#তোমার_জন্য_সব *১৪
✍️ #রেহানা_পুতুল
কলি মেঘমন্দ্র মুখে বিড়বিড়িয়ে বলল,
“আমার পছন্দের খেতা পুড়ি। এক জীবনে যার একজন ছেলে বন্ধু জুটল না কপালে। তার আবার বিয়ের পাত্র পছন্দ। তার পছন্দের গুরুত্ব থাকলে এই কাহিনী করতে না তোমরা আমার সঙ্গে।”
কয়েকদিন আগে মাহমুদ যখন কলির সঙ্গে কথা বলল। তখনই নিশ্চিত হয়ে গিয়েছে সে,কলির সঙ্গে প্রেম নয় কেবল বন্ধুত্ব করাও যাবে না। সে বাসায় গিয়ে অবসর হয়ে মাকে নিজের রুমে ডাকলো। গম্ভীরমুখে বলল,
“মা কলিকে তোমার পুত্রবধূ করা যাবে না। বাদ দাও।”
“কেন? কলি রিফিউজড করেছে তোকে?”
শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করলো মাহফুজা।
মাহমুদ মাকে সব বলল ক্লিয়ার করে।
“আচ্ছা বুঝলাম। তোর কলিকে পছন্দ কিনা সেটা বল? বাকিটা আমি দেখছি।”
“হুম খারাপ না। যতটুকু দেখেছি ওকে। খুব ভালো মেয়ে মনে হয়েছে।”
হেয়ালি স্বরে জবাব দিলো মাহমুদ।
“খারাপ না মানে কি? দ্বিধায় থেকে বিয়ের মতো সিরিয়াস বিষয়ে এগোনো যায় না। স্পষ্ট করে বল। কলি মেয়েটাকে বিয়ে করতে চাস কি চাস না।”
কপালে ভাঁজ ফেলে ভ্রু কুঁচকে মৃদু ধমকে বলল মাহফুজা।
“চাই।”
নিচু স্বরে উত্তর দিলো মাহমুদ।
” গুড! তাহলে সনাতন পদ্ধতিতে যেতে হবে। তার বাবা মায়ের ফোন নাম্বার আছে তোর কাছে?”
“না। তাদের নাম্বার আমি কই পাবো?”
“তুই তাদের বাড়ি চিনিস না?”
“হুম। পৌঁছে দিলাম যেদিন। দেখলাম ত।”
“তাহলে বাড়ির কেয়ারটেকারের কাছ থেকে তার বাবার নাম্বার যোগাড় করে দে আমাকে। কালই দিস। লেট করিস না।”
রাতে মাহমুদ তার ডায়েরিটা নিয়ে বসলো টেবিলে। এই প্রথম কলিকে বা কোন মেয়েকে নিয়ে তার ডায়রিতে লিখা। রুল টানা ডায়েরির একটি খালি পৃষ্ঠায় সে লিখলো,
” পৃথিবীতে তীব্র যন্ত্রণাগুলোর মধ্যে একটি যন্ত্রণা হলো কাউকে কিছু বলতে চেয়েও বলতে না পারা।” আবার লিখলো,
“কিছুদিন ধরে এক রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হলাম আমি। রা*গ,ক্রোধ,বিরক্তি,অভিমান থেকেও যে ভালোলাগা জন্ম হতে পারে তা আমার কাছে অচিন্তনীয় ছিলো। বলা যায় আমার জীবনে এটা এক অবিস্মরণীয় ঘটনা।
কে জানতো ক্লাসের শেষ বেঞ্চে ভর দুপুরের নিঃসঙ্গ গাঙচিলের মতো বসে থাকা শান্ত মেয়েটি আমার অবসরের কল্পনার সঙ্গী হবে। তার প্রতি আমি এক অজানা শিহরণ অনুভব করব। সে যত দূরে যায়। আমার হৃদয় তত তাকে কাছে চায়। তাকে আমি সামনের চেয়ে আড়ালে বেশি দেখি। আজকাল নিজেকে দিক হারিয়ে দিশেহারা নাবিকের মতো মনে হয়। সেই মেয়েটিই যেন আমার একমাত্র দিশা। ভালোবাসা বুঝি এমনি। যার কবলে পড়ে নিঃশ্ব হয়েছে ধরণীর কতশত মহাপুরুষগণ।”
মাহমুদ কলিকে নিয়ে ভাবতে ভাবতে নিদ্রা-ঘোরে হারিয়ে যায়। তার পরেরদিন সে ভার্সিটি থেকে সোজা কলিদের বাসার নিচে চলে যায়। নাম্বার নিয়ে নেয় কলির বাবা নুরুল হকের। মাহমুদা আবদুর রহমানকে বলল কলির বাবাকে বিয়ের প্রস্তাব দিতে। তিনি ফোন দিলেন কলির বাবাকে।
নুরুল হক রেবেকা,বড় মেয়ে মিলি,মিলির জামাই হারুনের সঙ্গে আলাপ করলেন। তারা সহমত জানালো সব শুনে। এভাবে ফোনালাপে মাহমুদের বাবা,মা ও কলির বাবা,মা কথা আদান প্রদান করলেন প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে। রেবেকা একজন মা। তাই মায়ের মনে খচখচানি ভাবটা প্রকট। মেয়ের ভবিষ্যত কতটুকু শান্তির হবে এই আশংকা থেকে বড় মেয়ের জামাইকে ডেকে আনলো বাসায়। এবং আদেশ দিয়ে বলল,
“ভালো করে পাত্র ও পাত্রের পরিবারের খোঁজ খবর নাও লুকিয়ে।”
“আচ্ছা আম্মা। অবশ্যই। ”
জুলি বড় দুলাভাইকে দারুণ পছন্দ করে। এর বড় একটা কারণ দুলাভাইকে ভুলিয়ে ভালিয়ে মাঝে মাঝে তার প্রয়োজনীয় জিনিস আদায় করে নেয়। জুলি হারুনের দিকে তাকিয়ে ভ্রু নাচিয়ে বলল,
“শাশুড়ী আম্মার হুকুম পালন করেন। চাপা স্বভাবের মেজো শালির জ্বালা থেকে বঞ্চিত ছিলেন। এবার তার দুলহা নির্বাচনে গরু দায়িত্ব পালন করেন।”
“দেখলেন আম্মা আমাকে গরু বলল জুলি।”
অধিকার সুলভ কন্ঠে নালিশ দেওয়ার মতো করে বলল হারুন।
“থুক্কু। থুক্কু। গুরু বলতে গিয়ে গরু বলে ফেলছি দুলহা ভাই।”
“হারুন তুমি যাওতো বাবা। এই ট্যাটনা থাম। কাজের সময় ফাইজলামি করে। তুই স্থির থাকতে পারস না মেয়ে? সারাদিন টইটই করিস। তোর দরকার ছিলো গ্রামে থাকা। বান্দরের মতন গাছে গাছে লটকালটকি করবি।”
জুলি ধুম করে হেসে ফেলে। মাকে বলল,
“তাহলে আমাকে তোমার সারাদিন কলা দিতে হতও। ইয়া বড় বড় কাঁদি কাঁদি কলা।”
হারুন তিন চারদিন সময় ব্যয় করে পাত্রের তথ্য যোগাড় করলো। শ্বশুরের বাসায় গিয়ে জানালো সব।
” আম্মা যতটকু জানতে পেরেছি ছেলে ভালো। চরিত্রবান। কর্মঠ। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা সাহিত্যের শিক্ষক। তবে ইতঃপূর্বে কোন মেয়ের সঙ্গে রিলেশন ছিল কিনা বা ব্রেকাপ হয়েছে কিনা জানা যায়নি। আর এটা তাদের নিজস্ব ফ্ল্যাট। তার বাবাও বসে নেই। শেয়ার বাজারে অংশীদার আছে। গ্রামে ঘরবাড়ি আছে। তারা প্রতিবছর যাওয়া আসা করে। বাসায় সর্বদা একজন গৃহপরিচারিকা নিযুক্ত আছে তাদের। ”
” ছেলের রিলেশন নাই। থাকলে তাকেই বিয়ে করতো। ছেলেরা ফ্যামিলি ম্যানেজ করে নিতে তেমন সমস্যা হয় না। সুতরাং এটা নিয়ে আমার মনে ঘাপলা নেই।”
” আম্মা কুমিল্লার ছেলে কিন্তু ইতর। বদমায়েশ। কলির মতামত নিতে হবে সব বলে।”
“সেটা আমি দেখছি। তুমি এখন আসতে পারো কাজ থাকলে।”
দুই পরিবারের সব পছন্দে মিলে গেলো। রেবেকা ফোন দিলেন মাহফুজাকে। বললেন,
“আপা ছেলে মেয়ে একবার দেখা করে কথা বলে নেওয়া দরকার। নাকি বলেন? ওরা এখন এডাল্ট। তাদের মতামতের গুরুত্ব দেওয়ার দরকার আপা।”
“আপা, আপনি ও ভাই কি একটু আমাদের সঙ্গে বাইরে দেখা করবেন। দরকার ছিলো। কলি যেন না জানে। সেভাবেই আসবেন।”
বিনীত গলায় বলল মাহফুজা।
রেবেকা তব্দা খেলো। তবুও বলল,
“আপা আমি সময়টা আপনার বাইয়ের সঙ্গে আলাপ করে জানিয়ে দিবো।”
তার দুইদিন পর এক বিকেলে লালবাগ একটি রেস্টুরেন্টে মাহমুদের বাবা, মা ও কলির বাবা মা মুখোমুখি চেয়ারে বসলো। হালকা নাস্তার অর্ডার দিলো আবদুর রহমান। তিনি হৃদ্যতাপূর্ণ স্বরে বললেন,
“আপা, ভাই সাহেব ,কলিকে আমরা একটা সারপ্রাইজড দিতে চাই। পাত্রপক্ষের পরিচয়টা তার কাছে আপাতত গোপন রাখবেন।”
রেবেকা ও নুরুল হক একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করলেন সন্দেহভাজন চোখে। তা দেখে হাসলেন মাহফুজা। তিনি নিজের মতো করে সব বুঝিয়ে বললেন কলির মা বাবাকে।
রেবেকা স্মিত হেসে বলল,
“হুম বুঝিয়ে বলাতে বুঝলাম আপা। কিন্তু কলি যখন দেখবে তার টিচার। তখন ত বেঁকে বসবে। যেহেতু তাদের মাঝে অন্য সম্পর্ক নেই।”
“আপা,ভাই সেটা আমার উপর ছেড়ে দিন। আমি সিচুয়েশন ও কলিকে হ্যান্ডেল করবো।”
এই ভিতরে মাহমুদ আর কোন কথা বলেনি কলির সঙ্গে। পড়াশোনা, ক্লাসের প্রয়োজনে যতটুকু দরকার। ঠিক ততটুকুই বলেছে। খেয়া ভার্সিটি আসছে না। মিসেস হেড খবর নিলো নিলো খেয়ার। জানা গেলো খেয়া এই সেমিস্টার ড্রপ দিয়েছে। কারণ তার চিকিৎসার জন্য পরিবার তাকে নিয়ে চেন্নাইতে চলে গিয়েছে। এতে মাহমুদ স্বস্তিবোধ করলো দুটো কারণে। এক খেয়ার ডিস্ট্রাব হতে রেহাই। দুই কলির সঙ্গে টুকটাক কথা বলা যাবে নানান বাহানায়। খেয়া দেখলে জেলাস ফিল করতো।
কলিকে মাত্র দুদিন আগে জানানো হলো আজ তাকে পাত্রপক্ষ দেখতে আসবে। তাদের সবার পছন্দ হয়েছে। কলির মিডটার্ম পরিক্ষা শুরু হলে বলে মাহমুদের পরিবারের সঙ্গে কলির পরিবারের কথা চালাচালি সবকিছুই গোপন রইলো। কলি দুঃখমাখা কন্ঠে বলল,
“আশ্চর্য! পনেরোদিন ধরে তোমরা দেখাদেখি করছো। অথচ আমি কিছুই জানিনা?”
সর্বদা খিটমিটে মেজাজে ডুবে থাকা রেবেকা হই হই করে উঠলো না মেয়ের উপর। মেয়ের অভিমানকে প্রশ্রয় দিয়ে শান্ত গলায় শান্তনার ভঙ্গিতে বলল,
“তোর পরিক্ষা চলতেছিলো। তাই তোর বাবা বলল তোকে যেনো না জানাই। পড়াশোনার ক্ষতি হবে মন অন্যদিকে গেলে। কোন মা বাবা তার সন্তানের খারাপ চায়না। যেভাবে ভালো হয়,মঙ্গল হয়। সেটাই চায় নিজেদের ক্ষতি করে হলেও। আমরা তাদের মানা করেছি কত। শুনলই না। বলল সামনাসামনি এসে এক কাপ চা খাবে। আর কিছুই না। বারবার করে বাসায় আসতে চাইলে মানা করা যায় বল?”
“ছেলে কি করে আম্মু?”
“কোন প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি করে। পরশু আসুক। দেখবি। তোর অমতে কিছুই হবে না। আমাদের যতই ভালোলাগুক। তোর দুলাভাই ছেলে দেখেছে। তার খুব পছন্দ হয়েছে।”
“তারা কয়জন আসবে?”
“তিনজন ত বলল। চা,নাস্তা খাবে একটু।”
কলি এই দুইদিন গোমড়া মুখে ছিলো। কিন্তু বাবা মায়ের মুখের উপরে অতিরিক্ত কিছুই বলল না আর। মিলি ও হারুন চলে এসেছে। কলি বলল,
“এই সামান্যতে তোরা কেন এলি আপা?”
“আজব? আমাদের বাসায় আমি এনিটাইম আসতে পারি না।”
হেসে জবাব দিলো মিলি।
কলি শাড়ি পরে রেডি হয়ে বসে আছে। তার রুম ভিতরে। তাই ড্রয়িংরুমে কে বা কারা এলো কলি টের পায়নি। সেখানে বসে আছে নুরুল হক,হারুন,মিলি, রেবেকা,জুলি,আবদুর রহমান, মাহফুজা ও আনুশকা। রেবেকা, মাহফুজাকে বলল,
“আপা তুফান আপনি সামলাবেন কিন্তু।”
মাহফুজা সরস হেসে আস্বস্ত করলো রেবেকাকে।
মিলিকে বললো রেবেকা, কলিকে নিয়ে আসতে সঙ্গে করে। সবার বুকের ভিতর টিমটিম করছে লন্ঠনের নিভে আসা আলোর মতো। কলির বুকের গহীনেও দ্রিমদ্রিম বাজছে। এভাবে আর কোন পাত্রপক্ষের সামনে সে যায়নি।
শাড়ি পরিহিতা কলি লজ্জাশীলা নারীর মতো ড্রয়িংরুমে পা রেখে সবাইকে মুখে সালাম দিলো। মাহফুজাকে দেখে কলি অতি বিস্মিত হলো । তবুও ধরে নিলো পাত্রপক্ষের কোন রিলেটিভ হবে হয়তো তারা।
“আন্টি আপনি? উনি আনুশকা আপু না?”
চমকানো সুরে বলল কলি।
“আসো মা। কাছে এসো। বসো। আমাকে ত আর তুমি তোমাদের বাসায় আসতে বললে না। তাই নিজেই চলে এলাম গল্প করতে।”
কলি মিশ্র অনুভূতির করাতলে ঘায়েল হয়ে যাচ্ছে। মাহফুজার পাশে গিয়ে বসলো। সবার মুখ হাসি হাসি। মিলি ও জুলি মিলে দুই তিন ট্রে ভর্তি বাহারি পদের নাস্তা পরিবেশন করে দিলো সবাইকে। কলি বাবা মায়ের মুখের দিকে চেয়ে আছে বোকা বোকা চোখে। সবাই নাস্তা খেয়ে নিলো। মাহফুজা কলির হাত ধরে নুরুল হকের দিকে চেয়ে বলল,
“ভাইসাহেব আলহামদুলিল্লাহ। আমাদের কোন আপত্তি নেই আপনাদের সঙ্গে আত্মীয়তা করতে।”
নুরুল হক ও রেবেকা আলহামদুলিল্লাহ বলে উঠলো।
মাহফুজা কলিকে বলল,
“তোমার পরিবারের কারো বিন্দুমাত্র দোষ নেই। তুমি তাদের উপর মনঃক্ষুন্ন হতে পারবে না। তোমার পরিক্ষা ছিলো বলে আর তোমাকে সারপ্রাইজড দেওয়ার জন্য আমিই একটু লুকোচুরির আশ্রয় নিলাম মা। উনারা আমার অনুরোধেই চুপ ছিলো। তুমি ছোট বাচ্চা নও। আশাকরি বুঝতে পেরেছো।”
“আন্টি আমি কিছুই বুঝতেছি না।”
“তোমাকে সারাজীবনের জন্য আমার কাছে নিতে যেতে চাই। আপত্তি আছে মা?”
মাহফুজার কন্ঠে স্নেহ ঝরে পড়ছে।
কলি হকচকিয়ে গেলো। বলল,
“কিভাবে আন্টি?”
“তোমার মাহমুদ স্যারের বউ করে।”
প্রীতিময় কন্ঠে বলল আনুশকা।
কলির মাথায় যেন আকস্মিক বজ্রপাত হলো। তার সমস্ত শরীর দুলে উঠলো। চোখ বড় বড় করে কপালে তুলে সে কিইই বলে মৃদু আর্তনাদ করে উঠলো। বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। আতংকিত গলায় একবাক্যে বলে উঠলো,
“অসম্ভব আন্টি! মরে গেলেও আমি এটা পারব না। উনাকে স্যার হিসেবে আমি শ্রদ্ধা করি। অন্যচোখে দেখা আমার পক্ষে একেবারেই অসম্ভব! আমাকে ক্ষমা করবেন।”
চলবে…১৪
#তোমার_জন্য_সব (১৫)
✍️ #রেহানা_পুতুল
কলির মাথায় যেন আকস্মিক বজ্রপাত হলো। তার সমস্ত শরীর দুলে উঠলো। চোখ বড় বড় করে কপালে তুলে কিইই বলে মৃদু আর্তনাদ করে উঠলো। বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। আতংকিত গলায় বলে উঠলো,
“অসম্ভব আন্টি! মরে গেলেও আমি এটা পারব না। উনাকে স্যার হিসেবে আমি শ্রদ্ধা করি। অন্যচোখে দেখা আমার পক্ষে একেবারেই অসম্ভব! আমাকে ক্ষমা করবেন।”
“তুমি এক মাকে ফিরিয়ে দিবে?”
শীতল গলায় বলল মাহফুজা।
“আপনার পছন্দের জন্য দুটো জীবন বলী হতে পারে না আন্টি। স্যারও আমাকে শুধু ছাত্রী হিসেবেই দেখে। অন্যদৃষ্টিতে নয়।”
” তোমার স্যারের মত না জেনে আমরা এসেছি?”
হেসে বলল আনুশকা।
কলি বলল,
“উনি মায়ের অনুরাগী ছেলে। তাই মায়ের মুখের উপর মানা করতে পারেনি বিধায় হয়তো হ্যাঁ বলতে বাধ্য হয়েছে।”
“এমন কিছুই না। ঠিকাছে তোমার কথাই রইলো। তুমি যদি আমার কাছে থাকতে না চাও। নাই। বিয়ে জোরের বিষয় নয়। মনের বিষয়।”
হতাশ গলায় বলল মাহফুজা।
আনুশকা বলল,
“কলি বাচ্চামো করো কেন? তোমাকে প্রথমে আম্মু পছন্দ করেছে। এটা সত্যি। তারপর আম্মু আমাদের সবাইকে বলল তোমার কথা। ভাইয়া ও আমরা চিন্তা করে সহমত জানালাম। বিষয়টা যে আম্মুর ইচ্ছাকেই কেবল প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। তা মোটেও নয়। এটা দুজন মানুষের পুরো লাইফের বিষয়। আমরা ভেবেচিন্তেই সিদ্বান্ত নিয়েছি। তোমাদের পরিবারের সবাই, ভাইয়া ও আমাদেরকে পছন্দ করেছে।”
কলি নত মস্তকে মৌন হয়ে রইলো। পরক্ষণেই বলল,
“বুঝলাম। তবুও আমি সরি বলবো। স্যারকে আমি অন্যচোখে দেখতে পারব না।”
“রাজধানীতে বাস করেও তুমি দেখি মান্ধাতার আমলের মেয়েদের মতো কথা বলছ? আম্মুর মাথা হেঁট হয়ে যাবে এখন ভাইয়ার কাছে। ভাইয়া বারবার বলছে কলির মত না জেনে তোমরা যেওনা। পরে অপমানিত হবে।”
স্বল্পভাষী আবদুর রহমান নিরব ভূমিকা পালন করছেন। কি বলবেন তিনি। কিছুই বলার নেই। বাকিরা নিরব দর্শকের মতো চুপ হয়ে আছে। আড়চোখে কলিকে দেখছে ও কলির মনোভাব বোঝার চেষ্টা করছে। মাহফুজা দীর্ঘস্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ালেন। খেদ ঝেড়ে মরাকন্ঠে বললেন,
“সব ভুল আমারই হয়েছে। নিজের উপর অগাধ আত্মবিশ্বাস ছিলো। সব ভেস্তে গেলো। মাহমুদের কথাকে গুরুত্ব দেওয়া উচিত ছিলো আমার।”
আনুশকা বলল,
“ফাইনাল একটা জিজ্ঞাসা কলি। আচ্ছা ভাইয়া যদি তোমার মুখোমুখি হয়ে বলে তোমাকে পছন্দ। তাহলে কি তুমি ইয়েস বলবে?”
“নাহ আপু। সরি।”
বলে কলি নিজের রুমে চলে গেলো।
” আপা,ভাইসাহেব আপনারা যাবেন না। একটু বসুন।”
নুরুল হক আন্তরিক গলায় অনুরোধ করলো অতিথিদের।
তারা তিনজন দাঁড়ানো থেকে আবার বসলো। রেবেকা,মিলি,নুরুল হক উঠে ভিতরে গেলো। জুলি ও হারুন বসে আছে। হারুন কথোপকথন চালিয়ে নিলো অতিথিদের। জুলি ও আনুশকা নানান রসবোধে মেতে উঠলো। নাইনে পড়ুয়া জুলি বন্ধুবৎসল ও স্বভাবে মিশুক প্রকৃতির। পৃথিবীর সব পর মানুষকে এক দেখায় আপন করে নেওয়ার অসীম ক্ষমতা এই বালিকা মেয়েটির।
আনুশকা অতি আগ্রহ নিয়ে জুলির সঙ্গে গল্প করছে। এক পর্যায়ে জুলি বলল,
“আনুপু আমি একটা মজার জোকস জানি। এক্ষুনি শোনাতে চাই আপনাকে। পরে যদি আপার বিয়ে না হয় তার স্যারের সঙ্গে। তাহলে আর কোনদিন শুনানো হবে না। আমার আফসোস রয়ে যাবে।”
আনুশকা দেখলো জুলি তার এত সুন্দর নামের অর্ধেক ঘ্যাচাং করে কেটে ফেলেছে। শুধু আনুপু বলছে। যদিও তার কাছে এটাও শুনতে বেশ লাগছে। শটকার্ট সহজ সরল শব্দ। আনুশকা চায়না এত হাসিখুশী মেয়েটার মনে বিন্দুসম হলেও অপূর্ণতাটা রয়ে যাক।
সে উৎসুক চাহনিতে বলল,
“সেটাই। বিয়ে না হওয়ার চান্স সেভেনটি পার্সেন্ট। অবশ্য হতেও পারে। জিরো পার্সেন্ট চান্স থেকেও মানুষ হিরো হয়ে যায়। ক্রিকেট খেলায় দেখনা,হারতে হারতে চার,ছক্কা মেরে জিতে যায়। আমার কাছে এই বিষয়টা অদ্ভুত মজার লাগে জুলি। ও হ্যাঁ তোমার কৌতুকটা? প্লিজ।”
“ওহ! শোন,
পার্কের খোলা বেঞ্চে বসে আসে দুজন কপোত-কপোতী। ছেলেটা বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। বুক টান টান করে পাখির ডানার মতো দুই হাত দুই দিকে মেলে ধরলো। বলল,
প্রিয়া এই পৃথিবী শুধু তোমার আমার।কোন ভয় নেই। কোন দ্বিধা নেই। বুকে আসো। তখন সামনের পথ ধরে হেঁটে যাচ্ছিলো একজন অচেনা মুরুব্বি। তিনি থেমে গেলেন। তাদের দুজনের দিকে স্থির চোখে চাইলেন। বললেন,
তা বাবা তাহলে কি এই পৃথিবীর আমরা সব মানুষেরা তোমাদের ভাড়াটিয়া?”
আনুষকা উচ্ছল হাসিতে লুটিয়ে পড়লো। জুলিও রিনরিনিয়ে হেসে ফেলল। বলল,
“মজার না জোকসটা?”
“সেরা। সেরা। কোথায় শুনেছে এটা?”
“স্কুলে গনিতের স্যার বলেছে।”
“বাহ! জটিল গণিতের মতো সাবজেক্টের স্যার এত রসিক? লাইক সিরিয়াসলি? ”
কলিকে এতক্ষন মা,বাবা,বোন তাদের সাধ্যনুযায়ী জীবন নিয়ে বিভিন্ন যুক্তিখন্ডন করে বোঝালো। কলির ঘুরেফিরে দুটো কথা। এক, স্যার তাকে পছন্দ করেছে এটা তার বিশ্বাস হয়না। দুই, হলেও তার সংকোচ হয়। অন্য কেউ হলে এতটা হতো না। কলি বসে রইলো চেয়ারে নিজের রুমে। তারা ড্রয়িংরুমে গিয়ে বসলো। কলির বিষয়টা জানালো।
আনুশকা উঠে এলো কলির কাছে। বলল,
“ভাইয়াকে বলবো আসতে তোমাদের বাসায়? বাইকে একটানে চলে আসতে পারবে। ভাইয়ার মুখ থেকেই শুনে নাও তবে। আম্মু,আব্বু কত অগাধ বিশ্বাস নিয়ে এসেছে তোমাদের বাসায়। শুভকাজকে অবহেলা করতে নেই কলি। রেস্পেক্ট করতে হয়। টিচার স্টুডেন্ট এর বিয়ে সেই আদিকাল থেকেই আমাদের সমাজে প্রচলিত ও জনপ্রিয়। প্লিজ হবু ভাবি ইয়েস বল না।”
“নাহ। উনি আসতে হবে না।”
নিরুৎসাহিত কন্ঠে জানালো কলি।
“তাহলে কি? ইয়েস?”
কলি নিরুপায় হয়ে নিমরাজি হলো। তাও শর্ত জুড়ে দিয়ে। বলল,
“আমি এক সপ্তাহ একটু ভেবে দেখি আপু।”
“আচ্ছা। রাজী।”
আনুশকা কলিকে নিয়ে সামনে চলে গেলো। কলিকে তার মায়ের পাশে বসালো। সুখ সুখ গলায় বলল,
“আম্মু তোমার হবু পুত্রবধূর অনামিকায় আংটিটা পরিয়ে দাওতো।”
কলির মুখে অমানিশার আঁধার ভর করলো। আনুশকা কলির আঙ্গুলগুলো মেলে ধরলো।
মাহফুজা আংটি পরিয়ে দিতে দিতে বলল,
“আমি এটা এমনিতেই দিলাম তোমাকে। ভালো থেকো মা।”
নুরুল হক ও আবদুর রহমান আলহামদুলিল্লাহ বলে দাঁড়িয়ে মোলাকাত করলো। জুলি, আনুশকাও আলহামদুলিল্লাহ বলে মোলাকাত করলো।
হারুন দুষ্টমিষ্ট চোখে মিলির দিকে তাকালো। ইশারায় বোঝালো,
আসো আমরাও বুকে বুক মিলিয়ে আলহামদুলিল্লাহ বলি। মিলি কঠিন চোখের দৃষ্টি দিয়ে শাসালো স্বামীকে।
নুরুল হক বললেন,
“ভাইসাহেব রাত হয়ে গেলো। আপনারা নৈশভোজ সেরে যান।”
“নাহ ভাইসাহেব। আজতো বিয়ের দিনক্ষন আমরা ঠিক করিনি। যেদিন পাকা কথা হবে বিয়ের। সেদিন খাবো। কথা দিলাম। আপনারা কলির মতামত নিয়ে সময়টা আমাদের জানাবেন।”
তারা হাসিমুখে চলে গেলো বিদায় নিয়ে।
কলি নিজের রুমে এসে আংটি ছুঁড়ে ফেলল মেঝেতে। জুলি সেই আংটি নিয়ে নিজের বুড়ো আঙ্গুলে দিয়ে বসে রইলো। কলি দরজা বন্ধ করে ফুঁফিয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো। মাহফুজা বাসায় গিয়ে জোরে নিঃশ্বাস ফেললেন।
তিনি বুঝতে পেরেছেন সেদিন ছেলের কথায়। তার সঙ্গে ছেলেও কলিকে বেশ পছন্দ করে বসে আছে। তাই ছেলের মনোবাসনা পূরণের জন্যই মা হয়ে উঠে পড়ে লাগলেন।
মাহমুদ তাদেরকে অবাক চোখে বলল,
“এত লেট হলো? তোমরা গেলে কখন আর এলে কখন? ডিনার করে এসেছো নাহ?”
“আরেহ নাহ। তারাতো যথেষ্টবার সেধেছে। আমরা করিনি। তোর অভিমানীনি ছাত্রীকে ম্যানেজ করতেই আমরা নাকানি চুবানি খেলাম। রীতিমতো ছোটখাটো একটা যুদ্ধ হাফ জয় করে এসেছি। আমরা রুমে যাই। কাহিল। বিশ্রাম নিতে হবে। তোর বোন থেকে ইতিহাস শোন।”
মাহমুদ চিন্তাগ্রস্ত হয়ে বসে পড়লো দাঁড়ানো থেকে। তার বাবা মা নিজেদের রুমে চলে গেলো।
“আনুশকা এদিকে আয়।”
আনুশকা গিয়ে বসলো ভাইয়ের সামনে।
“আমার আংটি কই?
দে।”
“আজব! আংটি কি ফেরত আনার জন্য কিনে দিয়েছো?”
“বিয়ে ফাইনাল হয়নি আংটি কেন রাখলো?”
বিরক্ত হয়ে বলল মাহমুদ।
” ধীরে বৎস ধীরে।”
হাত উঁচিয়ে সাধু,সন্নাসীর মতো বলল আনুশকা।
সে কলিদের বাসার সব ইতিবৃত্ত ভাইকে বুঝিয়ে বলল। মাহমুদ চিন্তিত সুরে বলল,
“তার মানে বিয়েটা মাকড়সার বাসার মতো ঝুলে আছে? যেকোনো সময় ভেঙ্গে যাওয়ার সম্ভাবনা বিপুল?”
“ইয়েস ব্রো। হান্ড্রেডপার্সেন্ট।”
“এখন আমার কি করতে হবে তাহলে?”
” কি বললাম এতক্ষণ? ওক্কে এগেইন রিপিট করি। কলির ফার্স্ট কথা হলো, তার বিলিভ হয়নি তুমি তাকে পছন্দ করেছো বিয়ে করার জন্য। দ্বিতীয় কথা হলো বিলিভ করলেও তার তোমাকে সেভাবে পছন্দ নয়। স্যার হিসেবেই দেখে তোমাকে সে।”
“তো আমার আংটি দিয়ে আসলি ক্যান? যা নিয়ে আয় গিয়ে।”
“এত ত্যাড়ামো করো কেন? এমন ভাবে তার সঙ্গে চলবা, যেন সে বিলিভ করতে বাধ্য হয় তুমি তাকে মন নয় শুধু, অস্থি,মজ্জা,পাঁজর,কলিজা,ফুসফুস, হার্ট,কিডনি, শিরা,উপশিরা, সব দিয়ে লাইক করো। এবং সেও যেন তোমাকে লাইক করে।”
“হুম বুঝলাম। আচ্ছা যা। ঘুমাবো।”
“টিপস দিয়ে দিলাম। এখন তো ভাগিয়ে দিবাই। হুহ্!”
আনুশকা চলে গেলে মাহমুদ তার ডায়েরিটা টেনে নিলো। একটানে লিখে ফেলল,
” আমার হৃদয়টা পোড়াতে এই অরণ্যহীন শহরে এত চন্দন কাঠ কোথায় পাও তুমি?”
তারপর ডায়েরিটা বন্ধ করে একপাশে ঠেলে রেখে দিলো মাহমুদ।
কলি আবার ভার্সিটি যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। মাহমুদের সঙ্গে চোখাচোখি হওয়ার জো রইল না আর। এই তীব্র সংকোচে তার প্রান উড়ে যাওয়ার দশা। মিসেস হেড কলিকে ফোন দিলো। কলি জানালো অসুস্থ। সুস্থ হয়েই ফিরবে ক্যাম্পাসে। এক সপ্তাহ পর কলি ক্লাসে গেলো। মাহমুদ বুঝতে পারলো বিষয়টা। তাই নিজেও কলির থেকে দূরে দূরে রইলো। কোন অযাচিত প্রসঙ্গ তুলে সামন্দ যাওয়া, কথা বলা, ফোন করা, মেসেজ দেওয়া সবকিছু থেকে নিজেকে বিরত রাখলো। এভাবেই পার হচ্ছে তার সময় ও দিন। তবে লুকানো নয়নে কলির প্রতি সুক্ষ্ম নজর রাখছে মাহমুদ।
তার পর একদিনের ঘটনা। বর্ষার এক বৃষ্টি ভেজা বিকেল। রাস্তাঘাট অন্যদিনের চেয়ে কিছুটা নিরব। বাস পাওয়া যাচ্ছে না। প্রচুর জ্যাম রাস্তায়। কলি ভার্সিটি থেকে বের হয়ে ছাতা মাথায় দিয়ে বাস স্টপেজ পার হয়ে ফুটপাত ধরে সামনের দিকে এগিয়ে গেলো। তার পথরোধ করে ফেলল দুটো যুবক ছেলে। তারা কলির সঙ্গে অশালীন কথা বলছে৷ এরা মাস্তান টাইপ। তাই কেউ কেউ দেখেও না দেখার মতো রইলো।
এক পর্যায়ে একজন ছেলে কলির বুকের উপর থেকে হ্যাঁচকা টানে ওড়নাটা নিজের হাতে নিয়ে পেঁচিয়ে নিলো। বলল,
“এভার যাও পারলে। প্রতিশোধ নিলাম। ওড়না পাবে না।”
কলি লজ্জায়,ঘৃণায়,আড়ষ্টতায় মিশে গেলো মাটির সঙ্গে। হাতের ব্যাগকে বুকে চেপে ধরে অসহায় ভঙ্গিতে অন্যদের সাহায্য চাইলো। কেউ এগিয়ে এলো না। কলি দাঁড়িয়ে রইলো ফুটপাতের কিনারা ঘেঁষে। ছেলেদুটো তার ওড়না নিয়ে বাইক চালিয়ে চলে গেলো। তাদের ধরার ও শায়েস্তা করার কোন সুযোগ নেই। কলি কেঁদে ফেলল।
পরক্ষণেই পিছন হতে কলির পিঠের উপর দিয়ে বুকের উপর ওড়নাটি মেলে দিলো মাহমুদ। কলি বিস্ময় ভরা কন্ঠে কাঁপা কাঁপা অধরে শুধালো,
“স্যার আপনিই? আমার ওড়নাটা কোথায় পেলেন? ”
“হ্যাঁ আমি। বাইকে উঠে আসুন।”
গাম্ভীর্যপূর্ণ কন্ঠে আদেশ করে বলল মাহমুদ।
চলবে…১৫
#Romantic