তোমাকে বলার ছিল……
একাদশ পর্ব
তৃণা ভেবেছিল সুজন ওকে কখনো ভালোবাসার কথা বললে ও খুব খারাপ ব্যবহার করবে I কিন্তু কেন যেন পারল না I হয়তো মনটা খারাপ ছিল তাই I বরং ভীষণ কান্না পেয়ে গেল I আবেগে ভেসে যাওয়ার মতন মেয়ে তৃণা নয় I ছোটবেলা থেকেই ও নিজেকে খুব শক্ত প্রাচীর দিয়ে ঘিরে বড় করেছে, যেন কোনো আঘাত ওকে ভেঙে ফেলতে না পারে; কোন আবেগ নাড়িয়ে দিতে না পারে I মোবাইলের সাউন্ডটা বন্ধ করে অনেকক্ষণ কাঁদলো তৃণা I সুজন চুপ করেই ছিল অনেকক্ষণ পর নীরবতা ভেঙে বলল
– তুমি কিছু বলবে না তৃণা ?
ততক্ষনে তৃণা নিজেকে সামলে নিয়েছে I যদিও ওর গলা এখনো ভেঙে আছে I তৃনা বললো
– তুমি আর আমাকে কখনো ফোন করো না সুজন l
– কেন?
– আমার মনে হয় সেটাই সব দিক থেকে ভালো হবে l
-আমি তোমাকে ভালবাসি তৃণা I এটা কি আমার অপরাধ?
– যদি এটা ভালোবাসা হতো, তাহলে হয়তো অপরাধ হতো না I কিন্তু তুমি যেটাকে ভালোবাসা ভাবছো, এটা আসলে ভালোবাসা নয় l
– তাহলে এটা কি?
– আমি একটা ক্রাইসিস মোমেন্ট-এ তোমার সঙ্গে ছিলাম; তাই হয়তো সাময়িক ভাবে একটা ডিপেন্ডেন্সি তৈরি হয়েছে I এটাকে ভালোবাসা ভেবে ভুল করোনা I কিছুদিন পর দেখবে আমার কাছ থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য অস্থির লাগবে I
– আমাকে তোমার এরকম মনে হয়?
– তুমি কিরকম সেটা ফ্যাক্টর নয় I এটাই রিয়ালিটি l
– তুমি কি আমাকে বিশ্বাস করছো না?
– আমি ভালোবাসা ব্যাপারটাতেই বিশ্বাস করিনা I তোমাদের দুজনকে দেখার পর তো আরো করি না I কদিন আগে তুমি হিয়াকে ভালবাসতে; আজ আমাকে ভালোবাসো, কদিন পর হয়তো অন্য কাউকে ভালো লাগবে l
সুজন হঠাৎ চুপ করে গেল I ও যত ভালোই পড়াক না কেন তৃণার সঙ্গে কথায় পেরে ওঠা ওর কাজ নয় I তৃণা কথাগুলো এত জোর দিয়ে বলছে, যেন মনে হচ্ছে কথাগুলোও সুজনকে নয়, নিজেকেই বলছে I সুজনের হঠাৎ ভীষণ অভিমান হল I দুম করে ফোনটা রেখে দিল ও I দুই হাতে মাথা চেপে ধরে কোলের উপর ফোনটা রেখে বসে থাকল অনেকক্ষণ I ফোন বাজছে I নিশ্চয়ই তৃণাই কল করেছে আবার I সুজন ফোনটা ধরে বলল
– আমাকে আরো অপমান করা কি বাকি রয়ে গেছে তৃণা?
– হ্যালো সুজন l
– কে?
– আমি হিয়া l
*********
সামাদ সাহেব আর তার স্ত্রী রেহানা দুজনে মিলে সব গুছিয়ে নিয়েছেন I পরীক্ষার পরেই বিয়েটা সেরে ফেলতে হবে I বেশি দেরি করা যাবে না I তৃণা একবার পাশ করে চাকরি নিয়ে ফেললে, তখন ওকে সামলে রাখা মুশকিল হবে I যা করার এখনই করতে হবে I রেহানা ফোন করে শাশুড়িকে জানিয়ে দিয়েছেন; যেন এই ছুটির মধ্যে ওকে বিয়ের জন্য রাজি করিয়ে ফেলেন I হিসেব মতো তৃণা ফিরে এলে বলতে হবে ছেলের মা দেখা করতে চায় I পছন্দ হলে আংটি পরিয়ে যাবে এতটুকুই I শাশুড়িকে আনিয়ে রাখতে হবে I আংটি পরানোর পর হঠাৎই সামাদ সাহেব বলবেন আংটি যখন পড়ানো হয়ে গেছে, তখন না হয় আজকেই বিয়েটা পরিয়ে ফেলি I ঝামেলা রেখে কি লাভ I তৃণার পড়াশোনা শেষ হলে তখন না হয় ছোট করে একটা অনুষ্ঠান করে ফেলা যাবে I আগে থেকেই কাজী ঠিক করে রাখতে হবে I একটা নতুন শাড়ির ব্যবস্থাও রাখতে হবে I একবার বিয়েটা পড়ানো হয়ে গেলে আর কোন চিন্তা নেই I এখন সবকিছু ভালই ভালই হলেই হয় I
********
সন্ধ্যা হয়ে গেছে অনেকক্ষণ I ঘরের ভেতর আবছা অন্ধকার I অন্ধকার ঘরেই বসে আছে সুজন I উঠে আলো জ্বালাতে ইচ্ছে করছে না I কাল দুপুরের ঘটনা টা এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না I হঠাৎ করে একসাথে এতগুলো ঘটনা ঘটে যাওয়ায় কেমন যেন নিতে পারছে না ও I তৃণার কথাগুলো এত তীব্রভাবে আঘাত করেছিল ওকে যে মনে হচ্ছিল ভেতরটা ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেছে I ফোনের রিংটোন যখন বাজলো ধরেই নিয়েছিল তৃণা ফোন করেছে I মনের ভিতর একটা ক্ষীণ আশা ছিল I হয়তো তৃণার কষ্ট হয়েছে অপরাধবোধ জন্মেছে এভাবে কথা বলে I কিন্তু ফোন ধরে একটা ধাক্কা খেয়েছে সুজন I ফোনটা তৃণা করেনি করেছিল হিয়া I অসম্ভব বিরক্তি নিয়ে সুজন বলেছিল
– হিয়া ? তুমি হঠাৎ, কি মনে করে ?
– এত পার্ট নেওয়ার দরকার নেই I তোমার সঙ্গে আবার ভাব করার জন্য ফোন করিনি I একটা ইনফরমেশন দেওয়ার জন্য ফোন করেছি I
– কি ইনফর্মেশন ?
– বলছি I তার আগে বল তৃণা তোমাকে কি অপমান করেছে ?
-সেটা আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার I
– আরে ঢ্যামনা গিরি ছাড়ো তো I আমি এখানে তোমার স্বার্থের কথা ভাবছি তুমি আমার সঙ্গে ভাব দেখাচ্ছো ?
সুজন হতভম্ব হয়ে গেল I কোনমতে বলল
– এটা কি ধরনের ল্যাংগুয়েজ ইউজ করছ তুমি ?
– এটাই আমার ইউজুয়াল ল্যাঙ্গুয়েজ I এতদিন তোমার সঙ্গে অনেক ভালো সেজে ছিলাম I এখন কি তুমি বলবে তোমার আর তৃণার মধ্যে কি হয়েছে , নাকি তৃণার বিয়ের পর বলবে I
– কি বললে ?
– ঠিকই শুনেছো I তৃণার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে I
-কবে ? আমার সঙ্গে তো রেগুলার কথা হয় I কই আমাকে তো একবারও বললে না
– তোমাকে কেন বলবে ? তুমি কি ওর বয়ফ্রেন্ড ? শোনো যে ছেলের সঙ্গে তৃণার বিয়ে ঠিক হয়েছে ঐরকম থার্ডক্লাস মারকা ছেলের সঙ্গে আমি কিছুতেই ওর বিয়ে হতে দেবো না I ভেবেছিলাম তোমাকে দিয়ে হয়তো কোনো লাভ হবে I কিন্তু তুমি আগে যেরকম হোপলেস ছিলে এখন তার থেকেও বেশি হোপলেস I ফোন রাখলাম I
– শোনো হিয়া I হ্যালো
– বল শুনছি
– তৃণা কি কাউকে ভালোবাসে ?
-হ্যাঁ
এক মুহুর্তে সুজনের পৃথিবীটা দুলে উঠলো I এজন্যই তাহলে তৃণা ওকে মানা করে দিয়েছে I কোনমতে দাঁতে দাঁত চেপে বললো
– কাকে ? ওই পিয়াস কে ?
– আরে নারে গাবলু
– তাহলে ?
– তৃণা যাকে ভালোবাসে তার কথা সে মরে গেলেও স্বীকার করবে না
সুজনের নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে I ও কোনমতে বলল
– কাকে ভালবাসে তৃণা ?
-তুমি এত ইন্টারেস্ট দেখাচ্ছ কেন ? তুমি কি ওকে ভালবাসো ?
– হ্যাঁ
– বলেছ ওকে সে কথা ?
– বলেছি
– তারপর ? ও কি বলেছে ?
– বলেছে ও ভালবাসায় বিশ্বাস করে না I
– আমি জানতাম এটাই বলবে I তারপর তুমি কি করলে ? অভিমান করে বসে থাকলে ?
– তো কি করবো আমি ?
– ওকে ওর মতো করেই হ্যান্ডেল করতে হবে I আমি বলছি তোমাকে কি করতে হবে I শোনো মনোযোগ দিয়ে I
*********
তৃণা ফিরেছে কিছুক্ষণ আগে I অসম্ভব ক্লান্ত লাগছে; খিদেও পেয়েছে I পথে কিছু খেতে পারেনি l অন্যান্য সময় দাদি খাবার দিয়ে দেয় আজ রাগ করে খাবারও নেয়নি I আসার আগ পর্যন্ত দাদির ঘ্যানর ঘ্যানর চলছিল I হঠাৎ করে কি হলো বুঝতে পারছে না তৃণা I
ঘরে ঢুকে ব্যাগ রেখে হাত মুখ ধুয়ে এসে দেখলো বড় চাচী দাঁড়িয়ে আছেন ঘরে I তৃণাকে দেখে মধুর কন্ঠে বললেন
-ফ্রেশ হয়ে কিছু খেয়ে নাও; এত লম্বা জার্নি করে এসেছ I টেবিলে খাবার দেয়াই আছে I
তৃণা বুঝতে পারছে না হঠাৎ করে কি হয়ে গেল I এরকম ব্যবহার-এর পেছনে নিশ্চয়ই কোন উদ্দেশ্য আছে I কি হতে পারে সেটা I তার আত্মীয়র সঙ্গে তৃনাকে বিয়ে করিয়ে উনার কি লাভ I এতসব ভাবতে ইচ্ছা করছে না I মাথা ধরে আছে I হিয়াকে ফোন করতে হবে I কালই ওদের বাসায় রাতিনের আসার কথা ফ্যামিলি নিয়ে I হিয়া বলেছে সকাল সকাল চলে যেতে I তৃণা ফোনটা হাতে নিয়ে হিয়াকে কল করতে যাবে, তার আগেই দেখল একটা মেসেজ এসেছে I মেসেজ ওপেন করে তৃণা হতভম্ব হয়ে গেল I ও ভেবেছিল সুজনের সঙ্গে ওই রকম আচরণ করার পর হয়তো আর কখনো ফোন করবে না; কোনো যোগাযোগ রাখবে না I কিন্তু তা না করে সুজন যেটা লিখে পাঠিয়েছ সেটা পড়ে ও হতবাক হয়ে গেল I তৃণা বুঝতে পারছে না এসব কি হচ্ছে I সুজন লিখেছে
তুমি ভালো না বাসলেই
বুঝতে পারি ভালোবাসা আছে।
তুমি ভালো না বাসলেই
ভালোবাসা জীবনের নাম,
ভালোবাসা ভালোবাসা বলে
দাঁড়ালে দু’হাত পেতে
ফিরিয়ে দিলেই
বুঝতে পারি ভালোবাসা আছে।
না না বলে ফেরালেই
বুঝতে পারি ফিরে যাওয়া যায়
না কখনো।
না না বলে ফিরিয়ে দিলেই
ঘাতক পাখির ডাক শুনতে পাই চরাচরময়।
তৃণার মাথা ঝিমঝিম করছে I ও কোনমতে ফোনটা করে বলল
– তুমি এসব কি শুরু করেছে সুজন ?
– শুরুটা তো আমি করিনি I আমিতো শুধু কন্টিনিউ করছি I
চলবে. ………..
তোমাকে বলার ছিল……
একাদশ পর্ব
লেখনীতে
অনিমা হাসান
আজ যে কবিতাটা দেয়া হয়েছে তার নাম ‘যে পায় সে পায় ‘ লিখেছেন আহসান হাবীব