তোমার ছায়া পর্ব-১৪

0
1650

#তোমার ছায়া (পর্ব ১৪)
#মেহেদী_হাসান_রিয়াদ

– বিয়ের কি রেজিট্রি হয়েছিলো?
পুরো কাহিনি শুনে চেয়ারে লম্বা লম্বি ভাবে বসে কথাটা বললো, উকিল।
আবরার মাথাটা হালকা দুই দিকে নাড়িয়ে বললো,
– আজ্ঞে না। ধর্মিয় ভাবে হয়েছিলো।
– মানে কোনো ডোকোমেন্সই নেই, তাই তো?
– জ্বি। আর থাকলেও তা ওখানকার ওদের কাছে।
– তাহলে তো ঝামেলা। তোমরা আগে রেজিট্রি করে ফেলো খুব দ্রুত। এরপর রেজিট্রির ছয় মাস পর তোমাদের যদি মনে হয়, তোমরা একসাথে থাকতে চাও না। তখন ডিবোর্স করে নিও।
– মানে আরো ছয় মাস অপেক্ষা করতে হবে?
– হ্যা।
– কিন্তু আঙ্কেল ওর ফ্যামিলি তো ওর বিয়ের কথাবার্তা বলছে। যদি কোনো ভাবে ছয় মাসের আগে বিয়েটা ঠিক হয়ে যায়। তাহলে স্বামী থাকা অবস্থায় একটা মেয়ে দ্বিতীয় বিয়ে কিভাবে করবে?
উকিল আঙ্কেল এবার সোজাসুজি ভাবে বসে বললো,
– আচ্ছা সত্যি করে বলো তো, তুমি কি চাও?
আবরার কিছুক্ষন নিশ্চুপ থেকে বললো,
– আমি চাইলেই কি সব হবে আঙ্কেল? আচ্ছা একবার ভাবুন তো। একজন শিক্ষক আর একজন ছাত্রী লুকিয়ে বিয়ে করে ফেলেছে, তাও আবার এমন ভাবে। বিষয়টা মানুষ কোন চোখে নিবে? আর অন্যান্য স্টুডেন্টদের সামনেই বা দাড়াবো কি করে?আর তাছারা সে আমার বন্ধুর বোন। বন্ধুর বোন মানে তো নিজেরও বোন, তাই নয় কি? বন্ধুর সামনেই বা কোন চোখে দাড়াবো?
– দেখো আবরার, আমি বুঝতে পারছি বিষয় টা। তবে বিয়ে জিনিস টা মানুষের লাইফে খুব গুরুত্ব পূর্ণ একটা পয়েন্ট। যা মানুষের জীবনের গতিশীলতা একটু হলেও পাল্টে ফেলে। ধরো তোমাদের ডিবোর্স হয়ে গেলো। তার পর কি তোমরা দুজন খুব সুখে থাকতে পারবে? আর লোকে কি বলছে তা ভেবে তুমি কেন নিজের জীবনের সিদ্ধান্ত টা নিবে? যারা তোমাদের নিয়ে কথা বলবে তারা কি তোমার বাকি জীবন চলার জন্য দু পয়সা দিয়ে সাহায্য করবে? নাকি বাকি জীবনটা তোমার পাশে থাকবে? তাই লোকে কি বলবে তা না ভেবে, এটা ভাবো যে, তোমার মন কি চায়? কারণ দিন শেষে আশে পাশের মানুষ গুলো খোজ নিতে আসবে না, তুমি ভালো আছো কি নেই।

আবরার কিছুক্ষন নিশ্চুপ থেকে বললো,
– আচ্ছা আঙ্কেল আমি উঠি।
– হুম, আবার দেখা হবে। গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গুলো মাথা ঠান্ডা রেখে ভেবে চিন্তে নিবে।
,
,
অনেক দিন পর আবার আয়রিনের শশুর-শাশুড়ি তাদের বাড়িতে পা রাখলো। গত কাল তার শাশুড়ি ফোন দিয়ে বললো এই বাড়িতে আসবে তারা।
তাই পরদিনই চলে আসে। ছেলে বিয়ে করিয়েছে কিন্তু পূত্র বধু পরে আছে বাবার বাড়ি। তাদের একটু অমত থাকলেও আয়রিনের ইচ্ছাকেই প্রাধান্য দিয়েছিলো তারা। বিয়ের আগে তো মাহিনের বাবা বলেছিলো তারা ছেলের বৌ চায় না। চায় শুধু একটা মেয়ে। যেখানে নিজের মেয়ে আর পূত্র বধুর মাঝে কোনো পার্থক্য থাকবে না।

মাহিন যখন মায়ের সাথে ফোনে কথা বলছিলো তখন আয়রিন পাশেই ছিলো। মাহিন চলে যাওয়ার পর তেমন একটা কথা বলেনি তার সাথে।
মাহিনের সাথে কথা বলার মহুর্তে আয়রিন ও তাদের নানান বিষয় প্রশংসা করতে ব্যাস্ত সে। আয়রিন কিছুটা লজ্জা ভঙ্গিতে বসে ছিলো এক পাশে।
ইচ্ছে হচ্ছিলো শাশুড়ি মাকে বলে ফোনটা নিয়ে অন্য রুমে চলে গিয়ে লুকিয়ে কথা বলতে দুজন।
হয়তো তার ধারণ মাহিন তাকে প্রথমে পছন্দ না করলেও, আস্তে আস্তে মানিয়ে নিতে শিখবে। কারণ হুট করে তো আর ভালোবাসা হয় না।
ফোনালাপে অল্প অল্প করে শুরু হবে সব কিছু। বিয়ের পরও ফোনালাপে প্রেম শুরু, বিষয় টা খুবই ইন্টারেস্টিং।
এতোদিন নিজে অনেকবার মাহিনকে ফোন দিয়েছিলো। কিন্তু সামান্য একটু হাই হ্যালো করে ব্যাস্ততা দেখিয়ে রেখে দিতো সে। আয়রিনও নিজেকে শান্তনা দেয়। অফিস থেকে বাইরে দেশে গেলো, ব্যাস্ততা তো একটু থাকতেই পারে।

কিন্তু আজ মায়ের সাথে অনেক্ষন কথা বলছে মানে আজ হয়তো ফ্রি আছে সে। আয়রিনের এমন পাশে বসে থাকার কারণটা হয়তো কিছুটা বুঝতে পারে তার শাশুড়ি। তাই মাহিনকে বলে,
– নে আয়রিনের সাথে কথা বল। অনেক্ষন ধরে দেখছি, তোর সাথে কথা বলার জন্য পাশে বসে আছে।
শাশুরির ডিরেক্ট এমন কথায় একটু লজ্জা পায় আয়রিন। কিন্তু মুহুর্তেই সব লজ্জা বিষণ্নতায় মিলিয়ে যায়। যখন মাহিন ব্যাস্ততা দেখিয়ে বলে,
– ওর সাথে পরে কথা বলবো মা। এখন ডিউটিতে যেতে হবে। ডিউটি শেষে কথা বলবো ওর সাথে।
বলেই ফোন রেখে দেয় মাহিন। আয়রিন বিষণ্ন মনে শাশুড়িকে জিজ্ঞেস করে।
– ও কি সব সময় এমন ব্যাস্ত থাকে? আপনাদের সাথে তেমন কথা বলে না তাই না?
তার শাশুড়ি একটু হেসে বলে,
– ব্যাস্ততা তো থাকবেই। আর কথা বলবে না কেন? ফোন দিলে তো সবার সাথে কথা বলেই ফোন রাখে। কেন, আজ কথা হয়নি তাই তো? ডিউটি শেষে কথা বলবে বলেছে। মন খারাপ করার কিছু নেই।
জোর পূর্বক একটা হাসি দিয়ে সেখান থেকে উঠে হাটা ধরলো আয়রিন। সে মাহিনকে যতই মানিয়ে নিতে চায়, ততোই দুরে দুরে থাকে সে।
,
,
সকাল হতেই মায়ের ডাকাডাকি তে ঘুম ভাঙে ফারহার। তাও কি ডাক, মনে হচ্ছে হিংস্র বাঘিনি হুংকার ছারছে। টুর থেকে ফিরে আসার চার-পাঁচ দিন হয়ে গেলো। ফারহা কলেজের ও কোচিং-এর কিনারেও যায় নি এই কয়দিন। তার মা জানতে চাইলে বলে ভালো লাগছে না। তাই আজ সকাল সকাল ডেকে বলে, কলেজে না গেলে, আর যাওয়ারও দরকার নেই, পড়ালেখা করারও দরকার নেই। বিয়ে করে সংসার শুরু করার ব্যাবস্থা করবে।
প্রাইভেট কলেজ, রেগুলার ক্লাস করতে হয়। এদিকে মায়ের এমন ঘ্যান ঘ্যান। সব মিলিয়ে উঠে, খেয়ে দেয়ে কলেজে যাওয়ার জন্য রেডি হচ্ছে।

কলেজে যাওয়ার জন্য বের হলে রাস্তায় গাড়ির জন্য দাড়িয়ে ছিলো ফারহা। তখনই একটা গাড়ি এসে দাড়ায় ওখানে। প্রথমে বিষয়টা এতো গুরুত্ব না দিলেও সাদাফ কে দেখে অবাক হয় সে।
সাদাফ তার কাছে এগিয়ে এসে বললো,
– গাড়িতে উঠো, কথা আছে তোমার সাথে।
ফারহা কিছুটা পিছিয়ে গিয়ে বলে,
– কেন এসেছেন আপনি? আর গাড়িতে উঠবো মানে কি? আপনি আমার কে যে আপনার গাড়িতে আমার উঠতে হবে?
– এখন কেউ না হলেও, এক সময়তো ছিলাম তাই না?
– ওটা অতিত, আর আপনি ভুলে গেলেও আমি ভুলে যাইনি অতিতে আপনি কি করেছিলেন আমার সাথে?
সাদাফ একটা শ্বাস নিয়ে চার পাশে চোখ বুলিয়ে বললো,
– দেখো ফারহা সব কিছুর জন্য আ’ম রিয়েলি সরি। আমি আসলে এমনটা করা উচিৎ হয়নি।
– আমি সরি বলতে বলেছি আপনাকে? আর কোন মুখে সরি বলছেন আপনি? ওই দিন আয়রিনের বিয়েতে যে মেয়েটার পাশে ছিলেন, ওটা কোথায় এখন? ছেরে দিয়েছেন তাকে, তাইনা? আপনার থেকে এর চেয়ে বেশিই কি বা আশা করা যায়?
– আমি তোমাকে সব বলবো। কিন্তু এখানে রাস্তায় না। চলো কোথাও গিয়ে বসি আমরা।
– জ্বি না, পর পুরুষের সাথে এখানে দাড়িয়েও কথা বলার ইচ্ছে নেই।
– এখন পর পুরুষ হয়ে গেছি তাই না?
– হ্যা, কারণ আই এম ম্যা……
এতটুকু বলেই থমকে গেলো ফারহা। সাদাফ একটু ভ্রু-কুচকে বললো,
– কিছু বলছিলে?
– না কিছু না, আমার দেড়ি হয়ে যাচ্ছে।
ফারহা কথা ঘুরিয়ে পাশ দিয়ে যাওয়া একটা রিক্সা ডেকে উঠে কলেজের উদ্দেশ্যে ছুটলো।
,
,
ক্লাস শেষে কলেজ থেকে ফিরার সময় হটাৎ ভাইয়ার সাথে দেখা হয় ফারহার। একটা চাকরির ইন্টারভিউ দিয়ে ফিরছিলো ফারদিন। হাতে এটা ফাইলে কিছু কাগজ পত্র। ফারহাকে বললো,
– ক্লাস শেষ?
– হুম, এখন কোচিং-এ যাবো।
তখনই আয়রিন পাশে এসে ফারহাকে বললো,
– চলে এখন, দেড়ি হলে আবার ভাইয়ার বকা খেতে হবে।
হটাৎ আয়রিনকে দেখে হাসি মুখটা মলিন হয়ে যায় ফারদিনের। আর এদিকে ফারদিনকে দেখে আয়রিন হাসি মুখে বললো,
– কেমন আছেন ভাইয়া?
ফারদিন একটু মুচকি হেসে বললো,
– আলহামদুলিল্লাহ ভালো, তুমি কেমন আছো?
– জ্বি ভালো? কাগজ পত্র নিয়ে কোথায় গিয়েছিলেন?
ফারদিন খুব স্বাভাবিক ভাবেই বললো,
– ইন্টারভিউ ছিলো একটা।
– এখন আমাদের বাসায় যান না কেন? আগে তো প্রায়ই ভাইয়ার সাথে যেতেন। সবাই মিলে গল্প করতাম।

ফারহা স্তব্দ হয়ে তাকিয়ে দুজনকে দেখছে। ভাইয়াকে বাইরে থেকে যতটা স্বাভাবিক দেখাচ্ছে, ভিতর ভিতর মোটেও এতোটা স্বাভাবিক নয় সে। রাত ভর কেঁদেছিলো নিজের ভালোবাসা হারিয়ে। আর আজ কতো স্বাভাবিক সাজার চেষ্টায় আছে সে। হয়তো এখনো একজনের মন পুড়ছে খুব, আর অন্য জন কিছুই জানে না।

To be continue…..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে