#তোমার_জন্য_সব (৫)
✍️ #রেহানা_পুতুল
মাহমুদ বিমূঢ় হয়ে চেয়ে রইলো বাবা মায়ের মুখপানে।
মাহফুজা বললেন,
“কিরে কোন সমস্যা? মুখ অমন করছিস কেন?”
“সমস্যা নয়? আমি কিছুই জানিনা। আর বাবা পাত্রী ঠিক করে ফেলল?”
আবদুর রহমান একটু নড়ে চড়ে বসলেন চেয়ারে। মাহফুজা ছেলের পাশে গিয়ে খাটের উপর বসলেন দুই পা তুলে। ছেলেকে একটু স্বাভাবিক করতে বললেন,
“বাবা চা খাবি? বানাতে বলব?”
“হ্যাঁ বলো। মাথা ধরেছে। ”
“এই বাতাসী শুনে যা। এদিকে আয়।”
গলা হাঁকিয়ে ডাক দিলো আবদুর রহমান।
বাতাসী তড়িতেই এলো।
” খালুজান বলেন?”
“আমি না। তোর খালাম্মা কি বলে শোন।”
“বাতাসী কড়া করে মসলা চা বানিয়ে নিয়ে আয় তিন কাপ। দারুচিনি,লবঙ্গ,এলাচ,তেজপাতা,লবণ দিবি। ফ্রিজে ডিপ থেকে আদা নিয়ে ছেঁচে দিস।”
“আইচ্ছা খালাম্মা।”
মাহমুদ বলল,
“আশ্চর্য মা। প্রতিদিন চা বানানোর জন্য তুমি ওকে সেইম কথাগুলো বলো। কেন? ওর মনে থাকে না? ”
“ও ভুলে যায়। বাদ দে।”
“না কেন বাদ দিবো? এই বাতাসী দাঁড়া।”
বাতাসী বুঝলো মাহমুদ রেগে আছে। দাঁড়ালো নম্রভাবে।
“মা কি কি বলছে বল?”
বাতাসী ঠিক ঠিক সব বলতে পারলো।
“কিরে পারলি তো। পরে ভুলে যাস কেন? আজকের পর মা যেন আর তোকে কি কি দিবি বলতে না হয়। যা কিচেনে গিয়ে পড়ার মতো করে সবগুলো মসলার নাম মুখস্থ করে নিবি। আমি যেকোনো সময় জিজ্ঞেস করবো।”
বাতাসী রান্নাঘরে গিয়ে চা বসিয়ে দিলো। বিড়বিড়িয়ে উচ্চারণ করলো,
মাষ্টার সাব ঠিকই জানতে চাইবো। ভুইলা যাইব না। বলতে না পারলে মোর চাকরি ঝুইলা যাইবো।
বাতাসী অনবরত ছড়ার মতো টেনে টেনে বলতে লাগলো,
“রঙ চা বানাইতে নুন লাগে/আরো লাগে তেজপাতা।
খাইতে বড় স্বাদ লাগে/ দিলে একটু কুচি আদা।
দু’চারখান দারুচিনি লাগে/ গোটা কয়েক এলাচ।
দিতে পারলে চা হবে /এক্কেবারে ফাস কেলাস।
থাকলে লেবুর রসও লাগে/ আরো লাগে লং।
এক কাপ চায়ের লাইগা সবার/ দিলে কত ঢং।”
মাহমুদ তার বাবাকে বলল,
“বাবা ডিটেইলস বলো।”
তার বাবা পাত্রীর আদ্যোপান্ত শুনালো ছেলেকে। মাহমুদেরও মোটামুটি পছন্দ হলো শুনে। বলল,
“পাত্রীর নাম কি? কিসে পড়ে?”
“অনার্সে পড়ে। কোন ভার্সিটি জানিনা। নাম বলল কি জানি। এই মুহূর্তে মনে পড়ছে না।”
“এখন আমাকে কি করতে হবে?”
“তোর বাবা ও আমি চাই তুই একবার মেয়েটির সঙ্গে বাইরে কোথাও নিরিবিলি দেখা করে আলাপ করে নে। মেন্টালিটি ম্যাচ হওয়াটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। ”
বলল মাহফুজা।
“আমার যদি পছন্দ না হয়? আর কন্টাক করবো কিভাবে?”
“না হলে নাই। তবে পছন্দ হওয়ার মতই মেয়ে। মাশাল্লাহ। আমি মেয়ের নাম্বার এনেছি তার বাবার থেকে।”
“ঠিকাছে বাবা। তাদের বাড়ির এড্রেস দাও। আমি সময় করে আগে খোঁজখবর নিবো আমার মতো করে। এত তাড়ারতো কিছু নেই। ফোনে একবার কথা বলে দেখি ভালোলাগে কিনা? আনুশকা জানে?”
“নাহ। বলিনি। তোর পছন্দ হলে তবেই জানাবো তাকে।”
বাতাসী ট্রেতে করে চা এনে দিলো। সবাই চা খেয়ে প্রশংসা করলো তার। সে সলাজ হেসে চলে গেলো। আবদুর রহমান টেবিলের উপরে থাকা একটি নোটবুকের মধ্যে পাত্রীদের বাড়ির ঠিকানা লিখে দিলো। মোবাইল দেখে পাত্রীর মোবাইল নাম্বারও লিখে দিলো। পাত্রীর বড় ভাইয়ের ভিজিটিং কার্ড টেবিলে রাখলো। মাহমুদের থেকে বিদায় নিয়ে তার বাবা,মা নিজেদের বেডরুমে চলে এলো।
মাহফুজা যেতে যেতে বলল,
“মাথা ঠান্ডা রেখে সময় নিয়ে ভাবিস কিন্তু।”
মাহমুদের মাথায় বিয়ে নিয়ে কোন ভাবনাই ছিলো না। কিন্তু মাঝে মাঝেই তার মা,বাবা বিয়ের প্রসঙ্গ নিয়ে আসে। তারা তাদের মতো করে সুপাত্রীর সন্ধান করে যাচ্ছে গত একবছর ধরেই। একমাত্র ছোটবোন আনুশকার বিয়ে হয়ে গেলো গত বছরেই। তার পর হতেই তারা ছেলের বিয়ের জন্য উঠে পড়ে লেগেছে। কিন্তু মনমতো পাত্রী মিলছেই না। এটা হলে ওটা হয়না। কেবলই মিসম্যাচ হয়। মাহমুদ টেবিল থেকে পাত্রীর ঠিকানা, মোবাইল নাম্বার,ভিজিটিং কার্ডটি ভালো করে দেখে রেখে দিলো পূর্বের স্থানে।
কলি রাত জেগে জেগে এসাইনমেন্ট লিখছে। হাত ব্যথা করছে একটানা লিখতে। বারবার হাত ঝেড়ে নিচ্ছে আর খেয়া,রিমি,মাহমুদ স্যারকে ঝাড়ছে ইচ্ছেমতো। জুলি হঠাৎ চড়ুই পাখির মতো ফুরুৎ করে কলির রুমে ঢুকলো। কলি ভূত দেখার মতো চমকে উঠলো। ভ্রু কুঁচকালো। বলল,
“কিরে ঘুমাসনি?”
“নাহ। ভিডিও বানাই। আপা টিকটক করবি আমার সঙ্গে? তোকে অনেকেই দেখতে চেয়েছে সেখানে? টিকটকে চেহারা ফাটাফাটি আসে। তোরেও হেব্বি লাগবে।”
“আম্মুকে বলব গিয়ে? ফাজিল কোথাকার। যা বলছি।”
জুলি দু-হাত তুলে মোনাজাতের ভঙ্গি করে বলল,
“হে খোদা। আমার নিরামিষ আপার কপালে একটা নিরামিষ জামাই জুটায়া দিয়েন। নয়তো সেই বেচারার লাইফটাই বরবাদ হো গায়া। আমারে দিয়েন আমিষ জামাই। খালি সিনেমা আর বায়োস্কোপ দেখবো। ”
কলি চোখ কটমট করে তাকাতেই জুলি নিজের রুমে চলে গেলো। জুলি আর কলি একসঙ্গেই ঘুমাতো আগে। তাদের বড় বোন মিলির বিয়ে হয়ে যাওয়ায় জুলি সেই রুম নিজের করে নিলো। তার নাকি প্রাইভেসি দরকার। সে বড় হয়ে গিয়েছে। বেড শেয়ার করে ঘুমাতে তার সমস্যা হয়। মূলত সে দরজা বন্ধ করে ক্যামেরা অন করে নেচে গেয়ে ভিডিও বানায়। দোষ তার নয়। বয়সের। উড়াউড়ি, দুরন্তপনা,পাগলামি করাই কিশোরী বয়সের কাজ। তবে কলি তার বিপরীত। সে বরাবরই চুপচাপ নিরিবিলি থাকতে পছন্দ করে। পানসে জীবনে সে অভ্যস্ত।
মাহমুদ পরের দিন তার বাবার পছন্দ করা পাত্রীর বাড়ি দেখতে গেলো। রাস্তায় দাঁড়িয়ে দূর থেকে দেখে নিলো। তারও বেশ ভালো লাগলো। সুন্দর চারতলা বাড়ি মোহাম্মদপুরে। তাহলে এবার পাত্রীকে ফোন দেয়া যায়। সে অবসর হয়ে ফোন দিলো। পাত্রী সালাম দিয়ে সুন্দর করেই কথা বলছে। নাম বলল মাহি। পড়ে ধানমন্ডির একটি ভার্সিটিতে। মাহমুদ দেখা করার কথা বলল। মেয়েটি রাজী হলো। মাহমুদ বলল,
” ঠিকাছে মাহি। আপনার সুবিধামতে লোকেশন ও টাইম আমাকে হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ করে দিবেন।”
মাহি তার দুইদিন পর মেসেজ করে বলল,
“ভাইয়া আমি একটু ঝামেলায় আছি। দু’চারদিন পর আমরা মিট করিই?”
মাহমুদ রিপ্লাই দিলো।
“ঠিক আছে। সমস্যা নেই।”
“এভাবে সৌজন্যতার খাতিরে টুকটাক মেসেজে কথা হচ্ছে মাহি ও মাহমুদের।”
কলি একে একে সব স্যারের এসাইনমেন্ট জমা দিয়ে দিলো। মাহমুদ স্যারের একটা বাকি রয়ে গেলো এখনো। তারটা জমা দিতে হলো সবার শেষে। মাহমুদ ক্লাসে গেলে কলি জমা দিয়ে নিচু স্বরে বলল,
“স্যার খুব সরি। সরি ফর লেট।”
মাহমুদ কিছুই বলল না প্রতিউত্তরে। কলি নিজের বেঞ্চে গিয়ে বসল। সে বরাবরই পিছনে বসতে পছন্দ করে। মাহমুদ অফিসে বসে কলির এসাইনমেন্ট দেখছে। খেয়া প্রবেশ করলো রুমে।
সালাম দিলো মাহমুদকে। বলল,
“স্যার আপনার সঙ্গে আমার একটু কথা ছিলো। ভাবলাম ইমেইল বা মেসেজ দিবো। কিন্তু চিন্তা করলাম একবার ঝামেলা হয়ে গেলো। এভাবে আর না দেই।”
“ঝামেলা ত আপনাদের হয়নি। যা হওয়ার কলির ও আমার হয়েছে। সে সাফারার হয়েছে আমার আচরণের জন্য। ভুল বুঝলো আমাকে। এখন ত সে আমার ছায়া থেকেও দূরে থাকতে চায়।”
“এতে কি আপনার গিল্টি ফিল হচ্ছে স্যার?”
” একজন সুস্থ বিবেকবোধসম্পন্ন হওয়া মানুষ হিসেবে গিলটি ফিল হওয়াটা উচিত নয় কি?”
“তা অবশ্য রাইট স্যার।”
“কি যেন বলবেন আপনি? ”
“কিভাবে যে বলি স্যার? আচ্ছা স্যার ব্যক্তিগতভাবে আমি কি কখনো আপনার সঙ্গে অযাচিত ভুল আচরণ করেছি?”
“নাতো? হঠাৎ এমন কথার কারণ? ”
জানতে চাইলো মাহমুদ।
“স্যার সদ্য ঘটে যাওয়া বিচ্ছিন্ন ঘটনার পর হতে মনে হলো আপনি আমার উপরে ফেডাপ হয়ে আছেন। এগেইন সরি স্যার। এক্সট্রেমলি সরি স্যার।”
“ইটস ওকে খেয়া।”
“স্যার একটা আবদার ছিলো। ”
“বলে ফেলুন।”
“স্যার আমি আপনাকে ট্রিট দিতে চাই। এই ধরেন লাঞ্চ করা।”
“এটা কেন খেয়া?”
ভ্রুকুটি করে বলল মাহমুদ স্যার।
“এমনিই স্যার। কোন কারণ নেই।”
“পৃথিবীতে কারণ ছাড়া কিছুই ঘটেনা। সেটা অতি ক্ষুদ্র বিষয় হলেও।”
“স্যার…”
আহ্লাদী সুরে ডেকে উঠলো খেয়া।
“কারণ বলুন। তবে বিবেচনা করে দেখব।”
“কারণ বললে যদি আপনি উল্টো রিয়েকশন করে বসেন?”
মাহমুদ উঠে দাঁড়ালো। তীক্ষ্ণ মেজাজে খেয়াকে বলল,
“যেহেতু আপনি বুঝতে পারছেন এমন সম্ভাবনা আছে। তাহলে না বলা বেটার হবে আপনার জন্য। ”
মাহমুদ তার অফিস রুম হতে বেরিয়ে গেলো। খেয়া হতাশ নয়নে মাহমুদের চলে যাওয়া দেখলো। পা ঘুরিয়ে নিজেও চলে গেলো।
গ্রীষ্মের আকাশে মেঘের ঘনঘটা। থেকে থেকে গর্জন করে উঠছে। বৈশাখী ঝড় নামবে এখুনি। বলতে না বলতে শুরু হয়ে গেলো তার উম্মাতাল নৃত্য। ক্লাসের সবাই চলে গিয়েছে। খেয়াদের নিজেদের গাড়ি। রিমিকে নিয়ে সেও চলে গেলো। কলি কোনভাবে বাসস্টপেজে গিয়ে রাস্তার পাড়ে উঠে দাঁড়ালো। সে আজ ছাতা আনেনি। ছাতা নষ্ট হয়ে গিয়েছে। সময় হচ্ছেনা বলে ছাতা সারাই করতে বিলম্ব হচ্ছে।
মাহমুদ আগে থেকেই সেখানে ছিলো। বাইক থামিয়ে মায়ের জন্য মেডিসিন কিনতে লাগল। অমনি বৃষ্টি শুরু হলো। গতি মন্থর হওয়ার জন্য অপেক্ষা করছিলো। তখনই সে
কলিকে দেখতে পেলো পাড়ের শেষ প্রান্ত হতে। ঝড়ো হাওয়ায় কলির ওড়না বিক্ষিপ্তভাবে উড়াউড়ি করছে। কলি বারবার ওড়না সামলে নিচ্ছে। বৃষ্টির ছাঁটে মাহমুদের চোখের চশমার ফ্রেম ঘোলাটে হয়ে এলো। খুলে নিয়ে টিস্যু দিয়ে পানি মুছে আবার চোখে দিলো। এবার ভালো করে দেখলো কলিকে। কলি তাকে দেখেনি। ডাকলেও শুনবেনা।
মাহমুদ হেঁটে গিয়ে কলির পিঠ বরাবর পিছনে দাঁড়ালো। তার ছাতাটা কলির মাথায় উপরে ধরলো। কলি শুরুতে দেখতে পায়নি তাকে। মাথার উপরে কারো ছাতার আভাস পেয়েই চকিতে চাইলো পিছনে। হতবুদ্ধির মত দৃষ্টি তাক করলো স্যারের দিকে। নিমিষেই সরে গেলো।
“আহ! কলি ভিজে যাচ্ছেন।”
মাহমুদ দুপা এগিয়ে গিয়ে ফের কলিকে ছাতার ভিতরে নিয়ে নিলো।
বলল,
“বাসের জন্য অপেক্ষা? ”
“হুম স্যার।”
মাহমুদ খেয়াল করলো কলি নিজ থেকে কোন কথা বলছে না তারসঙ্গে। যেমন,
স্যার আপনি কেন এখানে? কিংবা আপনিও কি বাসের জন্য ওয়েট করছেন? এই জাতীয় প্রশ্ন।
“বাস ত আসছেনা। ঝড়,তুফানের মাঝে কতক্ষণ অপেক্ষা করবেন কলি?”
“সমস্যা নেই স্যার। বিকল্প ওয়ে নেই আমার কাছে। বাসা দূরে।”
“তাহলে সিনজিতে যান।”
কলি ইতস্তত বোধ করলো। বলতে পারল না,আমি মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়ে। টানাপোড়েনের মাঝে বড় হয়েছি।
“না স্যার। আমি ঠিক আছি। আপনি আসতে পারেন।”
“বাসা কোথায় আপনার?”
“পুরান ঢাকা। লালবাগ।”
“কলি আমি বাইকে আসা যাওয়া করি। আসুন পৌঁছে দিই।” আন্তরিক স্বরে বলল মাহমুদ।
কলি অবাক চোখে চাইলো মাহমুদের দিকে।
মাহমুদ চাপা হাসি দিয়ে বলল,
“আচ্ছা আমার সঙ্গে যেতে হবে না। কিন্তু কতক্ষণ এভাবে দাঁড়িয়ে থাকবেন। তারচেয়ে বরং উপরে আসুন। ফাস্টফুডের কিছু শপ আছে এখানে। অবিশ্রান্ত বৃষ্টি কমুক। তবেই যাবেন।”
“ধন্যবাদ স্যার। আপনার ছায়া থেকে,দৃষ্টি থেকে, আমি দূরে থাকতে ইচ্ছুক।”
কাঠ কাঠ গলায় বলল কলি।
চলবে..