#তোমার_জন্য_সব (১২)
✍️ #রেহানা_পুতুল
সেদিন রাত নয়টার দিকে মাহমুদের ফোন বেজে উঠলো উচ্চস্বরে। ফোন রিসিভ হলো। ওপাশের কথা শোনার পর মাহমুদ উদ্বিগ্ন স্বরে বলল,
“ওহ মাই গড! এড্রেস বলুন। আমি এক্ষুনি আসছি আপনাদের বাসায়।”
মাহমুদ দ্রুতবেগে বাইক নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। বাসার কাউকে কিছু বলার সময়টুকুও নেই তারহাতে।
মাহমুদ গিয়ে পৌঁছালো এড্রেস অনুযায়ী। যদিও খেয়াদের এই বাড়ি সে আগেও একবার দেখেছে। তবুও নিশ্চিত হওয়ার জন্য আবার জেনে নিলো। তিনতলা বাসায় প্রবেশ করেই মাহমুদ দেখলো সোফায় বসে আছে একজন বয়স্ক পুরুষ। সে সালাম দিলো।
“ওয়ালাইকুম আসসালাম। আমি খেয়ার বাবা। তোমাকে আমিই ফোন দিয়েছি। বসো বাবা।”
মাহমুদ বসতে বসতে দ্বিধাগ্রস্ত চোখে তাকালো খেয়ার বাবার দিকে। মাহমুদ মার্জিত গলায় বলল,
“আংকেল আপনাকে আমার একটু চেনা চেনা মনে হচ্ছে। আপনার নাম যেন কি বলছিলেন সেদিন, ঠিক মনে করতে পারছি না।”
” আমি জাফর চৌধুরী। কিভাবে চেনা মনে হচ্ছে?”
” আপনার সঙ্গে একদিন দেখা হয়েছে পথচলায় আঙ্কেল। এটা বেশ কয়েকবছর আগের কথা।”
” একটু ধরিয়ে দাওতো। স্মৃতি ঘোলাটে হয়ে গিয়েছে। তাই সময় লাগছে। মনে করতে পারছি না।”
দ্বিধাজড়িত স্বরে বলল জাফর চৌধুরী।
মাহমুদের সব মনে আছে দিনের আলোর মতই স্পষ্টভাবে। সে প্রীত চোখে চেয়ে চমকানো সুরে বলল,
“প্রায় দশ বছর পূর্বের কথা আংকেল। আমি মাত্র ইউনিভার্সিটিতে এডমিশন নিলাম। আমাকে পুলিশের হাত থেকে বাঁচিয়েছিলেন আপনি। প্লেস ধানমন্ডি আট। সময় বিকেলেবেলা। অকারণেই পুলিশ ভুল করে ভুল বুঝে সেদিন বিকেলে আমাকে ধরে ফেলল। এবং হট্রগোল বাঁধিয়ে ফেলল। আপনি সেই পথ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন। পুলিশের জটলা দেখে আপনি দাঁড়ালেন। আমিই অসহায় কন্ঠে আপনার কাছে হেল্প চাইলাম।
মাহমুদের বলার মাঝপথেই খেয়ার বাবা তাকে থামিয়ে দিলেন। বললেন,
“ধানমন্ডির থানার ডি আই জি ছিলো আমার ঘনিষ্ঠজন। তাকে ফোন দিলাম। সে তোমাকে ধরা পুলিশকে ফোন দিলো। তারা তোমাকে ছেড়ে দিলো। তুমি অনেক আকুতি করে বললে আমি যেনো কাউকে বিষয়টা শেয়ার না করি। নয়তো কোনভাবে তোমার পরিবার জেনে যাবে। তাতে তোমার আদর্শবান শিক্ষক পিতার মর্যাদা ক্ষুন্ন হবে। ”
“ইয়েস আংকেল। ইয়েস! একদম রাইট। আপনার জন্যই পরে আর বেশি হেনস্তা করেনি পুলিশ আমাকে। আমি কি ঘাবড়ে নাই গিয়েছিলাম সেদিন।”
জাফর চৌধুরীর সারামুখে উৎফুল্লতার ছাপ ফুটে উঠলো। বললেন,
“স্বাভাবিক। তখন তোমার বয়সতো অল্প ছিলো। তোমাকেতো এখন আমি চিনতেই পারিনি বৎস! চেহারায় বেশ পরিবর্তন এসেছে। সেদিনের সেই টগবগে তরুণ ছেলেটা আজকের তুমি। বেশ সুদর্শন হয়েছো ইয়াংম্যান। আমার মেয়েটা এমনি এমনি ক্রেজি হয়নি। এখন বুঝলাম। আমি ওপেন মাইন্ডের লোক।সো ডোন্ট মাইন্ড। ”
” না না আংকেল। ঠিক আছে। আমিও আপনাকে দেখেই চিনতে পারিনি।সেদিন আপনার গোঁফ দাঁড়ি ছিল না।”
“হুম।রেখে দিলাম। মুসলমান আমরা। মৃত্যুর ভয়তো আছেই।”
যেদিন মাহমুদের সঙ্গে অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে খেয়ার বাবার দেখা হয়েছিলো। সেদিন তার ক্লিন সেভ ছিলো। চোখে চশমা ছিল না। এখন মাহমুদ পাওয়ারজনিত সমস্যার কারণে চব্বিশ ঘন্টাই চশমা পরে থাকে। মুখে ফ্রেঞ্চকাট দাঁটিগোঁফ।
মাহমুদ ও জাফরের কথোপকথনের ইতি ঘটে তনিমার আগমনে।
“বাবা খেয়া নড়ে উঠলো।”
উদ্বেগজনিত স্বরে বলল তনিমা।
“বাবা আগে একটু খেয়ার রুমে যাও। পরে ডিটেইলস জানাচ্ছি তোমাকে।”
অনুরোধ করে বলল জাফর।
মাহমুদ উঠে গেলো তনিমার সঙ্গে। অনুরোধে ঢেঁকি গেলা ছাড়া আর উপায় কি তার। তনিমা মাহমুদকে খেয়ার রুমে নিয়ে গেলো। ফিসফিসিয়ে বলল,
“স্যার আপনি ওর পাশে বসে একটু হাতটা ধরেন। ওকে বোঝাবেন আপনি ওকে পছন্দ করেন। ভালোবাসেন। আমরা পরে সব বলছি আপনাকে।”
মাহমুদ হা হয়ে তাকিয়ে রইলো তনিমার দিকে। তার দু’চোখ দিয়ে যেন উষ্ণ ধোঁয়া বেরুচ্ছে। তনিমা দরজা চাপিয়ে রুমের বাইরে চলে গেলো। মাহমুদ কঠোর দৃষ্টিতে খেয়ার পানে চাইলো। খেয়ার চোখ বন্ধ। চিৎ হয়ে শোয়া। বিছানায় পড়ে আছে নির্জীবের মতো। হাত পা ছড়ানো। কোমরের উপর অবধি পাতলা একটি কম্বল দিয়ে ঢাকা। ঘুমের মেডিসিন দেয়া হয়েছে খেয়াকে।
মাহমুদ একটি চেয়ার টেনে খেয়ার মুখ বরাবর বসলো খাটের সামনে। দেখলো খেয়ার বুকে ওড়না নেই। গায়ে পাতলা একটি টিশার্ট জাতীয় কিছু। মাহমুদ নিজেই ইতস্ততবোধ করলো। না চাইতেই দৃষ্টি চলে যাচ্ছে খেয়ার বুকের দিকে। কি বিদঘুটে বিষয়। সে বিছানার আশপাশে খেয়ার ওড়না খুঁজেও পেলনা। বুঝে নিলো এই মেয়ে বাসায় তেমন ওড়না পরেই না। মাহমুদ আলতো করে খেয়ার গায়ের কম্বলটি বুকের উপর টেনে দিলো। এতেই খেয়া নড়ে উঠলো আবার। চোখের পাতা মেলে ধরলো। মাহমুদকে দেখেই ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো অবিশ্বাস্য চোখে। মাহমুদের একহাত ধরে ফেলল নরম করে। মাহমুদ অপ্রস্তুত হয়ে গেলো। বিরক্তির চরম সীমায় পৌঁছে গেলো। তবুও হাত সরিয়ে নিলো না। বরং নিজের একহাত খেয়ার হাতের পিঠে রাখলো। কারণ মৃত্যুপথযাত্রী কাউকে বাঁচানোর চেষ্টা করাও ফরজ। একজন মানুষ হিসেবে এই দায় প্রতিটি মানুষের উপরেই বর্তায়। এবং এটা নৈতিক ও মানবিক দায়িত্ব।
মাহমুদ এখানে বসে থাকলে হবে না। বাসায় যেতে হবে। তাই খেয়াকে হৃদ্যতাপূর্ণ কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
“খেয়া পাগলামো করেন কেন? বাবা,মা কষ্ট পায়না? এই যে আমি আসলাম।”
খেয়া বিগলিত কন্ঠে বলল,
“স্যার আপনাকে কে আসতে বলল? কেন এলেন? আমি ঠিক আছি। আপনি চলে যেতে পারেন।”
মাহমুদ খেয়াল করলো,খেয়ার কন্ঠে গাঢ় অনুরাগ,অভিমান।
“আপনি ভালো থাকলে আমার কাছে ফোন গেলো কেন? রাত করে আসতে হলো কেন আপনাদের বাসায়?”
খেয়া চুপ হয়ে আছে শান্ত দিঘির জলের মতো। মাহমুদ খেয়ার মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে দিলো। বলল,
“আপনি থাকুন। আমি আসছি। বাসায় বলে আসা হয়নি। ড্রয়িংরুমে গিয়ে জানিয়ে দিই।”
মাহমুদ খেয়ার বেডরুম থেকে বেরিয়ে যায়। ড্রয়িংরুমে গিয়ে বসলো। তার মাকে ফোন দিয়ে বলল,
“মা টেনশন করো না। আমি খেয়াদের বাসায় আসছি। এসে সব বলছি।”
মাহমুদকে খেয়াদের হেল্প হ্যান্ডিং মেয়েটা এসে ট্রে ভর্তি নাস্তা দিয়ে গেলো। সে খাচ্ছে না। বসে বসে ভাবছে। কি হবে,কি করবে সে।
তনিমা, খেয়ার বাবা, খেয়ার বড় ভাই সাহিল গিয়ে বসলো মাহমুদের পাশে। সবাই মিলে নাস্তা করলো। কথা শুরু করলেন খেয়ার বাবা।
“কিভাবে যে বলি বিষয়টা। খেয়া ছোটবেলায় তার মাকে হারায়। আমি আর দ্বিতীয় বিয়ে করিনি। সে খালাদের কাছে বড় হয়। পরে হাইস্কুলে ভর্তি হওয়ার সময় হলে আমার কাছে নিয়ে আসি। ওর টেইক কেয়ারের জন্য একজন খালা সার্বক্ষণিক থাকতো আমাদের বাসায়। লক্ষ্য করি ও দিনে দিনে একরোখা,বেয়াড়া,জেদী হয়ে উঠে। বিশেষ করে যেটা চায় সেটা না পেলে সে অস্বাভাবিক আচরণ শুরু করে। আমরা সাইক্রিয়াটিস্ট এর শরনাপন্ন হই।
ডাক্তার বলল,
এটা ওর একটা মেন্টাল ডিজিজ। এটার চিকিৎসা হলো ওকে ওর মতো করে থাকতে দেওয়া। বাঁচতে দেওয়া। মাকে হারানোর জন্য সে কোনকিছু না পাওয়া, ব্যর্থ হওয়া, হারানোর বিষয়টা নিতে পারেনা। সেটা ব্যক্তি হোক আর বস্তু হোক। যাইহোক চলছে সব মোটামুটি। কিন্তু ইদানীং সমস্যাটা প্রবল আকার রূপ নিলো। গ্লাস ছুঁড়ে মারছে। ব্লেড দিয়ে হাত কেটে ফেলছে। পড়াশোনায় অমনোযোগী হয়ে যাচ্ছে। যার ফলস্বরূপ এই সেমিস্টার রেজাল্ট খারাপ হলো।
এবং এগুলো হচ্ছে তোমার জন্য। না না। আমরা তোমাকে ব্লেইম দিয়ে বলছি না। বলার জন্য বললাম। তোমাকে খেয়া অনেক ভালোবাসে। যা জানলাম আমার বৌমা তনিমার কাছ থেকে।
হ্যাঁ মাহমুদ, আমি জানি পৃথিবীতে জোর করে সব করা গেলেও ভালোবাসা,অনুভূতি জোর করে আদায় করা যায়না। কিন্তু আমি ও আমরা তোমাকে বলতে চাই, তুমি যদি একটু মন বসাবার চেষ্টা করো ভিতর থেকে। হয়তো পারবে। মানুষের অসাধ্য কি আছে বলো। এমন বহু বিয়ে হয় ছেলে মেয়ের অমতে। পরে দেখা যায় সংসার করতে করতে মন বসে যায়। কিছুদিন পাশে থাকলে কুকুর, বিড়ালের উপরেওতো আমাদের মায়া জন্মে যায়। আমার লজিক ভুল নাকি বলো?”
পাশ থেকে তনিমা ও সাহিল বলল,
” বাবার কথাই আমাদের কথা। আমরা কেবল চাই আপনি খেয়াকে বিয়ে করুন। এবং ওকে ভালোবাসার চেষ্টা করুন দয়া করে। আপনার পারিবারিক স্ট্যাটাসের সঙ্গে আমাদের পরিবার মানানসই।”
জাফর চৌধুরী করুণ চাহনিতে বসে রইলেন পায়ের উপর পা তুলে।
তনিমা বলল,
“আজতো সন্ধ্যায় আমরা না দেখলে তার প্রানবায়ু বের হয়েই যেতো। তার সুইসাইড সফল হয়নি অল্পের জন্য। পায় ঝুলেই গিয়েছিলো সিলিং ফ্যানটার সঙ্গে। পড়ে ও গিয়ে ডাক্তার নিয়ে এলো বাসায়। ঘুমের ট্যাবলেট খাইয়ে দিতে বলল ডাক্তার। সে কিছু চেয়ে পায়নি এই ব্যর্থতা কেন জানি সে হজম করতেই পারেনা। তখন সে নিজেকে অনেক ক্ষুদ্র মনে করে। অযোগ্য মনে করে। আমরা আপনার বিষয়ে ওকে অনেক বুঝিয়েছি। কিন্তু ও মানতেই চায়না। আপনার প্রতি খেয়া সিরিয়াস রকমের অবসেস।”
সবকিছু শুনে মাহমুদ জমে গেলো বরফখন্ডের ন্যায়। গ্রীষ্মের এই খরতাপেও তার শিরদাঁড়া বেয়ে একটা শীতল স্রোত বয়ে গেলো সর্পিল গতিতে। বহুবছর আগে যেই মানুষটা তাকে অনেক বড় বিপদ থেকে রক্ষা করলো। আজ এতটা বছর পরে এসে সেই প্রতিদান কি তাকে এভাবেই দিতে হবে?
খেয়ার বাবা নিদারুণ কন্ঠে বললেন,
” খেয়া যখন নিশ্চিত হবে তোমাকে কোনদিন পাবে না। তখন সে নিজেকে শেষ করে দিবে। এখন এনগেজমেন্ট হয়ে থাকুক না হয়। তোমার সুবিধা অনুযায়ী বিয়ে হবে। তাও খেয়া ভালোথাকবে। বুঝে নিবে যখনই হোক তুমি তারই হবে। আসলে বাবা হয়ে এসব বলতে আমারো বাধছে। কিন্তু আমরা নিরুপায়। আজতো এই সিচুয়েশন দেখে তনিমা বলল,
স্যারকে আনান। নয়তো রাতে আবার এক্সিডেন্ট ঘটে যেতে পারে।”
মাহমুদ বিপন্ন মুখে বলল,
” আচ্ছা আংকেল আমি বাসায় গিয়ে আলাপ করি আগে। এটা পুরো জীবনের বিষয়। হুট করে ডিসিশন নেয়া ঠিক হবে না। এখন উঠি আমি।”
“বাবা হুট করে হবে কেন? আমরা তোমার পরিবারের সঙ্গে আলাপে বসবো। তুমিও সময় নাও। ”
সাহিল বলল,
“আমি ক্লিয়ার করছি মাহমুদ ভাই। খেয়া আপনার স্টুডেন্ট। ভার্সিটি বলেন বা বাইরে বলেন আপনি আপাতত মিথ্যা করে হলেও খেয়াকে বোঝাবেন,আপনিও খেয়ার প্রতি অনুরক্ত। খেয়াকে পছন্দ করেন। তবেই আমার মা হারা একমাত্র আদরের ছোটবোনটা হাসিখুশি থাকবে। আপনার একটু সদয় আচরণ,সান্নিধ্য, কিছুক্ষণ গল্প করায় যদি একজন মানুষের জীবনটা ভালোভাবে বেঁচে যায়। তাতে আপনারও ভালোলাগার কথা। পৃথিবীতে কয়জন মানুষের হাতে এমন সুযোগ আগে কাউকে বাঁচিয়ে তোলার। ভালো রাখার। বলেন?”
মাহমুদ প্রতুৎত্তরে কিছুই বলল না। পাথর চোখে তাকালো সাহিলের দিকে।
তনিমা বলল,
“ভাইয়া যাওয়ার আগে খেয়াকে একটু বুঝিয়ে যান। ওর আনন্দে থাকার মেডিসিন আপনি। শুরু থেকে সব একবার চিন্তা করুন। রিয়েলাইজ করতে পারবেন একটা মেয়ে আপনাকে কতটা চায়। এমন করে আর দ্বিতীয় কোন মেয়ের হৃদয়ে আপনি বাস করতে পারছেন? এটা সৌভাগ্য হিসেবে ধরে নিন।”
মাহমুদ শক্ত চোয়ালে উঠে দাঁড়ালো। খেয়ার রুমে চলে গেলো গম্ভীর মুখে। খেয়ার পাশে বসলো। হাত ধরে বলল,
“খেয়া আমি আসি। ফোনে কথা হবে আমাদের। আমি হারাব না। এবার ভালো থাকবে অবশ্যই। ”
খেয়া ম্লান হাসে মাহমুদের মুখপানে চেয়ে৷
মাহমুদ নিজেকে সামলে অতিকষ্টে বাসায় এসে নিজের রুমে প্রবেশ করে। বিছানায় ধপাস করে পড়ে। মাথার চুল খামচি দিয়ে ধরে। ক্ষোভে, যন্ত্রণায় দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে তার হৃদয়টা।
মাহফুজা টের পেলেন ছেলে বাসায় এলো। তিনি ছেলের রুমে এলেন।
চিন্তাগ্রস্ত স্বরে কপাল ভাঁজ করে জিজ্ঞেস করলেন,
“কিরে মাহমুদ কি হলো? কি বিপদ তাদের? গেলি কখন? এলি এখন। রাত কয়টা বাজ?”
“খেয়াকে বিয়ে করতে হবে মা। নইলে ও মরে যাবে।”
বরফ শীতল গলায় মায়ের মুখপানে তাকিয়ে বলল মাহমুদ।
চলবে…১২
#তোমার_জন্য_সব *১৩
✍️ #রেহানা_পুতুল
বরফ শীতল গলায় মায়ের মুখপানে তাকিয়ে বলল মাহমুদ।
মাহফুজা শুকনো মাটিতে আছাড় খাওয়ার মতো নড়ে উঠলেন। দাঁড়ানো থেকে চেয়ার টেনে বসলেন। বুঝলেন ছেলের মুখ নিসৃত বাক্যটি ক্ষোভের ও অধৈর্য্যের।
তিনি বিস্মিত গলায় ছেলেকে শুধালেন,
“কাহিনী কি? কি শুরু করলো তারা এসব?”
মাহমুদ এ টু জেড মাকে বিস্তারিত বলল। মাহমুদা প্রচন্ডভাবে ক্ষেপে গেলেন ছেলের উপর। বললেন,
“কোন এককালে উপকার করেছে বলে তোর মাথা কিনে ফেলেছে নাকি। এরা গোটা পরিবার মেন্টাল। পাবনা মানসিক হাসপাতালে ভর্তি হওয়া দরকার এদের। যত্তসব আজাইরা যুক্তিখণ্ডন। এটা বাংলা সিনেমা? নায়কের উপকার করলো। এবার ধনীর অবুঝ দুলালীকে বিয়ে করে সেই ঋণ পরিশোধ করো। পথ চলায় এমন উপকার মানুষ মানুষের করেই। এর চেয়ে বড় বড় উপকার তোর বাবা মানুষের করেছে। আমি করেছি। কিন্তু আমরা কোন প্রতিদান আশা করিনি। এখন একবিংশ শতাব্দী। যুগ অনেক এগিয়ে। বহু মনোচিকিৎসক রয়েছে। চিকিৎসা করাক। দেশের বাইরে নিয়ে যাক মেয়েকে। তারাতো পয়সাওয়ালা।”
“মা থামোতো। এমন শুরু করেছ,মনে হচ্ছে বিয়ে হয়ে গেলো।”
“শোন,তুই আর কোন যোগাযোগ করিস না। তারা বা সেই মেয়ে করতে চাইলে বাহানায় এড়িয়ে যাবি।”
মাহমুদ মায়ের বোঝার জন্য বলল,
“প্রথমে তোমরাওতো খেয়া মেয়েটাকে পছন্দ করেছো।”
“করছি বলে মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যায়নাই। আমরাতো তাদের কোন পাকা কথাই দেইনি। আমি শীঘ্রই তোকে বিয়ে করাবো। এরপর দেখি সেই মেয়ে কি করে। আমাকে মেয়ে ও তার বাবার নাম্বার দে। কিছু কথা শোনাবো।”
“কাকে বিয়ে করাবা? পাত্রী কই?”
“কলি আছে না।”
” কলি বা তারা যদি রাজি না হয়?”
“চেষ্টায় কিনা হয়। দেখি। তুই রাজি কিনা সেটা বল? বাকিটা ওপরওয়ালার ইচ্ছা।”
মাহমুদ হেসে বলল,
“একজন পারে না বাসায় চলে আসে। আরেকজনের সঙ্গে ত কথাই বলা যাচ্ছে না দুনিয়ার সব ইগো,আত্মসম্মান, পারসোনালিটি নিয়ে বসে আছে উনি।হুহ্! আমি ভেবে জানাবো মা।”
” ঠিক হয়ে যাবে। সময় লাগবে। আমি।গেলাম। ঘুমাবো। টেনশন করিস না। ঘুমায়া পড়।”
মাহমুদ খিটখিটে মেজাজ নিয়ে ঘুমিয়ে পড়লো।
বিকেলের অবসরে কলি তার রুম লাগোয়া এক চিলতে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। সামনে দৃষ্টি প্রসারিত করলেই দেখা মেলে এক টুকরো উদার আকাশ। আজ আকাশের মন ভালো। তাই তার বুকে নেই কোন নীল মেঘের আনাগোনা। কেবলই থোকায় থোকায় গুচ্ছ পুষ্পরাশির ন্যায় সাদা মেঘপুঞ্জগুলো আপন মনে ভেসে বেড়াচ্ছে। তার বুক চিরে দু’ডানা মেলে উড়ে গেলো একটি অচেনা পাখি। একেলা পাখিটির মাঝে নীড়ে ফেরার তাড়া।
সঙ্গীর বিরহে পোড়া বিরহী প্রেমিকার মতো আনমনা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে কলি। তার কোন প্রেমিক বা ছেলেবন্ধুও নেই। মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে মেয়েদের জীবনে এসব আসার ফুরসত নেই। তাদের সময় কাটে,বেলা ফুরোয় যাপিত জীবনের রোজকার হিসেব মেলাতেই।
তখনই উড়ে এসে জুড়ে বসার মতো কলির ভাবনায় ঠাঁয় পেলো একটা বিষয়। মনে পড়লো মাহমুদ স্যারের মায়ের কথা। এক মিস বিহেভিয়ারের জন্য কম মাশুল দেয়নি স্যার। যথেষ্ট হয়েছে। শোধবোধ। উনার মা মিসেস মাহফুজা। এই নারীটি যেমন প্রাণোচ্ছল। তেমনি মমতায় ঘেরা তার অন্তরখানি। স্যারের বিয়েতে শুধু দাওয়াত নয় তাকে নিয়েই ছাড়বে এই স্নেহময়ী জননী। গায়ে হলুদ থেকে শুরু করে বিয়ের দিন,বৌভাত সবকিছুতেই হাস্যোজ্জ্বল উপস্থিতি থাকতে হবে তার। কি পরবে তখন। এত আয়োজনে পরার মতো ভিন্ন ভিন্ন ড্রেস কই? টাকাও কই? উপহারই বা কি দিবে? ত্রিশ দিন কাটাতে হয় যাদের হিসেব করে করে। সেখানে বিয়ের মতো আনন্দোৎসবে অংশগ্রহণ করার কথা কল্পনা করা তার জন্য বিলাসিতার নামান্তর।
আচ্ছা স্যারের বিয়ে কবে। কিঞ্চিৎ কৌতুহল জাগলো কলির মনে। এনগেজমেন্ট হয়ে গেলো নাকি। ক্লাসে এগুলো বলবে না স্যার। স্বাভাবিক। নিজের প্রয়োজনেই জিজ্ঞেস করে জেনে নিতে হবে স্যারের থেকে। তাহলে হয়তো যতটুকু সম্ভব আগে থেকে একটু পিপারেশন নেওয়া যাবে। হুট করে ইনভাইটেশন পেয়ে গেলে বিপাকে পড়ে যাবো। তবে ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করা যাবে না। এতে স্যার ধরে নিবে আমি তার বিয়ে খেতে উৎসুক হয়ে আছি। তার মাতো ছাড়বে না আমাকে। তাই জেনে নেওয়া। ভার্সিটি গেলে কথাপ্রসঙ্গে টপ করে জিজ্ঞেস করে ফেলবো।
কলির ভাবনায় ছেদ ঘটে রেবেকার আগমনে।
“হ্যাঁরে কলি তুই এখন কোন বর্ষে?”
“এটাতো সরকারি ভার্সিটি নয় আম্মু। এখানে সেমিস্টারের হিসাব। তোমার বোঝার সুবিধার্থে বলছি। আমি এখন তৃতীয় বর্ষে আছি অর্থাৎ সেভেন সেমিস্টারে আছি। কিন্তু কেন আম্মু বলতো?”
“নাহ এমনিই জানতে মন চাইলো।”
মলিন হেসে বলল রেবেকা।
কলি জানে মা কেন এটা জিজ্ঞেস করেছে। কারণ একটাই। তার পড়াশোনা যত দ্রুত শেষ হবে। তত দ্রুত একটা চাকরি করবে মেয়ে। টানাপোড়েন কমে আসবে সংসারে। কলি মাকে মোলায়েম স্বরে বলল,
“আম্মু তোমার মেডিসিন শেষ? তাহলে প্রেসক্রিপশনটা এনে দাও। একটু পরে স্টুডেন্টদের বাসায় যাবো। আসার সময় নিয়ে আসবো।”
রেবেকা চলে যায়। খানিক পর ফিরে আসে। কলির দিকে প্রেসক্রিপশনটা বাড়িয়ে দেয়। ধূসর মুখে চলে যায় পা ঘুরিয়ে।
কলির চোখ ভিজে উঠে আজ মাকে দেখে। ভাবে সংসারে এই মা নামক প্রাণটির কত ত্যাগ! কত যন্ত্রণা! নিরবে কত রোগ শোক বয়ে চলা স্রোতস্বিনী নদীর মতো। কলি সন্ধ্যার পর আসতে মায়ের ঔষধ নিয়ে এলো।
মাহফুজা পরেরদিন মেয়েকে ফোন দিলেন। যদিও স্বামীকে শুনান নি। অযথা টেনশন ঘাড়ে দেওয়ার মানে হয়না রিটায়ার্ড করা লোকটাকে। সব বললেন মেয়েকে। শুনে আনুশকা মাকে উপদেশের ভঙ্গিতে বলল,
“বুঝলাম। যেহেতু তোমার এতই পছন্দ ফুটন্ত কলিকে। অপরদিকে ভাইয়ার সঙ্গে কলির টিচার স্টুডেন্ট সম্পর্ক। এর বাইরে বাড়তি কোন সখ্যতা নেই। তাহলে একটু সময় নাও। ভাইয়া ট্রাই করে দেখুক, ভাব জমানো যায় কিনা। আর পারসোনালিটির জন্য যদি ভাইয়া না পারে এডভান্স হতে। তাহলে আট দশটা বাঙালী মেয়ের মতো বিয়ের প্রস্তাব পাঠাতে হবে তাদের বাসায়। যাও বিনা ভিজিটে এডভাইস দিয়ে দিলাম। সফল হলে আমায় ট্রিট দিতে বলবা তোমার একমাত্র পুত্রধনকে। ”
“এমন করে বলিস কেন? ফাজিল মেয়ে। তুইওতো আমার একমাত্র মেয়ে।”
মুঠোফোনের দু’প্রান্তে নির্মল হাসিতে ঢলে পড়লো মা, মেয়ে দুজনেই।
“আম্মু কলিকে বাসায় আরেকদিন নিয়ে আসতে বলনা ভাইয়াকে। আমি দেখবো ভালো করে বিয়ের পাত্রী হিসেবে। ”
“একবার আসছে। আর আসবে নাকি। আল্লায় জানে। আচ্ছা আমি বলছি তোর ভাইকে।”
মাহফুজা দেরী করলেন না। মাহমুদকে আনুশকার আবদারের কথা জানালেন। মাহমুদ বলল,
“আমি হার্ডলি ট্রাই করবো। তবে মনে হয়না কাজ হবে।”
“আচ্ছা দেখ। আমার কথা বলিস।”
দু’দিন পর মাহমুদ ক্লাসে গিয়েই খেয়াকে খুঁজলো মনে মনে। দেখলো খেয়া আসেনি ক্লাসে। এই ভিতরে তাদের থেকে কোন ফোনও,আসেনি তার কাছে। স্বস্তির দম ফেলল মাহমুদ। নয়তো ক্লাসেও হয়তো সবার সামনে সিনক্রিয়েট করে বসতো খেয়া। মাহমুদ দেখলো কলি এসেছে ক্লাসে। অফিসে গিয়ে কলিকে মেসেজ দিলো।
“ক্লাস শেষে অফিসে আসবেন।”
কলি মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে মাহমুদের।
“স্যার ডেকেছেন?”
“হুম। আমার ছোট বোন আনুশকা আপনাকে দেখতে চেয়েছে। কিবোর্ড এ আঙ্গুল চালাতে চালাতে ব্যস্ত সুরে বলল মাহমুদ। ”
কলি নির্বোধের মতো হেসে বলল,
“কারণ?”
“কারণ আপনার আন্টির অতিরিক্ত প্রশংসা আপনাকে নিয়ে।”
“ওহ বুঝলাম। বাসায় যাব না স্যার। উনি বাইরে আসুক না। সমস্যা কি? বাইরেই কোন কফিশপে আড্ডা দেওয়া যাবে।”
“ওহ সিউর কলি। তাই হবে। ম্যানি ম্যানি থ্যাংকস আমার আদরের ছোট বোনের ইচ্ছে পূরণ করার জন্য।”
” কারেকশন প্লিজ স্যার। ইচ্ছেটা এখনো পূরণ হয়নি। ও হ্যাঁ স্যার, খেয়া আর আপনার বিয়েটা কবে যেন?”
মাহমুদ হেসে ফেলল। বলল,
“কেন আসবেন নাকি?”
“আমি ইনভাইট পাবো নাকি?”
স্মিত হেসে বলল কলি।
“আপনার আন্টি আপনাকে ছাড়া আমার বিয়ে সম্পূর্ণ করবে না। এনিওয়ে, সেদিন রেস্টুরেন্টে আপনাকে নিলাম খেয়ার বিষয়ে কিছু কথা বলার জন্য। কিন্তু বলা হলো না। এখন আসুন না সময় থাকলে। এখানে এতক্ষণ কথা বলা দৃষ্টিকটু।”
ভরাট কন্ঠে বলল মাহমুদ।
“কোথায় আসবো স্যার?”
“সেখানেই আসুন। নাকি?”
“ওকে স্যার।”
মাহমুদ কলিকে খেয়ার বিষয়ে ডিটেইলস বলল। কলি আশ্চর্য হয়ে গেলো শুনে। হতভম্ব গলায় বলল,
“আন্টির কথায় আমি সহমত। এক পাক্ষিক ভালোবাসায় কোন পূর্ণতা আছে কি? এজ আর এজ পসিবেল আপনি বিয়ে করে ফেলুন। তখন ডাবল আপনাকে সিংগেল খেয়া আর বিরক্ত করবে না।”
“হুম করবো। মায়ের একটা মেয়েকে পছন্দ। তাদের বাসায় প্রপোজাল পাঠাবে বাবা। মা বলছে তার সঙ্গে আগে একটু ফ্রেন্ডশিপ করার চেষ্টা করতে। আমার মতো বোরিং ছেলের সঙ্গে কোন মেয়ে ফ্রেন্ডশিপ করবে বলেন?”
“আপনি চিনেন তাকে?”
মাহমুদ ধরা না পড়ার জন্য বলল,
“নাহ। মা বলল পরিচয় করিয়ে দিবে।”
“ভালো তো। সেটাই করুন। স্যার উঠি। বাসায় যেতে হবে।”
“বাইকে যেতে আপত্তি?”
“হ্যাঁ স্যার। ঘোর আপত্তি।”
কলি উঠে গেলো তাড়া করে। নিচে নেমে গেলো। বাস এলে উঠে গেলো ভীড় ঠেলে। মাহমুদ বিল মিটিয়ে দ্রুত নেমে এলো। কলিকে দেখতে পেল না। ভারী মুড নিয়ে বাসায় চলে গেলো মাহমুদ। বুঝলো কলির সঙ্গে এভাবে এগোনো এভারেস্ট জয়ের মতো। আবার নিজেও সরাসরি কিছু বলতে পারছে না। ব্যক্তিত্বে ভাটা পড়ে তাহলে। টিচার না হয়ে অন্য পেশায় হলে হয়তো বলা যেতো।
গ্রীষ্মঋতু শেষের দিকে। বরষার আগমনী সংকেত প্রকৃতিজুড়ে। এমন এক আলো আঁধারির শেষসন্ধ্যায় রেবেকা তাড়া দিলো কলিকে। পাশ থেকে নুরুল হকও বলে উঠলেন,
“কিরে মা। শাড়ি পরা হয়েছে? পাত্রপক্ষ এসে পড়বে যে। ”
“এইতো আব্বু রেডি হচ্ছি। বদ্ধ দরজার ভিতর থেকে গলা বাড়িয়ে জবাব দিলো কলি।”
রেবেকা ফের বলে উঠলো আশাবাদী কন্ঠে,
“সুন্দর করে রেডি হয়ে নে কলি। তারা বলছে দু’পক্ষের সবার পছন্দ এক হলে আজই তারা আংটি পরিয়ে দিবে।”
কলি মেঘমন্দ্র মুখে বিড়বিড়িয়ে বলল,
“আমার পছন্দের খেতা পুড়ি। এক জীবনে যার একজন ছেলে বন্ধু জুটল না কপালে। তার আবার বিয়ের পাত্র পছন্দ। তার পছন্দের গুরুত্ব থাকলে এই কাহিনী করতে না তোমরা আমার সঙ্গে।”
চলবে…১৩