তোমার জন্য সিন্ধুর নীল পর্ব-২৩+২৪

0
83

#তোমার_জন্য_সিন্ধুর_নীল
#পর্ব_২৩
#সারিকা_হোসাইন

~~~~~~
পূর্ণিমার ঝকঝকে থালার মতো রুপালি চাঁদ শেষ হয়ে গেছে আরো কয়েক দিন আগে ।ঘন কালো অমাবস্যার নিশুতি গ্রাস করেছে পুরো ধরণী।আকাশে চাঁদ এখনো দৃশ্যমান হয়নি।বাইরের পরিবেশ উত্তপ্ত,গুমোট।হঠাৎ ইলেক্ট্রিসিটি চলে গেলো।
চাঁদহীন আকাশ আর আলো হীন ধরণী সব মিলিয়ে ঘুটঘুটে চারপাশ।মাঝে মাঝে ঝিঁঝিঁ পোকার কর্কশ ডাক শোনা যাচ্ছে।

এই অন্ধকার নিশুতিতে সাগরিকা নিবাসের পাঁচিল টপকে উঠে গেলো দুজন তাগড়া যুবক।পাঁচিল টপকানোর কৌশলে মনে হচ্ছে তারা এই কাজ আরো আগেও বহু বার খুব সুনিপুণ ভাবে করেছে।

কোমরে গুঁজে রাখা রিভলবার টাকে দুই হাতে পজিশন করে ধরে ধীরে ধীরে সামনে আগাতে থাকলো।
আশেপাশে ভালো ভাবে যুবক দুটো খেয়াল করে দেখলো কেউ আছে কি না।
নাহ কেউ দেখছেনা।ভেতরে প্রবেশের এটাই উপযুক্ত সময়।
দূতলা বাসাটির নিচ তলায় কিচেন।সেই কিচেনের জানালার একটা পাল্লা খোলা দেখা যাচ্ছে।
যুবক দুটির চোখ চকচক করে উঠলো।
পরিবেশ আর সুযোগ সব মিলিয়ে যেনো সোনায় সোহাগা।

*****
ইজি চেয়ারে বসে দোল খাচ্ছেন নাসের হায়দার।জীবনের সব সুখ যেনো হাওয়ায় মিলিয়ে যেতে চাইছে তার।হঠাৎই আশরাফ চৌধুরী গিরগিটির ন্যায় রং বদল করে ফেলছে।মেজর মুহিত ও ফিরে এসে সব প্ল্যানিং প্রোগ্রাম পন্ড করে দিচ্ছে।
এদিকে মেয়েটাও অনেক তথ্য হাতিয়ে নিয়েছে।
মায়ের মতো তাকেও চিরতরে শেষ করে দেয়াই বুদ্ধিমানের কাজ হবে মনে হচ্ছে।

নাহ আর ভালো লাগছে না।সব কিছু পানসে লাগছে ।পানসে সময় কে একটু স্বাদ যুক্ত করতে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন তিনি।
পছন্দের হুইস্কির বোতল থেকে ঢেলে নিলেন এক প্যাগ হুইস্কি সাথে দিলেন কয়েক টুকরো বরফ।

চোখ বন্ধ করে প্রথম চুমুক দিতেই গলায় তিতকুটে ঝাঁঝালো স্বাদ অনুভূত হলো।
হুইস্কি গ্লাস হাতে ধীরে ধীরে বারান্দায় পাতা সোফা টাতে বসলেন ।
এখান থেকে বকুল ফুলের গাছটা ভালো দেখা যায়।
কিন্তু ইলেক্ট্রিসিটি হীন পরিবেশ অন্ধকার কবরের মতো মনে হয়।
বকুল গাছ সম্পূর্ণ না দেখা গেলেও হালকা বাতাসে দোল খাওয়া পাতার খচ খচ শব্দ শোনা যাচ্ছে।
বিশ টি বছর ধরে এই বকুল গাছ দেখেই জীবন পার হয়ে গেলো।

নাহ হুইস্কি তে ভালো নেশা হচ্ছে না আজ।

পুরোনো অতীতের ক্ষত গুলো তাজা হয়ে উঠে নেশা কাটিয়ে দিচ্ছে।
★★★

সালটি ১৯৯৫।
ঘর আলো করে চাঁদের মতো একটি পুত্র সন্তান এসেছিলো নাসের আর সাগরিকার ঘরে।নাসের তখন সাধারণ একজন লেফটেন্যান্ট।
খুবই সামান্য বেতন ছিলো তার।
সেই অল্প বেতনে নাসের আর সাগরিকার চললেও সন্তান আসার পর হিমশিম খেতে হতো তাদের।
সাগরিকার বুকের দুধ খুবই কম ছিলো, শিশুটি সারাদিন কাঁদতে থাকতো করুন সুরে।
সামান্য বেতনে বাসা ভাড়া,বাজার খরচ ,সব চালাতে হতো।এর পর যুক্ত হলো বাচ্চার দুধ।
এতো অভাব অনটনের মধ্যেও সাগরিকা ছিলো হাসি খুশি।ছেলেটার বয়স যখন দুই তখন কঠিন এক ব্যধিতে আক্রান্ত হলো সে।
চিকিৎসা করেও কোনো ভালো হবার লক্ষণ দেখা যাচ্ছিলো না।এক দিকে অনাহারে জীবন যাপন,তার মধ্যে বাচ্চা নিয়ে যুদ্ধ,নির্ঘুম রাত্রি যাপন,হঠাৎই সম্পর্কে বিতৃষ্ণা এসে গেলো দুজনের।
ছেলেটা একদিন খুবই অসুস্থ হয়ে পড়লো।এদিকে মাসের শেষ প্রায়।হাতে কোনো টাকাই নেই।
ছেলেটা এক নাগাড়ে কেঁদেই যাচ্ছে।।
কাঁদতে কাঁদতে হঠাৎই খিঁচুনি উঠে ছেলেটা কোনো কিছু বুঝে উঠার আগেই মৃত্যু কোলে ঢলে পড়লো।
সাগরিকা একটুও কাঁদলো না সেদিন।
শুধু আমার দিকে তাকিয়ে বললো,

―টাকা হীন পুরুষের একটা নেড়ি কুত্তার সমান দাম ও নেই।
এক দিকে পুত্র শোক অন্যদিকে সাগরিকার এহেন অপবাদ।
সব মিলিয়ে মাথা ঘুরে উঠলো।পৃথিবীর সমচেয়ে অসহায় মনে হলো নিজেকে।

ধীরে ধীরে পুত্র শোক কাটিয়ে উঠলাম ঠিকই কিন্তু দুজন দুই মেরুর মানুষ হয়ে একই ছাদের নিচে বসবাস করতে লাগলাম।

হঠাৎই একদিন দিনাজপুর বর্ডার এলাকায় ট্রান্সফার হলো আমার।
চুরাই পথে বিভিন্ন জিনিস আসে,ওখানে গিয়ে জানতে পারলাম এসব দেখেও না দেখার ভান করলে শুধু টাকা আর টাকাই আসে।
এমন কথায় চোখ চক চক করে উঠলো আমার।।

এমন পরিস্থিতিতে পরিচয় হলো আহমেদ কসাই এর সাথে।
বিশাল ব্যাবসা তার।মানুষ পাচারের ব্যাবসা।
লোকটি আমাকে আশার আলো দেখালো,বিনিময়ে আমার সাহায্য প্রার্থনা করলো।
আমিও রাজি হয়ে গেলাম,টাকার লোভ কে হাতছাড়া করবে?

আমি নিজেই গাড়ি করে মানুষ বর্ডার পার করে দিলাম।
এক বছরের ব্যাবধানে লাখপতি হয়ে গেলাম।
ঢাকায় জমিও কিনে ফেললাম।
খুশি হয়ে সাগরিকা কে গড়ে দিলাম দূতলা একটি বাড়ি।

আহমদ কসাই নিমিষেই নাম ধাম বদলে বিশিষ্ট সমাজ সেবী আশরাফ চৌধুরী হয়ে গেলো।আর আমি হলাম তার বিষ্যভাজন ব্যাক্তি।
এমন কোনো কাজ নেই যেখানে আমি তাকে সাহায্য করিনি।

পিউ পেটে এলো।সাগরিকা খুশিতে পাগল হয়ে গেলো।
টাকা সন্তান দুটোই এক সাথে।সুখ যেনো সত্যি ই ধরা দিলো এবার।

আমি ঢাকায় শিফট হলাম আবার।পিউ এর বয়স তখন চার।
একদিন আমার আর আশরাফ চৌধুরীর সকল কথা শুনে ফেললো সাগরিকা।
শুনেই আমাকে ঘৃণা করতে লাগলো,সংসারে অশান্তি শুরু করে দিলো।।

আমার নামে ক্যান্টনমেন্ট এ বিচার দেবে সেই ভয় দেখাতে লাগলো।

আমার এতদিনের গড়া সুখ,টাকা এই নির্বোধ মহিলা এক নিমিষেই শেষ করে দিতে চাইলো।
যখন টাকা ছিলোনা তখনো কথা শুনাতো,যখন টাকা দিয়ে ভরিয়ে দিলাম তখন আবার টাকা প্রাপ্তির উৎস খুঁজতে লাগলো।

মেয়েদের মন কে বুঝতে পারবে যে,তাদের কখন কি চাই?

টাকার নেশা ততোদিতনে আমাকে বদ্ধ উন্মাদ করে দিয়েছিলো।
সাগরিকা বিভিন্ন ভয় ভীতি দেখিয়ে চুপ করিয়ে নজরদারি তে রাখলাম।

সাগরিকা এক রাতে পিউকে কোলে নিয়ে পালিয়ে যাচ্ছিলো।
আমার সন্তান নিয়ে আমার বাসা থেকে পালিয়ে যাচ্ছে আমার নামে আর্মি হেড কোয়ার্টার এ বিচার দিতে।
রক্ত গরম হলো মুহূর্তেই।
পিউকে ছো মেরে নিয়ে বন্দি করে দিলাম স্টোর রুমে।কাঁদতে কাঁদতে মেয়েটা কখন ঘুমিয়ে গেছে কে জানে?

রাগ সংবরন করতে না পেরে প্যান্টের বেল্ট খুলে সাগরিকার গলায় চেপে ধরলাম,
―হারামজাদী বিচার দিবি আমার নামে?
―তোর কথার জন্যই তো হারাম পথে টাকা কামাতে গেলাম।
―তুই ই তো আমাকে রাস্তার কুকুরের সাথে তুলনা করেছিলি।
তোকে রাজপ্রাসাদ গড়ে দিলাম তবুও এখন মনে ধরছে না তোর?

জিভ বেরিয়ে এলো সাগরিকার, অসহায় চোখে তাকিয়ে থাকলো আমার দিকে।অনেক কিছু বলতে চাইলো, কিন্তু পারলো না।

সেসবে আমার কিচ্ছু যায় আসে না।
ধস্তাধস্তির এক পর্যায়ে নিস্তেজ হলো সাগরিকা।
নাক দিয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়লো।
নিমিষেই রাগ পানি হলো আমার কিন্তু সাগরিকা আর নেই।
কোথায় লুকাবো এই লাশ?
সাগরিকার তিন কুলে কেউ নেই যে খুজ করতে আসবে।
কিন্তু মেয়েটি তো মাকে খুঁজবে।
কোদাল নিয়ে চলে গেলাম বাড়ির পাশের খালি জায়গা টায়।গভীর গর্ত করে পুতে দিলাম ভালোবাসার সাগরিকা কে।লাগিয়ে দিলাম বকুল ফুলের চারা।

স্মৃতি চারণ করতে করতে পুরো বোতল সাবাড় করে ফেললো নাসের হায়দার।এবার তার প্রচুর ঘুম পাচ্ছে।
ইজি চেয়ারে বসেই মুহূর্তেই তলিয়ে গেলো ঘুমের রাজ্যে।

******
বহু কসরতের পর জানালার গ্রিল খুলতে সক্ষম হলো যুবক দুটো।
রান্না ঘরের জানালা দিয়ে ঢুকে গেলো বাসার ভেতর।
অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে খুঁজতে লাগলো পিউ এর কক্ষ।
দূতলা বাড়ি টিতে মোট বারোটি রুম রয়েছে।
কোনটাতে আছে পিউ?
অন্ধকারে ছোট টর্চ জ্বালিয়ে খুঁজেও সারা বাড়িতে পিউ এর কোনো খুজ পাওয়া গেলো না।
নিস্তব্ধ পরিবেশে হঠাৎই ফুঁপিয়ে কান্নার আওয়াজ পাওয়া গেলো।
চকিত হলো যুবকদ্বয়ের কান।
কান খাড়া করে শব্দ অনুসন্ধান করে এগুতে এগুতে একটি তালাবদ্ধ দরজার সামনে এসে হাজির হলো তারা।
আরেকটু সজাগ হতেই বুঝতে পারলো এই রুম থেকেই কান্নার আওয়াজ আসছে।
দ্রুত ব্যাকপ্যাক থেকে লক কাটার টুলস বের করে শক্ত পেশির শক্তিতে কেটে ফেললো লক।
সহকারী কে পাহাড়ায় রেখে ঢিপঢিপ করা বুক নিয়ে ঢুকে পড়লো কক্ষের ভেতর।
টর্চের আলো ফেলতেই ভয়ে কেঁপে উঠলো পিউ।
নিজের অতিপরিচিত প্রানপ্রিয় পুরুষকে দেখে দাঁড়িয়ে গেলো ।
দৌড়ে এসে গলা জাপ্টে ধরে ফুঁপিয়ে উঠলো।
ভালোবাসার মানুষের এমন করুন পরিস্থিতি সহ্য হলো না প্রেমিক পুরুষের।
গড়িয়ে পড়লো দু ফোটা জল।
পিউ কান্না থামিয়ে শার্টের কলার ধরে বলে উঠলো
―আমাকে এখান থেকে নিয়ে চলো সৌম্য।বাবা আমাকেও আমার মায়ের মতো মেরে ফেলবে।

উপর নিচ মাথা ঝাঁকালো সৌম্য।
অবশ্যই সে আজ সাথে করে নিয়ে যাবে তার ভালোবাসাকে।

হাত ধরে প্রস্থান করতে নিলেই দাঁড়িয়ে গেলো পিউ।
“”এক মিনিট সৌম্য।
দৌড়ে চলে গেলো নিজের কক্ষে।লুকিয়ে রাখা ফোন আর রেকর্ডার ডিভাইস নিয়ে কীয়তক্ষন বাদেই ফিরে এলো।

ধীরে ধীরে পা ফেলে তারা চলে এলো রান্না ঘরে।
মেজর আদ্রিয়ান লাফিয়ে নেমে গেলো বাইরে।
সৌম্য পিউ কে কোলে তুলে বাইরে বের করে দিলো।
মেজর আদ্রিয়ান ধরে ফেললো পিউ কে।
সৌম্য ঝাঁপিয়ে পড়লো এরপর।
খুব সাবধানে গেট ক্রস করে গাড়িতে এসে বসলো।
মেজর আদ্রিয়ান গাড়ি স্টার্ট দিয়ে চলতে লাগলো।

――――――
সকাল হতেই দরজায় ধুপধাপ বাড়ির আওয়াজে ঘুমের ব্যাঘাত ঘটলো নাসের হায়দার এর।
আবারো ঘুমের চেষ্টা চালালো সে।কিন্তু চিৎকার চেঁচামেচি তে ব্যার্থ হলো।
রাগে মুখে খারাপ গালি উচ্চারণ করে দরজা খুলতেই আর্মি স্পেশাল ফোর্সের পুলিশ দেখে অবাক হয়ে জানতে চাইলো
আপনারা?
“”কি চাই আমার কাছে??
দুটো সোলজার গাড়ির ভেতর থেকে শাবল ,করাত আর কোদাল নিয়ে এলো।
এসব যন্ত্রপাতি দেখে চোখ কপালে উঠলো নাসের হায়দার এর।
বিশ বছর ধরে যত্ন করা বকুল ফুলের গাছটি নিমিষেই কেটে ফেললো নবাগত দুজন সোলজার।
কোদাল দিয়ে কুপিয়ে শাবলের সাহচর্যে উপরে ফেললো গাছের মূল।
আরো কিছুখন খনন করতেই বেরিয়ে এলো একটি এলোমেলো কঙ্কাল।
সকলের চক্ষু চড়ক গাছে পরিণত হলো।
পুলিশ অফিসার নির্দেশ দিলেন
“”এরেস্ট হিম।
দুজন সিপাহী হ্যান্ডকাফ পরিয়ে দিলো নাসের হায়দার এর হাতে।
টেনে হিচড়ে নিয়ে যাওয়া হলো তাকে গাড়ির কাছে।

–—–/—–
কোর্ট -মার্শাল বসানো হয়েছে নাসের হায়দার এর জন্য।
বিচারক হিসেবে রয়েছেন আর্মি জেনারেল,এবং বিচার বিভাগ এর একজন বিচারক,সামরিক প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত দুজন উকিল ।

নাসের হায়দার কে হ্যান্ডকাফ পরিয়ে টেবিলে বসানো হলো।সামনে তার কোর্ট রুমের জন্য বরাদ্দকৃত মাইক্রোফোন।

পিউকে ডাকা হলো।

শুরু হলো বিচার কার্য।

একের পর এক পাল্টাপাল্টি প্রশ্ন চলছে।

পিউ তার হাতে থাকা সমস্ত প্রমান আর্মি জেনারেল এর কাছে পেশ করলো।
সকল প্রমানাদির ভিত্তিতে এবং নিজের স্ত্রীকে খুনের দায়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হলো নাসের হায়দার কে আর আশরাফ চৌধুরী কে দ্রুত গ্রেফতার এর নির্দেশ দেয়া হলো।

মেয়ের দিকে তাকিয়ে স্মিত প্রাণহীন হাসলেন নাসের হায়দার।ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নিলো পিউ।
পুলিশ নাসের হায়দার কে নিয়ে যেতে উদ্দত হতেই আসামি পক্ষের উকিল পিউকে জিজ্ঞেস করলেন
―আপনি কি আপনার বাবার উদ্দেশ্যে কিছু বলতে চান?
উকিলের কথা শুনে পিউ ধীর পায়ে নাসের হায়দার এর সামনে এলো।
সে অনেক কিছুই বলতে চায় বাবা নামের এই অমানুষ টাকে।
কিন্তু বলতে ইচ্ছে করছে না এই মুহূর্তে।

কিছুক্ষন মৌন রইলো পিউ,এর পর মাথা উঁচু করে নাসের হায়দার এর চোখে চোখ রেখে বলে উঠলো
―পৃথিবীর সবচেয়ে খারাপ বাবা তুমি,তোমাকে আমি ঘৃণা করি।দূর হয়ে যাও আমার সামনে থেকে।

নাসের হায়দার এর চোখে নীল বেদনার জল দেখা গেলো।
নিজের মেয়ের মুখে এমন কথা শুনে কলিজা মোচড়ে উঠলো তার ।
কিছুই বলতে পারলেন না পিউ কে।
কেউ বুঝি গলা টিপে ধরে আছে।
বহু কষ্টে গলার স্বর স্বাভাবিক করে শুধু বলে উঠলো
―কোনো বাবাই পৃথিবীতে খারাপ হয়ে জন্ম নেয়না রে মা।
পরিস্থিতি বাবাদেরকে খারাপ করে দেয়।
শুধু খারাপ নয়,জঘন্য থেকে জঘন্যতম।

কথাটি বলে আর এক মুহূর্ত অপেক্ষা করলেন না নাসের হায়দার।
পুলিশের আগে আগে চলে গেলেন কারাগারের দিকে।

হাটু মুড়ে মেঝেতে বসে পড়লো পিউ।সৃষ্টিকর্তা তার জন্য কি একটুও বাবা মায়ের আদর রাখতে পারলো না?
দুজন কেই দুই ভাবে কেড়ে নিতে হলো?
পিউএর কান্নায় সৌম্যের চোখেও জল এসে গেলো।
আর্মি জেনারেল পিউকে উদ্দেশ্য করে শান্তনার বাণী দিয়ে প্রস্থান করলেন।
স্বর্গ এসে জড়িয়ে ধরলো পিউ কে।
কোনোমতে শান্ত করে স্বর্গ পিউকে তার সাথে নিয়ে যাবার জন্য প্রস্তুতি নিলো।

*******
সকল পরিস্থিতি যেনো আশরাফ চৌধুরীর প্রতিকূলে।শালা নাসের হায়দার তাকে চূড়ান্ত ফাঁসানো ফাঁসিয়েছে।
এদিকে মন্ত্রী মোশতাক আহমেদ ফোন তুলছে না।
ব্যাটা নির্ঘাত মেয়ে নিয়ে ফুর্তি করে বেড়াচ্ছে।
এদিকে আমি শুলে চড়ে আছি আর ঐদিকে উনি মস্তি করে ঘুরছে।
আরো বার চারেক মোস্তাক আহমেদ এর নম্বর ডায়াল করে রাগে ফোন ছুড়ে মারলেন আশরাফ চৌধুরী।

মেজর মুহিত কে টুকরো টুকরো করে কুত্তা দিয়ে খাওয়াতে পারলে মনে একটু শান্তি পাওয়া যেতো।রাগে মাথার চুল ছিড়তে ইচ্ছে করছে আশরাফ চৌধুরীর।

আশরাফ চৌধুরীর বাড়ির চারপাশ ঘিরে ফেলেছে জনগণ।ক্রমাগত ঢিল ছুড়ে জানালার কাচ ভাঙছেন ক্রুদ্ধ জনতা।
আইনের বিচারের আগে তারাই বিচার করবেন এই জানোয়ারের।
তাদের বোকা বানিয়ে তাদের নাকের ডগায় বসে এসব কুৎসিত অপকর্মের শোধ আজকেই তুলবেন তারা।কিছু মানুষ গেট টপকে ভেতরে ঢুকে গেলো।
সারা বাড়ি তন্ন তন্ন করে খুঁজেও তাকে কোথাও পাওয়া গেলোনা আশরাফ চৌধুরী কে।

আরো কিছু ভাঙচুর করে চলে গেলেন তারা।কিছু মানুষ সুযোগ পেতেই ঘর থেকে দামি জিনিস নিতেও ভুললেন না।

আশরাফ চৌধুরী তার গোপন কামরায় ঘাপটি মেরে বসে আছেন।মানুষের সকল কথাই তিনি শুনতে পাচ্ছেন।
কেউ কেউ নাখাস ভাষায় গালিগালাজ ও করে যাচ্ছেন।
আশরাফ চৌধুরী মনে মনে ভাবলেন
পরিস্থিতি খালি একবার স্বাভাবিক হোক।সবকটা কে চামড়া তুলে লবন মরিচ লাগাবো।

#চলবে।

#তোমার_জন্য_সিন্ধুর_নীল
#পর্ব২৪
#সারিকা_হোসাইন

******
টিকটিক শব্দ তুলে আকস্মিক নীরবতা ভেঙে ঘড়ির কাটা জানান দিলো এখন রাত বারোটা।জানালার ফাক গলিয়ে মৃদু চাঁদের আলো স্বর্গের কক্ষের মেঝেতে হুটোপুটি করছে।থেকে থেকে দমকা বাতাসে সাদা ফিনফিনে পর্দা গুলো উড়ুউড়ি করছে।চারপাশ নিস্তব্ধ, নিগূঢ়।
পিউ কিছুক্ষণ আগেই কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে গিয়েছে।
এসির পাওয়ার কমিয়ে একটা কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লো স্বর্গ।

ত্রিশ মিনিট যুদ্ধ করেও চোখে ঘুম আনতে পারলো না সে।ইদানিং মুহিতের বুকে না শুলে ঘুম ই আসতে চায়না তার ।মুহিত নামক অস্তিত্ব তার সকল অভ্যাস বদ অভ্যাসে পরিণত করেছে দিনে দিনে।

আরো কিছুক্ষণ এপাশ ওপাশ করে উঠে বসলো স্বর্গ।
পিউকে ভালো ভাবে পর্যবেক্ষণ করে শব্দ না করে বিছানা থেকে নেমে দাঁড়ালো।এর পর পা টিপে টিপে দরজার দিকে এগুতে লাগলো।
আস্তে করে দরজা খুলে রুমের বাইরে এসে বাহির থেকে দরজা চাপিয়ে দিলো।

এদিকে নিজের প্রয়োজনীয় সকল কাজ গুছিয়ে ব্যাগ গুছাচ্ছে মুহিত।সকালে সে তার নিজের কোয়ার্টার এ ফিরে যাবে।এখানে থেকে কাজ করতে কিছুটা সমস্যা হচ্ছে তার।নাফিজ মাহমুদ বা স্বর্গ কারো কাছেই এমন প্রশ্নের সম্মুখীন হতে চায়না মুহিত যার উত্তর তার জানা নেই।

নিজের বাসা থেকে যেই কাজ যতো কমফোর্টলি করা যায় অন্যের বাসায় সেটা ততোটাই আনইজি।
মায়ের জন্য মুহিত এতোদিন এখানে পরে ছিলো।নামিরা ফিরে এলে মুহিত সবাইকে নিয়ে তার বাবার পুরাতন বাড়িটাতে উঠবে।আবার একসাথে হেসে খেলে বাঁচবে তারা।

এবার যে পথের কাটা হয়ে দাঁড়াবে তাকেই মূল সমেত উপড়ে ফেলবে মুহিত।
যেই গ্লানি এই ছয় বছর টেনেছে তারা প্রত্যেকে ,তার আর পুনরাবৃত্তি হতে দেবেনা সে কিছুতেই।

দরজার সামনে কারো হাঁটার শব্দে সজাগ হলো মুহিত,
মৃদু শব্দে নক হতেই ঠোঁটে ফুটলো প্রাপ্তির হাসি।
দরজার ওপাশে কে আছে বুঝতে ন্যানো সেকেন্ড সময় ও লাগলো না তার।
সহসাই রুমের লাইট নিভিয়ে খুট করে দরজা খুলে হেচকা টানে কোলে তুলে ফেললো স্বর্গকে।
আদুরে বিড়ালের ন্যায় মুহিতের গলা জড়িয়ে ধরে থুতনিতে মুখ গুজলো স্বর্গ।
এর পর মুহিতের গলায় নাক ডুবিয়ে লম্বা এক নিঃশ্বাস নিলো।
মুহিতের গায়ের গন্ধে আপনা আপনি চোখ বন্ধ হয়ে এলো তার।এখন ভালো ঘুম হবে।

স্বর্গকে বিছানায় এনে বসিয়ে দিলো মুহিত।তার চলে যাওয়ার কথা এখনো বলেনি স্বর্গকে।
কিভাবে কথাটা শুরু করবে সেটাও জানেনা।
মুহিত জানে, চলে যাবার কথা শোনা মাত্রই মেয়েটা কষ্ট পেয়ে কেঁদে দিবে।কিন্তু মুহিতের যেতেই হবে।
আরো দুটো পথের কাঁটা এখনো তুলতে বাকী আছে যে।।

নীরবতা ভেঙে আদুরে কন্ঠে বলে উঠলো মুহিত
―তুমি না বলেছিলে আজকে আসবে না?পিউ এর সাথে ঘুমুবে?

ঠোঁট উল্টালো স্বর্গ।এই মানুষটার সামনে আসলে তার যতো ধরনের বাচ্ছামো আছে সব করতে ইচ্ছে করে।

মুহিতের শার্টের বাটনে আঙ্গুল খুটতে খুটতে বললো
―তোমাকে ছাড়া ঘুম আসছিলো না।
জানো এক ঘন্টা ধরে এভাবে চোখ বন্ধ করে রেখেছি আমি
বলেই হাত দিয়ে চোখ টিপে ধরে মুহিতকে দেখালো ।

মেয়েটির এমন কিউট ফেস দেখে ঠোঁট কামড়ে হেসে উঠলো মুহিত।।
স্বর্গকে উদ্দেশ্য করে মুহিত বললো
―চলো আমি ঘুম পাড়িয়ে দিচ্ছি।ভোর হবার আগেই চলে যাবে কেমন?
বড় বড় চোখ মেলে দুই ঠোঁট ফুলিয়ে স্বর্গ জবাব দিলো
―হু।
ডিম লাইট জ্বালিয়ে এসির পাওয়ার কমিয়ে কাঁথা জড়িয়ে স্বর্গকে বুকে টেনে শুয়ে পড়লো মুহিত।
এই মুহূর্তে যেনো তুলতুলে শরীরের এই উত্তাপ টাই প্রয়োজন ছিলো মুহিতের।
মুহিতের পেশীবহুল হাতের নীচে গুটিসুটি মেরে মুহিতের বুকে চুপ করে শুয়ে শুয়ে এক শয়তানি ফন্দি আটলো স্বর্গ।

হঠাৎই মুহিতের বাইসেপ পেশিতে কামড়ে ধরলো স্বর্গ।
অকস্মাৎ আক্রমণে ককিয়ে উঠলো মুহিত।
সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে কামড়ে ধরেছে স্বর্গ।
ইদানিং নাকি মুহিত কে দেখলেই তার দাঁত কিড়মিড় করে কামড়ানোর জন্য।
দাঁত পিষে সবটা সহ্য করলো মুহিত।একদিকে মামাতো বোন,আবার প্রেমিকা তারমধ্যে বউ।এমন বাম্পার অফার পেতে প্ল্পহলে একটু কষ্ট তো সহ্য করতেই হবে।

কিছুক্ষণ বাদে মুখ সরিয়ে মুহিতের বুকে ঘাপটি মেরে রইলো স্বর্গ।
মুহিত নরম কন্ঠে জানতে চাইলো
–মাংস খাওয়া শেষ মনা?

স্বর্গ আস্তে করে বললো
―হুম।
স্বর্গকে একটু লজ্জা দিতে মুহিত আহ্লাদী স্বরে বলে উঠলো
―আমি তো সহ্য করে নিলাম।
এখন আমি যদি খেতে শুরু করি তুমি সহ্য করতে পারবে তো বউ?

মুহিতের মধুমাখা স্বরে তনুমন জ্বলে উঠলো স্বর্গের।লোকটা দিনে দিনে বদের হাড্ডিতে পরিণত হচ্ছে।
কিন্তু যতো যাই হোক আজকে সে মুহিতের কাছে কিছুতেই ধরা দিবেনা।

হঠাৎই কথা ঘুরাতে বলে উঠলো বিলি কেটে দাও ঘুম পেয়েছে।

স্বর্গের ঘুম ঘুম কন্ঠে বেসামাল হতে ইচ্ছে কাছে মুহিতের।
কিন্তু নিজেকে কন্ট্রোল করে স্বর্গকে এক হাতে জড়িয়ে ধরে অন্য হাতে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো।

মুহিতের মনে হলো তার চলে যাবার ব্যাপারে স্বর্গকে এখন বলা টাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে।
কিছুক্ষণ ইতস্তত করে মুহিত বলে উঠলো
―একটা কথা ছিলো।
“”হু বলো শুনছি
―আমি কাল ফিরে যাচ্ছি আমার কোয়ার্টার এ।
কথাটা শোনামাত্র লাফ দিয়ে বসে গেলো স্বর্গ।
অবাক হয়ে জানতে চাইলো
―চলে যাচ্ছ মানে?

স্বর্গের ডেসপারেট ভাব দেখে মুহিত স্বর্গকে কাছে টেনে নিজের কোলে বসালো।
এরপর নিজের সাথে জড়িয়ে ধরে পিঠে হাত বুলাতে বুলাতে বললো
―কিছু কাজ আছে,ওগুলো দ্রুত শেষ করে তোমাকে একবারে আমার কাছে নিয়ে যাবো।
মনে করো, সেই কাজ গুলোই দ্রুত শেষ করতে যাচ্ছি।

মুহিত চলে যাবে ভাবতেই মন ভার হলো স্বর্গের।যেহেতু মুহিত বলেছে তার কাজ আছে সেহেতু স্বর্গ কোনো ভাবেই বাধা দিবেনা মুহিত কে।আর মুহিত যেহেতু নিজে থেকে বলেনি কি কাজে যাচ্ছে তাই স্বর্গ ও আগ বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করে মুহিত কে বিব্রত করলো না।

ভেজা কন্ঠে মুহিত কে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে অনুরোধ করে বললো
―যেখানেই যাও আমার মুহিত কে অক্ষত অবস্থায় আমার কাছে ফেরত দিবে।
প্রমিস?
স্বর্গের কপালে অনেক গুলো চুমু খেয়ে মুহিত বললো
“”প্রমিস।

―――――
পেরিয়ে গেছে দুটো দিন আশরাফ চৌধুরী কে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।রিপোর্টার, জনগণ, ছোট বড় ইউটিউবার সবাই মিলে ভিড় করে আছে আশরাফ চৌধুরীর বাড়ির সামনে।
একটা জলজ্যান্ত মানুষ গায়েব হয়ে গেলো নিমিষেই ,কেউ ই টের পেলো না?

যতো ধরনের যানবাহন আছে প্রত্যেকটা জায়গায় খুঁজ নেয়া হলো।আশরাফ চৌধুরীর ছবি দিয়ে বিজ্ঞাপন দেয়া হলো
―ধরিয়ে দিন।
মুহিতের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়লো,
গেলো কোথায়?

হঠাৎই মুহিত সৌম্যকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো
―ক্যাপ্টেন চলো আহিয়ান কে দেখে আসি।
বলেই বাঁকা হাসলো মুহিত।

*******
ঢাকার নামিদামি একটি হোটেলের বিলাসবহুল কক্ষে দুটো মেয়েকে নিয়ে ফুর্তিতে মেতেছে মন্ত্রী মোশতাক আহমেদ।
ফুর্তির সময় ফোন কলে ডিস্টার্ব করা একদম পছন্দ নয় তার।
তার মতে যে ব্যাক্তি প্রতিদিন নতুন দেহের স্বাদ না পেয়েছে তার জীবন বৃথা।
মনের মধ্যে আফসোস নিয়ে মরার কোনো সাধ নেই তার।যতদিন বাঁচবে ফুর্তি করেই বাঁচবে।
ক্ষমতা বড়ই ভয়ঙ্কর জিনিস।ক্ষমতা থাকলে টাকা থাকে আর টাকা থাকলে বাঘের চোখ ও কেনা যায়।
না হলে তার মতো এক বুড়ো চুষা আমের কাছে কচি হট মেয়ে গুলো শয্যাসঙ্গী হতে কেনো আসবে?
নিজের ক্ষমতার দাপটে নিজেই হো হো করে হেসে উঠলো।

দুটো মেয়ে বয়স বিশ কি বাইশ,খুবই ছোট ছোট পোশাকে মোশতাক আহমেদ এর গায়ে পরে ঢলাঢলি করছে আর মোশতাক আবেশে চোখ বন্ধ করে সুরা পানে ব্যাস্ত।
হঠাৎই খুট করে খুলে গেলো দরজা।
ঘরে প্রবেশ করলো তিনজন উঁচু,চওড়া,কালো কাপড় পরিহিত আগন্তুক।
হঠাৎ রুমের মধ্যে কারো আগমনে মেয়ে গুলো দৌড়ে বিছানার সাদা চাদরে নিজেকে আবৃত করলো।
হঠাৎ ই একজন কালো কাপড় পরিহিত লোক মেয়ে গুলোর উদ্দেশ্যে গর্জে উঠে বললো
―গেট আউট।
ভয়ে মেয়ে গুলো দ্রুত প্রস্থান করলো।
রুমে হঠাৎ কারো আগমনে ভড়কে গেলো মোশতাক আহমেদ।মুহূর্তেই নিজেকে ধাতস্থ করে বালিশের নিচে রাখা রিভলবার বের করে যুবক গুলোর দিকে তাক করলো।

রিভলবার ধরার স্টাইল দেখেই যুবক গুলো বুঝে গেলো এই লোক কোনোদিন একটা গুলি তো দূরে থাক ট্রিগার ই চাপে নি।

বন্দুক তাক করে মোশতাক বলতে থাকলো
―মুখের কাপড় খোল শুয়োরের বাচ্চা রা দেখি বুকের কতো পাটা।
বলা মাত্রই মুখের কাপড় খুললো তারা।
তাদের চেহারা দেখেই মোশতাক বলে উঠলো
―তুই বেঁচে আছিস?
হাসলো মুহিত,তাচ্ছিল্য ভরা কন্ঠে বলে উঠলো
“”তুই কিসের মন্ত্রী?
এতো এতো ঘটনা হয়ে যাচ্ছে আমাকে ঘিরে তুই কিছুই জানিস না?
মোশতাক মুহিতের কথার আগা মাথা কিছুই বুঝতে পারলো না।

হঠাৎই মেজর আদ্রিয়ান জোরে এক ঘুষি বসিয়ে দিলো মোশতাক এর পেটে।
ঘুষি খেয়ে পেটের সব হাওয়া গালে জমা হলো,গাল ফুলিয়ে
“ওপ” শব্দ করে বসে পড়লো মোশতাক।হাত থেকে ছিটকে পড়লো ভারী রিভলবার।
ইন্টার কমে ফোন করার চেষ্টা করলো সে,সৌম্যের জন্য সেটাও পারলো না।

মুহিত গমগমে কন্ঠে সৌম্যকে আদেশ দিলো ওকে বাথটাবে শুইয়ে বেঁধে ফেলো।

দুজন সেনা সদস্যের শক্তির সাথে টিকতে পারলো না মোশতাক।তাকে চ্যাঙ্গদোলা করে তুলে নিয়ে বাথরুমের দিকে অগ্রসর হলো মেজর আদ্রিয়ান আর সৌম্য।

মোশতাক মুখের ঠাট বজায় রেখে বিভিন্ন হুমকি ধামকি দিতে থাকলো।
―তোদের সবকটার চাকরি খেয়ে ফেলবো দেখিস,কার সাথে পাঙ্গা নিয়েছিস?

―বেঁচে থাকলে তবেই তো চাকরি খাবি বলে উঠলো আদ্রিয়ান।
সেনাসদস্য দের এমন হেঁয়ালি কথা শুনে রাগে হিতাহিত জ্ঞান হারালো মোশতাক।
বাথটাবের পাশে থাকা কাঁচের বডি ওয়াশ এর বোতল দিয়ে মুহিতের মাথায় বাড়ি বসিয়ে দিলো।
হাত দিয়ে নিজেকে প্রটেক্ট করতে গিয়ে হাতের কব্জি থেকে উপর পর্যন্ত কেটে রক্ত বেরিয়ে গেলো মুহিতের।
রাগে চক্ষু লাল হয়ে গেলো মুহিতের।
ভাঙা টুকরো কুড়িয়ে মোশতাকের চোখ বরাবর বিধিয়ে দিতে উদ্দত হতেই চোখ খিচে বন্ধ করে ফেললো মোশতাক।

এইটুকু সাহস নিয়ে আমায় বাড়ি মেরেছিস?বলেই হা হা করে হাসলো মুহিত।
মোশতাক এর গায়ে আগুন ধরে যাচ্ছে মুহিতের হাসিতে।
নিজেকে নিজেই মনেমন গালাগাল দিয়ে যাচ্ছে সিকিউরিটি ছাড়া কেনো এসেছে সেটা ভেবে।
সিকিউরিটি সাথে থাকলে মুহিতের তেরোটা বাজিয়ে ছেড়ে দিতো আজকে সে।
সামান্য মেজর হয়ে তাকে বাথ টাবের সাথে বেঁধে ফেলে ?

হঠাৎই স্কচটেপ আটকে দেয় মোশতাকের মুখে মুহিত।এবার মোশতাকের ভয় করতে শুরু করে।
কি করতে চাইছে এই মেজর?

মুহিত আগ্নেয়গিরির লাভার ন্যায় রক্ত চক্ষু নিয়ে মোশতাকের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলে
―তুই ই সেদিন আমার মা কে বাথটাবে চুবিয়ে দিয়েছিলি নাহ?

কুকর্মের সকল স্মৃতি হাতড়ে মনে পড়ে যায় মোশতাকের ছয় বছর আগের সেই ঘটনা।
আশরাফ চৌধুরীর কথা মতো আদনান ওয়াসিফ এর বাড়িতে তারা হানা দেয়।
ড্রয়িংরুমে বসে ছিলো আদনান ওয়াসিফ আর তার ছোট বাচ্চা ছেলেটা।
তাদের কে হত্যার সময় দূতলা থেকে আদনান ওয়াসিফের স্ত্রী দৌড়ে সিঁড়ি বেয়ে নামতে থাকে আর চিৎকার চেঁচামেচি করতে থাকে।
সকলেই যখন বাপ ছেলেকে নিয়ে পড়ে আছে তখন মোশতাক দৌড়ে গিয়ে খাবলে ধরে মিসেস তারিনের হাত।
সপাটে গালে চড় মেরে সিঁড়িতে ফেলে দেয় তাকে।
এর পর চুলের মুঠি ধরে টেনে হিঁচড়ে দুতলায় নিয়ে গিয়ে কি করবে ভাবতে থাকে।
হঠাৎই ওয়াশরুমের খোলা দরজা তার নজরে পড়ে।তৎক্ষণাৎ এক শয়তানি বুদ্ধি চাপে তার মাথায়। ওয়াশরুমে নিয়ে গিয়ে শাড়ীর আঁচল দিয়ে শক্ত করে মিসেস তারিনের দুই হাত বেঁধে ফেলে।

মহিলা অনেক কাকুতি মিনতি করছিলো তার বাচ্চাটার জন্য।
কিন্তু মোশতাকের শক্তির সাথে কুলিয়ে উঠতে পারছিলো না।
মহিলার আর্তনাদে মোশতাকের কান ধরে গেলো।
পকেট থেকে টেপ বের করে মুখে লাগিয়ে দিয়ে বাথ টাবে ধাক্কা মারে।
সিরামিকের শূন্য বাথ টাবে চিৎ হয়ে পড়তেই মাথা ফেটে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন মিসেস তারিন।
মোশতাক দ্রুততার সহিত বাথ টাবের কল চালু দিয়ে বেরিয়ে চলে আসে।

মোশতাকের ধ্যান ভাঙে পানি পড়ার শব্দে।
ভয়ে চোখ বড় হয়ে যায় মোশতাকের।মুখে উম উম করে অনেক কিছু বলার চেষ্টা করে যাচ্ছে সে ।হাত পা এমন ভাবে বাধা হয়েছে, ডাঙ্গায় তোলা মাছের মতো মোশতাক শুধু উল্টা পাল্টা করে যাচ্ছে কিন্তু দাঁড়াতে পারছে না।
টাকা, ক্ষমতা,কিছুই যেনো আজ তার কাজে আসছে না।

মুহিত বেদনা জড়িত কন্ঠে বলতে থাকে
―তোরা আমাদের পুরো পরিবার শেষ করে দিয়েছিস।আমার মাকে জিন্দা লাশ বানিয়ে রেখেছিস।ঠিক সময়ে আমরা না এলে মা ও হয়তো বাবা আর ছোট ভাইয়ের মতো হারিয়ে যেতো।তোদের জন্য আমার বোনটা ছয় বছর ধরে বাংলাদেশে আসতে পারেনা।

হিসেব না চুকে কিভাবে তোকে ছাড়বো বল?

মিনিট দশেক বাদেই স্বচ্ছ পানিতে পরিপূর্ণ হলো বাথটাব।মুহিত বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে মোশতাকের বুকে পাড়া দিয়ে ধরলো।তলিয়ে গেলো মোশতাক।
মিনিট দুয়েক বাদে ছেড়ে দিলো,ভেসে উঠে যেনো বেঁচে ফিরলো মোশতাক।
এমন কঠিন দম বন্ধকর মৃত্যু কে চাইবে?
মনে মনে ভাবলো মোশতাক বেঁচে ফিরলে সকল খারাপ কাজ বাদ দিয়ে ভালো হয়ে যাবে।
কিন্তু এই মেজর কি সেই সুযোগ তাকে দিবে?
মোশতাক কে দ্বিতীয় বার পানিতে ডুবানোর আগে মুহিত তেজী কন্ঠে বলে উঠলো
―তোকে আমি মেরে ফেলবো রে মন্ত্রী।
তুই তোর এই ক্ষমতার জেরে কতো মানুসের ক্ষতি করেছিস তুই নিজেও জানিস না।তোর লালসা মিটাতে ভার্সিটির মেয়েদের পর্যন্ত ছাড় দিস নি তুই। তুই দেশের ভবিষ্যৎ কি গড়বি?তুই আরো ভবিষ্যত নষ্ট করছিস।

কতোজন কে পাচার করেছিস আশরাফ এর সাথে মিলে?
ক্রুদ্ধ হয়ে জানতে চাইলো আদ্রিয়ান।

তুই বেঁচে থাকলেই বরং দেশ ও দেশের মানুষের ক্ষতি।
তার চেয়ে তুই মরে যা।কারন তুই সমাজের জঞ্জাল।
আর জঞ্জাল সাফ করাই আমাদের দায়িত্ব বলে উঠলো সৌম্য।

মুহিত দুই হাত দিয়ে বাথটাব ভর্তি পানিতে চুবিয়ে চেপে ধরলো মোশতাক কে।তড়পাতে থাকলো মোশতাক।মুহিতের মাথায় যেনো খুন চেপে গিয়েছে।মোশতাক এর প্রাণবায়ুর বিনিময়ে ই যেনো মুহিতের শান্তি মিলবে।

ধস্তাধস্তির এক পর্যায়ে চোখ বড় হয়ে গেলো মোশতাকের।তার শেষ নিঃশ্বাসের সাথে পানি ভুরকি কাটলো।
মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই ভেসে উঠলো পানির উপরে।

শেষ হয়ে গেলো তাদের আরেকটি গোপন মিশন।

দ্রুততার সাথে হাত পায়ের বাধন খুলে দিয়ে,মুখের টেপ তুলে বাথরুম পরিষ্কার করে সব কিছু ঠিকঠাক করে নিথর মোশতাক কে ফেলে চলে গেলো তারা।
এবার আশরাফ চৌধুরীর পালা।
কঠিন থেকে কঠিনতম শাস্তি দিবে তাকে মুহিত।

#চলবে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে