#তোমার ছায়া (পর্ব ১৭)
#মেহেদী_হাসান_রিয়াদ
আবরার ও ফারহাকে একসাথে দেখে কিছুক্ষন স্থির হয়ে দাড়িয়ে রইলো ফারদিন। অথচ এই আবরারই এক সময় তাকে নীয়ম-নীতি, ভালো-মন্দের বানী শুনাতো।
বন্ধুর বোন মানে নিজেরও বোন, কথাটা সবচেয়ে বেশি শুনেছিলো আবরারের মুখেই। যার কারণে ফারদিন ভালোবাসি শব্দটা কখনো ভালোবাসার মানুষটিকে বলার সাহস পায়নি।
চুপচাপ সব সহ্য করে মেনে নিয়েছে। এই টপিক টা নিয়ে সোহেলের সাথে বন্ধুত্ব নষ্ট করেছে। আয়রিনকেও হাসি মুখে অন্যের হয়ে যেতে দেখেছে।
আর আজ সেই আবরার কিনা, বিয়ের কথা চলছে দেখেও ফারহাতে নিয়ে নদীর তীরে একাকি সময় কাটাচ্ছে।
ফারহার সাথে দেখা করতে আসার সময় পথি মধ্যে একটা ছোট ছেলে কিছু ফুল নিয়ে এসে বললো, কয়টা ফুল নিতে। আজ সারা দিনে তেমন বেচা-কেনা হয়নি তার। কয়টা ফুল নিলে খুব উপকার হতো।
ছেলেটার প্রতি একটু মায়া জন্মালো তার। টেপ দিয়ে মোড়ানো দশটা ফুল একসাথে। ওগুলো নিলে হাসি মুখে সেখান থেকে চলে যায় ছেলেটা। আবরার ফুল হাতে হাসি মুখে নদীর তীরের দিকে চলে যায়। কারণ ফারহা বলেছিলো, এমন একটা নিরিবিলি জায়গায় দেখা করতে, যেখাতে তেমন একটা মানুষ জন থাকবে না।
ফারহা সম্পর্কে আবরারের স্ত্রী হলেও কখনো কিছু দেওয়া হয়নি তাকে। তাই কাঁপা হাতে ফুলগুলো ফারহার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো,
– আসার সময় নিয়েছিলাম।
ফুল নেওয়ার সময় থমকে যায় ফারহা। বুকের ভেতর ধুক ধুক শব্দটা বেড়ে যায় দ্বিগুন। কিছুটা দুড়ে দাড়িয়ে থাকা ফারদিনের দিকে চেয়ে বললো,
– ভা ভা ভাইয়া,,,,,,
ভাইয়া শব্দটা শুনতেই পেছন ফিরে তাকায় আবরার। ফারদিন কে দেখে দুজনই উঠে দাড়ায়।
ফারদিন তাদের কাছে এগিয়ে এসে দুই হাত পকেটে গুজে স্ট্রেট হয়ে দাড়িয়ে বলে,
– এসব কি আবরার? খুবতো জ্ঞান দিতি এক সময়।
পাশ থেকে ফারহা বললো,
– ভাইয়া ওর কোনো দোষ নেই।
ফারহার মুখ থেকে কথা বের হওয়ার আগেই সজোড়ে একটা থাপ্পর বসিয়ে দিলো ফারদিন। রাগ মিশ্রিত চাহোনিতে বললো,
– তোকে কিছু জিজ্ঞেস করেছি আমি?
আবরার ফুল হাতে নিশ্চুপ হয়ে দাড়িয়ে থাকলে ফারদিন তার বাম কাধে ধাক্কা দিয়ে বললো,
– কি হলো কথা বলছিস না কেন? কি এসব?
আবরার কিছুটা পিছিয়ে গিয়ে কিছুক্ষন নিশ্চুপ থেকে বললো,
– ওয়াইফ সে আমার।
ফারদিন এবার হতভম্ব হয়ে বলে,
– মানে?
বলেই ফারহার দিকে তাকালে দেখে সেও নিশ্চুপ।
– তোকে আমি বিষয়টা বুঝিয়ে বলছি। এখানে সিনক্রিয়েট না করে চল কোথাও গিয়ে বসে ঠান্ডা মাথায় বলি সব।
পারদিন সোজাসুজি ভাবে বলে,
– কোথাও যাওয়ার প্রয়োজন মনে করছি না। যা বলার এখানেই দাড়িয়ে বলতে থাক। কান খোলা আছে আমার। শুনছি আমি।
ফারদিনের এমন কথা বার্তায় ভয়ে দুই হাত এক করে চুপচাপ দাড়িয়ে আছে ফারহা।
নিজের ভালোবাসা হারানোর কষ্টটা যেন পুনরায় জেগে উঠেছে ফারদিনের। সেই সাথে নিজের বন্ধুর সাথে বোনকে দেখে রাগটা ও বেড়েছে অনেক।
অনেক্ষন চুপচাপ দাড়িয়ে পুরো কাহিনিটা শুনলো ফারদিন। সব শুনে কিছুক্ষন নিশ্চুপ থেকে আবরারের দিকে চেয়ে কঠিন স্বরে বললো,
– ফারহাকে ভালোবাসিস?
প্রতি উত্তরে আবরার বললো,
– ভাই দেখ এখানে প্রশ্নটা ভালোবাসার নয়। বিষয়টা একটা এক্সিডেন্ট ছিলো। আর আমরা নিজেদের মধ্যে সমাধান করতে চেয়েছিলাম। তাই কাউকে জানাইনি। এক মাস পর হয়তো আমাদের ডিবোর্সও হয়ে যাবে। তখন সব আবার আগের মতোই হয়ে যাবে। প্লিজ ভাই ভুল বুঝিস না আমায়।
রাগ নিয়ন্ত্রন করতে না পেরে এবার অনেক্ষন মুষ্টিবদ্ধ হাত টা আবরারের মুখে বসিয়ে দেয় ফারদিন। হটাৎ এমন ঘু’ষির আঘাতে ছিটকে কিছুটা পেছনের দিকে চলে যায় আবরার।
আবরার নিজেকে সামলে নিয়ে আবারও বললো,
– বিশ্বাস কর, আমাদের বিন্দু মাত্র কোনো দোষ নেই। সব হুটহাট হয়ে গিয়েছিলো,,,
বলতেই আরেকটা মে’রে দেয় ফারদিন। পেছন থেকে ফারহা দৌড়ে এসে ফারদিনের এক হাত চেপে ধরে বলে,
– প্লিজ ভাইয়া ওকে এভাবে মে’রো না।
ফারদিনের রাগটা এতোই বেশি ছিলো যে, ফারহার কথা কানে না নিয়ে তাকেও সজোড়ে একটা থা’প্পর মে’রে দেয়। ছিটকে কিছুটা দুড়ে গিয়ে ঘাসের মাঝে পরে ফারহা।
রাগি দৃষ্টিতে বলে,
– একটু বেশিই আদর করি আর ফ্রি-লি কথা বলি দেখে মাথায় চড়ে বসেছিস না?
ফারদিন এবার নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করে চার দিকে তাকিয়ে দেখে, আর কিছুক্ষন এমন চলতে থাকলে লোক জড় হয়ে যাবে এখানে।
তাই ফারহার এক হাত চেপে ধরে টানতে টানতে মেইন রোডের দিকে হাটা ধরে সে।
ওদিকে নাক থেকে ঝড়ে পরা র’ক্ত টা হাত দিয়ে মুছে নিশ্চুপ হয়ে দাড়িয়ে আছে আবরার। ফারদিন এবার থেমে আবরারের দিকে চেয়ে বললো,
– বন্ধুত্বের মর্যাদা এভাবে দিবি তা ভাবিনি আমি। আজ থেকে ফারদিন নামক কোনো ফ্রেন্ড তোর জীবনে নেই।
বলেই পারহাকে টেনে হিছরে বাড়ির দিকে রওনা দিলো ফারদিন।
,
,
– আমাদের পছন্দের বিষয় নিয়ে আপনাকে ভাবতে হবে না। আমরা আমাদের সিদ্ধান্ত পাকা করেই আজ ফাইনাল কথা বলতে এসেছি। আর যেখানে আমাদের ছেলেই ফারহা মাকে পছন্দ করেছে সেখানে আমাদের আর দ্বি-মত নেই।
ফারহার বাবা একটু হাসি দিয়ে ঘরির দিকে তাকালো। ফারদিনও তো এখন আসবে বলেছিলো। বললো, আজ অফিস থেকে ছুটি নিয়েছে। কিচুক্ষনের মাঝেই চলে আসার কথা, অথচ এখনো খবর নেই।
তখনই ফারহাকে নিয়ে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করলো ফারদিন। কাঁদেই চলছে ফারহা। বাবা বসা থেকে উঠে বললো,
– কি হলো ফারদিন, ফারু কাঁদছে কেন? আর ওকে কোথায় থেকে নিয়ে এলি? ফারু তো ঘরেই ছিলো।
পারদিন এখনও রাগি লুক নিয়ে বললো,
– ঘরেই ছিলে তোমার মেয়ে তাই না? মাকে জিজ্ঞেস করো কোথায় ছিলো এতোক্ষন?
ততোক্ষনে মা ড্রয়িং রুমে এসে বললো,
– ফারু তো পাঁচ মিনিটের কথা বলে বাইরে গিয়েছিলো। কেন কি হয়েছে?
– তোমার মেয়েকে জিজ্ঞেস করো কাহিনি কি?
ফারহা এবার কাঁদু কাঁদু ভাব নিয়ে নিজেকে সামলাতে না পেরে চিৎকার করে বললো,
– আমার হাসবেন্টের সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম আমি। শুনছো তোমরা, আমার হাসবেন্ট আবরারের সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম। এখন তোমরাও আমাকে মা’রবে তাই না, মা’রো সবাই মা’রো আমাকে। আমার ইচ্ছে, আমার চাওয়া তো কখনো জানতে চাও নি তোমরা। কেন আমার জীবনের সব তোমাদের সিদ্ধান্তের উপরে নির্ভর করবে? কেন আমার কোনো কিছু চাওয়ার কোনো অধিকার থাকবে না? কেন আমার মতামত একবার জানতে চাইলে না তোমরা? আমার জীবনে কি আমার চাওয়ার গুরুত্বটা একটুও নেই? শুনে রাখো সবাই, আবরারকে বিয়ে করে নিয়েছি আমি। এখন সে ছারা আর কারো ঘরে নিয়ে যাওয়ার অধিকার নেই আমাকে।
বলেই কাঁদতে কাঁদতে রুমের দিকে চলে গেলো ফারহা।
ওদিনে ছেলের বাবা ও মা হা করে বিষয় গুলো তাকিয়ে দেখছে।
পাশ থেকে ছেলের মা বলে উঠলো,
– ছি! এমন একটা দুঃচরিত্রা মেয়েকে কিভাবে আমাদের ছেলে পছন্দ করলো? বিয়ের আগেই অন্য পুরুষের সাথে সম্পর্ক থাকার পরও এই মেয়েকে আমার ছেলের বৌ বানাতে এসেছি? ছি!
পাশ থেকে ছেলের বাবা বললো,
– বিয়ের কথাবার্তা নামে এই বাড়িতে ডেকে এনে মেয়ের কু-কর্ম দেখিয়ে অপমান করে মোটেও ঠিক করেন নি আপনারা। এর জবাব আপনাদের সবাইকে দিতে হবে।
বলেই চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো তারা। বের হওয়ার সময় ছেলের মা বলে গেলো,
– খুব তো বড় বড় কথা শুনতাম এই মেয়েকে নিয়ে। যে মেয়ে এমন, মেয়ে তেমন, বাবা মায়ের মুখের উপর কথা বলার ও সাহস নেই। খুব ভদ্র ঘরের মেয়ে। এখন দেখছি ঠিক তার উল্টো। না জানি আরো কতো কু-কর্ম ঢেকে মেয়ের বিয়ে দিতে চাইছে তারা। বলেই ধম ধম শব্দে পা ফেলে বেড়িয়ে গেলো তারা।
বাবা কথা বলার শব্দ হারিয়ে সোফায় বসে গেলো ধপাশ করে। মা দেখি রক্তিম চোখে হাতের মুষ্ঠি বদ্ধ করে বড় বড় কয়েকটা শ্বাস নিচ্ছে।
রুমে গিয়ে স্থির হয়ে কয়েকটা বড় বড় শ্বাস নিলো ফারদিন। এমন একটা ঘটনা ঘটে গেছে তার এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না। সবার ভালোবাসাই পূর্ণতা পাক এটাই সে চায়। কিন্তু আবরার? তাকে হিট করার আগ মুহুর্তেও ফারদিন জিজ্ঞেস করেছিলো, সে ফারহাকে ভালোবাসে কি না?
কিন্তু আবরারের উত্তরে না সুচক শব্দটাই খুজে পেয়েছিলো সে। কারণ সে বার বার বলছিলো, এটা একটা এক্সিডেন্ট, আর এক মাস পরই বিচ্ছেদ হলে সব আগের মতো হয়ে যাবে। কিন্তু ফারহা, সে কি মেনে নিতে পারবে সব? আর একজন ডিবোর্সি মেয়ে সমাজে কতোটা অবহেলিত এটা ফারহার সাথে মিলাতেই নিজের রাগকে কন্ট্রোল করতে পারেনি সে। রাগে আবরারকে হি’ট করে বসে।
রুম থেকে বেড়িয়ে ফারহার রুমের দিকে এগিয়ে গেলেই দেখে ভেতর থেকে দরজা বন্ধ। ভেতর থেকে ঠাস টাস শব্দ আসতেই জানালা দিয়ে উকি দিয়ে দেখে মা হাতে বাবার একটা বেল্ট নিয়ে নানান ধরনের কথা বলো বলে বেধরম পি’টাচ্ছে। আর বাবা ড্রায়িং রুমের সোফায় নিশ্চুপ হয়ে বসে আছে। এতো আদরের মেয়েটাকে বাচাতেও আসছে না আজ।
ফারদিন বার বার দরজায় থা’প্পর দিতে দিতে মাকে ডাকতে লাগলো। মায়ের এমন রুপ দেখেছিলো সেই ছোট বেলায়। বড় হওয়ার পর আজ প্রথম এমন ভাবে পি’টাচ্ছে ফারহাকে।
মায়ের বলা কথা গুলোর কোনো উত্তর না দিয়ে চুপচাপ ফ্লোরে বসে মা’র খাচ্ছে আর কান্না করছে ফারহা। কারণ মা সব সময়ই বলতো, তাদের কথার বাইরে কিছু করলে কে’টে নদীতে ভা’ষিয়ে দিবে। তবুও কোনো অন্যায়কে মেনে নিবে না সে।
To be continue…….