#তোমায়_ছোঁয়ার_ইচ্ছে
#পর্ব_২১
#সুমাইয়া_মনি
কড়ায়ে গরম তেলে মাছ ভাঁজছিল ইসানা। হাতে খুন্তি নেওয়ার সময় হঠাৎ থেমে যায়। অন্যমনস্ক হয়ে ভাবতে আরম্ভ করে রাদের জ্বরের বিষয়টি। থার্মোমিটার দিয়ে তাপমাত্রা মাপার পর যদি ১০০ ডিগ্রি ফারেনহাইট বা তার চেয়ে বেশি হয় তবে তাকে জ্বর বলা যায়। ১০২ ডিগ্রি ফারেনহাইট পর্যন্ত খুব জ্বর এবং ১০৩ ডিগ্রি ফারেনহাইটের বেশি হলে খুব বেশি জ্বর ধরে নেওয়া যায়। সেহেতু রাদের জ্বর মেপে ডাক্তার ১০৮ ডিগ্রি বলেছিল। তাহলে তো রাদকে হাসপাতালে নিতে হবে। ইসানা বিড়বিড় করে বলে,
‘এখনই মুরাদ ভাইয়াকে বলা উচিত।’ কথাটা বলে এগিয়ে গিয়েও থেমে যায়। পরক্ষণেই ফের বলে,
‘ ওয়েট, তার জ্বর যদি এতোই হয়ে থাকে। তাহলে তো তার অবস্থা করুন হবার কথা। তাকে তো এখন বেশ ভালোই দেখাচ্ছে।’ বলতে বলতে এগিয়ে গেল রাদের রুমের নিকট। ভেতরে প্রবেশ করার পূর্বে রাদ ও মুরাদের কথপোকথন কানে আসে। ইসানা পাশে চেপে দাঁড়ায়।
‘ডক্টর ১০৮ডিগ্রি বলে মিস্টেক করেছে। সানা ধরতে পারেনি। বুঝতেও পারেনি।’
‘আমি তাকে ১০৪ডিগ্রি বলতে বলেছি। সে বাড়িয়ে ৮ বলেছে। এখানে আমাদের তো কোনো দোষ নেই। এখন সে তো এই বিষয়টি এড়িয়ে গেছে, তুইও এড়িয়ে যা, সিম্পল।’
‘গেলাম এড়িয়ে। যদি ধরতে পারে তবে আমাদের প্লান খ*ত*ম।’
‘ডোন্ট ওয়ারি!’
ইসানা দু’হাত বগলদাবা করে দাঁড়িয়ে রাগী নিশ্বাস ফেলছে। তাদের চালাকি এখন বুঝেছে। কিন্তু এটা বুঝতে পারছে না তার সঙ্গে মিথ্যা কথা কেন বলা হলো।
.
সন্ধ্যার সময় মুরাদকে কল দিয়ে বাড়িতে আসতে বলে ইসানা৷ এই মুহূর্তে রাদ ও মুরাদকে প্রচণ্ড ঠান্ডা পানিয়ে পা ভিজিয়ে রাখার নির্দেশ দিয়েছে ইসানা৷ সঙ্গে ড্রইংরুমে এসি ফুল স্প্রিডে ছেড়ে রেখেছে। দু’জনের চেহারা ভেজা বেড়ালের মতো হয়ে আছে। নজর মেলাতে পারছে ইসানার নজরে। ইসানা স্বাভাবিক কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,
‘কেমন ফিল হচ্ছে?’
দু’জনে সংকোচ বোধ নিয়ে তাকিয়ে আবার নজর সরিয়ে নেয়। ইসানা গম্ভীর কণ্ঠে ফের শুধালো,
‘জ্বর নিয়ে কেন মিথ্যে বলেছিলেন আমার সঙ্গে? কারণটা জানতে চাই।’
সেকেন্ড কয়েক দু’জনে চুপ থেকে মুরাদ রাদকে কনুই দ্বারা গুঁতো দিয়ে বলে,
‘তুই বল।’
‘আমি পারব না তুই বল।’ রাদ পাল্টা গুঁতো দিয়ে বলে।
‘নাহ তুই বল।’
‘তুই!’
‘তুই!’
‘তুই বল শালা।’
‘তু…’
‘থামুন!’ ধমক দিয়ে বলল ইসানা। দু’জনে ইসানার দিকে তাকায় অপরাধ বোধ নিয়ে। ইসানা বিরক্ত হয়ে বলে উঠে,
‘বলবেন নাকি আমি এক্ষুণি চলে যাব বাড়ি ছেড়ে।’
‘নাহ! বলছি।’ মিনমিন স্বরে বলল মুরাদ।
‘বলুন।’
মুরাদ বলল,
‘আপনি চলে যাবেন দেখে রাদ এটা করেছে।’
‘আমার চলে যাওয়ার সঙ্গে এটার কি সম্পর্ক?’
‘ও একা হয়ে যাবে। আপনাকে মিস করবে।’
লাস্টেরটুকু বলে রাদের দিকে তাকাতেই দেখে চোখ গরম করে তাকিয়ে আছে রাদ। নজর সরিয়ে নেয় মুরাদ।
ইসানা দু’জনের দিকে সন্দেহ নজরে তাকায়। বলে,
‘আমাকে কী বোকা মনে হয় আপনাদের। যতোক্ষণ না আমি উঠতে বলব, ততক্ষণ এখানেই বসে থাকবেন আপনারা।’
আমতা আমতা কেটে মুরাদ বলল,
‘বলছি কি আপু পানি অনেক কুল। শাস্তি….’
‘কোনো কথা শুনব না আমি। বসে থাকুন।’ বলে চলে যায় ইসানা।
মুরাদ রাদের দিকে চোখ রাঙিয়ে তাকায়। আঙুল তুলে বলে,
‘সব তোর বাকোয়াস প্লানের জন্য হলো। ওই মা, কী ঠান্ডা পানি।’ কেপে কেপে বলল।
‘তোকে কে ঐ কথাটা বলতে বলেছে হ্যাঁ! আমার মান-মর্যাদা শেষ!’
‘তোর মান-মর্যাদা আমি ঠান্ডা পানিতে চু’বি’য়ে দেবো। কখনো কি ঠিকমতো প্লান সাকসেসফুল করেছিস? করিস নি। আগে জানলে আমি আসতামই না বাড়িতে।’
‘চল পা*লি*য়ে যাই!’ আস্তেধীরে বলল রাদ।
‘হ! পালাই। তারপরে ঠান্ডা পানিতে চু’বি’য়ে দিক আপু। তুই কোনো কথাই বলিস না।’
রাদ চুপ হয়ে রইলো। মুরাদ কাপছে। রাদেরও শীত লাগছে। একে তো ঠান্ডা তার ওপর বেশ কাল পানিতে পা চু’পি’য়ে রেখেছে। থরথর করে কাপছে দু’জনে। পাশের রুম থেকে ইসানা তাদের কথপোকথন শুনেছে এবং সোহানাকেও শুনিয়েছে। তারা বুঝতে পারছে না জ্বরের নাটক কেন করেছিল রাদ। বিষয়টি ইসানার কাছে ঘোলাটে।
বিশ মিনিট পর তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়। মুরাদ দ্রুত পা মুজা পড়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে ছুটে পালায়। ইসানা রাদকে উপেক্ষা করে চলে যেতে নিলে পিছন থেকে ডাক দেয়।
‘সানা শুনুন।’
‘ইসানা আমার নাম।’ ঘুরে তাকিয়ে কাঠ কাঠ কণ্ঠে বলল।
রাদ ইসানার কথাতে পাত্তা না দিয়ে বলল,
‘আই এম স্যরি সানা! এই নামেই আপনাকে ডাকবো।’ পুরো কথা বলে রুমের দিকে এগিয়ে গিয়ে মাঝপথে থাকে। ঘাড় হালকা ঘুরিয়ে কোমল স্বরে বলল,
‘আপনি চলে গেলে সত্যি মিস করব আপনাকে সানা।’ অংশটুকু বলে রাদ কক্ষে চলে এলো। ইসানা রাদের দরজার পানে কপাল কুঁচকে তাকায়। সে কিছুটা চিন্তিত হয়ে তার রুমে আসে। ধীরে ধীরে বিছানায় বসে মনোযোগ দিয়ে ভাবতে আরম্ভ করে রাদের বলা বাক্যগুলো। প্রত্যেকটা কথার পিছনে ইসানা অন্যরকম ভাবনায় ডুবে যায়। বুঝতে পারছে না রাদ কি তাকে পছন্দ করতে শুরু করেছে কি-না। এমনটা যদি হয়ে থাকে তাহলে সে নিজ দায়িত্বে এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্তে অটল হয়।
_
রাতের ফ্লাইটে বাংলাদেশে ফিরে ইভান। তাকে বাংলাদেশে ফিরার পিছনে ওর এক বন্ধু সাহায্য করেছে। তার মাধ্যমেই নিজের মাতৃভূমির মুখ দেখতে পেরেছে পুনোরায়। রাস্তা, পথ অলি-গলি বেরিয়ে নিজের বাসস্থানে চলে আসে। ভেতরে প্রবেশ করে নিজের বৃদ্ধ মাকে জড়িয়ে ধরে। এতদিন বাদে ছেলেকে দেখে অভিমান করে বসে থাকতে পারে না। জড়িয়ে নেয় বুকে। বাড়ির বাকি লোকজন তাকে দেখে ছুটে আসে। শুরু হয় তাদের কুশল বিনিময়। পরিশেষে ইসানা ও চাকরির বিষয়টি উল্লেখ করে। ইসানার কথা শুনে সাজেদা বানু মুখ শুকনো করে বলল,
‘আমরা অনেক অন্যায় করেছি ওর সঙ্গে। এ বাড়ির বউ হিসাবে ইসানাই যোগ্য ছিল।’
ইভান হতভম্ব হয়ে মায়ের মুখের পানে তাকায়। সে ভাবেনি তার মায়ের মুখে এরূপ বাক্য শুনবে। তিনি আবার বললেন,
‘ইসানার মামার অর্ধেক যৌতুকের টাকা দিয়ে তুই বিদেশে গিয়েছিলি। নয়তো তোর বিদেশ যাওয়া হতো না। তুই ভেবেছিলি বাকি টাকা আমরা দিয়েছে। নাহ! লিয়াকত আলি দিয়েছিলেন। ইসানার মা ওর বিয়ের জন্য টাকা রেখেছিল। সেটাই তিনি দিয়েছেন আমাকে। আমি তোকে মিথ্যে বলেছি বাবা। ক্ষমা করিস। নিজের ভুলগুলো শুধরে নে।’
ইভান দৃষ্টি নিচের দিকে নামিয়ে ফেলে। চোখ বন্ধ করে ভাবে ইসানাকে দেখার প্রথম মুহূর্তটি। পাপের পথ বেছে নিয়ে অর্জন করেছিল নিজের সাফল্য। কিন্তু শেষে ধ্বংসের পথে এসে অন্তিম হয় তার পাপের কর্জকাজ। ইসানার ওপর জমে থাকা রাগ পানি হয়ে গেল। নিরুত্তর হয়ে রইলেন তারা।
_
সকালে….
রাদ রান্নাঘরে এসে ইসানাকে রান্নার কাজে সাহায্য করতে চাইলে না করে দেয়। এফন রাদের জ্বর অনেকটা কমে গেছে। ইসানা এপাশে এলে রাদ ওর পাশে এসে গা ঘেঁষে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে। ইসানা বুঝতে পেরে সরে গেলেও রাদ সেদিক গিয়েই দাঁড়ায়। ইসানা পুনরায় সরে না গিয়ে ডিরেক্ট রাদকে উঁচু গলায় জিজ্ঞেস করে,
‘লাগবে না হেল্প! যাবেন নাকি আমি চলে যাব এখান থেকে?’
‘যাচ্ছি! আমিই চলে যাচ্ছি।’ নিচু কণ্ঠে কথাটি বলে রাদ নিরাশ হয়ে রান্নাঘর ত্যাগ করে। টাইসনকে নিয়ে টেবিলে বসে গাল ফুলিয়ে। কিছুক্ষণ বাদে ইসানা রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এসে রাদকে টেবিলের ওপর বসে থাকতে দেখে। রাদ টাইসনকে শুনিয়ে ইসানাকে উদ্দেশ্যে করে বলে,
‘শোন টাইসন। সানাকে তুই সানা আপু বলে ডাকবি।’
‘সঙ্গে আপনিও!’ ইসানা আঙুল তুলে জোর গলায় বলল।
‘রাদ যেটা না বলে সেটা না-ই থাকে।’ কিছুটা কাঠিন্য স্বরে বলল রাদ।
ইসানা চোখ পাকিয়ে তাকায়। রাদ ইসানার চাহনি দেখে মৃদু হেসে দেয়। যেটা দেখে তেলেবেগুনে ক্ষেপে ইসানা কাঁটাচামচ ছুটে দেয় টেবিলে। চলে যায় রান্নাঘরে। রাদ উঁকি দিয়ে ইসানার যাওয়ার দিকে দেখে ঠোঁটের হাসি চওড়া করে।
অসুস্থতার জন্য রাদ নিজেও চারদিনের ছুটি নিয়েছে।
এ চারদিন ইসানাকে কৌশলে তার মনের বার্তাটি বোঝাবে। অনুভব করাবে তাকে ভালোবাসে।
.
.
.
#চলবে?
#তোমায়_ছোঁয়ার_ইচ্ছে
#পর্ব_২২
#সুমাইয়া_মনি
‘আমি বিরক্ত হচ্ছি আপনার টর্চারে।’ খেঁকিয়ে রাদের উদ্দেশ্যে বলল ইসানা।
‘আমি তো শুধু আপনাকে সাহায্য করতে এসেছি।’ মিনমিন কণ্ঠে বলল।
‘কোনো প্রয়োজন নেই।’
‘ওকে।’
‘আমাকে আমার কাজ করতে দিন।’
‘সানা আপনি কথায় কথায় রাগ দেখান কেন? আগে এমন ছিলেন না। পরিবর্তন!’
ধীরেধীরে ঘাড় কাত করে রাদের পানে তাকায় ইসানা। কাঠিন্য স্বরে বলে,
‘আপনিও তো এমন ছিলেন না। ইভেন আমাকে সহ্য করতে পারতেন না। আর এখন? পরিবর্তনটা আগে নিজের মধ্যে লক্ষ্য করুন।’
‘আই নো, অস্বীকার করব না আমি। এজন্যই তো আমিও আপনাকে সাহায্য করতে চাই।’
ইসানা গমগম আওয়াজ তুলে বলল,
‘ফিঙ্গার ফ্রাই খেয়েছেন কখনো?’
‘নিউ শুনলাম এ নাম। টেস্ট কেমন?’ আগ্রহ নিয়ে জানতে চাইলো রাদ।
ইসানা বড়ো ছু’রি’টি হাতে নিয়ে বলল,
‘প্রথমে হাতের আঙুল কে’টে, তারপর লবন-মরিচ মাখিয়ে ডুবো তেলে ভাজতে হয়। ভাজা শেষে সস্ দিয়ে খেতে হয়। আপনি খাবেন?’ ভ্রু উঁচু করে ইসানা জিজ্ঞেস করল।
রাদের চোখমুখ কিছুটা আতংকে ঘুচে এলো। কথা ঘুরাতে জোরপূর্বক ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে বলল,
‘ওয়েট! মেবি ফোনে কল এসেছে। আসছি এক্ষুণি!’ বলতে বলতে রান্নাঘর থেকে ছুটে পালায় রাদ। ইসানা দ্রুত দরজা বন্ধ করে দেয়। যাতে রাদ পুনরায় রান্নাঘরে প্রবেশ করতে না পারে। রাদকে ভয় দেখাতে তার বেশ ভালোই লেগেছে। রাদ বাহির এসে হতাশাজনক দৃষ্টিতে তাকায় দরজার পানে। ইসানার ভয়তে পালিয়ে এলেও এখন তার আফসোস হচ্ছে। কক্ষে এসে ঠান্ডা মস্তিষ্কে ভাবে কী করা যায়।
ব্রেকফাস্টের পর ইসানা নিজের কাপড়চোপড় ধুয়ে ছাদে দিয়ে আসে শুকাতে। নিচে আসার পর রান্নার কাজ সম্পূর্ণ করে। কাজের ফাঁকে ফাঁকে রাদ টাইসনকে বার বার অজুহাতে রান্না ঘরে পাঠাচ্ছে। ছোট্ট কাগজে লিখে লিখে এটা-ওটা দেওয়ার অবদান করছে। ইসানা বিরক্ত হয়ে দিচ্ছে ঠিকিই, রাগ চেপে রেখেছে মনে মনে। ইদানীং তাকে বিরক্ত করাই রাদের লক্ষ্যে পরিনত হয়েছে। পরিশেষে কফি চেয়ে বসে রাদ। এ নিয়ে তিন বার হলো কফি খাওয়া। কড়ায় নামিয়ে রাদের জন্য কফি বানায়। মগে ঠেলে রাদকে দিয়ে আসতে যায় ইসানা। ছাদের এক কিণারায় গিটান হাতে বসে আছে রাদ। টাইসন এসে ঠিক ওপর পাশের নরম কুশানের ওপর বসল। কালো রঙের চকচকে গিটারটি দেখে ইসানার পছন্দ হয়। তবে সেটা বুঝতে দেয় না। রাদ পীক দ্বারা গিটারের সুর তুলছে। ইসানা এগিয়ে গিয়ে কফি মগ রেখে চলে যেতে উদ্যত হতেই রাদ পিছন থেকে সুর তুলে একটি গান ধরে,
‘চাইনা মেয়ে আপনি অন্যকারো হন। পাবে না কেউ আপনাকে আপনি কারো নও।’ ইসানা গানের লাইন শুনে চোখ রাঙিয়ে তাকায়। রাদ ভ্রূক্ষেপ না করে বাকি লাইন গুলো গেয়ে শুনাচ্ছে। সে বিরক্ত হয়ে চলে যায়। রাদ ইসানার যাওয়ার পথের দিকে তাকিয়ে আরো জোরেশোরে গানটি গাইতে লাগলো। ইসানা ঘুরে তাকাবার আগেই রাদ নজর অন্যদিক সরিয়ে স্বাভাবিক ভাবে গান গায়। ঠের বুঝতে পেরেছে ইসানা রাদের চতুর্মাত্রিক বুদ্ধি। রেগেমেগে হনহনিয়ে নিচে চলে আসে। রাদ পিছনে ফিরে ইসানাকে না দেখতে পেয়ে হেসে ফেলে। গিটার পাশে রেখে কফির মগ হাতে তুলে চুমুক দেয়। সঙ্গে সঙ্গে চেহারার রং পরিবর্তন দেখা মিলে। থুথু দিয়ে মুখে কফির অংশ বিশেষ পাশে নিক্ষেপ করে। গেঙ্গির হাতা দ্বারা মুখ মুছতে মুছতে বলল,
‘এটা নিশ্চয় তিনি ইচ্ছে করে দিয়েছে।’ বলতে বলতে গিটার পাশে রেখে মগ হাতে সিঁড়ির দিকে এগোয়। নিচে নেমে রান্নাঘরের সামনে এসে ইসানার উদ্দেশ্যে জিজ্ঞেস করে,
‘কফি টক লাগছে কেন সানা?’
‘আপনার ব্যবহার ক’দিন যাবত অতিরিক্ত মিষ্টি হচ্ছে দেখে লেবুর রস দিয়েছি। যাতে আগের মতো টক হয়ে যায় ব্যবহার।’ না তাকিয়ে জবাব দিলো ইসানা।
‘ইউ মিন আগে আমার ব্যবহার টক ছিল?’
‘শুধু টক না, রসকষহীন গম্ভীর ছিল।’
‘কফি খেয়ে নিলে ব্যবহার টক সত্যিই হবে?’
‘হ্যাঁ!’
‘যদি উল্টো রিয়াকশন করে, তাহলে?’ মৃদু হেসে বলল।
ইসানা একবার তাকিয়ে নজর সরিয়ে নিয়ে বলে,
‘নো চান্স!’
কথাটা শুনে রাদ এক নিশ্বাসে কফিটুকু শেষ করে। পুরো মুখ টক হয়ে গেছে। তবুও স্বাভাবিক ভাব নিয়ে দাঁড়িয়ে মুখ মুছতে মুছতে বলল,
‘এখন থেকে কি টক কফি দিবেন?’
ইসানা রাদের কথায় প্রতিত্তোর না দিয়ে খাবার হাতে বাহিরে আসে। টেবিলের ওপর রেখে রুমের দিকে এগোতেই পথরোধ করে দাঁড়ায়। ইসানা সরু চোখে তাকায়। রাদ দরজার এক পাশে হাত ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে বলল,
‘আপনাকে মিষ্টিজাতীয় খাবার বেশি করে সেবন করানো উচিত। তবে যদি মুখের ভাষা একটু মিষ্টি হয়।’
ইসানা কপাল আরো কুঁচকে তাকায়। রাদ মৃদুহাসি প্রধান করে এগোয় তার রুমের দিকে।
দুপুরের আহার শেষ করার পর থেকে রাদ ও টাইসনকে একবারও চোখের সামনে পড়েনি তার। ইসানা কাপড়চোপড় গুলো আনতে ছাদে এসে দেখে দু’জনেই উপরে। রাদ ল্যাপটপ ঘাঁটছিল। টাইসন ছোট্ট বল নিয়ে খেলছে। ইসানা তাদের উপেক্ষা করে শুঁখনো কাপড়গুলো হাতের উপরে নিতে আরম্ভ করে। তখনই খেয়াল করে গোলাপি রঙের সিল্কের ওড়নাটি রশিতে নেই। তড়িঘড়ি করে চারদিক খুঁজতে আরম্ভ করে। রেলিঙের এপাশ-ওপাশ না দেখতে পেয়ে দাঁড়িয়ে যায়।
তীব্র বাতাস ছিল না যে উড়ে যাবে। চিন্তিত হয়ে উল্টোদিকে মুখ করে দাঁড়ায়। ঠিক সেই মুহূর্তে রাদ পিছন থেকে বলে,
‘এই ওড়নাটি খুঁজছেন সানা?’
ঘুরে তাকিয়ে রাদের হাতে ওড়নাটি দেখে চোখমুখ ঘুচে এলো ইসানার। কাছে এসে ছোঁ মে’রে ওড়নাটি নিয়ে এগিয়ে যায় বাকি কাপড় আনতে। তখনই রাদ সরসমুখে বলল,
‘ওড়নার ছেঁড়া অংশটুকু নিবেন না?’
থমকে দাঁড়ায় ইসানা। চটজলদি ফিরে দেখে রাদের হাতে পেঁচানো ওড়নার বাকি অংশটুকু। সেটিতে লাল রক্তের দা’গ লেগে রয়েছে। ইসানার মনে পড়ে তিন বছর আগের স্মৃতি। অন্যমনস্ক হয়ে স্মৃতিচারণ করতে তিন বছর পিছনে চলে যায়। এক রাতে বাড়িতে ফিরার পথে মাঝরাস্তায় নিরব গলিপথে হেলমেট পরিধান একটি ছেলেকে অজ্ঞান অবস্থায় দেখে ছুটে যায় তার নিকটে। কালো রঙের Suzuki বাইকটি কাত হয়ে পড়ে থাকতে দেখে বুঝতে পারে ছেলেটি বাইক এক্সিডেন্ট করেছে। আনুমানিক রাত তখন বারোটা ছুঁই ছুঁই। শীতের রাত হওয়ায় পথেঘাটে মানুষজন ও গাড়ি চলাচল কম ছিল। হাতের কব্জি থেকে রক্ত বের হচ্ছিল। ইসানা নিজের ওড়নার অংশ ছিঁড়ে ছেলেটির হাত বেঁধে দেয়। মুখ থেকে হেলমেট সরিয়ে মাথায় কোনো আঘাতের চিহ্ন আছে কি-না উত্তেজিত হয়ে দেখতে আরম্ভ করে। হাতের কব্জি ব্যতীত আর কোথায় আঘাত পায়নি। ইসানা দ্রুত মেইন রাস্তা থেকে একটি টেক্সি ডেকে ছেলেটিকে হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে বাড়িতে চলে আসে।
‘অতীত থেকে বের হন সানা ম্যাম। আমিই সেই ছেলেটি।’
চকিতে তাকায় ইসানা। বিশ্বাস নয়, ভাবতেই অবাক লাগছে রাদ সেই ছেলেটি। তাড়াহুড়ায় রাদের চেহারা দেখলেও খেয়াল ছিল না রাদই সেই ছেলেটি। পারিবারিক চাপে, ডিপ্রেশনে সে এক্সিডেন্টের বিষয়টি ভুলেই গিয়েছিল। কিন্তু কী ভাগ্য তার! আজ সেই ছোট্ট অতীতের অচেনা ছেলেটি তার বস নামে পরিচিত।
‘ভাবনা থেকে বের হয়ে আমার প্রশ্নের উত্তর দিন সানা।’
ইসানা চৈতন্য ফিরে পেয়ে চোখ তুলে তাকায়। বলে,
‘আপনি.. আমি মানে সত্যি আপনিই সে-ই অচেতন ছেলেটি?’
‘হ্যাঁ! সন্দেহ হলে হাতের কব্জি দেখুন। কাঁ’টা দা’গ এখনো আছে।’ বলতে বলতে হাতের কব্জি উন্মুক্ত করে ইসানার সামনে তুলে ধরে। হাতের পানে তাকিয়ে ইসানার সন্দেহ সত্য তে পরিনত হয়। রাদ হাত সরিয়ে ফেলে বলে,
‘জ্ঞান ফিরার পর ডাক্তারের কাছে আপনার কথা জানতে চাইলাম। আপনাকে খোঁজার বাহানায় ওড়নার টুকরোটি নিজের কাছে রেখে দিলাম। আপনার সম্পর্কে ধারণা ছিল না বিধায় নিঁখোজ ছিলেন। আজ ওড়নাটি দেখে সেদিনের ঘটনা মনে পড়ে। কিন্তু যখন দেখলাম ওড়নার নিচের অংশ ছেঁড়া তখনই বাকি অংশটুকু মিলিয়ে বুঝতে পারলাম আপনিই সেই অচেনা মেয়েটি।’
ইসানা রাদের পুরো কথা শুনে নজর সরিয়ে নেয়। রাদ দীর্ঘ শ্বাস নিয়ে স্মিত হেসে বলে,
‘জানেন, আমি সময় পেলে ওড়নার ছেঁড়া অংশটুকু দেখতাম। ভাবতাম কখনো কি আপনাকে আমি খুঁজে পাব না? ওড়নার মতো কখনো কি হবে না তাকে ছোঁয়া? কিন্তু যেদিন আপনি আমার জীবনে এসেছেন সেদিন থেকে আমি ঐ অচেনা মেয়েটিকে খোঁজা বন্ধ করে দিয়েছি। স্মৃতির পাতায় রেখে দিয়েছি পৃষ্ঠা হিসাবে। যেটা শুধু স্মৃতি হিসাবেই থাকবে, বাস্তবে না! বাট, আজ আমার অতীত বাস্তব হয়ে ধরা দিয়েছে। আমি কক্ষণো চাইব না এই অতীতের মানুষটি আমার কাছ থেকে দূরে চলে যাক। সারাজীবন পাশে থাকুক ওড়নার ছেঁড়া অংশের মতো। আগলে রাখব চিরকাল! তাকে যে ছোঁয়ার ইচ্ছে আমার তীব্র…!’ লাস্টের অংশটুকু রাদ কোমলভাবে বলে। ইসানার হৃদয় কিঞ্চিৎ কেঁপে উঠে। রুক্ষ স্বরে বলে,
‘স্টপ! কিছু স্মৃতি, কিছু ইচ্ছে স্মৃতি ও কল্পনাতেই থাকা শ্রেয়। বাস্তব রূপ নিলে ভ’য়ং’ক’র হয়ে উঠে।’
‘হোক! তবুও আমি বাস্তবে চাই তাকে। সারাজীবন চাইবো।’
ইসানা রাদের উদ্ভট কথা শুনে বিরক্ত হয়ে নিয়ে চলে এলো। কাপড়গুলো পাশে রেখে কপালে আঙুল বুলিয়ে রাদের কথাগুলো ভাবে পুনরায়। ফের ঈষৎ হৃদয় কেঁপে উঠে। যখনই মনে উঠে অতীতকে বাস্তবের রূপ দিতে চায় রাদ।
.
.
.
#চলবে?
কার্টেসী ছাড়া কপি করা সম্পূর্ণ নিষেধ।