#তোমার_জন্য_সব (৪)
✍️ #রেহানা_পুতুল
আমান স্যার রসিকতা করে বলল,
“হয়তো। নারী রহস্যময়ী। বোঝা মুশকিল। এদের অনেক আজগুবি ব্যাপার স্যাপার থাকে।”
সবাই নিজ নিজ ক্লাসে চলে গেলো চা পান করে। মাহমুদ স্যার ক্লাশ শেষে খেয়া,রিমি ও কলিকে গম্ভীর স্বরে বলল,
“আপনারা তিনজন আমার রুমে আসবেন। জরুরী প্রয়োজন।”
ওরা ব্যাগ নিয়ে ক্লাস থেকে বেরিয়ে গেলো। কলির মন ভালো নেই। মুড অফ এই ভেবে, স্টাডির প্রয়োজনেও মাহমুদ স্যারের সান্নিধ্যে যেতে হবে তাকে। কিন্তু তার কিছুতেই এই স্যারকে ভালোলাগে না এখন। ক্লাসের বাইরে দাঁড়িয়ে খেয়া, কলিকে বলল,
“কেন ডাকলো স্যার? তুই কিছু জানিস? আর তোকে ধন্যবাদ ম্যামকে মিথ্যে বলে আমাদের রক্ষা করার জন্য।”
কলির ইচ্ছে করেনা খেয়ার সঙ্গে কথা বলতে। খেয়া তাকে ধন্যবাদ দিলো নিজের স্বার্থে। কিন্তু ভুলের জন্য একটা সরিও বলল না। পাজী মেয়ে একটা।
নিরুপায় হয়ে কলি বলল,
” না জানিনা। তবে ম্যাম, স্যারকে বলছে এসাইনমেন্টের জন্য আমাকে টাইম দিতে।”
“ওহ! আচ্ছা চল যাই।”
ওরা তিনজন গেলো। মাহমুদ স্যার খাতা দেখতে দেখতে ওদের জন্য অপেক্ষা করছিলো মনে মনে।
“স্যার ডেকেছেন আমাদের।” বলল রিমি।
মাহমুদ মাথা তুলে তাকালো খেয়া ও রিমির দিকে। কলির দিকে দৃষ্টিপাত করল না। কলিও সেটাই চাইলো। কলি ওদের দুজন থেকে যথাসম্ভব দূরে দাঁড়িয়ে আছে। মাহমুদের মনে পড়লো নিজের বলা কথাটা।
‘ইন ফিউচারে আমার ছায়া মাড়াতেও চেষ্টা করবেন না।’
কলিও তাতে সহমত প্রকাশ করেছে। যার বহিঃপ্রকাশ এখন তার সামনেই দৃশ্যমান। কলির আত্মসম্মানবোধ ও ব্যক্তিত্ব মাহমুদের দৃষ্টি কাড়লো।
মাহমুদ স্যার খেয়াকে বললেন,
“আপনার আমাকে ফোন দেয়ার কথা ছিলো। ভুলে গেলেন?”
“না স্যার। সরি স্যার। একদম ভুলিনি। কিন্তু এরপর আর সময় সুযোগ করে উঠতে পারিনি।”
“ওকেহ। এখন বলুন। ফোনের টাকা বা এমবি সেইভ হবে।”
খেয়া নারভাস হয়ে চুপ করে আছে। রিমি খেয়াকে বলল,
“আমি বলি স্যারকে?”
“আচ্ছা।”
খেয়া মনে মনে ভাবলো,
আপনার নেক নজর পেয়ে ঝামেলাটা এড়ানোর জন্য দু’দুইটা দামী চকোলেট বক্স গিফট দিলাম। এখন দেখি ঘুষ দিয়েও লাভ হলো না। হুহ।
“স্যার আমি কি চলে যাবো?”
নিচু মাথায় বলল কলি৷
“ডাকলাম কেন তাহলে?”
কলির দিকে না চেয়েই বলল মাহমুদ।
কলি দাঁড়িয়ে নখ খুঁড়তে লাগলো। মাহমুদ চিবুকে হাত দিয়ে দৃষ্টিতে কাঠিন্যতা এনে রিমির দিকে চেয়ে,
“হ্যাঁ রিমি বলুন।”
রিমি ওদের মাঝে বলা কথাগুলো সব সম্ভব হলো না বলে একটু কাটছাঁট করে বলল।
“স্যার কিছুদিন আগে ক্যাম্পাসের মাঠে বসে বসে আমি আর খেয়া এটা ওটা বলে ফাজলামো করছিলাম। তো প্রসঙ্গক্রমে আমি আর খেয়া বলছিলাম মাহমুদ স্যার একটু ভিন্ন। পারসোনালিটিসম্পন্ন। দেখতেও ভালো। রুচিসম্পন্ন! স্মার্ট! তো আমিই প্রথমে বললাম, সাহিত্যের টিচারগুলো হয় মজার। কিন্তু মাহমুদ স্যারকে দেখলে মনে হয় অংকের শিক্ষক। রাতদিন অংকের জটিল সমাধান নিয়ে পড়ে থাকে। আর নয়তো ফিজিক্সের সূত্র নিয়ে রিসার্চ করে। কেমন গুরুগম্ভীর! খেয়া দুষ্টমি করে বলল,
” স্যারকে একটু বাজিয়ে দেখা যায়।”
“কিভাবে?”
“স্যারের সেল নাম্বার বা মেইলে মেসেজ দিয়ে। সেই মেসেজ এমন হতে হবে। যেন স্যারের মাথা ঘুরে যায়।”
“স্যার জানলে? আর এতে আমাদের কি বেনিফিট? ”
“মজা নেওয়া। এটাই লাভ। জানবে না স্যার।”
“কে দিবে?তুই না আমি?”
“আমরা দুজনের কেউই না। এমন কেউ দিতে হবে যেন স্যার স্তম্ভিত হয়ে যায়। অবিশ্বাস্য জিনিস যখন বিশ্বাসযোগ্য হয়ে উঠে তখন অন্যরকম কিছু ঘটে।”
“কে দিবে?”
“আমাদের ক্লাসে কলি মেয়েটা সবচেয়ে শান্তশিষ্ট। ভদ্র। নিরীহ গোবেচারা টাইপের। কারো সাতেও নেই পাঁচেও নেই । তার থেকে স্যার যখন প্রপোজাল পাবে। সেই মজাটা হবে।”
তখন মাঠের এক পাশে কলি ছিলো। আমরা ওকে ডাক দিলাম। কলিকে খেয়া অনুনয় করে বিষয়টা বলল। কলি কিছুতেই রাজী হলো না। পরে বলল, তোর অন্য কোন মেইল আইডি থেকে দে। তারপর স্যারের রিয়েকশনটা দেখতে চাই। তাও কলি রাজী হচ্ছিল না। পরে আমি ও খেয়া ওকে নানাভাবে পড়ার কথা বলে পেঁচিয়ে ফেলি। ও বাধ্য হয় আপনাকে ইমেইল করতে।
বলল,
“আমার মূল জিমেইল আইডি থেকে দিব না। অন্য মেইল থেকে দিবো। লিখে দে মেসেজ।”
“মেইলটা আমি ও খেয়া মিলে রেডি করে ওকে খাতায় লিখে দেই। এইই।”
মাহমুদ স্থির রইলো কিয়ৎক্ষণ। অনুধাবন করতে পারলো খেয়ার ধান্ধায় তাকে দিয়ে কলিকে ছোট করার বিষয়ওটাও ছিলো।
সে রিমি ও খেয়াকে বলল,
“আপনাদের জন্য নিদোর্ষ কেউ আমার কাছে অপর্যস্ত হলো। সেই তীব্র অপমান হজম করতে না পেরে ক্যাম্পাস ছেড়ে দিলো। মিসেস হেড তাকে ফোন দিয়ে ক্লাসমুখী করেছে। তার এখন এই সেমিষ্টারে রেজাল্ট খারাপ হবে। এত কিছুর দায়ভার কে নিবে? আপনারা দুজন আমার থেকে কি পানিশমেন্ট ডিজার্ভ করেন বলেন? বিশেষ করে খেয়া আপনি? ”
রিমি নিজ থেকেই বলল,
“স্যার আমি খুব সরি ও লজ্জিত। কলি তোকেও বলছি। সরিরে দোস্ত।”
খেয়া বুঝতে পারলো হিতে বিপরীত হয়ে গেলো। চাইলো কি। হলো কি। ওর প্ল্যান ছিলো কলি তার কথা স্যারকে বলে দিলে,স্যার তার প্রতি ইমপ্রেস হবে কিছুটা। টুকটাক কথোপকথনের মধ্য দিয়ে স্যারের সঙ্গে রিলেশনে জড়াবে। স্যারকে তার পছন্দ। তাই চালাকি করে ইমেইলের আশ্রয় নিলো কলিকে ব্যবহার করে। কিন্তু হায় বিধিবাম! ফন্দি ভেস্তে গেলো।
রিমির দেখাদেখি খেয়া গিয়ে কলির দুহাত ধরলো। বলল,
“সরি কলি। আমিই দায়ী এতসব কিছুর জন্য। সামান্য ফান করতে গিয়ে বড় কিছু ঘটে গেলো।”
কলি কিছু বলল না। নিশ্চুপ রইলো। তার সমস্ত ক্ষোভ স্যারের উপর। খেয়া,রিমি তো তাকে নাজেহাল করেনি। তাকে নাস্তানাবুদ করে ছেড়েছে স্যার। সে বারবার সত্য প্রমাণ করতে চেয়েছে। কিন্তু স্যার সেই সুযোগ তাকে দেয়নি। মাহমুদ খেয়া ও রিমিকে ভার কন্ঠে আদেশ করে বলল,
“আপনারা দুজন চলে যান। কলি এদিকে আসুন। আমার দুটো কোর্সের এসাইনমেন্টের টপিক জেনে নিয়েছেন? ”
খেয়া ও রিমি মলিন মুখে বেরিয়ে গেলো। কলিও চলে যেতে উদ্যত হলো। কারণ টপিক সে জেনে নিয়েছে।
“কলি আমি ডেকেছি আপনাকে। শুনতে পাননি?”
পিছন হতে মাহমুদের ডাক পেয়ে কলির পা থেমে গেলো। মাহমুদের সামনে এসে চোখ নামিয়ে বলল,
“স্যার আমি টপিক জেনে নিয়েছি ক্লাস লিডারের কাছ হতে। এজ আরলি এজ পসিবেল এসাইনমেন্ট শেষ করে জমা দিবো।”
“সবারগুলো দেওয়ার পরে আমার গুলো দিবেন। চাপ নেওয়ার দরকার নেই আমার দুটোর জন্য। কোন হেল্প লাগবে নোট করার বিষয়ে?”
“না স্যার। আমিই পারবো। ধন্যবাদ।”
“একজন ছাত্রী হয়ে অকারণেই শিক্ষকের নাম্বার ব্লক লিস্টে রাখা বেয়াদবি নয় কি?”
“স্যার আনব্লক করে দিবো বাসায় গিয়ে।”
“এখন করলে সমস্যা কি?”
কলি মৌন হয়ে আছে।
“আপনার মোবাইলটা দেখি।”
মাহমুদ হাত প্রসারিত করলো। কলি তার মোবাইল স্যারের হাতে না দিয়ে টেবিলের উপর রাখলো। মাহমুদ এই প্রথম ধীরে ধীরে কোন যুবতী মেয়ের ব্যক্তিত্বের প্রতি আকর্ষণ অনুভব করলো। অথচ ফ্রেন্ড সার্কেলে শুনতে পাওয়া যায়,এখনকার কলেজ, ভার্সিটির প্রায় মেয়েরা খুব এডভান্স। জড়তা নেই বললেই চলে এদের মাঝে। লায় পেলে ছেলেদের কোলে চড়ে বসে এরা। কই কলি মেয়েটা ত তার সম্পূর্ণ অপজিট।
মাহমুদ কলির মোবাইল টিপে তার নাম্বার আনব্লক করে নিলো। সেও ব্যক্তিত্ববান ছেলে। তাই মোবাইলটা কলির হাতে না দিয়ে তার সামনে ঠেলে দিলো। ঈষৎ হেসে বলল,
“বুঝলাম। আপনি নাম্বার ব্লক করতে পারেন। কিন্তু আনব্লক করতে পারেন না।”
মাহমুদ চাচ্ছে কলি একটু ইজি হউক। তার দিকে দৃষ্টি ফেলুক। চোখাচোখি হউক। নয়তো পড়ার বিষয়েও কোন হেল্প নিবে না মেয়েটি। কলিকে তার সরি বলতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু পারছে না। একজন শিক্ষক হয়ে ছাত্রীকে সরাসরি সরি বলা তার পারসোনালিটির সঙ্গে বেমানান। খাপছাড়া।
কলির ফর্সা নাকের ডগা রক্তিম হয়ে গেলো। এই স্যার এমন কেন? ফোঁড়ন না কেটে কথা বলতে পারে না?
“আমি আসি স্যার।” বিরস গলায় বলল কলি।
“আসুন।”
কলি চলে গেলো। মাহমুদ পিছন হতে কলির দিকে অপলক চেয়ে রইলো।
মাহমুদ বাসায় গেলে তার মা মাহফুজা তাকে জিজ্ঞেস করলো,
“হ্যাঁরে মাহমুদ। সেই কলি মেয়েটা আজ ক্লাস আসছে? ঠিকঠাকভাবে ক্লাস করছে?”
“হ্যাঁ মা আসছে। এভরিথিং ইজ ওকে।”
“তোর সঙ্গে কথা বলেছে? তুই সরি বলছিস তাকে?”
“আমার সঙ্গে কথা বলেনি স্বাভাবিকভাবে। সরি বলতে গিয়েও পারিনি। ছোট ছোট লাগে নিজেকে। তোমার নামও মনে আছে দেখছি?”
” কি মিষ্টি আদুরে নাম। কলি। ফুটন্ত কলি। মনে থাকবে না? আমার মতো বড্ড অভিমানী যে মেয়েটা। কতটা আঘাত পেলে, কতট আত্মসম্মানে বাধলে, তোর আচরণে, সে ভার্সিটি ছেড়ে দিতে পারে। ভাবছিস?”
মাহমুদ মায়ের দিকে চেয়ে রইলো এক দৃষ্টিতে। তিনি ফের বললেন ছেলেকে,
“ভুল যেমন ছোট বড় সবারই হতে পারে। তদরূপ সরিও ছোট বড় সবাইকেই বলা যায়।”
“বুঝলাম মা।”
“বুঝলে হবে না। ওকে কাল ডেকে সরি বলবি। একদিন আমাদের বাসায় নিয়ে আসিস। দেখব আমার চেয়েও বেশী অভিমানী নাকি। সেই বয়সে আমি যেমন ছিলাম।”
মাহমুদের কাশি উঠে গেলো মায়ের আগ্রহ দেখে কলির প্রতি। শুধু কি মায়ের আগ্রহ? তার নেই? একটু হলেও সৃষ্টি হয়েছে। মানুষের ভিতরে কাউকে নিয়ে কোন বোধ জন্মানোর জন্য একটা উপলক্ষ লাগে। সেই ইমেইল টা ছিলো হয়তো সেই উপলক্ষ। নইলে বারবার কলির কথা মনে পড়ছে কেন তার।
মায়ের কথায় মাহমুদের মন সামান্য প্রশ্রয় পেলো যেনো। রাতে সে মোবাইলটা হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করলো। ভাবলো,
কলি হয়তো এখনো জেগে আছে। এসাইনমেন্ট লিখছে। মেসেজে সরি বলব? না থাক। ও যেমন। বোবা কয়েকটি শব্দে সে সহজ হবে না। ভুল ও বুঝতে পারে। সরাসরি বলার ব্যবস্থা করবো। ভার্সিটিতে নয়। বাইরে হলে ভালো হয়। কিন্তু কিভাবে? এটাও তো এক কঠিন কাজ। মুনী ঋষির তপস্যার মতো। খেয়া হলে খুশীতে আত্মহারা হয়ে যেতো।
মাহমুদ ঘুমিয়ে পড়লো। কলিকে মেসেজে সরি বলা হলো না আর।
খেয়ার ভীষণ মন খারাপ। সে রাতেই নিরুপায় হয়ে তার ভাবিকে সব বলল। তার ভাবি তনিমা তাকে ভরসা দিলো কিছু একটা করবে বলে। একমাত্র ননদ বলে কথা।
তার একদিন পর মাহমুদ ক্লাসে গেলে কলি একটা কোর্সের এসাইনমেন্ট জমা দিয়ে দিলো। মাহমুদ ভরা ক্লাসে কিছু বলল না কলিকে। কিন্তু আশ্চর্য হয়ে গেলো। তাকে বলছে সবারগুলো দিয়ে তারপর যেন তারটা দেয়। সেখানো উল্টো একদিন পরেই দিয়ে দিলো। তারমানে ছাত্রী হিসেবে মাহমুদ স্যারের কোন আনুগত্য কলি নিতে চায়না। মাহমুদের ভিতরে এক অজানা অনুভূতি ঢেউ খেলে গেলো কলিকে নিয়ে।
মাহমুদ বাসায় এসে মায়ের সঙ্গে এই বিষয়টাও শেয়ার করলো। বলল,
” মনে হয়না ওর তেজ বেশী?”
“একদম না। তুই ওর সঙ্গে একটু আন্তরিক হয়ে কথা বলিস। যেই রোবট হয়ে থাকিস। মানুষ সহজ হবে কিভাবে তোর জন্য?”
“চেষ্টা করবো মা।”
তার দুদিন পরে এক রাতে আবদুর রহমান, স্ত্রীকে নিয়ে মাহমুদের রুমে প্রবেশ করলেন। দু’চার কথা বলে প্রসঙ্গ তুললেন,
“মাহমুদ তোর জন্য পাত্রী ঠিক করেছি আমি। উত্তম প্রস্তাব পেয়েছি। তোর মায়েরও বেশ পছন্দ হয়েছে সব শুনে। ঢাকায় সেটেল্ড। নিজস্ব বাড়ি। আমরা জানি তোরও পছন্দ হবে পাত্রীকে। আমি দেখেছি নিজে গিয়ে।”
মাহমুদ বিমূঢ় হয়ে চেয়ে রইলো বাবা মায়ের মুখপানে।
চলবে..