#তৃষ্ণার্থ_প্রেয়সী
পর্ব-০১
#লাবিবা_ওয়াহিদ
০১.
“দেখা তুমহে তো..এয়সা লাগা হে
জেয়সা ইয়ে আখে..ধারাক্নে লাগি,
যাব মে বাদেল বান জাওউ..
তুম ভি বারিশ বান জানা,
যো কাম পার যায়ে সাসেইন,
তুম মেরা দিল বান জানা…
রিমঝিম সাওয়ান কী বুন্দে
তু হার মোসাম বারসানা,
যো কাম পার যায়ে সাসেইন,
তুম মেরা দিল বান জানা…!!!”
গাড়িতে তিন বন্ধু গানের সাথে তাল মিলিয়ে নিজেরাও গাইছে। এমন সময় তিনজনের মাঝে একজন বলে উঠে,
-“সামি! ড্রাইভারকে গাড়ি থামাতে বল, দেখ সামনে থেকে একটা মেয়ে আসছে। এই ড্রাইভার গাড়ি থামাও জলদি।”
ফারিশের চেঁচামেঁচিতে ড্রাইভার গাড়ির ব্রেক কষলো। পেছন থেকে সেজান এবং ফারিশ সামনে তাকালো। একটা মেয়ে তাদের গাড়ির সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। মেয়েটির চোখ ছাড়া কিছুই দেখা যাচ্ছে না। ফারিশ সেজানকে নিয়ে গাড়ি থেকে নেমে মেয়েটির কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। কিছুক্ষণ পর সামিও নেমে আসলো। মেয়েটি হাঁপাতে হাঁপাতে পিছে হাত দিয়ে কিছু একটা ইশারা করছে। মেয়েটার ইশারা বুঝতে না পেরে তিনজন সামনে তাকালো এবং ল্যাম্পপোস্টের সোডিয়াম আলোয় দেখলো কিছু ছেলে এদিকেই আসছে৷ তাদের দেখে মেয়েটি ফারিশের পিছে গিয়ে লুকিয়ে পরলো ফারিশের শার্টের কিছু অংশ খামচে ধরে। মেয়েটা খামচে ধরায় ফারিশের বুকটা ধক করে উঠলো। হঠাৎ-ই আনমনে হয়ে গেলো সে। সেজানের কথায় তার ধ্যান ভাঙলো।
-“অনেকদিন কাউরে ডোজ দেই নাই ব্রো! চল আজ দিয়ে দেখি হাত-পা ঠিক আছে নাকি জম ধরে আছে।”
-“রাইট ব্রো! আজ শরীরটা ম্যাজম্যাজও করছে বেশ! ডোজটা দিলে মন-প্রাণ একটু শান্তি পাইবো!” সেজানের কথায় তাল মিলিয়ে বললো সামি।
-“আগে তো এটা দেখ মেয়েটার পিছু নিচ্ছে কেন তারা! মেয়েটার হাতে তো একটা ব্যাগও দেখতে পারছি, পালিয়ে আসেনি তো?”
-“হ মামা! ঠিক বলছিস! ব্যাপারটা একটু লাড়াচাড়া দিয়া দেখতে হইবো।”
ছেলেগুলা তাদের সামনে এসে দাঁড়ালো আর বিশ্রী ভাষায় কথা বলে মেয়েটিকে নিয়ে যেতে চাইছে। লোকগুলোর কথার কারণে তাদের মুখ থেকে মদের গন্ধ তিন বন্ধুর নাকে আসছে। এতে তারা বেশ বুঝলো এরা রাস্তার বখাটে, পোশাক-আশাকও একই কথা বলছে। একসময় তো ওই ছেলেগুলার মধ্যে একজন সামির গায়ে হাত উঠাতে আসলো। ভাগ্যিস ছেলেটার হাত ফারিশ ধরেছিলো। তাদের গায়ে হাত উঠানোর চেষ্টা করছে দেখে তিনজনই ক্ষেপে গেলো। ফারিশ ছেলেটার পেট বরাবর জোরে লাথি মারলো যার ফলে ছেলেটা ছিটকে তার বাকি চ্যালাগুলোর উপর গিয়ে পরলো। ফারিশ সামনে এগোবে তখন খেয়াল করলো মেয়েটা তার শরীরেই ঢলে পরেছে। এতে ফারিশ কিছুটা বিরক্ত হলো। সে সেজান এবং সামিকে সামনে এগোতে বলে নিজে পিছে ফিরে মেয়েটির দিকে তাকালো। মেয়েটি হা-হুতাশ করছে বারংবার। এর কারণ ফারিশ বুঝতে না পেরে অস্ফুট সুরে মেয়েটিকে বললো,
-“খারাপ লাগছে আপনার?”
মেয়েটির হাত আলগা হয়ে ধপ করে ব্যাগটা রাস্তায় পরে গেলো। ওদিকে সামি এবং সেজান দুজনেই উত্তম মাধ্যম দিচ্ছে ওদের। মেয়েটি নিভু নিভু চোখে ফারিশের দিকে তাকিয়ে কাঁপা গলায় বলে উঠলো,
-“পপা..পানি!”
ফারিশ মেয়েটির ব্যাগ এক হাতে নিয়ে আরেক হাতে মেয়েটিকে ধরে নিয়ে গাড়িতে আসলো। সাবধানে মেয়েটিকে বসিয়ে দিয়ে মেয়েটিকে পানির বোতল এগিয়ে দিলো। পানি পেতেই মেয়েটি তার খিমারের মুখোশটা খুলে ফেললো। মেয়েটার চেহারা আর কাজল কালো চোখ দেখে ফারিশ বিমোহিত হলো, হিতাহিত জ্ঞানটাই যেন হারিয়ে ফেললো। মেয়েটিকে নিয়ে ভাবনার জগতে যাওয়ার আগেই সেজানের ডাক পরলো। ফারিশ মেয়েটিকে নিয়ে না ভেবে উঠে দাঁড়িয়ে সেজানদের দিকে এসে প্রতিটা ছেলেকে বেশ ভালোভাবে কেলানি দিলো। একসময় ছেলেগুলো নিজেদের জান নিয়ে কোনোরকমে পালালো। ছেলেগুলা পালাতেই সামি জোরে শিষ বাজালো। আশেপাশে বাড়িঘর না থাকায় তাদের কোলাহলের শব্দ কেউ-ই শুনেনি। ড্রাইভার সব চোখ বড়ো বড়ো করে দেখছিলো। একসময় ভাবলো এসব গুন্ডা ছেলেদের ফেলেই সে তার গাড়ি নিয়ে চলে যাবে কিন্তু ছেলেগুলোর মারের স্টাইল দেখে সেই সাহস তার হলো না, তার উপর এতক্ষণের ভাড়াও তো তাদের থেকে পায়নি। ভাড়া ছাড়া খামখা চলে যাওয়ার মানেই হয় না। সেজান হাত ঝাড়তে ঝাড়তে হেসে বললো,
-“যেমন জম ধরসে ভাবসিলাম, সেরকম জম ধরে নাই! ভালোই এক্সারসাইজ হলো। কি বলিস তোরা?”
সেজানের কথায় সামি এবং ফারিশ একসাথে হেসে উঠলো। অতঃপর মেয়েটির কথা মগজে আসতেই তিন বন্ধু গাড়ির দিকে চলে আসে। ড্রাইভার এমনভাবে আছে যেন সে কিছুই জানে না, নিষ্পাপ বাচ্চা। তারা ড্রাইভারের দিকে মনোযোগী না হয়ে মেয়েটির দিকে তাকালো। মেয়েটি সিটের সাথে হেলান দিয়ে চুপ করে সামনের দিকে তাকিয়ে আছে। আবারও মুখোশ বেঁধেছে সে, হাতে তার পানির বোতলটা এখনো বিদ্যমান। সামি ভ্রু কুচকে বললো,
-“ছেলেগুলো তোমার পিছু নিলো কেন? তুমি কী পালিয়ে এসেছো বাড়ি থেকে?” সামির মুখের কথা কেড়ে নিয়ে সেজান বললো,
-“বাবা-মাকে ফেলে পালানোটা কিন্তু ঘোর অন্যায়!”
সেজানের কথায় সানাম যেন নাক সিঁটকালো। সানামের চোখজোড়া দেখে মনে হচ্ছে সেজান যেন তাকে কৌতুক শুনিয়েছে। সানামের এহেম কান্ডে সেজান বোকা বনে গেলো। সানাম সোজা হয়ে বসে তিনজনকে ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করে বললো,
-“আমি কেন নিজের বাড়ি থেকে পালাবো? আমি তো বান্ধুবীর বাসা থেকে পালিয়েছি।”
সানামের কথায় তিন বন্ধু একটু বেশি-ই বিস্মিত হলো। তিনজন একে অপরের দিকে চাওয়া-চাওয়ী করে একসাথে বলে উঠে,
-“মানে!!”
-“আর কী বলবো, বান্ধুবীর বাড়ি গেছি বেড়াতে আর ফকিন্নি আমাকে ফাঁসিয়ে দিয়ে চলে গেলো? আমি নাকি বিয়ে করবো ওর হবু বরকে? মানে সিরিয়াসলি? মাথা খারাপ নাকি যে অজানা ছেলেকে বিয়ে করতে যাবো! তাই আমিও পালিয়ে গেছি হু!”
-“তো এখন কই যাচ্ছিলে?”
-“স্টেশন! পাশের শহরে যেতাম কিন্তু ওই বদ ছেলেগুলো পিছু নেয়। ও সরি আপনাদের তো ধন্যবাদ জানাতেই ভুলে গেছি। ধন্যবাদ আমার হয়ে বদ ছেলেগুলোকে উদুম কেলানি দেয়ার জন্য।”
মেয়েটার এমন স্বাভাবিক কথাবার্তায় তিনজন আবারও বিস্মিত হলো। মেয়েটার তো তাদের ভয়-ই লাগছে না, এমনভাবে কথা বলছে যেন তারা মেয়েটির কতদিনের চেনা। মেয়েদের এমন পরিস্থিতিতে রিলেক্স হওয়াটা সত্যিই অস্বাভাবিক। সামি বলে উঠে,
-“তোমার নাম কী? আর তোমার বাসা কোথায়?”
বাসার কথা শুনে মেয়েটা যেন চুপ মেরে গেলো। কিছুক্ষণ সময় নিয়ে মাথা নিচু করে বলে,
-“আমার নিজস্ব কোনো বাড়ি নেই, আমি এতিম। এতিমখানাতে বড় হয়েছি। আর আমি সানাম, দোহা সানাম।”
সানামের নাম শুনে সামি মিনমিন করে একটা গান ধরলো,
-“সানাম রে, সানাম রে তুই মেরি সানাম হুয়া রে..!” গান গেয়ে নিজের অজান্তেই আবার হেসে ফেললো।
★
সামি, সেজান এবং ফারিশ এক রেস্টুরেন্টের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। সানাম ভেতরে গিয়েছে তার বিয়ের শাড়ি চেঞ্জ করতে। এই রেস্টুরেন্টটা ২৪ ঘন্টাই ওপেন থাকে। সেজান রেস্টুরেন্টটার দিকে তাকিয়ে বলে,
-“ভাই আমার মন মানছে না মেয়েটাকে একা স্টেশনে ফেলে আসার। ওর সেফটি প্রয়োজন!”
-“আমাদের কী করার আছে তাহলে?”
-“দেখ আমারও বোন আছে, আমি তার জায়গায় সানাম মেয়েটাকে চিন্তা করলাম। আমার বোনটাকে কে দেখতো বল তো? তাই কেন যেন ছাড়তে পারছি না। মেয়েটার থাকার ব্যবস্থা করলে কেমন হয়?” বলেই সেজান ফারিশের দিকে তাকালো, সাথে সামিও! দুজনের এমন চোখা দৃষ্টির মানে ফারিশ বেশ ভালোভাবেই বুঝতে পারলো। ফারিশ দুজনের দিকে তাকিয়ে মাথা ডানে বামে নাড়িয়ে অস্ফুট সুরে বলে,
-“একদম এই মেয়েকে আমার ঘাড়ে চাপানোর চেষ্টা করবি না। আমি ওরে নিয়ে কী করবো? এমনেই প্রায় এক বছর চেষ্টা করে সবে একটা চাকরি পেলাম আর তোরা এসব ফাউ খাওয়া মানুষ আমার ঘাড়ে চাপাতে আসছিস! আমার নানু তো ওর কথা জানলে জুতো পেটা করে বাসা থেকে বের করবে ”
-“কিচ্ছু করবে না। এমন করছিস কেন! দেখ, আমাদের সামর্থ্য থাকলে ঠিকই ওই মেয়েকে নিতাম কিন্তু এ শহরে তো আমাদের ফ্যামিলি নাই, তারা তো অন্য শহরে। আমরা দুই ভাই মিলে একটা ফ্লাটে ভাড়া থাকি। তুই-ই বল আমাদের দুজনের সাথে একটা মেয়ে থাকলে কেমন দেখাবে! তাই ভাই তুই-ই ওর থাকার ব্যবস্থা কর। একা এতিম একটা মেয়ের থাকার ভালো ব্যবস্থা এর চেয়ে বেশি কি-ই বা হতে পারে? প্লিজ না করিস না, পারলে তোর বাপকে এখনি ফোন লাগা। দেখিস সে ঠিকই একটা ব্যবস্থা করে দিবে।”
এমন নানান কথা দিয়ে ফারিশকে ভুলানোর চেষ্টা করতে থাকলো দুজন। ফারিশ দুজনের বকবকানিতে অতিষ্ঠ হয়ে একসময় তার বাবাকে কল করতে বাধ্য হয়।
ফোনের রিংটোনে ইকরাম ফরিদের ঘুম ভেঙ্গে গেলো। ঘুমের ঘোরে বালিশের পাশে হাঁতড়ে হাঁতড়ে ফোন খুঁজে নিয়ে পিটপিট করে চোখ মেললো। ফোনের স্ক্রিনে ফারিশের নাম দেখে তার ঘুম ছুটে গেলো। জলদি উঠে বসে পাশে তাকালো এবং দেখলো তার স্ত্রী গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। ইকরাম ফরিদ ফোন নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। রুম থেকে বের হতে হতেই কল কেটে গেলো। রুম থেকে বের হতেই আবার ফোন বেজে উঠলো। এবার রিসিভ করতে দেরী করলেন না ইকরাম ফরিদ। রিসিভ করতেই ফারিশ তাকে সালাম জানালো। সালামের উত্তর নিয়ে ইকরাম বললেন,
-“কি হলো সান, এই অসময়ে ফোন করলে? ফিরছো কখন?”
-“আসলে বাবা কিছুটা সমস্যায় পরেছি,” বলেই একে একে সবটা খুলে বললো ইকরাম ফরিদকে। সব শুনে ইকরাম ফরিদের কপালে চিন্তার ভাঁজ পরলো। সে নিজেও বুঝে তার শ্বাশুড়ি কেমন খাতারনাক চিজ। তিনি কিছু একটা গুছিয়ে নিয়ে দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকালেন। রাত প্রায় ৩টা ছুঁইছুঁই।
-“ঠিক আছে বুঝলাম, তোমার আসতে কতো সময় লাগবে সেটা জানাও।”
-“দুই ঘন্টা তো লাগবেই।”
-“তাহলে আমি যা বলছি তা শুনো,”
বলেই ইকরাম তার পরিকল্পনা ফারিশকে খুলে বললেন। এবং ফারিশকে এও বললেন তার কী কী করণীয়। ফারিশ সব মনোযোগ দিয়ে শুনে সম্মতি জানালো এবং কল কাটলো। ফারিশ আর ইকরাম ফরিদ বাপ-বেটার চেয়ে বন্ধু বেশি। যেকোনো পরিস্থিতিতেই ফারিশ তার বাবাকে সঙ্গ হিসেবে পাবেই!
~চলবে।