#তোমায়_ছোঁয়ার_ইচ্ছে
#পর্ব_১৫
#সুমাইয়া_মনি
ইমরানের মুখোমুখি রাদ ও মুরাদ বসে রয়েছে। রাদের উগ্র নজরে ইমরান ভয়ে ভেতরে ভেতরে ঘামছে। তার এরূপ চাহনি মেনে নিতে পারছে না। তার জানা মতে অফিসিয়াল কাজে সে ফাঁকিবাজি করেনি। না কোনো ভুলত্রুটি হয়েছে। তবে কেন তাকে জরুরী তলব দিয়ে ডেকে এনেছে কেবিনে। এনেছে এতটুকু ঠিকঠাক থাকলেও এখন রাদের আচরণ তাকে বিব্রত করে তুলছে। সে নীরবতা ভেঙে বলেই ফেলল,
‘স্যার, আমার কী কোনো ভুল হয়েছে? হঠাৎ ডাকলেন যে?’
রাদ নজর নরম করে গুরুগম্ভীর কণ্ঠে বলল,
‘আজকাল দেখছি আপনি খোশমেজাজে থাকছেন। কোনো কারণ আছে কী?’
এমন প্রশ্ন শুনে ইমরান আহাম্মক হয়ে যায়। ইসানাকে ভালোবাসার পর থেকেই তার মনমেজাজ সব সময় ফুরফুরা থাকে। তবে রাদ এটা কীভাবে লক্ষ্য করল বুঝতে পারছে না। তিনি বললেন,
‘তেমন কোনো ব্যাপার নেই স্যার এমনিত…’
‘এমনিতেই?’
‘হ্যাঁ!’
‘আচ্ছা, আপনি আসতে পারেন।’
‘কেন ডেকেছিলেন?’ কোমলস্বরে প্রশ্ন করে।
‘আগামী সপ্তাহে আমাকে আমেরিকায় যেতে হবে। আপনিও যাচ্ছেন আমার সঙ্গে। প্রস্তুতি নিয়ে রাখবেন।’
‘ওকে স্যার।’
‘আর শুনুন, কাজের দিকে ফোকাস রাখবেন। অন্যসব বাহিরে ভাববেন।’
ইমরান মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ সূচক জবাব দিয়ে প্রস্থান করে। পাশে বসে থাকা মুরাদ চেহার দুলিয়ে থুতনিতে হাত রেখে মিটমিটিয়ে হাসছে রাদের পানে চেয়ে। রাদ কপালে ভাঁজ ফেলে বলল,
‘হোয়াট?’
‘তুইও রোগে আক্রান্ত হচ্ছিস।’
‘আই নো, তুই কী বলতে চাইছিস।’
‘নয়তো মনিটরে তাদের বাক্যবিনিময় দেখে ইমরানকে ডাকতি না।’
‘স্টপ মুরাদ।’
‘ওকে।’ মুচকি হেসে ঠোঁটে আঙুল রেখে বলল।
‘বাড়িতে যাব।’
‘আজ এত তাড়াতাড়ি?’
‘মাথা ব্যথা করতেছে।’
‘তাকেও সঙ্গে নিয়ে যাবি?’
‘কেন নয়? ওনি আমার পি.এ।’
‘যা তবে।’
‘এদিকটা তুই দেখিস।’
‘আচ্ছা।’
মুরাদকে কাজ সঁপে দিয়ে রাদ ইসানাকে নিয়ে বাড়ি ফিরে।
ইসানা প্রায় সময়েই কাপড়চোপড় আগেভাগে ধুয়ে ছাদে দিয়ে এসে রান্না বসায়। আজও তাই করেছে। রাদ মেডিসিন খেয়ে টাইসনকে ছাদে হাঁটাহাঁটির জন্য নিয়ে আসে। ছাউনির নিচের অংশে বেতের চেয়ারে বসে। কিছুক্ষণ বসার পর রাদ ইসানাকে কফি বানিয়ে নিয়ে আসতে বলল। একটু হাঁটাহাঁটির জন্য উঠে কার্নিশের কিণারায় আসে। ইসানা রাদকে পিছন থেকে ডাক দেয়।
কফি বানিয়ে নিয়ে এসেছে। রাদের হাতে তুলে দিয়ে ইসানা নিচে চলে আসে।
__
লিয়াকত আলী মেয়ের বিয়ের জন্য বাকিটাকা ম্যানেজ করে ফেলেছেন। এ ক’দিনে ও পরবর্তীতে ওভারটাইমের টাকা জমিয়ে মেয়ের বিয়ে ধুমধাম করে দিবেন। শেষ বিকেলের দিকে তিনি ব্যাগ ভর্তি বাজার নিয়ে বাড়ি ফিরলেন। সেদিনের পর থেকে সুরভী খাতুন তার সঙ্গে তেমন একটা কথা বলেন না। লিয়াকত আলী প্রশ্ন করলেও হ্যাঁ, না বোধক উত্তরেই সীমাবদ্ধ থাকেন। তিনি সেদিনের জন্য মন থেকে অনুতপ্ত। সে চাইছে আগের মতো সব ঠিকঠাক হয়ে যাক। বাসার ভেতরে প্রবেশ করে হাক ছেড়ে তার অর্ধাঙ্গিনীকে ডাকলেন,
‘কই গো, বাজারের ব্যাগটি নেও।’
সুরভী খাতুন স্বামীর ডাক শুনে বেরিয়ে এসে বিনাবাক্যে ব্যাগ নিয়ে চলে গেলেন। মনােবেদনা হলেন তার। তবে কিছু বললেন না। গামছা নিয়ে গোসলের জন্য গেলেন।
.
দ্বিধাদ্বন্দে ভুগছে সোহানা। মুরাদকে কল দিবে কী দিবে না দোটানায় পড়ে রয়েছে সেই দু’দিন থেকে। রুম জুড়ে পায়চারি করে করে অস্থির হয়ে উঠেছে। শেষে সব দ্বিধাবোধ ফেলে কল দিয়েই ফেললো। রিং হতে হতে বুক ধড়ফড় করছে উঁচু লেভেলের। মুরাদ কল রিসিভ করার সঙ্গে সঙ্গে বুক ধক করে উঠে। চোখে খিঁচে বন্ধ করে নেয়। মুরাদ কল রিসিভ করে চুপ থাকে না৷ মৃদু হাসি ফুটিয়ে তুলে বলে,
‘তাহলে হ্যাঁ সম্মতি পেয়ে গেলাম?’
সোহানা চোখ মেলে মুখে ‘হুম’ উচ্চারণ করে।
‘আমি কী আপনাকে তুমি করে বলতে পারি মিস?’
‘হ্যাঁ!’
‘ধন্যবাদ মিস।’
সোহানা স্মিত হাসে। মুরাদের মুখে ‘মিস’ শব্দটি শুনতে খুব ভালো লাগে তার। দু’জনে বেশকিছুক্ষণ চুপ করে রয়। পরিশেষে মুরাদ মৌনতা কাটিয়ে বলে,
‘পরে কল দিচ্ছি।’
সোহানা জবাব দেয় না। মুরাদ ফোন রেখে দেয়। সোহানা লজ্জায় ফোন কপালে ঠেকিয়ে হাসে। কেবল ভালোবাসার পথচলা শুরু হয় তাদের।
___
পরেরদিন দুপুরে দিকে ইসানা ফুট গার্ডেনে আসে। এসে রীতিমতো সে চমকে উঠে। মামা-মামি দু’জনকে দেখে সে বিস্মিত! সোহানা তাকে ডেকেছে। ঘুনাক্ষরেও মামা-মামির কথা জানায়নি ওঁকে। সুরভী খাতুন ইসানাকে জড়িয়ে ধরে দীর্ঘ শ্বাস ফেলে। মমতাময়ী মামিকে সে নিজেও জড়িয়ে নেয়। অনেকদিন পর তাদের দেখা হলো। সুরভী খাতুন জড়িয়ে ধরা অবস্থায় জিজ্ঞেস করল,
‘কেমন আছিস তুই?’
‘আলহামদুলিল্লাহ! ভালো। তোমরা কেমন আছো?’
‘আপাতত ভালো আছি।’
ইসানা মুখ তুলে মামার দিকে তাকায়। দৃষ্টি নত রেখে এগিয়ে এসে বলে,
‘কেমন আছেন মামা?’
লিয়াকত আলী ইসানার পানে নরম ভঙ্গিতে চেয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,
‘মাফ করে দিস আমায়। অনেক কষ্ট দিয়েছি তোকে।’
ইসানা হাত ধরে মৃদু হেসে বলে,
‘বাবার স্থান দিয়েছি আপনাকে। মেয়ের কাছে মাফ চাইতে নেই।’
তিনি ইসানাকে বুকের সঙ্গে জড়িয়ে নিয়ে বললেন,
‘আমাদের সঙ্গে চল মা। আবার এক সঙ্গে থাকবো আমরা। তবেই বুঝবো তুই আমাকে মাফ করেছিস।’
‘নাহ! মামা। আমি একজনের আন্ডারে কাজ করি। এক বছর না হলে সেখান থেকে বের হতে পারব না।’ লিয়াকত আলীর বুকে মাথা ঠেকিয়ে বলল ইসানা। তিনি ইসানাকে সরিয়ে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলে,
‘আমি তার সঙ্গে কথা বলি।’
‘দরকার নেই মামা। সিমা, মানিক কেমন আছে?’
‘ভালো আছে। সিমার বিয়েতে যাবি না?’
‘আমি বড়ো মেয়ে তোমাদের। না গেলে কি হয় বলো? বিয়ে কবে?’
‘এগারো তারিখ।’
‘এ বিয়েতে আমার স্যারকেও নিমন্ত্রণ কোরো মামা।’
‘কার্ড দিয়ে দিলাম। তোর বোনের বিয়ে উপলক্ষে যাকে যাকে মন চায় নিমন্ত্রণ করিস।’
ইসানা বিয়ের কার্ডের ব্যাগটি হাতে নেয়। সোহানা সহ তারা বেশকিছুক্ষণ আড্ডা দেয় এক সঙ্গে। তাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চারটার দিকে ইসানা বাড়ি ফিরে আসে। রাদ তখন ফ্যাক্টরিতে ছিল। ইসানার বুক থেকে পীড়াদায়ক বড়ো পাথরটি সরে গিয়েছে আজ। তার কাছে মনে হচ্ছে ভুবনের সেরা সুখি মানুষ সে নিজে। আর কোনো কষ্ট রইলো না তার জীবনে।
_______
এক সপ্তাহের কাছাকাছি চলে আসে। কাল রাদ আমেরিকায় যাবে। সঙ্গে যাবে মুরাদ, ইসানা, লিসা, ইমরান। এই চারজনকে রাদ সিলেক্ট করেছে। রাদ কাপড়চোপড় গোঁজ গাঁজ করছিল। এমন সময় ইসানা দরজায় করাঘাত করে।
রাদ এগিয়ে এসে ইসানাকে দেখে জিজ্ঞেস করার আগেই ইসানা বলে,
‘আমি আসলে যেতে চাইছি না আমেরিকায়।’
‘এনি প্রবলেম?’
‘মামাতো বোনের বিয়ে এগারো তারিখে। বিয়েতে থাকাটা জরুরী। আপনাকে তো বলেছিলাম।’
‘সমস্যা নেই! আমরা বিয়ের আগেই চলে আসব। এক সপ্তাহের বেশি থাকা লাগবে না।’
ইসানা মৌন হয়ে রয়। রাদ ভ্রু কিঞ্চিৎ উঁচু করে বলে,
‘ঠিক আছে এবার?’
‘হুম।’ উচ্চারণ করে রুমের দিকে এগোয়। রাদ ইসানার পিঠের দিকে সেকেন্ড কয়েক তাকিয়ে থেকে নজর সরিয়ে ভেতরে চলে আসে।
রুমে প্রবেশ করতেই ইসানার ফোনটি বেজে উঠে। স্ক্রিনে অচেনা নাম্বার দেখে না ধরার সিদ্ধান্ত নেয়। পরক্ষণে দরকারী হতে পারে বলে রিসিভ করে। ইসানা ‘হ্যালো’ বাক্যটি সম্পূর্ণ করার পূর্বেই অপর প্রান্ত থেকে উত্তেজিত হয়ে পুরুষালী কণ্ঠ ভেসে আসল,
‘বলেছিলাম না তোমার নাম্বার খুঁজে নিবো। দেখলে তো আমার ভালোবাসার পাওয়ার।’
ইসানার বুঝতে বাকি থাকে না এটা ইমরান। বিরক্ত বোধ নিয়ে বলল,
‘এখন?’
‘এখন আমাদের প্রেম শুরু।’
‘রাখি, আমি ব্যস্ত আছি।’
‘ওয়েট, ওয়েট!’
‘বলুন?’
‘আমেরিকায় আমাদের প্রেমের পর্ব শুরু হবে। কী বলো?’
ইসানা বাক্যগুলো শুনেই খট করে ফোন রেখে দিলো। বিরক্তিতে চোখমুখ শক্ত করে রাখে। ফ্যাক্টরিতে নানানভাবে তাকে বিরক্ত করে। এখন নাম্বার জোগাড় করে তাকে ফেলেছে মহা মুশকিলে।
.
.
.
#চলবে?
#তোমায়_ছোঁয়ার_ইচ্ছে
#পর্ব_১৬
#সুমাইয়া_মনি
আমেরিকার মাটিতে এই প্রথম ইসানা পা রেখেছে। এখানের কালচার বাংলাদেশের তুলনায় অনেকটা পার্থক্য রয়েছে। মেয়েদের ওয়েস্টার্ন ড্রেসআপে দেখা যায়। এয়ারপোর্ট থেকে বের হবার সময় অনেককেই ছোট ছোট পোষাকে দেখা গিয়েছে।
অবশ্য ইসানা নিজেও জিন্সেট প্যান্ট, শার্ট ওপরে কালো রঙের জ্যাকেট পরিধান করেছে। সে-সব মেয়েদের সঙ্গে তা অনেকটাই মিলে যায়। এখানের আবহাওয়া অনেকটা শীতল। সকলের গায়েই জ্যাকেট রয়েছে। তারা ট্যাক্সি করে হোটেলে চলে আসে। বিকেলে মিটিং আছে তাদোর। তাই আপাতত রেস্ট নিচ্ছে তারা। আমেরিকায় এখন প্রায় দুপুর। সবাইকে আলাদা আলাদা রুম দেওয়া হয়েছে। রাদ ও ইসানার রুমটি ছিল একদম মুখোমুখি। ইসানার পাশাপাশি রুম দু’টি ছিল মুরাদ ও লিসার। রাদের অপর পাশে ইমরানের রুম ছিল। যে যার মতো ফ্রেশ হয়ে নেয়। মুরাদ তার বাবা-মাকে ফোন করে জানানোর পর সোহানাকে কল দেয়।
‘পৌঁছে গেছেন?’
‘হ্যাঁ! অনেক আগেই। কি করছো?’
‘কাজে আছি। আপনি?’
‘হেই তুমি করে বলো না আমাকে। এমনিতেই তো আমি তোমার পিচ্চি হবু বর। নাকি এটা বলতেও সময়ের প্রয়োজন।’
‘হুম। লাগবে সময়।’
‘নেও, নেও। আমি তো টেনসনে আছি তোমাকে নিয়ে।’
‘কেন?’
‘বাসর রাতে বলে না বোসো আমার সময় প্রয়োজন। তখন….’
অপর পাশ থেকে কল কাটার টু টু শব্দ ভেসে আসল। কান থেকে ফোন সরিয়ে মুরাদ দেখল সোহানা কল কে’টে দিয়েছে। ফিক করে হেসে দেয়। সোহানার লজ্জার কারণটি সে বুঝতে পারে। একা একা হাসে কতক্ষণ। তবে আর কল দেয় না।
এদিকে লজ্জায় সোহানার হাত-পা জমতে আরম্ভ করেছে মুরাদের কথাগুলো শুনে। সে মারা’ত্মক বিব্রতবোধ করে।
আনমনে হেসে ফেলে সে নিজেও।
.
কিছুক্ষণ পর পরই ইমরান দরজার বাহিরে উঁকি দিয়ে দেখছে ইসানা রুম থেকে বের হয়েছে কি-না। কয়েকবার কল দিয়েছে সঙ্গে মেসেজ পাঠিয়েছে বাহিরে আসার জন্য৷ কিন্তু ইসানার কোনো খবর পাত্তা নেই। পরিশেষে সে চিন্তাভাবনা করে দরজায় করাঘাত করবে। ডেকে জিজ্ঞেস করবে ‘এতবার আসতে বলার পরও কেন আসছে না বাহিরে।’
সাহস জুটিয়েও এগোতে পারছে না। যদি তারা কেউ দেখে ফেলে এই ভয়ে। রিস্ক না নিয়ে সে অপেক্ষা করে।
অপেক্ষা করতে করতে সন্ধ্যা হয়ে এলো। বোরিংনেস এসে জড়ো হয়। ঘুম পাচ্ছে তার। এখন ঘুমালে চলবে না। মিটিংয়ের জন্য রেডি হতে হবে। রাদ সবাইকে আগেভাগে বের হতে বলে। কারণ মিটিংয়ের আগে তারা একটি নতুন ফ্যাক্টরিতে যাবে। সেখানের কাপড় গুলোর ডিজাইন দেখতে। একত্রে মাইক্রোতে উঠার পর ইমরান ইসানাকে টেক্সট করে জিজ্ঞেস করে ‘সমস্যা কী? আসোনি কেন?’ ইসানা ইমরানের টেক্সট পড়ে ওর পানে তাকালে পরে সে ভ্রু উঁচু করে। তবে ইসানা জবাব দেয় না। ফোন সাইলেন্ট করে চুপচাপ বাহিরে তাকিয়ে থাকে। ইমরানের ইশারাসূচক বার্তা রাদের নজর এড়ায়নি। গাড়ির ওপরের অংশে রাখা আয়নাটিতে সব দেখেছে। চোখেমুখে তার ক্ষ্যা’পা’টে ক্রোধ। নিজেকে নরম শান্ত করার চেষ্টা করলেন। তার সহ্য হয়না ইসানার ওপর কেউ আগ্রহ দেখাক। কথাবার্তা বলুক তা তো প্রশ্নই আসে না! দশ মিনিট পর তারা পৌঁছে যায় সেই ফ্যাক্টরিতে। সেখানের ম্যানেজার তাদের সম্মানের সাথে ভেতরে নিয়ে আসে। কাপড়ের ডিজাইন, মানসম্মত দেখে তারা কিছুক্ষণ পর চলে এলো মিটিংয়ের জন্য। গ্রিন কোম্পানির ভেতরে আসার পর তাদের মিটিং রুমে নিয়ে যাওয়া হয়। রাদ ইসানার পাশে বসেছিল। চুপিসারে ইসানাকে জিজ্ঞেস করে,
‘কাল রাতে যে ফাইলটি দিয়েছিলাম সেটির কাজ সম্পূর্ণ করেছেন?’
‘হ্যাঁ! করেছি।’
‘গুড!’
ইসানার কাল রাতের কথা মনে পড়ে। এগারোটার দিকে রাদ ইসানাকে একটি ফাইলের ডকুমেন্টস তৈরী করতে বলে। ইসানা অর্ধেক রাত জেগে ডকুমেন্টসটি তৈরী করে। যে ইংরেজি গুলো তার বুঝতে অসুবিধা হয়েছে, সেগুলো গুগলের সার্চ করে বের করে সমাধান করেছে। বহু কষ্ট পোহাতে হয়েছে রাতে। সে খুব করে চাইছে তার স্থান যেন লিসার মতো পরিপোক্ত হয়। কয়েক বছর যদি না সে গ্যাপ দিতো, তবে আজ তার এতটা সমস্যায় পড়তে হতো না।
সে দমে থাকবে না। নিজ যোগ্যতায় এগিয়ে যাবে। ভাবনার মধ্যে ব্যাঘাত ঘটে কোম্পানির ম্যানেজারের আগমনে।
সবাই উঠে দাঁড়ায়। রাদ, মুরাদ হ্যান্ডশেক করে আসন গ্রহন করেন। ইসানার কপাল ঘুচে আসে ম্যানেজারকে দেখে। অতিচেনা পরিচিত লোক মনে হচ্ছে তাকে দেখে। কিন্তু সে মনে করতে পারছে না ওনি কে? তাকে কোথায় কখন দেখেছে মনে নেই তার। রাদ ঠোঁটে মাধুর্যময় হাসি ফুটিয়ে তার উদ্দেশ্যে বলল,
‘সো মি.ইভান আহমেদ শুরু করতে পারি প্রেজেন্টেশন?’
বিষ্ণুর চক্র ইয়াং প্রকৃতির ইভান আহমেদ সানগ্লাস চোখ থেকে নামিয়ে মৃদুহেসে জবাব দেয়,
‘অবশ্যই!’
কা’টা যুক্ত তীর তীব্রভাবে ইসানার হার্টে এসে বিঁধল ইভান নামটি শুনে। ইভানের চোখের পানে চেয়ে কিছুক্ষণের জন্য থমকে গেলো। চিরচেনা পরিচিত লোকটি যে তার প্রাক্তন স্বামী ইভান আহমেদ। যে কি-না তাকে অস্বীকার করে বিবাহর পরদিন বিদেশে পালিয়ে গিয়েছিল। যার জন্য অপেক্ষা করেছিল কয়েক বছর। ফিরেনি সে, নিরাশ হয়েছে প্রতিটা প্রহর। বুকে পাথর ফেলে ডিভোর্স দিয়েছেন তাকে। ইসানা চমকে উঠলো। ধ্যান ভাঙল তার রাদের ডাকে। সেখানে উপস্থিত সকলের নজর ইসানার ওপর।
‘আপনি ঠিক আছেন?’
ইসানা চোখ পিটপিট করে কম্পিত গলায় বলল,
‘হ..হ্যাঁ!’
‘আপনি প্রেজেন্টেশন দিন।’
ইসানা নিরুত্তর হয়ে বসে থাকে। সে আজ তৃতীয় বারের মতো ভেঙে পড়েছে। বিধাতা কেন তার সঙ্গে এমনটি করছে বার বার। এ কেমন লীলাখেলা তার? সেই ভয়ং’কর অতীত থেকে বেরিয়ে নিজেকে গুছিয়ে নিয়েছে। তবে কেন আবার এরূপ পরিস্থিতির স্বীকার হতে হচ্ছে। গলা ফাটিয়ে কান্না আসছে। কষ্টে নয়, ক্রোধে! এখন তার অতীত নিয়ে আফসোস হয়না। বরঞ্চ রাগ হয়। চোখ বন্ধ করে নিজেকে সামলে নেয়। চটপট সে উঠে দাঁড়ায়। ফাইলটি হাতে নিয়েই হোয়াইট বোর্ডের সামনে দাঁড়ায়। রুমটির পুরো লাইট অফ করে হোয়াইট বোর্ডের লাইন অন করা হয়। সেখানের কম্পিউটারে পুরো প্রজেক্টের ড্যামো তুলে ধরা হয়। ইসানা তার লম্বা জ্যাকেটটা খুলে চেয়ারের ওপর রেখে প্রেজেন্টেশন আরম্ভ করে। সকলে মনোযোগ দিয়ে ইসানার প্রেজেন্টেশন শুনে। টানা ছয় মিনিট ইসানার প্রেজেন্টেশন চলে। রাদ ইসানার প্রেজেন্টেশনে মুগ্ধ হয়। ইসানার কথা বলার কনফিডেন্স ও স্টাইলে মন্ত্রমুগ্ধ হয় ইভান নিজেও। সাত মিনিট বিশ সেকেন্ডে ইসানার প্রেজেন্টেশন শেষ করে। সবাই হাতে তালি দিয়ে সম্বর্ধনা প্রদান করে। তালির মাধ্যমে লাইট জ্বালানো হয়। ইসানা শক্ত ভঙ্গিতে নজর অন্যদিকে সরিয়ে রাখে। ইভান মুচকি হাসি প্রধান করে ইসানার উদ্দেশ্যে বলল,
‘চমৎকার প্রেজেন্টেশন ছিল। মি.রাদ আমি আপনাদের কোম্পানির সঙ্গে ডিল কনফার্ম করলাম।’
রাদ উঠে ইভানকে ‘থ্যাংকস’ জানায়। ইসানার পরিচয় জানতে চাইলে রাদ পি.এ বলে পরিচয় দেয়। ইভান উঠে ইসানার দিকে এগোয়।
‘হ্যালো মিস.ইসানা ইবনাত।’ বলতে বলতে হাত বাড়িয়ে দেয় হ্যান্ডশেক করার জন্য। ইসানা কিয়ৎক্ষণ শক্ত চোখে তাকিয়ে বলল,
‘হাই! দুঃখিত, হ্যান্ডশেক করতে পারছি না।’
ইভান অপমানিত হয় কিছুটা। হাত সরিয়ে কথা ঘুরিয়ে বলল,
‘আই লাইক ইউর এ্যাটিটিউড!’
‘থ্যাঙ্কিউ!’ বাক্যাটি শেষ করে জ্যাকেট হাতে বেরিয়ে যায় ইসানা। লিফটে উঠে প্রথম নাম্বার বাটনে প্রেস করে। রাদ সহ বাকিটা এতে কিছুটা অবাক হয়। তবে লিসা বিষয়টি সামলে নেয়। লিফট জুড়ে ইসানা একা। স্থির হয়ে দৃষ্টি নত রেখে ফুঁপিয়ে হাউমাউ করে কেঁদে উঠে বসে পড়ে। এতক্ষণ নিজেকে পাথর মূর্তির ন্যায় সকলের সামনে তুলে ধরলেও এখন সে নিজেকে আটকে রাখতে পারে না। ভেতরটা তার জ্বরে যাচ্ছে। যে ভয়া’বহ অতীত থেকে সে বাঁচতে চাইছে, সে অতীত তার সামনে বিক্ষিপ্তভাবে দাঁড়িয়েছে। ক্ষণে ক্ষণে দমে যাচ্ছে সে। কিন্তু তার এই চাপা আর্তনাদ কাউকে দেখাবে না। চোখ মুছে উঠে দাঁড়ায়। ইভান তাকে চিনতে পারেনি। সে তাকে প্রাক্তন স্ত্রী হিসাবে পরিচয় দিবে না। কিছুতেই নাহ!
.
মিনিট দশের পর ইমরান নিচের ফ্লোরে এসে ইসানাকে চারদিকে খুঁজতে আরম্ভ করে। রিসিপশনে বসা এক তরুণীর কাছে জিজ্ঞেস করে খবরবার্তা মিলে না। ইমরান বাহিরে এসে খোঁজাখুঁজি শুরু করে। কয়েকবার কলও দেয়। রিং হচ্ছে কিন্তু ফোন তুলছে না।
ল্যাম্পপোস্টের স্বচ্ছ আলোর রশ্মি অনুসরণ করে খালি পায়ে টাইসের সরু পথ দিয়ে এলোমেলো পায়ে হেঁটে চলেছে ইসানা।
আকাশে অর্ধগোলাকার চাঁদের ন্যায় নিজেকে ভীষণ একা মনে হচ্ছেন তার। কান্নাগুলো বুকে দলা পাকিয়ে কিছুক্ষণ পর পর দীর্ঘশ্বাস হয়ে বের হচ্ছে। অচেনা এক পুরুষকে মনের এক কোণায় জায়গা দিয়েছিল। দিনের পর দিন তার জন্য অপেক্ষা করেছিল। শ্বাশুড়ির কটুবাক্য শুনেও আশ্বাস দিয়েছে নিজেকে সে ফিরে আসবে! তার জন্য অপেক্ষা করেছিল চারটা বছর। কিন্তু দিন শেষে তাকে নিরাশ হতে হয়েছে। ডিভোর্সী নারীর তালিকায় নাম লিখছে।
খানির সময় স্থির হয়ে দাঁড়ায় সে। আকাশের পানে তাকিয়ে সৃষ্টিকর্তার নাম স্মরণ করে আলতোভাবে চোখ বন্ধ করে নেয়। বিড়বিড় করে বলে,
‘হে আল্লাহ! ধৈর্য্য দেও আমায়। ধৈর্য্য দেও!’
পুনরায় বড়ো নিঃস্বাস টেনে পাশের বেঞ্চে বসল। তখনই ভাইব্রেশনে থাকা ফোনটি বেজে ওঠলো। জ্যাকেটের পকেট থেকে ফোনটি বের করে দেখে রাদ কল দিয়েছে। রিসিভ করে। রাদ উগ্রতার সঙ্গে উত্তেজিত কণ্ঠে বলল,
‘কোথায় আপনি? ফোন কেন তুলছেন না?’
ইসানা রাদের প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বলে,
‘হোটেলের এড্রেস সেন্ড করুন। আসছি আমি।’ বলা শেষ করেই ফোন রেখে দেয়। ইমরানের টেক্সট ও কল দেখতে পায়। ইসানা লক করে নেয় ফোন। রাদ কিঞ্চিৎ চিন্তিত হয়। তবুও হোটেলের এড্রেস সেন্ড করে দেয় ইসানার ফোনে।
এড্রেস পেয়ে ইসানা টেক্সি নিয়ে রওয়ানা হয়। এগারোটার দিকে সকলে খেতে আসে হোটেলের এডজাস্ট রেস্টুরেন্টে।
সবাই থাকলেও ইমরান ছিল না সেখানে। রাদ মুরাদকে ইমরানের কথা জিজ্ঞেস করতেই ইসানা জবাব দেয়,
‘আসছে সে। এতক্ষণ বাহিরে ছিল।’
‘কেন?’
‘আমাকে খুঁজেছে।’
রাদ ফের কিছু বলতে নিলেই ইমরান ছুটে আসে। সকলের উদ্দেশ্যে বলে,
‘স্যরি স্যরি!’
রাদ ক্রোধান্বিত চোখে তাকালে ইমরান নজর সরিয়ে নেয়। রাদ তাদের উপেক্ষা করে হাঁটতে শুরু করে সামনের দিকে। ইমরান হাঁটার সময় ইসানার কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল,
‘তোমার জন্য লেট হলো।’
ইসানা শান্তভাবে ধীরে জবাব দিলো,
‘আমাকে খুঁজতে বলিনি আমি।’
‘বেপরোয়া ভালোবাসা তুমি দেখোনি।’
‘দেখতেও চাই না।’
‘ওকে, সানগ্লাস ব্যবহার করিও।’
‘স্টপ!’
‘পারব না।’
ইসানা বিরক্ত হয়ে থেমে যায়। ইমরানও থামে। বাকিরা সামনে হাঁটছে। নিজেকে স্বাভাবিক করে সরস কণ্ঠে ইসানা বলে,
‘আমার থেকে দূরে থাকুন। ভালো হবে আপনার আমার জন্য।’
‘পারব না।’ মুখ ভার করে বলে ইমরাম হাঁটা ধরলো।
ইসানা ইমরানের হাঁটার গতি দেখছে চেয়ে চেয়ে। প্রেম-ভালোবাসার প্রতি তার কোনো ফিলিংস কাজ করে না।
সে যে ভেতর থেকে অ’র্ধ’মৃ’ত! কীভাবে বোঝাবে তাকে জানা নেই তার।
.
.
.
#চলবে?
কার্টেসী ছাড়া কপি করা সম্পূর্ণ নিষেধ।