#তোমাতে_বিলীন_হবো
#Tahsina_Arini
#পর্ব_৬
আল্লাহর রহমতে তাহসী ও তননের বিয়ে ভালোভাবে সম্পন্ন হলো। বিদায়ের সময় নাতাশা রহমান কান্না চেপে হাসিমুখে অনেক কিছু বললেন দুজনকে দাড় করিয়ে। তখন তৌহিদ হোসেন পাশে দাঁড়িয়ে। নাঈম ও চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। কোথা থেকে যেন নাহিদ এসে তাহসীকে জড়িয়ে ধরলো। এরপর তাহসীর কপালে চুমু দিয়ে বললো,
-“সেদিনের ব্যবহারের জন্য খুবই দুঃখিত। আর কখনো হবে না।”
সেই ঘটনার পরে তাহসী নাহিদের সাথে একদিনও ভালো করে কথা বলেনি। তাহসী নিঃশব্দে হাসলো। কিন্তু নাহিদ তাতে মলিনতা ছাড়া কিছু খুঁজে পেল না। তাহসীর দিক থেকে চোখ সরিয়ে তননকে বললো,
-“আমাদের বিশ্বাসের মর্যাদা রেখো।”
তনন ঘাড় কাত করে সায় দিল।
গাড়ির কাছে তাহসী ও তনন কে এগিয়ে নিয়ে গেল নাহিদ। তনন উঠে বসলে তারপর তাহসীও উঠলো। তাহসীর সাথে যাবে তাহসীর ফুফাতো দুই বোন সারা ও সুমাইয়া। সবাই উঠে বসতেই গাড়ি চলতে শুরু করলো। তাহসী চেষ্টা করলো সবার অগোচরে বাম হাতের উল্টো পাশ দিয়ে চোখের পানি মুছতে। কিন্তু তনন দেখে ফেললো। তবে কিছু বললো না।
তাহসী খুবই চাপা স্বভাবের। নিজের কান্না দেখাতে চায় না সে। তৌহিদ হোসেন বলেন মায়ের মতো স্বভাব পেয়েছে। যেমন আজ নাতাশা রহমান ও কাঁদলেন না সবার সামনে।
অল্প সময়ের মধ্যেই তারা তননের বাড়িতে পৌঁছে গেল। তখন মাত্র আছরের আযান পড়েছে। সেলিনা শেখ তাহসীকে নিয়ে গেস্ট রুমে বসালেন, যেহেতু অনেকেই এখন বউ দেখতে আসবে। তাহসী এতে ইতস্তত করলো। সেলিনা শেখ বুঝতে পেরে নিচু স্বরে জানতে চাইলেন কোনো সমস্যা হয়েছে কি-না। তাহসী বিনা দ্বিধায় নিজের সমস্যার কথা জানিয়ে দিল। সে এখানে বসতে চাচ্ছে না। মূলত সবাই এসে তাকে এটা সেটা প্রশ্ন করুক, তাকে নিয়ে মন্তব্য করুক এটা সে চায় না। বিশেষ করে ছেলেরা যেন এখানে না আসে। মুরব্বি হলেই যে তার সামনে যেতে হবে এমন তো কোনো কথা নেই।
তননের চাচি পাশ থেকে এসব শুনে মুখ বাকালো। তাহসী খেয়াল করলেও ভ্রুক্ষেপ করলো না। আশেপাশের মানুষের চিন্তা করে না সে। তার চিন্তা হচ্ছে সেলিনা শেখ কি উত্তর দিবেন।
সেলিনা শেখ হাসিমুখে তাহসীর কথায় সায় দিলেন। তবে তাহসীকে সবার সাথে কিছুক্ষণ বসে থাকতে হবে এই ব্যাপারে কিছু করার নেই ওনার। তাহসী ও ওনার সমস্যা বুঝলো। কি আর করার! নিজের বাড়িতে এখন নেই বলে মুখের উপর উত্তর দিতেও পারবে না। তবে সেলিনা শেখ তাকে আশ্বস্ত করে তনু কে তার কাছে রেখে গেলেন। সারা আর সুমাইয়া তার পাশেই বসে আছে।
রাত সাড়ে দশটা নাগাদ তাহসী কে তননের রুমে দিয়ে আসলো তননের কাজিন মহল। তাহসীর তখন থেকেই উশখুশ শুরু হলো। তনন রুমে আসলে কথা বলবে কি বলবে না; কোন দিকে তাকিয়ে থাকবে কি থাকবে না; নিজে থেকেই প্রথমে সালাম দিবে কি-না; সেলিনা শেখ দুধের গ্লাস দিয়ে গেছেন সেই দুধের গ্লাস তননকে কিভাবে দিবে, তাহসীর হাত কাঁপাকাঁপি তে বোধহয় পড়েই যাবে; এইসব নানা জল্পনা কল্পনা করতে লাগলো তাহসী। রুমের আশেপাশে তাকিয়ে দেখতে লাগলো। রুমের সাথে এটাচড ওয়াশরুম আছে, তাহসীর কাছে এটাই বড় স্বস্তির। তাহসীর ভাবনার অবসান ঘটিয়ে প্রায় আধাঘণ্টা পর তনন রুমে আসলো।
তাহসী অল্পতেই নার্ভাস হয়ে যায় তননের সামনে। বিয়ের কথা উঠার পর থেকেই কমার পরিবর্তে বরং বেড়েছে এইটা। তননও সময় দিতে পারিনি এই কয়েকদিন পরীক্ষার জন্য। তাহসী সালাম দিবে কি না ভাবতে ভাবতেই তনন মুচকি হেসে সালাম দিল। তাহসী চমকে আস্তে করে সালামের উত্তর দিল।
তনন যতোটা তাহসীর দিকে এগোতে লাগলো, তাহসীর হৃৎস্পন্দন যেন তেমন গতিতে বাড়তে লাগলো। তনন তাহসীর সামনে দাঁড়িয়ে বললো,
-“এত ঘামছো যে? ভালোই তো ঠান্ডা আজ। ফ্যান এর পাওয়ার বাড়িয়ে দিবো?”
তাহসী কেঁপে উঠলো কিছুটা। ঘোমটার আড়ালে থেকেও তনন তাকে দেখতে পাচ্ছে! তারপর কি বললো? তুমি! এই প্রথম তনন তাকে তুমি বলে সম্বোধন করলো।
-“না-হ।”
তনন বুঝলো তাহসীর অস্বস্তি। বললো,
-“শাড়ি চেঞ্জ করে ওযু করে এসো।”
তাহসী তাড়াহুড়ো করে নামতে যেয়ে নিজেই নিজের শাড়ির সাথে বেঁধে গেল। তনন সরে যেয়ে দাঁড়ালো। তাহসী আস্তে আস্তে নামলো। টেবিলের উপর রাখা দুধের গ্লাস নিয়ে তননকে দিয়েই এক ছুটে ওয়াশরুমে চলে গেল। তনন আলতো হাসলো। তাহসীর হাত দিয়ে ধরা জায়গায় নিজের হাত স্থাপন করলো।
তাহসী মেকআপ উঠিয়ে একে একে চুড়ি, নূপুর খুলে বেসিনের সামনে থাকা তাঁকে রাখলো। তাও ভালো হালকা মেকআপ দিয়েছিল তার মামাতো বোন। এইসব মেকআপ নেওয়ার অভ্যাস নেই তাহসীর। এরপর ওযু করে অলংকার গুলো হাতে তুলে নিয়ে ওয়াশরুম থেকে বের হলো।
তনন তখন বিছানার এক কোণায় বসে আছে। তাহসী ইতস্তত করে জিজ্ঞেস করলো,
-“এইগুলো কোথায় রাখবো? আমি ওয়াশরুমে শাড়ি চেঞ্জ করতে পারছি না। একটু বাইরে গেলে…..”
তনন মাথা নাড়িয়ে বললো,
-“আমি বাইরে না বরং ওয়াশরুমে যাচ্ছি। তাহলে আমিও চেঞ্জ করে নিতে পারবো। আর আলমারি তে রেখে দাও সব। অথবা খুলে রাখো আমি জায়গা দেখিয়ে দিবো।”
তনন শার্ট আর ট্রাউজার নিয়ে ওয়াশরুমে চলে যেতেই তাহসী এইপাশ থেকে নিঃশব্দে ছিটকিনি আটকে দিল। এরপর একটানে শাড়ি খুলে ফেলে সাথে আনা টপস আর লেগিংস পড়ে নিল। একে তো একটা ছেলের সাথে ঘুমাতে হবে। রাতে ঘুম আসবে কিনা জানেনা তাহসী। তারপর যদি সে আবার শাড়ি পরে ঘুমাতে যায় সব উলোট পালট হয়ে যাবে। আবার আজ তার বাসর রাত! এইটা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে চাইলো তাহসী। কিন্তু চাইলেই কি আর মাথা থেকে এটা বের করা যায়!
আর তাহসী ভাবলো সে যখন সুযোগ পেয়েছে তাহলে সেইটা কাজে লাগাবেই বা না কেন?
তাহসীর ড্রেস চেঞ্জ করা হয়ে যেতেই তাহসী পুনরায় নিঃশব্দে ছিটকিনি খুলে দিল। ইতিমধ্যে তনন একবার বলেছে হয়েছে কিনা শাড়ি পরা। তাহসী একটু সরে এসে বললো,
-“হয়েছে।”
তনন এসে তাহসীর দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালো। তাহসী তখন আলমারিতে সব গুছিয়ে রাখতে ব্যস্ত। বিশেষ করে গহনা গুলো। শাড়ি লাগেজে রাখবে বলে ঠিক করলো। তাহসীর নিজের রাখার ইচ্ছা ছিল না, কিভাবে কোথায় রাখবে। কিন্তু কাজের মধ্যে থাকলে নিজের অস্বস্তি ভাব থাকবে না এইজন্যই এই কাজ করা। তনন তাহসীর কাছে এগিয়ে গেল। তনন কে দেখে তাহসী একটু সরে দাঁড়ালো। তনন দেখিয়ে দিল কোথায় রাখবে। এরপর আরেক ড্রয়ার খুলে তনন সাদা খাম বের করলো। তাহসীর হাতে দিয়ে বললো,
-“দেনমোহর এর টাকা। তখন নিয়ে যাইনি কারণ হারিয়ে যেতে বা চুরি হতে পারতো।”
তাহসী মিনমিন করে জবাব দিল,
-“এখানেই থাক। এত মানুষ! আনা নেওয়া ঝামেলা।”
তনন কিছুক্ষণ চুপ থেকে সায় দিল। আগের ড্রয়ারে রাখতে যেয়ে আবার তাহসীর হাতে দিল।
-“অন্তত ছুঁয়ে রাখো। শেষে যদি আবার হালাল না হয় বিয়ে?”
তাহসী নিজেই রেখে দিল ড্রয়ারে। তাদের বিয়েতে লোক দেখানো কোনো দেনমোহর ধরা হয়নি। এই বিষয়ে তাহসী আগেই কথা বলে নিয়েছিল নাহিদের সাথে। এমন টাকার পরিমাণ যেন ঠিক করা হয় যেইটা তনন বিয়ের দিনই দিতে পারে। দেনমোহর পরিশোধ না করলে তাহসী যাবে না তননের বাড়ি।এতে অবশ্য উভয় পক্ষের সায় ছিল। তবে তনন বিয়ের সময় নিয়ে যায়নি যদি চুরি করে নেয় কেউ। এটা তার বাবার গোছানো টাকা থেকে তোলা।
তনন তাহসীর হাতে জায়নামাজ ধরিয়ে দিল। পাশাপাশি দাঁড়িয়ে দুজনে সালাত আদায় করে নিল। তবে পুরোপুরি পাশাপাশি দাঁড়ালো না, কারণ নিয়ম নেই। তাহসী একটু পিছনের দিকে সরে দাঁড়ালো।
নামাজ শেষে তাহসী জায়নামাজ তুলে তননের হাতে দিল। তাহসী বুঝতে পারছে না তার করণীয় কি এখন। বিছানায় যেয়ে শুয়ে পড়বে নাকি বিছানায় যেয়ে বসে পড়বে।
তনন কথা বলে উঠলো,
-“তো বলো বাসর রাত নিয়ে তোমার স্বপ্ন কি ছিল? ছাদে উঠে চাঁদ দেখা নাকি অন্য কিছু…!”
চলবে ইনশাআল্লাহ;