরাফ চৌধুরী।
মুহূর্তেই ছেলেগুলো দৌড়ে আশরাফ চৌধুরীর সামনে এসে দাড়ালো ।
একটি ছেলেকে উদ্দেশ্য করে আশরাফ চৌধুরী বলে উঠলো
―ড্যানিয়েল চেক হিম!
ড্যানিয়েল নামের ছেলেটি দৌড়ে এসে মুহিত কে পা থেকে মাথা পর্যন্ত সার্চ করে কিছুই পেলো না।
ছেলেটি ফিরে যেতেই বাঁকা হাসলো মুহিত।
মুহিতের ভাবভঙ্গি কিছুই আশরাফ চৌধুরীর ভালো লাগছে না।
যতো দ্রুত এই মেজরের থেকে নিস্তার পাওয়া যায় ততোই মঙ্গল।
আশরাফ চৌধুরী মুহিতের দিকে এগিয়ে এসে গলা খাকরি দিয়ে বলে উঠলো
―তা মেজর বাপ ভাইয়ের লাশ গুলো জানাজা করে দাফন করতে পেরেছিলে?
লাশ দাফনের কথা শুনেই মুহিত মুষড়ে উঠলো।অজানা নীল ব্যাথায় সর্বাঙ্গ দুর্বল হলো।বুকে তোলপাড় শুরু হলো।
মুহিত কোথাও খুঁজে পায়নি তার বাবা আর মাসুম ভাইয়ের লাশ।
কতো মর্গ কতো জায়গায় তল্লাশি চালিয়েছে।
লাভের ফল বরাবরই শূন্যের কোঠায় ছিলো।
মুহিতের নীরবতা দেখে আশরাফ চৌধুরী বলে উঠলো
―চলো মেজর একটা ম্যাজিক দেখাই তোমাকে।
বলতেই দুটো ছেলে ধরাধরি করে একটা কফিন আনলো।
মুহিতের সামনে কফিনটা রাখার নির্দেশ দিলেন আশরাফ চৌধুরী।
ছেলে গুলো কফিন রেখে সোজা হয়ে মুহিতের পেছনে বুকে হাত ভাঁজ করে দাঁড়ালো।
আশরাফ চৌধুরী হাটু ভাঁজ করে বসে কফিনের ঢাকনা খোলতে তৎপর হলেন।
মুহিত যেনো কিছু বলার ভাষাই খুঁজে পাচ্ছে না।
এতোগুলো বছর পর আশরাফ চৌধুরী লাশ দাফনের কথা বলে এভাবে কেনো ব্যাথিত করবে মুহিত কে?
একজন সন্তানের কাছে পিতার লাশ দাফনের কার্য সম্পন্ন করতে না পারার যে কষ্ট বা ব্যার্থতা।এটা কি আশরাফ চৌধুরী বুঝবে?
নিমিষেই খুট করে খুলে গেলো কফিনের দরজা।ধ্যান ভাঙলো মুহিতের।
কফিনের দিকে দৃষ্টি দিতেই হাটু গেড়ে বসে গেলো মুহিত।
লাশটি আর কারো নয় তার বাবা আদনান ওয়াসিফ এর লাশ।
লাশটি দেখেই আশরাফ চৌধুরী হুহু করে হেসে উঠলো।
মুহিত কে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো
―দেখ মেজর তোর বাপ কে কতো যত্ন করে রেখে দিয়েছি আমি।অনেক ভুগিয়েছিলো আমাকে।যখন কোনো কারণ খুঁজে না ই রাগ
করার জন্য!তখন তোর বাবার লাশ টা বের করে দেখি।
খুব রাগ হয় তখন জানিস?
তখন রাগের চোটে মনে চায় সব জ্বালিয়ে দেই।
তোর ভাইয়ের লাশ ও আছে রে মেজর ।
ওটাও রেখেছি।ফেলতে পারিনি,মায়া লেগেছে ছেলেটার জন্য বলেই ছেলে দুটোকে নির্দেশ দিলো ছোট কফিনটা নিয়ে আসতে।
ছেলে দুটো কফিন নিয়ে এসে মুহিতের সামনে রাখতেই মুহিত কফিন খোলার জন্য উন্মাদ হয়ে গেলো।
মুহিতের এমন অস্বাভাবিক আচরণে আশরাফ চৌধুরী হেসে কুটিকুটি হচ্ছে।
তার ভাব দেখে মনে হচ্ছে এমন হাস্যকর দৃশ্য পৃথিবীতে দ্বিতীয়টি আর হয় না।
মুকিতের কফিনটা মুহূর্তেই খুলে ফেললো মুহিত।
একপাশে বাবার আরেক পাশে প্রানপ্রিয় আদরের ভাইয়ের মেডিসিন মিশ্রিত ফ্যাকাশে লাশ দেখে মুহিতের বুকে ব্যাথা শুরু হলো।
টপটপ করে শুধু মুহিতের চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে।মুহিত মুখে কিছুই বলতে পারছে না।
লাশ গুলোর মেডিসিনের ঝাঁঝালো গন্ধে প্রত্যেকে নাকে রুমাল গুজলো।
মুহিত সেভাবেই ঠাঁয় বসে রয়েছে।
কিছুক্ষন বাদে আশরাফ চৌধুরী হুংকার দিলেন কফিন দুটো নিয়ে যেতে।
ছেলে গুলো কফিন নিয়ে যেতেই আশরাফ চৌধুরী ড্যানিয়েল নামের ছেলেটিকে বললেন
―কিল হিম।
আশরাফ চৌধুরীর নির্দেশ পাওয়া মাত্র ছেলেগুলো মুহিত কে ঘিরে ফেললো চার পাশ থেকে।
মুহিত মাটির দিকে দৃষ্টি দিয়ে এক ধ্যানে বসে রয়েছে।
ছেলে গুলোর মধ্য থেকে “তায়ও” নামের ছেলেটি মুহিত কে শার্টের কলারে ধরে টেনে দাঁড় করালো।
মুহিতের আজকে নিজেকে ভারসাম্য হীন মানুষ বলে মনে হচ্ছে,যার পায়ে বল নেই,মনে জোড় নেই,মাথা বুদ্ধিশুণ্য।
মুহিতের মা এই লাশ গুলো দেখে আবার জীবন্মৃত হয়ে যাবে?
আবার এই বেদনায় ভরা অতীতের পুনরাবৃত্তি হবে?
মুহিতের ভাবনার মাঝেই মুহিতের মুখ বরাবর একটা পাঞ্চ মেরে দিলো বডিবিল্ডার দের মতো দেখতে একটি ছেলে।
টাল সামলাতে না পেরে পরে গেলো মুহিত।সে এখনো নির্বিকার।ঠোঁট ফেটে রক্ত ঝরছে সেদিকে তার কোনো খেয়াল নেই।জড়বস্তু লাগছে তার নিজের কাছেই।
হঠাৎ ই মুকিতের স্বপ্নে বলা কথা গুলো মনে পড়লো মুহিতের।
―ভাইয়া তুমি কাপুরুষ, পাপা তোমাকে তার যোগ্য পুত্র ভেবে অনেক দায়িত্ব দিয়ে এসেছিলো।
তুমি কিছুই পালন করো নি।তুমি চলে যাও আমাদের দরজার সামনে থেকে।পাপা কোনোদিন আর তোমার সাথে কথা বলবে না।
চলে যাও,চলে যাও ভাইয়া,চলে যাও।
চোখ খুলে উঠে দাঁড়ালো মুহিত।
সে এখান থেকে জ্যান্ত ফিরবে সাথে বাপ ভাইয়ের লাশ নিয়েই ফিরবে।
পিছন মুড়ে সব গুলো ছেলেকে দেখে নিলো মুহিত।
প্রত্যেক টা ছেলের শরীরের গঠন,উচ্চতা,গায়ের রঙ এক।শুধু চেহারা আলাদা।এরা সবাই যে ভালো ফাইট জানে তা তাদের শরীর আর আশেপাশের ইকুইপমেন্ট দেখেই বোঝা যাচ্ছে।
ছেলে গুলো খালি গা,সবার পরনে কালো প্যান্ট আর বুটস।
ধবধবে ফর্সা শরীরে মাসেল গুলো চকচক করছে।
মুহিত এদের সাথে শক্তিতে পারবে কিনা জানেনা।
কিন্তু মনোবল হারাবে না সে।পারতে তাকে হবেই।
নিজের গায়ের শার্ট খুলে ছুড়ে মারলো মুহিত।
শার্টের ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো মুহিতের মাসেল যুক্ত জিম করা শক্ত বডি।
ঘাড় ঘুরিয়ে কটকট শব্দে হাড়ের গিট ফুটিয়ে নিজেকে রিল্যাক্স করলো মুহিত।
ছেলেগুলো কারাতে পোজে ঘিরে দাঁড়িয়ে গেলো মুহিতের চার পাশে।
বাঁকা হাসলো মুহিত।
মুহিত নিজেও একজন কারাতে ব্ল্যাক বেল্ট পাওয়া চ্যাম্পিয়ন।কিন্তু ভাবে কিছুই প্রকাশ করলো না।
আস্তে ধীরে কোমরে হাত দিয়ে খুলে ফেললো বেল্ট এর বকলেস এর পিন।
ছেলে গুলো এগিয়ে আসতেই সহসাই বেল্ট খুলে হাতে পেঁচিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বাড়ি দিতে লাগলো।
ছেলে গুলো সামান্য আহত হয়ে ছিটকে পড়ে গেলো।
আহত বাঘের ন্যায় ফুসফুস করতে করতে ছেলে গুলো উঠে দাঁড়ালো।একটা ছেলে দৌড়ে এসে মুহিতের পেট বরাবর পাঞ্চ মারার ট্রাই করলো।
মুহিত তার বুদ্ধি আর শক্তির সাহায্যে ছেলেটির পাঞ্চ ব্লক করে নিজের হাটু দিয়ে ছেলেটিকে তলপেট বরাবর আঘাত করলো।এর পর কুনুই দিয়ে বুকে আঘাত করতেই মাটিতে লুটিয়ে পড়লো ছেলেটা।
দৌড়ে এলো আরো দুটো ছেলে।পেছন থেকে দুজনেই মুহিত কে ঝাপটে ধরলো।
মুহিত কুনুই এর সহায়তায় তাদের দুজনকেই বুকের খাঁচা বরাবর আঘাত করলো ছেলে গুলো ছিটকে না পড়ে মুহিত কে আরো ভালো করে চেপে ধরলো।
মুহিত তার সমস্ত শক্তি দিয়ে হাত ঝাড়া দিয়ে ফেলে দিলো ছেলে দুটো কে।
এর পর দৌড়ে একটা ওয়ালের অর্ধেক পর্যন্ত উঠে ঝাঁপিয়ে পড়লো ছেলে গুলোর উপর।
দুই পাশ থেকে দুটো ছেলের হাত মুচড়ে ধরে উল্টিয়ে ভেঙে দিলো মুহিত।
হঠাৎ ই একটা ছেলে চাইনিজ চপার আর কুড়াল নিয়ে আক্রমন করতে এলো।
হঠাৎই সৌম্য আর আদ্রিয়ান দৌড়ে এসে প্রটেক্ট করলো মুহিত কে।
শুরু হলো ফাইট।
কেউ কারো থেকে কম যাচ্ছে না।
দুই পাশের মানুষেরই রক্ত ঝরে যাচ্ছে সমানে।
বিভিন্ন মিলিটারি কায়দায় ,শক্তি বলে আর বুদ্ধির জোড়ে সব গুলো ছেলেকে কাবু করে ফেললো তারা তিন জনে।
হঠাৎ ই পেছন থেকে একটা চাইনিজ চপার ছুড়ে মারলো মুহিতের দিকে।সৌম্য চিৎকার করতেই মুহিত সাইড হয়ে সরে যায়।
ধারালো সেই চপার মুহিতের সামনের দেয়ালে লেগে অর্ধেক ঢুকে গেলো।
এবার মুহিতের মাথায় খুন চেপে গেলো।
রক্ত চক্ষু নিয়ে হাত মুষ্টি বদ্ধ করে এগিয়ে গেলো চপার এর দিকে।
শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে টেনে বের করলো চপার টা।
এরপর সেটা নিয়ে দৌড়ে আশরাফ চৌধুরীর দিকে এগুতে থাকলো।
আশরাফ চৌধুরী যেনো নড়ার ক্ষমতা হারিয়ে ফেললো এই মুহূর্তে।
মুহিত দৌড়ে এসে সেই চপার দিয়ে কোপ বসিয়ে দিলো আশরাফ চৌধুরীর বুক বরাবর।
বুকের দিকে তাকিয়ে চোখ বড় বড় করে ফেললেন আশরাফ চৌধুরী।
গল গল করে রক্ত বেরিয়ে যাচ্ছে সমানে।
একের পর এক এলোপাতাড়ি কুপিয়ে যাচ্ছে মুহিত।
এক সময় আশরাফ চৌধুরী লুটিয়ে পড়লো মাটিতে।
হাটু মুড়ে বসে আশরাফ চৌধুরীর চুল টেনে বসালো মুহিত।
এর পর দাঁতে দাঁত পিষে বলে উঠলো
তুই মোটেও কোপানোর উস্তাদ নস।এক্সপার্ট হলে আমাকে মারতে সক্ষম হতি।বলেই তাচ্ছিল্য পূর্ণ হেসে উঠলো মুহিত।
― আর শোন, তোর ছেলেই তোর মৃত্যুর কাল হলো রে আহমেদ।আমি চির কৃতজ্ঞ তোর ছেলের কাছে।এজন্য তাকে আমি জেল থেকে পালাতে সাহায্য করেছি।
এবার তুই শান্তিতে মর বলেই গলা বরাবর চালিয়ে দিলো চপার টা।
আশরাফ চৌধুরী চোখ বড় করে হা করে শেষ নিঃশ্বাস নিলেন।
মুহিত দৌড়ে চলে গেলো কফিন দুটোর কাছে।
মেজর আদ্রিয়ান আর সৌম্যকে ধরতে বললো তার বাবার কফিন
আর নিজে কাঁধে তুলে নিলো আদরের ছোট ভাইয়ের ছোট কফিন টি।।
ফাইটিং ক্লাব থেকে বেরিয়ে গেলো মুহিতরা,পরে রইলো মৃত আশরাফ চৌধুরীর ক্ষতবিক্ষত লাশ।যা এই অজানা শহরে ধরার কেউ নেই,কবর ,জানাজা এসব করার ও কেউ নেই।
মেজর আদ্রিয়ান আর্মি হেডকোয়ার্টার এ মুহিতের বাবা আর ভাইয়ের লাশের কথা জানালেন।
ওখান থেকেই লাশ নেবার সমস্ত কিছু রেডি করে দিবেন।
থাইল্যান্ডের কর্পস প্রিজারভেটিং ফ্রিজে কফিন দুটো রেখে চলে এলো মুহিত।
হোটেলে এসে লম্বা শাওয়ার নিয়ে বেরিয়ে ফোন হাতে তুললো মুহিত।
ডায়াল করলো নির্দিষ্ট নম্বরে।
রিং হতেই ফোন তুললো ওপাশের ব্যাক্তি
―সোহাগ ভাই !
#চলবে
#তোমার_জন্য_সিন্ধুর_নীল
#পর্ব_৩০
#সারিকা_হোসাইন
এক লহমায় কেটে গিয়েছে পনেরটি দিন।সোহাগ নামিরা দের নিয়ে দেশে ফিরে এসেছে।
মিসেস তারিন কোনোভাবেই আর নাফিজ মাহমুদ এর বাংলো তে থাকতে রাজি নন।তিনি তার ছেলে মেয়েদের নিয়ে তার স্বামীর পুরাতন বাড়িটা তে বাকী যে কদিন বাঁচবেন সে কদিন কাটাতে চান।
পুরাতন যেই ক্ষত দীর্ঘ সাড়ে ছয় বছরে কিছুটা সেরে উঠেছে মুহিতের ফোন কল পাবার পর থেকে পুরোনো সেই ক্ষত থেকে চুয়ে চুয়ে যেনো গড়িয়ে পড়ছে লাল টকটকে রক্তের ধারা।
বাংলাদেশ আর্মি হেডকোয়ার্টার মুহিতের বাবা আর ভাইয়ের লাশ বাংলাদেশে আনার সকল ব্যাবস্থা করে দিয়েছে।
আগামীকাল ভোরের ফ্লাইটে তারা বাংলাদেশে পৌঁছুবে।
নামিরা থেকে থেকে শুধু কেঁদেই যাচ্ছে।নামিরার কোলের আড়াই মাসের বাচ্চাটা থেকে থেকে করুন সুরে কেঁদে উঠছে।হয়তো মায়ের কান্না অবুঝ শিশুটিও সহ্য করতে পারছে না।
স্বর্গ বাচ্চাটাকে নামিরার কোল থেকে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলো।একদিকে ভ্যাপসা গরম তার মধ্যে কান্নাকাটি।বাচ্চাটা একদম নেতিয়ে যাচ্ছে।
কিন্তু এতকিছুর ভিড়ে মিসেস তারিন নির্বিকার।দীর্ঘ বছরের শোক সইতে সইতে পাথরে পরিণত হয়েছেন।
তনুজার কাছে এই মুহূর্তে তারিন কে রোবট মনে হচ্ছে।অবশ্য জন্ত্র মানবী বলাই চলে।
যার হৃদ ক্রিয়া চালানোর জন্য একটা আস্ত মেশিন বুকের ভেতর বসানো হয়েছে সে কি আর নরম দিলের মানুষ আছেন?
কিছু লোক লাগিয়ে বাড়ির পাশের জঙ্গল গুলো পরিস্কার করানো হচ্ছে।কাজের লোকেরা বাড়ি ঘর ধুয়ে মুছে সাফ করছেন।মনে হচ্ছে বিশেষ কোনো অতিথি এই বাড়িতে আসবেন।তার জন্য এতো এতো আয়োজন।
――――――
শুক্রবার,১২ ই আগস্ট
আজকের আবহাওয়া টা মনোরম।আকাশে তীক্ষ্ণ রোদের তেজ নেই।ধরনীতে স্বর্গের হাওয়া বিরাজ করছে সর্বত্র।বাতাসে মিষ্টি একটা গন্ধ ভেসে বেড়াচ্ছে যেনো সারাক্ষন।এতো এতো কাজ কর্ম করেও কেউ হাপাচ্ছে না।
মুহিত বিমানে উঠার আগে ফোন করে জানিয়েছে যে,তারা আসছে।
মুহিতের দাদা বাড়ির কিছু নিকট আত্মীয় বাসায় ভিড় করেছে।কেউ কেউ কোরআন তেলাওয়াত, তসবিহ পাঠে ব্যাস্ত।
নামিরার কান্না যেনো শেষ ই হচ্ছে না।
যেই ব্যাথা নতুন অতিথি পেয়ে ভুলতে বসেছিলো সেই ব্যাথা আবার কিভাবে ফিরে এলো?
―ওরে আল্লাহ তুমি কেনো এতো নিষ্ঠুর হলে আমাদের প্রতি?
সকাল পেরিয়ে দুপুর গড়াতেই পু পু সাইরেন এর আওয়াজ পাওয়া গেলো।
আদনান ওয়াসিফ এর বিশাল তিন তলা বাড়ির খোলা প্রাঙ্গণে প্রথমে একটি পুলিশের গাড়ি প্রবেশ করলো।এর পর দুটো আর্মি জিপ।এরপর মুহিত দের এম্বুলেন্স।
পিছে পিছে এলো মন্ত্রী মহোদয় এর গাড়ি।
নিমিষেই মানুষে গিজগিজ করে উঠলো আদনান ওয়াসিফ এর পরিত্যক্ত খালি বাড়িটি।
কান্নার আওয়াজ বাড়ালো নামিরা।বাইরে বের হবার জন্য পাগল হয়ে গেছে সে।স্বর্গ আর তনুজা কেঁদে চলেছে নামিরাকে জড়িয়ে।
সোহাগ ছোট বাচ্চাটা কে নিয়ে পায়চারি করছে আর চোখের জল মুছছে।
অপরাধীর ন্যায় মুহিত ঘরে প্রবেশ করলো।
তার সারা শরীর ছোট ছোট জখমে ভর্তি ।মুহিতের রোগা মলিন চেহারা দেখে স্বর্গের বুক ধক করে উঠলো।
কিন্তু পরিস্থিতি এখন অন্য ধাঁচের।
মুহিতের কাছে এখন গিয়ে এসব নিয়ে কথা বলার প্রশ্নই আসে না।
মুহিত ড্রয়িং রুমে এসে জোরে ডেকে উঠলো
―মা!
মিসেস তারিন আজ নিজেকে সজ্জিত করেছেন।
গায়ে জড়িয়েছেন ধবধবে সাদা শাড়ি।মধ্যে খানে সিঁথি করে শক্ত করে হাত খোঁপা করে বেঁধে নিলেন।চোখের চশমাটা ঠিক করে মাথায় কাপড় দিয়ে দূতলার আদনান ওয়াসিফ এর ঘর থেকে ধীরপায়ে বেরিয়ে এলেন।
মুহিত তার মায়ের এমন নির্বিকার রূপ দেখে প্রচন্ড ভয় পেয়ে গেলো।তার মা কি পাগল হয়ে গেলো অধিক শোকে?
মা কি আবার হারিয়ে যাবে তাদের জীবন থেকে?
নামিরা সহসাই এসে ঝাপটে ধরলো মুহিত কে।কেঁদে ভাসালো মুহিতের বুক।
নাফিজ মাহমুদ নিজেই কাউকে শান্তনা দেবার অবস্থায় নেই।নিমিষেই পুরো বাড়িটি শোকের মাতমে ছেয়ে গেলো।
মুহিত আজ তার শক্ত খোলস থেকে বেরিয়ে বোনের সাথে মিলে কাঁদছে।ছোট বাচ্চার মতো কাঁদছে মুহিত।
মুহিতের কান্না দেখে স্বর্গ নিজেকে সামলাতে পারছে না।
মেজর আদ্রিয়ান আর সৌম্য এসে মুহিত কে শান্ত করার অনেক চেষ্টা করলো।
মিসেস তারিন এসে মুহিতের সামনে দাঁড়ালেন।
মুহিত অসহায় ভাবে তার মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো
―পাপাকে নিয়ে এসেছি মাম্মা!
মিসেস তারিন আজ একটুও কাঁদলেন না।মুহিত কে কঠিন সুরে আদেশ দিলেন
―যাও তোমার পাপার লাশ গাড়ি থেকে বের করে আনো।তাকে ধোঁয়ানোর ব্যাবস্থা করো।দ্রুত জানাজা যে দিতে হবে মুহিত।
মায়ের আদেশ পেয়ে মুহিত দৌড়ে ফ্রিজিং কারের নিকট আসে।
লাশ গাড়ি থেকে নামানোর আগে পুলিশ আর রিপোর্টার এসে মুহিত কে বিভিন্ন জেরা শুরু করে।
আর্মি জেনারেল এটা দেখে রেগে গিয়ে পুলিশকে ধমকে উঠেন।
পুলিশ সরতেই তিনি আরো কয়েকজন সোলজার ডেকে কফিন গুলো নামাতে আদেশ দেন।
বিশাল বড় ড্রয়িং রুমের ফাঁকা জায়গায় পরপর দুটো খয়েরি রঙের কফিন সাজিয়ে রাখা হয়েছে।
মুহিতের মা আদেশ দিলেন কফিনের ঢাকনা খুলতে।
আদ্রিয়ান আর সৌম্য ঢাকনা খুলতেই নামিরা একবার বাবার কাছে একবার মুকিতের কাছে গিয়ে পাগলের মতো বিলাপ করতে শুরু করে।
মুকিতের ফ্যাকাশে মায়াবী মুখখানা প্রত্যেকটি মানুষের হৃদয় কে মুষড়ে দিলো।কেউ কেউ কষ্টে জ্ঞান হারিয়ে ফেললো।
মুকিতের কফিনের কাছে গিয়ে মিসেস তারিন হাটু ভেঙে বসে পড়লেন।
নরম সুরে ডেকে উঠলেন
―মুকিত!মানিক আমার,এই দেখ মাম্মা বসে আছি,চোখ খুলবি না?
কিন্তু হায় আদরের মুকিত।সে তো চোখ খুলে না।
এবার মিসেস তারিন আদনান ওয়াসিফ এর কফিনের কাছে এলেন।
―আদনান,এই আদনান উঠবে না?
কথা বলবে না আমার সাথে?
অনেক দিন তোমার সাথে মন খুলে কথা হয়না।
আমাকে নিঃস করে দিয়ে বাবা ছেলে কী সুন্দর ঘুমাচ্ছ নাহ?
নীরবে অশ্রু বিসর্জন দিলেন মিসেস তারিন।হাউমাউ করে কাঁদার ক্ষমতাও হারিয়েছেন বহু আগেই।
একটু কাঁদলেই বুকে অসহনীয় ব্যাথা অনুভূত হয়।দম আটকে আসে।
মুহিত এসে তার মা কে জড়িয়ে ধরলো।সোহাগ কারো কাছে বাচ্চাটা গছিয়ে দিয়ে কফিনের কাছে এসে বাচ্চাদের মতো ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো।
যেই মানুষটা তাকে এতো বড় করলো,বিপদ থেকে উদ্ধার করলো।অথচ সোহাগ সেই মানুষটির কোনো উপকারেই আসলো না।
এর চাইতে নির্মম কিছু কি ধরনীতে আর কিছু আছে?
নিজেকে স্বাভাবিক করে নাফিজ মাহমুদ কে ডাকলেন মিসেস তারিন।
―তোর দোলাভাই এর গোসল এর ব্যাবস্থা কর।
যেহেতু লাশ গুলো দীর্ঘদিন প্রিজারভেটিং করা ছিলো তাই দীর্ঘ সময় এগুলো এভাবে না ফেলে রাখাই ভালো।
রোগ জীবাণু বা ভাইরাস ছড়াতে পারে যখন তখন।
নাফিজ মাহমুদের হুকুমে কয়েকজন লোক এসে গোসলের কাজ শুরু করে দিলো।
একে একে আদনান ওয়াসিফ আর মুকিতের গোসল শেষে তাদের সাদা কাফনের কাপড় পরিয়ে খাটিয়ায় তোলা হলো।
তাদের জানাজা পড়তে দলে দলে মানুষ আসতে শুরু করলো।
আদনান ওয়াসিফ এর সহকর্মীরা এলেন।
হাজার লোকের সমাগমে শেষ হলো জানাজা।
মিসেস তারিন কবর কোথায় হবে সেটা আগেই দেখিয়ে দিয়েছিলেন।
জানাজা শেষে দ্রুত তাদের দাফনের ব্যাবস্থা করা হলো।
সমস্ত কাজ শেষ করতে করতে দুপুর গড়িয়ে রাত নামলো।
কিছু পুলিশ আর আর্মির বড় বড় অফিসাররা ভিড় করেছে মুহিতের বাসায়।
তাদের একটাই প্রশ্ন লাশ ওখানে কিভাবে গেলো?
মুহিত মেঝেতে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে বসে আছে।বাবা আর ভাইয়ের করুন চেহারা মনে পড়তেই চোখ থেকে খসে পড়লো মোটা মোটা দু ফোটা জল।
প্রশ্নবিদ্ধ নজরে প্রত্যেকে মুহিতের দিকে তাকিয়ে আছে।
নীরবতা ভেঙে মুহিত বলতে শুরু করলো
―যখন সবাই জানাজানি হতে শুরু করে যে নির্বাহী অফিসার আর তার ছেলেকে কেউ খুন করে দিয়েছে,ঠিক সেই মুহূর্তই পোস্টমর্টেম রিপোর্ট বদলে গিয়েছিলো।রিপোর্টের কোথাও লিখা ছিলো না যে পাপা আর মুকিত কে কুপিয়ে ,শ্বাসরোধ করে মারা হয়েছে।
পাপা আর মুকিতের লাশ সরিয়ে ফেলা হয়েছিলো আর আমাদের বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়েছিলো।
মুহূর্তেই খবরের কাগজে আর সংবাদ শিরোনামে হেডলাইন বের হয় যে সৎ নির্বাহী অফিসার আদনান ওয়াসিফ আর তার পরিবার আগুনে পুড়ে মারা গিয়েছে।তাদের দেহাবশেষ কোথাও খুঁজে পাওয়া যায়নি।
আমি আর মামা অনেক মর্গ অনেক হসপিটাল তন্ন তন্ন করে খুঁজেছি।কিন্তু কেউ সেই লাশের হদিস দিতে পারেনি।
আর্মি জেনারেল প্রশ্ন করলেন
―কোথায় তোমার সেই মামা মুহিত?
মুহিত আঙ্গুলি দিয়ে নাফিজ মাহমুদ এর দিকে নির্দেশ করলো।
সকলেই মুহিতের আঙ্গুল বরাবর তাকিয়ে অবাক হয়ে গেলো।
এক যোগে সবাই প্রশ্ন করলেন
―মেজর জেনারেল নাফিজ মাহমুদ তোমার মামা?
মুহিত মাথা নিচু করে জবাব দিলো জি স্যার।
তুমি একথা কেনো এতোদিন আমাদের বলো নি মুহিত? অবাকের স্বরে জানতে চাইলেন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল।
―আমি চাইনি আমার বাবা আর আর ভাইয়ের মতো মামাও হারিয়ে যাক।আশরাফ চৌধুরী পাপা কে বলেছিলো আমাদের যে হেল্প করবে তাকেই মেরে ফেলবে।
মুহিত কিছু স্থির চিত্র আর পেনড্রাইভ বের করে নিয়ে আসলো তার কক্ষ থেকে।
সেগুলো পুলিশের ডিআইজির হাতে তুলে দিয়ে মুহিত আহত সুরে বললো এখানে আশরাফ চৌধুরীর বিভিন্ন খারাপ কাজের সামিল হওয়া কিছু পুলিশ অফিসার এর তথ্য আছে।যারা মোটা অংকের ঘুষ খায় আর অপরাধ করে বেড়ায়।এখানে তাদের সকল বায়োডাটা আর কি কি অপরাধ করে তার সকল বিবরণ রয়েছে।পাপা নিজে এদের শাস্তি দিতে চেয়েছিলেন।
কিন্তু উনাকেই চিরতরে শেষ করে দেয়া হয়েছে।
আমি চাই আপনারা সকল প্রমাণের ভিত্তিতে তাদের এরেস্ট করুন।দেশকে কলুষিত মুক্ত করুন।
এর পর মুহিত আবার বলতে শুরু করলো―
মা যে বেঁচে ছিলো এটা আশরাফ চৌধুরী জানতেন না।
তিনি কৌশল খাটিয়ে লাশ গুলো থাইল্যান্ড নিয়ে যান।
সেখানে এগুলো এতোগুলো বছর প্রিজারভেটিং করা ছিলো।
উনি কেন এতদিন পর্যন্ত লাশ গুলো রেখেছিলেন তা আমার কাছে অজানা।
হয়তো পাপার মৃত্যুতে দেশে উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছিলো এজন্য তিনি নিজে বাঁচার জন্য লাশ পাচার করে গুম করে ছিলেন।
আশরাফ চৌধুরী এখন কোথায় আছেন?
জিজ্ঞেস করলেন এক পুলিশ অফিসার।
মুহিত সাবলীল কন্ঠে উত্তর দিলো
বন্দুক যুদ্ধে নিহত হয়েছেন তিনি।
আর্মি অফিসার রা পুলিশ গুলোকে নিয়ে বেরিয়ে গেলেন।
নাফিজ মাহমুদ বোনকে বিভিন্ন শান্তনা দিলেন।স্বর্গ এখনো ফুপিয়েই যাচ্ছে।
নামিরা জ্ঞান হারিয়ে পরে রয়েছে।
ইতোমধ্যে বাড়ি খালি হতে শুরু করেছে।ধীরে ধীরে আত্মীয় স্বজন ফিরে যাচ্ছে নিজ নিজ আবাসস্থলে।
মুহিত কে উদ্দেশ্য করে মিসেস তারিন বলে উঠলেন
―তুমি আমার মনের এতদিনের দাউদাউ করে জ্বলা আগুন নিভিয়ে দিয়েছো মুহিত।
তোমার বাবা সত্যি ই আমাদের জন্য তার অবর্তমানে একজন যোগ্য গার্ডিয়ান রেখে গিয়েছে।
এভাবেই আমাদের আগলে রেখো মুহিত ।
বলেই মুহিতের গালে মমতার হাত ছোয়ালেন মিসেস তারিন।
মায়ের আদুরে হাতের পরশে চোখ বন্ধ করে ফেললো মুহিত।টুপ করে গড়িয়ে পড়লো উষ্ণ দুফোটা জল।
মুহিতের আজকে সত্যি ই পিতার যোগ্য পুত্র মনে হচ্ছে।
মুহিত পেরেছে তার বাবা,ভাইয়ের লাশের জানাজা করে কবর দিতে এবং অপরাধীদের শাস্তি দিতে।
তার বাবা ভাইকে বেওয়ারিশ লাশ হতে হয়নি।
************-***********
সমস্ত ঝুট ঝামেলায় পেরিয়ে গেছে একটি মাস।
ধীরে ধীরে ক্ষত গুলো শুকিয়ে যাচ্ছে।
নিজের স্বামী সন্তানের কবরের দিকে তাকিয়েই শান্তিতে বুক ভরে নিঃশাস নেন মিসেস তারিন।
তিনি তার পাশেই পুত্র স্বামীর উপস্থিতি অনুধাবন করতে পারেন।
সবাই ধীরে ধীরে স্বাভাবিক জীবনযাপন এ অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছে।
আশরাফ চৌধুরী নামক মানুষের অস্তিত্ব ও ভুলতে বসেছে সবাই।
কেটে গিয়েছে আরো পনেরো দিন।
আজ সৌম্য আর পিউ এর রিশিপশন এর অনুষ্ঠান।
পিউ একটি লাল খয়েরি রঙের ভারী লেহেঙ্গা পড়েছে,সাথে ভারী ভারী ম্যাচিং করা পাথরের গহনা,ভারী মেকআপ।
সৌম্যের কাছে পিউকে অপ্সরা লাগছে।
বহু কষ্টে বেচারা নিজেকে ধরে রেখেছে।না হলে মন বার বার বলছে
―যা ব্যাটা জড়িয়ে ধরে চুমু খা।ঐটা তোর ই বউ।
সৌম্যের রিশিপশন এর আয়োজন করা হয়েছে সেনাকুঞ্জে।বড় বড় সকল আর্মি অফিসার এসেছেন নিমন্ত্রণ খেতে।
সৌম্য অলরেডি কোয়ার্টার এর জন্য আবেদন করেছে।আজকে আপাতত ভাড়া বাসায় উঠবে।বাসাটা অবশ্য পিউ এর পছন্দতেই নিয়েছে সৌম্য।
বিশাল ড্রয়িং রুম আর খোলা বারান্দা পিউ এর খুব পছন্দ।পিউ এর সকল চাওয়া পাওয়া অক্ষরে অক্ষরে পালন করবে সৌম্য।
বিশাল জাকজমক ভাবে শেষ হয়ে গেলো সৌম্য আর পিউ এর বিয়ের অনুষ্ঠান।
মুহিত কে টেনে কমিউনিটি সেন্টার এর একটি চিপায় নিয়ে এসেছে স্বর্গ।
মুহিতের গলা জড়িয়ে ধরে আদুরে স্বরে জানতে চাইলো
―আমাদের টা কবে হবে?
মুহিত স্বর্গের ঠোঁটে চুমু দিয়ে আদর মিশ্রিত কন্ঠে বলে উঠলো আরেকটু গুছিয়ে নেই সবকিছু?
স্বর্গ মন খারাপ করে দৃষ্টি অবনত করে সম্মতি জানালো।
স্বর্গের মুখের দিকে তাকিয়ে মুহিত মনে মনে অনেক কষ্টে পেলো।ভাষায় প্রকাশ না করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো
―বাসায় চলো।
#চলবে।