#তুমি_প্রেম_হলে_আমি_প্রেমিক
পর্ব: ১১
নাচ শেষ হতেই দর্শক সারির করতালিতে মুখরিত হয়ে ওঠে। প্রিয়তা এতোক্ষণ ঘোরের মধ্যে ছিলো। হাততালির শব্দে ধাতস্থ হয়ে স্তব্ধ হয়ে তাকায় সে সামনের দিকে। আর দৃষ্টি দর্শক সারিতে থাকা উচ্ছ্বাসের উপর নিবদ্ধ। উচ্ছ্বাসও একদৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে।
মার্জিয়া বেগমের চোখের কোণে পানি চিকচিক করছে। সে চাচ্ছে না নিজের দূর্বলতা প্রকাশ করতে। কবির শাহ মুচকি হাসে স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে।
“কেমন দেখলে মেয়ের নাচ?”
মার্জিয়া বেগম কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে বললো,”বেশ ভালোই খেটেছে মেয়েটা।”
কবির শাহ হালকা হেসে বাকিদের দিকে তাকায়। সবাই তার মেয়েরই প্রশংসা করছে। গর্বে শরীরটা যেনো কেঁপে উঠছে তার বারবার।
“মার্জিয়া।”
মার্জিয়া বেগম চোখ মুছে স্বামীর দিকে তাকায়।
“এখন কি মনে হচ্ছে সন্তানদের তার স্বকীয়তা প্রকাশে উৎসাহিত করা উচিত?”
মার্জিয়া বেগম মাথা নাড়ে।
“আমাদের সেতারা কি সুন্দর গান করতো তোমার মনে আছে? ওর স্কুলের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে ওর গানে মুগ্ধ হলো শ্রোতারা সবাই। কিন্তু মর্জিনা আপা কি করলেন? ওর গান গাওয়া বন্ধ করে দিলেন। মেয়েটা মা কে এতো ভয় করতো, কোনোদিন মুখ ফুটে নিজের ইচ্ছাটা আর বলার সুযোগ পায়নি। তুমি কি জানো সেতারার তার মায়ের উপর একবুক ভরা অভিমান জমা হয়ে আছে? সে চাইলেও মা কে আপন করে কাছে টেনে নিতে পারেনা। তুমি কি চাও তোমার মেয়েদের সাথে তোমার সম্পর্কটা এমন হোক? মেয়েরা একসময় আমাদের কাছে আর থাকবে না। কে কোথায় চলে যাবে আমরা জানিনা। দূরে বসেও মেয়েরা তোমার কথা ভেবে বুকে অভিমান জমিয়ে রাখুক, এটা কি তুমি চাও?”
মার্জিয়া বেগম মুখ কঠিন করে বসে থাকলো। সে আজ মেয়েকে সাজানোর সময়ই বুঝেছে ইতোমধ্যেই মেয়েদের কাছ থেকে তার মনের দূরত্ব ঠিক কতোটা বেড়েছে। তবে কি সবাই ভাবে সে তার মেয়েদের খারাপ চায়? একজন মধ্যবিত্ত মা হিসেবে এটুকু কি খুব সাধারণ নয়?
ফড়িং এর মতো প্রিয়তা ছুটছে। তাকে এক্ষুনি মানুষটার কাছে পৌঁছাতে হবে, এক্ষুনি। তার মনে হচ্ছে এই মুহুর্তে তাকে মানুষটার কাছে না যেতে পারলে অনেক দেরী হয়ে যাবে।
মঞ্চের সিঁড়ির মুখেই উজ্জ্বল মুখে দাঁড়িয়ে ছিলো রুনাসহ প্রিয়তার আরো কিছু বান্ধবী আর তাকে যারা নাচ শিখিয়েছে তারা। তাদের মধ্যে প্রিয়তার নীলু আপা ছিলো অন্যতম।
প্রিয়তা নেমে আসতেই ছুটে যেয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে নীলু। তার কষ্ট করা স্বার্থক হয়েছে। মেয়েটার নাচের পিছনে অনেক শ্রম দিয়েছে সে। তার বিশ্বাস ছিলো, আর প্রিয়তা সেইটা করে দেখিয়েছে।
“উফ প্রিয়তা তুই তো মুগ্ধ করে দিয়েছিস। বিশ্বাস কর, আমরা কেউ এক মুহুর্তের জন্য পলক পর্যন্ত ফেলতে পারিনি। অসাধারণ প্রতিভা আছে তোর।”
প্রিয়তা শুকনো মুখে হাসে। তার চোখ বারবার ইতিউতি খুঁজছে।
“এদিক ওদিক কি দেখছিস? চল তো আমার সাথে।”
প্রিয়তা ভ্রু কুঁচকে বললো,”কোথায় যাবো নীলু আপা?”
নীলু মুখ টিপে হেসে বললো,”গেলেই দেখতে পারবি।”
প্রিয়তা ক্ষীণ গলায় বললো,”আমি একটু বাদেই আসছি নীলু আপা। আমাকে পাঁচটা মিনিট সময় দিন।”
নীলু বিরক্ত গলায় বললো,”চুপ কর তো তুই। তোর জন্য একজন অপেক্ষা করে আছে। এক্ষুনি যেতে হবে।”
প্রিয়তা অবাক হয়ে বললো,”আমার জন্য আবার কে অপেক্ষা করবে? এসব কি বলছেন?”
নীলু প্রিয়তার হাত টেনে ধরে বললো,”তুই আয় তো।”
প্রিয়তা আর কিছু বলার সুযোগ পায়না। হতভম্ব হয়ে অনুসরণ করতে থাকে নীলুকে। নীলু প্রিয়তার হাত ধরে টানতে টানতে কলেজের অন্য প্রান্তে নিয়ে যেতে থাকে। প্রিয়তা বারবার পিছনে ঘুরে উচ্ছ্বাসকে খুঁজতে থাকে।
“এখানে কেনো আনলেন আমাকে নীলু আপা?”
নীলু প্রিয়তার গাল টেনে বললো,”এতো বিখ্যাত একজন মানুষ যে তোর প্রেমিক আগে জানাসনি কেনো?”
প্রিয়তার মাথায় ঢোকে না কিছু। নীলু আপা এসব কি বলছে? উনি কি কোনোভাবে উচ্ছ্বাস ভাইয়ের কথা বলছে? কিন্তু উনি বিখ্যাত হবেন কেনো?
“এসব কি বলছেন নীলু আপা? আমার প্রেমিক মানে? আপনার কোথাও ভুল হচ্ছে।”
“থাক থাক আর লজ্জা পেতে হবে না। উনি আসছেন, এখানেই অপেক্ষা করতে বলেছেন। মানুষটা একদম পাগল তোর জন্য।”
নীলু কুটকুট করে হাসতে থাকে। প্রিয়তা কথা আগামাথা কিছু বুঝতে পারেনা। নীলু আপা নিশ্চয়ই অন্য কারো সাথে তাকে মিলিয়ে ফেলেছে।
মিনিট পাঁচেকের মাথায় নীলু উজ্জ্বল মুখে হালকা চিৎকার দিয়ে বললো,”ওইতো উনি চলে এসেছেন।”
প্রিয়তা নীলুর দৃষ্টি অনুসরণ করে নিজের উল্টোদিকে তাকাতেই ভয়াবহভাবে চমকে ওঠে। তার শিরদাঁড়া বেয়ে একটা শীতল স্রোত নেমে যায়। এই লোকটা এখানে কেনো? আবার দেখা হওয়ার কি খুব প্রয়োজন ছিলো উনার সাথে? কি চায় উনি প্রিয়তার কাছে?
পাথরের মূর্তির মতো অনড় দাঁড়িয়ে থাকে প্রিয়তা।
নীলু ছুটে যায় সেদিকে।
“এইযে নিয়াজ সাহেব ওকে এনেছি। আমার দায়িত্ব শেষ। চারদিকে এতো শোরগোল, বুঝতেই পারছেন অনুষ্ঠান হচ্ছে। সেরকম নিরিবিলি জায়গা বলতে এটাই আছে। আপনার প্রেমিকা তো লজ্জায় শেষ।”
নিয়াজ মোর্শেদ বাঁকা ঠোঁটে হাসে। প্রিয়তার শরীর জ্বলে যায় হাসি দেখে।
নীলু প্রিয়তার কাছে এসে চাপা গলায় বললো,”কথা শেষ করেই রিহার্সাল রুমে চলে আসিস। দলীয় নাচের জন্য শেষ সময়ের প্রস্তুতির ব্যাপার আছে। প্রেমিককে পেয়ে আবার সব ভুলে যাস না।”
প্রিয়তা জোরালো গলায় নীলুর দিকে তাকিয়ে বললো,”খুব বেশি বেশি হয়ে যাচ্ছে নীলু আপা।”
নীলু মুখে আঁচল চাপা দিয়ে হাসতে হাসতে চলে যায়। প্রিয়তা জড়সড় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। সে এখন কোনো ঝামেলা চাচ্ছে না।
“তুমি এতো দারুণ নাচ করো, জানতাম না তো।”
প্রিয়তা লাল চোখে তাকায় নিয়াজের দিকে।
“আপনি আমাকে কেনো ডেকেছেন? আর নীলু আপার সামনে নিজেকে আমার প্রেমিক পরিচয়-ই বা দিয়েছেন কেনো?”
নিয়াজ শব্দ করে হাসে। লোকটার হাসি খুবই জঘন্য। কথায় আছে, একটা মানুষের চরিত্র তার হাসিতেই অনেকটা ফুটে ওঠে।
“দয়া করে উত্তরটা দিন। আমার জানামতে আমার বাড়ি থেকে বিয়েটা ভেঙে দেওয়া হয়েছে। আপনার সাথে আমার আর কি সম্পর্ক থাকতে পারে? আপনি কেনো
আমাকে অনুসরণ করছেন?”
নিয়াজ মোর্শেদ বুকে দুই হাত বেঁধে প্রিয়তার দিকে তাকিয়ে থাকে হাসিমুখে। যেনো খুব মজা পাচ্ছে সে মেয়েটার কথায়।
প্রিয়তা একরাশ বিরক্তি নিয়ে চলে যাওয়ার জন্য ঘুরে দাঁড়াতেই নিয়াজ শক্ত করে তার বাম হাত চেপে ধরে।
ঘটনার আকস্মিকতায় হতবিহ্বল হয়ে যায় প্রিয়তা। অবাক হওয়ার মাত্রাও যেনো অতিক্রম করে ফেলেছে সে।
দাঁতে দাঁত চেপে প্রিয়তা নিয়াজের চোখের দিকে তাকিয়ে বললো,”আপনার এতো বড় সাহস? আপনি আমার হাত ধরেছেন?”
“হ্যা ধরে ফেললাম তো। এখন কি করবে? চিৎকার করে মানুষ ডাকবে? তা ডাকতে পারো। ইতোমধ্যেই হয়তো জেনেছো এই কলেজে আমার প্রতিপত্তি ঠিক কোন পর্যায়ের। কেউ আমাকে অসম্মান করে কথা বলা দূরের কথা, আমার চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলার সাহস রাখেনা এখানে।”
প্রিয়তা ঘন ঘন শ্বাস ফেলে।
“সবাই কি জানে ভালো মানুষের মুখোশের আড়ালে ঠিক কেমন একজন মানুষ আপনি?”
নিয়াজ প্রিয়তার হাত ছেড়ে দিয়ে শান্ত হয়ে দাঁড়ায়।
“সবাই জানুক তুমি আমার প্রেমিকা, এতে ক্ষতি তো নেই। বরং লাভ আছে তোমার। কলেজের সবাই তোমাকে বাড়তি খাতির করবে। কেউ কুনজরে দেখবে না তোমাকে।”
ঝাঁঝিয়ে ওঠে প্রিয়তা।
“আমার কোনো বাড়তি খাতিরের প্রয়োজন নেই। আর কীভাবে বোঝালে আপনি বুঝবেন আমি চাইনা আপনি আমার পিছনে এভাবে পড়ে থাকুন।”
“তোমার চাওয়া বা না চাওয়াতে কিছুই যায় আসে না। আমি সবসময় স্ত্রী হিসেবে তোমার মতো একটা মেয়ে চেয়েছি। যাকে চাবি দেওয়া পুতুলের মতো আমি ব্যবহার করতে পারবো। আমি যেভাবে বলবো সেভাবেই চলবে এমন মেয়ে। আমার মনে হয়েছে তুমি এমন ধরণেরই। আর মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়েদের পরিবারও অনেকটাই রক্ষনশীল হয়। তারা মেয়ের বিয়ের পর আর কোনো ঝামেলা চায়না।”
প্রিয়তার অসহ্য লাগতে থাকে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা এই মুখোশধারী লোকটার কথা। তার ইচ্ছা করছে চিৎকার করতে। কিন্তু মনে হচ্ছে না চিৎকার করে কোনো লাভ হবে।
“দেখো প্রিয়তা, একটা কথা যতো তাড়াতাড়ি মাথায় ঢুকিয়ে নিতে পারবে ততই তোমার জন্য ভালো হবে। আমি যখন ভেবেছি তোমাকে বিয়ে করবো, তবে করবোই। ও হ্যা, তোমার আবার কোনো প্রেমিক নেই তো? থাকাটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। তোমাদের মতো মেয়েদের একজন বাউন্ডুলে, ভবঘুরে এবং বেকার প্রেমিক থাকে। যারা সারাজীবন স্বপ্ন দেখাতেই জানে, স্বপ্ন পূরণ করতে নয়। প্রেমিকার বিয়ের রাতে একটু পাগলামি করবে, কিছু নির্ঘুম রাত পার করবে। তারপরই সব ভালোবাসা শেষ। তোমার যদি এমন কেউ থাকে, তাতেও আমার কিছু যায় আসেনা। বিয়ের পর প্রেমিককে কীভাবে ভোলাতে হয় আমার জানা আছে।”
লোকটার স্পর্ধা দেখে হতবাক হয়ে যায় প্রিয়তা। দুই গালে সপাটে দুইটা থাপ্পড় মারতে পারলে বোধহয় শান্তি হতো এখন।
এদিকে হঠাৎই মঞ্চ থেকে প্রিয়তাকে ছুটে যেতে দেখে অবাক হয় উচ্ছ্বাস। মনে হচ্ছে এই ফুলগুলো বুঝি আজ ওই মেয়েটার জন্যই ফুটেছে। উচ্ছ্বাস জানে এ ধরণের অনুভূতি তার জন্য অন্যায়। তার ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। প্রিয়তা মধ্যবিত্ত বাবার একটা রাজকন্যা। তার কৃষ্ণগহ্বরের মতো অতিশয় কালো জীবনটার সাথে প্রিয়তার প্রজাপতির ডানার মতো রঙিন জীবনটা বড্ড বেমানান।
কিন্তু এই হৃদয়ের চেয়ে বড় আদালত কি দুনিয়ায় কিছু আছে? সে কি কোনো বাঁধন, বারণ মানে? সে নিজেও জানেনা এর পরিণাম কি? যে মানুষটা তার বিপদের সময় পাশে দাঁড়িয়েছে, সে কি তার ক্ষতি করতে পারে?
কলেজ আঙিনার প্রতিটা কোণায় উন্মাদের মতো প্রিয়তাকে খুঁজে চলেছে উচ্ছ্বাস। প্রখর রোদে মাথা ঝা ঝা করছে তার। দরদর করে ঘাম পড়ছে তার কপাল চুইয়ে। কোনো কোণা বাকি নেই তার খুঁজতে। মোটামুটি ফাঁকা একটা জায়গায় দাঁড়িয়ে যায় সে। কোথায় গেলো মেয়েটা হুট করে?
হঠাৎই কিছুটা দূরে চোখ যাওয়ায় থমকে যায় সে। খুব ভালো করে দেখতে চোখ সরু করে তাকায়। আচমকাই বুকটা ঈষৎ কেঁপে ওঠে তার। প্রিয়তাই তো, কিন্তু তার পাশের মানুষটা কে? কার সাথে এভাবে কথা বলছে ও?
“আপনি কেনো এতোগুলো কথা বলার সাহস পাচ্ছেন জানেন? কারণ আমি আপনাকে সেই সুযোগটা দিচ্ছি। আর সুযোগটা দিচ্ছি কারণ, আমার বাবা আমাদের অসভ্যতা শেখায়নি। তবে এরপর আমাকে কিংবা আমার পরিবারকে অসম্মান করে আর একটা কথা বললে আমি আমার বাবার শিক্ষা ভুলে যাবো।”
নিয়াজ হাসিমুখে বললো,”কি করবে তুমি?”
প্রিয়তা রাগে গজগজ করতে করতে ছুটে চলে যায় সেখান থেকে। নিয়াজ বাম হাত দিয়ে মাথার চুল ঠিক করতে করতে শিষ বাজিয়ে সুর ওঠায়।
স্থাণুর মতো জমে একদৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে আছে উচ্ছ্বাস। মনে হচ্ছে বুকের পাঁজরগুলো কেউ খুব অযত্নে একটা একটা করে ভাঙছে। তার কেনো এমন লাগছে? সে তো মেয়েটাকে ভালোবাসে না, কখনো বাসতে চায়ওনি। মনের কোন কোণায় অনুভূতির জন্ম হলে এতোটা কষ্ট হতে পারে?
লোকটাকে উচ্ছ্বাস চিনতে পারে। এই লোকটাই তো প্রিয়তাকে দেখতে গিয়েছিলো। তবে কি প্রিয়তা পছন্দ করে ফেলেছে তাকে? আবারও যোগাযোগ হচ্ছে তাদের মধ্যে?
দুই হাঁটু সমানভাবে কাঁপতে থাকে উচ্ছ্বাসের। ব্যর্থ মনে হচ্ছে নিজেকে। সবকিছু ভেঙে গুড়িয়ে দিতে ইচ্ছা করছে তার। একটু আগে দিনটাকে যেমন রঙিন লেগেছিলো, এখন ঠিক ততটাই ধূসর লাগছে সবকিছু। দুই চোখ ভীষণভাবে জ্বালা করতে থাকে তার। এক নারীর জন্য ধ্বংস হয়েছিলো ট্রয় নগরী। ঠিক তেমনই এক নারীর জন্যই মফস্বল শহরটা শেষ করে ফেলতে ইচ্ছা করছে উচ্ছ্বাসের।
বড় করে শ্বাস ফেলতে ফেলতে জোর কদমে হাঁটতে থাকে উচ্ছ্বাস। তার হাতের মুঠোর মধ্যে থাকা ফুলগুলোকে আবর্জনা মনে হচ্ছে এখন। ফুলগুলোকে ফেলে পা দিয়ে মাড়িয়ে নিজের অস্থিরতা প্রকাশ করে।
“আরে উচ্ছ্বাস ভাই আপনি এখানে? কখন এসেছেন আপনি? আপা কতোবার খুঁজছিলো আপনাকে।”
পেখমের হাসি হাসি মুখের দিকে রক্তলাল চোখে তাকায় উচ্ছ্বাস। পেখম কিছুটা ভড়কে যায় সেই দৃষ্টি দেখে।
“কি হয়েছে উচ্ছ্বাস ভাই আপনার? এমন লাগছে কেনো আপনাকে? সব ঠিক আছে তো?”
উচ্ছ্বাস উত্তর দেয়না। এক উৎসহীন রাগ, অভিমানে যেনো বোবা হয়ে গেছে সে।
পেখমের এবার কিছুটা সন্দেহ হয়। উচ্ছ্বাসের পায়ের কাছে বেশ অনেকগুলো তাজা লাল গোলাপ পড়ে আছে। মাত্রই উচ্ছ্বাস পা দিয়ে মাড়িয়েছে সেগুলো।
পেখম উচ্ছ্বাসের দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে বললো,”আপার সাথে দেখা হয়েছে আপনার? নাচ দেখেছেন৷ আপার?”
উচ্ছ্বাস চাপা রোষের সাথে বললো,”আমি কারো নাচ দেখতে এখানে আসিনি। কারো সাথে দেখা করতেও নয়। তোমার আপা এমন কিছুই হয়ে যায়নি যে আমার সময় নষ্ট করে তার নাচ দেখতে আসবো। আর একটা কথা ভালো করে শুনে রাখো, আমি যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব। তোমাদের বাড়ি ছাড়বো। আর ততদিন তুমি বা তোমার আপা কেউ আমার সামনে আসবে না। আমি তোমাদের ছায়া দেখতে চাইনা। মনে থাকবে?”
কথাটা শেষ করে উচ্ছ্বাস জোরে জোরে দম ফেলতে থাকে। সমস্ত রাগ, অভিমান পেখমের উপর ঝাড়ে সে। নিজেও জানেনা এই মেয়েটাকে কেনো এতো কথা বললো সে। ওর কোনো দোষ নেই।
পেখম কাতর চোখে উচ্ছ্বাসের দিকে তাকায়। তার মাথায় আসে না সে কি এমন করলো যে উচ্ছ্বাস ভাই এভাবে কথা বললো তার সাথে। কোনো খারাপ কথা তো বলেনি। আর তার মনে হয়েছিলো আপার সাথে হয়তো উনার সব ঠিক হয়ে যাচ্ছে আস্তে আস্তে। আপাকে এতো সুন্দর শাড়িটা উপহার দিলো। হঠাৎ করে কি হলো তাদের মধ্যে? পেখমের মাথায় আসেনা।
পহেলা বৈশাখের দিনটা কবির শাহের খুব পছন্দ। তার মধ্যবিত্ত পরিবারে সাধ্য অনুযায়ী আয়োজন করতে ভালোবাসে সে এই দিনটায়। যেহেতু আজ সারাদিনই প্রায় প্রিয়তার কলেজেই কাটিয়ে দিয়েছে তারা। তাই রাতের খাবারে আজ পান্তা ভাত আর ইলিশ মাছের ব্যবস্থা করেছে মার্জিয়া বেগম। পেখম হাতে হাতে সাহায্য করছে মা কে।
প্রিয়তার মনটা বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে। নিয়াজ মোর্শেদ তার মেজাজ খারাপ করে দিয়েছে। তারপর থেকে উচ্ছ্বাসকে অনেক খুঁজেও পায়নি। তখন থেকেই কেমন বেসামাল লাগছে তার। বিকেলের দলীয় নাচেও ভালো করে মন দিতে পারেনি সে। আলুথালু পায়ে ঘরের এদিক ওদিক ঘোরাঘুরি করছে আর বার বার উঁকি দিচ্ছে উচ্ছ্বাসের ঘরে। আসার পর থেকে তার ঘরের দরজা বন্ধ রেখেছে। কি হলো মানুষটার? মনে মনে অস্থির লাগে প্রিয়তার।
কাজের ফাঁকে ফাঁকে আড়চোখে আপাকে দেখছে পেখম। সকালের ঘটনাটা আপাকে বলার সুযোগ পায়নি সে এখনো। কি হয়েছে তাদের মধ্যে জানার জন্য ব্যাকুল হয়ে আছে সে। আপাকেও কেমন আনমনা দেখাচ্ছে। সকালের নাচের সময়ও কতো হাসিখুশি ছিলো। কি হলো হঠাৎ করে তার?
“মার্জিয়া।”
মার্জিয়া বেগম কাজ করতে করতে উত্তর দেয়,”বলো শুনছি।”
কবির শাহ ক্ষীণ গলায় বললো,”তোমাকে একটা অনুরোধ করবো, রাখবে?”
মার্জিয়া বেগম ছোট্ট একটা ফেলে স্বামীর দিকে তাকিয়ে বললো,”আমি জানি তুমি কি অনুরোধ করবে। আজ রাতে যেনো ওই ছেলেটা আমাদের সাথে একসাথে বসে খায়, এই কথাটা যেনো আমি নিজে যেয়ে ওকে বলি।”
কবির শাহ ম্লান হেসে স্ত্রীর দিকে তাকায়।
“বিশটা বছর সংসার করছি তোমার সাথে। তোমার মুখ দেখলেই আমি বুঝতে পারি তুমি কখন কি বলবে।”
কবির শাহ উত্তর দেয়না। মনে হয় মার্জিয়া বলবে না। কিন্তু তাকে অবাক করে দিয়ে মার্জিয়া বেগম বললো,”চিন্তা করোনা। তুমি মেয়েদের ডেকে বসে পড়ো। আমি হাতের কাজটা সেরেই ওকে ডাকতে যাবো।”
কবির শাহের মুখটা সাথে সাথেই উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। মার্জিয়া বেগমের মুখ সেই তুলনায় নির্লিপ্ত।
কবির শাহ স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বললো,”প্রিয়তমা, আমি বার বার তোমার প্রেমে পড়ে যাই। মানুষ হিসেবে তুমি যে কতোটা দারুণ তুমি কি তা জানো?”
মার্জিয়া বেগম কিছু না বলে চোখ রাঙিয়ে তাকায় স্বামীর দিকে।
বেশ অনেকক্ষণ ধাক্কানোর পর ভিতর থেকে দরজা খোলার খুট করে একটা আওয়াজ হয়।
কিছুটা ইতস্তত করে ঘরে ঢুকতেই একটা ছোট্ট ধাক্কা খায় মার্জিয়া বেগম। সিগারেটের ধোঁয়ায় ভরে আছে ঘরটা। বিকট গন্ধে মার্জিয়া বেগম নাকে আঁচল চাপা দেয়।
উচ্ছ্বাস মার্জিয়াকে দেখে কিছুটা অবাক হয়। উনি সাধারণত এখানে আসেনা।
“এতো ধূমপান করো কেনো?”
উচ্ছ্বাস স্মিত হেসে বললো,”কেউ নিষেধ করে না তাই।”
বেশ অপ্রস্তুত হয়ে যায় মার্জিয়া বেগম। এমন উত্তর আশা করেনি সে।
“এসব কাব্যিক কথা বাস্তব জীবনের সাথে যায়না। কেউ নিষেধ না করলেও এটা তোমার জন্য কতোটা ভয়ানক হতে পারে এটা তো অন্তত জানো তুমি। জীবনের উপর এতো বিতৃষ্ণা কেনো এতোটুকু বয়সে? কি দেখেছো জীবনের?”
“হয়তো আমি যা দেখেছি কেউই তা দেখেনি।”
মার্জিয়া বেগম ভ্রু কুঁচকে বললো,”তার মানে?”
“তেমন কিছু না। আপনি মনে হয় কিছু বলতে এসেছিলেন।”
“প্রিয়তার বাবা চায় আজ রাতের খাবারটা সবাই একসাথে খাবে। তুমি যেহেতু আপাতত আছো এখানে, তুমিও আমাদের সাথেই খাবে আজকে। টেবিলে খাবার দেওয়া হয়েছে, আমরা অপেক্ষা করছি।”
মার্জিয়া বেগম কথা শেষ করে দরজার দিকে পা বাড়াতেই উচ্ছ্বাস পিছন থেকে থমথমে গলায় বললো,”ক্ষমা করবেন, আমার খিদে নেই। আপনারা আমার জন্য অপেক্ষা না করে খেয়ে নিন।”
মার্জিয়া বেগম কঠিন মুখে উচ্ছ্বাসের দিকে তাকায়।
“আমি উনাকে যেয়ে বলবো না তুমি আসবে না। তিনি আশা করে বসে আছেন। যে মানুষটা তোমার বিপদের দিনে তোমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। পরিবারের বিরুদ্ধে যেয়ে তোমাকে নিজের বাড়িতে এনে তুলেছে। তুমি নিশ্চয়ই তাকে কষ্ট দিতে চাইবে না।”
হালকা হেসে মার্জিয়া বেগম চলে যায়। খাটের উপর বসে দুই হাতে চাদর চেপে ধরে উচ্ছ্বাস। যন্ত্রণায় মাথার দুই পাশের শিরা দপদপ করছে তার।
প্রতিটা সেকেন্ড অস্থিরতায় কাটছে প্রিয়তার। বারবার ঘাড় ঘুরিয়ে বাঁকা চোখে উচ্ছ্বাসের ঘরের দিকে তাকাচ্ছে সে। তার দিকে কঠিন দৃষ্টি রেখে বসে আছে মার্জিয়া বেগম।
“ও কি আসতে চাচ্ছে না মার্জিয়া? আমি কি একবার যাবো ওকে ডাকতে?”
“মনে হয়না লাভ হবে। কেউ যদি নিজে থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিতে চায় তবে জোর করে পাঁচিল টপকে তার গন্ডির মধ্যে না ঢোকাই ভালো। তোমরা খেয়ে নাও, আমি ওর খাবারটা ওর ঘরে দিয়ে আসবো।”
কবির শাহ একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। এই ছেলেটা ঠিক কি করতে চাচ্ছে সে বুঝতে পারছে না। এমন মেধাবী একটা ছেলেকে চোখের সামনে একটু একটু করে শুকনো ফুলের মতো ঝরে যেতে দেখতেও ভীষণ কষ্ট হচ্ছে তার। তবে কি মার্জিয়ার কথাই সত্যি? সে কি জোর করে ছেলেটার চারপাশের অদৃশ্য শক্ত প্রাচীরের মধ্যে ঢুকতে চাচ্ছে?
ভারাক্রান্ত মন নিয়ে কবির শাহ খাবারে হাত দেওয়ার আগেই পেখম সহাস্যমুখে চিৎকার করে বললো,”ওইতো উচ্ছ্বাস ভাই।”
কবির শাহের বুকটা ভরে যায় খুশিতে। মার্জিয়া বেগম ছোট্ট করে হাসে মাথা নামিয়ে।
বুকটা ঢিপঢিপ করছে প্রিয়তার। তার মুখোমুখি একটা চেয়ারই শুধু খালি রয়েছে। সে কি ওখানে বসবে?
“বসো বাবা, আমার পাশে বসো।”
উচ্ছ্বাস দাঁড়িয়ে থাকে।
কবির শাহ আবার বললো,”কি হলো বাবা, বসো এখানে।”
উচ্ছ্বাস তীক্ষ্ণ গলায় বললো,”মামা আমি আসলে আপনাকে একটা কথা বলার জন্য এখানে এসেছি।”
“সব শুনবো বাবা, আগে খেয়ে নাও।”
উচ্ছ্বাস সবার দিকে একবার চোখ বুলিয়ে তাকায়। প্রিয়তা আকুল চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে। ছলছল করছে তার পদ্ম পাতার মতো চোখ দু’টো। উচ্ছ্বাস চোখ সরিয়ে নেয় তার উপর থেকে।
“মামা আপনি আর মামি অনেক করেছেন আমার জন্য। বাইরের অচেনা একটা ছেলেকে নিজের ছেলের মতো বাড়িতে এনে তুলেছেন তার বিপদের দিনে। আমি হয়তো সারাজীবন কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেও শেষ করতে পারবো না। আপনারা আমার কাছে অতি মূল্যবান দুইজন মানুষ।”
কবির শাহ অবাক হয়ে বললো,”হঠাৎ এসব কথা বলছো কেনো? তোমার মনটা কি খারাপ?”
কবির শাহ সরু চোখে মার্জিয়া বেগমের দিকে তাকায়। সে কি তবে ওই ঘরে যেয়ে কটু কোনো কথা শোনালো ছেলেটাকে? কিন্তু মার্জিয়ার ভাব দেখে তো এমন কিছু মনে হচ্ছে না।
উচ্ছ্বাস চোখ বন্ধ করে বড় একটা শ্বাস নেয়। অবাধ্য চোখজোড়া নিটোল তরুণীটির চোখে নিবদ্ধ হতে চায়। অনেক কষ্টে নিজেকে সংবরণ করে সে।
“মামা আমি অতি শীঘ্রই এ বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে চাই। হতে পারে সেইটা আগামীকাল কিংবা হতে পারে আগামী পরশু।”
বসা থেকে সাথে সাথে উঠে দাঁড়ায় কবির শাহ। বুকটা ধকধক করে ওঠে প্রিয়তার। দুই চোখ পানিতে ছাপিয়ে ওঠে তার সাথে সাথে।
(চলবে…..)