#তোমাকে_চাই
#পর্বঃ০৬
#মারিয়া_আক্তার
ক্লাসরুমে বসে বসে ঝিমুচ্ছি। বোরিং লেকচার হচ্ছে। স্যার কখন থেকে খালি পড়াচ্ছেনই। থামাথামির নাম নিচ্ছেন না একটুও। এখন সময়টা প্রায় একটা ছুঁইছুঁই। দুপুরবেলা ক্লাসরুমে এমনিতেই ঘুম আসে। তার ওপর স্যার একনাগাড়ে পড়াচ্ছেন। পুরো ক্লাসরুমে চোখ বুলিয়ে দেখি আমার মত প্রায় ম্যাক্সিমাম স্টুডেন্টই ঝিমুচ্ছে। অপেক্ষায় আছি কখন যে স্যারের ক্লাসটা শেষ হবে আর কখন এখান থেকে যাবো। আসলে দীপ্ত ভাইয়া বলেছেন ক্লাস শেষ হলে ওনার সাথে লাইব্রেরিতে দেখা করতে। আজকে দীপ্ত ভাইয়ার শেষ পরীক্ষা ছিল।দীপ্ত ভাইয়া কেন দেখা করতে বলেছেন কে জানে? অবশ্য আমারও তর সইছে না। ইদানীং দীপ্ত ভাইয়ার কাছাকাছি থাকতে কেন যেন খুব ভালো লাগে। কথায় কথায় বকাবকি করলেও আমার এখন আর সেটা খারাপ লাগে না।
– মৌ চল। আজকে সবাই মিলে ফুচকা খাই।
মিশু কথাটা বলার সাথে সাথেই শিমু আর নয়না হৈ হৈ করে উঠে। স্যার চলে গেল মাত্র। এখন সবাই মিলে ফুচকা খাওয়ার প্ল্যানিং করছে। কিন্তু আমায় যে লাইব্রেরিতে যেতে হবে।
– এই শোন না যাওয়ার সময় না হয় ফুচকা খাবো। এখন আমায় একটু লাইব্রেরি যেতে হবে। দীপ্ত ভাইয়া বলেছেন লাইব্রেরিতে ওনার সাথে দেখা করতে। তোরাও আমার সাথে আয় না।
– শিমু আর নয়না তোরা দু’জন মৌ এর সাথে যা। আমি যাবো না। দীপ্ত ভাইয়াকে দেখলে আমার কেমন জানি ভয় লাগে ভাই। ওইদিন দেখলি কিভাবে ক্যান্টিনে সবার সামনে মৌকে থাপ্পড় মেরেছিল।
– সেটাতো এই শিমুর জন্যই হয়েছিল।
মিশুর কথার বিপরীতে নয়না কথাটা বলা মাত্র শিমু নয়নার পিঠে কিল দিয়ে বলে,
– আমি শুধু বলেছিলাম আমাকে সাহায্য করতে। আমি কি এটা বলেছিলাম ওই ছেলেটার সাথে ফ্লার্টিং কর। ওইদিন মৌ কি করেছিল তোদের মনে নেই। ন্যাকা ন্যাকা মেয়েগুলোর মত ছেলেটার সাথে কেমন করলো।
– শেষেতো শাসিয়ে দিয়ে এসেছি হুহ্।
শিমু আমাকে মুখ ভেংচি দিয়ে বলে,
– ইশ! শাসিয়ে দিয়ে এসেছে। তোর কি মনে হয় তোর এই শাসানোতে ছেলেটা আমার পিছু ছেড়েছে? দীপ্ত ভাইয়ার কাছে হেল্প চাইছিলাম তারপর দীপ্ত ভাইয়া ছেলেটাকে টাইট দিয়েছিল।
– দীপ্ত ভাইয়া তাহলে আগে থেকেই সব জানতো? তাহলে আমাকে থাপ্পড় মেরেছিল কেন?
– আরে গাধি। তোকে থাপ্পড় মারার পর তুই যখন বাসায় চলে গেলি তখনই তো আমি দীপ্ত ভাইয়াকে সবটা বলি পরে উনি ছেলেটার ব্যবস্থা নেন।
শিমুর কথা শেষ হতেই আমি কাঁদোকাঁদো মুখ করে বলি,
– তাহলে উনি বাসায় গিয়ে আমায় কান ধরে দাঁড় করিয়ে রেখেছিলেন কেন? আর এমনভাবে সব জিজ্ঞেস করছিলেন যেন উনি কিছুই জানেন না।
– তার কারণটা হল তুই আগ বাড়িয়ে ছেলেটার কাছে গেছিলি।
– শয়তান লোক একটা। দেখিস একটা শাঁকচুন্নির সাথে বিয়ে হবে ওনার। অভিশাপ দিলাম। এই মৌ এর অভিশাপ বিফলে যায় না।
শিমু আমার মাথায় গাট্টা মেরে বললো,
– অবশ্যই বান্ধবী তোমার অভিশাপ বিফলে যাবে না। ইভেন আমরাও দোয়া করছি যাতে তোর অভিশাপটা কাজে দেয়। দীপ্ত ভাইয়ার কপালে যদি শাঁকচুন্নিই থাকে তাহলে ওনার আর কষ্ট করে মেয়ে খুঁজতে হবে না। মেয়েতো সামনেই আছে। কিরে কি বলিস তোরা।
– অবশ্যই। দীপ্ত ভাইয়া আর ওই শাঁকচুন্নির বিয়েতে আমরা খুব মজা করবো। তাইনা নয়না?
– হুম। তাতো বটেই। ওই তোরা দৌঁড় মার। নাহলে শাঁকচুন্নি আমাদের ঘাড় মটকিয়ে ফেলবে।
তিনটে শয়তানই ব্যাগ নিয়ে দৌঁড় মেরেছে।জানে এখানে থাকলে ওদের আমি আস্ত রাখবো না। ওরা শাঁকচুন্নি বলতে যে আমাকেই মিন করেছে সেটা আমি জানি। ওরা প্রায়ই আমাকে আর দীপ্ত ভাইয়াকে নিয়ে এমন আজেবাজে কথা বলবে। আমার খুব লজ্জা লাগে তখন। দীপ্ত ভাইয়া আর আমি? না
এটা ভাবলেই আমার কেমন অদ্ভুত ফিলিংস হয়। নাম না জানা এই ফিলিংস গুলোর সাথে আমার সাক্ষাৎ নেই। আমার এই ফিলিংসের কথা ওদের সামনে প্রকাশ করি না নাহলে এই শয়তান মেয়েগুলো আমাকে সারাক্ষণ পঁচাবে।
আচ্ছা আমিতো দীপ্ত ভাইয়াকে নিয়ে কতকিছু ভাবি, কিছু ফিল করি। দীপ্ত ভাইয়াও কি আমাকে নিয়ে কিছু ফিল করেন? না তা কেন হবে। উনি আমাকে নিয়ে কিছু ফিল করতে পারেন না কারণ উনি আমার সাথে যেমন ব্যবহার করেন এতে কিছু বুঝার উপায় নেই। কিন্তু মাঝেমাঝে ওনার ব্যবহারগুলো আমার খুব অদ্ভুত লাগে। উনি আমার উপর এমনভাবে অধিকার খাটান যেন আমি ওনার নিজস্ব সম্পদ। উনিতো একদিন বলেও ছিলেন আমার চেয়ে আমার ওপর ওনার বেশি অধিকার। কিন্তু কেন? না আমি আর এসব ভাবতে পারছি না। থাক বাবা আর ভাববার দরকারও নেই আমি বরং আগে লাইব্রেরিতে যাই।
______________________
বিশ মিনিট ধরে লাইব্রেরিতে বসে রয়েছি। আমার সামনের চেয়ারটাতে বসে দীপ্ত ভাইয়া কি যেন লেখছেন। কেন ডেকেছেন সে সম্পর্কে কিছু বলছেনও না। আমি একবার চলে যেতে নিলে ধমক দিয়ে বলেন,
– তোকে কি আমি যেতে বলেছিলাম স্টুপিড? বসে থাক এখানে। আমি না বলা পর্যন্ত একপাও নড়বি না।
তাই অগত্যা এখানে বসে থাকতে হচ্ছে। তবে আমি আড়চোখে বেশ কয়েকবার দীপ্ত ভাইয়ার দিকে তাকাচ্ছি। উজ্জ্বল ফর্সা মুখে খোঁচা খোঁচা দাঁড়িগুলোতে খুব মানিয়েছে ওনাকে। আমার আবার দাঁড়ি ছাড়া ক্লিন সেভ করা ছেলেদেরকে পোল্ট্রি মুরগীর মত লাগে। দীপ্ত ভাইয়া যখন ক্লিন সেভ করেন তখন ওনাকেও পোল্ট্রি মুরগীর মত দেখতে লাগে। আমিতো ভেবে রেখেছি ভাই আমার হাজবেন্টকে ক্লিন সেভ করতে দেবো না।কারণ ক্লিন সেভ আমার কাছে একটুও ভালো লাগে না।
– চল।
আমার ভাবনায় ব্যাঘাত ঘটিয়ে দীপ্ত ভাইয়া উঠে দাঁড়ালেন। এতক্ষণে ওনার লেখা তাহলে শেষ হলো। তাই আমারও তার সাথে উঠে দাঁড়াতে হলো।
– ভাইয়া কোথায় যাচ্ছেন?
দীপ্ত ভাইয়া দরজার দিকে যাচ্ছিলেন। আমার কথায় আমার দিকে ফিরে বলেন,
– আসলেইতো বুঝতে পারবি কোথায় যাচ্ছি। চল তাড়াতাড়ি।
আমিও দীপ্ত ভাইয়ার পিছন পিছন হাঁটতে লাগলাম। ওমা উনি কোথায় যাচ্ছেন। বাইকের কাছে যাচ্ছেন কেন? আমায় কি এখন ওনার সাথে বাইকে করে যেতে হবে?ধুর ছাতার মাথা। আমি ভেবেছিলাম আজকে ফুচকা খাবো। ইনিতো সব প্ল্যানই ঘেটে ‘ঘ’ করে দিলেন। আমার থেকে প্রায় দশহাত দূরে আমার বেস্টি গুলা দাঁড়িয়ে আছে। ওদের মুখে বিশন্নতার ছাপ। আজকে বুঝি আর ফুচকা খাওয়া হলো না। আমারও ওদের জন্য খারাপ লাগছে। কিন্তু আমি কিছু করতেও পারবো না।
– এইযে প্রধানমন্ত্রীর বউ আমাকে কৃপা করুন একটু। তাড়াতাড়ি এসে আমায় উদ্ধার করেন।
আমি মুচকি হেসে দীপ্ত ভাইয়ার বাইকের পিছনে গিয়ে বসলাম। শো শো করে বাইক ছুঁটছে অবশ্য আমার কাছে ভালোই লাগছে। আমি আশেপাশে তাকিয়ে পরিবেশটাকে ভীষণ ইঞ্জয় করছি। হঠাৎ দীপ্ত ভাইয়া বাইকটাকে একটা বিরিয়ানি হাউজের সামনে দাঁড় করালেন।বিরিয়ানি নামটা দেখেই আমার জিহ্বায় পানি চলে আসলো। আমার সবচেয়ে বেশি পছন্দের খাবারটা হলো বিরিয়ানি। এখানে দীপ্ত ভাইয়া তাহলে আমায় বিরিয়ানি খাওয়ানোর জন্য এনেছেন। কি মিজা।
– নামছিস না কেন বাইক থেকে? নাকি বিরিয়ানি খেতে চাইছিস না তুই?
আমি ফটাফট বাইক থেকে নেমে গেলাম। যেখানে বিরিয়ানি আছে সেখানে অবশ্যই মৌমিতা আছে। দীপ্ত ভাইয়া আমায় চোখ দিয়ে ইশারা করলেন ভিতরে ঢুকার জন্য। আমি ওনার পিছুপিছু ভিতরে ঢুকে গেলাম। দীপ্ত ভাইয়া বিরিয়ানি অর্ডার দিয়ে বসে বসে মোবাইল স্ক্রল করছেন।আর আমি বিরিয়ানির জন্য বসে বসে ইনতেজার করছি। অবশেষে আমার অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে বিরিয়ানি আসলো। প্লেটটা নিজের কাছে টেনে এনে আমি ফটাফট খাওয়া শুরু করলাম।ফুচকা খাওয়ার জন্য যে মন খারাপ ছিল তা নিমিষেই কেঁটে গেল। সামনে তাকিয়ে দেখি দীপ্ত ভাইয়া আমার দিকে হা করে তাকিয়ে আছে। তা দেখে আমি খাওয়া অফ করে দেই।আমি যেভাবে খাচ্ছিলাম তিনদিন অভুক্ত ব্যাক্তিও মনে হয় এভাবে খায় না। ছি! দীপ্ত ভাইয়া আমাকে এখন কি ভাবছেন। নিশ্চয়ই ভাবছেন বড় খাদক ভাবছেন। খাবার দেখে লোভ সামলাতে পারিনি বলে গপাগপ গিলছিলাম? মানসম্মান আর রইলো না আমার।
– ভাইয়া আপনি খাচ্ছেন না কেন?
দীপ্ত ভাইয়া আমার থেকে দৃষ্টি সরিয়ে এদিক সেদিক তাকালেন। তারপর গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন,
– দু’প্লেটই তোর। আমি এসব খাই না।
মানে কি ভাই বিরিয়ানি নাকি কোনো মানুষে খায় না। এ আদৌ মানুষ নাকি অন্যকিছু। যাক বাবা খাবে না এতে আমারই লাভ হলো। দু’প্লেট বিরিয়ানিই তাহলে আমার।হঠাৎ করে মাথায় আসলো উনি আমায় বিরিয়ানি খাওয়াচ্ছেন কেন? কি উপলক্ষে?ইচ্ছেটাকে দমিয়ে না রেখে ওনাকে প্রশ্নই করে ফেললাম,
– আচ্ছা আপনি কি উপলক্ষে আজ হঠাৎ আমায় বিরিয়ানি খাওয়াচ্ছেন?
– ওইদিন তোকে বললাম না আমি আমার স্বপ্নের খুব কাছাকাছি পৌঁছিয়ে গেছি। আজকে আমি ভীষণ খুশি সেজন্য ভাবলাম তোকে বরং ট্রিট দেই।
ওনার কথা শুনে আমার কাঁশি উঠতে গিয়ে উঠলো না। ওনার খুশিতে উনি আমায় ট্রিট দিচ্ছেন ভাবা যায় এগুলা।
– আচ্ছা বলুন না আপনার স্বপ্নটা কি? পাক্কা প্রমিজ কাউকে বলবো না। আমার হবু জামাইয়ের কসম।
কথাটা বলেই জিহ্বায় কামড় দিলাম। কি বললাম মাত্র আমার হবু জামাইয়ের কসম। মুখ ফসকে বেরিয়ে গেছে। উনি এখন আমায় কি ভাববেন কি জানি।
– তোর হবু জামাইয়ের বউয়ের কসম। আমিও সময় হলে সব বলবো।
আমার হবু জামাইয়ের বউ মানেতো আমিই উনি আমার কসম দিলেন। কিন্তু এমন ঘুরিয়ে পেছিয়ে বললেন কেন? যাক গে সেসব কথা ওনার পেট থেকে আসল কথাটা বের করতে পারলেই হলো।
– ভাইয়া আজকে বলুন না। সত্যি বলছি আমি কাউকে বলবো না।
– আচ্ছা মৌ এখন থেকে তুই আমার সাথে কথা বললে আমার দিকে তাকিয়ে কথা বলবি।
– কেন?
– এতদিন ভাবতাম তুই অন্যদিকে তাকিয়ে কথা বললে মনে হয় আমার জন্য ভালো হবে, তবে এখন মনে হচ্ছে তুই আমার চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বললেই ভালো হবে।
ওনার এই আউলাজাউলা কথা শুনে আমি ওনার দিকে হ্যাবলাকান্তের মত তাকিয়ে আছি। তা দেখে উনি শুঁকনো কাঁশি দিয়ে বলেন,
– আচ্ছা মৌ। তোকে একটা কথা বলার ছিল। শোন দোয়া করিসরে পড়শু চাকরীর ইন্টারভিউ আছে। চাকরীটা যেন হয়ে যায়।
– আপনার আবার চাকরীর কি দরকার? আপনাদের এত বড় ফ্যাক্টরি আছে। আপনারতো আপনাদের অফিসের দায়িত্ব নিলেই হয়। আর মাত্র না পরীক্ষা দিলেন রেজাল্ট কি বেরিয়েছে নাকি?
– এই চাকরীই তো আমার স্বপ্ন পূরণে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। চাকরী না পেলেতো আমার এতদিনের স্বপ্ন পূরণ হবে না। বাবার অফিসে জয়েন করলেতো কবেই করতাম। কিন্তু আমায় যে নিজের দক্ষতার বলে প্রতিষ্ঠিত হতে হবে। আর বোকা মেয়ে পরীক্ষা দিয়েছি মাস্টার্সের অনার্সের রেজাল্ট দিয়ে বুঝি চাকরী হয় না?
আমি কিছু বলছিনা আপাতত খাওয়াতে মশগুল আছি। উনি হঠাৎ করে বলে উঠলেন,
– সরি।
এবার আমার কাঁশি সত্যি সত্যি উঠে গেল। দীপ্ত ভাইয়া তাড়াতাড়ি আমায় পানি এগিয়ে দিলেন। আমি এক নিঃশ্বাসে পানিটুকু শেষ করে ওনার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলাম।উনি আমায় হঠাৎ সরি বলছেন কেন?
– মানে?
উনি লম্বা একটা শ্বাস টেনে বললেন,
– আসলে আজ পর্যন্ত তোর সাথে যা যা খারাপ ব্যবহার করেছি সে সবকিছুর জন্য সরি।আর সরি বলছি এটা ভাবিস না আবার অন্যায় করলে আমি তোকে ছেড়ে দিবো। অন্যায় করলে শাস্তি পেতেই হবে।
এ আবার কি? নিজের কাজের জন্য সরি বলছে আবার হুমকিও দিচ্ছে। এনার মাথা মনে হয় গেছে।
– তোর খাওয়া শেষ হয়েছে?
আমি মাথা থেকে সব জেরে ফেলে বলি,
– হুম।
– চল এবার।
চলবে…