#তোমার_জন্য_সব (১)
✍️ #রেহানা_পুতুল
“কি ব্যাপার? আপনারা তিনজন কেন এসেছেন?
“স্যার আপনি নাকি আমাদেরকে ডেকেছেন?”
“এটা কে বলল?”
“কলি বলেছে স্যার।”
মাহমুদ গম্ভীর মুখে কলির দিকে চাইলো। বলল,
“মিথ্যা বললেন কেন কলি? আমি কেবল আপনাকে ডেকেছি।”
“স্যার আমি ভেবেছি এসাইনমেন্টের বিষয়ে আমাদের তিনজনকেই ডেকেছেন।”
নিচু গলায় বলল কলি।
মাহমুদ বিরক্তিকর কন্ঠে কলিকে বলল,
“ভার্সিটিতে পড়ুয়া একজন স্টুডেন্ট হয়ে যদি সঠিকভাবে কথার না মানে বোঝেন। তাহলে পড়াশোনা বাদ দিয়ে দেন।”
কলি ভীষণ অপমানিতবোধ করলো। পাশে দাঁড়ানো থেকে খেয়া ও রিমি বলল,
“স্যার আসলে এটা নয়। সত্যিটা হলো ও আপনার কথা শুনতে পেয়েছে। নার্ভাসনেস থেকেই আমাদেরকে সঙ্গে করে এনেছে। সরি স্যার।”
” তারমানে নার্ভাস হওয়ার কাজ করেছে কলি।”
ওরা তিনজন চুপসে যায়। দৃষ্টি বিনিময় করে একে অপরের।
“খেয়া, রিমি আসুন।”
খেয়া,রিমি চলে যায়। মাহমুদ চেয়ার থেকে উঠে রুমের দরজায় গিয়ে দেখে ওরা গিয়েছে কিনা। আবার এসে চেয়ারে বসলো। কলি জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে টেবিলের সামনে। মাহমুদ ল্যাপটপে তার মেইলে প্রবেশ করলো। কলিকে নির্দেশ দিয়ে বলল,
“এই মেইলটা পড়ুন কলি। এবং আমাকে শুনিয়ে পড়তে হবে। রুমে অন্যকেউই নেই। পড়ুন। হারিআপ।”
কলির বুক ধড়পড় করছে। ভয়ে তটস্থ হয়ে আছে। স্থাণু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
“স্যার দেখতে পাচ্ছিনা।”
“স্টাচু হয়ে থাকলে কিভাবে দেখবেন। ঝুঁকে আসুন ল্যাপটপের সামনে।”
“স্যার আমার কথা শুনুন প্লিজ।”
ভীতু স্বরে বলল কলি।
“শোনাশুনির পাত্র মাহমুদ নয়। পড়ুন বলছি।”
মৃদু ধমকে বলল মাহমুদ। কলি ঝুঁকতে গেলে বুকের ওড়না পড়ে যেতে থাকে। হাত দিয়ে ওড়না সামলে নেয়। মাহমুদ ঠায় চেয়ে আছে কলির মুখাবয়বের দিকে। কলি কম্পিত ঠোঁটে শব্দ করে পড়লো বাংলায় লেখা মেইলটি।
“আপনি আমার নামে একটা মামলা দিবেন স্যার। নইলে আমিই আপনার নামে মামলা দিয়ে দিবো। তাহলে দুজনের দেখা হবে প্রতি সপ্তাহে। বলতে পারেন এটা আমার পক্ষ হতে আপনার জন্য একটা আল্টিমেটাম। হুহ!”
পড়া শেষে কলি শুকনো ঢোক গিলে নিলো।
মাহমুদের চোখদুটো মরিচ লাল হয়ে উঠলো। টেবিলে চাপড় মারলো। কলি কেঁপে উঠলো।
“আপনাকে ত দেখলে মনে হয় ভেজা মাছটিও উলটে খেতে জানেন না। নিরীহ গোবেচারা টাইপের। অথচ আস্পর্ধা হিমালয়ের মতো। একজন টিচারকে প্রপোজাল করা মেইলে নাহ? তাও আবার ভিলেন স্টাইলে। ইডিয়েট কোথাকার! পিছনের বেঞ্চে বসেন এসব অসভ্যতামি করার জন্য? অন্য কোর্সের টিচারদেরকেও সেইম মেইল দিলেন নাকি? আমি চাইলে ক্লাসে সবার সামনে বা এখন খেয়া,রিমির সামনে আপনাকে অপমানিত করতে পারতাম। কিন্তু আমি একজন টিচার। এটা আমার সঙ্গে যায়না। যদি ছোট হতেন বয়সে, চাপটে পিঠের চামড়া তুলে নিতাম। তাই ভদ্রভাবে আপনাকে সতর্ক করে দিচ্ছি। ইন ফিউচারে আমার ছায়া মাড়াতেও চেষ্টা করবেন না। কি মনে থাকবে? ”
“স্যার খুউব মনে থাকবে। তবে সত্যি বলছি এই মেইল আমি আপনাকে দেইনি। ওদেরকে ডেকে আনি। শুনে নিন।”
ভীরু ও বিব্রতকর স্বরে বলল কলি।
” দাঁড়ান। কাউকে ডাকতে হবে না।
যেই মেইল হতে আমাকে মেইলটা করা হয়েছে। এটা আপনার মেইল নয়?”
“স্যার…”
“এক শব্দে আনসার চাই। ইয়েস অর নো। এই মেইল আপনার নয়?”
“হ্যাঁ।”
“এনাফ। এবার আসতে পারেন।”
“আমাকে ভুল বুঝেছেন স্যার। বিষয়টা ভিন্নরকম।”
“গো আউট।”
কলির জলপূর্ণ চোখদুটো টলমল করছে। চোরের মতো পালিয়ে গেলো কলি মাহমুদের সম্মুখ হতে। ওয়াশরুমে ঢুকে পানির ট্যাপ ছেড়ে দিলো। হুড়মুড় করে আটকে থাকা অশ্রুগুলো ঠেলেঠুলে বেরিয়ে এলো আঁখিযুগল হতে। চোখেমুখে পানির ঝাপটা দিয়ে দিলো। ক্লাসে গিয়ে ব্যাগ হাতে নিয়ে বেরিয়ে গেলো। সবাই যারযার মতো ব্যস্ত। খেয়া ও রিমি কলির পিছনে ছুটে এলো। হাত ধরে থামালো। কলি তাদের হাত ঝাড়া দিয়ে সরিয়ে দিলো প্রচন্ড ক্ষোভে।
“এই কলি। তোর মুখে অমাবশ্যা ভর করলো কেন? মাহমুদ স্যার কি বলল?”
“তোদের সঙ্গে আর কোন কথা নয়। তোদের জন্যই আজ মাহমুদ স্যার আমাকে কি ইনসাল্ট না করলো।”
কলি স্যারের বলা সবকথা ওদেরকে শুনালো।
“স্ট্রেঞ্জ! এতদিন পরে স্যার মেইলদাতাকে খুঁজে বের করলো কেন?”
“তা আমি কি করে জানি। গেলাম। ভালোথাকিস তোরা।”
কলি লম্বা লম্বা পা ফেলে ভার্সিটির আঙিনা ছেড়ে যায়। খেয়া ও রিমি অনুতপ্ত হয়। ঠিক করে দুজনে মিলে স্যারকে সত্যিটা বলে দিবে। রিমি খেয়াকে বলে,
“দোস্ত, এই ক্যাবলাকান্তরে মুরগী বানাতে গিয়ে নিজেরাই মনে হয় এখন মুরগী হতে হবে। সত্যিটা বলা যাবে?”
“আরেহ ছাড় মামু। একটা বুদ্ধি বের করবো। জাস্ট ওয়েট।”
“কিভাবে? দেখলি কলিরে কি ধোলাই দিলো। তুই কিভাবে হাত করবি তোর ড্যাসিং হিরো মাহমুদ খানকে?”
খেয়া ফিচলে হাসে। বলে,
“কলি দেখতে কেমন ল্যাবেনডিস। গেঁয়ো। আর আমার লুক দেখ। ম্যালা ডিফারেন্স। বুঝলি রিমিঝিমি।”
“আহ প্রেম! মধু মধু! তুই পারবি। হিম্মতি বালিকা।”
বনানীর একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মাহমুদ খান। এই বিশ্ববিদ্যালয় দিয়েই তার কর্মজীবন শুরু। লেকচারার, সিনিয়র লেকচারার, অতিক্রম করে সদ্য সহকারী অধ্যাপক পদে নিযুক্ত হয়েছেন নিজ মেধায় ও প্রজ্ঞায়। শিক্ষক পিতা আবদুর রহমানের একান্ত ইচ্ছে ছিলো ছেলেও যেন তার মতো এই মহৎ পেশায় যুক্ত হয়। সেভাবেই ছেলেকে গড়ে তুলেছেন।
পনেরো দিন আগে আসা মেইলটি হঠাৎ মাহমুদের চোখে পড়ল সাতদিন পূর্বে। অবাক হয়ে গেলো সে। কয়েকবছর ধরে আছে এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। অথচ এমন অপ্রীতিকর কিছু কখনো তাকে ফেইস করতে হয়নি। ভয়ানক ক্ষেপে গেলো সে। মেইলটা এসেছে একটি ছেলের মেইল এড্রেস হতে। তার ডাউট হলো। একটা ছেলে তাকে এমন মেইল দিবে কেন? ব্যস্ততার ফাঁকে অবসর পেলেই সে বিভিন্ন পক্রিয়া চালিয়ে যেতে লাগলো। উদ্দেশ্য খুঁজে বের করে পানিশমেন্ট দিতে হবে মেইলকারীকে। নয়তো প্রশ্রয় পেয়ে যাবে। অবশেষে সে নিশ্চিত হলো এটা একটি মেয়ের মেইল এড্রেস। কিন্তু কে সেই মেয়ে। মাহমুদ কৌশল করে সেই মেইলের রিপ্লাই দেয়।
“কাল তুমি ক্লাসে আসার সময় ভার্সিটির মেইন গেইটের পাশে যে কাঁচা ফুলের দোকান রয়েছে। সেখান থেকে দুটো গোলাপ নিয়ে নিও। আমার পক্ষ থেকে গিফট তোমার জন্য। আমি বলে রেখেছি। আমি নিরস মানুষ। রস করে মেইল দিতে পারলাম না বলে দুঃখিত!”
পরেরদিন দশটায় মাহমুদ একটি ফটোকপির দোকানের ভিতরে দাঁড়িয়ে থাকে। বাহানা করে কিছু সিট ফটোকপি করতে দেয়। তবে সুক্ষ্ম চাহনি পথের উপরে। দেখলো কলি নামের ভোলাভালা মেয়েটি ফুলের দোকানে গিয়ে দাঁড়ালো। ইতি-উতি চাইলো। দোকানিকে কিছু একটা বলল। এবং দোকানি তাকে টকটকে দুটো তাজা ফুটন্ত গোলাপ হাতে দিলো। কলি ফুলগুলো হাতে নিয়ে নেড়েচেড়ে রেখে দিলো। না নিয়ে চলে গেলো।
পিছন দিয়ে মাহমুদ দোকানে এসে জানতে চাইলো,
“মামা মেয়েটি ফুল নিল না কেন?”
“কি জানি স্যার। রাইখা চইলা গ্যালো। কিছুই কইল না।”
মাহমুদ বিস্মিত হলো কিছু কারণে। কলির মতো শান্ত স্বভাবের মেয়ে তাকে এই মেইল দিতে পারলো? কিন্তু কেন সে ফুল নিলনা। হয়তো হাতে তুলে দেওয়া হয়নি বলেই। আরো বিস্মিত হলো, সে ভেবেছে এটা খেয়ার কাজ। খেয়া মেয়েটি বেশ চটপটে ও মর্ডান। পোষাকেই বোঝা যায় ধনীর দুলালি। যদিও তার সঙ্গে কখনো অমার্জিত আচরণ করেনি। কি আশ্চর্য! মানুষ ভাবে এক হয় আরেক।
মাহমুদ ভীষণ চটে আছে আছে কলির উপরে। ক্লাসে গিয়ে নোট দেখার অজুহাতে কলিকে আস্তে করে বলল, যেন ক্লাশ শেষে তার অফিস-রুমে যায়। কলি নার্ভাস ফিল করে। খেয়া ও রিমিকে নিয়ে যায়। তবুও রক্ষা পায়না মাহমুদ স্যারের তর্জন গর্জন হতে। কঠিন ভাষায় ঝেড়ে তার হৃদয়টা ক্ষতবিক্ষত করে দিয়েছে। তাহলে ফুল রাখলো কেন? তাকে ধরার জন্য? সেটাই হবে।
সেদিনের পর হতে কলিকে ভার্সিটিতে ক্লাসে আর দেখা যায়নি। মানুষ মন্দ এবং ভালো দুটো কাজের জন্যই কারো নজরে পড়ে যায়। তাই কলিকে মাহমুদ মন্দ কাজের জন্যই ভালো করে চিনে নিলো। একদিন ক্লাসে গিয়ে ওর কথা জিজ্ঞেস করলো মাহমুদ।
“কলি নামের মেয়েটি আসেনা কেন? কেউ বলতে পারবেন?”
মাঝ বেঞ্চ হতে কেউ একজন গলা তুলে বলল,
“স্যার কলি আর কোনদিন ক্লাসে আসবে না। স্টাডি ছেড়ে দিয়েছে।”
চলবে।