তোমার জন্য সব পর্ব-০৭

0
22

#তোমার_জন্য_সব (৭)
✍️ #রেহানা_পুতুল
মাহমুদ স্তম্ভিত হয়ে কপাল ভাঁজ করে ফেলল। তার আহত মন ও শরীর আরো আহত হয়ে গেলো। দুমড়ে মুচড়ে একাকার হয়ে যাচ্ছে সে ভিতরে।

“ওহ! মাত্রই জানলাম। আপনাকে উষ্ণ অভিনন্দন স্যার। শুভবিবাহ মোবারকবাদ।”

আন্তরিক হেসে সন্তুষ্টি চিত্তে বলল কলি।

“আমি তোমার কাছে অভিনন্দন চেয়েছি কলি? আজ হাসপাতালে আমি তোমার জন্যই। তোমার আচরণ নিতে পারিনি বলে বেখেয়ালি ছিলাম। ব্রেন ঠিকভাবে কাজ করছিল না। তবে এখন তুমি আসাতে ভালো লাগছে। থ্যাংকস কলি। তোমরা মেয়েরা আসলেই ডেঞ্জারাস! পুরুষকে মারতেও পারো। বাঁচাতেও পারো।”

মনে মনে বিষাদ ঢেলে কথাগুলো বলল মাহমুদ।

মাহফুজা ভেজা স্বরে কলিকে বলল,

“জানো মা, তোমাদের স্যার আর কোনদিনও এভাবে বাইক এক্সিডেন্ট করেনি। তার আঠারো বছর বয়স থেকে সে মোটর সাইকেল চালায়। ও খুব সাবধানী। যদিও আবার বেশ জেদীও বটে। কাল যে ওর কি হলো। আল্লাহ আমার দিকে চেয়ে ওরে বাঁচিয়ে রাখছে। দেখো পায়ে পাঁচটা সেলাই দিয়েছে। ছিলে গেলো পা টা। ভাগ্যিস মাথাটা রক্ষা পেয়েছে হেলমেট থাকার জন্য।”

কলি মাহফুজার হাত ধরে শান্তনা দিলো।
“আন্টি ভেঙ্গে পড়বেন না। আমার তো শুনেই অনেক খারাপ লাগলো স্যারের জন্য। তাইতো ক্লাস শেষ করেই ছুটে এলাম। আল্লাহ রহম করেছেন।”

মাহমুদ নিরবে কলির কথাগুলো শুনতে পেলো। তার অশান্ত হৃদয় উদ্বেলিত হয়ে উঠলো নিমিষেই।

কলির সঙ্গে আনুষকাও সামান্যক্ষণ কথা বলল পরিচিত হয়ে। তারপর কলি উঠে দাঁড়ালো। মাহমুদের বেডের খুব কাছে গেল না। দুই হাত দূরত্ব বজায় রেখে দাঁড়ালো। হৃদ্যতাপূর্ণ কন্ঠে বলল,

“স্যার আমি আসি। আপনি কি খান না খান তাই কিছু আনতে পারিনি। সরি। সাবধানে পথ চলবেন। নিজের খেয়াল রাখবেন। আমি ফোন দিয়ে খবর নিবো।”

কলি তাদের সবাইকে সালাম দিয়ে কেবিন থেকে বের হয়ে গেলো। মাহমুদ দু’চোখ বন্ধ করে ফেলল। আবারও মনে মনে বলল,

“তোমার কিছু আনতে হবে না কলি। তোমাকে যে রূপে দেখেছি এই কয়দিন। সেখানে তুমি আমাকে দেখতে এসেছ। সুন্দর করে কথা বলেছ। এটাই আমার জন্য বড় সারপ্রাইজড। এটাই আমার বড় প্রাপ্তি।”

কলি বাসায় চলে গেলো। মাহমুদের কথা বেশিক্ষণ মাথায় রাখল না ইচ্ছে করেই। সামনের সপ্তাহে সেমিস্টার ফাইনাল। তাই ফ্রেস হয়ে কিছুক্ষণ রেস্ট নিয়ে পড়ার টেবিলে বসলো। হুট করে খেয়ার কথা মনে হলো তার। আপন মনে বলতে লাগল,

“খেয়া ফ্যাশনেবল। বড়লোকের মেয়ে।।মাঝে মাঝেই দেখতাম মাহমুদ স্যারের সঙ্গে হেসে হেসে কথা বলতো। আর সে যে মাহমুদ স্যারকে পছন্দ করে সেটা পরোক্ষভাবে তো বোঝালই। কিন্তু স্যারকে দেখে তো তেমন মনে হলো না। বিয়েটা কি পারিবারিকভাবে? নাকি স্যারের বন্ধুত্ব ছিল খেয়ার সঙ্গে। যেটা ক্লাসের কেউই বুঝতে পারেনি। ধূর জাহান্নামে যাক। কি ছাইঁপাশ ভাবছি নিজের পড়াশোনা রেখে।”.

কলি পড়ায় মনোনিবেশ করলো। তিনদিন হয়ে গেলো, মাহমুদ এখনো হাসপাতালে। সুস্থতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। ফোনেও কথা বলতে পারছে। বাসার লোকজন আসা যাওয়ার মধ্যে আছে। সন্ধ্যার পর মাহমুদের ফোন বেজে উঠলো। কেবিনে কেউ নেই। তার মা পাশের কেবিনের একটা বাচ্চাকে দেখতে গিয়েছে। মাহফুজা বরাবরই মানবিক! নরম মনের। অচেনা মানুষের দুঃখ, বেদনাতেও নিজে জর্জরিত হয়ে যান। টিভিতে, পত্রিকায় অপঘাতে মৃত্যুর সংবাদ পেলেও কেঁদে বুক ভাসান। মাহমুদ মায়ের এসব কোমল স্বভাবগুলো তেমন পায়নি। পেয়েছে বাবার মতো। ভিতরে চুরমার হয়ে গেলেও উপর দিয়ে সহজে সেই, আবেগ,অনুভূতি প্রকাশ করেনা।

মাহমুদ নাম্বার চিনতে পারল না। রিসিভ করে ম্যাড়ম্যাড়ে স্বরে হ্যালো বলল।

“স্যার আসসালামু আলাইকুম। আমি কলি বলছি। কেমন আছেন স্যার?”

মাহমুদ আপ্লুত হয়ে গেলো কলির কন্ঠ শুনে। কিন্তু কলিকে তা বুঝতে দিল না৷ মনে মনে আওড়ে নিলো,

“দূর্ঘটনা থেকে দেখি ভালো কিছুর আভাস পাওয়া যাচ্ছে। অন্তত কলি এবার স্বাভাবিকভাবে কথা বলবে অন্য সবার মতো।”

“স্যার চুপ হয়ে আছেন? আচ্ছা সরি। রাখি তাহলে। আপনার হয়তো খারাপ লাগছে কথা বলতে। একচুয়েলি আপনার নাম্বার ছাড়া আর কারো নাম্বার আমার কাছে নেই। তাই আপনাকেই কল দিতে হলো।”

মাহমুদ কলিকে ক্লান্ত গলায় ডেকে উঠলো।
“কলি রাখবেন না। আমি ঠিক আছি। কেমন আছেন? এ নাম্বার কার?”

“আলহামদুলিল্লাহ। আপনি এখন কেমন আছেন স্যার? এটা আমার আম্মুর নাম্বার। আপনার হোয়াটসঅ্যাপে ট্রাই করলাম। পেলাম না। পরে বুঝলাম। আপনি অসুস্থ। নেট ইউজ না করাটাই যুক্তিসঙ্গত। আপনার শারীরিক কন্ডিশন এখন কেমন স্যার?”

“শারিরীক কন্ডিশন ভালোর দিকে কলি। মানসিক কন্ডিশন ভালো না।”

“এটা স্বাভাবিক স্যার। একদিকে সামনে আমাদের পরিক্ষা। আরেকদিকে আপনার বিয়ে। সবমিলিয়ে চাপে আছেন আপনি। ”

মাহমুদ ক্রোধে নিজের হাত মুঠি করে নিলো। বলল,

“আপনার ধারণা ভুল কলি। এমন কিছুই না।”

কলি আলতো হাসলো মুঠোফোনের ওপ্রান্তে। হেয়ালি সুরে বলল,

“আচ্ছা বাদ দেন স্যার। সহজেতো মনে হয় ভার্সিটি আসতে পারবেন না। তাইনা স্যার?”

“এই ভিতরে আসা যাবে না। তবে আশাকরি আপনাদের এক্সামের সময় আসতে পারবো। ধন্যবাদ কলি ফোন দিয়ে আমার খবর নেওয়ার জন্য।”

কলি বিদায় নিলো। মাহমুদ দাঁতমুখ খিঁচিয়ে বলল,

আপনি একটা চিজ কলি। যতই আপনাকে দেখছি। অবাক হচ্ছি। আমার নিজের অজান্তেই আপনি আমার মনের বাগিচায় বিচরণ করতে শুরু করেছেন মুক্ত বিহঙ্গের ন্যায়। যতই আমি প্রসঙ্গ তোলার চেষ্টা করি কাছাকাছি হওয়ার জন্য। ততই আপনি দূরত্বের বেড়ি দিয়ে দেন। ভেবেছিলাম পালটা জানতে চাইবেন, কেন মানসিকভাবে ভালো নেই আমি। তা না করে হেসে উড়িয়ে দিলেন। সেদিনও একই কাজ করলেন।
প্রথমত’র বিষয়টা ইচ্ছে করেই এড়িয়ে গেলাম। যেন আপনার মাঝে কৌতুহলবোধ কাজ করে। মানুষ স্বভাবতই কৌতুহল প্রিয়। উৎসুক। কিন্তু আপনি যেন মনোযোগের সাথেই সেটা স্কিপ করে গেলেন। একবারও জানতে চাইলেন না প্রথমত কি? স্ট্রেঞ্জ কলি! আমিও টিচার হওয়ার দরুণ এরবেশি এডভান্স হতে পারছি না। উফফস! মাহমুদ সযতনে কলির মায়ের নাম্বারটা সেইভ করে নিলো মোবাইলে। হয়তো কাজে লাগতেও পারে।

মাহমুদ রিলিজ হয়ে বাসায় চলে গেলো। তার অসুস্থতার জন্য ছোট বোন আনুশকাও তাদের বাসায় রয়েছে। ড্রয়িংরুমে সবাই বসে নাস্তা করছে। টিভিতে খবর চলছে। মাহফুজা ছেলেকে জিজ্ঞেস করলেন,

“কিরে তোর সেই অভিমানী ছাত্রী তোকে একবারও দেখতে এলনা?”

“এলোতো মা। খেয়া ও রিমি যেদিন আসলো। তারপর যে মেয়েটা এলো সেইতো কলি। আবার গত পরশু ফোন করেও খবর নিলো।”

মাহফুজা বলল,
“আলহামদুলিল্লাহ! তোর সঙ্গে ইজি হচ্ছে হয়তো। আমি নামটা জিজ্ঞেস করতে ভুলেই গেলাম। তাই বুঝতে পারিনি সেইই কলি। এমন জানলে তারসঙ্গে আরো সময় গল্প করতাম। খুব ভালোলাগছে কলিকে আমার। কি আটপৌরে জীবন যাপন। কি পরিপাটি বসার ধরন। পোষাকে কি শালীনতা। ব্যবহারে কি মার্ধুযতা। কি স্নিগ্ধ! কি লাবন্যময়ী চেহারা!”

আনুশকা বলল,

“হ্যাঁ আমিতো জানি। সেই মেয়েটাই কলি। নাম জিজ্ঞেস করলাম আর বলল, কলি।কিন্তু ভাইয়ার অভিমানীনি কলি মানে?এই ভাইয়া কাহিনী কি বলো না?”

গলায় উৎসুক ভাব এনে জানতে চাইলো মাহমুদের ছোটবোন আনুশকা।

মাহমুদ বোনকে নেত্রপল্লব তুলে ইশারায় বলল,

“এখন বাবা আছে। পরে বলবে সব।”

আবদুর রহমান এতক্ষন অন্যমনস্ক ছিলেন। তাই কলির কথা শুনতে পাননি। মাহমুদ তার বাবাকে জিজ্ঞেস করলো,

“বাবা জরুরী কথা। আপনি যে পাত্রীর নাম্বার আমাকে দিলেন, সেই মেয়েতো ধানমণ্ডি পড়ে। নাম মাহি। তবে বাড়ির লোকেশন ঠিক আছে। কিন্তু সেদিন বললেন খেয়া। বুঝলাম না।”

আবদুর রহমান চকিতে চাইলো ছেলের দিকে। উদ্বিগ্ন গলায় বলল,

“কি বলিস। মাহি? ধানমন্ডি পড়ে? আমার ত নাম মনে নেই। কোথায় পড়ে তাও মনে নেই। তবে এই মেয়েটাকেই তো দেখলাম। আমাকে পা ছুঁয়ে সালাম দিলো। তার বাবাই ডেকে দেখালো। তুই ভালো করে খবর নিসতো।”

“আচ্ছা আমি খবর নিচ্ছি সহসাই। বিয়ের মতো মহৎ বিষয় নিয়ে ফাজলামো!”

বিরক্তিকর কন্ঠে বলল মাহমুদ।

তার মা বলল,
“কি ভূতুড়ে কাণ্ড! অন্য মেয়ে ফোন দিবে কেন তোকে? খেয়া মেয়েটা যথেষ্ট ভালো। সুন্দর। আমার পছন্দ হয়েছে।”

“ভাবি হিসেবে আমারও খেয়াকে বেশ ভালোলেগেছে। মিশুক! চটপটে! বন্ধুবৎসল! হাসিখুশি! প্রাণোচ্ছল! এমন মেয়েরাও ভালো মনের হয়। মনে যা আসে মুখে তা বলে দেয়। কোন ভণিতা করে না।”

মাহমুদ ঝিম মেরে মা বোনের কথা হজম করে গেলো বনজি ঔষধীর মতো।

আবদুর রহমান চলে গেলে মাহমুদ ছোটবোনকে সব জানালো। এবং সেদিন এক্সিডেন্ট হয়েছে কলি মেয়েটার জন্যই তাও জানালো মা,বোনকে। তারা দুজন আতংকিত চোখে তার দিকে চাইলো। তার মা বড় বড় চোখে জিজ্ঞেস করলো,

“কি বলিস? কিভাবে?”

মাহমুদ সেদিনের কাহিনি বলল। শুনে তারা দুজন বলল,

“এখানে কলি মেয়েটা কারণ। কিন্তু সে দায়ী নয়। দায়ী তুমি নিজেই। নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলছ। ইগোতে লেগেছে বেশ। সে তার স্থানে রাইট। বড্ড অভিমানীনি। ”

মাহমুদ থ বনে গেলো মা বোনের পক্ষপাতীত্ব কথায়। আহাম্মকের মতো চেয়ে রইলো তাদের দিকে। তাদের কথায় তার অশান্ত হৃদয়টা লায় পেয়ে গেলো। অজান্তেই কলির প্রতি একটা অদৃশ্য টান অনুভব করলো সে।

ডুবে গেলো কল্পনায়। পথ চলায় কাকে,কখন,কিভাবে ভালোলেগে যাবে,তা পূর্ব থেকে জগতের কোন মহামানবও বলতে পারবে না। ক্লাসের লাস্ট বেঞ্চে নিঃশব্দ রাত্রির মতো নিরালায় চুপটি করে বসে থাকা কলি নামের মেয়েটিকে তার ভালোলাগছে কেন? তার কথা সময় অসময়ে মনে পড়ে কেন?
উত্তর খুঁজে নেয় মাহমুদ নিজেই। হয়তো কলির প্রখর ব্যক্তিত্ব, প্রবল আত্মসম্মানবোধ,সংযমীভাব, নমনীয় আচরণ, দূরত্ব বজায় রেখে চলা, সরল, শালীন সাজসজ্জা ইত্যাদি। এসবের জন্যই সে একটা শক্ত আসন গেঁড়ে বসেছে মাহমুদে হৃদয়ে। নাগালের বাইরের জিনিসকে কাছে পাওয়ার দূর্বার আকর্ষণ মানুষের সেই আদিকাল হতেই।

আনুশকার ডাকে ঘোর কাটে মাহমুদের। মাহমুদ সুস্থ হলে একটা ফন্দী আঁটলো মনে মনে। সরাসরি মিট করে নিশ্চিত হতে হবে খেয়ার সঙ্গে।

তারপর মাহির সঙ্গে দেখা করার আগ্রহ প্রকাশ করলো মেসেজ দিয়ে। মাহিও রাজী হলো। এবং প্লেস জানিয়ে দিলো মাহমুদকে। যথাসময়ে মাহমুদ সেখানে চলে গেলো। কফিশপে বসে অপেক্ষা করছে। দেখলো তার সামনে এসে বসলো শাড়ি পরিহিত অচেনা একটি মেয়ে। সুন্দর!

হাই,হ্যালো পর্ব সেরেই মাহমুদ সহাস্য হেসে জিজ্ঞেস করলো,

“আপনি মাহি?”

“জ্বি না। আমি তনিমা। মাহির ভাবি। মাহি ভয়ে বাইরে দাঁড়িয়ে আছে।”

“কেন? পাত্রী পাত্রকে দেখবে না?”

তনিমা নিরিহ ঢংয়ে আকুতিমাখা সুরে মাহমুদকে বিস্তারিত বলল। এবং খেয়া মাহমুদের সঙ্গে মিলিয়ে নিজের ছদ্মনাম মাহি রাখলো। তাও জানালো।

মাহমুদ ক্রোধান্বিত হয়ে উঠলো। চোয়াল শক্ত করেও শান্ত সুরে বলল,

“ঠিকাছে ভাবি। বুঝলাম খেয়ার প্রবলেমটা। আচ্ছা দেখি কি করা যায়। আপনি বাইরে গিয়ে খেয়াকে পাঠান। সমস্যা নেই। আগে কথা বলি খেয়ার সঙ্গে।”

চলবে…
#Romantic #shortstory #shortstorywriter #rপুতুল #romanticsuspense #lovestory #loveshortstoryputul #writer #writing #genre #samajik #Rehana #putul

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে