তোমার জন্য সব পর্ব-৩০ | বাংলা ভালোবাসার গল্প

0
14

#তোমার_জন্য_সব -৩০
✍️ #রেহানা_পুতুল
কলি মনে মনে বলল,
ভালোবাসা সত্যি হলে প্রয়োজনে অনেক কিছুই বিসর্জন দিতে হয়। আশাকরি আমার কড়াডোজে এবার তুই খেয়া সিধা হয়ে যাবি।
হৃদয় দিয়ে হৃদয় কিনেছি। কারো ছিনিয়ে নেওয়ার সাধ্যি নেই।

কলি এবার নিজেই সংকোচবোধ করলো। সে কবে থেকে এমন এলো। ভালোবাসা বুঝি মানুষকে সাহসী ও আত্মবিশ্বাসী করে তোলে? সে মাহমুদের দিকে মুখ তুলে চাইলো না আর। চলে যেতে পা বাড়ালো। মাহমুদ হাত টেনে ধরলো কলির। শিহরিত চোখে বলল,

“কলিকে ভালোবাসি। কলি বিকশিত হচ্ছে স্বমহিমায়। এটা আমার জন্য সুসংবাদ।এতটাই ভালোবাসতে চাই, যেন তার সমস্ত পাপড়িগুলো সঠিক নিয়মে প্রস্ফুটিত হতে পারে। আর আমি নিতে পারি তার সমস্ত অঙ্গসুরভির স্বাদ।”

“হাত ছাড়ুন স্যার!”

“স্যার?”

“এটা বাসা নয়।”

“ওহ! সরি। মনে পড়েছে। বাইকে যাবে একসংগে?”

“নাহ। লোকে দেখবে। জানাজানি হয়ে যাবে।”

“একটু আগে যে কাজ করেছেন,জানাজানি এমনিতেই হয়ে যাবে। তবে এটা মনে হয় ঠিক হয়নি কলি। আমরা স্বামী স্ত্রী। কিন্তু খেয়া জানলো নেগেটিভ কিছু।”

“আপনার কথা লজিক্যাল। আমাদের পবিত্র হালাল সম্পর্ককে খেয়া জানলো হারাম হিসেবে। আমি বাসায় গিয়েই খেয়াকে বিয়ের বিষয়টা জানিয়ে দিচ্ছি। তাহলেই চুকে যাবে সব।”

মাহমুদ বিষম খাওয়া কন্ঠে বলল,

“হায় হায়! তাহলে ত দুনিয়া রটে যাবে এবার?”

“নো স্যার। দুনিয়া নয় ক্লাসের দেয়ালটাও জানবে না। আমার কাছে সেই মহাষৌধ আছে।”

“কি জানতে পারি?”

কৌতুহলভরা সুরে জানতে চাইলো মাহমুদ।

“বাসায় আসুন। বলব। আমি গেলাম।”

কলি বের হয়ে বাসায় চলে গেলো। ওয়াশরুমে গিয়ে হাতমুখ ধুয়ে নিলো। বাতাসী টেবিলে কলির জন্য খাবার নিয়ে রাখলো। কলি তার আগেই বরাবরের মতো স্বশুর শাশুড়ীর রুমে গেলো দেখা করতে।

“বাবার শরীর খারাপ নাকি মা?”

“হ্যাঁ কলি। হঠাৎ করেই কেমন শরীরটা নেতিয়ে আসতেছে।”

প্রেশার চেক করতে হবে, বলে কলি প্রেশারের মেশিনটা নিলো। চেক করে দেখলো প্রেশার লো। দূর্বল শরীর। কলি দায়িত্বসুলভ ভঙ্গিতে মায়াজড়ানো স্বরে বলল,

” শরীর হঠাৎ এমন হলো কেন? বাবা ঠিকমতো খাওয়া দাওয়া করছেন না? ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে হবে সন্ধ্যায়। আমি খেয়ে সিরিয়াল নিচ্ছি ইবনেসিনায়। লালবাগে আমাদের বাসার কাছে ওদের ব্রাঞ্চ আছে। আমরা কিছু হলেই সেখানে দেখাই।”

আবদুর রহমান চোখ বন্ধ করে নির্জীবের মতো পড়ে আছে। কলি উঠে গিয়ে ভাত খেয়ে নিলো। মনে পড়লো, খেয়াকে সেই বিষয়টা জানানোর কথা। ব্যস্ত ভঙ্গিতে আনুশকার রুমের বারান্দায় গেলো। সরাসরি খেয়ার হোয়াটসঅ্যাপে কল দিলো। খেয়া রিসিভ করলো সেই আশায়। ভিডিও ক্লিপের বিষয়টা জানার জন্য।

“খেয়া যেজন্য তোকে ফোন দিলাম। মাহমুদ স্যার বিয়ে করেছে শুনলি না,তার বউ আমি কলি। আমি যে ক্লাসে বলছি কাবিন হয়েছে আমার। সেটা স্যারের কথাই বলছি। একবারেই তুলে নিয়েছে। আশাকরি ক্লিয়ার হলি। বিষয়টা আমরা হাইড রেখেছি। এটা সংকোচের জন্যই। এর বাইরে কিছুই না। আশাকরি দুকান করবি মা। আর তোর ভিডিওর বিষয় পরে জানাচ্ছি। এখন বিজি।”

“কলি, ভার্সিটিতে লাইভ যেটা দেখালি সেটা বিলিভ করলাম। তবে বিয়ের বিষয় তুই মিথ্যা বলছিস।”

ঘৃণামিশ্রিত কন্ঠে বলল খেয়া।

“ওকেহ। তোদের মতো স্যার ও আমার একটা ভিডিও ক্লিপ পাঠাবো। নয়তো তোকে ভিডিও কল দিয়ে লাইভ কিছু দেখাবো।”

“হুম তাই করিস। তোকে কখন কল দিবো পরবর্তীতে?”

“তোর দিতে হবে না। আমিই দিব।”

ফোন সংযোগ বিচ্ছিন্ন হলো।
খেয়া নিজের মাথার চুলগুলো টেনে ধরলো। কি হচ্ছে এসব? কলি এত ডেঞ্জারাস মেয়ে? মেনকার শয়তান মেয়ে একটা। পেছনের বেঞ্চে বসে বসে এসব করতো? এই মেয়ে স্যারের প্রেমে পড়বে, ভালোবাসবে এটা দুঃস্বপ্নের মতো। উফফস! মানা যায় না।

মাহমুদ বাসায় গেলে কলি বলে উঠলো,

“আপনার আসতে এত লেট হলো কেন? বাবা অসুস্থ?”

কি বলছ? বলে মাহমুদ বাবা মায়ের রুমে চলে গেলো। পিতার হাত,বুক,কপাল ধরে দেখলো। মায়ের থেকে খোঁজ খবর নিলো সব।

“ডাক্তার দেখাতে হবে।”

“কলি সিরিয়াল দিয়ে রেখেছে। রাত আটটার দিকে। লালবাগ ইবনেসিনা। তুই ফ্রেস হয়ে নে। খাবি না?”

“নাহ। লাঞ্চ করেছি মা। এক ফ্রেন্ডের সঙ্গে দেখা করতে হয়েছে। একত্রে খেলাম।”

রাতে কলি স্বশুরকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলো। মাহমুদ ব্যস্ত থাকার জন্য যেতে পারেনি। ডাক্তার পরিক্ষা দিলো। কলি পরিক্ষাগুলো করিয়ে নিলো সেখানেই।

রাতে মাহমুদ কলির থেকে পিতার শারিরীক কন্ডিশনের খোঁজখবর নিলো। তারপর প্রসঙ্গক্রমে খেয়ার বিষয়টা জানতে চাইলো। কলি ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে মাহমুদকে বুঝ দিলো। নয়তো সে দেখতে চাইবে। তাকে না দেখানোই সমীচীন হবে। কলি মাহমুদের খোলা বুকের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হলো। একই বালিশে একই কাঁথার নিচে। পনেরো সেকেন্ডের ভিডিও করলো। সেন্ড করে দিলো খেয়ার হোয়াটসঅ্যাপ মেসেঞ্জারে। কোন রিপ্লাই এলনা। তারমানে খেয়ার বিশ্বাস অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে ভিডিও ক্লিপ্টা।

মাহমুদ জিজ্ঞেস করলো,
” কি করলে কলি?”

কলি বলল,
” খেয়া বিলিভ করে না আমাদের বিয়ের কথা। প্রমাণ দিলাম।”

“আগে বলবা না তুমি? কোন বলিষ্ঠ প্রমাণ দিতাম। সেও তা দেখে বলিষ্ঠভাবে বিলিভ করতো। তুমি প্রমাণ দিলে যৎ কিঞ্চিৎ। সেও বিশ্বাস করবে যৎকিঞ্চিত। শুরু করবো কিছু?”

কলি মাহমুদের ঠোঁট বন্ধ করলো নিজের একহাত দিয়ে চেপে ধরে। মাহমুদ কলির হাতের তালুতে দুঠোঁটের নিবিড় স্পর্শ দিতে লাগলো।

পরেরদিন কলি হাসপাতালে গিয়ে রিপোর্ট নিলো। জানা গেলো র*ক্ত স্বল্পতার জন্য এমন হয়েছে। হিমোগ্লোবিন কমে যাওয়াতে ক্লান্তিবোধ ও শ্বাসকষ্ট দেখা দিয়েছে। আর হিমোগ্লোবিন শরীরে নানাবিধ কারণেই কমতে পারে। এক ব্যাগ রক্ত দিয়ে দিলেই ঠিক হয়ে যাবে। র*ক্তের গ্রুপ জানা হলো। কলির সঙ্গে মিলে গেলো রক্তের গ্রুপ। তারপর কলিই নিজ থেকে আগ্রহান্বিত হয়ে স্বশুরকে রক্ত দিলো। উনার দৈনন্দিন খাবারের প্রতি বিশেষ যত্ন নিলো। এভাবে এক সপ্তাহে নিজ দায়িত্বে স্বশুরের তদারকি করলো। সেবাশুশ্রূষা করে সুস্থ করে তুলল। তারা পুরো পরিবারের স্নেহ, মমতা বৃদ্ধি ও গভীর হলো কলির উপর।

মাহফুজা বলল,
“দেখলেন ত, আমার পছন্দ কত দারুণ? কত ভালো ফ্যামেলির মেয়েকে আনলাম। বাবা,মা ভালো হলে সন্তানেরাও ভালো হয়। নিজের গায়ের র*ক্ত দিয়ে আপনাকে সুস্থ করে তুললো।”

” এই সেরেছে। এবার ত তুমি এই ক্রেডিট নিতে নিতেই আমাকে জব্দ করবা।”
প্রাণময় হাসি দিয়ে বলল আবদুর রহমান।

তার পরের সপ্তাহে কলি ভার্সিটি গেলো। খেয়া নিরবে কলিকে ডেকে নিলো। জিজ্ঞেস করলো,

“কিরে ফোন ত আর দিলি না।”

“আমার শ্বশুরকে নিয়ে হাসপাতাল, ডাক্তার, রিপোর্ট, ব্লাড দেওয়া,সব মিলিয়ে দৌড়ঝাঁপ করতে হয়েছে। আরেকদিকে ফাস্টফুড সামলানো। তাই দেওয়া হয়নি।”

“স্বশুর মিনস মাহমুদ স্যারের ফাদার?”

“হুম।”
“এবার বল কলি।”

কলি খেয়াল করলো,খেয়ার গলার স্বর হালকা নমনীয়। চাহনি নরম। কন্ঠে নেই আগের মতো তেজস্বীয়তা ও দম্ভ! কোন ঐশ্বরিক যাদুবলে যেন খেয়ার সব অহমিকা চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেলো এক লহমায়। হ্যাঁ তাই। একজন মেয়ে বা নারীর সম্ভ্রম লুটে গেলে তার আর মর্যাদাটুকু রইলো কই।

কলি সংক্ষেপ করে বলল,
” একদিন দুপুরে আমার ফেসবুক মেসেঞ্জারে সেই ভিডিও ক্লিপ দিয়েছে তোর প্রাক্তন নেহাল। সম্ভবত সে আমার নাম ফেসবুকে সার্চ করে বের করেছে। আর নাম হয়তো তোর কাছেই শুনেছে। নিশ্চয়ই তুই আমাকে মুরগী বানানোর গল্পটা তাকে বলেছিস বেশ রসিয়ে রসিয়ে। তুই চাইলে স্ক্রিন শট দিতে পারি তোকে। আমি ভিডিও প্লে করে দেখে ত স্তব্ধ হয়ে গেলাম। ভাবলাম তোর কোন শত্রু হয়তো। এডিট করে এমন করেছে।

জিজ্ঞেস করতেই বলল,
” খেয়া আমার সঙ্গে বেঈমানী করেছে। আমাকে ছারখার করে দিয়েছে। সে তার এক স্যারকে লাভ করে। আপনার সঙ্গে নাকি তার মনোমালিন্য হয়েছে। এটা আপনি রাখেন। প্রয়োজন মনে করলে তাকে শায়েস্তা করতে পারবেন এনিটাইম। ”

বুঝলি এবার। আমি ভুলেও গেছি খেয়া। কিন্তু তুই সেদিন আমার দোকানে খুব বাজে আচরণ করেছিস আমার সঙ্গে। আবার আমার বর মাহমুদের পিছু ছাড়ছিস না। তাই তোকে বলতে বাধ্য হলাম। আমার কাছে এটা গচ্ছিত থাকবে। কখনোই কেউ দেখবে না। আমার বরও দেখবে না।

খেয়ার মুখ দিয়ে কোন রা সরছে না। আশি বছরের বৃদ্ধার ন্যায়
পা টেনে টেনে কলির সামনে হতে চলে গেলো। কলি খেয়ার চলে যাওয়া দেখলো পলকহীন চোখে।

খেয়া দাঁত কিড়মিড়িয়ে বলল,

নেহাল তাহলে রিমুভ করেনি এটা? একবার দেশে তার পা পড়ুক। বুড়িগঙ্গার কালো জল তার র*ক্তে লাল করে ফেলব আমি খেয়া।

খেয়া সেদিন মধ্যরাত অবধি কলিকে নিয়ে ভাবলো। কলির কাছে যেমন সে সারাজীবনের জন্য ছোট হয়ে গেলো। বড় গলায় কথা বলার কোন পথ অবশিষ্ট রইল না। সেইম একটা ভিডিও ক্লিপ যদি কলির হয়। আর তা যদি তার কাছে থাকে। তাহলে ব্যপারটা কেমন হয়। খেয়া বিলম্ব করল না। একটা পাতি মাস্তানকে ফোন দিলো। যে কিনা তারসঙ্গে কলির ফুড শপে গেলো।

খেয়া তাকে বলল,

” আপনি আর একজন ছেলে হলেই হবে। আগামীকাল সে ভার্সিটি থেকে যাওয়ার সময় তুলে নিবেন। অন্তরঙ্গ কিছু মুহূর্ত ক্রিয়েট করবেন দুজন মিলে কলির সঙ্গে। ভিডিও করে নিবেন। দেন আমাকে দিবেন। আমি ভিডিও হাতে পেলেই আপনাকে ক্যাশ দিয়ে দিবো।”

ওপাশ হতে জবাব এলো,

“যথাসময়ে কাজ হয়ে যাবে। আমি ভাড়ায় খাটি। এসব কাজ পল্টুর কাছে মশা মাছি মারার মতো।”

তারপরের দিন কলি ভার্সিটিতে যায়। মাহমুদ যায়নি কারণবশত। কলি ক্লাশ শেষে বের হয়ে নিচে যায়। হেঁটে গিয়ে বাস স্টপেজে দাঁড়ায়। অপেক্ষা বাসের জন্য। কিন্তু তার কাঙ্ক্ষিত বাস আসছে না। কলি পা বাড়ায় সামনের দিকে।

চলবে…৩০

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে