তোমার জন্য সিন্ধুর নীল পর্ব-১৯+২০

0
229

#তোমার_জন্য_সিন্ধুর_নীল
#পর্ব_১৯
#সারিকা_হোসাইন

নির্ঝর আবাসিক
চারপাশে সবুজ গাছ আর ফুলের সমারোহ,সাথে একটি বড় লেক।চারপাশের নারিকেল গাছের চিরল পাতা গুলো হালকা বাতাসে থেকে থেকে দোলে উঠছে।পাখির কিচিরমিচির এ পুরো জায়গাটা অসাধারন লাগে।

এই অমায়িক পরিবেশে থমথমে মুখে দাঁড়িয়ে আছে পিউ আর সৌম্য।
পিউএর চোখ থেকে গড়িয়ে পড়ছে জল।সে আর কখনো স্বর্গকে মুখ দেখাতে পারবে না।
পিউ কান্না থামিয়ে শক্ত কন্ঠে বলে উঠলো―
তোমাকে সব জানানোর পর ও মেজর মুহিত কে কেনো জানালে না সৌম্য?

পিউ এর এহেন অভিযোগ এর আঙ্গুল উঠানো দেখে অবাকের চরম সীমায় পৌঁছে গেলো সৌম্য।
এই মেয়ে এখনো তাকে চিনতে পারেনি?
এতো বড় অপবাদের আঙ্গুল তুলে ফেললো?

তবুও কন্ঠে স্বাভাবিকতা বজায় রেখে বললো
―তোমার কি মনে হয় পিউ?
“”মেজর সম্পর্কে এতো বড় একটা কথা গোপনে চেপে যাবো আমি ?
আমি রেকর্ড সমেত মেজর কে সব বলেছি।
উনি আমাকে কি বলেছে জানো?

প্রশ্নবিদ্ধ নজরে সৌম্যের পানে চাইলো পিউ।সে জানতে চায় কি বলেছে মেজর?

মেজর মুহিত বলেছে এসব কথা যেনো আমি কাউকে না বলি,শুধু তাই নয় ডিপার্টমেন্ট কেও জানাতে নিষেধ করেছে
উনি সকল প্রমান এক সাথে জোগাড় করে লড়াই করতে চেয়েছিলো।
ভাগ্য সহায় না হলে আমাদের কি কিছু করার থাকে পিউ?

থেকে থেকে সৌম্যের চোখ লালচে বর্ন ধারণ করছে, টলটলে অশ্রু জমা হচ্ছে মনিতে।কন্ঠ রোধ হয়ে আসছে।
কিন্তু ছেলে মানুষ চাইলেই কি যখন তখন কাঁদতে পারে?

পিউ তোমার কাছে আমার অনুরোধ তুমি রিস্ক নিয়ে আর কিছু করতে যেও না।তোমার বাবা তোমাকে জিম্মি করতে এক মিনিট ও সময় নেবেনা।প্লিজ এখানেই স্টপ যাও।

******
ফোনের গ্যালারি থেকে নিজেদের আনন্দঘন মুহূর্তের ছবি স্ক্রল করে করে দেখছে স্বর্গ।টুপটুপ করে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে কপোল বেয়ে।মুহিত নেই এটা ভাবতেই তার বুকে ব্যাথা হচ্ছে।আজকাল কান্না করতে গেলেও কষ্ট হয় অনেক।নিঃশাস বন্ধ হয়ে আসে।নিজেকে অপয়া মনে হয়।
―আমার সংস্পর্শে এসেই তোমার ক্ষতি হয়ে গেলো মুহিত!
দুজনের কতো প্ল্যানিং ছিলো, এখনো কতোটা পথ হাটতে বাকী।এভাবে চলে গেলে আমি কিভাবে বাঁচবো?
হঠাতই চিল্লাচিলি শুরু করে দিলো স্বর্গ
―তুমি ধোঁকাবাজ মুহিত, ইউ চিট
―আই উইল নেভার ফরগিভ ইউ
বেড সাইড টেবিলের উপর থাকা ফুলদানি ছুড়ে মারলো ড্রেসিং টেবিলের আয়নায়।
মুহূর্তেই পুরো রুম ঝনঝন শব্দে আলোড়িত হয়ে গেলো।
বাইরে থেকে তনুজা আর সুখ দরজা কড়া নেড়ে যাচ্ছে,কিন্তু স্বর্গ দরজা খোলে না।

মেয়ের এমন দুরবস্থা মা হয়ে সহ্য করতে পারছেন না তনুজা।এমন কঠিন পরিস্থিতিতে কোনো দিন তার পড়তে হবে এটা তিনি দুঃস্বপ্নেও ভাবেন নি।

সুখ দরজার বাইরে থেকে বলে উঠলো
―প্লিজ আপু শান্ত হয়ে যা,ভাইয়া ঠিক ফিরে আসবে,মাম্মা অসুস্থ হয়ে যাচ্ছে,,প্লিজ হুঁশে আয়।

তনুজা কাঁদতে কাঁদতে স্বর্গকে উদ্দেশ্য করে বললো
―মাম্মা যেখান থেকে পারি মুহিত কে এনে দেব তবুও এমন করিস না বাবা!
হঠাৎ ই শান্ত হলো স্বর্গ।স্বাভাবিক গলায় মাকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো
―কিচ্ছু হয়নি মাম্মা আমি ঠিক আছি।
চলে যাও দরজার সামনে থেকে।

――――――
ট্রাক ড্রাইভার ছেলেটিকে আদ্রিয়ান ঢাকায় এনে সিএমএইচ এ ভর্তি করেছে ,ছেলেটিকে তাদের প্রয়োজন।ভয়ে ঘাবড়ে আছে ছেলেটি।একটু স্বাভাবিক হলেই জবানবন্দি নেয়ার কাজ শুরু হবে।
ছেলেটির মা আর ছোট ছোট ভাই বোনকেও ঢাকা এনে নিরাপদ আশ্রয়ে রাখা হয়েছে।
এই মুহূর্তে ছেলেটির স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসা সবার কাছে বেশি ইম্পরট্যান্ট।
আর্মি দেখলেই ভয়ে কেঁদে উঠছে ছেলেটি, আর বলছে সে কিছুই জানেনা।
বিভিন্ন কায়দা করে তাকে ট্রমা থেকে বের করতে হবে।
কিভাবে ছেলের মুখ থেকে কথা বের করতে হবে তা মেজর আদ্রিয়ান এর খুব ভালো করে জানা আছে।
অপেক্ষা শুধু উপযুক্ত সময়ের।

******

জুন মাস শেষ হয়ে জুলাই এ পড়েছে।এক লহমায় কেটে গেছে পঁচিশ টি দিন।অসহায় দরিদ্র পরিবারটি অচেনা লোকটিকে নিয়ে ভীষন বিপদে পড়েছে।।কবে লোকটির জ্ঞান ফিরবে ,কবে তার আসল পরিচয় জানা যাবে?

প্রতিদিনের মতো সেদিনও তারা খুব সকালে অন্ধকার না কাটতেই দেবতার পূজা দেবার জন্য সুরমা নদীর তীরে গিয়েছিলো।
নদীর তীরে তারা রহস্য জনক কিছু দেখতে পেয়ে দৌড়ে এগিয়ে যায়।
কাছে যেতেই গৃহ কত্রী দেখতে পায় একটি যুবক নদীর তীরের কাঠের গুড়ির সাথে আটকে আছে।হয়তো স্রোতে ভেসে এসেছে।পরনের কাপড় ছেড়া।
প্রথমে তারা ভেবেছিলো মৃত কোনো লাশ হয়তো ভেসে এসেছে।কিন্তু নাকের কাছে আঙ্গুল ছোয়াতেই কর্তা চমকে উঠে।
এখনো শ্বাস চলছে।
স্বামী স্ত্রী দুজনে মিলে টেনে হিচড়ে শুকনো পাড়ে তোলার চেষ্টা করে।
লোকটির অত্যাধিক উচ্চতা,আর ওজনের ভারে দুজনেরই বেগ পোহাতে হয়।
যুবক টিকে উল্টে পাল্টে দেখতেই তাদের মাথা কাজ করা বন্ধ করে দেয়।
―বুকে ক্ষত, একটা হাত আর পা ভেঙে ভাঁজ হয়ে আছে,গালের চামড়া ছিলে গেছে,পিঠে বুকে অসংখ্য জখম।

স্বামী স্ত্রী দুজনেই দুজনের মুখ চাওয়া চাওয়ি করে নিজেদের ঘরে নিয়ে যাবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।

কোনো মতে টেনে হিঁচড়ে বাড়িতে এনে ভেজা পোশাক পাল্টে নিজেদের পোশাক পরাতে চায়।
কিন্তু তাদের পোশাক কোনোভাবেই ছেলেটির দেহে ঢুকানো গেলো না।
যুবকটির গড়ন তাদের থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন ।শুধু একটা লুঙ্গি পরিয়ে কাঁথা দিয়ে শরীর ঢেকে দিয়ে চলে গেলো বৈদ্য খুঁজতে।

তাদের কাছে মনে হয় ডাক্তার এর ওষুধ থেকে বৈদ্যর জরিবুটি তে বেশি কাজ হয়।
আর ডাক্তার এর কাছে নিতে গেলেও ঝামেলা অনেক।এখান থেকে উপজিলা হাসপাতাল অনেক দূর।যানবাহন এর ও তেমন ভালো ব্যাবস্থা নেই।পাহাড় আর কাঁচা রাস্তার কাদামাটি পার হয়ে তার পর যেতে হবে উপজেলায়।
লোকটির এহেন অবস্থায় তাকে নিয়ে উপজেলায় যাওয়াও দুষ্কর।আপাতত সুস্থ হলে পরে ভেবে দেখা যাবে কি হয় না হয়!

বৈদ্য এসে লোকটি কে দেখে চিন্তিত হয়ে পড়লেন―
ধারালো কিছু দিয়ে তার বুকে আঘাত করা হয়েছে যা বুক ভেদ করে পিঠ দিয়ে বেরিয়ে গেছে।হাত পা এমন ভাবে ভেঙেছে জরিবুটি তে কাজ হবে কিনা সে জানেনা,কিন্তু গালের,বুকের পিঠের জখম ঠিক করতে পারবে তিনি।
অসহায় পরিবার টি তবুও বৈদ্য কে সাময়িক চিকিৎসা চালাতে অনুরোধ জানান।

বৈদ্য জরিবুটি লাগিয়ে চলে গেছে সেই কবেই লোকটির জ্ঞান তবুও ফিরছে না।
পল্লীর আরো জাত গোষ্ঠীকেও এব্যাপারে বলা যাচ্ছে না।তারা বলবে অজাতের মানুষ ঘরে কেনো জায়গা দিয়েছি?
তখন আমাদের সমাজ থেকে বিতাড়িত করবে।
যতটা গোপনে পারা যায় লোকটিকে সুস্থ করে বিদেয় করতে হবে।

ছোট মেয়েটা প্রতিদিন আগন্তুক লোকটির দিকে তাকিয়ে থাকে।তার কাছে লোকটিকে দেবতাই মনে হচ্ছে।মানুষ হলে তো ঘুম ভাঙতো এতোদিনে।মেয়েটির অনেক প্রশ্ন জমা আছে এই দেবতার কাছে সাথে নানান স্বপ্ন পূরণের বাহানা।দেবতা জেগে উঠলেই প্রথমে এক বস্তা চাল দিতে বলবে,যাতে তারা প্রতিদিন তিন বেলা পেট ভরে ভাত খেতে পারে।
সেজন্য সারাক্ষন মেয়েটা তার শিয়রে বসে থাকে।

――――――
তুমি এভাবে কাপুরুষের মতো পালিয়ে এসেছো ভাইয়া?তুমি তো ভীতু!তুমি আমাদের সবাইকে কষ্ট দিয়েছো।বাবা আর তোমার সাথে কোনোদিন কথা বলবে না।তুমি দুর্বল,তুমি তো বিবেক কাজে লাগিয়ে কাজ করোনি,তুমি নির্বোধ।চলে যাও আমাদের বাড়ির দরজা থেকে ,বেরিয়ে যাও।তুমি কাপুরুষ।

হঠাৎই আগন্তুক অস্থিরতা শুরু করলো,তার কপাল কুঞ্চিত হলো,ঠোঁট নড়ে উঠলো কিন্তু কিছু বলছে তা বোঝা যাচ্ছে না।হঠাৎই বড় বড় করে চোখ মেলে চাইলো দেবতা সম্বোধন করা লোকটি।

বাচ্চা মেয়েটা খুশিতে হাততালি দিতে শুরু করলো।হঠাৎই বাচ্চা মেয়েটা মুখে তৃপ্তির হাসি ফুটিয়ে তার বাবা মায়ের উদ্দেশ্যে চিল্লিয়ে বলতে শুরু করলো―
――স্যান ইউ ইসঙ্গী(দেবতা জেগে গেছে)
লাফাতে লাফাতে হাত তালি দিতে দিতে একই কথা বার বার বলছে মেয়েটা।
মেয়েটির কথা শুনে তার বাবা মা দৌড়ে আসে ,এসে দেখতে পায় লোকটি অবাক নয়নে তাকিয়ে আছে।মেয়েটির বাবা মা এসে তাদের প্রথা অনুযায়ী আগন্তুক এর পায়ে লুটিয়ে পড়ে হাত ছোয়ায়।
আগন্তুক ভড়কে যায়,পা সরিয়ে ফেলতে চায়,কিন্তু ব্যাথায় পারে না।
আগন্তুক হাত ইশারায় লোকটিকে কাছে ডেকে কিছু বলে উঠে।ঠোঁট নাড়ানো দেখা যাচ্ছে কিন্তু কথা বোঝা যাচ্ছে না।
লোকটি বুঝতে পেরে যায় হয়তো সে কোথায় আছে তা জানতে চাচ্ছে।

লোকটি তাদের নিজস্ব ভাষায় কথা বলতে শুরু করলে যুবক বহু কষ্টে শক্তি সঞ্চয় করে তার হাত দিয়ে লোকটির গায়ের জামা টেনে ধরে।এবং আবার ঠোঁট নাড়ায়।
লোকটি কথা শোনার জন্য ঠোঁটের কাছে কান আনলে যুবক শুধায়
―আমি কোথায়?
এবার লোকটি বুঝতে পেরে যায় আগন্তুক এর কথা
তখন সে বলতে শুরু করে―
বাবু তোহকে থ হামরা ছুরমার কিনেরত পাইহেচি,
তোর কায়া থ ঘায়ে ভৈরে ছিবে(তোমার শরীর ক্ষততে ভরা ছিলো)
লোকটি আরো কিছু বলতে চাইলো কিন্তু হাতের ইশারায় যুবক থামিয়ে দিলো।

যুবকটি মনে মনে ভাবলো
সে কোথায় আছে এটা পরে দেখা যাবে, আগে নিজেকে সুস্থ করা দরকার,হাত পায়ের অবস্থা বেগতিক, বুকের ক্ষততে ইনফেকশন হয়ে যেতে পারে,
যুবক আর কিছুই ভাবতে পারলো না পেট গুলিয়ে উঠলো,বমির উদ্রেক হচ্ছে।অস্থির হয়ে উঠলো যুবক।
যুবকের অস্থিরতা দেখে দৌড়ে চলে গেলো বাড়ির কর্তী, একটু পরেই ফিরে এলো হাতে একটি গ্লাস সমেত।
মধু,আর পাহাড়ি উদ্ভিদের রসের সমন্বয়ে তৈরি করা পানীয় বাড়িয়ে দিলো যুবকের উদ্দেশ্যে।
কর্তা লোকটি যুবকটিকে ধরে পিঠের পিছনে দুটো বালিশ দিয়ে আধশোয়া করে বসিয়ে দিলো।
ব্যাথায় চোখ মুখ কুঁচকে এলো তার কিন্তু মুখে শব্দ করার শক্তি অবশিষ্ট রইলো না।
বাচ্চা মেয়ে টি পানীয় টি খাইয়ে দিতে উদ্দত হলো
ওহিদু―(খেয়ে নে)
যুবক এক নিঃশ্বাসে পুরো পানি টুকু খেয়ে ফেললো, অমৃতের মতো স্বাদ ঠেকলো তার কাছে।
পানীয় টি পান করার পর সকল অস্বস্তি এক নিমিষেই গায়েব হয়ে গেলো।
শরীরে শক্তি ফিরিয়ে আনতে হলে প্রথমে দরকার ভালো খাবার।কিন্তু এদের অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে দরিদ্র সীমার নীচে এদের বসবাস।নিজেরাই হয়তো ভালো ভাবে খেতে পায়না,তাকে খাওয়াবে কোথা থেকে?
একটু পর ছোট মেয়েটি হাতে করে খাবারের একটি প্লেট নিয়ে এলো
খাবারের চেহারা দেখেই যুবকের পেট গুলিয়ে উঠলো,কিন্তু বেঁচে থাকতে হলে এটাই তাকে খেতে হবে।
উঠে বসতে চাইলো সে,শরীর সায় দিলো না,আবারো চেষ্টা করলো একটু নড়তে সক্ষম হলো,তিন বারের চেষ্টায় বসতে সক্ষম হলো।মনোবল বাড়াতে হবে,এই ব্যাথায় ভেঙে পড়ল হবে না।
আপনজন দের চেহারা মনের কোঠায় ভাসতেই চোখের মণিতে জলে টলমলে হলো।পলক ফেলে জল গুলোকে লুকিয়ে ফেললো।

নিজের হাতে খাবার খেতে চেষ্টা করে ব্যার্থ হলো,ছোট মেয়েটির সহায়তায় পুরো খেতে না পারলেও অল্প খেলো।

পেরিয়ে গেছে আরো এক সপ্তাহ।হাত পা নাড়ানো গেলেও তাতে ব্যাথা প্রচুর।জরিবুটি কি হাড্ডি জোড়া লাগাতে পারে,?
বুকের ক্ষত ড্রেসিং না করলে ইনফেকশন হবে মাস্ট।এখান থেকে আমাকে কোনো শহরে যেতে হবে।
তার আগে হাঁটার ক্ষমতা অর্জন করতে হবে।
বাঁশ ধরে ধরে ভালোই হাঁটা যায়,তাই বলে কি পঁচিশ কিলোমিটার রাস্তা পাড়ি দেয়া সম্ভব??
তবুও যেতে হবে,একটা কচ্ছপ যদি খরগোশের সাথে রেসে জিততে পারে তাহলে সে কেনো পারবে না?
এতো এতো অর্জিত মেডেল, এক্সারসাইজ,মিশন ,প্রতিকূল পরিবেশে যুদ্ধ,ট্রেনিং তাহলে তো বৃথা হয়ে যাবে সব।

উপজাতি লোকটিকে কোনো মতে বুঝিয়ে উদ্ভট পোশাক গায়ে চেপেই,কালো একটি চাদরের সহিত সারা শরীর,মুখ ঢেকে শক্ত বাঁশে ভর দিয়ে চলতে লাগলো সে।

উপজাতি লোকটির নাম মারুং।
মারুং যুবকের হাঁটার ভাবভঙ্গি দেখে বুঝে ফেললেন এই ছেলে কোনো সাধারণ মানুষ নয়।

বিশ্রাম নিয়ে নিয়ে তিন ঘন্টা হাঁটার পর তারা একটি গরুর গাড়ি দেখতে পায় সামনে।দুজনের চোখ ই চকচকে হয়ে উঠে।
গাড়িয়াল কে অনুরোধ করে মারুং তাদের উপজেলার রাস্তায় নামিয়ে দিতে।
গাড়িয়াল লোকটি পাশের যুবকের শারীরিক অবস্থা বিবেচনা করে রাজি হয়।
মুখের হাসি প্রশস্ত হয় মারুং এর।

★★★★★
চৌকষ মেজরকে কেউ অনায়াসে গায়েব করে দিলো এটা কেউ টের ও পেলো না?
ডিপার্টমেন্ট এটা কিছুতেই মানতে পারছে না ।আর্মি হেডকোয়ার্টার এ মিটিং বসেছে এই বিষয়ে।

অফিসিয়াল ভাবে তারা মেজর মুহিত কে মৃত ঘোষণা করে তার প্রাপ্ত জিনিসের প্রতি সম্মান জানিয়ে মেডেল সহ তার পরিবার কে প্রদান করবে।এজন্য মেজর মুহিতের মাকে প্রয়োজন।
আর্মি জেনারেল বক্তব্য দিচ্ছেন এমন সময় ক্যাপ্টেন সৌম্যের ফোনে একটি ফোন এলো।
সৌম্য গুরুত্ব না দিয়ে বক্তব্য শুনতে মনোযোগ দিলো।
আবারো কেঁপে উঠলো সৌম্যের ফোন
ফোন বের করে আননোন নম্বর দেখে ভ্রু কুঁচকে উঠলো সৌম্যের।

হল রুম ছেড়ে বাইরে এসে ফোন কানে তুলতেই
ওপাশ থেকে ভাঙা ভাঙা গলার গমগমে আওয়াজ এলো আওয়াজ এলো
―ইটজ ইউর মেজর স্পিকিং ক্যাপ্টেন সৌম্য।

শরীরের লোম দাঁড়িয়ে গেলো সৌম্যের,চোখের কোনে জমা হলো খুশির জল।

আর্মি জিপ স্টার্ট দিয়ে দ্রুত ছুটে চললো
গন্তব্য অজানা শহর।

#চলবে ।

#তোমার_জন্য_সিন্ধুর_নীল
#পর্ব_২০
#সারিকা_হোসাইন

◆◆◆
ধরনীতে সূর্যের তেজ দেখে মনে হচ্ছে যেনো হাশরের মাঠে দাঁড়িয়ে আছে সবাই।এতো সূর্যের তেজ?রোদের তাপে মাটি শুকিয়ে সাদা রং ধারণ করেছে।পাড়া দিলেই মনে হয় গরম তাওয়া।

ক্রিমিনাল ভিজিটিং রুমে বসে আছেন আশরাফ চৌধুরী,মাথার উপর ক্যাচক্যাচ শব্দ তুলে বৈদ্যুতিক পাখা আস্তে আস্তে ঘুরে যাচ্ছে।শরীর ঠান্ডা হবার বদলে মনে হচ্ছে আরো উত্তপ্ত ছাদের গরম হাওয়া গায়ে মাখিয়ে দিচ্ছে।গায়ের সাদা পাঞ্জাবি ভিজে জবজবে হয়ে গেলো নিমিষেই।
বহু কষ্টে রাগ সংবরন করে বসে আছেন,আহিয়ান কে পুলিশ আনতে গেছে।
হঠাতই ঝনঝন শব্দে সম্বিৎ ফিরে এলো আশরাফ চৌধুরীর।
এ কাকে নিয়ে এসেছে পুলিশ?

যেই ছেলে দামি ব্র্যান্ডেড পোশাক বাদে অন্য কোনো পোশাক গায়ে জড়ায় নি তার গায়ে কয়েদির ময়লা পোশাক?চুল দাঁড়ির একি হাল?এসির পাওয়ার কমিয়ে কম্বল মুড়িয়ে ঘুমানো ছেলে এমন গরমে ঘুমায় কিভাবে?
গলায় শিকল হাতে পায়ে বেড়ি?
হঠাতই পিতৃ হৃদয় বেদনায় মুষড়ে উঠলো।যতোই পাষান হৃদয়ের মানুষ হোক,বাবা তো হয়।
ছেলে আজ উন্মাদ হয়ে কয়েদি জীবন গুজরান করছে।সুস্থ হওয়া মাত্রই ফাঁসির হুকুম হবে।কি থেকে কি করে দিলো শালা মেজর মুহিত।

আশরাফ চৌধুরী কে দেখা মাত্রই এক দলা থু থু ছুড়ে দিলো আহিয়ান।
এর পর হঠাৎই উত্তেজিত হয়ে গেলো।তেড়ে মারতে আসলো আশরাফ চৌধুরী কে। দুজন কনস্টেবল কোনো রকমে কব্জা করে ফেললো আহিয়ান কে।
এর পর খিক খিক করে হেসে উঠলো আহিয়ান।
আশরাফ চৌধুরী কে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো

―পাপা মেজর মুহিত ওয়াসিফ তুমাকে পিষে ফেলবে।পালিয়ে যাও পাপা।আমি তাকে দেখে ফেলেছি ,সে আসছে।তোমাকে পিস পিস করে কেটে লবন ভরে দেবে ।
বাঁচতে চাইলে পালাও।

যেই ছেলের জন্য কিছুক্ষণ আগে মন জমিনে দুঃখ হানা দিয়েছিলো সেই ছেলের এহেন কথায় রাগে বিতৃষ্ণা এসে গেলো আশরাফ চৌধুরীর।
কেমন নিমকহারাম জন্ম দিয়েছে ভাবতেই নিজের প্রতি রাগ হলো।

একদিকে অসহনীয় গরম তার মধ্যে ছেলের বাতুলতা মাথায় রক্ত ছলকে উঠলো তার।
মনে মনে শয়তানি হাসলো আশরাফ চৌধুরী।
তোর মেজর এর কঙ্কাল এর খুজ ও কেউ পাবেনা হারামজাদা ছেলে।
গহীন অরণ্যে সমাধি দিয়ে এসেছি ওই দুই টাকার লাফাঙ্গা মেজর কে।
মনের ভাবনা মনে রেখে বুকের ব্যাথার ভান ধরে বাইরে বেরিয়ে আসলেন আশরাফ চৌধুরী।

――――――
দীর্ঘ সাত ঘন্টা জার্নি করে তাহির পুর উপজেলায় এসে পৌঁছেছে সৌম্য।মেজর মুহিত এখানেই স্থানীয় হেলথ ক্লিনিকে আছেন।
মুহিত যখন কল করে সৌম্য কে এখানে আসার কথা বলেছে,সৌম্যের মনে হয়েছে তার দুটো পাখা থাকলে ভালো হতো,উড়ে উড়ে দ্রুত চলে যাওয়া যেতো।
লোকাল মানুষের কাছে জিজ্ঞাসা করে স্বাস্থ্য কেন্দ্রে পৌঁছে গেলো সৌম্য।
স্বাস্থ্য কেন্দ্রে ঢুকে মুহিতকে পাগলের মতো খুঁজতে লাগলো সে।অবশেষে পেয়ে গেলো তার মেজর কে।মনে যেনো প্রশান্তির হাওয়া বয়ে গেলো।

দৌড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠলো সৌম্য।ব্যাথায় আর্তনাদ করে উঠলো মুহিত।ভয়ে ছেড়ে দিয়ে সৌম্য বলে উঠলো
―সরি স্যার সরি।আবেগ সামলাতে পারিনি।
ভাঙা কন্ঠে মুহিত ফ্যাসফ্যাসে কন্ঠে বলে উঠলো
―সুস্থ হয়ে পানিশমেন্ট দেবো তোমাকে ক্যাপ্টেন।

সৌম্যের চোখের জল গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়লো।
―জি স্যার,আমি সকল পানিশমেন্ট এর জন্য প্রস্তুত।
একটু পর ডিউটি ডক্টর এলো।
মুহিত কে উদ্দেশ্য করে মাধুর্যহীন কন্ঠে বলে উঠলো এই রোগীর গার্ডিয়ান কে আছে?

সৌম্য তড়িঘড়ি করে ডিউটি ডক্টর এর কাছে গিয়ে জানালো
―আমি।
এমন জীর্ণ রোগীর গার্ডিয়ান একজন আর্মি অফিসার?
কন্ঠ নরম হয়ে এলো ডিউটি অফিসার এর।
সৌম্য তার ভাবাবেগ বুঝতে পেরে আগ বাড়িয়ে বলে উঠলো
―নো কুয়েশ্চেন প্লিজ!ইটজ আওয়ার সিক্রেট ম্যাটার।

ডক্টর ঢোক গিলে মুহিতের দিকে অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টি দিয়ে সৌম্যের দিকে তাকিয়ে বললো
দেখুন উনার পা,হাত দুটোই মারাত্মক ভাবে ভেঙে গেছে,আমি জানিনা উনি কিভাবে এতোদিন এগুলো নিয়ে বসে ছিলো?
দ্রুত বড় হসপিটাল এ উনাকে এডমিট করতে হবে,আর বুকে একটা ক্ষত দেখা যাচ্ছে।বুকের ক্ষত টা গভীর।আমাদের এখানে এসবের চিকিৎসা নেই।বুঝতেই পারছেন!বলে হাত কচলালো ডিউটি ডক্টর।

যা বুঝার সৌম্য বুঝে গেলো।ডিউটি ডক্টর কে থামিয়ে দিয়ে মুহিতের কাছে আসলো।স্যার আমাদের যেতে হবে।আপনি কি যেতে পারবেন আমার সাথে?

―না পারলেও আমাকে যেতে হবে সৌম্য।একজনের কাছে আমি খুব অপরাধী হয়ে গেছি।সে অপরাধ মার্জনা না করলে আমি শান্তি পাবো না।যতো দ্রুত তার কাছে যাবো ততো দ্রুত ক্ষমা পাবো।

–তোমাকে যেটা আনতে বলেছিলাম এনেছো?
―জি স্যার,বলেই গাড়ির বক্স থেকে একটা ব্যাগ নিয়ে আসলো সৌম্য।
মুহিতের হাতে দিয়ে বললো
― নিন স্যার।

মুহিত মারুং আর সৌম্যকে নিয়ে স্বাস্থ্য কেন্দ্র থেকে বেরিয়ে জিপের কাছে আসলো।
মুহিত মারুং কে উদ্দেশ্য করে বললো
―আপনারা আমার জন্য যা করেছেন তার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার ভাষা নেই আমার।আমি মন উজাড় করে কিছু দিতে চাই আপনাকে।
মারুং এর হাত টেনে হাতে থাকা ব্যাগটি মারুং এর হাতে দিলো মুহিত।
মারুং প্রশ্নবিদ্ধ নয়নে চাইলো মুহিতের পানে।মারুং এর চোখের ভাষা মুহূর্তেই বুঝে গেলো মুহিত।

মৃদু হাসলো মুহিত।
এখানে পাঁচ লাখ টাকা আছে।আপনি জীবিকা নির্বাহের জন্য কিছু করে টাকাটা ব্যায় করলে মনে শান্তি পাবো আমি।
আজকে আমি চলে যাচ্ছি।
কিন্তু অতিশীঘ্রই আমি আবার ফিরে আসবো।ডিকো কে আমার তরফ থেকে ভালোবাসা জানাবেন।
ডিকোর প্রতি আমার কিছু কর্তব্য আছে।সুস্থ হয়ে এসে আমি অবশ্যই সেগুলো পালন করবো।
আপনি নিজেও জানেন না আপনি কাকে বাঁচিয়েছেন।
এর প্রতিদান না দিয়ে কিভাবে যাবো বলুন?

মারুং এর চোখে জল এসে গেলো।সে এটা বুঝে গেছে লোকটি বড় কোনো সাহেব।মারুং সেভাবে কিছুই করতে পারেনি তার জন্য।

যতটুকু করেছে তার বিনিময়ে দেবতা তার জন্য এতোবড় পুরস্কার রেখেছে সে ভাবতেই পারেনি।
কাঁদতে কাঁদতে মারুং মুহিত কে হাত জোড় করে ধন্যবাদ জানালো।
সৌম্যের কাছ থেকে আরো কিছু খুচরো টাকা নিয়ে মারুং এর হাতে দিয়ে বললো
―আপনার মেয়ে ফল খেতে আর নতুন জামা পড়তে ভালোবাসে।
মারুং এর মুখে হাসি ফুটে উঠলো।মারুং কে আবারো কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করে সৌম্যের সহযোগিতায় জিপে উঠে বসলো মুহিত।
সহসাই জিপ স্টার্ট দিয়ে বাতাসের গতিতে চালাতে লাগলো সৌম্য।
যতদূর তাদের দেখা গেলো মারুং ততক্ষণ তাকিয়ে তাদের দেখলো।

গাড়ি চলছে আপন মনে।সৌম্য কোনোভাবেই নিজের ভেতরের কৌতুহল দমিয়ে রাখতে পারছে না।মেজর চোখ বন্ধ করে আছে বলে কিছু জিজ্ঞেস করতে ও পারছে না।
মুহিত এর কন্ঠে নীরবতা ভাঙলো।
চোখ বুঝেই মুহিত সৌম্যকে বলে উঠলো
―তুমি যে এখানে এসেছো কেউ জানে?

সৌম্য গলা খাকরি দিয়ে বললো
―না স্যার,আপনার কথা মতো শুধু নাফিজ স্যার কে বলে জিপ নিয়ে এসেছি।

“”তোমাকে অনেক দায়িত্ব পালন করতে হবে এখন থেকে ক্যাপ্টেন।””

―জী স্যার আমি যেকোনো দায়িত্ব পালনে প্রস্তুত।আপনি আমাকে আলাদিনের জীন ভাবতে পারেন।

সৌম্যের এমন ডেডিকেশনের জন্যই মুহিত তাকে এতো পছন্দ করে।

আমার বউকে তোমার নম্বর থেকে কল করো।
নিমিষেই কড়া ব্রেক কষলো সৌম্য।
ঝাঁকি খেয়ে ব্যাথায় আউচ্ করে উঠলো মুহিত।
বউ মানে?

না বলে ব্রেক কষার জন্য পানিশমেন্ট পাবে ক্যাপ্টেন।

স্যার যা খুশি দিয়েন আগে সব খুলে বলুন।

আমি তোমার ম্যাডাম কে বিয়ে করে ফেলেছি গোপনে।
অবাক নয়নে প্রশ্ন করলো সৌম্য
কেনো স্যার?
―আমি যতদূর জানি আপনাদের দুই পরিবার ই রাজি ছিলো।

সৌম্যকে এতোটা অবাক হতে দেখে স্মিত প্রাণহীন হাসলো মুহিত।
এর পর বলতে শুরু করলো―

ছিলো সৌম্য,কিন্তু একই ছাদের নিচে একই বাড়িতে আগুন আর মোম এক সাথে থাকতে পারে?
তোমার ম্যাডাম ভালোবাসার দাবি নিয়ে যখন তখন আমার কাছে ছুটে আসতো।
তাকে বারবার ফিরিয়ে দিতে আমার অনেক কষ্ট হতো,আবার পাপ বোধ ও হতো।।
আর তোমার ম্যাডামের অভিমানের পাল্লা ভারী হতো।
মেয়েটা বড্ড অবুজ সৌম্য।

মা অস্ট্রেলিয়া গিয়েছে তুমি জানো।
যাবার আগে মা আমাকে কি বলে গিয়েছে জানো?

না স্যার জানিনা,সৌম্যের সাবলীল উত্তর।
গাড়ি স্টার্ট দাও বলছি।
সৌম্য গাড়ি স্টার্ট দিলো,গাড়ি রানিং হতেই মুহিত বলতে লাগলো―

মা আমাকে অনুরোধ করে বলেছে উনাকে যেনো একা ফিরিয়ে না আনা হয়।উনি তার মেয়ে নাতি,জামাই সবাইকে নিয়ে ফিরতে চায়।

পাপা কেনো ওদের দূরে পাঠিয়ে ছিলো আমার নতিজা দেখেই বুঝতে পারছো।

―জী স্যার।

―আমি চেয়েছিলাম আশরাফ চৌধুরীর সকল প্রমান জোগাড় করে আইনের আশ্রয় নিতে।
কিন্তু এর পরের ঘটনা তুমি জানো।বিষয়টা অতোটা সহজ নয়।আরো কতোদিন অপেক্ষা করতে হবে তাও জানিনা।

ঘরে আগুন সুন্দরী প্রেমিকা রেখে কোনো পুরুষ সাধু থাকতে পারবে ক্যাপ্টেন?

―না স্যার পারবে না!

এজন্যই বিয়ে করেছি আমরা।যাতে কোনো পাপবোধ না হয়,আর অপেক্ষার প্রহর গুনতে না হয়।

কিন্তু বিয়ে করেও কোনো ফায়দা হলো না।তোমার ম্যাডাম মারাত্মক কষ্ট টাই পেলো আমার থেকে।
দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে গাড়ির সিটে হেলান দিলো মুহিত।

কিছুক্ষন মৌন থেকে আবার বলতে শুরু করলো

আমার সিলেট আসার খবর কে উনাকে দিয়েছে জানো?

―কে স্যার?

গেট কিপার খলিল।

খলিলের নাম শুনে কপালের চামড়ায় চিন্তার ভাঁজ পড়লো সৌম্যের।

সৌম্যকে কোনো প্রশ্ন করার সুযোগ না দিয়ে মুহিত আবার বলে উঠলো

পাপাকে আর মুকিত কে যেদিন হত্যা করা হয় সেদিন ও খলিল সাথে ছিলো।
খলিল ই মুকিতের শ্বাস রোধ করেছিলো।

চোখের কোনে জমা জল আঙ্গুল দিয়ে মুছে মুহিত আফসোস এর সুরে বললো

সবচেয়ে কষ্টের বিষয় কি জানো সৌম্য?

এই খলিল কে চিহ্নিত করতে আমার ছয় বছর লেগে গেলো।
যেদিন আমি সিলেট আসি,কোয়ার্টার এর গেট ক্রস করতেই লুকিং গ্লাসে আমি ওর ক্রুরতা মিশ্রিত হাসি দেখেই সব বুঝে গেছিলাম।

এখন করতে চাচ্ছেন স্যার?

সব গুলোকে কেটে লবন মরিচ লাগাবো।আইন আমার দেখা শেষ।এবার তুমি আমার আইন দেখবে সৌম্য।

মুহিতের আগ্নেয়গিরির মতো লালচে চোখ দেখে ভয়ে কেঁপে উঠলো সৌম্য।

এখন কোথায় যাবো স্যার?
গলার সমস্ত আওয়াজ দিয়ে মুহিত বলে উঠলো

ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট সৌম্য।

মুহিতের তেজে লোমকূপ পর্যন্ত ফুলে উঠলো সৌম্যের।দ্রুত গাড়ি হাকালো ক্যান্টনমেন্ট এর উদ্দেশ্যে।

******
বিছানায় মৃতের ন্যায় পড়ে আছে স্বর্গ।এই দুনিয়া সম্পর্কে তার কোনো ধ্যান জ্ঞান নেই।নিজের জীবনের হিসেব কিছুই মিলছে না যেনো তার।কি থেকে কি হয়ে গেলো নিমিষেই।
মুহিতের সকল স্মৃতি তাকে প্রতিনিয়ত কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে।মাঝে মাঝে সিলিং এর ফ্যান স্বর্গ কে খুব টানছে।
কিন্তু তার মতো একজন ডাক্তার এর এসব শোভা পায়না।যার দায়িত্ব একজন মানুসের জীবন বাঁচানো সে কিভাবে নিজের জীবন ই নিয়ে নেবে?

হঠাৎই রুমে তনুজা আর সুখ প্রবেশ করলো।তারাও নেতিয়ে পড়েছে এই কদিনে।সুখ যে ভাবে ছুটি কাটাচ্ছে,মেজর জেনারেল এর ছেলে না হলে তাকে এতদিন মিলিটারি একাডেমি থেকে বহিষ্কার করা হতো।
পরিবারের মানুষ এর পাশে আগে থাকতে হবে পরে পড়াশোনা ।এটা ভেবেই সুখ যায়নি আর।

বোনকে শান্তনা দিতে সুখ অনেক কিছু বোঝালো।
কদিনেই স্বর্গের চোখের নিচে কালি পরে গেছে।চেহারার জৌলুষ মলিনতায় চাপা পড়ে আছে।
মেয়ের এহেন অবস্থা কি কোনো মা সহ্য করতে পারে?

তনুজা করে যাচ্ছে।পরীর বাচ্চার মতো মেয়ে তার,কেমন জীর্ণ শীর্ন হয়ে আছে।
মেয়েকে খাবার খাওয়ার জন্য অনেক ক্ষণ চাপাচাপি করলেন ।লাভের ফল শূন্যে।
মা হয়ে তিনিও মুখে খাবার তুলতে পারছেন না।
স্বর্গকে আরো কিছু কথা বলে কান্না মুছতে মুছতে বেরিয়ে গেলেন তনুজা।

মায়ের পিছে পিছে সুখ বেরিয়ে দরজা ভিড়িয়ে দিয়ে স্বর্গকে একা থাকতে দিয়ে চলে গেলো।

হঠাৎই স্বর্গের ফোন ভাইব্রেশন হলো।কে ফোন করেছে দেখার প্রয়োজন মনে করলো না সে।
যেখানেই নিজের প্রাণেশ্বর ই তাকে আর কোনো দিন ফোন করবে না।সেখানে অন্যের ফোন ধরে শান্তনা বাণী শোনার কোনো ইচ্ছে নেই স্বর্গের।
দ্বিতীয় বার ও ফোন আসলো।তাকিয়েও দেখলো না স্বর্গ।
তৃতীয় বারের কলে রাগে বিবেক বোধ হারিয়ে ফেললো।
ভাবলো ফোন ধরেই জন্মের গালি দিবে।
ফোনে ক্যাপ্টেন সৌম্যের নম্বর দেখে রাগ পানি করে ফেললো স্বর্গ।
ভ্রু কুঁচকে ফোন রিসিভ করে
নরম ভেজা কন্ঠে বলে উঠলো
―হ্যালো?
ওপাশ থেকে কোনো সাড়া আসলো না।
আবার হ্যালো বলতেই ওপাশ থেকে আওয়াজ এলো
―আমার হাতের স্লিং টা তুমি ই লাগিয়ে দাওনা বউ।

কেঁপে উঠলো স্বর্গ।বেহায়া নেত্র চাপিয়ে বর্ষণ শুরু হলো।স্বাস যেনো বন্ধ হয়ে আসছে।শরীর থরথর করে কাঁপছে।

ফোন কেটে চোখের জল মুছে তড়িঘড়ি করে নিজের এপ্রোন খুঁজে বের করে গায়ে জড়ালো স্বর্গ।
তনুজা কে চিল্লিয়ে ডেকে উঠলো।
মাম্মা,মাম্মা

মেয়ের ডাকে অন্তর শুকিয়ে এলো তনুজার,আবার নতুন কোন তান্ডব আসতে চলেছে?

,সুখ কে নিয়ে দৌড়ে ড্রয়িং রুমে এলেন তনুজা।
মেয়ের কান্না দেখে আরো ভয় পেয়ে গেলেন তিনি।

স্বর্গ কান্নার চোটে কথাই বলতে পারছে না।
তবুও ভাঙা ভাঙা শব্দে বলে উঠলো
―মুহিতের পছন্দের ইলিশ পোলাও করে সুখকে দিয়ে সিএমএইচ এ পাঠিয়ে দিও।
আমি যাচ্ছি ওখানে,মুহিত আমার কাছে চিকিৎসার আবদার করেছে।

#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে