#তোমার_জন্য_সব -২৬
✍️ #রেহানা_পুতুল
হঠাৎ তার হোয়াটসঅ্যাপে একটা মেসেজ এলো। সে মেসেজটি পড়ে কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে গেলো। আবার সেই উটকো ঝামেলা? তার দৃষ্টিভ্রম হলো নাকি। সে মেসেজটি পুনরায় পড়লো বোঝার জন্য।
“স্যার খেয়াকে নিয়ে আসা হয়েছে দেশে। সে এখন ভালোর দিকে আছে। আপনি কি খেয়াকে বিয়ে করবেন?
এটা ক্লিয়ার করে জানান। আমার স্বশুর বলেছে আপনি খেয়াকে বিয়ে করলে তাদের বাড়ির একটা ফ্ল্যাট আপনার নামে লিখে দিবে।”
মাহমুদ বুঝলো এই মেসেজ খেয়ার ভাবি দিয়েছে। এবং মনে মনে আওড়ালো,তারমানে এই মেয়ের মাথা থেকে এখনো আমার ভূত যায়নি। মাহমুদ সঙ্গে সঙ্গেই সেই মেসেজের রিপ্লাই দিলো।
“সরি। আমি আমার মায়ের পছন্দের এক মেয়েকে বিয়ে করে ফেলেছি।বউ এখন আমার পাশেই আছে। খেয়ার জন্য শুভকামনা।”
মেসেজ সেন্ড হয়ে গেলো। মাহমুদ খেয়াল করলো তার মেসেজের আর কোন রিপ্লাই এলোনা।
সকালে কলির আগেই মাহমুদ ঘুম থেকে জেগে গেলো। মাহমুদ কলির দিকে কাত হয়ে ঝুঁকলো। কপালে,ঘাড়ে হাত রাখলো। দেখলো কলির গায়ে এখন জ্বর নেই। কলি উঁহু বলে কুঁকিয়ে উঠলো। মাহমুদ হেসে বলল,
“কপালে হাত রাখলেও ব্যথা পান আপনি? তো হাত কোথায় রাখবো বলে দেন?”
কলি নিরুত্তর। মাহমুদ কলির চোখের সামনে সেই মেসেজটি ওপেন করে ধরলো। কলি পিটপিট করে চেয়ে মেসেজ দুটো পড়লো। পরক্ষণেই চোখ বড় করে ফেলল। মোবাইলটা নিজের হাতে নিয়ে নিলো। ভালো করে পড়লো। চোখে মুখে কাঠিন্যতা ভর করলো। অভিমানে মুখ গোঁজ করে ফেলল। মাহমুদ লুকানো চোখে কলির অভিব্যক্তি পরখ করে দেখলো। এবং মনে মনে বলল,
“এইতো কাজ হচ্ছে। তোমার ভিতরে আমাকে নিয়ে এই জেলাসিভাব হোক এটাই ত আমি চাই। তুমি কবে থেকে যেচে আমাকে একটু ভালোবাসা বিলাবে? নিবিড়ভাবে আলিঙ্গন করবে? ”
মাহমুদ কলির মুখকে নিজের বুকের সান্নিধ্যে নিয়ে এলো। দু’ গালে চুমু খেয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“ব্যথা আছে এখনো? ব্যথা না কমলে মেডিসিন চেঞ্জ করতে হবে।”
কলি সংকোচপূর্ণ নিচু স্বরে বলল,
“এ কথা আর জিজ্ঞেস করবেন না আমাকে।”
“এটা স্বামী হিসেবে আমার কর্তব্য কলি। কর্তব্য পালনে বাধা দিচ্ছেন কেন?”
কলি শুয়ে রইলো। মুখে আর কিছুই বলল না। মাহমুদ বলল,
“উঠতে পারবেন? আমি ধরবো? ওয়াশরুমে যাবেন?”
“লাগবে না। আপনি উঠে যান।”
“কেন?আমার ওমে সুখ পাচ্ছেন না কলি?”
কলি চোখ বুঁজে ফেলল লজ্জায়। মাহমুদ উঠে গিয়ে ফ্রেস হলো।রুমে এসে দেখে তার মোবাইলে মেসেজ এলো।
“এই ওয়াশরুমে স্যাভলন নেই। ব্যাথা করছে।”
কলি ওপাশ ফিরে আছে। মাহমুদ আড়চোখে কলির পিঠের দিকে চাইলো। মুচকি হাসলো। কমন ওয়াশরুম থেকে স্যাভলনের বোতল এনে তাদের ওয়াশরুমে রাখলো। কলির গালের উপর ঝুঁকে বলল,
“স্যাভলন এনে রেখেছি ফুলকলি। হট ওয়াটারের সঙ্গে বেশি করে ইউজ করবেন। শেষ হলে আবার আনবো। তবুও ব্যথা দ্রুত দূর হওয়া চাই।”
কলি ঠোঁট কামড়ে ধরলো নিজের। মাহমুদ নাস্তা খেয়ে এসে রুমে প্যান্ট শার্ট পরে নিলো। রেডি হয়ে কলিকে বলল,
“থাকেন। নাস্তা খেয়ে নিবেন। সন্ধ্যায় এসে শ্বশুর বাড়ি যাবো।”
মাহমুদ চলে গেলে কলি আস্তে করে উঠে দাঁড়ালো। রুমের দরজা বন্ধ করে দিলো। বেশ সময় নিয়ে স্যাভলন ইউজ করলো।তারপরে ফ্রেস হলো। নিজের হাতে বিছানা পরিপাটি করে গোছালো। মাহমুদের ভেজা তাওয়েলটা নিয়ে ব্যালকনিতে রোদে দিলো। ক্ষুধাটা পেটের ভিতর চনমনিয়ে উঠলো। বের হতে যাবে,অমনি বাতাসী নাস্তার ট্রে নিয়ে রুমে এলো।
“ভাবিসাব। নাস্তা খেয়ে লন। রঙ চা আইনা দিতাছি।”
“বাতাসী, মা,বাবা,নানু, আপু সবাই নাস্তা খেয়েছে?”
“হ খাইছে সবাই। কব্বেই।”
“তুমি খেয়েছো নাস্তা?”
“ওরেহ! আমি খাই সবার আগে। রাজত্ব ত আমার হাতে ভাবি। সবকিছু বানাই আর খাই। ”
“হুম। আচ্ছা চা মগ ভরে নিয়ে এসো।”
কলি মাহমুদের টেবিলে বসে নাস্তা খেয়ে নিলো। পরে বাতাসী চা বিস্কুট নিয়ে দিলো।নাস্তা খাওয়ার পর কলি বারান্দায় গিয়ে রোদে বসলো। দরজার টোকা মেয়ে আনুশকা ও তার নানু কলির রুমে চলে গেলো। অনেকক্ষন তারা গল্পগুজব করলো। কলি আনুশকার বর ও বরের পরিবারের কথা জানতে চাইলো।
আনুশকা বলল,
“ভাবি জাহিদদের নিজের বাড়ি বংশাল। তার ছোট দুবোন। বিয়ে হয়ে গিয়েছে। বাবা মা আছে। বাসা ভাড়া দিতে হয় না তাদের। উপরন্তু পায়। আর জাহিদ ত ক্যাশ পাঠাচ্ছেই। সে কানাড়ায় থাকে। ইঞ্জিনিয়ার। ছয়মাস হয় দেশ থেকে গেলো। রোজই ভিড়িও ফোনে কথা হয়। সব মিলিয়ে বিন্দাস লাইফ। আমি চাইলেই কোন জব করতে পারি। কিন্তু প্রয়োজন নেই। তারাও চায়না। আরেহ ভাবি শোন,আমার ভাই মানে তোমার জামাই ত অনেক ভদ্র আছে। আমারটা তো লুইচ্চা নাম্বার গ্রেট ওয়ান। তাদের বাসায় আমার ওয়াশরুমে বাথটাব আছে। তো শাওয়ারের সময় সেই বাথটাবে সব খুলে শুয়ে তাকে ভিড়িও কলে দেখাতে হয়। বুঝো এবার।”
কলি হতবুদ্ধির মতো হা হয়ে গোলগোল চোখে আনুশকার দিকে চেয়ে রইলো। আনুশকার নানু কলির দিকে চেয়ে বলল,
“অমন চাইয়া থাইকা লাভ নাই বইন। ব্যাডার মন যুগায়া চলতে হয়। নইলে হে অন্য মাইয়ার শরীর দেখতে চাইবো। ব্যাডার জাতটাই অমন। স্বামী কিছু দেখতে চাইলে বাধা দিও না। স্বামীরা এসবেই দিলে শান্তি পায়!”
কলি অবাক হয়ে গেলো। কি বলে এসব। এ দেখি সব খুল্লাম খুল্লাম কাজ কারবার। তারা চলে গেলো। দুপুরে কলি গোসল করে একরকম রেডি হয়ে নিলো। কখন নিজের প্রিয়জনদের মুখখানা দেখবে। সেই প্রতিক্ষায় প্রহর গুনছে। মাহমুদ কলিকে ফোন দিয়ে দুপুরে খেয়েছে কিনা খবর নিলো। মাহফুজাও কলির শারিরীক খোঁজ খবর নিলো মাথায় মাতৃস্নেহের পরশ বুলিয়ে দিয়ে।
মাহমুদ বিকেলে বাসায় এলো। সন্ধ্যায় কলি ও ছোটবোনকে নিয়ে স্বশুরের বাসায় গেলো। সেখানে সবাই মিলে আমোদ ফূর্তি করলো। রাতে জুলি ও শাশুড়ীর জোরাজোরিতে মাহমুদ ও আনুশকা রয়ে গেলো। বিয়ের পর ছেলেদের স্বশুরের বাসায় একরাত নাকি থাকতে হয়। আনুশকা জুলির রুমে ঘুমালো। রাতে বিছানায় শুয়ে মাহমুদ কলিকে বলল,
“আপনার বেডরুম সুন্দর আছে। কিন্তু আপনার বেডে আমি কখনো ঘুমাবো। এটা অকল্পনীয় ছিলো।”
কলি বলল,
“সেইম টু মি স্যার। মানুষ যা কল্পনা করে না তাই বাস্তবে প্রতিফলিত হয়।”
“আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করতে ভয় হয়? ব্যথা পুরোপুরি গিয়েছে?”
“হাউ ফানি! যে নিজেই আমাকে ভয়ে তটস্থ করে রাখতো,সে আমাকে ভয় পায়?”
“ব্যথা গিয়েছে?”
কলি চোখ কটমট করে চাইলো মাহমুদের দিকে। মাহমুদ চুপ হয়ে গেলো। কলির পেটের উপরে হাত দিয়ে ঘুমিয়ে পড়লো। সকালে মাহমুদ চলে গেলো নাস্তা খেয়ে নিজেদের বাসায়। বাসা থেকে ভার্সিটি যেতে হবে। তাই।
কলি আজ ক্লাসে গেলো। সে আগের মতই বাসে বা সি এন জিতে যাতায়াত করে। মাহমুদের বাইকে আসে না। যেন কেউ না বুঝতে পারে। খেয়াও ক্লাসে আজই প্রথম আসলো। কলি ও খেয়া কেউ কারো সঙ্গে কথা বলে না। ক্লাসের দু’চারজন স্টুডেন্ট কলির দিকে কেমন সন্দেহতীত চোখে তাকালো। মাহমুদ ক্লাসে গেলে কথা প্রসঙ্গে একজন বলল,
“স্যার কলির মনে হয় বিয়ে হয়েছে। আমাদের মিষ্টি খাওয়ানোর ভয়ে অস্বীকার করছে।”
মাহমুদ বলল,
“কলি সত্যিই বলছে উনারা?”
কলি গম্ভীর সুরে বলল,
“স্যার আমার কাবিন হয়েছে। এম.এ কমপ্লিট হলেই অনুষ্ঠান করে তাদের বাসায় তুলে নিবে।”
“ওহ তাহলে ত উনাদের ধারণা সত্যি। আচ্ছা আপনারা কিভাবে গেইস করলেন?”
“স্যার কলির দু-হাত ভর্তি মেহেদি। চেহারাতেও জেল্লা ফিরে এসেছে।”
“হুম বুঝলাম। কলি বর নিয়ে পড়ে থাকবেন না। মন দিয়ে পড়াশোনা চালিয়ে নিবেন উজ্জ্বল ক্যারিয়ার গড়তে চাইলে।”
আদেশপূর্ণ কন্ঠে শাসনের সুরে বলল মাহমুদ।
ক্লাস শেষে সবাই বেরিয়ে গেলো। কলি মাহমুদের অফিস রুমে গেলো মাহমুদ আছে না বেরিয়ে গেলো দেখার জন্য। তাদের মধ্যে সমঝোতার একটি চুক্তি হয়েছে। ভার্সিটিতে তারা দুজন আগের মতই টিচার স্টুডেন্ট হয়ে আচরণ করবে। যেন কেউই এতটুকু ডাউট না করতে পারে।
রুমের দরজা চাপানো ভিতর থেকে। কলি চাপানো দরজা ঠেলেই ভিতরে প্রবেশ করলো। তাতে সে যা দেখলো, তক্ষুনি তার চোখদুটো কোটর হতে বেরিয়ে আসার উপক্রম। সে দেখলো খেয়া মাহমুদকে চেয়ারের পিছনে দাঁড়িয়ে দু-হাত দিয়ে গলা জড়িয়ে ধরে কি কি যেন বলছে। মাহমুদ হাত দিয়ে খেয়াকে ছাড়ানোর চেষ্টায় ব্যর্থ হচ্ছে।
অমনি কলি গিয়ে খেয়ার গালে কষে চড় বসিয়ে দিলো।
হোয়াট! দুই পয়সার সস্তা মেয়ে আমার গায়ে হাত তুলিস? তোর এত বড় আস্পর্ধা? বলেই উত্তেজিত হয়ে খেয়াও ফের কলির গালে চড় মারতে হাত উঠালো।
নিমিষেই মাহমুদ খেয়ার হাত ধরে ফেলল। রক্তচক্ষু নিয়ে বলল,
চলবে…২৬
#তোমার_জন্য_সব -২৭
✍️ #রেহানা_পুতুল
অমনি কলি গিয়ে খেয়ার গালে কষে চড় বসিয়ে দিলো।
“হোয়াট! দুই পয়সার সস্তা মেয়ে আমার গায়ে হাত তুলিস? তোর এত বড় আস্পর্ধা? ”
বলে উত্তেজিত হয়ে খেয়াও ফের কলির গালে চড় মারতে হাত উঠালো। নিমিষেই মাহমুদ খেয়ার হাত ধরে ফেলল। রক্তচক্ষু নিয়ে বলল,
“স্টপ খেয়া। কলির গায়ে হাত তোলার চেষ্টাটুকুও করবেন না বলছি।”
খেয়া ক্রোধে অগ্নিশর্মা হয়ে উঠলো। আদ্রকন্ঠে বলল,
“স্যার ও আমাকে চড় মারলো কেন?”
“সেটা কলিকে জিজ্ঞেস করুন। আমাকে নয়?”
“ওর হয়ে আপনি আমাকে প্রতিহত করলেন। তাই আনসার আপনি দিবেন স্যার।”
“আপনি অন্যায়ভাবে কলির গায়ে হাত তুলতে চেয়েছেন। তাই।”
খেয়ার কন্ঠে অনুযোগ ঝরে পড়লো মাহমুদকে নিয়ে। বলল,
“আমারটা অনুচিত? তার আগে সেই যে কাজটা করলো সেটা খুব উচিত হয়েছে? তাকে কিছু না বলে উল্টো আমাকে শাসাচ্ছেন স্যার?”
মাহমুদ নিজের রাগকে সংবরণ করলো। শান্ত গলায় খেয়াকে বলল,
“আপনি আমার পিছনে দাঁড়িয়েছিলেন। কলি আপনার গায়ে হাত তুলল আমি দেখার আগেই। তাকে আটকানোর সুযোগটুকুও হয়নি। আর তাকে কিছু বলিনি এই অভিযোগ? বলিনি, আপনার যে কাজটা আমার কাছে খারাপ লেগেছে। ভুল লেগেছে। সেই একই কাজ কলির চোখেও দৃষ্টিকটু লেগেছে। তাই ছাত্রী হিসেবে সে আপনাকে চড় দিলো। ক্লিয়ার?”
“নাহ স্যার। ক্লিয়ার নই। আপনার লজিকটা আমার কাছে লেইম লেগেছে।”
কলি কিছুই বলছে না। ঘটনার আকস্মিকতায় সে হতবুদ্ধির ন্যায় হয়ে গেলো। বিরক্তিকর মুখে বেরিয়ে যেতে উদ্যত হলো।
“এই কলি দাঁড়া। আমার কথার আনসার দে বলছি। নইলে পরিণাম ভয়াবহ হবে। স্যারের হয়ে তুই আমাকে চড় মারলি কেন?”
ঝাঁঝালো কন্ঠে বলল খেয়া। কলি পা ঘুরিয়ে খেয়ার মুখোমুখি এসে দাঁড়ালো। ক্ষিপ্র স্বরে খেয়াকে বলল,
“আমি সহজ সাধারণ একজন মেয়ে। ক্লাসের লাস্ট বেঞ্চে চুপচাপ বসে থাকা ছাত্রী। তোর মতো বিত্তশালী বাবার মেয়ে নই। ঠিক এই বিষয়গুলোকেই মাথায় রেখে কয়েকমাস আগে তুই মুরগী বানালি আমাকে। স্যারের কাছে আমাকে দিয়ে ইমেইল পাঠালি। সেই ব্যাঙ ও মানুষের গল্পের মতো তুই পাড়ে বসে মজা লুটলি। আর আমি ব্যাঙের প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়ে গেলো। স্যার আমাকে সেই এক ইমেইলকে কেন্দ্র করে তীব্রভাবে অপমান করলো।
আত্মসম্মানটুকুই আমাদের মধ্যবিত্তদের বেঁচে থাকার সম্বল। সেই লজ্জা, সংকোচ ও গ্লানিতে ক্লাসে আসতে পারিনি দিনের পর দিন। বাসায় মিথ্যা বলতে হয়েছে। রাতদিন মায়ের বকুনি হজম করতে হয়েছে। ম্যামের কাছেও মিথ্যা বলতে হয়েছে। সামনে পরিক্ষা ছিলো। রেজাল্ট ভালো করার জন্য ঘুম মেরে রাত জেগে জেগে পড়াশুনা করতে হয়েছে। এতকিছু হলো আমার,তবুও তোকে কিচ্ছু বলিনি। আমার স্থানে তুই হলে কি করতি একবার ভেবে দেখ? তাই আজ সুযোগ পেয়ে তোর উপর আমার জমে থাকা পুরোনো ঘৃণার কিছুটা লাঘব করলাম। স্যার ছিলো মাধ্যম মাত্র। ব্যাস। এটাই। এর বাইরে কিছুই না।
ক্লাসের সবাই জানে তুই মাহমুদ স্যারকে পছন্দ করিস। এতে দোষের কিছুই নেই। করতেই পারিস। কিন্তু প্রশ্ন এখানেই, স্যার যখন তোকে অন্যচোখে দেখে না, এটা জানার পরেও তুই কেন স্যারের পিছু ছাড়িস না?”
মাহমুদের কঠিন দৃষ্টি টেবিলের উপরে স্থির। কলির সাহসিকতা ও তার প্রতি অধিকারবোধে সে আশ্চর্য হয়ে গেলো। খেয়া সরাসরি কলিকে জিজ্ঞেস করলো,
” তাতে তোর জ্বলছে কেন? তুই কি স্যারকে পছন্দ করিস?”
” কেন? তুই করতে পারলে আমি স্যারকে পছন্দ করতে পারি না? কেবল তোর প্রেমে ভরা,মধুয় ভরা একটা বিশাল হৃদয় আছে। আমার থাকতে পারে না?”
কলির কথাগুলো শুনে মাহমুদের হৃদয় আনন্দে নেচে উঠলো। কলির দিকে প্রীতিময় চাহনি নিক্ষেপ করলো এক ঝলক।
কলি হনহন পায়ে রুম হতে বেরিয়ে গেলো। খেয়া ফের মাহমুদের হাত টেনে ধরলো। আপ্লুত স্বরে বলল,
“স্যার কলির কথা সত্যি? আপনি না বিয়ে করেছেন বললেন ভাবির কাছে? ”
“সেটা জানার পরেও তো আপনি আমার সান্নিধ্য কামনা করেন। তাহলে কলি পছন্দ করলে সমস্যা কোথায়?”
“তারমানে কলির পছন্দকে আপনি গুরুত্ব দিতে চাচ্ছেন? প্রশ্রয় দিতে চাচ্ছেন? ও আপনার যোগ্য?”
“দিতে চাচ্ছি না। দিচ্ছি অলরেডি। আর যোগ্যতা? যার মনুষ্যত্ববোধটুকু আছে, সেই আমার চোখে যোগ্য। যা আপনার মাঝে নেই। থাকলে এত ইগনোর করার পরেও আপনি বেহায়া,ছ্যাচড়ার মতো আমাকে চাইতেন না।”
মাহমুদ হাতের কাজ সেরেই রুম থেকে প্রস্থান নিলো। বাইক স্ট্রাট দিয়ে সোজা বাসায় চলে গেলো। হীনমন্যতায় ভুগছে বেশ। কি বলবে কলিকে। কলিইবা তাকে কি বলবে। বাসায় গিয়ে নিজের রুমে গেলো। দেখলো কলি নিজেদের রুমে নেই। সে ড্রেস চেঞ্জ করে ফ্রেস হয়ে নিলো। বাতাসী টেবিলে ভাত এনে দিলে খেয়ে নিলো।
তারপর মাহমুদ আনুশকার রুমে গেলো। দেখলো কলি উপুড় হয়ে শুয়ে আছে। মাহমুদ কলির পিঠের উপর নিজের হাত রাখলো। সংকোচপূর্ণ কন্ঠে বলল,
“কি ব্যপার? আপনি এখানে কেন? আমাদের রুমে আসুন।”
কলি মুখ গোঁজ করে রইলো। মাহমুদ কলির হাত ধরে ফের বলল,
“কলি মন খারাপ? আমাদের রুমে আসুন না। কথা আছে।”
কলি বলল,
“এটা রুম নয়? আপনি চলে যান। আমি এখন থেকে এই রুমে থাকবো। আমার কিছু ভালো লাগছে না।”
“প্লিজ আসুন বলছি। নইলে আমি সত্যি সত্যি পাঁজাকোলা করে নিয়ে যাবো।”
কলি বুঝতে পারলো, মাহমুদ এটা করেই ছাড়বে। সে নিজ থেকেই উঠে গেলো রুমে। গিয়ে বারান্দায় চলে যেতে লাগলো। মাহমুদ হাত টেনে ধরে দাঁড় করালো। দরজা বন্ধ করে দিলো। কলিকে বিছানার উপরে বসালো। অপরাধীর ন্যায় জানতে চাইলো,
“মুখ ভার কেন? খেয়ার বিষয়টা নিয়ে? জেলাসী?”
কলি দৃষ্টি অন্যদিকে ঘুরিয়ে অভিমানী কন্ঠে বলল,
“আমাকে কোন ছেলে এমন ঘনিষ্ঠভাবে ছুঁয়ে দেক? তখন আপনার কেমন লাগবে? শুরু থেকেই যদি আপনি হার্ড অবস্থায় থাকতেন, তাহলে সে এতটা এগোয় কিভাবে? আমি দেখতাম না পিছনের বেঞ্চে বসে? সে আপনাকে নানা বাহানায় কোন গিফট দিলে কেমন খুশীতে গদগদ হয়ে নিয়ে নিতেন।”
মাহমুদ নির্বাক চোখে চেয়ে রইলো কলির দিকে। আগের কলি আর বর্তমানের কলির ব্যবধান রাত দিনের মতো। যেই কলির সঙ্গে তার প্রণয় ঘটেনি। বন্ধুত্ব হয়নি। সখ্যতাটুকু গড়ে তুলতেও সে ব্যর্থ হয়েছে। নিজের সমস্ত অধিকারের ভার অর্পিত করে যাকে অবশেষে নিজের অর্ধাঙ্গিনী করে নিলো দুই পরিবারের আগ্রহে। সেই কলি যে আজ নিজের অধিকার পুরোটাই লুফে নিবে এবং তার যথাযোগ্য ব্যবহার করবে এত সহসাই। এ মাহমুদের কাছে ঘোরতর অবিস্বাস্য ঠেকলো।
যদিও সে এতেই বিপুল আনন্দ লাভ করেছে গোপনে। সেতো এই কলিকেই চেয়ে প্রতিটিক্ষন। কলি তার স্ত্রী হয়ে উঠুক। পূর্ণ অধিকারটুকু ফলাক। অভিমানে,অনুযোগে ফেটে তুলুক। সে তখনই কলির হৃদয়ের অতলান্ত হতে তার জন্য জমে থাকা ভালোবাসাটুকু ছেঁকে নিবে।
ঘড়ির কাঁটার টুংটাং আওয়াজে মাহমুদ সম্বিৎ ফিরে পায়। কলিকে বিছানায় শুইয়ে দেয়। নিজেও কলির গা ঘেঁষে শুয়ে পড়ে। কলির চুল থেকে পাঞ্চ ক্লিপটা খুলে নেয়। চুলগুলো সারা পিঠময় ছড়িয়ে দেয়। চুলের নিচে নিজের মুখ ডুবিয়ে দেয়। জোরে স্বাস টেনে নেয়। কলিকে লেপ্টে ধরে খোলা বুকের মাঝে। কলির গালের উপর নিজের দুঠোঁট ঘষতে ঘষতে নিবেদিত কন্ঠে বলে,
“আপনি আমাকে ভুল বুঝলে আমি নিঃশ্ব হয়ে যাবো। আমার মৌনাকাশে শুধু আপনার আধিপত্য বিস্তার চলবে। দ্বিতীয় কারো নই। একটু ভালোবাসুন না আমাকে।”
কলি হুঁ হ্যাঁ কিছুই বলছে না। চুপটি করে ওভাবেই পড়ে আছে মাহমুদের বুকের মাঝে।
কলির বাবা নুরুল হক সরকারি চাকরি থেকে অবসর নিলেন। বড় অংকের পেনশনের টাকাও হাতে পেলেন। সেখান থেকে একটা অংশ চলে গেলো ব্যাংকের লোন শোধ করতে গিয়ে। যেটা কলির বিয়ের জন্য নেওয়া হয়েছিলো। আরেকটা অংশ চলে গেলো গ্রামে একটা বন্ধকী জমি ছাড়াতে গিয়ে। কিছু টাকা ডিপোজিট করে ব্যাংকে রাখলেন নিজের নামে। বাকি টাকা বর্তমান ব্যাবসার জন্য গচ্ছিত রাখলেন বাসায়। কিছুদিন আগ থেকেই তিনি বাইরে বিভিন্ন লোকেশনে দোকান খুঁজতেছিলেন কলিকে নিয়ে একটা ব্যবসা দাঁড় করাবেন বলে। যেকোনো ছোট বড় ব্যবসার জন্য উপযুক্ত সেন্টার পাওয়া মোস্ট ইম্পর্ট্যান্ট। পাশাপাশি জনবহুল জায়গাও হতে হয়। যেখানে ক্রেতার সমাগম হবে। প্রথম ছয়মাস ব্যবসায় লস হবে এটাই মাইন্ড সেট করে নিতে হয়। তারপর থেকে ধীরে ধীরে লভ্যাংশ আসতে থাকে। বীজ পুঁতে ফেললেই যেমন ফল পাওয়া যায় না সঙ্গে সঙ্গে। তদরূপ ব্যবসার ক্ষেত্রেও এমন। শুরুতেই লাভ আসা করা বোকামি। ধৈর্য, অনেস্টি, শ্রম, নির্ভেজাল পন্য, ভালো আচরণ সবমিলিয়ে একটা ব্যবসা এগিয়ে যায় ও বৃহৎ আকার ধারণ করে।
কলিও অনলাইনে নিউ বিজনেস নিয়ে অনেক স্টাডি করলো। অবশেষে পরিবারের সবার সম্মতিতে ঠিক হলো ফাস্টফুড শপ দিবে কলি। কারণ সে নিজেই অনেক মেন্যু তৈরি করতে পারে। সেগুলো বাসা থেকে বানিয়ে নিতে পারবে মায়ের হেল্প নিয়ে। দু’বছর আগে সে শখ করে অনলাইনে একটা ফুডকোর্সও করেছে। দোকান ভাড়া নেওয়া হয়ে গেলো। প্লেস লালবাগের মধ্যেই। তাদের বাসার নিকটবর্তী। মেয়েদের কর্মস্থল ও বাসা কাছাকাছি হওয়া অপরিহার্য! দোকানে একজন স্টাফ নিয়োগ দিতে হলো। যেহেতু কলির স্টাডি এখনো শেষ হয়নি। তার বাবা ও স্টাফ মিলে পরিচালনা করবে। কিন্তু তার তত্বাবধানে চলবে সব। কারণ তার বাবার চেয়ে তার আইডিয়া ভালো হোম মেড ফুডের দরদাম সম্পর্কে। অন্যদিকে নুরুল হক প্রায় অসুস্থ হয়ে পড়েন। ডেকোরেশন সম্পন্ন হয়েছে। টেবিল চেয়ার থেকে শুরু করে যাবতীয় সরঞ্জামাদিও কেনা শেষ। খাবারের আইটেমগুলো কাঁচের বিভিন্ন সেল্ফে সাজানো হলো। কিছু খাবার কিনে এনেছে। কিছু খাবার বাসা থেকে বানিয়ে নেওয়া হয়। ফাস্টফুড দোকানের নাম দিলো ‘মজা’। কলিই নামটা ঠিক করলো।
তার মাস দুয়েক পরের কথা। কলির মিডটার্ম ও সেমিস্টার ফাইনাল শেষ হলো। তারপর এক সন্ধ্যায় কলি তাদের ‘মজা’ শপের ভিতরে ক্যাশে বসে আছে৷ পাশে দাঁড়িয়ে ক্রেতাদের খাবার পরিবেশন করছে তার ম্যানেজার। সেই সময়ে তার সামনে উপস্থিত হলো খেয়া। সঙ্গে একটি যুবক ছেলে। তার বেশভূষা মাস্তান টাইপের। কলি ঘাবড়ে গেলেও বুঝতে দিল না খেয়াকে। বলল,
“খেয়া তুই? ভিতরে আয়। কোথা থেকে এলি? ইনি কে?”
খেয়া কলির কথাকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করলো। দোকানের নেইম ফলকের দিকে একটুক্ষণ তাকালো। ঠোঁটের কোণে বিদ্রুপের হাসি ঝুলিয়ে বলল,
“বাহ! দারুণ নাম দিলিতো কলি। ‘মজা’! তো মজা কি মানুষ খাবার থেকে নেয়? না তোর থেকেও নেয়?”
নিমিষেই কলির মুখ রক্তিম হয়ে উঠলো অপরিসীম লজ্জায় ও বিতৃষ্ণায়। চুপ করে রইল না। খেয়ার কথার প্রত্যুত্তরে বলল,
“সবাইকে নিজের মতো ভাবিস কেন খেয়া?”
খেয়া চমক খেলো। মুখাবয়ব বিকৃত করে বলল,
“হোয়াট?”
“চোর যখন চুরি করে, সে মনে করে কেউই দেখেনি। কেউই জানে না। কিন্তু সে নিজের অজান্তেই এমন এক প্রমাণ রেখে যায়, যা তার গোটা জীবনটা ধ্বংস করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। সঙ্গে তার পরিবারেরও।”
দুর্বোধ্য হেসে বলল কলি।
চলবে…২৭
#Romantic