তোমার জন্য সিন্ধুর নীল পর্ব-২১+২২

0
252

#তোমার_জন্য_সিন্ধুর_নীল
#পর্ব_২১
#সারিকা_হোসাইন

দেয়ালে থাকা এসিটা এই তীব্র তাপদাহের মধ্যেও ফুরফুরে ঠান্ডা হাওয়া দিয়ে যাচ্ছে যার কারনে বাইরের আগ্নেয়গিরির লাভার মতো উত্তাপ গায়ে লাগছে না।জানালার দামি ভারী পর্দা গুলো মাঝে মাঝে বাতাসে দোলে উঠছে।চারপাশে ফিনাইলের উটকো গন্ধ ভেসে বেড়াচ্ছে পুরো কেবিন জুড়ে।

সকল পরীক্ষা নিরীক্ষার পর স্ট্রেচারে করে এনে মুহিত কে কেবিনে শিফট করা হলো।চাইলেই মুহিত বাসায় যেতে পারবে।কিন্তু মুহিত ই যেতে চাচ্ছে না।

একজন নার্স সহ একজন এসিস্ট্যান্ট ডক্টর নিয়ে কেবিনে প্রবেশ করলেন প্রফেসর সারোয়ার জাহান।হাতে মুহিতের সকল রিপোর্টস।

মুহিত কে উদ্দেশ্য করে প্রফেসর বলতে শুরু করলেন

―মেজর মুহিত ভয়ের কিছুই নেই,আপনাকে যেই গুলি টি করা হয়েছিলো তা খুব কম রেঞ্জের হওয়ার কারনে পিঠ ভেদ করে বেরিয়ে গেছে।আল্লাহ সহায় জন্য আপনি বেঁচে গেছেন।গুলি ভেতরে থাকলে এতোদিনে ইনফেকশন হয়ে আপনি মারা যেতেন।আর হাতে পায়ের যেই হাড় গুলো ভেঙেছে তা অনেকটাই রিকভার করেছে।
আমি জানিনা কে এগুলো ঠিক পজিশনে বসিয়েছে?
তবে যিনি বসিয়েছেন তার হাতে জাদু আছে বলতে হবে।
এরকম ফ্রাকচার আর ভাঙা হাড় জোড়া লাগতে অনেক সময়ের ব্যাপার।
আপাতত ব্রেচ পরিয়ে কয়েকদিন গলায় স্লিং ঝুলালেই আপনার হাত ঠিক হয়ে যাবে।
প্রফেসর সারোয়ার জাহান এর কথা শেষ হতে না হতেই ঝড়ের বেগে দৌড়ে কেবিনে প্রবেশ করলো স্বর্গ।

স্বর্গকে দেখে প্রফেসর অবাকের স্বরে জিজ্ঞেস করলো
―আরে স্বর্গ মামনি তুমি এই সময়ে ?
স্যার মেজর মুহিত ইজ মাই উডবি!
ওর ড্রেসিং গুলো আমি করাতে চাই।

প্রফেসর হাসি মুখে বললেন
―সিউর,হুয়াই নট?

মুহিত স্বর্গের এহেন স্বাভাবিক আচরণ দেখে নবম আশ্চর্যে উপনীত হলো।সে ভেবেছিলো কোথায় স্বর্গ তাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদবে,অভিযোগ, অনুযোগ জানাবে।কিন্তু মেয়ে দেখি পুরো স্টিল হয়ে বসে আছে।
ফিরে এসে ভুল করলো নাকি মুহিত?

নাকি ঝড়ের পূর্বাভাস?

খালি গায়ে বেডে বসে আছে মুহিত।স্বর্গ ভালোভাবে হাত ধুয়ে ষ্টেরাইল গ্লাভস পরে নিলো।এর পর একজন নার্স এসে ট্রলিতে করে ষ্টেরালাইজড যন্ত্রপাতি ব্যান্ডেজ, রিবোন গজ, আরটারি ফরসেপ্স, টুথ ফরসেপ্স, সিজোর, পোভিসেপ, হেক্সিসল, স্পিরিট, দিয়ে গেলো।
বড় রিবন গজ পভিসেপে চুবিয়ে মুহিতের দিকে করুন চোখে তাকিয়ে ক্ষততে ঢুকিয়ে দিলো।সাথেই সাথেই মুহিত চিৎকার করে উঠলো।
স্বর্গ নির্বিকার কঠিন হয়ে তার কাজ চালালো।

মুহিতের এই মুহূর্তে স্বর্গকে কঠিন হৃদয়ের মানবী মনে হচ্ছে।মুহিতের আর্তনাদে নার্স আর সহকারী ডক্টর শিউরে উঠলো।

স্বর্গ মুহিত কে উদ্দেশ্য করে স্বাভাবিক কন্ঠে বলে উঠলো―

―মেজর মুহিত প্লিজ দাঁত চেপে সহ্য করুন,আমি এভাবে ড্রেসিং না করলে ভেতরের ময়লা পরিষ্কার হবে না।যতো জোরে প্রেস করবো ততো গজ টা ময়লা চুষে নেবে।
প্লিজ আরেকটু সহ্য করুন।

টুথ ফোর্সেপ্স দিয়ে প্রথম রিবন গজ বের করে আনলো স্বর্গ।মুহিত যেনো দ্বিতীয়বার বেঁচে ফিরলো।এর পর আবার একটি মেডিকেটেড গজ রেডি করলো স্বর্গ।
ক্ষততে দেবার আগেই মুহিত স্বর্গের হাত চেপে ধরলো।

স্বর্গ চোখের ইশারায় নার্স আর এসিস্ট্যান্ট ডক্টর কে চলে যেতে বললো।
তারা চলে যেতেই স্বর্গ মুখের মাস্ক খুলে মুহিতের ঠোঁটে উষ্ণ চুমু দিয়ে বলে উঠলো
―এটাই শেষ আর কষ্ট দিবোনা।

গজ ঢুকিয়ে চিপে চিপে ক্লিনিং প্রসেস চালাতেই মুহিত বহু কষ্টে গলায় স্বর এনে বলে উঠলো
―অনেক কষ্ট হচ্ছে বউ।

মরে যাচ্ছি।

একটু তো রহম করো প্লিজ।

মুহিতের আর্তনাদে স্বর্গের বুক ভেঙে কান্না পেলো।
কিন্তু সে একজন ডাক্তার।কিছু কিছু ক্ষেত্রে ডাক্তার দের হতে হয় কঠোর মনের অধিকারী।
নিজ নিজ অবস্থানে থেকে পরিস্থিতি যতোই খারাপ হোক দায়িত্ব পালন করতেই হবে।

―আরেকটু সহ্য করো প্লিজ মুহিত।

মুহিত দাঁত চেপে বসে থাকলো ।
বিশ মিনিট পর স্বর্গের ড্রেসিং শেষ হলে মেডিসিন দিয়ে গজ দিয়ে মুহিতের বুক পিঠ পেঁচিয়ে দিলো।

নার্স কে ডাকতেই তারা এসে মুহিত কে পিঠের নিচে বালিশ দিয়ে আধ শোয়া করে দিলো।

হাতে পায়ে প্লাস্টার করে ব্ৰেচ পরিয়ে বেডে শুইয়ে দেয়া হলো মুহিত কে।
শরীরের জখম গুলো অনেকটাই শুকিয়ে গিয়েছে।

মুহিতকে কেবিনে রেখে স্বর্গ বাইরে চলে আসলো চেঞ্জ করতে।
ডাস্টবিনে গ্লাভস গুলো ফেলে বেসিনের সামনে দাঁড়ালো হাত ধুতে।
নিমিষেই মন আকাশে কালো মেঘের আনাগোনা হলো।
টুপটুপ করে অবিরত গড়িয়ে পড়লো কপোল বেয়ে।
মুহিতের এমন অবস্থা সহ্য করতে অনেক কষ্ট হয়েছে তার।তবুও হিংস্রের ন্যায় মুহিতকে কষ্ট দিয়েই গেছে সে।
মুহিতকে এতোটা অসহায় আর কখনো লাগেনি।
মুহিত তার কাছে বেচে ফিরেছে এই অনেক।স্বর্গের মাথায় স্বাভাবিক জ্ঞান থাকতে মুহিতকে কোনো দিন কষ্ট পেতে দিবেনা আর।
দরকার পড়লে বুকের ভেতর আগলে রাখবে সে ।

চোখে মুখে পানির ছিটা দিয়ে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে এলো স্বর্গ।

সুখ আর তনুজা মুহিতের প্রিয় ইলিশ পোলাও নিয়ে কেবিনের সামনে বসে আছে।
স্বর্গের কঠিন নির্দেশ
কেউ দুই মিনিটের বেশি ওর রুমে থাকতে পারবে না।
প্রথমে সুখ গেলো।

―হ্যালো ব্রো
তুমি আমার বোনকে এতো কষ্ট দিলে এটার জন্য বিশেষ শাস্তির ব্যাবস্থা আছে তোমার জন্য।
তুমি সুস্থ হলে আমি তোমার বিষয় টা হ্যান্ডেল করবো।

তোমার বোন যদি আমাকে পানিশমেন্ট দিতে দেয় তাহলে আমি ঘাড় পেতে নিবো সালা বাবু।

বলেই ফিচেল হাসলো মুহিত।
সুখ আরো কিছু কথা বলে বেরিয়ে গেলো।

তনুজা নীরবে কেঁদেই যাচ্ছে মুহিতের পাশে বসে।মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে উঠলেন
আমার মেয়েটা তোমাকে বড্ড ভালোবেসে ফেলেছে বাবা।
এতোদিন আমরা কেমন জীবন কাটিয়েছি আল্লাহ ছাড়া কেউ জানে না।
দ্রুত সুস্থ হলেই তোমাদের চার হাত এক করে দেব।
সময় করে তোমার মাকে একটা কল করো।।
উনি চিন্তায় ভেঙে পড়েছেন তোমাকে ফোনে না পেয়ে।
মুহিত ঘাড় কাত করে বাধ্য ছেলের মতো সায় জানালো।

তনুজা চলে যেতেই টিফিন ক্যারিয়ার সমেত কেবিনে প্রবেশ করলো স্বর্গ।
প্লেটে খাবার গুলো ঢেলে ইলিশ মাছের কাঁটা বেছে মুহিতের সামনে লোকমা তুললো।

এই হৃদয়হীনা একটু আগে তাকে চরম কষ্ট দিয়েছে। মুহিত কিছুতেই খাবেনা তার হাতের খাবার।
মুখ ঘুরিয়ে বসে থাকলো মুহিত।

স্বর্গের কাছে মুহিতের মতিগতি সুবিধার ঠেকলো না।যেখানে তার অভিমান করার কথা সেখানে সে ভাব ধরে বসে আছে?

মুহিতের দুই চোয়ালে হাত দিয়ে চেপে ধরে পোলাও পুড়ে দিলো।
মুহিতকে উদ্দেশ্য করে স্বর্গ তেজি কন্ঠে বলে উঠলো
―ঢং কম করে করো।খাবার পুরোটা খেয়ে মেডিসিন খেতে হবে।ঢং করলে তোমার ই লস।
বলেই আরেক লোকমা ঠুসে দিলো।
খাবার চিবুতে চিবুতে মুহিত বলে উঠলো

― জল্লাদি একটা।

―――――
মিসেস তনুজার ল্যান্ড লাইনে সমান তালে রিং বেজে যাচ্ছে।তনুজা দৌড়ে এসে ফোন কানে তুলতেই মিসেস তারিনের আওয়াজ পাওয়া গেলো

কি গো তনু কি খবর তোমাদের?
―জি আপা ভালো রেখেছে উপর ওয়ালা।
নামিরা আর বাবু কেমন আছে?

মিসেস তারিন প্রাণহীন উত্তর দিলেন।মুহিতের জন্য কদিন ধরে মনটা খচ খচ করছে।আজ প্রায় এক মাসের বেশি হয়ে গেলো ছেলেটার সাথে কোনো যোগাযোগ নেই।ইদানিং ঘুমালেই বিভিন্ন আজেবাজে স্বপ্ন এসে হানা দেয়।
মনের সন্দেহের ভিত্তিতে তনুজা কে মিসেস তারিন বলেই ফেললো

―আমার ছেলেটা বেঁচে আছে তো তনু?

মিসেস তারিনের এহেন প্রশ্নে চমকে উঠলো তনুজা।
নিজেকে ধাতস্থ করে বলে উঠলেন
ছি ছি এসব কি বলেন আপা?

মুহিত আজ ফোন করেছিলো আপনাকে ফোন করার কথা বলেছে আপনার ভাই।
আজ কালকের ভেতরই মুহিতের ফোন পাবেন ইনশাআল্লাহ।

আরো কিছু কথা বলে লাইন কেটে ঢকঢক করে পানি খেয়ে নিলেন তনুজা।
এই প্রশ্ন টা মিসেস তারিন যদি আরো আগে করতো তাহলে তনুজা কিভাবে সামলাতেন সব কিছু?

―――――
ক্যাপ্টেন সৌম্য আর নাফিজ মাহমুদ দাঁড়িয়ে আছে মুহিতের সামনে।নিজের ভাগ্নের এমন সূচনীয় অবস্থা সহ্য না করতে পেরে কেঁদে দিলেন নাফিজ মাহমুদ।এতো সুন্দর ছেলেটা ব্যান্ডেজ এর চোটে মমিতে পরিণত হয়েছে।এসব কি মানা যায়?

সৌম্য হঠাৎ ই মুহিতের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছুঁড়লো
―স্যার আমার পরবর্তী কাজ কি?

―প্রেস কনফারেন্স এর আয়োজন করো ক্যাপ্টেন সৌম্য শাহরিয়ার।
বলেই বাঁকা হাসি হাসলো মুহিত।

*******
ছেলেটাকে দেখে আসার পর থেকে কিছুই ভালো লাগছে না আশরাফ চৌধুরীর।সবকিছু একঘেয়ে লাগছে।একটু দেশ বিদেশের খবর দেখা দরকার।টিভি অন করে নিউজের চ্যানেল চাপতে চাপতে এক জায়গায় এসে থমকে যান আশরাফ চৌধুরী।দৃষ্টি বিস্ফারিত হয়ে যায় তার।এ কিভাবে সম্ভব?নিমিষেই মাথা ঘুরে উঠলো তার।

সাংবাদিক রা একের পর এক প্রশ্ন করে যাচ্ছে মুহিত কে আর সেগুলোই বিভিন্ন টিভি চ্যানেল এ টেলিকাস্ট করা হচ্ছে।

―মেজর মুহিত কে বা কারা আপনাকে হত্যা করার চেষ্টা করেছিলো?
আপনি কি তাদের চেহারা দেখতে পেয়েছিলেন?

―না আমি তার চেহারা দেখতে পাইনি, আমাকে পিছন থেকে শ্যুট করা হয়েছে।লোকটি কালো পোশাকে আবৃত ছিলো।

সাংবাদিক আবার প্রশ্ন ছুঁড়লো

―এই ছোট ছেলেটির সাথে আপনার কিভাবে পরিচয়?আমরা শুনেছি সে একজন ট্রাক ড্রাইভার।

পাশে থাকা ছেলেটি লাইট ক্যামেরা দেখে ভয়ে গুটিসুটি মেরে মুহিতের কাছ ঘেষে রইলো।মুহিত মুখের ভাব স্বাভাবিক রেখে বলে উঠলো

আসলে ছেলেটি ওখানকার স্থানীয়।আমি ওর সাহায্য নিয়ে পাহাড়ে উঠেছি।আমাকে যখন কেউ গুলি করে ও তা দেখে ফেলে এজন্য আগন্তুক এই ছেলেটিকেও গুলি করে দেয়।

মেজর মুহিতের এসব বানোয়াট ইন্টারভিউ দেখে আশরাফ চৌধুরীর মাথা ঘুরে যাচ্ছে।

এতোটা স্বভাভিক কিভাবে রয়েছে এই মেজর?আহমেদ কসাই এর হাত থেকে আজ পর্যন্ত কেউ বেঁচে ফিরতে পারেনি।তাহলে এরা কিভাবে পারলো?

আর সত্য না বলে এসব বলে কি করতে চাইছে সে?আশরাফ চৌধুরী নিজেই মুখ খুলে তাকে চেহারা দেখিয়েছে।

দাবার চাল কি নিমিষেই উল্টে যাবে?

――――
আমার মেয়ে হয়ে আমার ই ঘরের খবর তুই ওই আর্মি ক্যাপ্টেন এর কাছে পৌঁছে দিস?কি ভেবেছিস,আমি এতোই বোকা?আমার পিঠ পিছে চাকু বসাবি আমি কিচ্ছুটি টের পাবো না?

তোর মা ও এই একই ধৃষ্টতা দেখিয়েছিলো।
কি করেছি তার সাথে জানিস?

বলেই নাসের হায়দার পিউ এর চুলের মুঠি ধরে জানালার পাশে এনে দাঁড় করালো।

এর পর আঙ্গুলি নির্দেশ করে বললো ঐ যে বকুল গাছ টা দেখছিস ঐখানে পুতে দিয়েছি তোর মাকে।
বাবার মুখে এমন নৃশংস কথা শুনে কেঁপে উঠলো পিউ।

তার মা তাহলে অন্য মানুষের সাথে পালিয়ে যায়নি?
তার বাবা তার মাকে মেরে ফেলেছে?
মায়ের পুরোনো স্মৃতি মনে করে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো পিউ।
রাগী দৃষ্টি নিক্ষেপ করে নাসের হায়দার এর উদ্দেশ্যে বলে উঠলো

―আমাকেও পুতে দাও বাবা
নাহলে আমি কাল সাপ হয়ে ছোবল মারবো তোমাকে।

মেয়ের এমন সাহস দেখে রাগে বোধ শক্তি হারিয়ে ফেললো নাসের হায়দার।
গায়ের সমস্ত শক্তি খাটিয়ে পিউকে এক থাপ্পড় কষিয়ে দিলো।
থাপ্পড়ের তাল সামলাতে না পেরে পিউ ডাইনিং টেবিলের চেয়ার এর সাথে বাড়ি খেয়ে পড়ে গেলো মেঝেতে।
কপালের কোনা কেটে গড়িয়ে পড়লো রক্ত।

পিউ আবার বলে উঠলো
আমাকে মেরে ফেলা বাবা,না হলে তুমি আমার হাতে খুন হবে।

নাসের হায়দার বাজ পাখির মতো পিউকে থাবা মেরে ধরে টেনে হিচড়ে তার গোপন কক্ষে নিয়ে ধাক্কা মেরে বিছানায় ফেলে দিলো।

তুই এখানেই বন্দী থাকবি হারামজাদী।
বলেই বাইরে থেকে দরজা লক করে চলে গেলো।

হাটু মুড়ে বসে হাঁটুতে মাথা ঠেকিয়ে ডুকরে কেঁদে উঠলো পিউ।
পৃথিবীতে এমন খারাপ বাবাও আছে?

মায়ের হাসি মাখা মুখটা মনে পড়তেই বুকে চিনচিনে ব্যাথার অনুভূতি হলো তার।

――――
মুহিত সোহাগের নম্বরে কল করেছে
ওপাশ থেকে সোহাগ হ্যালো বলতেই মুহিত সোহাগের সাথে কুশল বিনিময় করলো।
এর পর সোহাগ স্টোর রুমে গিয়ে দরজা লাগিয়ে দিয়ে ফিসফিসিয়ে বলতে শুরু করলো

―মুহিত তুমি বেঁচে আছো?
টিভিতে তোমার নিউজ দেখে আমি বাসায় সকল লাইন কেটে দিয়েছি যাতে নামিরা বা মা কেউ এই বিষয়ে না জানতে পারে।
মামা কে অনেক বার ফোন করে তোমার খবর জেনেছি।কোনো ভাবেই নাকি তোমাকে উদ্ধার করা যায়নি।
তাহলে কিভাবে বেঁচে ফিরলে?

মুহিত স্মিত হাসলো।সোহাগ কে উদ্দেশ্য করে নরম কন্ঠে বললো
―সময় করে সব বলবো সোহাগ ভাই।আগে প্রয়োজনীয় কিছু কথা বলে নেই।

মা বড্ড অবুজঝ।মাকে আপনার একটু আগলে রাখতে হবে সোহাগ ভাই।
প্রথমে মা কে বলবেন আমি ছয় মাসের জন্য মিশনে এসেছি।আমি ফিরলে মা বাংলাদেশে আসবে ।
যেভাবেই হোক সোহাগ ভাই মাকে ছয় মাস আপনি ধরে বেঁধে রেখে দিবেন।
এখানে আমার কিছু জরুরি কাজ পেন্ডিং আছে।ওগুলো কমপ্লিট করেই আমি আপনাদের সবাইকে দেশে ফিরিয়ে আনবো।
আমরা আবার একসাথে হাসি খুশি ভাবে বাঁচবো সোহাগ ভাই।

******
সৌম্য বসে আছে মুহিতের সামনে।মুহিত তাকে ইন্সট্রাকশন দিচ্ছে কিভাবে কখন কি করতে হবে।

―খলিল কে একটু ধরে আনার ব্যাবস্থা করো সৌম্য
জামাই আদর টা খলিল কে দিয়েই শুরু করবো।

কোথায় ধরে আনবো স্যার?

আহা ক্যাপ্টেন দুধের বাচ্চার মতো সব বুঝিয়ে দিতে হয় তোমাকে।

―যেখানে গেলে ওকে চারশত চল্লিশ ভোল্টে শক দেয়া যাবে সেখানে।

চোখ বড় হলো সৌম্যের, ঠোঁট প্রশস্ত হলো মুহিতের।

#চলবে।

#তোমার_জন্য_সিন্ধুর_নীল
#পর্ব_২২
#সারিকা_হোসাইন®

মুশুলধারে ধরনীতে ঝাঁপিয়ে পড়ছে ভারী বর্ষনের দল।থেকে থেকে বিকট শব্দে বড় বড় বাজ পড়ছে।ভারী বর্ষনের কারনে কোনো মানুষ জন ঘর থেকে বাহির হয়নি আজ।বৃষ্টি আর বজ্রপাত দুটো মিলিয়ে মনে হচ্ছে যেনো সাক্ষাৎ যমদূত ধরনীতে তান্ডব চালাচ্ছে।

ভাঙা একটি পরিত্যক্ত বাড়িতে লোহার চেয়ারে শক্ত করে মুড়িয়ে বাধা হয়েছে গেট কিপার খলিল কে।খলিলের মুখ স্কচ টেপ দিয়ে আটকানো।
আগাগোড়া কালো কাপড়ে মোড়ানো এক দানবের মতো ব্যাক্তি দাঁড়িয়ে আছে খলিলের সামনে।বজ্রপাতের ঝলকানি তে তার অবয়ব বোঝা যাচ্ছে কিন্তু চেহারা স্পষ্ট নয়।
সবেই হুশ ফিরেছে খলিলের।হুশ ফিরেই নিজের এহেন দুর্দশা আর সামনে দাঁড়ানো আগন্তুক কে দেখে রূহ কেঁপে উঠলো খলিলের।

হঠাৎই ছটফট করতে লাগলো খলিল।কিন্তু হাত পা শক্ত করে বাধা।এক বিন্দু নড়ার শক্তি নেই।মুখে অনেক কথাই বলতে চাইলো।সেটাও পারলো না।
খলিলের ছটফটানি দেখে হা হা করে হেসে উঠলো যুবক।

পাশেই বিকট শব্দে বাজ পড়লো।কেঁপে উঠলো খলিল।আজ কি তার জীবনের লীলা খেলা সাঙ্গ হতে যাচ্ছে তবে?

ভয়ের আতংক খলিলের চোখে স্পষ্ট।এটাই চেয়েছিলো মুহিত।
তার কলিজার টুকরা ভাইকে এই নির্দয় খলিল গলা টিপে হত্যা করেছে।
শুধু তাই নয় মুখে স্কচ টেপ লাগিয়ে কথা বলার,চিল্লানোর সুযোগ টা পর্যন্ত দেয়নি।

যেই মুকিত কে বাড়ির কোনো সদস্য ফুলের টোকা পর্যন্ত দেয়নি,সেই মুকিত কে এই জানোয়ার চিপে চিপে মেরেছে।

কতোটা কষ্ট পেয়েছে মুকিত?
মুকিতের করুন চেহারা মনে পড়তেই আগ্নেয়গিরির মতো জ্বলে উঠলো মুহিত।

মুখের কাপড় সরিয়ে টর্চ জ্বালিয়ে হাটু মুড়ে খলিলের সামনে বসলো।

মুহিতের চেহারা দেখেই খলিলের অন্তরাত্মা কেঁপে উঠলো।

মুহিতের পাশেই দুটো ব্যাটারি আর কিছু ক্লিপ যুক্ত তার রয়েছে।

খলিলের উদ্দেশ্যে মুহিত বলে উঠলো
―ভয় করছে খলিল চাচা?

খলিল মাথা দিয়ে ইশারায় বুঝালো সে ভয় পাচ্ছে।
মুহিত হাসতে হাসতে বললো
“”ভয় পাওয়ানোর জন্যই তো এতো আয়োজন খলিল চাচা।
আপনি ভয় না পেলে তো আমার সব কষ্ট বৃথা।

কথা বলতে বলতে মুহিত ক্লিপ গুলো ব্যাটারি তে লাগিয়ে নিলো।এর পর খলিলের উদ্দেশ্যে বলে উঠলো
―এগুলো দিয়ে আপনাকে ইলেকট্রিক শক দেবো খলিল চাচা।সেই শক খেয়ে আপনি তড়পাবেন আর আমি মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় উপভোগ করবো।

কেমন মজা হবে তাই না?

মুহিতের এসব কথায় পিপাসায় গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেলো খলিলের।
মুহিত উঠে দাঁড়ালো,এক টানে খুলে ফেললো খলিলের মুখের টেপ।

খলিল হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো।
আমাকে কেনো ধরে এনেছেন স্যার?আমার অপরাধ কি?

খলিলের প্রশ্ন শুনে চোয়াল শক্ত হয়ে এলো মুহিতের ।
কতো বড় সাহস,আমাকে প্রশ্ন করা হচ্ছে?

পায়ের ভারী বুট দিয়ে পিষে ধরলো খলিলের পা,
ব্যাথায় গগন বিদারী চিৎকার করে উঠলো খলিল।
মুহিত হাসতে হাসতে বললো

―জোরে জোরে চিৎকার কর খলিল।
আমার মাসুম ভাইকে তো তুই চিৎকার করতে দিস নি।
কিন্তু আমি তোকে সেই সুযোগ দিলাম।
তুই যতো চিৎকার করবি আমি ততো শান্তি পাবো।

তোর জন্য আজকে ছয় বছর ধরে আমি ভাইয়া ডাক শুনি না।

দোকানে কতো ভালো ভালো খেলনা,চকলেট ,জামা কাপড় দেখি,কিন্তু কিনতে পারিনা।কারন যাকে এগুলো কিনে দেবো সেই ই নেই।তুই তাকে শেষ করে দিয়েছিস।

বুকের এই খান টাতে কতো কষ্ট হয় জানিস?

তুই এটা কিভাবে করেছিস খলিল?

ওর নিষ্পাপ চোখের জ্বলে কি তোর মন একটুও গলেনি?
তুলার মতো ধবধবে সুন্দর গলায় কিভাবে তোর ওই কুৎসিত হাত দিয়েছিস খলিল?

দুই হাতের সাহায্যে মুহিত খলিল কে ইঙ্গিত দিয়ে বুঝালো
―এতোটুক বয়স থেকে কোলে পিঠে করে আগলে রেখেছি ওকে আমরা।কোনো দিন আহ শব্দ টুকু করতে দেইনি।

আর তুই তাকেই এতো কষ্ট দিয়ে মারলি?
চোখের জল মুছে মুহিত খলিল কে প্রশ্ন করলো
―তুই কিভাবে মরবি ডিসাইড কর।
চারশত চল্লিশ ভোল্টের শক খেয়ে মরবি নাকি শ্বাসরোধ হয়ে মরবি?

খলিল ভয়ে কেঁদে কেঁদে মিথ্যে বলে বাঁচার আকুতি জানিয়ে যাচ্ছে শুধু।
খলিলের এসব মিথ্যে নাটকে রাগ ধরে গেলো মুহিতের সারা শরীরে।

বৈদ্যুতিক তারের দুটো মাথা লাগিয়ে দিলো লোহার চেয়ারের সাথে লাগানো কটকা তে।
দোলে উঠলো খলিল।তার সারা শরীর ঝাকুনি দিয়ে উঠছে শুধু।
শক দেয়া বন্ধ করে মুহিত আবার খলিলের উদ্দেশ্যে বললো
“”কেমন লাগলো?””
“”আবার দেবো?””

খলিল ভারসাম্য হীনের মতো শুধু তাকিয়ে দেখছে সব কিছু,মুখে কিছুই বলতে পারছে না।সে চোখের সামনে সাক্ষাৎ যমদূত দেখতে পাচ্ছে।

মুহিত আবার শক দিলো।

খলিলের শরীর আবার ঝাঁকুনি দিয়ে উঠলো।এই বয়সে এতো শক নিতে পারলো না খলিল,নিমিষেই মুখ দিয়ে লালা ছুটে গেলো তার,মিনিট পাঁচেক পরেই মৃত্যু কে আলিঙ্গন করে নিলো খলিল।

খলিলের নিস্তেজ হয়ে যাওয়া দেহের দিকে তাকিয়ে তৃপ্তির হাসি হাসলো মুহিত।
দুই হাতের আঙ্গুল এর সাহায্যে চোখে জমা জল মুছে
ক্যাপ্টেন সৌম্য বলে হুংকার দিয়ে উঠলো মুহিত।

বাধ্য ভৃত্যের ন্যায় দৌড়ে এলো সৌম্য।
গমগমে কন্ঠে মুহিত বলে উঠলো

―ভোর হবার আগে জায়গা ক্লিয়ার করে আগের মতো করে রাখবে।
যেনো ঘটনা কিছুই ঘটেনি।

সৌম্য কন্ঠ খাদে ফেলে মাথা নিচু করে জিজ্ঞেস করলো
―স্যার লাশ কি করবো?

মুহিত কিছুক্ষণ মৌন থেকে স্বাভাবিক কন্ঠে উত্তর দিলো
―রাস্তার পাশে যেই বড় ইলেকট্রিক খাম্বা রয়েছে সেখানে সব ব্যাবস্থা করা আছে।জাস্ট শুইয়ে দিয়ে আসবে।

সকালে যে কেউ ভাববে বজ্রপাতে পরে মারা গেছে।
বলে এলবো ক্রাচে ভর দিয়ে প্রস্থান নিলো মুহিত।

―――――――

রাত এগারোটা বেজে পয়ত্রিশ মিনিট,বজ্রপাত কমে গিয়ে ঝুপঝুপ করে মোটা মোটা বৃষ্টির ফোটা পড়ছে শুধু।
নিজের ঘর টাকে মন মতো গুছিয়ে নিলো স্বর্গ।
সকালেই মুহিত ফিরে আসবে হসপিটাল থেকে।
মুহিতের কথা মনে পড়তেই লজ্জায় রাঙা হলো স্বর্গের ধবধবে সাদা গাল।

নিজেকে কিভাবে উপস্থাপন করবে সে মুহিতের সামনে?

আয়নায় নিজেকে খুটিয়ে খুটিয়ে দেখছে স্বর্গ।
নিজের মনের সাথে যুদ্ধ করে অভিনয় অনেক হয়েছে,নিজেকে শক্ত প্রমান করতে গিয়ে বহু কষ্টে গিলে ফেলেছে সকল কান্না,অভিযোগ, অনুযোগ।

হসপিটালে ও সে মুহিতের সামনে বাকি দশ জন ডাক্তারের মতো থেকেছে।
আর কতোদিন চলবে নিজের সাথে নিজের এই কানামাছি?
মুহিতকে একান্তে পেলে নিজেকে এভাবেই ধরে রাখতে পারবে তো সে?

ভাবনার সুতো ছিড়লো হঠাৎ দরজায় নকের আওয়াজে।

এই টাইমে কেউ আশার কথা নয়।
বাপী জরুরী কাজে চিটাগাং গিয়েছে,মাম্মা তো ঘড়ির কাটা দশের ঘরে যেতেই ঘুমে কাত।
আর সুখ?
সেও তো মিলিটারি একাডেমী তে ফিরে গেছে বিকেলে।
তাহলে কে এলো?
এতো সিকিউরিটি, ক্যামেরা ফাঁকি দিয়ে চোর ও তো আসতে পারবে না।
তবুও ভয় হলো স্বর্গের মনে।

ঘর পোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলেও ভয় পায়।
এক পা দু পা করে এগিয়ে দরজা অল্প খুলতেই অতি পরিচিত পুরুষালী গন্ধ ভুরভুর করে নাসারন্ধ্রে বাড়ি খেলো।

নিমিষেই বুক ধক করে উঠলো,মন ভারী হলো,চোখ থেকে গড়িয়ে পড়লো জ্বল।
দরজা ঠেলে কক্ষে প্রবেশ করলো মুহিত।

বহু কষ্টে শক্তি সঞ্চয় করে দরজা আটকে দিলো স্বর্গ।
এলো মেলো পায়ে মুহিতের সামনে এসে দাড়ালো।
মুহিতের চোখের দিকে তাকিয়ে হঠাৎই ঝাপটে ধরলো মুহিত কে।

বাইরের বর্ষনের সাথে পাল্লা দিয়ে চলতে থাকলো স্বর্গের অক্ষি বর্ষণ।বেহায়া মন আর নেত্র কোনোটাকেই আয়ত্তে আনা গেলো না অবশেষে।

গলার স্লিং খুলে বুকের সাথে মিশিয়ে ফেললো স্বর্গকে মুহিত।

কাঁদতে কাঁদতে হিচকি উঠে গেলো স্বর্গের।

শুরু হলো নানান অভিযোগ অনুযোগ।

―তুমি আমাকে ধোকা দিয়েছো মুহিত,
অন্ধের মতো শুধু নিজের পথেই হেঁটেছো অথচ তোমার সাথে যে আরেক জনের জীবন জুড়েছে সেটা ভেবে দেখোনি।
আমি কক্ষনো তোমাকে ক্ষমা করবো না।

তুমি আমার কথা একবারো কেনো ভাবলে না?
যদি তুমি ফিরে না আসতে আর ?
আমি কোথায় যেতাম কি করতাম?
তুমি এতো বড় অন্যায় কিভাবে করলে আমার সাথে?

এই কয়েকটা দিন আমার কাছে কয়েক হাজার বছরের মতো ঠেকেছে।আমার বুকে অনেক কষ্ট হয়েছে মুহিত!
প্রতি মুহূর্তে আমার নিজেকে শেষ করে দেবার ইচ্ছে জেগেছে।
তুমি কখনো বুঝতেই পারলে না আমি তোমাকে কতোটা ভালোবাসি!

অসহায় এর মতো কাঁদতে কাঁদতে স্বর্গ হাটু মুড়ে মুহিতের পা জড়িয়ে ধরে বসে পড়লো।

প্লিজ মুহিত আমাকে ছেড়ে আর কখনো কোথাও যেওনা।
আমি বাঁচতে পারবো না,মরে যাবো।সহ্য করতে পারিনা আমি।
বুকের এইখানে অনেক ব্যাথা করে।দম বন্ধ লাগে।

স্বর্গের এমন কান্না দেখে মুহিতের নেত্র বেয়ে ফোটায় ফোটায় টুপটুপ করে গড়িয়ে পড়লো জল।
সত্যি ই তো,সে তো স্বার্থপর এর মতো কাজ করেছে।
মুহিত যদি আর না ফিরতো কোনোদিন?
ফুলের মতো পবিত্র মেয়েটা সারাটা জীবন বিধবার তকমা গায়ে জড়িয়ে বেঁচে থাকতো।
প্রতিশোধ পরায়নতা তাকে এতো অন্ধ কিভাবে করলো?

মুহিত ওয়াসিফ যে তার পিতার আদর্শে আদর্শায়িত ,তার মতো বিচক্ষণ মানুষের দ্বারা এতবড় ভুল কিভাবে হলো?

বহু কষ্টে উপুড় হয়ে টেনে তুললো স্বর্গকে।
বুকের সাথে মিশিয়ে কপালে,চোখে,মুখে অজস্র চুমুতে ভরিয়ে দিলো।
আবার বুকে চেপে ধরলো।
স্বর্গের মাথায় চুমু খেয়ে আহত কন্ঠে বলে উঠলো
―সরি বউ,অনেক বড় অন্যায় করে ফেলেছি।
এই দেখো আমি কান ধরেছি।
জীবনেও আর কখনো এমন ভুল হবেনা।

ফুঁপিয়ে কেঁদেই যাচ্ছে স্বর্গ।
স্বর্গের এহেন কান্না মুহিতের বুকের শেলের মতো বিধছে।
কন্ঠে সকল দরদ ঢেলে স্বর্গের উদ্দেশ্যে বলে উঠলো

―ক্ষমা করে দে না জান!

―তুই ক্ষমা না করলে আমি নিজেকে কঠিন শাস্তি দিবো।

সাথে সাথেই স্বর্গ তার কোমল হাতের তালু দিয়ে ছাপিয়ে ধরলো মুহিতের হাত।
অসহায় নেত্রে তাকিয়ে থাকলো মুহিতের মুখের পানে।
স্বর্গের তুলতুলে নরম হাতের পিঠে,তালুতে চুমু খেলো মুহিত।

রজনীগন্ধার স্টিকের মতো লম্বা আঙ্গুল গুলো তে আস্তে করে কামড়ে ধরলো।
শিউরে উঠলো স্বর্গ।
গলা জড়িয়ে ধরলো মুহিতের।
জানালার গ্রিল গলিয়ে বৃষ্টির ঝাপটা এসে সামান্য ভিজিয়ে দিলো দুজন কে।
বেসামাল হলো মুহিত।
স্বর্গের চোখের গড়িয়ে পড়া জ্বল শুষে নিলো ঠোঁট দিয়ে।
উত্তাল হলো বুকের মাঝে জমানো ভালোবাসা।
দুজনে ডুব দিলো ভালোবাসার সুধা আস্বাদনে।

―――――
বিমর্ষ মনে নিজের বরাদ্দকৃত রুমে বসে আছে সৌম্য।আজ দুদিন ধরে না পিউ ফোন তুলছে না দেখা করছে।
চারপাশে এতো সহিংসতা যা মনের ভীতি বাড়িয়েই দেয় শুধু।
যেই পিউ এক মিনিট ও সৌম্যের সাথে কথা না বললে পাগল হয়ে যায়,সেই পিউ আজ দুদিন ধরে ফোন অফ করে রেখেছে।
বুকের ভেতর জলোচ্ছাস বয়ে যাচ্ছে সৌম্যের।
সারাক্ষন মন টা কু ডেকে চলেছে।
নিজের কার্য সাধন করতে গিয়ে নিজের প্রাণ প্রিয়ার ক্ষতি করে ফেললো না তো?

নাসের হায়দার সাংঘাতিক একজন মানুষ।টাকা পয়সাই তার জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ।
নিশ্চয় কিছু জানতে পেরে পিউকে কিছু করে দিয়েছে।
নাহ আর এক মুহূর্ত দেরি করা যাবেনা।
মেজর মুহিত কে সব কিছু জানাতে হবে।

চিন্তিত মুখে গায়ে ইউনিফর্ম জড়িয়ে ডিউটির উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেলো ক্যাপ্টেন সৌম্য শাহরিয়ার।

―――――
দুদিন পর খলিলের লাশ পাওয়া গিয়েছে বড় রাস্তার মোড়ের বৈদ্যুতিক খাম্বার নীচে।বজ্রপাতে মারা গিয়েছে সে।মাথার চুল গুলো সহ পুড়ে গেছে।বিশ্রী রকম কালো হয়ে গিয়েছে তার লাশ।
আজকে বাদ জোহর তার জানাজা।
নিমিষেই কোয়ার্টারের প্রত্যেকটা মানুষের কানে পৌঁছে গেলো এই খবর।
ক্রুর হাসলো মুহিত।
নেক্সট নাসের হায়দার এর পালা।
তাকে মুহিত শাস্তি দিবেনা।
তার শাস্তির ব্যাবস্থা ভিন্ন।
তাকে দেশদ্রোহীতার শাস্তি দেয়ার ব্যাবস্থা করবে মুহিত নিজে।
আজীবন জেলে পচে মরবে সে।
মনে মনে এসব ভাবতেই কফি খেতে খেতে আনমনে হেসে উঠলো মুহিত।
পাশেই নাফিজ আর স্বর্গ ব্রেকফাস্ট করছিলো।
মুহিতের আচমকা এমন হাসি তাদের সুবিধার ঠেকলো না।তবুও কেউ কিছুই প্রশ্ন করলো না মুহিত কে।
হঠাৎ ই মুহিতের ফোন ভো ভো আওয়াজ তুলে ভাইব্রেট হতে লাগলো।
ক্যাপ্টেন সৌম্যের কল দেখে দ্রুত তা রিসিভ করে কানে তুললো।
ওপাশ থেকে সৌম্যের আহত আওয়াজ ভেসে উঠলো
―স্যার আজ তিন দিন ধরে পিউ এর কোনো খুঁজ পাচ্ছিনা।
যা বুঝার বুঝে গেলো মুহিত।

দুদিন রেস্ট নিয়ে নাসের হায়দার এর বন্দোবস্ত করতে চেয়েছিলো।কিন্তু এখন তো মনে হচ্ছে আজকে রাতেই একশনে নামতে হবে।
সৌম্য কে আস্বস্ত করে ফোন কেটে দিলো মুহিত।

―――――
ক্রিমিনাল ভিজিটিং রুমে বসে আছে স্বর্গ আর মুহিত।আহিয়ান কে দেখার জন্য এসেছে তারা।মুহিত যখন শুনেছে আহিয়ান এর মানসিক সমস্যা দেখা দিয়েছে তখন থেকেই দেখা করার চেষ্টা করেছে,কিন্তু সময় স্বল্পতার জন্য পারেনি।

কিছুক্ষন পর দুজন কারারক্ষী আহিয়ান কে ধরে আনলো।
আহিয়ানের এমন সূচনীয় অবস্থা দেখে কোথাও একটু মন খারাপ হলো মুহিতের।
মুহিতকে দেখে আহিয়ান যেনো আকাশের চাঁদ হাতে পেলো।দৌড়ে এসে মুহিত কে জাপ্টে ধরলো।
মেজর মুহিত ওয়াসিফ,আমি জানতাম তুমি আসবে।তোমাকে আমি আগেই দেখে নিয়েছি।
পাপার বিনাশ তোমার হাতে ই হবে তাইনা বলো?
এতো স্মার্ট একটা ছেলে কেমন হয়ে গেছে নিমিষেই।মুহিতের মনে হঠাৎই এক দয়া এলো।
সব কিছু স্বাভাবিক থাকলে আহিয়ান কে আরেকটা চান্স দেবে মুহিত।সে জন্য তার যা যা করতে হয় সব করবে।

স্বর্গের দিকে তাকিয়ে স্বাভাবিক মানুষের মতো করে বলে উঠলো
―স্বর্গ তুমি মলিন হয়ে গেছো, তোমাকে এমন ভালো লাগেনা।
তুমি সবসময় প্রাণবন্ত থাকবে ঠিক আছে?

ভিজিটিং আওয়ার শেষ হতেই মুহিত ,স্বর্গ উঠে দাঁড়ালো।
কারারক্ষী আহিয়ান কে বগল দাবা করে ধরে নিয়ে যেতে উদ্দত হলো।
হঠাৎই আহিয়ান ডেকে উঠলো
―স্বর্গ!
পিছন ফিরে তাকালো স্বর্গ।
মৃদু হেসে আহিয়ান বলে উঠলো
―আমি তোমাকে সত্যি ই আমার করে পেতে ছিলাম।
কিন্তু প্রাপ্তির উপায় টা ছিলো অপরাধের।

#চলবে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে