#তোমার_জন্য_সব -২০
✍️ #রেহানা_পুতুল
কন্ডিশন আর কন্ডিশন। হায়রে! বলুন।”
“বিষয়টা আমার পরিবার নিয়ে স্যার।”
” ওহ হো! সিউর কলি। প্লিজ।”
কলির মুখ ম্লান। দৃষ্টি আনমনা। কন্ঠ ভারি। সে বলতে লাগলো,
“স্যার যেহেতু এটা পারিবারিক বিয়ে। সেই সুবাধে অনেক কিছু না জানলেও কিছু বিষয় নিঃশ্চয়ই জেনে গিয়েছেন ইতঃপূর্বে।”
“কোন বিষয়ে কলি?”
“আমার পরিবারের বিষয়ে।”
“হ্যাঁ। আমাদের জন্য যতটুকু জানার প্রয়োজন ছিলো। ততটুকু আমরা জেনে নিয়েছি। এনাফ।”
“আপনাদের জন্য হয়তো এনাফ। আমাদের সিচুয়েশনে জানানো অত্যাবশ্যক।”
টেবিলের উপরে চোখ রেখে বলল কলি।
“প্লিজ কন্টিনিউ।”
মাহমুদ কলির মুখপানে চেয়ে ভারিক্কি গলায় অনুরোধের ভঙ্গিতে বলল।
“স্যার আমি মিডেল ক্লাস পরিবারের মেয়ে। বড় আপা অনার্স কমপ্লিট করেনি। সুপাত্র পেয়ে যাওয়াতে আব্বু আম্মু আপাকে পাত্রস্থ করে দেয় আগেপরে সব বিবেচনা করে। জুলি ছোট। নাইনে পড়ে। আমাদের কোন ভাই নেই। আব্বু গভর্মেন্ট জব করে। রিটায়ার্ড হয়ে যাবে এক বছর বাদে। তখন,আব্বু যে পেনশনের টাকা পাবেন,তা দিয়ে উনি একটা বিজনেস দাঁড় করাতে চাচ্ছেন। এই বিষয়গুলো বিয়ে ঠিক হওয়ার বেশ আগেই আমাদের বাসায় ডিসকাসন হয়েছে। তো জব করা মানুষ তো হুট করে বিজনেস দাঁড় করাতে পারবে না। হিমশিম খেয়ে যাবে। তাই আব্বু,আম্মুর কথা, আব্বু ও আমি মিলেই যেন বিজনেস শুরু করি। অর্থাৎ আমাদের পারিবারিক বিজনেসটা পুরোপুরি আমার হস্তক্ষেপে চলতে হবে। আব্বু অনেক সময় অসুস্থ থাকে। আর লোকও রাখবো একজন প্রয়োজন বুঝে।”
মাহমুদ কফি পান করতে করতে মনোযোগ সহকারে কলির কথাগুলো শুনলো। এবং বলল,
“আমার করণীয়?”
“আপনার কিছুই করতে হবে না। আমাকে সেই ফ্রিডম দিতে হবে। এটা চাওয়া আমার। বিয়ে পিছাতে চেয়েছি। তাতো আর হলো না।”
অনুযোগ করে চাপাস্বরে বলল কলি।
“আমি এবং আমার পরিবার এসব বেশ উপলব্ধি করতে পারি। কারণ আজ আমরা সমাজের শ্রেনীভেদে যে সচ্ছল অবস্থানে আছি। তা কেবল পরিশ্রম, সততা ও বুদ্ধির জোরে। সো এ নিয়ে দ্বিতীয়বার চিন্তা করবেন না। আপনার পরিবারের জন্য যা যা করতে চান, করবেন। আমি স্যাক্রিফাইস করতে জানি। বাসায় গিয়ে আজই জানিয়ে দিবেন এই বিষয়টা। কেমন?”
কলি ঈষৎ হাসলো।
“আন্তরিক ধন্যবাদ স্যার। খুব ভালোলাগছে এখন। এটা নিয়ে এই কয়দিন দ্বিধায় ছিলাম আমি।”
“বিয়ে পেছানোর মতো উপযুক্ত কোন হেতু খুঁজে পায়নি আমার ফ্যামেলি। তাই মামা ও বাবা পেছায়নি। কিন্তু আমি আপনার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেছি বিয়ে পিছাতে। সরি।”
“হুম। কচু! ঘোড়ার ডিম করেছেন।”
গোপনে বলল কলি।
” হুম। ওহ! এক মিনিট কলি। আপনার বিয়ে ঠিক হলো যেন কার সঙ্গে?”
সিরিয়াস মুডে জানতে চাইলো মাহমুদ।
কলি ভ্যাবাচেকা খেয়ে উঠলো। দোনোমোনো করতে করতে অপ্রস্তুত গলায় বলল,
“এটা কি ধরনের প্রস্ন হলো ?”
“প্রশ্ন প্রশ্নই। সেটা যেমনই হোক। জাস্ট আপনার হবু বরের নামটা জানতে আগ্রহী এই মন।”
“আমি জানি না। বাসায় গিয়ে জেনে জানাবো।”
“আমি জানিয়ে দিবো এখন?”
“আপনি জানলে আবার জানতে চাইলেন কেন?”
“আপনার মুখ থেকে শুনতে খুব ইচ্ছে হচ্ছিলো।”
“স্যার বাসায় যাবো। আম্মু চিন্তা করবে।”
মাহমুদ তার তিন আঙুলের ডগার পিঠ কলির কোমল গালের একপাশে উপর থেকে নিচে বুলিয়ে নিলো। থুতনির মাঝে এনে আঙুল থামিয়ে নিলো। রোমান্টিক চাহনিতে বলল,
“ফাঁকি দেওয়ার ধান্ধা আর নয়। অনেক ফাঁকিঝুঁকি দিয়েছেন। আম্মু একটুও চিন্তা করবে না। এডাল্ট মেয়ে। তার বিয়ে ঠিক হয়েছে। হবু বরের সঙ্গে ঘোরাঘুরি করবে এটাই স্বাভাবিক। কলি হয়ে আর কতকাল থাকবেন? এবার ফুল হয়েতো ফুটুন। বিকশিত হোন সমস্ত অঙ্গসুরভি নিয়ে।”
কলির নাক মুখ দিয়ে যেন উষ্ণ ধোঁয়া বের হচ্ছে। কি করছে স্যার। এতো দেখি শিক্ষক বেশের আড়ালে কড়া ডোজের প্রেমিক।
একরাশ বিরক্তি ভর করলো কলির মুখশ্রীতে। সে না পেরে ঠনঠনে গলায় বলল,
“বিয়ে পড়ানোর পূর্ব মুহুর্ত পর্যন্ত বিয়ে ভেঙ্গে যাওয়ার চান্স থাকে শতভাগ। এটা বোধহয় আপনি জানেন না?”
মাহমুদের ভিতর থেকে রোমান্টিকভাব মিলিয়ে গেলো। চোখ থেকে চশমা খুলে নিলো। কাঠিন্য সুরে বলল,
” আল্টিমেটাম দিচ্ছেন মনে হয়?”
“ধরে নিন তাই। সময়ের কাজ অসময়ে করতে চান কেন? আপনি আমার জন্য পর পুরুষ। ভুলে যাবেন না।”
“কি করলাম আমি?”
নিরস ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করলো মাহমুদ।
“কি না করলেন? হাত ধরে ফেললেন, ঘনিষ্ঠ হয়ে বসলেন। গালে,চিবুকে হাত দিলেন।”
লজ্জাবনত কন্ঠে দৃষ্টি নামিয়ে বলল কলি।
মাহমুদের জেদ হলো। সে ফের কলির গলা বরাবর চার ইঞ্চি নিচে বুকের উপরে চার আঙ্গুল রাখল। গম্ভীর মুখে ও কন্ঠে বলল,
“বুকের উপরে হাত রেখেছি এটা বলতে ভুলে গেলেন? পর পুরুষ আমি? ওকেহ! যেদিন থেকে আপন পুরুষ হবো,সেদিন থেকেই ছোঁবো। আমি আপনার ছায়াও মাড়াবো না আর। মাইন্ড ইট। পারিবারিক বিয়ে পারিবারিক নিয়মেই হবে। তার আগে না আমি আপনাকে চিনি। না আপনি আমাকে চিনেন। বেস্ট অফ লাক। আসতে পারেন আপনি। বাই।”
মাহমুদ উঠে গেলো নিমিষেই। বিল মিটিয়ে বের হয়ে গেলো গমগমে পায়ে। কলিও তার মতো করে বের হয়ে বাসায় চলে গেলো।
দুই পরিবার নিজেদের মতো করে বিয়ের প্রস্তুতি নিচ্ছে। মাহমুদের পরিবারের তেমন সমস্যা না হলেও বিপাকে পড়ে গেলো কলির পরিবার। নুরুল হল ব্যাংক থেকে লোন নিলেন গ্রামের হাউজ প্রোপার্টি দেখিয়ে। মাসিক কিস্তিতে শোধ করতে হবে। কিন্তু করবেন কিভাবে? তা ভেবেও দিশেহারা। রেবেকা স্বামীকে আস্বস্ত করলেন। বললেন,
“আপনি চিন্তা করবেন না। আমার যে ব্যংকে ডিপোজিট আছে। সেটা ক্লোজ করে ফেলব। সেই টাকা দিয়ে লোন নেওয়া ব্যাংকের কিস্তি দিতে পারবেন। আমার এই টাকায় যদি দরকার সারতো তাহলেত লোন নিতেই হতোনা।”
রেবেকা উঠে গেলো অন্যদিকে। নুরুল হক ভিতরে নরম হয়ে গেলেন রেবেকার জন্য। আজকাল রেবেকার মাঝে স্থিরতা ও ধৈর্যতা চোখে পড়ার মতো। সামান্যতেই হই হই আর হায় হায় করে উঠা রেবেকা কেন এত শান্ত হয়ে গেলো? কি হয়েছে রেবেকার? যারজন্য রেবেকার এই প্রকাশ্য পরিবর্তন? নুরুল হক উত্তর খুঁজে পেলনা।
মাহমুদ ক্লাসে কলির সঙ্গে একাডেমিক বিষয়েও কোন কথা বলে না। সব ধরনের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে। আজকাল মাহমুদের ভাবখানা এমন, যেন কলিকে সে চেনেই না। অথচ মাত্র কটা দিন পার হলেই এই মেয়ের সঙ্গে তার বাসর উদযাপন হবে। হবে স্মরণীয় রাত্রি যাপন।
কলির সেমিস্টার ফাইনাল চলছে। মাহমুদ অন্যদের বেঞ্চের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু কলির বেঞ্চের পাশে গিয়ে দাঁড়ায় না। যদিও প্রয়োজন হয়। তখন বরাবরের মতো শিক্ষকসুলভ আচরণ করে কলির সঙ্গে। মাহমুদের একরোখা মনোভাব কলির চেনা। তবুও তা নিয়ে কলির মাঝে বিশেষ হেলদোল পরিলক্ষিত হলো না। পরিক্ষা শেষ হলো। রেজাল্ট প্রকাশ হলো যথাসময়ে। কলি ধরে নিলো মাহমুদ তাকে ইচ্ছে করে মার্ক কমিয়ে দিবে। কিন্তু না। সে খুব ভালো রেজাল্ট করলো তার দুই বিষয়ে।
দিন ফুরিয়ে গেলো। বিয়ের দিন ঘনিয়ে এলো। দু’পক্ষের সমঝোতায় গায়ের হলুদের স্টেজ তৈরি হলো। কলি + মাহমুদের গায়ে হলুদ। কলি খুব চেয়েছে গায়ে হলুদে বর না আসুক। দুই পক্ষ আলাদা আলাদাভাবে গায়ে হলুদ করবে।
কিন্তু বরপক্ষ মানল না। বিশেষ করে বরের ছোট বোন আনুশকা। গায়ে হলুদের স্টেজে মাহমুদ চুপচাপ রইলো। একইভাবে কলিও। দুজন দুজনের সঙ্গে কোন কথা বলল না। দৃষ্টি বিনিময় করল না। অন্যরা ভেবে নিলো দুজন টিচার স্টুডেন্ট বলে সংকোচে ও ,ভদ্রতা বজায় রেখে চুপ হয়ে আছে।
কিন্তু তা নয় আদৌ। তারা দুজন জানে কেন এমন নিরবতায় চাদরে জড়িয়ে গেলো তারা। একজনের অসন্তোষজনক বিহেভিয়ার ও বাকিজনের একরোখা মনোভাবের স্বচ্ছ প্রতিফলন এটা।
ফটোগ্রাফারের অনুরোধে কিছু পোজ দিতে হয়েছে মাহমুদ ও কলিকে। গায়ে হলুদ অনুষ্ঠান নাচে গানে শেষ হয়ে গেলো। মাহমুদ উঠে চলে গেলো বাসায়। কলির সঙ্গে সে টু শব্দটিও করল না। কি ভেবেছে কলি তাকে। সে ইমশোনকে কন্ট্রোল করতে পারবে না? প্রয়োজনে মানুষকে অনেক কিছুই পারতে হয়। তাই সেও পেরে যাচ্ছে। কলিও মনে মনে বলল,
“বেশ হয়েছে। আমি দারুণ মজা পেয়েছি। দু ‘বাক্যে কিছুদিনের জন্য স্টপ করিয়ে দিতে পারলাম। বাহ! আমার কথারও তো দেখি হেবি জোর আছে। শালা মাহমুদ। কি পেয়েছো। হুহ্!”
উৎসবে, আমেজে, বর্ণিল আলোকসাজে,ভরপুর খাওয়া দাওয়ায় মাহমুদ ও কলির বিয়ে সম্পন্ন হয়ে গেলো। বিয়ের দিনেও কলি ও মাহমুদ কোন বাক্য বিনিময় বা খুনসুটি আলাপে মগ্ন হয়নি। আগের দিনের মতই ফটোশেসনের জন্য কিছু ক্লোজলি পোজ দিতে হয়েছে কলির সঙ্গে।
ইট কাঠের নগরীর মধ্যরাত। হাই ভোল্টেজের বৈদ্যুতিক লাইট জ্বলছে। রুমভর্তি আলোর ঢল। শতপুষ্পরাজিতে সজ্জিত মাহমুদের বেডরুম। কলি একহাত ঘোমটা টেনে বধূবেশে বসে আছে মাহমুদের বিছানায়। এলো সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। বিতর থেকে দরজা চাপানো।
হাট করে দরজা খুলে মাহমুদ রুমের ভিতরে প্রবেশ করলো। ইচ্ছে করেই সে এমন করেছে। কলির হার্টবিট কি পরিমাণ বৃদ্ধি পেতে পারে আজ সে দেখবে।
কলির কলিজা শুকিয়ে গেলো। প্রাণ বুঝি উড়ে যায়। ভয়ে,আড়ষ্টতায় জুবুথুবু হয়ে যাচ্ছে সে। হৃৎপিণ্ডের ধুকপুকানি এত প্রবলতর হচ্ছে, মনে হয় এক্ষুনি ছিঁড়েপুড়ে বেরিয়ে আসবে।
মাহমুদ দরজার খিল লাগিয়ে দিলো ভিতর থেকে। এগিয়ে গিয়ে বিছানার সামনে কলির মুখোমুখি দাঁড়ালো।
প্রেমিক কন্ঠে শুধালো,
“কলিইই কেমন আছেন?”
“হ্যাঁ.. জ্বিইই…স্যার..একটু..একটু পানি হবে?”
গহীন গুহায় আটকে পড়া বিপথগামী মানুষের মতো ভীত কম্পিত স্বরে অনুনয় করে বলল কলি।
চলবে…২০
#তোমার_জন্য_সব -২১
✍️ #রেহানা_পুতুল
মাহমুদ দরজার খিল লাগিয়ে দিলো ভিতর থেকে। এগিয়ে গিয়ে বিছানার সামনে কলির মুখোমুখি দাঁড়ালো।
প্রেমিক কন্ঠে শুধালো,
“কলি কেমন আছেন?”
“হ্যাঁ.. জ্বিইই…স্যার..একটু..একটু পানি হবে?”
গহীন গুহায় আটকে পড়া বিপথগামী মানুষের মতো ভীত কম্পিত স্বরে অনুনয় করে বলল কলি।
“পানি কোন তাপমাত্রার দিবো? নরমাল,ঠান্ডা, মিক্স?”
ব্যক্তিত্বপূর্ণ কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো মাহমুদ।
কলি তোতলানো স্বরে বলল,
“মিইই..মিইক্স।”
মাহমুদ রুমের বাইরে গেলো। ফিল্টার ও ফ্রিজ থেকে পানি মিক্স করে গ্লাসে নিলো। ফিরে এসে নিজের রুমের দরজা বন্ধ করে দিলো। কলির সামনে দাঁড়িয়ে গ্লাস এগিয়ে দিলো তারদিকে। কলি গ্লাস ধরতে গিয়েও পারছে না। হাতের পাঁচ আঙ্গুল অনবরত কাঁপছে।
“আশ্চর্য! একটু আগে দেখলাম আপনার কথা জড়িয়ে যাচ্ছে। তারপর দেখলাম তোতলাচ্ছেন। এখন দেখি হাত কাঁপছে। মৃগী রোগী নাকি? এতো জটিল সমস্যা। আপনাকে নিয়েতো সংসার করা যাবে না।”
বাঁকা স্বরে বলল মাহমুদ।
কলি দু’হাত দিয়ে শক্ত করে গ্লাস ধরলো। কোনমতে পুরো গ্লাসের পানি খেয়ে নিলো। বেড সাইড টেবিলের ওপরে ওয়াটার পট রয়েছে। সেটা থেকে গ্লাসটিতে মাহমুদ একটু নরমাল পানি ঢেলে খেয়ে নিলো। তার পরনে বরের পোশাক নেই। সে আগেই চেঞ্জ করে ফেলেছে। নতুন ট্রাউজার ও টিশার্ট পরে নিলো। হাত খালি। ঘড়ি খুলে রেখেছে রোজরাতের মতই। তার শরীর থেকে পারফিউমের ঘ্রাণ গিয়ে কলির নাকে ঠেকছে। মাহমুদ কলির সামনে থেকে সরে এক চিলতে বারান্দাখানায় চলে গেলো।
কলির হার্টবিট ক্রমশ বেড়ে যাচ্ছে। সে ছোট খুকী নয়। অনার্স থার্ড ইয়ারের ছাত্রী। বিয়ের প্রথম রাতে কি হয় তা বেশ অবগত সে। সেসব চিন্তা করতেই তার নিঃস্বাস বন্ধ হওয়ার উপক্রম। সে এখন মাহমুদ স্যারের নিবন্ধিত নারী। ফোর্স করেও করতে পারে কিছু স্যার। ঠোঁটকাটা স্বভাবের মানুষ যিনি। তার মুখ, হাত ননস্টপ চলবে মনে হয়। কি করবে কলি। পালাবে কোথায়। যাকে সবসময় শিক্ষকের চোখে দেখে আসছে। আজ সে তার বিয়ে করা বউ। তার সবকিছু সে দেখবে। উপভোগ করবে। হায়! লজ্জায় তার মরি মরি দশা। স্যার কি তাকে কিছুদিন সময় দিবে আস্তেধীরে সহজ হওয়ার জন্য? মাহমুদ স্যার এখন তার স্বামী। এটা চিন্তা করতেই কলির প্রাণ উষ্ঠাগত!
বাসর রাত নব বর বধূর জন্য স্বপ্নের রাত। সুখের রাত। জেগে থাকার রাত। উপভোগের রাত। একে অপরের সঙ্গে মিশে একাকার হয়ে যাওয়ার রাত।
মাহমুদ এক চিলতে বারান্দা থেকে একটু ঘুরে রুমে আসলো। ফুলের পাপড়ি ছড়ানো বিছানার একপাশে উঠে বসলো। একটা বালিশ নিয়ে হেলান দিলো আধশোয়ার মত হয়ে। নিজের একপায়ের উপর আরেক পা তুলে দিলো। কলির দিকে অবশ চোখে চেয়ে আছে। ঘোমটা ও মাথা ঝুঁকে থাকার জন্য কলি মাহমুদের মুখাভঙ্গি দেখতে পাচ্ছে না।
মাহমুদ স্থির গলায় বলল,
“মাথা তুলে সোজা হয়ে বসুন কলি। যেভাবে ঢুলে যাচ্ছেন, মেরুদণ্ড বাঁকা হয়ে যাবে। ডাক্তারও সোজা করতে পারবে না।”
কলি একটু সোজা হলো মাথা তুলে। মাহমুদ কলির মুখটা ভালো করে দেখার জন্যই এটা বলল।
“এইতো। গুড গার্ল। আমি জানি আপনি কি কি ভাবছেন? তাই সেগুলো জানতে চাইবো না। বলুন আপনার বিয়ের প্রথম রজনী কিভাবে উপভোগ করতে চান?”
কলি আঁখিপল্লব বুঁজে ফেলল লজ্জায়। মৌন হয়ে আছে।
“কি প্রশ্ন করলাম? ওহে পুষ্পকলি?”
কলি ছোট্র করে অস্ফুট স্বরে বলল,
“কিছুই চাইনা স্যার।”
মাহমুদ গম্ভীর গলায় বলল,
“বাসর রজনী উপভোগ করতে কে না চায়? এভাবেই বসে থাকতে চান সারারাত্রি?”
“ঘুমাবো স্যার। ক্লান্ত লাগছে।”
ক্ষীণ স্বরে বলল কলি।
“ক্লান্ত লাগছে? ক্লান্ত লাগার মতো পরিশ্রম না করেই ক্লান্ত। শরীর মন বেশী উইক নাকি?”
শক্ত গলায় বলল মাহমুদ। কলি চুপ করে আছে মুখ ভিড়িয়ে।
“ঠিক আছে। ঘুমান। কিন্তু শরীরের গহনা,পোশাক, না খুলে ঘুমাতে পারবেন না। বাসরঘরে নাকি বউদের এসব স্বামীরা ঘুলে দেয়। মানে গহনাগুলো আমি খুলে দিবো?”
“নাহ। আমিই পারবো।”
“ওকে আপনি খুলুন।”
কলি থম মেরে আছে। একই অবস্থায় বসা থেকে হাত উল্টিয়ে গলার জড়োয়া নেকলেস খোলার চেষ্টা করছে। কিন্তু পারছে না বারবার চেষ্টা করেও। অগত্যা নিরুপায় হয়ে মাহমুদকে বলল,
“স্যার আনুশকা আপুকে ডেকে দিবেন? আমাকে হেল্প করতে। হুকটা এত টাইট, খুলতে পারছি না।”
আচ্ছা দেখছি, বলে মাহমুদ দরজা খুলে বেরিয়ে গেলো। সবাই নিজ নিজ রুমে আছে। সে পা ঘুরিয়ে চলে এলো রুমে। বিছানার উপরে উঠে বসল। বলল,
“মধ্যরজনীতে আপনার গহনা খোলার জন্য আমি ছাড়া কাউকে পাবেন না। সবাই নিদ্রারত এখন। দেখি একটু ঘুরুন পিঠ আমার দিকে দিয়ে। আমি হেল্প করছি।”
এসব না চেঞ্জ করে ঘুমানো যাবে না কিছুতেই। অস্বস্তি লাগবে। কলি অসহায়ের মতো মাহমুদের দিকে পিঠ ঘুরিয়ে বসলো। তখন কলির বসার স্থানের দলিতমথিত হয়ে গন্ধ বিলানো ফুলের পাপড়িগুলো মাহমুদ মুঠি ভরে এক হাতে নিলো। নাকে চেপে ধরে দু’চোখ বন্ধ করে জোরে স্বাস নিলো।
মাহমুদ কলির মাথা থেকে ওড়না খুলে নিলো। কানের ঝুমকোজোড়া খুলে নিলো। ব্লাউজের পিছনের ফিতার গিঁট খুলে দিলো। গলার নেকলেস হাত দিয়ে খোলা যাচ্ছে না। হুকে দাঁত বসিয়ে খুলে নিলো। কলি শিরশির করে কেঁপে উঠলো।
” কে গলায় এটা পরালো কলি? খোলা যাচ্ছিল না দাঁতের ব্যবহার ছাড়া।”
মাহমুদের সংস্পর্শে কলির বুক ধড়ফড় করছে। মাহমুদ কলির হাত টেনে বালাগুলো খুলে দিলো। বলল,
“নিচে নেমে আসুন। শাড়ি খুলে দেই।”
কলির মুখ রক্তিম হয়ে উঠলো। মাহমুদ বলল,
“সরি। শাড়ি নয়। শাড়ির উপরে আটকানো সেফটিপিনগুলোর কথা বললাম।”
কলি বিছানার ফুলগুলো মাড়িয়ে নিচে নামলো। নিজ থেকেই মাহমুদের পা ছুঁয়ে সালাম করে ফেলো। এটা তার মা রেবেকা তাকে শিখিয়ে দিয়েছে। বিয়ের রাতে স্বামীকে সালাম করতে হয়। মাহমুদ গাড়ির ব্রেক খাওয়ার মতো চমকে উঠলো। কলির দু’বাহু ধরে দাঁড় করালো। শিহরিত চোখে বলল,
“বাসর রাতে স্বামীর পা ছুঁয়ে সালাম দেওয়া বাঙালি মেয়েদের জন্য একটা প্রচলিত রেওয়াজ। তার মানে কলি মাহমুদের বউ। এটা মানছেন?”
কলি দৃষ্টি অবনত করে রাখলো। মাহমুদ টেবিলের উপর থেকে একটি সোনার আংটির বক্স হাতে নিলো। খুলে কলির আঙ্গুলে পরিয়ে দিলো। চুমু খেতে ইচ্ছে করলেও নিজের ইমোশনকে দমিয়ে রাখলো। শুধু কলির হাতের পিঠটাকে নিজের গালে আলতো ছোঁয়ালো। বলল,
“এটাও রেওয়াজ। বউকে সালামের সালামী দিতে হয়।”
দু’হাত পিছনে গিয়ে দাঁড়ালো মাহমুদ।
কলি মাথা ঝুঁকিয়ে শাড়ির কুচির উপরিভাগের সেফটিপিনগুলো খুলতে গিয়ে পারল না। মাহমুদ কলির হাঁটুর সামনে হাঁটুগেঁড়ে বসলো। দু’হাত ব্যবহার করে সেফটিপিন সব খুলে দিলো। পরক্ষণেই দাঁড়ালো। দেখলো শাড়ির আঁচলেও কয়েকটি সেফটিপিন। সেগুলো ব্লাউজের সঙ্গে আটকানো। মাহমুদ নিজ থেকেই কলির পিঠে,কাঁধের উপরে হাত দিয়ে সেফটিপিনগুলো খুলে দিলো। মাহমুদের হাতের স্পর্শ পেয়ে কলির সারাদেহ টলছে। এমন নেশা জাগানিয়া অনুভূতির সঙ্গে সে আজই প্রথম পরিচিতি হলো।
মাহমুদ বলল,
“বাপসরে! মেয়েদের এক শাড়িতেই সেফটিনের বহর দেখি। পুরুষ হয়েছি। সেই বেশ। এই লাগেজে আপনার ব্যবহারের জন্য শাড়ি এবং সবই রয়েছে। ওটা ওয়াশরুম। ফাইনালি জানতে চাই কলি,
বাসর না হোক। একই বেডে পাশাপাশি দুজন ঘুমাই?”
কাতর স্বরে বলল মাহমুদ।
“নাহ স্যার। এতে খুব সমস্যা হবে। প্লিজ। আমাকে কিছুদিন সময় দেন। আপনি বেডে ঘুমান। আমি ফ্লোরে বিছানা করে ঘুমাতে পারবো।”
” নো নীড ডিয়ার কলি! এই পুষ্পোশোভিত বিছানা আপনার জন্য। এখানে আপনাকেই মানাবে এই রাতে। ফ্রেস হয়ে লাইট অফ করে ঘুমিয়ে পড়ুন। ডিম লাইট জ্বালিয়ে নিবেন। নয়তো পড়ে যেতে পারেন। আমি বারান্দায় আছি। গল্প করতে চাইলে আসতে পারেন।”
কথাগুলো বলেই মাহমুদ দেরী করল না। বেড সাইড টেবিলের ড্রয়ার থেকে নতুন একটি সিগারেটের প্যাকেট, গ্যাসলাইট ও মশার স্প্রে বোতলটা হাতে নিয়ে নিলো। তার তাওয়েলটা কাঁধের উপর রাখলো। চশমাটা চোখে দিয়ে বারান্দায় চলে গেলো। বাইরে থেকে দরজা চাপিয়ে দিলো। চেয়ারটাতে তাওয়েল দিয়ে বসলো। নিজের চুলগুলো খামচি দিয়ে ধরলো। ছিঁড়ে ফেলতে পারলে তার হৃদয়ের উত্তাপ কিছুটা বিলীন হতো।চোখদুটো নেশাখোরের মতো লালবর্ণ ধারণ করলো। বহুদিনের অভুক্ত মানুষের ন্যায় একের পর সিগারেট জ্বালিয়ে নিচ্ছে আর শেষ করছে। বুকের বাঁ পাশে চিনচিন ব্যথা হচ্ছে।
কলি ওয়াশরুমে চলে গেলো। শাড়ি ব্লাউজ চেঞ্জ করে নিলো। অন্য একটা নতুন সুতী শাড়ি,ব্লাউজ পরে নিলো। মুখের মেকাপ তুলে ফ্রেশ হয়ে রুমে এলো। দেখলো শৈল্পিক করে ফুলসজ্জা সজ্জিত। বিছানা ভর্তি শত ফুলের রঙিন পাপড়ি। সে সেগুলো তুলে ফেলল না। ফুলসজ্জা তার দারুন পছন্দ হলো। চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে পুরো রুম দেখলো কলি। কয়মাস আগের এই রুম আর আজকের রুমের পার্থক্য চোখে পড়ার মতো। নজর কাড়ার মতো। সে লাইট অফ করে দিয়ে ডিম লাইট জ্বালিয়ে দিলো। বিছানা থেকে গহনাগুলো তুলে টেবিলে রেখে দিলো। দুইহাঁটু ভাঁজ করে অবসাদজনিত দেহখানি এলিয়ে দিলো ফুলের পাপড়িগুলোর উপরেই। নিমিষেই তার তন্দ্রাচ্ছন্ন আঁখিযুগল গভীর নিদ্রাঘোরে তলিয়ে গেলো।
মশার স্প্রে মারার পরেও দু’একটা মশা আক্রমণ করে চলল মাহমুদের গায়ে। যেখানে সেখানে কুটকুট করে কামড়ে যাচ্ছে মশা। মাহমুদ বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। শব্দহীন পায়ে রুমের ভিতরে এলো।
গভীর রাত! নির্জন কক্ষ! ফুলেল বিছানায় ঘুমন্ত এক যুবতী। রুমের আবছায়া হলদে আলোর সব মায়া ছড়িয়ে আছে সেই যুবতীর সারা অঙ্গে। তার পাশে ঘুরঘুর করছে এক তৃষিত যুবক। কি সম্মোহনী! কি লোভনীয় পরিবেশ! তবুও যুবকটি তাকে নিবিড় আলিঙ্গন করতে পারছে না। কি সুখসুধা পাবে এভাবে মনের বাইরে তাকে ছুঁয়ে? থাকুক না সে তার মতো করে। মাহমুদ ফের চলে গেলো বারান্দায়। পূনরায় আরেকটি সিগারেট জ্বালিয়ে নিলো। বিরহের ধোঁয়া উড়িয়ে দিলো রাতের বাতাসে।
রাত্রির শেষ প্রহরে কলির ঘুম ভেঙ্গে গেলো। কোন ডিস্টার্ব হয়নি বলে একটানা ভালো ঘুম হয়েছে তার। উঠে পরনের অবিন্যস্ত শাড়ি ঠিকঠাক করে নিলো। ঝরঝরে লাগছে তার নিজের কাছে নিজেকে। কলি দেখলো গোটা রুমে সে ছাড়া কেউ নেই। তাহলে স্যার কোথায় ঘুমালো? মাহমুদকে নিয়ে কলির ভাবনাগুলো সম্পূর্ণ মিথ্যে হলো। সে চিন্তাই করতে পারেনি মাহমুদ তাকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে ছোঁবেই না। তার ইচ্ছার মূল্যায়ন করবে এত বেশী। স্যার আসলেই কেয়ারিং মনে হয়। কলির ভালোলাগা কাজ করলো মাহমুদের উপর।
কলি পা টিপেটিপে সন্তপর্ণে বারান্দায় দরজায় গিয়ে উঁকি দিলো। হালকা আলোর সাদা বাল্ব জ্বলছে। সে দেখলো মাহমুদ চেয়ারে কোনরকম কাত হয়ে ঘুমিয়ে আছে। মেঝেতে তাকাতেই তার চক্ষু চড়কগাছ হলো। সবগুলো সিগারেটের খালি অংশ পড়ে আছে বিক্ষিপ্তভাবে। খালি প্যাকেটটাও পড়ে আছে। সে বিস্মিত চোখে মাহমুদের দিকে চেয়ে রইলো। শোয়ার নিদিষ্ট স্থান না হলে ভালো ঘুম আসা অসম্ভব। তাই মাহমুদেরও ভারি ঘুম এলোনা। সে কারো অস্তিত্ব অনুভব করতেই চোখ মেলে তাকালো। দেখলো কলি ঠায় চেয়ে আছে তার মুখ পানে।
সে জড়ানো কন্ঠে বলল,
“কলি আপনি? ঘুম ভালো হয়েছে?”
“আপনি কি করলেন এটা? সারারাত এখানে ছিলেন? এত সিগারেট টানলেন? মশার যন্ত্রণা সহ্য করলেন?”
অধিকারসুলব কন্ঠে নরম গলায় বলল কলি।
“যার কপালে বাসর উদযাপন নেই। তারতো এমনই যন্ত্রণা পোহাতেই হবে। সিগারেট খাওয়া,জেগে থাকা,মশার যন্ত্রণা সহ্য করা,ড্রিংকস করা। যদিও এটায় আমি নেই। রাত পোহাতে এখনো সময় বাকি। গিয়ে রেস্ট নিন। চলে যান।”
অভিমান,অনুযোগ মিশিয়ের ভারকন্ঠে বলল মাহমুদ।
“আপনি গল্প করতে চেয়েছেন স্যার। ”
“সময়ের কাজ অসময়ে করতে নেই। এটা আপনার কথা। গল্প করার মতো মানসিক এনার্জি এখন আমার মাঝে অবশিষ্ট নেই। চলে যান বলছি।”
আদেশের ঢংয়ে বলল মাহমুদ।
কলি ম্লান মুখে বিছানায় এসে ফের শুয়ে পড়লো।
চলবে…২১
#Romantic