তোমার জন্য সিন্ধুর নীল পর্ব-২৫+২৬

0
293

#তোমার_জন্য_সিন্ধুর_নীল
#পর্ব_২৫
#সারিকা_হোসাইন

গ্রীষ্মের এই তাপদাহ আর কোনো মতেই সহ্য করা যাচ্ছে না।জনজীবন বিতৃষ্ণায় ভুগছে।এই অতিরিক্ত গরম কেও ছাপিয়ে আরো সবকিছু উত্তপ্ত করেছে মন্ত্রী মোশতাক আহমেদ এর আকস্মিক মৃত্যু।

ব্রিফ মিটিং এ পুলিশের অতিরিক্ত ডিআইজি বক্তৃতা দিয়ে যাচ্ছেন সেগুলোই বিভিন্ন চ্যানেল এ টেলিকাস্ট করা হচ্ছে ঘুরে ফিরে।

পুলিশের বক্তৃতা অনুযায়ী চেক আউট এর টাইম পার হবার পরেও মন্ত্রী মোশতাক আহমেদ চেক আউট এর জন্য রিশিপশন এ না এলে তাকে ইন্টার কমে কল করা হয়।

দীর্ঘ সময় কল করেও তাকে পাওয়া যায়নি।

শেষে হোটেলের ম্যানেজার আর একজন এমপ্লয়ী তার কক্ষের সামনে এসে দরজায় ক্রমাগত নক করতে থাকেন।

দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হবার পরও দরজা না খুললে তাদের মনে সন্দেহ তৈরি হয়।

তাদের কাছে থাকা কপি ডোর লক কার্ড পাঞ্চ করে রুমে ঢুকে তাকে না পাওয়া গেলে ওয়াশরুমের দরজা খোলা দেখে তারা সেখানে সন্ধান চালায়।
এমপ্লয়ী বাথটাবে তাকে খুঁজে পায়।কিন্তু তাকে ডাকাডাকি করলে কোনো সাড়া পাওয়া যায়না।

হোটেল কতৃপক্ষ দ্রুত নিকটস্থ থানায় ফোন করে সব জানালে পুলিশ সেখানে উপস্থিত হন।

তার লাশ মেডিকেল এ আনা হলে ডিউটিরত চিকিৎসক বিভিন্ন পরীক্ষা নিরীক্ষার পর জানান তিনি হার্ট এট্যাক এ মারা গেছেন।

আপাতত আমাদের কাউকেই সন্দেহ হচ্ছে না কারন মন্ত্রী মহোদয় এর সাথে কারো কোনো শত্রুতা কখনো পরিলক্ষিত হয়নি।

মোশতাক আহমেদ এর মৃত্যুতে বিরোধী দলীয় মন্ত্রী সারা শহরে মিষ্টি বিতরণ করলেন।একজন মানুষের মৃত্যু নিমিষেই আনন্দ উৎসবে পরিণত হলো।
এসবে মুহিতের কিছু যায় আসছে না।সে হন্যে হয়ে আশরাফ চৌধুরীর খুঁজ চালিয়ে যাচ্ছে।
মুহিত দুই আঙুলের সহিত কপাল স্লাইড করতে করতে চোখ বন্ধ করে ভাবছে
―কোথায় লুকিয়েছে আশরাফ চৌধুরী?

মুহিতের ভাবনার মাঝেই কর্কশ স্বরে বেজে উঠলো রিডিং টেবিলের উপর থাকা মোবাইল টা।
স্ক্রিনে সৌম্যের নম্বর দেখে দ্রুত রিসিভ করে ফোন কানে তুললো
―হ্যা ক্যাপ্টেন বলো
―স্যার আগামী নয় তারিখ দুপুর দুটো পঁয়তাল্লিশ মিনিটে আহিয়ান এর সাথে আপনার ভিজিটিং আওয়ার।
সৌম্যের কথা কর্ণকুহরে আসতেই ঠোঁটের হাসি প্রশস্ত হলো মুহিতের।

――――
পুব আকাশে গোলাকার রবি ধীরে ধীরে রক্তিম আভা ছড়াচ্ছে সাথে মৃদুমন্দ হাওয়া বইছে।চারপাশে পাখিদের কিচিরমিচির শোনা যাচ্ছে।কিছু সোলজার কোয়ার্টার এর মাঠের ঘাস গুলো পানি দিয়ে ভিজিয়ে দিচ্ছে।মানুষের সাড়া শব্দ নেই বললেই চলে।স্নিগ্ধ মনোরম লাগছে সবকিছু।

ফজরের নামাজ পড়ে স্বর্গ তার বেলকনিতে পাতানো দোলনায় বসে সকালের এই সৌন্দর্য উপভোগ করছে।বিভিন্ন ঝামেলায় এতোদিন সকাল সকাল উঠা হয়নি।
আজ থেকে তার হসপিটালে ডিউটি শুরু হয়েছে এজন্য উঠে গেছে ভোর বেলা।এখন থেকে প্রতিদিন এই রুটিন ই চলবে।

ধীরে ধীরে কিছুক্ষণ আগের রক্তিম সূর্য সোনালী রঙের তেজী কিরণ ছড়াচ্ছে।বাতাস ও কোথায় যেনো মিলিয়ে গেলো।এখন আর সকাল মনে হচ্ছে না।মনে হচ্ছে দুপুর।
স্বর্গ বার বার ঘড়িতে সময় দেখে নিচ্ছে।সাতটা বাজলেই মুহিতকে সে কল করবে।
অপেক্ষার সময় যেনো কাটতেই চায় না।ঘড়ির কাটা যেনো নড়ছেই না।
ছয়টা ঊনষাট বাজতেই এভারেস্ট জয়ের হাসি দিলো স্বর্গ।

ইয়েস বলে ফোন হাতে নিয়ে মুহিতের নম্বর ডায়াল করে ফোন কানে তুললো।
এই বজ্জাত পুরুষের ঘুমু ঘুমু কন্ঠ টা মারাত্মক লাগে শুনতে।মন চায় গলা কেটে ফেলতে।এতো সুন্দর হতে হবে কেনো তার কন্ঠ?

প্রথম রিং হতেই ফোন তুলে ফেললো মুহিত।
ঘুম ঘুম কন্ঠে বলে উঠলো
―গুড মর্নিং জান।
স্বর্গ যেনো কোরবান হয়ে গেলো।এতো আদর লাগিয়ে কে কথা বলতে পারে?
মুহিত ছাড়া কেউ তাকে এতো সুন্দর করে আদর করে কথা বলতে পারবে না।
মুহিতের নেশাক্ত কন্ঠ শুনে আবেশে চোখ বন্ধ করে ফেললো স্বর্গ।
এখন মুহিত পাশে থাকলে টিপে মেরে ফেলতো সে মুহিত কে।
এর পর মুহিত আবারো বলে উঠলো
―ঘুম থেকে উঠলেই কাছে পেতে ইচ্ছে করে তোমাকে,যেমন এখন তোমাকে খুব চুমু খেতে ইচ্ছে করছে।
মুহিতের সাথে সায় জানিয়ে স্বর্গ ও তার মনের ভাব ব্যাক্ত করলো
―আমারো তোমাকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে থাকতে ইচ্ছে করছে।
কিন্তু তুমি আমাকে ফাঁকি দিয়ে চলে গেছো।
নেক্সট বার এলে উচিত শিক্ষা দেব।
দিল খোলা হাসি দিলো মুহিত।এর পর আদুরে কন্ঠে বললো
―আচ্ছা দিও যতো খুশি ততো শিক্ষা,আমি সকল শিক্ষা গ্রহন করতে প্রস্তুত।বিনিময়ে তোমাকে আদর করতে পারলেই হবে।

মুহিতের এমন ঠোঁট কাটা কথায় লজ্জায় গোলাপি আভা ছড়ালো স্বর্গের দুই গালে।
হঠাৎ ই স্বর্গ মেকি রাগ দেখিয়ে বলে উঠলো―
তুমি না ক্যাপ্টেন তুলিকা ফার্নাজ এর সাথে হাত ধরে হিহি করেছিলে?

স্মিত হাসলো মুহিত।স্বর্গকে উদ্দেশ্য করে হাসতে হাসতে বললো
―এই প্রশ্ন টা এই পর্যন্ত তুমি চারশত সাতাত্তর বার করেছো।আর কতোবার করলে আমি ক্ষমা পাবো তোমার কাছে বলতে পারো?

আর দেখা করতে যাবার উপর আমার কোনো দোষ নেই সব দোষ আমার শশুরের।

মুহিতের হাসি দেখে স্বর্গের হঠাৎ ই রাগ উঠে গেলো সাথে নিজের বাপের উপর ও চটে গেলো।
ক্যাপ্টেন তুলিকার চুল ছিড়তে পারলে শান্তি লাগতো মনে।
কতবড় সাহস মুহিতের গায়ে হাত দেয়।
রাগের চোটে মুহিতের মুখের উপর ফোন কেটে দিয়ে সুইচড অফ করে দিলো।
হনহন করে রুমে এসে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে হসপিটাল যাবার জন্য পা বাড়ালো।

স্বর্গের এমন রাগের মাহাত্ম বুঝলো না মুহিত।ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে ফোনের স্ক্রিনের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো।নিজের ভুলটা কোথায় হয়েছে সেটাই ভাবতে লাগলো।

তনুজা আর নাফিজ মাহমুদ সকালের ব্রেকফাস্ট সাড়ছেন, পিউকে ডেকে এসেছেন,পিউ পরে খাবে।
হঠাৎ কোনো দিকে না তাকিয়ে স্বর্গকে সদর দরজার দিকে যেতে দেখে ডেকে উঠেন তনুজা
―সে কী না খেয়ে কোথায় যাচ্ছিস?
―স্বর্গ গর্জে উঠা কন্ঠে বলে উঠলো
―খাবার খাওয়ার মতো কোনো অবস্থা রেখেছো তোমরা?

মেয়ের হঠাৎ এমন রেগে যাবার কোনো কারণ দেখতে পেলেন না তনুজা।
নাফিজ মাহমুদ আদুরে স্বরে মেয়েকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন কি হয়েছে মা?
এবার রাগ ঢালার মানুষ পেলো স্বর্গ।
এতদিন পর সে জানতে পেরেছে ক্যাপ্টেন তুলিকার সাথে মুহিত কে বিয়ে দেয়ার ঘটক তার বাবা নিজেই।
দাঁত কটমট করে স্বর্গ বলে উঠলো
―এমন ভান ধরছো যেনো কিছুই জানোনা?
―ক্যাপ্টেন তুলিকার সাথে মেজর মুহিত কে দেখা করার ব্যাবস্থা কেনো করে ছিলে?

মেয়ের এহেন গাধার মতো প্রশ্নে বেক্কল হয়ে গেলেন নাফিজ মাহমুদ।তবুও স্বাভাবিক স্বরে বললেন
―মুহিত কে বিয়ে দিতে হবে না?
মেজর মুহিত কি তোমাকে ঘটক রেখেছে বাপী?
নাফিজ মাহমুদ মেয়েকে অবাকের সুরে জিজ্ঞেস করলেন
তুমি এতো রেগে যাচ্ছ কেনো?

“”তখন তো আপা তোমাকে দিয়ে মুহিতের বিয়ের কথা বলেনি””
আর মেয়েটা যথেষ্ট ভালো এজন্য দেখা করিয়েছি।যদিও মুহিত যেতে চায়নি।

স্বর্গ দাঁতে দাঁত চেপে বললো
“”তোমার ঐ যথেষ্ট ভালো মেয়ে কি করেছে জানো?
–বার বার মুহিতের হাতে হাত রাখার চেষ্টা করছিলো, আর হাসতে হাসতে ঢলে পড়ছিলো।

পুরাতন বিষয় নিয়ে তুই কেনো পরে আছিস মা?উদ্বিগ্ন হয়ে জানতে চাইলেন তনুজা।
―ঐ মেয়ের কথা মনে পড়লেই হিংসে হয় আমার,শরীরে আগুন জ্বলে,সহ্য করতে পারিনা আমি বুঝতে পেরেছো?
বলেই গটগট করে বেরিয়ে গেলো স্বর্গ।

নাফিজ মাহমুদ মেয়ের যাবার পানে তাকিয়ে তনুজাকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো
―এটা কার মেয়ে?এমন হিংসুটে মেয়ে কোথা থেকে এনেছো তনু?
তনুজা নাফিজের কথা শুনে ভ্রু কুঁচকে বলে উঠে
―কথাটা আবার বলো,তার পর তোমাকে দেখে নিচ্ছি।

সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে সবকিছু দেখছিলো পিউ।
আজকে তার মা,বাবার সম্পর্ক ঠিক থাকলে এমন খুনসুটিময় একটি পরিবার তার ও হতো।
কিন্তু নির্মম নিয়তি কতো নিষ্ঠুর ভাবেই না তাকে নিঃস্বঙ্গ করে দিয়েছে!

চোখের জল আড়াল করে সকলের অগোচরে উপরে উঠতে নিলেই নাফিজ মাহমুদ ডেকে উঠলো
―পিউ!

–এদিকে একটু আয় তো রে বাবা।

নিজেকে স্বভাবিক করে অবনত মস্তকে নীচে নেমে এলো পিউ।

নাফিজ মাহমুদ এর পাশের চেয়ার টেনে পিউকে বসতে বললেন নাফিজ মাহমুদ।

পিউ বসতেই নাফিজ মাহমুদ আদুরে কন্ঠে বলে উঠলো
―ক্যাপ্টেন সৌম্য তার ফ্যামিলি নিয়ে তোকে আংটি পড়াতে আসতে চাইছে।
আসতে বলবো?

কথাটি শোনা মাত্রই হুহু করে কেঁদে উঠলো পিউ।
যেই দায়িত্ব নিজের বাবার পালন করার কথা সেটা পালন করতে চাচ্ছে বান্ধবীর বাবা!
এর চাইতে কষ্টের কি ধরনীতে দ্বিতীয় কিছু আছে?

তনুজা উঠে এসে পিউ এর পাশে দাঁড়ালেন।
পিউ এর মাথা তার পেটের কাছে জড়িয়ে ধরে আদর করে হাত বুলালেন।
তনুজা বলে উঠলেন
―আমাদের সেভাবে আপন ভাবতে পারছিস না বাবা?
―স্বর্গ আর তুই সমান সমান আমাদের কাছে।ছোট থেকে তোকে দেখে আসছি।
তুই ভাবিস না আমরা যেমন তেমন করে তোকে সৌম্যের হাতে তুলে দেবো।
মনে কর আমি ই তোর মা।মায়ের কাছে যেভাবে সব শেয়ার করে সন্তান রা ,তুই ও সেভাবে সব শেয়ার করবি আমাকে।
―ক্যাপ্টেন সৌম্য আসবে বাবা?
তনুজার আদুরে মমতায় আশার আলো পেলো পিউ।

পিউ উপর নিচ মাথা ঝাঁকালো তনুজার প্রশ্নে।

হ্যা বোধক উত্তর পেয়ে নাফিজ,তনুজা দুজনের মুখেই খুশির ঝিলিক দেখা গেলো।

★★★★
চৌধুরী ম্যানশন এর চার তলা বিশিষ্ট বাড়িটা আশরাফ চৌধুরী এমন ভাবে ডিজাইন করেছেন যে কারো দেখলে মাথা ঘুরে যাবে।
যেমন বাইরের নান্দনিক সৌন্দর্য তেমনি ভেতরে।।
শুধু তাই নয়,রয়েছে একটি গুপ্ত কুঠুরি ও।যার সন্ধান আশরাফ চৌধুরী ছাড়া কেউ জানেনা।
জানতো আরেকজন যিনি বাড়ির ডিজাইন করেছেন।
কিন্তু আশরাফ চৌধুরী তাকেও দুনিয়া থেকে খালাস করে দিয়েছেন।
আশরাফ চৌধুরীর রহস্য কেউ জানতে পারবে না কোনোদিন বলেই হা হা করে হেসে উঠলেন আশরাফ চৌধুরী।
হঠাৎই হাসি থামিয়ে রাগে ফুঁস করে উঠলেন।
না পারছেন ঠিক মতো খাবার খেতে না পারছেন ফোন খুলে কারো সাথে যোগাযোগ করতে।
ফোন খুললেই নেটওয়ার্ক ট্র্যাক করে কুকুর গুলো খুঁজে বের করে ফেলবে তাকে।
যেভাবেই হোক তিন তলায় নিজের কক্ষের আলমারি থেকে গোপন ফোন টা বের করে আনতে হবে।
একবার এই বাড়ি থেকে বের হয়ে জাহাজে উঠতে পারলেই তার একটা লোম ও কেউ বাঁকা করতে পারবে না।
আর বাকী রইলো মেজর মুহিত!
ওর বংশ নির্বংশ করে দেবে এবার সুযোগ বুঝে আশরাফ চৌধুরী।

আজ পর্যন্ত কখনো তাকে এই গুপ্ত কুঠুরিতে অবস্থান করতে হয়নি।
সামান্য একটা মেজরের ভয়ে সে এখানে লুকিয়েছে!
এর জন্য কঠিন মূল্য যোগাতে হবে ওই হারামজাদা মেজর কে।

এদিকে ছেলেটা কি আসলেই উন্মাদ হয়েছে নাকি ভান ধরে আছে সেটাও বুঝা যাচ্ছে না।
শুয়োর টাকে জেলের ভেতর ই যদি শেষ করে দেয়া যেতো!
আপাতত শান্তিতে ঘুমানো যেতো।
ছেলের মুখ খোলার চিন্তায় কুঠুরিতে এসেও আরামে ঘুমানো যাচ্ছে না।

――――――

নাফিজ মাহমুদের ড্রয়িং রুমে বসে আছে মুহিত।আজ তার ছুটির দিন,স্বর্গ ও বাসাতেই আছে।এতো ভোর বেলায় মুহিত কে এই বাসায় দেখে অবাক হলেন তনুজা।মুখে কিছুই বললেন না।ঘুম ঘুম চোখে হাই তুলতে তুলতে বেরিয়ে এলেন নাফিজ মাহমুদ।ভেবেছিলেন ছুটির দিনে একটু আরামে লম্বা সময় ধরে ঘুমাবেন,কিন্তু তনুজার ডাকাডাকি তে তা আর হলো না।
মুহিত কে চিন্তিত মুখে বসে থাকতে দেখে নিমিষেই ঘুম ছুটে গেলো তার।
কিছু হয়েছে কি না ভাবতেই ভয়ে এক প্রকার দৌড়েই নামলেন।মুহিতের পাশে বসতে বসতে উদ্বিগ্ন হয়ে প্রশ্ন করলেন কোনো সমস্যা হয়েছে মুহিত?
অসহায় এর ন্যায় মুহিত বলে উঠলো―
―বিশাল বড় সমস্যা হয়ে গেছে স্যার।

সমস্যার কথা শুনে ভয় পেয়ে গেলেন নাফিজ মাহমুদ।চিন্তিত হয়ে জানতে চাইলেন কি সমস্যা মুহিত?
―আপনার মেয়ে দুদিন ধরে ফোন তুলছে না স্যার।

“তোমরা ঝগড়া করেছো? জিজ্ঞেস করলেন নাফিজ মাহমুদ।
অসহায় বদনে মুহিত বলে উঠলো
― না স্যার।

নাফিজ আগ্রহ সহকারে জানতে চাইলো
―দোষটা কার?
মুহিত সাবলীল ভাবে উত্তর দিলো
―আপনার!

ঘটনা আন্দাজ করতে সময় লাগলো না নাফিজ মাহমুদ এর।
অপরাধীর ন্যায় জিজ্ঞেস করলো
এখন কি করবে?
―আজ যেহেতু অফ ডে আছে দেখি একটু হাওয়া খাইয়ে নিয়ে আসি,যদি মন গলে।
নাফিজ মাহমুদ তনুজাকে ইশারা করলেন মেয়েকে ডাকতে।

দরজার ফাঁক দিয়ে চোরের মতো মুহিত কে দেখে যাচ্ছে স্বর্গ।সকালে নামাজ পড়ে বেলকনিতে দাঁড়াতেই মুহিতের জিপ দেখতে পেয়েছে সে।মুহিতকে কিভাবে চুম্বকের মতো টানতে হয় সেই বুদ্ধি ভালোই আছে স্বর্গের।

সিঁড়ি দিয়ে তনুজাকে উঠতে দেখে ঘুমের ভান ধরে বিছানায় পরে রইলো স্বর্গ।
তনুজা এসে ডাক দিতেই চোখ খুলে এতো সকালে ডাকার কারন জিজ্ঞেস করলো স্বর্গ।
―মুহিত এসেছে শিগ্গির আয়।
―তুমি যাও,আসছি বলে তনুজাকে তাড়িয়ে দিলো স্বর্গ।
নিজের নাইট ড্রেস চেঞ্জ করে একটা নরমাল লং শার্টের সাথে ডেনিমের লোজ প্লাজো পরে গলায় ওড়না ঝুলিয়ে,চুল গুলো এক পাশে সিঁথি করে কাঁধের দুই পাশে ফেলে পরিপাটি হয়ে বেরিয়ে এলো স্বর্গ।
ড্রয়িং রুমে এসে মুহিতের আকর্ষণীয় হটনেস দেখে মনের ভেতর প্রজাপতি উঠতে থাকলো তার।
এস কালার সফট ডেনিম শার্টের সাথে ব্ল্যাক জিন্স পড়েছে।হাতে কালো ফিতার ব্র্যান্ডেড ঘড়ি,মনে হচ্ছে গোসল করেছে।একদম স্নিগ্ধ লাগছে তাকে।এখনই একটা চুমু মুহিতের অবশ্যই প্রাপ্য।
সময় বুঝে মুহিতকে দিয়ে দেবে স্বর্গ মনে মনে ভাবলো।

নাফিজ মাহমুদের ধমকে হঠাৎই ধ্যান ভেঙে চমকে উঠলো স্বর্গ।
―এটা কেমন বেয়াদবি করছো মুহিতের সাথে?
একজন ডাক্তার হয়ে এসব আচরণ তোমার মানাচ্ছে?
ছেলেটাকে হয়রানি করছো কেনো?
ছুটির দিনে না ঘুমিয়ে তোমার রাগ ভাঙাতে এসেছে!সব সময় সব কিছুতে জেদ করছো ইদানিং।
দিনে দিনে ফাজিল হয়ে যাচ্ছ বেশি আদরে?
একটা ব্যাক্তিত্ববান ছেলে তোমার জন্য ব্যাক্তিত্ব হারা হচ্ছে।
বয়স কতো তোমার?

সকাল সকাল বাবার মুখে ধমক খেয়ে চোখের কোনে জল জমা হলো স্বর্গের।
বহু কষ্টে চেষ্টা করলো আটকে রাখতে।
তবুও টুপ করে এক ফোটা জল গড়িয়ে পড়লো গাল বেয়ে।
মুহিত পড়লো মহা ফ্যাসাদে।এখন তো মনে হচ্ছে হ্যাঙ আউটে ও যাওয়া হবে না।
নাফিজ মাহমুদ কে সামলিয়ে মুহিত স্বর্গ কে বললো
―এসো আমার সাথে,প্লিজ কেঁদোনা।
মুহিত ভেবেছিলো স্বর্গ তার উপর মুখ ঝামটা দিয়ে চলে যাবে,কিন্তু মুহিত কে ভুল প্রমাণ করে গাড়িতে উঠে বসলো।

গাড়ি স্টার্ট দিয়ে দ্রুত কোয়ার্টার থেকে বেরিয়ে গেলো মুহিত।
আজ সারাদিন স্বর্গকে সময় দেবে সে।স্বর্গ যা যা করতে চায় তাই তাই করবে।

একটা রেস্টুরেন্টের সামনে এসে ব্রেক কষলো মুহিত।স্বর্গ না খেয়েই বাসা থেকে বেরিয়েছে।তাকে আগে ব্রেকফাস্ট করাতে হবে,তারপর ঘুরতে যাওয়া।

―নামো।
বলে গাড়ির দরজা খুলে দিলো মুহিত।
কোনো টু শব্দ না করে বাধ্য মেয়ের ন্যায় নেমে দাঁড়ালো স্বর্গ।

স্বর্গের হাত ধরে রেস্টুরেন্টের ভেতর প্রবেশ করলো মুহিত।
একটা ওয়াইটার ডেকে স্বর্গের পছন্দের চিকেন স্যুপ আর গার্লিক নান ওর্ডার দিলো।সাথে ভেজিটেবল স্যালাড।

ওয়েটার চলে যেতেই স্বর্গের হাত ধরে ফেললো মুহিত।
আদুরে নরম স্বরে বললো
―তুলিকা ফার্নাজ এর সাথে দেখা করার জন্য আমি আন্তরিক ভাবে দুঃখিত।প্লিজ তুমি এভাবে আমার থেকে দূরে থেকো না,বুকের এখানে খুব কষ্ট হয় বাবু।

―তুমি বোঝোনা?

আমি আর কোনোদিন কোনো মেয়ের দিকে তাকাবো না,ইভেন তুমি না বললে হাসবো ও না।
হ্যাপি?

স্বর্গ মাথা নিচু করে চুপ হয়ে বসে রইলো।

মুহিত স্বর্গের থুতনি ধরে মুখ উপরে তুলে আহ্লাদী হয়ে বললো
―আজকে সারাদিন আমি তোমার কাছে আছি,যেভাবে চাইবে সেভাবেই আজকে পাবে আমাকে।
মনে করো আমি তোমার ভালোবাসায় কেনা বাধ্যগত দাস,আমি তোমার সকল হুকুম পালন করতে আজকে প্রস্তুত।

কথাটা জাদুর মতো কাজ করলো স্বর্গের উপর।
নিমিষেই মন খারাপের কালো মেঘ সরিয়ে বলে উঠলো
―সত্যি?
মুহিত প্রশস্ত হেসে বললো
―তিন সত্যি!

#চলবে।

#তোমার_জন্য_সিন্ধুর_নীল
#পর্ব_২৬
#সারিকা_হোসাইন®

★★★★
মেঘলা আকাশ সাথে শিরশিরে বাতাস,সব মিলিয়ে যেনো ঘুরতে যাবার উপযুক্ত সময় এটা।
মানুষ সামাজিক জীব,সমাজে বেঁচে থাকার অদম্য লড়াই করতে গিয়ে মানুষ পরিণত হয়েছে যন্ত্র চালিত রোবটে।
টাকার পিছে,একটু সুখে থাকার আশায়,ভালো খাবারের জন্য মানুষ তার সকল চাওয়া পাওয়া ইচ্ছে, অনিচ্ছা সব কিছু যেনো মাটিচাপা দিয়ে দিয়েছে।সকল দায়িত্ব পূরণ করতে গিয়ে নিজের জন্য সময় বের করাই যেনো দুষ্কর।

যান্ত্রিক এই জীবন কে ছুটি দিয়ে মুহিত আর স্বর্গ একটু ভালো ভাবে নিজেদের জন্য সময় কাটাতে এসেছে ফ্যান্টাসি কিংডম এ।
আজ তারা তাদের সকল ক্লান্তি ভুলে,ডিউটি ভুলে,কারো অর্ডার এর তোয়াক্কা না করে বাঁধাহীন একটি দিন উপভোগ করবে।

বড় হবার সাথে সাথে মানুষ শৈশবের সবকিছু ভুলে যায়,বা শৈশবের জিনিস গুলো করতে গেলে অনেকে নাক ছিটকিয়ে বলবে ―বুড়ো বয়সে ঢং!
কিন্তু যেই আনন্দঘন শৈশব একবার হারিয়ে গিয়েছে তা কি আর ফিরে পাওয়া যাবে কোনো দিন?

স্বর্গের আজ বাচ্চা হতে ইচ্ছে হয়েছে।আজকের দিন সে তার ছোটবেলায় যেভাবে হেসে খেলে কাটিয়েছে সেভাবে কাটাবে।সাথী হিসেবে মুহিত রয়েছে।

প্রথমে তারা দুটো টিকিট নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলো।
টিকিটের সাথে যেই রাইড গুলো আছে তারা প্রথমে ওগুলো ট্রাই করবে।
প্রথমে মুহিত ডিসাইড করলো তারা রোলার কোস্টার এ উঠবে।
স্বর্গকে যতোটা উচ্ছসিত দেখা গিয়েছিলো প্রথমে, রোলার কোস্টার এর নাম শুনেই মুখ চুপসে গেলো তার।
কিন্তু মুহিত খুব এক্সাইটেড।স্বর্গকে বগল দাবা করে মুহিত ছুটলো রোলার কোস্টার এর দিকে।
একদম সামনের সিটে বসে পড়লো মুহিত।
স্বর্গ নিজেকে মুহিতের সামনে দুর্বল প্রমান করতে নারাজ।নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করছে কিন্তু হাত পা কাঁপছে।
কিছুক্ষন পর ব্যারিকেড হ্যান্ডেল গায়ের সাথে সেটে গেলো।
স্বর্গ বুঝতে পারলো এখন এটা চালু হবে।
সাথে সাথেই মুহিত কে খামচে ধরলো।
হোহো করে হেসে কুটিকুটি হলো মুহিত।
স্বর্গকে জিজ্ঞেস করলো
“”ভয় লাগছে মনা?””
স্বর্গ কিছু উত্তর করার আগেই ছুটে চললো রোলার কোস্টার,ধীরে ধীরে স্পিড বাড়তে থাকলো।
স্বর্গ প্রথমে যেই ভয়টা পেয়েছিলো নিমিষেই সেটা আনন্দে পরিণত হলো।
খুশিতে চিল্লাতে চিল্লাতে চোখ দিয়ে পানি বের করে ফেললো সে।

এর পর বড় যেই নৌকা স্যান্টা মারিয়া আছে ঐটাতে উঠলো।
এবারো মুহিত একদম লাস্টের মাথায় গিয়ে বসবে।
তার মতে যতো উপরে উঠে দোল খাওয়া যাবে ততো মজা।
স্বর্গ এবার কিছুতেই উপরে উঠবে না।
মুহিত টেনে হিচড়ে জোর করে স্বর্গকে নিয়ে বসিয়ে দিলো একদম লাস্ট মাথায়।
শুরু হলো দোল।
স্বর্গ ভয়ে চোখ বন্ধ করে হ্যান্ডেল চেপে ধরে খিচে বসে রইলো।
তার মনে হচ্ছে সে হাওয়ায় ভাসছে।তার পায়ের নীচে সব ফাঁকা।পেটের ভেতর থেকে সব বেরিয়ে যাচ্ছে।
পুরো সময় সে চোখ বন্ধ করেই কাটালো।
এর পর বাম্পার কার খেলায় স্বর্গ মুহিত কে চোখ ইশারায় বুঝিয়ে দিলো
―দেখে নেবো তোকে।
মুহিত ফিচেল হাসলো।
শুরু হলো দুজনের টক্কর,স্বর্গ মুহিত কে বিভিন্ন এঙ্গেল থেকে এসে মেরে দিচ্ছে ।বিজয়ীর হাসি স্বর্গের চোখে মুখে।
মুহিত ইচ্ছে করেই স্বর্গকে জিতিয়ে দিয়ে মনে মনে হাসলো আর বললো
―বাচ্চাটা আমার।

একে একে সব গুলো রাইড শেষ করে বেরিয়ে আসে তারা।
হাসতে হাসতে গাল ব্যাথা হয়ে গেছে স্বর্গের।
মুহিত আদুরে স্বরে জিজ্ঞেস করে
―ম্যাডাম আপনার নেক্সট প্ল্যান কি ?
এক বাক্যে স্বর্গ পেটে হাত দিয়ে বলে উঠলো
―খাবো।
খুব খিদে পেয়েছে।
দুজনেই জিপে উঠে বসলো,মুহিত গাড়ি হাকালো ভালো রেস্টুরেন্টের দিকে ।
আধঘণ্টা বাদে তারা রেস্টুরেন্টে পৌঁছে গেলো।
রেস্টুরেন্টে ঢুকে ওয়েটার ডেকে ইচ্ছে মতো অর্ডার দিলো স্বর্গ।
ওর্ডার দিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেলো ফ্রেস হতে।
মিনিট পাঁচেক পরে ফিরে এসে খাবার এখনো দেয়নি কেনো ?
সেটা নিয়ে মুহিত কে খুঁচিয়ে যাচ্ছে।

মুহিত ভাবছে অন্য কথা!
―এই ছোট পেটে এতো খাবারের জায়গা হবে কি করে?
তবুও মুখে কিছুই বললো না,পরে দেখা যাবে রেগে মেগে খাবারই খাবে না।
অযথা ঝামেলার দরকার কি বাবা?
শুধু মাথা ঝাকিয়ে আসবে, আসবে, বলে অপেক্ষা করতে বললো।

কিছুক্ষন পর তিন জন ছেলে ধীরে ধীরে খাবার গুলো নিয়ে টেবিলে পরিবেশন শুরু করলো।
খাবার রেখে চলে যেতেই স্বর্গ দুই হাতে দুটো স্পুন নিয়ে উচ্ছসিত হয়ে মুহিতের উদ্দেশ্যে বলে উঠলো
―লেটস ডিগ ইট!

একের পর এক খাবার মুহূর্তেই সাবাড় করে দিচ্ছে স্বর্গ।
মুহিতের মনে হচ্ছে খাবার গুলো বোধ হয় বেশি স্বাদ।
নিজেও টেস্ট করে দেখলো।
উহু আহামরি কিছুই না।
মুহিত যেনো আজ অন্য আরেক স্বর্গ কে দেখছে।
যেই মেয়ে এতো ডায়েট মেইনটেইন করতে করতে শুকিয়ে শুঁটকি মাছ হয়ে আছে,সেই মেয়ের ডায়েট ফায়েট আজ কোথায় তল্পিতল্পা গুটিয়ে পালালো?

মুহিত ভেবেছিলো অর্ধেকের বেশি খাবার নষ্ট হবে,কিন্তু মুহিতকে ভুল প্রমাণ করে স্বর্গ সব খেয়ে ফেলেছে।
মুহিত একটা ড্রিংকস এর বোতলে স্ট্র ঢুকিয়ে স্বর্গের পানে এগিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করলো
―আরো কিছু খাবে সোনা?
স্বর্গ মাথা নেড়ে অর্ডার দেয়ার ভঙ্গিতে বললো
―নো, এখন শপিংয়ে যাবো।

রেস্টুরেন্টের বিল মিটিয়ে মুহিত আবার গাড়ি হাকালো।গন্তব্য স্বর্গের পরিচিত শপিংমল।
কেনাকাটা শেষ করতে করতে রাত আটটা বেজে গেলো।এদিকে নাফিজ মাহমুদ সমানে ফোন দিয়ে যাচ্ছে তারা কোথায়?
সৌম্যের বাবা মা এসেছে।
স্বর্গকে নিয়ে দ্রুত জিপে বসলো মুহিত।গাড়ি স্টার্ট দিয়ে স্পিড বাড়িয়ে দিলো।
রাত সাড়ে নয়টার মধ্যে পৌঁছে গেলো নাফিজ মাহমুদ এর বাংলো তে।

শপিং ব্যাগ গুলো দুই হাতে জাপ্টে ধরে বহু কষ্টে হেলেদুলে উপরে উঠে গেলো স্বর্গ।
মুহিত সৌম্যের বাবা মায়ের সাথে কুশল বিনিময় করে ফ্রেস হতে গেলো।

সৌম্যের গ্রামের বাড়ি টাঙ্গাইল মধুপুরের এক প্রত্যন্ত গ্রামে।সেখান থেকে আসতে তাদের একটু দেরি হয়ে গেছে।ঠিক সময়ে গাড়ি ধরতে না পারায় দুপুরে পৌঁছনোর কথা থাকলেও সন্ধে গড়িয়ে গেছে।
সৌম্যের বড় একটা বোন আছে,তার বিয়ে হয়ে গিয়েছে।
সৌম্যের বাবা মা দুজনেই খুবই সাধাসিধে আর মিশুক প্রকৃতির।
পিউকে তারা খুবই পছন্দ করেছে।
সৌম্য আর পিউ চাইলে তারা আজকেই আংটি পড়িয়ে আকদ করে রাখবে।।

সৌম্যের বাবা মায়ের আরো কয়েকদিন পরে আসার কথা ছিলো।পিউ এর কথা চিন্তা করে সৌম্য আজই তাদের ফোন করে নিয়ে এসেছে।
মুহিত সৌম্যকে ডেকে জিজ্ঞেস করলো কি করতে চায় সে?
সৌম্য সাবলীল ভাবে উত্তর দিলো
―স্যার আমি আজকেই আকদ করাতে চাই,আগামী সপ্তাহে ওকে তুলে নেবো।পিউ ভেতরে ভেতরে ভেঙে পড়েছে।ওর এখন আমাকে বিশেষ প্রয়োজন।মুখে না বললেও আমি বুঝতে পারি।
বলেই মাথা নিচু করলো সৌম্য।

মুহিত সৌম্যের কাঁধ চাপড়ে ড্রয়িং রুমে এসে বসলো।
পকেট থেকে ফোন বের করে মেজর আদ্রিয়ান এর নম্বর ডায়াল করলো।
―কাজী নিয়ে আসুন মেজর আদ্রিয়ান।
সকলের মুখে হাসি ফুটলো,পিউ নার্ভাস হয়ে গেলো।

পিউকে গোসল করিয়ে বিছানায় বসালো স্বর্গ।
এরপর মুহিতের শপিং করে দেয়া ব্যাগ হাতড়ে একটা মেরুন রঙের সোনালী পাড়ের জামদানি শাড়ি বের করলো।
সাথে কিছু নতুন সিম্পল গহনা।
পিউকে দেখিয়ে বললো এগুলো তোর জন্য এনেছি।
পছন্দ হয়েছে?

পিউ নীরবে অশ্রু বিসর্জন দিলো।স্বর্গ পিউকে জড়িয়ে ধরে বললো
―কিচ্ছু হয়নি,মনে কর আমি তোর বোন।মাম্মা,বাপী তোর ও মাম্মা বাপী।
এখান থেকেই তোর বিয়ে হবে,বিয়ের পর তোর নাইয়র ও এখানেই করবি।
কি করবি তো?
শাসিয়ে জিজ্ঞেস করলো স্বর্গ।
পিউ চোখের জল মুছে মুচকি হেসে মাথা ঝাঁকালো
সে অবশ্যই আসবে!

খুবই সিম্পল ভাবে, ঘরোয়া পরিবেশে আংটি বদল আর আকদ হয়ে গেলো।
আগামী সপ্তাহে সেনা কুঞ্জে বড় অনুষ্ঠান করে সৌম্য পিউকে ঘরে তুলবে।
বিয়ে নিয়ে পিউ এর অনেক ফ্যান্টাসি ছিলো।
সৌম্য সব অক্ষরে অক্ষরে পালন করবে।
বাবা মা পাশে নেই তো কি হয়েছে?সৌম্য তো মরে যায়নি।এখনো অক্ষত অবস্থায় পিউ এর সামনে শ্বাস নিচ্ছে।

যদিও বিয়ের পর কিছু ঝামেলা আছে,সৌম্য এখনো ব্যাচেলর অফিসার্স কোয়ার্টার এ থাকে,বিয়ের পর কোয়ার্টার এর জন্য আবেদন করলে সেটাও সাবমিট হতে একটু সময় লাগবে।
তবুও সৌম্য সব ভেবে রেখেছে।
বাইরে বাসা নেবে সৌম্য দরকার পড়লে।তবুও পিউকে একা ছাড়বে না।
রাত বারোটা নাগাদ সকল কাজ শেষ করে সৌম্য আর মুহিত চলে যায় তাদের কোয়ার্টার এ,সৌম্যের বাবা মা থেকে যায়।
তারা ভোরে গ্রামে ফিরে যাবে।
তিন কুলে তেমন নিকট আত্মীয় না থাকায় কাউকে বিয়েতে নিমন্ত্রণ করার ও ভেজাল নেই।
অনুষ্ঠানের আগের দিন তারা চলে আসবে বড় মেয়েকে নিয়ে।

――――
রাত একটা বেজে দশ মিনিট।কোনোভাবেই মুহিতের ঘুম আসছে না।কাল দুপুরে আহিয়ান এর সাথে ভিজিটিং আছে।
দুইয়ে দুইয়ে চার কিছুতেই যেনো মিলছে না।
আশরাফ চৌধুরী গেলো টা কোথায়?

সহসাই লাফ দিয়ে শোয়া থেকে উঠে বসলো মুহিত।
সেনা নিবাস থেকে আশরাফ চৌধুরীর বাসা বিশ মিনিটের রাস্তা।
দুস্টু বুদ্ধি খেলে গেলো মুহিতের মাথায়।

কালো একটা শার্ট পরে মাথায় নরমাল ক্যাপ পরে মুখে মাস্ক লাগিয়ে চোরের মতো পা টিপে অন্ধকার হাতড়ে বেরিয়ে এলো গেটের কাছে।
আসতেই নাইট গার্ড কে গেটের কাছে আসতে দেখে একটা ঝাউ গাছের পিছনে লুকিয়ে গেলো।
লোকটি সরতেই দ্রুত গতিতে গেট বেয়ে লাফিয়ে রাস্তায় চলে এলো।
নাইট গার্ড শব্দ পেয়ে দৌড়ে গেটের কাছে এসে কিছুই দেখতে পেলো না।

প্রথমে ধীরে পরে জোরে হেটে একসময় দৌড়াতে শুরু করলো মুহিত।
দৌড়াতে দৌড়াতে চৌধুরী ম্যানশন এর সামনে এসে হাঁটুতে হাত দিয়ে হাপাতে লাগলো।
কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে রেস্ট নিয়ে ছোট টর্চ বের করে আবার গেট টপকে ভেতরে ঢুকলো মুহিত।
কোমরে রাখা রিভলবার হাতে পজিশন করে ধরে ধীরে ধীরে আগাতে থাকলো।
মানুষজন ধাক্কাধাক্কি করে,ঢিল ছুড়ে বাড়ির অবস্থা ঝকরমকর করে ফেলেছে।
মেইন গেটের লক পর্যন্ত নষ্ট করে ফেলেছে।
মুহিত বিনা শব্দে প্রত্যেকটি তলায় ঘুরে ঘুরে সবকিছু পর্যবেক্ষণ করলো।সন্দেহ জনক কিছুই পেলো না।তবুও হাল ছাড়ার পাত্র সে নয়।

সুযোগ বুঝে প্রত্যেক টি তলায় একটি করে স্পাই মিনি ভয়েস রেকর্ডার সেট করে দিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলো।
মুহিত শতভাগ নিশ্চিত আশরাফ চৌধুরী বাড়িতেই কোথাও লুকিয়ে রয়েছে।

হাটতে হাটতে ফেরার পথে নাফিজ মাহমুদ এর বাংলো দেখে সুপ্ত ইচ্ছে জেগে উঠলো মুহিতের মনে।
রাত তিনটে বাজে তবুও তার পা এই রাস্তা থেকে সরছে না।
ফোন বের করে স্বর্গের নম্বরে কল করতেই রিসিভ করলো স্বর্গ।
ঘুম ঘুম কন্ঠে বললো
হ্যালো মুহু!
মুহিত যেনো এই রোমাঞ্চকর কন্ঠ শুনে আরো পাগল হয়ে গেলো।
নিজেকে সামলে বলে উঠলো
―পাঁচিল টপকে যদি তোমাদের দরজার সামনে যাই আমাকে তোমার সাথে ঘুমুতে দেবে?
মুহিতের কথায় নিমিষেই স্বর্গের ঘুম ছুটে গেলো।

“”ছেলে বলে কি!”

দ্রুত বেলকনির দরজা খুলে আশেপাশে তাকিয়ে বললো
―কোথায় তুমি?তোমাকে তো দেখছি না।
মুহিত ফিসফিস করে বলে উঠলো
―আলোতে দাঁড়িয়ে দাঁত ক্যালাবো যাতে চোর মনে করে গার্ড ধরে ফেলে?
স্বর্গ আঙ্গুল কামড়ে ভাবতে লাগলো কি করবে।
পিউ আজ গেস্ট রুমে ঘুমিয়েছে। সৌম্যের বাবা মা ও নীচে ঘুমুচ্ছে।

মুহিত কে মেইন গেট দিয়ে আসার সময় হঠাৎ কেউ যদি দেখে ফেলে?

মুহিত আবার বলে উঠলো
“”কি ব্যাপার কথা বলছো না কেনো?
― ফিরে যাবো?
তড়িঘড়ি করে স্বর্গ বলে উঠলো
এমা, না না,যেও না।
– শুনো,আমার রুমের পিছনের বেলকনি দিয়ে উঠতে পারবে?
পাইপ বেয়ে কিন্তু উঠতে হবে!
মুহিত সিচুয়েশন বুঝলো,তবুও মনের সাথে যুদ্ধ করে জয়ী হবে কার সাধ্য?

ফোন কেটে সুযোগ বুঝে পাঁচিল টপকে স্বর্গের পিছনের বেলকনির দিকে অগ্রসর হলো।দুটো বেলকনি ই খোলা,গ্রিল হীন।আকাশের চাঁদ হাতে পেলো মুহিত।
লম্বা মানুষ চাইলেই অসাধ্য সাধন করতে পারে।
একটু পাইপ বেয়ে উঠতেই প্রথম বেলকনিতে উঠতে পারলো।
এর পর কোমড় সমান ইটের গাঁথুনি তে পাড়া দিয়ে স্বর্গের বেলকনিতে উঠে পড়লো।এদিকে হাত ছিলে গেলো সামান্য।সেসব গায়ে মাখলো না মুহিত।

বেলকনির দরজা আটকে স্বর্গ মুহিতকে বিছানায় বসতে দিলো।এর পর পানির বোতল এগিয়ে দিলো।
ঢকঢক করে পুরো বোতলের পানি সাবাড় করলো মুহিত।
হঠাৎ ই ভ্রু কুঁচকে সন্দিহান চোখে জিজ্ঞেস করলো স্বর্গ
―এমন ভুত সেজে কোথায় গিয়েছিলে?
কেনো আমাকে দেখে খুশি হওনি?পাল্টা প্রশ্ন করলো মুহিত।
আচ্ছা তাহলে চলে যাই বলেই উঠে দাঁড়ালো।
কুনুই বরাবর টেনে ধরলো স্বর্গ
―কখন বললাম খুশি হইনি?
ঘুম পাচ্ছে শুয়ে পড়লাম বলেই মুহিত বিছানায় চিৎ হয়ে শুয়ে গেলো।
স্বর্গ বেয়াক্কেল এর মতো দাঁড়িয়ে জিগ্যেস করল
―এহ?তুমি ঘুমুতে এসেছো এখানে?
―গায়ের শার্ট খুলতে খুলতে মুহিত রসিয়ে রসিয়ে বললো
―অনেক কিছুই করতে এসেছি।শুয়ে পড়ো বেশি কথা না বলে।

লাইট অফ করে নীল রঙা ডিম লাইট জ্বালিয়ে দুরুদুরু বুক নিয়ে মুহিতের পাশে শুয়ে পড়লো স্বর্গ।
হঠাৎ ই শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো মুহিত স্বর্গ কে।

এর পর ফিসফিস করে স্বর্গের কানের কাছে মুখ এনে বললো
―আগামী মাসেই বিয়ে করে তুলে নিয়ে যাবো তোমাকে,এভাবে আর থাকা যাচ্ছে না।
মুহিতের গরম নিঃশ্বাসে শিহরণ বয়ে গেলো স্বর্গের সারা শরীরে।
শক্ত করে মুহিত কে জড়িয়ে ধরে চোখ বন্ধ করে ফেললো।
স্বর্গের চোখে মুখে অজস্র চুমুতে ভরিয়ে দিলো মুহিত।
মুহিতের চুল খামচে ধরলো স্বর্গ।
নিজেকে আর কন্ট্রোলে রাখা গেলো না।
নিমিষেই উন্মাদনায় দুজন দুজনের মাঝে হারিয়ে গেলো।

★★★★
আজ নয় তারিখ,কাঙ্ক্ষিত সেই সময় একটু পরেই ঘনিয়ে আসবে।
সৌম্যকে না নিয়ে সিভিল ড্রেসে নিজের কালো রঙের কে টি এম বাইক স্টার্ট দিলো মুহিত।মাথায় কালো হ্যালমেট লাগিয়ে ছুটে চললো হাজতে।
নির্দিষ্ট সময়ের এক ঘন্টা আগে এসে দাঁড়িয়ে আছে মুহিত।আজ তার অনেক কাজ।
সকল কাজের দ্রুত সমাধা না করলে সমস্যা ধীরে ধীরে বাড়তেই থাকবে।
একদিকে মা বোন,অন্যদিকে বউ।
সবাই চুম্বকের মতো টানছে কিন্তু কারো কাছেই যাওয়া যাচ্ছে না।
আশরাফ চৌধুরী কে নির্মূল করে তবেই ধুমধাম করে স্বর্গ কে ঘরে তুলবে মুহিত।
শত্রু বাঁচিয়ে রেখে আনন্দ উল্লাস করতে মন সায় দিচ্ছেনা এবার।
এদিকে অপেক্ষা করতেও কষ্ট হচ্ছে।
অপেক্ষার সময় সবচেয়ে দীর্ঘ।

হঠাৎই এলার্ম বেজে উঠলো ফোনে।ধ্যান ছুটে গেলো মুহিতের।
দুটো বেজে চল্লিশ মিনিট।আর মাত্র পাঁচ মিনিট পরেই শুরু হবে দর কষাকষি।
কতদিন চালাতে হবে আর এই তামাশা?
ভিজিটিং রুমে বসে পায়ের উপর পা তুললো মুহিত।
চোখ বন্ধ করে গুনলো
―ওয়ান,টু,থ্রি!
আহিয়ান এসেছে।
আহিয়ান কে দেখেই মুখের হাসি প্রশস্ত হলো মুহিতের।

মুহিতকে দেখেই আবোল তাবোল বলতে শুরু করলো আহিয়ান।
মুহিত চোখ দিয়ে ইশারা করতেই কারারক্ষী বাইরে চলে গেলো।

সোজা হয়ে বসলো মুহিত।
এক ভ্রু বাঁকা করে ফিচেল হেসে আহিয়ান কে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো
―নিজের ফর্মে এসো আহিয়ান।
―ইউ আর আন এবল টু ডজ মুহিত ওয়াসিফস আইজ!

#চলবে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে