তোমার জন্য সব পর্ব-১৮+১৯

0
127

#তোমার_জন্য_সব -১৮
✍️ #রেহানা_পুতুল
“একদম না। ডোন্ট টাচ মি। আপনার জন্যই এই অবস্থা আমার। উঁহু মা!”

ঝাঁঝালো স্বরে চেঁচিয়ে উঠে বলল কলি।

এই প্রথম কলির রণমূর্তি দেখে মাহমুদ ভড়কে না গেলেও থমকে গেলো। একদৃষ্টিতে সে কলির দিকে চেয়ে রইলো। কলি মাথা ঝুঁকিয়ে পায়ের পাতা ধরে আছে।

মাহমুদ জিজ্ঞেস করলো,

“আমার জন্য? আমি আপনাকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়েছি?”

“কেবল শশরীরে ধাক্কা মারলেই পড়ে না মানুষ। কারো কথার আঘাতেও হোঁচট খেয়ে পড়ে যায় মানুষ।”

মাহমুদ থ বলে যায়। হা হয়ে চেয়ে থেকে বলল,

“বাহ! আমার কথা এত পাওয়ারফুল? জানতাম না। জেনে সুবিধা হলো। ইন ফিউচারে কাজে লাগবে।”

” স্যার আপনি চলে যান। আমি ট্রিটমেন্ট করিয়ে নিতে পারবো।”

এবার ছোট্ট করে বলল কলি।

” খোঁড়া মানুষের মতো পা টেনে টেনে বাসে উঠবেন কিভাবে?এতে আরো আহত হবার আশংকা। আমি সসম্মানে আপনাকে পৌঁছে দিবো বাসায়।”

ভরাট কন্ঠে বলল মাহমুদ।

“লাগবে না আপনার সসম্মান।”

“তাহলে কি অসম্মানে পৌঁছে দিবো? সেদিনের ওই দুজন বখাটে ছেলের মতো?”

কলি পালটা জবাব দিল না। ঘাড় বাঁকিয়ে বসে রইলো।

“সরি। আচরণ ভদ্রতার সীমা লংঘন করলো বোধহয়।”

ফার্মেসীর ছেলেটা এবার এলো। মাহমুদকে দেখেই সালাম দিয়ে বলল,

“স্যার আপনি?”

“তুমি কোথায় গিয়েছিলে? আমি পেশেন্ট নিয়ে আসলাম।”

ছেলেটা কলির পা দেখলো। ট্রিটমেন্ট করে ব্যথার জন্য ট্যাবলেট ও পায়ে ব্যাবহারের জন্য মলম দিয়ে দিলো। মাহমুদ টাকা দিয়ে দিলো মানিব্যাগ খুলে।

কলি দিতে চাইলে মানা করলো। বলল,
“আপনারগুলো গচ্ছিত থাকুক।
চাকরিজীবীদের বউরা সঞ্চয় করতে হয়। বিপদে কাজে লাগে।”

গম্ভীর স্বরে বলল মাহমুদ।

কলির মন চাচ্ছে মাহমুদের মাথায় ইট ভাঙ্গতে। সে ব্যথার জন্য দাঁড়াতে পারছে না। মাহমুদ হাত বাড়িয়ে দিলো কলির দিকে৷ কলি ধরল না। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে বের হয়ে গেলো। মাহমুদ বাইকে চড়ে বসে বলল,

“আসুন বলছি। পিছনে বসুন! সুবিধা যেভাবে হয় সেভাবে বসুন বিব্রত না হয়ে।”

কলি বুঝলো মাহমুদের কথার ইঙ্গিত। তবুও সে মাহমুদকে ধরে বসল না। এটা তারজন্য দুঃসাধ্য কাজ। আজ পর্যন্ত সে কোন ছেলের এতটুকু কাছাকাছি হয়েও বসেনি। সেখানে টিচারকে ধরে সাপোর্ট নিয়ে বসবে। নো। নেভার। প্রয়োজনে আবার পড়ে যাবে। পড়ে মরে যাবে। তবুও না।

কলিকে বাসার নিচে নামিয়ে দিলো মাহমুদ। “সাবধানে যাবেন।” বলে সেও চলে গেলো। বাসার নিচের গার্ড ও সেই বাড়ির দুজন লোক মাহমুদকে দেখেও কিছু মনে করল না। তারা সবাই জানে নুরুল হকের মেয়ের বাগদান হয়েছে। ছেলেরা এদের চেয়ে সচ্ছল পরিবার। নিজস্ব ফ্ল্যাট। ছেলে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। রেবেকা নিজে বাড়ির সব বাসায় মিষ্টি বিতরণ করে মেয়ের বিয়ের কথা জানিয়েছে। বাদ দেয়নি বাড়ির নিচের গার্ডদেরকে বলাও।

কলির খুঁড়িয়ে হাঁটা দেখে, জুলি গোল গোল চোখে উচ্চস্বরে জিজ্ঞেস করে উঠলো,

“আপা তোর পায়ে কি হইছে?”

রেবেকা ছুটে এলো জুলির কথা শুনতে পেয়েই। কলি নিজের রুমে চলে গেলো। ব্যাগ রেখেই বিছানায় শুয়ে পড়লো। নাকমুখ কুঁচকে বলল, কিভাবে পড়ে গেলো। রেবেকা উদ্বিগ্ন গলায় জানতে চাইলো,

“কিভাবে এলি মা এই পা নিয়ে?”

“স্যার পৌঁছে দিয়েছে আম্মু।”

লজ্জা লজ্জা স্বরে বলল কলি।

“আলহামদুলিল্লাহ। আত্মীয় ভালো পেয়েছি আমরা। নিরহংকারী তারা প্রত্যেকেই। শিক্ষক পরিবার যে। সেজন্যই তাদের বিচার বিবেচনাটা সঠিক ও সুন্দর। সামনে বিয়া সাদি। খেয়াল করে পথ চলিস। হাতমুখ ধুয়ে খেয়ে নে। ডাইনিংয়ে যেতে হবে না। জুলি এখানে ভাত এনে দিবে।”

কলি চুপচাপ শুয়ে আছে। রেবেকা সুরা ফাতিহা পাঠ করে মেয়ের মাথায় তিনবার ফুঁ দিয়ে দিলেন। চলে গেলো সংসারের আপন কাজে।

“খুব ভালো তোর মাষ্টারমশাই। তাইনা আপা? ভেরি কেয়ারিং।”

দুষ্টমিষ্ট স্বরে বলল জুলি।

“হুম বেশি ভালো। তুই কোলে উঠে বসে থাকিস।”

হেয়ালী করে বলল কলি।

“তার বউ থাকতে আমি কোন দুঃখে তার কোলে উঠবো? টিচারেরা কেয়ারিং তবে বোরিং। আমি বিয়ে করবো রোমান্টিক একটা ছেলেকে। তবে তারও মোটর বাইক থাকতে হবে। বাইকে চড়া আমার কাছে হেব্বি এনজয় লাগে। উফফস! দুই পা দুইদিকে দিয়ে জামাইয়ের পিছনে বসবো। দুই হাত দিয়ে তার পেট পেঁচিয়ে জড়িয়ে ধরবো। আমার শ্যাম্পু করা খোলা চুলগুলো হাওয়ায় উঠবে। হাওয়ায় চুল নিয়ে বেচারার নাম মুখে ছোঁয়া দিবে। সে চুলের ঘ্রাণ নিবে মুখ একপাশ করে। আমাদের দুজনের চোখে বড় স্টাইলিশ সানগ্লাস থাকবে। আমি পিছন থেকে তার পিঠের উপর গাল ঠেকিয়ে শুয়ে থাকবো। রোমাঞ্চটা জোস না আপা?”

“তার যদি বাইক না থাকে? দেন?” বলল কলি।

“কিনে নিবে। শিখে নিবে। এটা বিয়ের আগেই কন্ডিশন দিয়ে দিব। আর যদি থাকে,তাহলেত কেল্লাফতে। মাস্তি আর মাস্তি।”

কলি নাক মুখ খিঁচিয়ে অদ্ভুত চাহনি তাক করলো কিশোরী ছোটবোনের দিকে৷ বলল,

“তোর মাথায় এসব আজেবাজে ভাবনা কে দেয়? ক্লাসে কাদের সাথে মিশিস তুই? নিলজ্জ্ব কোথাকার। বড় বোনের সঙ্গে কিভাবে কথা বলতে হয় জানিস না? দিন দিন বেহায়া হয়ে যাচ্ছিস। তোর পড়াশোনা ধরবো আমি। দেখিস। টিকটক করা তোর বন্ধ।”

“হুহ্! নিজে এক বোরিং। কপালে জুটছে আরেক বোরিং পারসন। তার বাইক থাকলেও যা রিকসা থাকলেও তা। যাহা লাউ তাহাই কদু। তোরা আনন্দের কি বুঝিস। ঠিকই আছে তোর সঙ্গে বোরিং এক মাষ্টার ব্যাডার বিয়ে হবে। যে লোক নিজের এনগেজমেন্টেও আসে না। সে যে কি পরিমাণ ছ্যাবলার ছ্যাবলা আর ক্যাবলার ক্যাবলা পুরুষ। তা আমি খুউব বুঝছি।”

ঠোঁট উল্টিয়ে কথাগুলো বলল ঝুলি।
কলি চেঁচিয়ে উঠার আগেই জুলি লম্বা লম্বা পায়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। একটু পর এসে ভাত দিয়ে গেলো কলির পড়ার টেবিলে। জুলির কথাবার্তায় কলির মনে সন্দেহ দানা বাঁধল। জুলি প্রেমে ট্রেমে পড়ল নাকি। কলি উঠে ফ্রেস হয়ে ভাত খেয়ে আবার শুয়ে পড়লো।

নুরুল হক অফিস থেকে বাসায় ফিরলেন। মেয়ে পায়ে ব্যথা পেয়েছে শুনেই শশব্যস্ত হয়ে এলেন মেয়ের রুমে। পা ধরে দেখলেন মনোযোগের সহিত। মেয়ের মাথায় পিতৃস্নেহের পরশ বুলিয়ে দিলেন বার কয়েক। সতর্ক হয়ে পথ চলতে উপদেশ দিলেন।

মাহফুজা একমাত্র ছেলের বিয়ে নিয়ে অতিরিক্ত এক্সাইটেড হয়ে থাকে রাতদিন। বাসায় নিত্যকার কাজ শেষ হয়ে যখনই ফুরসত মিলে, কাগজ কলম নিয়ে বসে যায়। কিভাবে কি করবে। আয়োজনের কমতি রাখতে চায় না সে। মনের মতো একটা মেয়েকে সে জনমের জন্য পেয়ে যাচ্ছে। ঘাটতি থাকবে কেন? আনুশকা ও কলি তার দুজন মেয়ে। কলিকে সে কোনদিনই পুত্রবধূর নজরে দেখবে না। নিজের মেয়ের মতো দেখবে। আদর করবে। কলিও তাকে মায়ের মতই দেখবে। এটা তার ধারণা নয় শুধু পূর্ণ আস্থা কলির উপরে।

আনুশকাও স্বশুরের বাসায় অবসর হলেই নোট প্যাড নিয়ে বসে যায়। সবকিছুর লিস্ট করতে থাকে সিরিয়াল অনুযায়ী। দেশের বাইরে থাকা স্বামীর সঙ্গেও ভাইয়ের বিয়ে নিয়েই গল্প করে আজকাল। কলিকে সে বোনের মতো দেখবে। কাল ননদী খেতাব চায়না সে। শিক্ষক পিতার আদর্শ সন্তান তারা দুই ভাইবোন। সংসারে শান্তি ও আনন্দের পরিবেশ বজায় রাখার সমস্ত শিক্ষা ও দিক্ষা দিয়ে তাদের বড় করেছে মা, বাবা।

রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কলির পায়ের পাতা ফুলে গিয়েছে। মলম লাগিয়ে নিলো। মেডিসিন খেলো। তবুও ব্যথায় টনটন করছে পুরো পা। মাহমুদের উপর প্রচন্ড ক্ষেপে গেলো কলি। ক্লাসে সবার সামনে অমন বিদ্রুপ করে কথাটা না বললেই কি হতো না তাকে। এমন সময় কলির মোবাইল বেজে উঠলো।

স্ক্রিনে জ্বলে উঠলো ‘বদ মাহমুদ স্যার।’ বদ শব্দটা আগে ছিল না। কলিকে বারবার কটাক্ষ করে কথা বলাতে কলি এডিট করে বদ শব্দ যোগ করেছে মাহমুদ শব্দের আগে। এখন যেহেতু তার ভাষায় সেই বদের সঙ্গেই বিয়ে হতে যাচ্ছে,তাই সেদিন আবার বদ শব্দটি ছেঁটে ফেলবে। কলি রিসিভ করে সালাম দিলো।

কেমন আছেন না জিজ্ঞেস করে মাহমুদ সরাসরি জিজ্ঞেস করলো,

“আপনার পায়ের খবর নিতে ফোন দিলাম। আপনার ভাষায় আমিই দোষী। জানি আচ্ছামতে ঝাড়ছেন আমায়। পা ফুলে গিয়েছে?”

“হুম।”

“রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে যেকোনো যন্ত্রণা প্রকট আকার ধারণ করে। এবং সেটা শরীর, মন দুটোরই।”

“জানি ঢের।”

“এমন সবকিছু জানলে ভালো হয়। বেডে শুয়ে আছেন?”

“হুম।”

“ভিড়িও কল দিবো পা দেখার জন্য?”

“আপনি ডাক্তার নয়। পা দেখে কোন কাজ নেই।”

“ওহ আচ্ছা। সেটাই।”

কলি মৌন রইলো এপ্রান্তে৷ গান শুনতে তার খুব ভালোলাগে। সুরে সে মাতোয়ারা। খাওয়া ভুলে গিয়েও সে গানে ডুবে থাকতে পারে।
সেদিন স্যারের ভরাট কন্ঠে পুরোনো দিনের রোমান্টিক গানটা অস্থির লেগেছে। এখন যদি দু’লাইন গান শুনতে পেতো তার ভালোলাগতো। ইউটিউবে শোনা যায়। লাইভ শোনার সুযোগ থেকে ইউটিউবের টা শুনবে কেন। এমন ভাবনা থেকেই কলি চট করে বলে ফেলল,
“স্যার দুলাইন গান শোনাবেন?”

বলেই কলি নিজের জিভ কামড়ে ধরলো। ওহ শিট! চাওয়াটা কি শোভনীয় হলো? কি ভাববে মানুষটা এবার?

মাহমুদ হঠাৎ ধাক্কা খাওয়ার মতো নড়ে উঠলো। এদিক ওদিক চাইলো তার খালি রুমের মধ্যে। ভুল কিছু শুনলো নাকি। কলির মতো নিরস, মুডি,বেরসিক টাইপের মেয়ে এই প্রথম এমন কিছুর আবদার করলো তার কাছে। তার বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে। সে না শোনার ভান করে জিজ্ঞেস করলো,

“কলি কি বললেন? ভালো করে শুনতে পাইনি।”

“কিছু বলিনি স্যার। রাখতে পারেন।”

কলি ঘাড় হেলিয়ে বালিশে কাত হয়ে শুয়ে আছে। কানে হেডসেট লাগনো। তার কানে ভেসে এলো মাহমুদের কন্ঠ হতে ভালোবাসার গান।

” তাকিয়া আসমানের দিকে/সে কি বলো আছে সুখে?
ভাবিয়া কান্দিয়া মরি/সে যে পাশে নাই।

বিধাতা আমাকে বলো,
কোথায় গেলে তারে পাবো?
যন্ত্রণাগুলো আমাকে/ভেতরে পোড়ায়।

ভাবতে ভাবতে তারে আমি/
চোখ বুজিয়া জড়াই ধরি।🫂
চোখ মেলিয়া দেখি আমি
সে যে বুকে নাই….”

কলির দু’চোখ আবেশে জড়িয়ে এলো।
মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনলো।

“কলিইই…”

” হুঁ… হুঁ স্যার। অশেষ ধন্যবাদ। আপনি না শুনতে পাননি?”
ঘোর লাগা কন্ঠে বলল কলি।

মাহমুদ কলির বাচ্চামো কন্ঠ শুনে নিজের বুকের বামপাশ চেপে ধরলো হাত দিয়ে। একটা সুক্ষ্ম ব্যথা অনুভব করলো তার বুকের চিলেকোঠায়। নিজেকে সামলে নিয়ে মধুর হেসে ফেলল। বলল,

“কলি,আজ আপনাকে নিয়ে আমার ইচ্ছেটা অন্যরকম ছিলো। কিন্তু হায় বিধিবাম! হলো না। আপনার পা ভালো হোক। তবেই সেই কাজটা করবো। দিবেন ত আমার ক্ষুদ্র ইচ্ছেটা পূরণ করতে?”

কলি মনে মনে বলল,

হায়রে প্রেমিক জাতি। তোমরা লায় পেলেই উঠে যাও জায়গামতো। তারপর বলল,
“হয়তো। বিবেচনা করে দেখতে হবে।”

“হয়তো? দ্যাটস মিন নট সিউর?”

“মেইবি।”

” মনীষীগণ বলেছেন, বড় সাধ পূর্ণ করতে না পারো,কিন্তু তোমার টুকরো সাধগুলো মেটাতে ভুল করো না। জীবন ক্ষণস্থায়ী। তাই যত পারো আনন্দ করো। আনন্দের মাঝে বেঁচে থাকো।”

মুঠোফোনের ওপ্রান্তে প্রলম্ভিত স্বাস ফেলে ঠান্ডা গলায় বলল মাহমুদ।

“কোন মনীষী বলেছে এই কথাগুলো স্যার? ”

“আপাতত ধরে নিন মাহমুদ মনীষী বলেছে।”

কলি আনন্দ পেল না মাহমুদের কথায়। সে ভার গলায় বলল,

“স্যার আপনার সঙ্গে আমার গুরুত্বপূর্ণ আলাপ আছে।”

“ওহ সিউর কলি। বলুন। কান পেতে আছি।”

“এখন নয়। পরে অবশ্যই বলবো।”

কলির শুকনো গলায় কথাটা শুনে মাহমুদ চিন্তায় পড়ে গেলো। বিয়ে পড়ানোর পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত এই মেয়ের কোন ভরসা নেই। না জানি আবার কোন কঠিন শর্ত নিয়ে হাজির হয় এই হৃদয়হীনা মেয়েটি।

চলবে…১৮

#তোমার_জন্য_সব -১৯
✍️ #রেহানা_পুতুল
স্যার আপনার সঙ্গে আমার গুরুত্বপূর্ণ আলাপ আছে।”

“ওহ সিউর কলি। বলুন। কান পেতে আছি।”

“এখন নয়। পরে অবশ্যই বলবো।”

কলির শুকনো গলায় কথাটা শুনে মাহমুদ চিন্তায় পড়ে গেলো। বিয়ে পড়ানোর পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত এই মেয়ের কোন ভরসা নেই। না জানি আবার কোন কঠিন শর্ত নিয়ে হাজির হয় এই হৃদয়হীনা!

ওর শর্ত টা কি হতে পারে? অন্য কিছু? অন্যকিছু হলে বিবেচনা করা যায়। কিন্তু অন্যকিছু নয়। এটা একশো পার্সেন্ট সিউর। নিশ্চয়ই সেই অমানবিক আবদার। বিয়ে এক বছর পেছানো। নো ফুলকলি। সেটা কিছুতেই হবে না। দুই পরিবার মিলে যেখানে ডেট পাকা করে ফেলল,সেটা পেছানো এখন কোনভাবেই সম্ভব নয়। বিয়েটা কি ছেলেখেলা ওহে ফুলকলি। এমন সব ভাবনার বেড়াজালে আটকে গিয়ে ছটপটাতে লাগলো মাহমুদ।

কলি শুয়ে শুয়ে ভাবছে, অন্তত এর থেকে গান শোনা যাবে আর যাইহোক। এটা একটা ভালোলাগার দিক তারজন্য। কিন্তু কিভাবে তাকে সব উজাড় করে দিবো। শেইম! শেইম!

পা ভালো হলে কলি ক্লাসে গেল। কলি চোরাচোখে মাহমুদের আপাদমস্তক দেখে নিলো এক ঝলক। চমকিত মনে বলল,

কি ব্যাপার? এই বান্দা আজ প্রেমিকের সুরত নিয়ে হাজির হলো? নিউ জিন্স,নিউ টিশার্ট। যুবক থেকে তরুণ হয়ে গেলো দেখি। ঝরঝরে ঘন চুলগুলো আজ বেশ উড়ু উড়ু। অন্যদিনের চেয়ে বেশী স্মার্ট ও সুন্দর লাগছে। কাহিনী কি? যাক গা। খাল্লি বাল্লি।

মাহমুদ ক্লাসে কলিকে মুখে কিছু বলল না। চোখের ইশারাতেও কিছু বলল না। সে পরিবেশ বুঝে চলতে জানে। সীমা লংঘন না করার ক্ষমতা তার যথেষ্ট। ভার্সিটিতে সে আগের মতই কলির সঙ্গে টিচার, স্টুডেন্ট সম্পর্ক বজায় রেখে চলতে লাগলো। বরং একটু বেশিই সতর্ক হয়ে চলে। কলি যেন বিরক্ত না হয় সেদিকে বিশেষ সজাগ থাকে। পারসন হিসেবে মাহমুদ খুব কেয়ারিং প্রতিটি মানুষের ক্ষেত্রেই।

সে অফিসে এসে মেসেজ দিলো,

“কলি ‘ডার্লিং’রেস্টুরেন্টে চলে যাবেন। খুব জরুরী কথা আছে।”

‘খুব’ শব্দটা মাহমুদ ইচ্ছে করে ব্যবহার করেছে কলিকে গুরুত্ব বোঝানোর জন্য। নয়তো কলি নাও আসতে পারে।
কলি ভ্রুযুগল কুঞ্চিত করে বলল,

দরকারতো আমার নিজেরই। কলি এক শব্দে ফিরতি মেসেজ দিলো।

“আচ্ছা স্যার।”

মাহমুদ ঠোঁট ভিড়িয়ে বাঁকা হাসি হাসলো। এ কি বিয়ের পরেও আমাকে স্যার স্যার করতে থাকবে নাকি। আগে অধিকারে আসুক রমনী।

কলি ‘ ডার্লিং ‘রেস্টুরেন্ট আগেই পৌঁছে গিয়েছে। এর নাম বন্ধুদের কাছে সে আগেও শুনেছে। কিন্তু সে এলো আজই প্রথম। সে পুরো রেস্টুরেন্টে বার দুয়েক মোহনীয় দৃষ্টি ঘুরিয়ে নিলো।
অদ্ভুত সম্মোহনী পরিবেশ ‘ডার্লিং’ এর ভিতরে। কৃত্রিম সবুজাভ গাছগাছালী দিয়ে সজ্জিত। হালকা আলোর লাইটিং। রয়েছে একটি ছোট্ট পানির ফোয়ারা। নিচে দেয়া হয়েছে অসংখ্য পাথর। স্বচ্ছ পানিতে পাথরগুলো দেখতে বেশ নান্দনিক লাগছে। প্রতি টেবিলে কাপল বসা। টেবিলগুলো বাঁশের ছোট্টো বেড়ার বেষ্টনীতে ঘেরা। কলি এদিক ওদিক তাকাচ্ছে।
একজন ওয়েটার এগিয়ে এলো। জিজ্ঞেস করলো,

“ম্যাম আপনি কলি?”

“হ্যাঁ।”

“আপনি এদিকে আসুন। স্যার আগেই রিসিপশনে ফোন করে বুক দিয়ে রেখেছে।”

কলি ছেলেটার সঙ্গে হেঁটে গেলো। ওয়েটার একদম লাস্টের কর্ণারের টেবিলে নিয়ে গেলো কলিকে।

” এটা আপনাদের দুজনের। বসুন ম্যাম। ”

কলি বসলো। টেবিলে মেন্যুলিস্ট , গ্লাস,টিস্যু রাখা আগে থেকেই। সে খেয়াল করে দেখলো পুরো রেস্টুরেন্টে এসাইডটাই কাপল জোন। তার মানে এটা কাপল ফেভার রেস্টুরেন্ট।
সিঙ্গেল চেয়ার নেই এখানে। একটা টেবিলের জন্য একটাই বেঞ্চ দুজন বসার হিসেবে। বলা যায় একটা মিনি রুম। কলি আশ্চর্য হলো ! বিরক্তি জমা হলো চোখের পাড়ে। এত নিরিবিলি প্রাইভেট প্লেস কেন বুকিং দিলো?

মাহমুদ ভার্সিটির সামনের পরিচিত কাঁচাফুলের দোকানটার গেলো। বাইক থেকে নেমে গেলো। আদেশ দিয়ে বলল,

“মামা যত রকমের ফুল আছে। সবগুলো থেকে একটা করে নিয়ে সুন্দর একটা পুষ্পতোড়া রেডি করুন।”

ফুল দোকানী হাতের কাজ রেখে দিলো। মাহমুদের অর্ডারের কাজ ধরলো। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক বলে কথা। অতিরিক্ত ইজ্জত দিতেই হয়। মাহমুদ সব ফুল দেখে দুটো টকটকে তাজা বড় লাল গোলাপ বেছে নিলো। সেই দুটো গোলাপ আলাদা রাখলো। একটা সিগারেট জ্বালিয়ে নিলো ফুটপাতের উপরে এসে। কয়েকটা সুখটান দিয়ে ধোঁয়া উড়িয়ে দিলো শূন্যের মাঝে। ভাবলো,

আরেহ মদন মাহমুদ, তুইতো হেব্বি প্রেমিক পুরুষ হয়ে গেলি কলির ব্যক্তিত্বের প্রেমে পড়ে। প্রেম এমনিই বুঝলি। জগতের বড় বড় মহাপুরুষেরাও ভালোবাসার মানুষ পেলে কাবু হয়ে যায়। আর তুই ত কোন ছার। হাহ! তোর আজকের ক্যালকুলেশন ঠিকই আছে। হবু বউকে বিয়ের আগে একটু ইজি করে নিতে হয়।

ফুলের তোড়া প্রস্তত হয়ে গেলো। দামাদামিতে গেল না মাহমুদ। ফুল বিক্রেতা চা চাইলো তাই দিলো মাহমুদ। ফুলগুলোকে যত্ন করে বাইকে রাখলো। বাইক ছেড়ে গেলো দুর্বার গতিতে। ফুল বিক্রেতা মুচকি হাসলো মাহমুদের যাওয়ার ভঙ্গি দেখে। সে বিড়বিড়িয়ে বলল,

মাষ্টার সাব কি প্রেমে পড়ছে? না বিয়া ঠিক হইছে? হইলে আমার কি। এই ভেবেই বিক্রেতা তার বেসুরো গলায় গেয়ে উঠলো বারি সিদ্দিকীর বিখ্যাত বিচ্ছেদের গানের দু’চরণ।

“আষাঢ় মাইস্যা ভাসা পানি রে /পুবালী বাতাসে-বাদাম দেইখ্যা/ চাইয়া থাকি,
আমার নি কেউ আসে রে।
যেদিন হতে নতুন পানি আসল বাড়ির ঘাটে/
অভাগিনীর মনে কত শত কথা উঠে রে…”

কলি বসে বসে মোবাইলে ইউটিউবে একটা সিনেমার ট্রেইলার দেখছে। মাহমুদ তার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। কলি চোখ তুলে তাকাতেই তব্দা খেলো। মাহমুদের চোখে বড় সানগ্লাস। অধরকোণে ঝুলছে মৃদু রোমাঞ্চিত হাসি। হাতে এক গুচ্ছ ফুলের তোড়া। বাকি হাত পিছনে লুকানো। দেখা যাচ্ছে না। ভীষণ সুন্দর ও রোমান্টিক লাগছে। পরিবেসশের সঙ্গে উপযুক্ত গেট আপ।

আচ্ছা! তাহলে এইজন্যই আজ প্রেমিক সাজ উনার। ‘ডার্লিং’ এ আমাকে নিয়ে আসা। বুঝলাম।
দোল খাওয়া অনভূতি নিয়ে গোপনে উচ্চারণ করলো কলি।

মাহমুদ দাঁড়িয়েই রইলো। পিছনে তার গোলাপ ধরে রাখা হাতটি সামনে নিয়ে এলো। কলির সামনে বাড়িয়ে ধরলো।নিবেদিত কন্ঠে বলল,

“কলিকে ভালোবাসি।”

কলি চমকে উঠলো। কাঁপা কাঁপা হাতে ফুলটি ধরলো। সানগ্লাসে ঢাকা মাহমুদের দু’চোখ। কলি তার চোখের ভাষা পড়তে পারল না। কন্ঠকে খাদে নামিয়ে লাজুক স্বরে বলল,

“থ্যাংক ইউ স্যার।”

“ইউ আর মোস্ট ওয়েলকাম।”

মাহমুদ ফুলের তোড়ার পাশ থেকে আরেকটি সিঙ্গেল গোলাপ কলির দিকে বাড়িয়ে ধরলো। কলি জিজ্ঞাসু চোখে মাহমুদের মুখে চাইলো।

“সেটা দিয়ে আমি আপনাকে ভালোবাসার প্রপোজ করেছি। আর এটা আপনার হয়ে কিনেছি। আপনি ত আর আমার জন্য ফুলও কিনবেন না। প্রপোজও করবে না। আমি যেচে নিচ্ছি আর কি। সেটা আমাকে দিন। শুনিয়ে না বলুন। মনে মনে যা বলার তা বলুন। হৃদয়ের কথা আমি হৃদয় দিয়ে অনুভব করে নিবো।”

কলি গোলাপটি বাড়িয়ে ধরলো মাহমুদের দিকে। মাহমুদ প্রাণ দিয়ে কলির হাত থেকে গোলাপটি নিলো। কলির পাশে বসে পড়লো। কলি বেঞ্চের শেষ মাথায় গিয়ে দেয়াল ঠেসে বসল। মাহমুদ সানগ্লাস খুলে টেবিলের উপরে রাখলো। ফুলের তোড়াটি দু’হাত দিয়ে ধরে কলির দিকে বাড়িয়ে ধরলো।

“শুভ বিবাহ মোবারকবাদ। আপনার অনাগত যুগল জীবন মধুর ও শান্তির হোক।”

কলি হাত বাড়িয়ে ফুলের তোড়াটি নিলো। ভিতরে এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। তবুও যথাসম্ভব নিজের মাঝে কাঠিন্যতা ধরে রাখলো। কলি ফুল নিয়ে কিছু বলল না। মাহমুদ নিজ থেকেই বলল,

“আমাদের পরিবারে আমরা সবাই যেকোনো কিছু আর্টের সঙ্গে শুরু করি। আপনার বিয়ে ঠিক হয়েছে। আজকের সেলিব্রেশনটা সেদিনই করার ইচ্ছে ছিলো। বিয়েতে ইনভাইটেশন যেন পাই।”

কলি মৌন রইলো। সে নিজেও জানে তার কেমন লাগছে। মাহমুদ বলল,

“অর্ডার করেছেন কলি?”

” না স্যার। আপনি দেন।”

মাহমুদ চিকেন ফ্রাইড রাইস অর্ডার করলো। কলি পূর্বের অবস্থান ও অবস্থাতে থেকেই খেয়ে নিলো। মাহমুদ কলির দিকে চেয়ে বলল,

” দেয়াল ভেঙ্গে পড়ে যাবেন। এদিকে এসে বসুন।”

কলি না শোনার ভান করে রইলো।
মাহমুদ এক হাত প্রসারিত করে দিলো কলির দিকে। কলি ভ্রুক্ষেপহীনভাবে চেয়ে রইলো অন্যদিকে। মাহমুদ প্রথমে উঠে দাঁড়ালো সোজাসুজি হয়ে। কলি মনে করলো হয়তো ওয়াশরুমে যাবে। কিন্তু না। মাহমুদ তার খুব কাছে গিয়ে বসে পড়লো।

টেবিলের নিচ দিয়ে হাত বাড়িয়ে খপ করে কলির একহাত ধরে ফেলল। কলি হাত মোচড়ামুচড়ি করতে লাগলো। কিন্তু পারছে না আলগা করতে। এমতাবস্থায় তাদের দুজনের চোখ গেলো মাত্র চারহাত দূরত্বে পাশের টেবিলের এক জোড়া কপোত-কপোতীর দিকে। তাদের দুই জোড়া ঠোঁট একজোড়া হয়ে আছে। বেড়ার ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে একটু একটু তাদের অন্তরঙ্গ মুহূর্তখানি। তারা দুজন কাজটাতে এতটাই বিভোর হয়ে আছে। যেন প্রতিযোগিতায় নেমেছে অন্য টেবিলের কাপলদের একই কাজের সঙ্গে। যে জুটি যত দীর্ঘসময় অধরে গাঢ় চুম্বন করে যেতে পারবে। তাকে কর্তৃপক্ষ হতে বিশেষ পুরুস্কার দেওয়া হবে।

মাহমুদের প্রেমিকচিত্ত প্রশ্রয় পেয়ে উঠলো। কলির ঘাড়ে ফুঁ দিলো দুবার। কলির কপালের অবাধ্য চুলগুলোকে কানের পিছনে গুঁজে দিয়ে বলল,

“আচ্ছা এমন একটা রোমাঞ্চকর কাজের পুরুস্কার কি হতে পারে বলুন তো?”

কলির লজ্জার সীমা রইল না। মাথা নামিয়ে বসে রইলো। অসহিষ্ণু গলায় বলে উঠলো,

“স্যার কি করছেন? এমন অসভ্যতামি করার জন্য এখানে আসা?”

মাহমুদ কলির হাত ছেড়ে দিলো। দুটো আঙ্গুল কলির ঘাড় থেকে একটু নিচে বুকের উপরে এনে থামালো। বলল,

“মেয়েদের বুক ফাটে তবু মুখ ফাটে না। এই প্রবাদটা জানি। আবার একটা গান আছে না কি যেন? ওহ। মনে পড়েছে। ‘বাহির বলে দূরে থাকুক ভিতর বলে আসুক না।’
আমার সান্নিধ্য কি আপনাকে আনন্দ দান করেনি কলি? আর শুনুন মিস কলি, হাজব্যান্ড ওয়াইফ হয়ে জীবনকে উপভোগ করা আর গার্লফ্রেন্ড, বয়ফ্রেন্ড হয়ে উপভোগ করার বিশাল পার্থক্য। ক্লিয়ার? মন্দ কিছুই করিনি। অকারণে অপবাদ দিলেন। সেলিব্রেট করার জন্য এমন পরিবেশ পারফেক্ট। এটাই ছিলো মূখ্য।”

কলি থম মেয়ে বসে রইলো।

“ও হ্যাঁ। যেহেতু আমরা দুজন পূর্ব পরিচিত। সেই সুবাদে বিয়ের সাজপোশাক বা সবকিছু নিয়ে আপনার ব্যক্তিগত কোন সাধ থাকলে বলতে পারেন। আমি সর্বস্ব দিয়ে আপনার সেই সাধ পূর্ণ করার চেষ্টা করবো।”.

” নাহ স্যার। আমার এই বিষয়ে কোন চাওয়া পাওয়া নেই। এটা লাভ ম্যারেজ নয়। ‘অ্যারেঞ্জ ম্যারেজ।”

চাহনি অন্যদিকে ফেলে জানাল কলি।

” তাহলে বুঝি কিছু বলা যায় না? হতে পারে। এই হাদিস বা রুলস আমার অজানা। এনিওয়ে,
আমার পার্ট শেষ। আপনি কি যেন বলবেন? প্লিজ বলুন। নিউ কোন কন্ডিশন বিয়ে নিয়ে?”

” নাহ স্যার। তবে কন্ডিশন।”
অফ মুডে বলল কলি।

“কন্ডিশন আর কন্ডিশন। হায়রে। বলুন?”

“বিষয়টা আমার পরিবার নিয়ে স্যার।”

” ওহ হো! সিউর কলি। প্লিজ।”

কলির মুখ ম্লান। দৃষ্টি আনমনা। কন্ঠ ভারি। সে বলতে লাগলো,

চলবে…১৯

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে