তোমাকে চাই পর্ব-০৮ এবং শেষ পর্ব

0
1665

#তোমাকে_চাই
#পর্বঃ০৮(অন্তিম)
#মারিয়া_আক্তার

‘ভালোবাসা শব্দটার সাথে পরিচিত হয়েছি সেদিন, যেদিন জানতে পেরেছি মামির পেটে যেই বাবুটা আছে সে বাবুটা নাকি একটা মেয়ে। কিভাবে আমার ছোট্ট মনে ভালোবাসার সঞ্চার হল আমি আজও বুঝতে পারলাম না। আমি শুধু এটুকু জানতাম মামির গর্ভে যেই বাবুটা আছে সে শুধু আমার। একান্তই আমার। তোর যেদিন জন্ম হল মানে মামির যেদিন ডেলিভারি হল সেদিন সকালবেলা মামি যখন প্রসববেদনায় ছটফট করছিল তখন মামিকে ঐ অবস্থায় দেখে আমিও খুব কান্না করেছি। মামিকে ধরে সেদিন বলেছিলাম ‘তুমি কি বাবুটার জন্য এভাবে কষ্ট পাচ্ছো?’ মামি বলেছিল হুম। তখন আমি বলেছিলাম ‘ওর জন্য তুমি এভাবে কষ্ট পাচ্ছো মামি। বাবুটা তোমাকে এভাবে কষ্ট দিচ্ছে। আগে আমার কাছে আসুক তখন আমি আচ্ছামত বকে দিবো কেমন?’ মামি সেদিন শত কষ্টের মধ্যেও হেসে দিয়েছিল। মামিকে সেদিন আমি আরো বলেছিলাম ‘এই বাবুটাকে তুমি আমায় দেবে?’ মামি মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বলেছিল। বলেছিল সেই বাবুটা নাকি আমায় দিয়ে দেবে। সেদিন থেকে তুই আমার নামে লেখা হয়ে গেছিস। তারপর তোর যখন চার বছর হলো সেদিন মামি সবার সামনে আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ কথাটা বলেছিল।

দীপ্ত ভাইয়ার কথাগুলো শুনে আমার নিজের কাছে কেমন যেন লাগছে। কেমন অদ্ভুত ফিলিংসও হচ্ছে। এতসব কিছু আমি আজ জানলাম। দীপ্ত ভাইয়াকে থামিয়ে দিয়ে আমি এবার বলে উঠলাম,

– সেদিন কি বলেছিল আম্মু?

দীপ্ত ভাইয়া মিষ্টি করে হেসে বলেন,

– তোর যখন চার বছর ছিল তখন আমার নয় বছর। একদিন আমি স্কুল থেকে দুপুর প্রায় বারোটার সময় বাড়ি ফিরি। আমাদের বাসায় না গিয়ে সরাসরি তোদের বাসায় চলে যাই। তোকে না দেখে আমি একবিন্দুও থাকতে পারতাম না। সারাদিন তোর সাথে থাকতাম আমি। আম্মু রাতে আমায় বাসায় নিতে পারতো না। জোর করে নিতে হত। বাসায় যাওয়ার কথা বললেই আমার সে কি কান্না। আচ্ছা যা বলছিলাম তোদের বাসায় এসে দেখি তুই ড্রয়িংরুমের এককোণে বসে বসে হাড়ি পাতিল নিয়ে খেলছিস। তোকে দেখে আমি দৌঁড়ে তোর কাছে যাই। তোর সাথে প্রায় অনেক্ষণ ধরে খেলি। তারপর দেখি আব্বু আম্মু মামা মামি সবাই তোদের ড্রয়িংরুমে আসে। কি নিয়ে যেন তারা আলোচনা করছিল। আমি সেখানে উপস্থিত হলে ছোটমামি আমায় তার কাছে ডেকে নেন। আমার একগালে হাত রেখে মামি বলেন,

– তোমার মৌ-কে চাই?

সেদিন মামির কথায় আমি অবাক হয়ে যাই। আমার তো মৌ-কে চাই খুব করে চাই। কিন্তু মামি হঠাৎ এটা কেন জিজ্ঞেস করছে সেটা মাথায় ঢুকছে না। আমি সেদিন কোনো ভনিতা ছাড়াই সোজাসাপ্টা বলে দিয়েছি।

– হুম মামি আমার মৌ-কে চাই।

মামি মুচকি হেসে বলে,

– তাহলে তাই হবে। আজ আমি সকলের সামনে কথা দিলাম বড় হলে তোমার সাথে আমি আমার মৌ-এর বিয়ে দেবো।

বিয়ে মানে কি সেদিন আমি জানতাম না। শুধু এটুকু জানতাম আমার সাথে তোর বিয়ে হলে তুই আমার কাছে সবসময় থাকবি। সেদিন থেকে সবসময় ভাবতাম কবে আমরা বড় হবো আর কবে আমি তোকে বিয়ে করবো। তারপর দিন চলতে লাগলো। আমার এসএসছি পরিক্ষায় আমি যখন গোল্ডেন এ প্লাস পাই। সেই খুশিতে আব্বু সেদিন পার্টি রেখেছিল বাসায়। সে পার্টিতে আব্বু সবার সামনে আবার ঘোষণা করেছিল আমাদের বিয়ের কথা। কিন্তু সেদিন সেখানে আমায় কিছু শর্ত জুড়ে দেয় ছোটমামা। তিনি বলেছিলেন আমি নিজের পায়ে যেদিন দাঁড়াবো নিজে যেদিন প্রতিষ্ঠিত হবো সেদিনই তোকে আমার হাতে তুলে দিবেন। তার আগে নয়। আরো এক শর্ত দিয়েছিলেন আমি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগ পর্যন্ত তোকে আমাদের বিয়ের ব্যাপারে তোকে কিছু বলতে পারবো না। তোর সাথে আমায় এমনভাবে ট্রিট করতে হবে যাতে তুই না বুঝতে পারিস আমি তোকে ভালোবাসি। আর মামিও সেদিন থেকে তোর সব দায়িত্ব আমায় দিয়েছিলেন। এইতো এসবই তোর অগোচরে ঘটে যাওয়া ঘটনা।

আমার অনুভূতিরা যেন ধলা পাকিয়ে আসছে ভিতরে। মুখ দিয়ে কথা বেরোচ্ছে না আমার। আমার অগোচরে এত কিছু হয়ে গেল অথচ আমিই কিছু বুঝতে পারলাম না। দীপ্ত ভাইয়া আমায় ভালোবাসেন তাও আজ থেকে না আমার জন্মের আগে থেকে। কি করবো আমি এত খুশি রাখবো কোথায়। আবার লজ্জাও লাগছে। দীপ্ত ভাইয়া আর আমার বিয়ে? এই না না এত লজ্জা লাগছে কেন আমার? এই লজ্জায় ইচ্ছে করছে ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়ে মরে যাই।

________________

আজ আমার বিয়ে। বিয়ের সময় হয়তো প্রত্যেকটা মেয়েই অনেক নার্ভাস থাকে। আমিও ভীষণ নার্ভাস। অদ্ভুত অদ্ভুত ফিলিংস হচ্ছে মনে।আমার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না দীপ্ত ভাইয়ার সাথে আমার বিয়ে হচ্ছে। কিভাবে আমি তাকে স্বামীরুপে গ্রহণ করবো?আচ্ছা উনি বিয়ের পরও কি আমার সাথে এমন ব্যবহার করবেন? এমনই কি বকাবকি করবেন? বুঝতে পারছি না কিছু।

– শিমু আপু! রেডি করেছো ওকে?এখনি কাজী সাহেব রুমে আসবেন।

পুষ্পির কথায় আমি নিজের বেনারসির আঁচল খাঁমছে ধরি। এখনই তাহলে বিয়ে পড়াবে। কিছু মূহুর্ত পর আমি দীপ্ত ভাইয়ার বউ হয়ে যাবো। বউ এ শব্দটা দুই অক্ষরের হলেও এটা একটা মেয়ের কাছে খুব ভারী। বিয়ে হলে সংসারের সব দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিতে হয়। আমি কি পারবো? আমার ফুফু আর ফুফা খুব ভালো মানুষ আমায় যথেষ্ট স্নেহ করেন। ওনাদের দিয়ে আমার তেমন কোনো চিন্তা নেই কিন্তু দীপ্ত ভাইয়া না ভাইয়া বলছি কেন কিছু মূহুর্ত পর উনি আমার স্বামী হবেন ওনাকে ভাইয়া বলা যাবে না। দীপ্তর রাগকে কি করে সামলাবো আমি।ওনার রাগটাকে যে আমি খুব ভয় পাই। সব কিছু কি আমি সামলাতে পারবো?

– ওইতো কাজী সাহেব চলে এসেছেন।

এখনই তাহলে আমার ওপর থেকে অবিবাহিত নামটা চিরতরে মুছে যাবে। আমি হয়ে যাবো অন্যকারো অর্ধাঙ্গী।

_________________

– কিরে কিছু কি বলবি?

নিস্তব্ধ রুমে হঠাৎ দীপ্তর গলার আওয়াজে আমার শরীরটা কাঁটা দিয়ে উঠে। পেটের মধ্যে কথার পসরা সাজানো থাকলেও গলার মধ্যে ধলা পাকিয়ে আসছে বের করতে পারছি না।

– আমার সামনে এত লজ্জা পাওয়ার প্রয়োজন নেই মৌ। আমি তোর অপরিচিত নই। কিরে কিছুতো বল।

– আমি এখন আপনার বউ আপনি এখনো আমায় তুই করে বলছেন কেন?

কথাটা বলেই বেক্কল হয়ে গেলাম। এতক্ষণ কিছু বলতে পারছিলাম না আর এখন কি বলে ফেললাম। লজ্জায় মাথা কাঁটা যাচ্ছে আমার।

দীপ্ত মুচকি হেসে বলেন,

– এইতো আমার বউ কথা বলেছে। আর কি বলতো মৌ। আমি তোকে তুমি করে বলতে পারবো না। তুই করেই ডাকবো সবসময়। তুই ডাকটাই আমার কাছে ভালো লাগে। তোর কি সমস্যা হবে তুই ডাকলে?

আমি মাথা নাড়িয়ে না বুঝাই।

– আচ্ছা আপনি সবসময় আমার এমন রাগ দেখাবেন?

– রাগটা আমি ছোটবেলা থেকে তোর সাথে দেখিয়ে এসেছি চাইলেও আমি তোকে রাগ না দেখিয়ে থাকতে পারবো না। তবে দিনশেষে আমিই কিন্তু তোকে নিজের সবটা দিয়ে ভালোবাসবো।

– রাগতো দেখান সেতো আছেই। আপনার মনে আছে একদিন ক্যান্টিনে সবার সামনে আপনি আমায় থাপ্পড় মেরেছিলেন?

আমি অভিমানী গলায় কথাটা বলে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে ফেলি।

– ওটার জন্য সরি বলেছিতো। দেখ ওইদিন তুই যা করেছিলিস তাতে কি আমার রাগ উঠার কথা না? এরকম কাজ আর কখনো করবিনা যাতে তোর ওপর আমার কোনোরূপ রাগ দেখাতে হয়। ঐ দিন থাপ্পড় মেরেছি বলে কি তোর এখনো মনে হয় আমি তোকে মারবো? যারা নিজের স্ত্রীর ওপর হাত তোলে আমি মনে করি তারা পুরুষ নয়।

দীপ্ত খানিকক্ষণ উশখুশ করে আমার কাছে বসে আমার ডান হাতটা ওনার দু’হাতের মুঠোয় ভরে বলেন,

– আচ্ছা মৌ! তোর আমায় স্বামী হিসেবে গ্রহণ করতে কোনো অসুবিধা নেইতো?

আমি কি বলবো বুঝে উঠতে পারছি না। আমায় চুপ থাকতে দেখে উনি আবারো বলে উঠলেন,

– কিরে কিছু বলছিস না কেন? তোর আমাকে স্বামী হিসেবে গ্রহণ করতে অসুবিধা আছে?

বুঝতে পারলাম উনি আমার মুখ থেকে কথাটা শোনার জন্য উদ্ধিগ্ন হয়ে আছেন। ওনাকে স্বামী হিসেবে গ্রহণ করতে আমার কোনো অসুবিধা নেই। তাই আমিও কোনোরূপ ভনিতা ছাড়া বলেই দিলাম।

– না। আমার কোনো অসুবিধা নেই। তবে হ্যাঁ যখন তখন আমার সাথে রাগ দেখানো চলবে না। যদি এরূপ করেন তাহলে সেদিনই কিন্তু আমি বাপের বাড়ি চলে যাবো।

উনি মুখটাকে ছোট করে বলেন,

– এটা কিন্তু ঠিক না বউ। বিয়ে হতে না হতেই বরকে বাপের বাড়ি যাওয়া নিয়ে হুমকি দিচ্ছিস। এটা কিন্তু পাপ বুঝলি পাপ।

আমি খিলখিলিয়ে হেসে দিলাম। আমি কখনো ওনাকে এভাবে কথা বলতে দেখিনি তাই আর হাসিটাকে কন্ট্রোল করতে পারি নি। দীপ্ত আমায় একহাতে জড়িয়ে ধরে বলেন,

– সারাজীবন এভাবে হাসবি তুই। আর তোকে হাসিখুশি রাখার দায়িত্ব হলো আমার। আর আমার রাগকে কিন্তু কখনো ভয় পাবি না বুঝলি। আমি কিন্তু তোর কাছে সবসময় এমনই থাকবো। আমার রাগ জেদ সব তোকেই দেখাবো আবার অবাধ্য হলে শাস্তিও দেবো। আবার আমিই ভালোবাসবো। কিছুতো বল। রাখবিতো তোর হাতটা আমার হাতে।

উনি ওনার হাতটা আমার সামনে বাড়িয়ে দিলেন। আমি আমার হাতটা ওনার হাতে রাখলাম আর মুচকি একটা হাসি দিলাম। আমার হাসি দেখে উনারও ঠোঁট প্রশস্ত হলো। ওনার চোখগুলো যেন বলছে,

– আমার বাঁচতে হলে তোমাকে চাই।

সমাপ্ত।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে