তোমার ছায়া পর্ব-২২

0
1730

#তোমার ছায়া (পর্ব ২২)
#মেহেদী_হাসান_রিয়াদ

সাদাফ ও ফারহার রিলেশন থাকা কালিন এক সাথে তোলা ছবি গুলোর দিকে পলকহীন ভাবে তাকিয়ে আছে আবরার। পাশেই মুখে হাসির রেখা ফুটিয়ে রেখে ড্রাইভ করছে সাদাফ।
সাদাফ একটু হেসে বললো,
– ফারহার প্রিয় জায়গা কোনটা জানো?
আবরার কিছুক্ষন চুপ থেকে বললো,
– কোনো খোলামেলা নির্জন জায়গা অথবা কোনো কুল কুল পানির শব্দ কানে আসে এমন নদীর পাড়।
সাদাফ ড্রাইভ করতে করতে বলে,
– এক্সেক্টলি,,, তোমাকে একটা জায়গায় নিয়ে যাই চলো।
বলেই কিছুক্ষন পর একটা নদীর পাড়ে নিয়ে গেলো আবরার কে।

ইদানিং মাঝে মাঝে বৃষ্টি হওয়ায় নদীর পানিও বেড়েছে অনেক। নদীর বুকে ভেষে সবুজ কচুরিপানা গুলো এক পাশ থেকে ভেষে ভেষে অন্য দিকে হাড়িয়ে যাচ্ছে।
সাদাফ একটা ছোট পাথর নদীর দিকে ছুড়ে মেরে বলে,
– আমরা প্রথম দেখা টা এখানেই করেছিলাম।
আবরার একটু বিরক্ত নিয়ে বললো,
– তো আমাকে এখানে কেন নিয়ে এসেছো? আর তোমার মতলব টা কি ডিরেক্টলি বলো।
– আচ্ছা তাহলে সোজাসুজি ভাবেই বলি। তুমি তো এখন বিশ্বাস করলে যে ফারহার সাথে আমার রিলেশন ছিলো?
আবরার ভ্রু-কুচকে বললো,
– ছিলো? তার মানে এখন নেই? তাহলে ব্রেকআপ হয়েছে কেন তোমাদের?
সাদাফ আবারও হেসে বললো,
– বাহ্, স্বামী হয়ে স্ত্রীর প্রাক্তনের কাছে প্রেম কাহিনি শুনতে চাইছো? সহ্য করতে পারবে তো?
আবরার চোখ বন্ধ করে একটা শ্বাস নিলো। তারপর বললো,
– তুমি চাও টা কি?
– ফারহাকে ছেরে দাও ভাই, আর আমার জীনিস আমাকে দিয়ে দাও। প্রয়োজনে তুমি যা চাইবে তাই পাবে।
আবরার একটু রাগ কন্ট্রোল করে বললো,
– ফারহাকে কি তোমার এতোটাই সস্থা মনে হয় যে, আমি কিছু চেয়ে বিনিময়ে ফারহাকে তোমার কাছে দিয়ে দিবো? দেখো সাদাফ আমি এতোটাও মহৎ নই যে নিজের ভালোবাসাকে অন্যের হাতে তুলে দিবো। হ্যা বিষয় টা যদি এমন হতো যে, তোমাদের রিলেশন আছে। আর ফারহাও তোমাকে ভালোবাসে, তাহলে আমি বিষয়টা ভেবে দেখতাম।
সাদাফ এবার একটু সিরিয়াস লুক নিয়ে বলে,
– দেখো ফারহার সাথে যে আমার অনেক কিছুই ছিলো, তার সব প্রমানই এই ফোনে আছে। এসব কিছু অন্যরা জানলে তোমার মান সম্যান থাকবে?
আবরার একটু কপাল কুচকে বললো,
– কোথায় প্রমান?
সাদাফ কপালে হাত রেখে বললো,
– এতোক্ষন ধরে তো নিজের চোখেই দেখলে।
আবরার এবার হাতে থাকা সাদাফের ফোনটা ছুড়ে নদীর জলে ফেলে দিয়ে সোজা হয়ে দাড়িয়ে বললো,
– এবার দাও প্রমান।
সাদাফ কিছুক্ষন হা করে নদীর দিকে তাকিয়ে থেকে পরে আবরারের দিকে চোখ ফিরিয়ে বললো,
– কি করলে এটা তুমি? ওই ফোনে আমার কতো গুরুত্বপূর্ণ কিছু জিনিস ছিলো। আর এটা আইফোন থার্টিন। তোমার তিন মাসের ইনকাম দিয়েও এমন ফোন নিতে হিমশিম খাবে।
আবরার এবার সাদাফের চোখে চোখ রেখে বললো,
– যাই থাকুক, আমার কাছে ফারহার চেয়ে দামি আর কিছু নেই।
বলেই আবরার হাটা ধরে একটা গাড়ি ডেকে উঠে পরলো বাড়ি যাওয়ার উদ্দেশ্যে। ওদিকে সাদাফ একনো হা হয়ে তাকিয়ে আছে, এটা কি হলো?

বাড়ি যেতে যেতে টিসু দিয়ে কপালের ঘাম মুছতে লাগলো আবরার। ঘাম মুছে গাড়ির সিটে হেলান দিয়ে বাইরের দিতে তাকিয়ে আছে।
সেইদিনের কথাটি মনে পরলো আবার।

~ আয়রিনের বিয়েতে সাদাফকে অন্য একটা মেয়ের সাথে দেখে অস্থির হয়ে ছিলো ফারহা। তার চেয়ে বেশি অবাক হয়েছিলো সাদাফ কে এখানে দেখে। তার সারা চোখে মুখে হতাশা ও অস্থিরতার ছাপ ফুটে ছিলো পুরোপুরি। সেদিন যখন আবরারকে সাদাফের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করেছিলো তখনও কেমন অন্য মনস্ক দেখাচ্ছিলো ফারহাকে।
সাদাফকে কিভাবে চেনে সে? আর তাকে এমন দেখাচ্ছে কেন? একটু প্রশ্ন জাগলো আবরারের মনে। আবরার তখনও জানতো যে ফারহা আবরারকে পছন্দ করে। তবুও অন্য ছেলের কথা বলতে ফারহাকে এতোটা বিষণ্ন দেখাচ্ছিলো কেন?
সেদিন এসব ফারহাকে আর জিজ্ঞেস না করে খোজ নিতে লাগলো বিষটা আসলে কি? তখনই ফারহা আর সাদাফের সম্পর্কটা জেনেছিলো সে। বাট ফারহাকে কিছু বুঝতে দেয়নি আর। কারণ দোষটা সাদাফেরই ছিলো। তাই আজ সাদাফের ফোনটা হাতে পেয়ে ও পুরোনো প্রেমিকের সাথে ছবি গুলো দেখে তা নদীতে ফেলে দিয়েছে। কারণ ওসব ছিলো ফারহার অতিত। আর ফারহার সাথে অন্য কারো স্মৃতি জড়িয়ে থাকুক এটা সে কোনো ভাবেই চায় না। তাই সব প্রমান, সব স্মৃতি নদীর সাথে ভাসিয়ে নিয়ে গেলো।

তবুও অস্থির লাগছে আবরারের। আজ বাসায় গিয়ে ফারহাকে বিষয়টা জিজ্ঞেস করতে হবে। দেখবে সে তার কাছে কিছু লুকায় কি না? কারণ ফারহার সব বিষয়ে জানার অধিকার আছে।
,
,
রাতে খাবার টেবিলে বাবা মা ও ফারদিন একসাথে খাবার খেতে ব্যাস্ত। মা ফারদিনের দিকে তাকিয়ে বলে,
– কালকে গিয়ে ফারহাকে নিয়ে আসবি এই বাড়িতে।
খাওয়ার সময় মায়ের মুখে আচমকাই এমন কথা শুনে যেন বিষম উঠে গেলো তার। মা আজ নিজেই ফারহার কথা বলছে, এটাও কি সম্ভব? নাকি পুরোটাই স্বপ্ন দেখছে। তবুও সব চিন্তা ভাবনা এক পাশে রেখে একটু পানি খেয়ে মায়ের দিকে চেয়ে বললো,
– সত্যিই বলছো মা?
মা স্বাভাবিক ভাবেই উত্তর দিলো,
– হ্যা, কালকে গিয়ে নিয়ে আসবি। আমাদের মেয়ে কেন পালিয়ে বিয়ে করে শশুর বাড়িতে চোরের মতো থাকবে? অন্য আট দশ টা মেয়ের মতো তারও ধুম ধাম করে সব হবে। সেদিন নিয়ে যাওয়া চোরের মতো নয়। বৌ বেশে ওই বাড়িতে যাবে সে।
ফারদিন এবার এক পলক বাবার দিকে তাকালো। দেখে বাবাও কিছু না বলে চুপচাপ খাচ্ছে। মানে নিরবতা সম্মতির লক্ষন ধরে নিলো সে।
মা আবার বললো,
– যা হওয়ার তা হয়ে গেছে। আমরা এমন আচরণ করলে বা সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন রাখলেও আর কিছু ঠিক হবে না। আর আমাদের ইগো থেকে দামি হলো ফারহার সুখে থাকাটা।
,
,
সেই সন্ধার আগে বাসায় ফিরার পর থেকে ফারহার সাথে তেমন একটা কথা বলেনি আবরার। ফারহা বিষয়টা খেয়াল করে কয়েকবার আবরারের কাছে গিয়েছিলো। কিন্তু প্রতিবারই মুখটা গম্ভির দেখালো তার।

রাতের বেলায় খাওয়া শেষে ছাদে হাটাহাটি করছিলো আবরার। তখনই ফারহা পেছন থেকে গিয়ে বলে,
– আপনার সমস্যা টা কি বলুন তো? আমাকে ইগনোর করছেন কেন?
আবরার পেছন ফিরে দেখে ফারহা কোমরে দুই হাত দিয়ে দাড়িয়ে রাগি দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে। ফারহার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে আবরার শান্ত ভাবে বললো,
– কেন এমনটা মনে হলো?
– দেখুন আমি বাচ্চা না যে এসব বুঝবো না। আর আমি কোনো ভুল করলে বা কোনো অন্যায় করে ফেললে তা সরাসরি বলে দিবেন। দুজন কথা বলে সমাধান করে ফেলবো। এভাবে গাল ফুলিয়ে থাকা কথা না বলা ইগনোর করা, এসব আমার ভালো লাগে না।
আবরার অন্য দিকে তাকিয়ে বললো,
– কিছুনা, এমনি মনটা ভালো না তাই।
ফারহা আবার বললো,
– কিছুতো নিশ্চই হয়েছে, বলুন না কি হয়েছে?

আবরর এবার সোজা হয়ে দাড়িয়ে তার দিকে চেয়ে বললো,
– তোমার কোনো বয়ফ্রেন্ড ছিলো?
ফারহা কিছুক্ষন নিশ্চুপ থেকে মাথা নিচু করে বললো,
– আপনার কাছে মিথ্যে বলবো না। হুম ছিলো আগে।
– তো আমাকে আগে বলোনি কেন এটা?
ফারহা মন খারাপ করে বললো,
– ভয়ে বলিনি, যদি আপনি এসব শুনে আমাকে ছেরে চলে যান তাই।
– তো এখন কেন বললে?
– আপনি জিজ্ঞেস করেছেন তাই।
– যদি এখন ছেরে চলে যাই?
ফারহা এবার আর কোনো উত্তর না দিয়ে হুট করে আবরার কে জড়িয়ে ধরে নিশ্চুপ হয়ে রইলো। হুট করে তার এমন অনুভূতি তৈরি হওয়ার কারণটা সে নিজেও জানেনা। শুধু এটাই বুঝতে পারছে, আবরার কেন ছেড়ে যাওয়ার কথা বলবে? কেন বলবে সে? কোথায় যাবে? আমি যেতে দিবো না। কিছুতেই দিবো না।
,
,
সবাইকে সব কিছু বুঝিয়ে ফারহাকে নিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিলো ফারদিন। ভয়ে ধুক ধুক করছে ফাহার বুক। গিয়ে বাবা মায়ের সামনে কিভাবে দাড়াবে? কি করবে তারা? ইচ্ছে করছে ঘুমিয়ে যেতে। কারণ ঘুমিয়ে গেলে এই সময়টা খুব তারাতারি পার হয়ে যাবে। আর ঘুম ভাঙলে কি হয়েছে তা কিছুই মনে থাকবে না। দেখবে শুধু সব ঠিকঠাক।
এসব ভাবতে ভাবতে বাসায় পৌছালো তারা। দরজার বাইরে দাড়িয়ে হাত পা কাঁপছে তার। মা দরজা খুললে ফারহা কিছুক্ষন চুপচাপ দাড়িয়ে থেকে কেঁদে মায়ের বুকে ঝাপিয়ে পরে বলে,
– আমায় ক্ষমা করে দাও মা। খুব বেশিই অন্যায় করে ফেলেছি তোমাদের সাথে। আমি খুব খারাপ মা। খুব বেশিই খারাপ।
এর মাঝে বাবা এলো। দুজনকে ধরেই কাঁন্না করতে লাগলো সে। এটাও যেন এক ধরনের সুখের কাঁন্না।
,
,
পারিবারিক ভাবে সব কিছু করছে নতুন করে। দুই ফ্যামিলিই এখন খুব হ্যাপি। কয়েকদিন সময় নিয়ে সব কিছু স্বাভাবিক হওয়ার পর ধীরে সুস্থেই সব হচ্ছে।

সেই অনেক্ষন যাবৎ রেডি হচ্ছে ফারহা। এদিকে ফারদিন ড্রয়িং রুমে বসে বার বার ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছে।
– কি রে কোথায় তুই? কতোক্ষন লাগবে আর? আবরার ফোন দিচ্ছে বার বার। ওরা হয়তো পৌছে গেছে আর তোর এখনো রেডিই হওয়াটাই শেষ হয়নি। এতো ঘসা মান্জা করার কি আছে? বিয়ে করতে তো যাচ্ছিস না আর।
ফারহা রুম থেকে বেড়িয়ে বললো,
– হয়ে গেছে ভাইয়া, চলো এবার।

কিছুক্ষনের মাঝেই শপিংমলে পৌছে গেলো তারা। ওখানে আগেই এসে বসে আছে আবরার আর আয়রিন। আর এখান থেকে গেলো ফারহা আর ফারদিন।
আবরার আয়রিনের দিকে তাকিয়ে বললো,
– তুই আর ফারদিন যা ভেতরে গিয়ে সব কিছু দেখ। আমরা আসছি।
আয়রিন আর ফারদিন ভেতরে চলে গেলে ফারহা আবরারের দিকে চেয়ে বলে,
– ওদেরকে এভাবে পাঠিয়ে দিলেন কেন? আমাদের তো তেমন কোনো দরকারও নেই।
আবরার একটু হেসে বললো,
– আমার ইচ্ছা। আর বের করলে কতো দরকারই তো বের করা যায়।
তখনি সাদাফ তাদে পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় থেমে বলে,
– দু’জন দেখি একসাথে শপিং মলে? বাহ্ ভালো তো। তো মিস ফারহা, কেমন যাচ্ছে দিন কাল? সব টিক ঠাক?
ফারহা বিরক্ত হয়ে বললো,
– মিস না, মিসেস আবরার। আর আপনাকে না বলেছি আমার দুই চোখের সামনেও আসবেন না। তবুও কেন ফলো করেন বার বার।
– তোমার মতো থার্ট ক্লাস মেয়েকে ফলো করার সময় নেই সাদাফের।
এর মাঝে আবরার ফারহাকে বললো,
– তুমি আয়রিন আর ফারদিনের কাছে যাও তো, আমি আসছি।
ফারহা সাদাফের দিকে তাকিয়ে বিরক্তি প্রকাশ করে চলে গেলো সেখান থেকে।

আবরার সাদাফের দিকে চেয়ে বললো,
– আবার কেন এসেছো? কি চাইছো তুমি?
সাদাফ পূর্বের মতো হেসে বললো,
– কিছুই চাই না। আর এখানে এসেছি একটা দরকারে, তোমাদের ফলো করতে আসিনি। আর তোমাকে নতুন করে কিছু বলেই বা কি লাভ৷ বৌ এর পূর্বের সব নিজ চোখে দেখেও তোমার কিছুই আসলো গেলো না। আমি হলে এমন মেয়েকে লা’থি দিয়ে বের করে দিতাম।
আবরার এবার চার দিকে চেয়ে নিজের রাগ টা চেয়ে রেখে সাদাফকে বললো,
– দেখো সাদাফ, দুনিয়ার সব মেয়ে ভালো, শুধু একটা মেয়ে খারাপ, আর সে হলো ফারহা। বিষয়টা যদি এমনও হয়, তবুও আমি তাকেই ভালোবাসি। ভালোবাসা দিক দেখে পাল্টে যায় না। যাকে ভালোবাসবো তার সব কিছুকেই ভালোবাসবো। তার অতিত, বর্তমান, তার অস্তিত্ব, তার স্বপ্ন, তার ইচ্ছা সব নিজের সাথে মানিয়ে নিবো। এক কথায় সে যেমনই হোক তা একান্তই আমার ব্যাপার। উত্তর পেয়েছো? এবার নিজের রাস্তা মাপো।

To be continue….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে