#তৈলচিত্রের_কলঙ্কিনী
#পর্ব_২
#লেখিকা_মুসফিরাত_জান্নাত
তালুকদার মহল’ এর অভ্যন্তরে নিজেদের মাঝে আলোচনা সভা বসেছে।সভার বিষয়বস্তু হলো কলঙ্কিত মেয়েটির বিয়েতে অমত।অন্দরমহলে ছোটোখাটো একটা বৈঠক বসেছে।ঘরের এক কোণায় দাঁড়িয়ে আছে রায়া।সদর দরজার বাহির থেকে জোরপূর্বক ধরে নিয়ে আসা হয়েছে তাকে। তার গন্তব্যস্থল বদলে ফেলে এখানে বসিয়েছে চরম কঠোরতায়।গায়ে তার শুকিয়ে আসা র’ক্তের ভ্যাবসা গন্ধ।সেসবকে ছাপিয়ে করা হয়েছে এই বৈঠক আয়োজন।বাড়িতে পুরুষ মানুষ বলতে আছে রায়ার বাবা মশিউর তালুকদার,ছোট চাচা মোর্শেদ তালুকদার ও তার ফুপা জামিল উদ্দীন।আর বাকিরা সবই মেয়ে।ঘরময় গাঢ় নিস্তব্ধতা।শান্তশিষ্ট মেয়েটির এমন অবাধ্যতা নিশ্চুপ করে দিয়েছে তাদের।নিরবতার পর্দা ছিড়ে মুখ খুললেন মশিউর তালুকদার।বাড়িতে পুরুষদের মাঝে সবচেয়ে বয়োজেষ্ঠ্যা সে-ই আছে।এছাড়া রায়ার পিতা তিনি।তাই সিদ্ধান্তের ভার আজ তার কাঁধে।মশিউর তালুকদার বিচলিত ভঙ্গিতে আরাম কেদারা থেকে দাঁড়িয়ে রায়ার দিকে দৃষ্টি ফেলে বললেন,
“তুই নাকি বিয়ে করবি না বলে জানিয়েছিস? নিজেকে কী ভাবিস তুই?বিরাট কিছু?নাকি সব তোর লেখাপড়া শেখার অহংকার?”
শেষের বাক্যটা যে ভীষণ তাচ্ছিল্য ভরে উল্লেখ করেছে তার পিতা তা বুঝতে বাকি রইলো না কারো।বাড়ির সব পুরুষ মানুষই উচ্চশিক্ষিত।তার উপর কথাটা বলার সময় মশিউর তালুকদারের ঠোঁটের কোণে তীব্র কঠোরতার এক রেখা দেখা গিয়েছিল।তা গোপন হয়নি কারো দৃষ্টিতে।যা রায়াকে ভেতর থেকে আরেকটু কঠোর করলো। সে শক্ত কণ্ঠে বললো,
“হ্যাঁ আমি আমার লেখাপড়াকে প্রাধান্য দিচ্ছি।অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর শক্তি দিয়েছে আমার এই শিক্ষা।তার জোরেই আমি বিয়ে করবো না বলেছি।আমার অল্প শিক্ষা আমাকে জানিয়েছে একজন ধর্ষকের সাথে ধর্ষিতার বিয়ে দেওয়া মানে আরও ধর্ষককে প্রশ্রয় দেওয়া।যা আপনাদের উচ্চ শিক্ষিতদের সম্মান রক্ষার সিদ্ধান্তের চেয়ে ঢের ভালো আব্বু।”
পুরুষের কথার পিঠে মেয়েদের এমন শক্ত গলায় আওয়াজ তোলা চরম বেমানান কাজ।পুরুষের গায়ে তা অপমানের ঢিল ছোড়ে।যা রাগিয়ে দেয় রায়ার বাবাকে। সে বিরাট এক ধমক দিয়ে বলে,
“ভালো মন্দ বিচার করার তুই কে হ্যাঁ?কতটুকুই বা বয়স তোর?তাছাড়া সতীত্ব নষ্ট করার পরও নিজের সিদ্ধান্ত নেওয়ার মুখ থাকে কারো?”
“বাড়ির মুরুব্বীরা যখন ভুল পথে হাটে তখন সবচেয়ে কনিষ্ঠ হয়েও নিজের সিদ্ধান্তটা নিজেকে নিতে হয় আব্বু।আর সিদ্ধান্ত তো আমি নিতে চাইছি না।সিদ্ধান্ত নেবে আইন, তাতে এতো সমস্যা কিসের?”
রায়ার কথাটা জলন্ত অনলে ঘি পড়ার মতো কাজ করলো।তেড়ে এলেন মোর্শেদ তালুকদার।রায়ার একদম কাছাকাছি এসে সে যেন উৎপাত শুরু করে দিলেন।অগ্নি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে প্রায় চেঁচিয়ে বললেন,
“বড়দের মুখে মুখে তর্ক করা তালুকদার বংশের মেয়েদের শোভা পায় না মেয়ে।জানে কি ভয় ডর বলতে কিছু নেই?”
“কিসের ভয় পাবো চাচা?হারানোর কি আর কিছু আছে?”
রায়ার উচ্চারিত গীতিকাব্যে থমকে গেলো সবাই।সত্যি হারানোর আর কিছু নেই।সম্মান যা যাওয়ার তা ক্ষয়েই গিয়েছে।তবে কীসের ভয় পাচ্ছে তারা?
চোখ দু’টো বন্ধ করে ফেলেন মশিউর তালুকদার।একবার মনে হলো মেয়ের সাথে তিনি অন্যায় করছেন।আবার পরমুহুর্তেই নিজের গো বজায় রাখতে চোখ দুটো খুলে ফেললেন।নরম হয়ে আসা দৃষ্টি ধীরে ধীরে শক্ত হতে থাকলো।খেঁকিয়ে উঠলেন তিনি। যতই হোক, তাদের সিদ্ধান্ত কোনো মেয়েলোকের কথার কাছে হেরে যেতে পারে না।তাও কিনা এতো বাচ্চা মেয়ের কাছে।কঠোর হয়ে কিছু বলতে যায় সে।কিন্তু হটাৎ সেখানে তোরজোর করে প্রবেশ করে নাহিয়ান।ভেতরে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে গর্জিত হয় তার বাজখাঁই গলা,
“রায়া সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে চাচা।তোমরা কি করে পারলে একজন ধর্ষকের হাতে বাড়ির মেয়ে তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে?একজন ধর্ষকের মতো নরপশু মেয়ের জামাই হলে সম্মান পেতে?আমার ভাবতেই মাথা কা’টা যাচ্ছে আমি তোমাদের ঘরের সন্তান।তবে যাই বলো চাচা।ও বিয়ে করতে না চাইলে করবে না।কেও জোর করতে আসবে না ওকে।অন্তত আমি জীবিত থাকতে এই বিয়ে হতে দেবো না।”
নাহিয়ানের কঠোর কন্ঠে হতবিহ্বল হলো সকলে।ছেলেটি চরম অপছন্দনীয় কথা বললেও তার কথার পিঠে কথা বলার সাহস করে না কেও।নাহিয়ান বংশের একমাত্র পুত্র সন্তান ।বাড়ির একমাত্র পুত্র যে বড় আদরের।তার জেদের কাছে পেরে ওঠে না কেও।সে যখন একবার বলেছে তবে এ রায় নাকচ করার সাধ্য নেই কারো।তাছাড়া রায়া অপ্রাপ্তবয়স্কা মেয়ে।পুলিশি ঝামেলা করে বিয়ে ভাঙার হুমকি দিতেই সটকে পড়ে সবাই।চরম অসন্তোষ নিয়ে বেড়িয়ে যায় তারা।যাত্রাপথে ব্যঙ্গাত্মক কন্ঠের গুঞ্জন তোলে।সেসবকে উপেক্ষা করে রায়ার কাছে গিয়ে মাথায় হাত বুলায় নাহিয়ান।রায়ার ক্ষত বিক্ষত শরীরে তাকিয়ে হাহাকার করে উঠল তার মন।চঞ্চল তো কম ছিলোনা মেয়েটা।এই চঞ্চলতাই যেন কাল হয়ে দাঁড়াল রায়ার।মেয়েটার সবসময় উড়ে বেড়ানোর অভ্যােস ছিল।একটা কলঙ্কের কি এতটাই ক্ষমতা যে তার সব রাঙানো স্বপ্নকে পুড়ে ছাই করে দিবে?রায়া মিনমিন করে বললো,
“আমি আইনের আশ্রয় নিব ভাইয়া।আমি এমন অপরাধীকে বিয়ে করে মুক্তি দিব না।”
নাহিয়ানের হৃদয় পর্যন্ত পৌঁছালো সে কথা।একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে।এ সমাজ যে অনেক কঠোর।ধর্ষকের শাস্তি যে এত সহজে যে এ দেশে হবে না। নানা ঝড় ঝাপ্টা পাড়ি দিতে হবে।পুরুষতান্ত্রিক সমাজে বাস করে পুরুষদের সাথেই লড়াই করতে হবে।আইনের দেওয়া জখমও কম হবে না।ছোটো রায়া পারবে তো এসব সইতে?সংশয়ে কলিজা কাঁপে তার।রায়ার এক হাত ধরে বেরিয়ে পড়ে সে থানার উদ্দেশ্যে।ধর্ষণের ৭২ ঘন্টার মধ্যে যে হাজির হতে হবে তাকে।নইলে যে শরীরের আলামত নষ্ট হয়ে যাবে।
_______
প্রকৃতি তখন ভারী হীম।গাছ, পাতা সব ধোঁয়া ওঠা কুয়াশায় ভিজে একাকার।কুয়াশার চাদর যেন সবকিছুকে জাপ্টে ধরছে দু’হাত মেলে।কুহেলিকার এমন সম্বোহনে ঘরের ভিতরে লুকিয়ে রয়েছে সবাই।যার ফলে নিস্তব্ধ পরিবেশ।প্রকৃতি থেকে শুরু করে বাহিরে বিরাজমান হাতে গোনা কয়টা মানুষ ভীত হচ্ছে এমন নিঃশব্দে।রাত্রের শুরুর দিকটায় নিজ এলাকার থানা জুড়ে শুরু হয়েছে অভিযোগ দায়েরের কাজ।যার দরুন এখন আর থানার ওসি আরাম করে আরাম কেদারায় বসে গোঁফে তা দেওয়ার মুডে নেই।এখন তার কপালে গায়ের খাকি পোশাকের অধিকার দেওয়া নোংরামোর গাঢ় ভাঁজ।সেই পোশাকের বলেই সে নিজ মেয়ের বয়সী এক কন্যার থেকে তথ্য সংগ্রহের নামে করে চলেছে আপত্তিকর সব প্রশ্ন।যা একজন কন্যার জন্য কম বিব্রতকর ও কষ্টকর নয়।পুলিশের আপত্তিকর এমন সব প্রশ্ন শুনে রায়ার মনে হয় সে যেনো আবারও ধর্ষিত হচ্ছে।শারীরিক স্পর্শে না হলেও কথার দ্বারা তার অস্তিত্ব ধ্বংস করার প্রয়াস চলছে এখানে।পুলিশের করা একেকটা প্রশ্নের নোংরা ছোঁয়ায় তার গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে।কিন্তু নিজের বুকে আসা যন্ত্রণাদের ছাপিয়ে,গায়ের লাজ সম্ভ্রম ত্যাগ করে পুলিশকে অভিযোগ লিপিবদ্ধের নামের দ্বিতীয় কলঙ্ক গায়ে লেপ্টে নেয় সে।অভিব্যক্তি তার গম্ভীর।যেন কোনো সুউচ্চ হিমালয় তার সম্পূর্ণ বিশালতার শক্তিকে ঢাল করে দাঁড়িয়ে আছে।
সকলে হতভম্ব চোখে তাকিয়ে রয় রায়ার দিকে। এতো অল্পবয়সী মেয়ে যে এমন শক্ত চোখ মুখে সব প্রশ্নের জবাব দিতে পারে কেউ কল্পনাতেও বোধ হয় ভাবেনি।যেখানে প্রাপ্ত বয়স্কা সহ বড়রাই এমন অবস্থায় অস্বস্তিতে হিমশিম খায়,সেখানে ষোড়শী এক কন্যার এমন ভঙ্গিমা তাদের নাড়া দিতে পূর্ণ দমে সক্ষম।পুলিশ অফিসার হয়তো বোঝেন,এই মেয়ে অন্য ধাতুর তৈরী।মেয়েটির চোখে মুখে কেমন ছারখার করে দেওয়া শক্তি।ওই চোখে চোখ রাখলেই পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে তার পৈশাচিক চরিত্র।তাই তাকে আর অপ্রয়োজনীয় প্রশ্ন করে বিব্রত করার সাহস করেন না অফিসার।দ্রুত নিজের কাজ সেড়ে মেডিক্যাল পরীক্ষার জন্য পাঠিয়ে দেন।থানায় আসার সময় কাগজের ব্যাগে ভরে আনা ধর্ষনের সময় পরিধান করা পোশাকটা সেখানেই রেখে যায় সে।যেহেতু সে গোছল করে আলামত মুছে ফেলেনি তাই প্রমান সংগ্রহে বেগ পোহাতে হয় না ডাক্তারদের।এভিডেন্স কালেক্ট করে মেয়েটিকে সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়।
নাহিয়ান বিস্ময় ভরা চোখ নিয়ে তাকিয়ে থাকে নিজের সদ্য ধর্ষিতা চাচাতো বোনের দিকে। এইতো, সেদিন যখন তার বিয়ে পাকা করা হয় তখনও কতো নরম ও ভীত ছিলো মেয়েটা।পাত্রপক্ষের সামনে বসে কাচুমাচু করছিলো সে।কারো দিকে চোখ তুলে তাকালো না অব্দি।মাথা নত করে একহাত ঘোমটা টেনে চুপচাপ বসে ছিলো।বিয়েতে তার প্রচুর দ্বিমত থাকার পরও কোনো রা অব্দি করেনি।অথচ সেই নিশ্চুপ মেয়েটা কেমন যেন বুঝদার হয়ে গেলো এক দিনের ব্যবধানে।যাকে একটা ধমক দিলে কান্না করে গা ভাসিয়ে দিতো,সেই মেয়েটাই কিনা নিজের শরীরে হাজারো চ ড়ের আঘাত মুখ বুজে সহ্য করে যাচ্ছে।পারছে কীভাবে মেয়েটা?যেখানে এই পুরো প্রক্রিয়ায় সে নিজে পুরুষ মানুষ হয়েই বিধ্বস্ত হয়ে যাচ্ছে, সেখানে এই মেয়ে এতো অটল আছে কি করে?ভেবে পায় না নাহিয়ান।বিষয়টা চিন্তিত করে দেয় তাকে।
নাহিয়ানের ভাবনার মাঝেই পুরো প্রক্রিয়ার সমাপ্তি ঘটে।ধীরে ধীরে দিন কেটে যায়।এর মাঝে বিচার পাওয়ার সমস্ত কাঠগড়ায় শক্ত শরীরে অটল হয়ে দাঁড়ায় রায়া।বিবাদী পক্ষের আইনজীবীর করা প্রশ্নে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যায় রায়ার নারী সত্তা।সে স্পষ্ট বুঝতে পারে,এই সমাজে নারীরা বিচার চাইতে গেলে ধর্ষনের শিকার হয় তিনবার।প্রথম ধর্ষণের পর দ্বিতীয় ধাক্কা আসে অভিযোগ দায়েরের সময়।আর চুড়ান্ত ধর্ষণটা হয় বিচারের রায় দেওয়ার পূর্বে।সমাজের এই নিয়ম এক বারের জন্য হলেও রায়াকে ঝলসে দিতে বাধ্য করে।ঘর ভর্তি মানুষের সামনে যখন তাকে জিজ্ঞেস করা হয়,ওই সময়টা সে উপভোগ করেছে কিনা?তখন ঝলসে যেতে বাধ্য হয় সে।তার অসহায়ত্বের সুযোগে গজিয়ে ওঠা দুর্বল মন বুঝে যায়,এই সমাজে ধর্ষণের বিচার হয় না কেনো।কেনোই বা বাড়ির মুরুব্বীরা বিচার না চেয়ে বিয়ে দিতে তৎপর হয়।উত্তরটা সে অনায়াসেই পেয়ে যায় এই বিচারের কাঠগড়ায়।এখানের বেশিরভাগ আইনজীবি, জজ ও বিচারের সাথে সংশ্লিষ্ট সবাই পুরুষ।ধর্ষকও একজন পুরুষ।আর পুরুষেরা নিজেদের গায়ে নিজেরা চ ড় লাগতে দিতে চায় না।তাই তো এই বিষয়ের বিচার পেতে বেগ পোহাতে হয় নারীদের।দেশে হাজারো ধর্ষণ হলেও বিচার পায় মাত্র কয়েকজন।বিষয়টা পুড়িয়ে দেয় রায়াকে।কিন্তু এই আগুন তাকে ছাই বানাতে পারে না।কয়লার মতো মূল্যবান হয়ে ওঠে সে।যা তাকে নতুন উদ্যোমে সাহস যোগায়।চারিদক থেকে ধেয়ে আসা ঝড়ের বিপরীতে বিশাল বট বৃক্ষের ন্যায় মাথা গজিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে সে।সেও যেনো দেখতে চায় ধর্ষণের বিচার পাবার জন্য আর কতবার ধর্ষিত হতে হবে তাকে।
চলবে