#তৈলচিত্রের_কলঙ্কিনী
#অন্তিম_পাতা
#লেখিকা_মুসফিরাত_জান্নাত
রায়ার এই অটলতার জন্যই হয়তো তাকে হেলাতে অক্ষম হতো সবাই।কিন্তু ভাগ্য তার সুবিধার নয়।বিচারকার্যের এই সময়ে রায়ের পুরো মোড় পাল্টে দিতে জাহেদের আইনজীবী মোশাররফ করিম বললেন,
“মাননীয় বিচারপতি,আমার মক্কেলের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে তা সম্পূর্ণ রুপে মিথ্যা।ধর্ষিতার শরীরের আলামত, রক্ত ও সিমেন থেকে প্রাপ্ত ডিএনএ আমার মক্কেলের ডিএনএ’র সঙ্গে ম্যাচ করেনি।সেসব তথ্যের প্রমাণ হিসেবে একটা কপি আপনার সামনে পেশ করা হলো।এছাড়া আমার মক্কেল ও তার পক্ষের সাক্ষীর ভাষ্য থেকেও প্রমাণিত হয় বাদী কর্তৃক উল্লেখিত সময়ে সে ব্যবসার প্রয়োজনে শহরে উপস্থিত ছিলো।তার ব্যক্তিগত ফোনের লোকেশনের তথ্যও তাই প্রমাণ করে।যেহেতু একই ব্যক্তি একই সময়ে দুই জায়গায় থাকতে পারে না এবং সব তথ্য প্রমান সাপেক্ষে আমার মক্কেল নির্দোষ।অতএব তাকে মুক্তি দেওয়ার আবেদন করছি।”
আইনজীবীর কথাগুলো শুনে হতবাক হয়ে যায় রায়া।এছাড়া ডিএনএ রিপোর্ট দেখে থমকে যায় সে।এটা কি করে সম্ভব?রিপোর্ট সত্যি আনম্যাচ।হতবিহ্বল হয়ে যায় সে।রিপোর্ট ম্যাচ না করার তো কোনো কারণ অবশেষ নেই।দিনের বেলায় এতো বড় চোখের ভ্রম হতেই পারে না।এছাড়া পাড়ার লোকেরা যারা তাকে তুলে নিয়ে যাওয়ার সময় দেখেছে তারাও তো বলেছে ওটা জাহেদই ছিলো।তবে এমনটা কেনো হলো!
আকষ্মিক ঘটনায় কিংকর্তব্য বিমূঢ় রায়ার উত্তপ্ত রক্তস্রোত মস্তিষ্কে দ্রুত বেগে ধাবিত হয়।মস্তিষ্কের এতো চাপ সে সইতে পারে না।আবার উৎপাত করে সব ভণ্ডুলও করতে পারে না।সব সাক্ষ্য প্রমাণ রায়ার প্রতিকূলে।মনের ভিতরে প্রতিরোধের উত্থাল আগুন দাউ দাউ করে জ্বলে উঠলেও, বহিঃপ্রকাশ শূন্য থাকতে হয় তাকে।কেননা কোর্ট জাহেদকে মুক্তি দিয়ে দিয়েছে।ধীরে ধীরে সবাই বেরিয়ে যায়।শুধু থেকে যায় এই কোর্টের সারি জুরে আরেক দূর্নীতিতে ভরা জঘন্যতম বিচারকার্যের ইতিহাস।রায়া বুঝেই পায় না ঠিক কীভাবে এতো সাক্ষ্য প্রমান বদলে ফেললো ওরা।নিশ্চয় জাহেদের পক্ষের সাক্ষীদাতাদের প্রানের ভয় অথবা টাকার লোভ দেখিয়ে কিনে নেওয়া হয়েছে।এসব দেখে আফসোস হয় রায়ার।দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে।দূর্নীতিকে ঘেরা এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজে এভাবেই কি সব জালিয়াতি হয়ে যাবে?বার বার অন্যায় করে মুক্তি পেয়ে যাবে জুলুমকারীরা!জানা নেই তার।সে শুধু জানে,তার সাথে অন্যায় করা হয়েছে,ঘোর অন্যায়।যার বিরুদ্ধে সে একাই ব্যবস্থা নিবে।যেই পুরুষের দল নিজের জাতের অপমান হবে বলে অনায়াসেই অন্যায়কারীকে সাহায্য করে,এমন কাপুরুষের সাহায্যেরও তার প্রয়োজন নেই।
_____
সময়টা তখন রাত্রি এক প্রহর।গ্রাম্য সমাজে শীতলতার স্পর্শে এতেই নিরব প্রকৃতি।দূর হতে বন্যপ্রাণীর গা ছমছমে ডাক কুয়াশা ভেদ করে ভেসে আসছে অন্দরমহলে।যার শব্দ ধ্বনি রাতের বক্ষে কেমন যেনো এক রহস্যপট সৃষ্টি করছে।রায়া তার ছোটো লতানো দেহখানি মেলে অগোছালো পা ফেলে বৈঠক খানার ঘরটায় দাঁড়িয়ে আছে।শান থেকে ঠান্ডা উঠছে।রায়া গুটিশুটি মেরে খালি পায়ে দাঁড়িয়ে আছে সেই ঠান্ডা মেঝেয়।পুরোপুরি বৈঠক যখন জমে এলো তখন ভীষণ বিশ্রী রকমের একটা অনুভূতি হলো তার মন জুড়ে।তিক্ত এক অনুভূতি।রায়ার মস্তিষ্ক সজাগ হলো।এমন তিক্ত অনুভুতি এর আগেও হয়েছে।যেদিন সে বিচার পাওয়ার নেশায় সোচ্চার হয়েছিলো,তখনও পরিবারের মানুষ তার দিকে ঢিল ছুড়েছে এভাবে।যার দাগ এখনো তার গা থেকে শুকায়নি।কিন্তু তখন ঢাল হয়ে দাঁড়িয়েছিলো নাহিয়ান।এখন সেও নিরব।যেই বিচারের আশায় সবার রায়ের অবাধ্য হয়েছিলো সে,অন্যায়কারীর গালে চ ড় দিতে চেয়েছিলো,সেখানে সেই চ ড় নিজের ঘাড়েই এসে পড়েছে তার।এখন এভাবে চারিদিকের আঘাত তো তার সইতে হবেই।রায়ার নিরবতার মাঝেই কানে আসে বাবার হুংকার।
“খুব তো তোর লেখাপড়াকে প্রাধান্য দিচ্ছিলি,অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর কথা বলছিলি,তার কি হলো এখন?সেই অন্যায় তো নিজেই করে বসলি।নিরপরাধ একজন মানুষকে অপরাধী বানিয়ে সাজা দেওয়ার পায়তারা করছিলি।হলো তো সব ভণ্ডুল!”
“এতোকিছুর পর তুমিও বিশ্বাস করছো জাহেদ নিরপরাধ আব্বু?পাড়ার লোকেদের কথা শুনোনি।ওরাও তো দেখেছে জাহেদ কীভাবে দিনের আলোয় আমাকে তুলে নিয়ে গিয়েছে।ঘুষ খাইয়ে রিপোর্ট বদল করে ফেলেছে ওরা।এটা বুঝতে পারছো না কেনো?”
শক্ত কণ্ঠে জবাব দেয় রায়া।চেতে ওঠেন মোর্শেদ তালুকদার।গলা খেঁকিয়ে বলেন,
“হ্যাঁ এখন তো এসবই বলবি।বলার আর কিছু আছে নাকি তোর?নিজেকে তো খুব বড় পণ্ডিত প্রমাণ করার চেষ্টা করছিস।সত্যি করে বল তো রায়া,তোর কোনো নাগর টাগর নেই তো?যার সাথে এই কুকাম করে, নিজের দোষ লুকাতে জাহেদকে দোষাচ্ছিস।”
এতক্ষণ নিচের দিকে সীমাবদ্ধ রাখা দৃষ্টি তুলে তাকালো রায়া।এত বাজে রকমের প্রশ্ন যে তার আপন চাচা করবে সে কখনো কল্পনাতেও ভাবেনি।রাগে গা জ্বলে উঠলো তার।অগ্নি ঝাড়া দৃষ্টিতে তাকিয়ে সে বলে,
“আমাকে বর্তমানে দেখে ছিঃ ছিঃ করা পাড়ার মানুষগুলোও কি জাহেদকে অকারণে দোষ দিচ্ছে বলতে চাইছেন?সবাই দেখেছে ওই নরপশু আমাকে কীভাবে তুলে নিয়ে গিয়েছে।তারপরও এমন অপবাদ কীভাবে দিতে পারলেন চাচা?তাছাড়া ওরা যদি দোষ নাই করে থাকে তবে ব্যবহৃত একটা মেয়েকে কেনো বিয়ে করতে রাজী ছিলো বলুন?”
এবার আর কোনো উত্তর খুঁজে পেলো না কেও।কথাটা একেবারে যুক্তিহীন নয়।বরং গভীর ভিত্তি আছে কথার।যা ভেঙে গুড়িয়ে দেওয়ার সাধ্য কারো নেই।রায়া অবশ্য কাওকে সে সময়টাও দিলো না।বেরিয়ে গেলো ঘর থেকে।কেবল মাত্র ফ্যাল ফ্যাল করে যাত্রাপথে তাকিয়ে থাকলো ওরা।
_______
পরদিন সকালে রবির আগমনের বেশ খানিকটা পরে হৈ হৈ পড়ে গেলো সারা গ্রাম জুড়ে।হৈ হৈ পড়ার ঘটনাই ঘটেছে বটে।তালুকদার বাড়ির ধর্ষিতা কন্যা যে খু’ন করে বসেছে।তাও আবার পর পর তিনজনকে।ক্যারাম খেলার দোচালা টিনের ঘরটায় থরে থরে তাদের লা’শ পড়ে আছে।সাথে পড়ে আছে র’ক্ত মাখা কায়া রায়া।হ’ত্যা করে সারা রাত ওদের নিথর দেহ দেখে মনের জ্বালা মিটিয়েছে সে।এখনো নিশ্চল হয়ে বসে আছে ওখানে।সকাল বেলা কানাই সওদাগর বাজারে যাওয়ার পথে এই দৃশ্য দেখে হাঁকডাক শুরু করে দেয়।তারপরই মানুষ জড়ো হয়ে যায়।ধীরে ধীরে ঘটনাটা তালুকদার বাড়ি অবধিও পৌঁছে যায়।বাড়ির সবাই ছুটে আসে ঘটনাস্থলে।রাতের আঁধারে কন্যা কখন সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে এখানে এসেছে জানা নেই কারো।এজন্য নাহিয়ানের ভীষণ আফসোস হয়।ধর্ষনের বিচার না হলেও ধর্ষকের খু’নের বিচার এ সমাজে ঠিকই হবে।হন্তদন্ত হয়ে ছোটে সে রায়ার কাছে।ভীর ঠেলে এগিয়ে গিয়ে বলে,
“এটা কেনো করলি রায়া?”
নিষ্প্রাণ চোখ দুটো মেলে তাকায় রায়া।ভারাক্রান্ত কণ্ঠে বলে,
“যেখানে অন্যায়ের শাস্তি আইন দেয় না,সেখানে নিজের সাথে করা অন্যায়ের দায় ভার নিজেকেই নিতে হয়।”
প্রতিউত্তরে দীর্ঘশ্বাস ফেলে নাহিয়ান।মেয়েটার বুকে জমা ক্ষতের গভীরতা আন্দাজ করে।মিইয়ে যাওয়া গলায় শুধায়,
“কিন্তু এটা করা কি ঠিক হলো?”
“নাহ এটা করা ভুল হয়েছে।তবে যদি কিছু না হতো আরও অধিক ভুল হতো।এবার আপনিই বলুন কোনটা করা ভালো?ভুল নাকি অধিক ভুল?”
কিছু একটা ছিলো রায়ার কণ্ঠে, যা নিরব করে দিলো নাহিয়ানকে।উপস্থিত জনতাও যেনো থমকে গেলো কথাগুলো শুনে।তাদের মাঝের চাঞ্চল্যতা থেমে গেলো যেনো।কেও কেও গুঞ্জনও তুললো ঠিক হয়েছে,একদম উচিত কাম করছে।কিন্তু এই উচিতকে অনুচিত প্রমাণ করতে আইনের দু দণ্ড ভাবতে হলো না।সাজা হয়ে গেলো রায়ার।কারাগারে ভরে দেওয়া হলো তাকে।অকালেই ঝরে গেলো একটি প্রাণ।কাঠগড়ার আসামী হয়ে গেলো কন্যা।তবুও যেনো তার সম্মানে ভাটা পড়লো না একটুও।বরং বেড়ে চললো তার গুনগান।ঘরে ঘরে নতুন জাগরণের সৃষ্টি হলো।বিষয়টা নাড়িয়ে দিলো সবার শেকড়।ধর্ষকের মনে ভয়ের জন্ম হলো।কচু কা’টার মতো কা’টা বডি গুলোকে দেখলে ভয় যে হওয়ারই কথা।
লোকে বলতে লাগলো এমন রায়ার জন্ম হয়তো আরও পূর্বেই হওয়া উচিৎ ছিলো।তবে আর কোনো নারীর সম্মান, সম্ভ্রম হারাতে হতো না।আসামী হয়েও সে সবার চোখে জ্বলন্ত উদাহরণ হয়ে বেঁচে রইলো।যাবত জীবন কারাদণ্ড হলো তার।কিন্তু অন্যান্য খু’নের আসামীর মতো ঘৃন্য হয়ে নয়,বরং কারাগারের দিনগুলিতে সবার সম্মানই পেয়ে গেলো সে।অন্যান্য আসামী সহ কারা কর্তৃপক্ষও সম্মান দিয়ে গেলো তাকে।রায়া একবার কারাকর্তৃপক্ষকে জিজ্ঞেস করেছিলো তাকে এতো সম্মান জানানোর কারণ কী!সে তো আসামী।উত্তর হিসেবে পেয়েছিলো,স্রোতের বিপরীতে চলা রমনী সে।নিজ অন্যায়ের হ’ত্যাকারী।তাকে অসম্মান করার সাধ্যি কারো আছে নাকি?
মনটা ভরে গিয়েছিলো রায়ার।নতুন কিছু করার আরও উ’ন্মাদনা পেয়েছিলো।তাই তো অন্ধ প্রকোষ্ঠের দিনগুলিতে সে আঁকিয়ে ফেললো এক যুগান্তকারী চিত্র।য়ার নাম দিলো ‘কলঙ্কিনী’।চিত্রটিতে স্থান পেয়েছে অর্ধ ছেড়া পোশাকে আবৃত এক ধর্ষিতার কায়া।যার মাঝে একটা মেয়ের সব হারিয়ে নিঃস্ব অবস্থার কষ্টটা পরিস্ফুটিত হয়েছে।তার এই ‘তৈলচিত্রের কলঙ্কিনী’ আরও একবার নাড়িয়ে দিলো সবার শিকড়।
সমাপ্ত