#তুমি_প্রেম_হলে_আমি_প্রেমিক
পর্ব: ১০
কোনোভাবেই সাজ পছন্দ হচ্ছে না প্রিয়তার। পেখমের ঘাম ছুটে যাচ্ছে আপাকে সাজাতে যেয়ে। তবুও কোথায় যেনো খুঁত থেকেই যাচ্ছে। এদিকে বৈশাখের শুরুতেই গরমও পড়েছে অসম্ভব। সকালটা হতে না হতেই সূর্যটা একদম প্রখর রোদ দেওয়া শুরু করেছে। প্রিয়তার চিবুক বেয়ে দরদর করে ঘাম ঝরতে থাকে। প্রিয়তা আয়নার দিকে তাকাতেই চমকে ওঠে। তার গায়ের রঙ এমনিতে শ্যামলা, কিন্তু এভাবে ঘেমে যাওয়ায় বেশ কালো লাগছে তাকে।
রাগে, দু:খে শাড়ি অর্ধেক পরা অবস্থাতেই খাটের উপর বসে পড়ে প্রিয়তা। চোখে পানি চলে আসে তার অসম্ভব রাগে।
পেখম অবাক হয়ে আপার দিকে তাকিয়ে বললো,”এ কি রে আপা? বসে পড়লি কেনো তুই? কয়টা বাজে খেয়াল আছে? দশটা তো বেজেই গেলো। এগারোটায় তোর নাচ। এখনো সাজগোজ শেষই হলো না তোর। আর তুই কিনা এভাবে বসে পড়লি?”
প্রিয়তা টান দিয়ে বাকি অর্ধেকও খুলে ফেললো শাড়ির। চাপা গলায় বললো,”আমি যাবো না।”
পেখম আরো এক প্রস্থ অবাক হয়। সে ভেবেই পাচ্ছে না আপা এসব কি বলছে।
“আপা তুই কি মজা করছিস? সারা মাস রিহার্সাল করলি নাচের। আর এখন কিনা বলছিস যাবি না? আজ অনুষ্ঠানের একটা অন্যতম আকর্ষণ যে তোর নাচ, ভুলে গেছিস তুই?”
প্রিয়তা এবার সত্যি সত্যি কেঁদে দেয়। অন্যদিন চুলটা কি সুন্দর ঢেউয়ের মতো ফুলে থাকে। আর আজই কিনা চুলগুলো এমন নেতানো লাগতে হলো? তাকে দেখতে ভালো না লাগলে, কেউ দেখবে তার নাচ? আগে তো দর্শনধারী, তারপর গুণবিচারী।
প্রিয়তা মাথার চুলগুলো এলোমেলো করে দিয়ে বললো,”আমি যাবো না, যাবো না, যাবো না। এই পেত্নীর মতো চেহারা নিয়ে আমি নাচবোই না।”
পেখমের অস্বস্তি হতে থাকে। বারবার ঘড়ির দিকে তাকায় সে। এই পরিস্থিতিতে বাবাকেই দরকার ছিলো শুধু। কিন্তু বাবা সকাল সকাল তার স্কুলে চলে গেছে। ওখানের অনুষ্ঠানটায় কোনো রকম উপস্থিত হয়েই একবারে বাবা আপার কলেজে চলে যাবে।
পেখম প্রিয়তার মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,”লক্ষী আপা আমার, এমন জিদ করিস না। আগে শাড়িটা পরিয়ে দিই সুন্দর করে তোকে। এরপর চুলে ফুল জড়িয়ে খোঁপা করে দিই। দেখবি কেমন সুন্দর লাগে তোকে।”
প্রিয়তা চিৎকার করে বললো,”কিচ্ছু ভালো লাগবে না আমাকে। তুই যা এখান থেকে। আমি আজ কলেজে যাবো না বলছি, তো যাবোই না।”
পেখম প্রমাদ গোণে। তার আপা শান্ত হলেও জেদী। আর এ ধরণের মানুষগুলো ভীষণ খুঁতখুঁতেও হয়।
বাড়িতে শুধু তাদের মা আর তারা দুই বোন। উচ্ছ্বাস ভাইটাও সকাল সকাল কোথায় যে বেরিয়ে গেলো। মা কে ডাকতে ভয় করে পেখমের। মার্জিয়া বেগম এসব নাচানাচি কোনোদিনই পছন্দ করে না।
“কি হচ্ছে এখানে?”
মায়ের গলার আওয়াজ পেয়ে পেখম শুকনো ঢোক চাপে। আপাকে আবার কথা না শোনায় মা। এমনিতেই মেজাজ তেতে আছে আপার। মায়ের বকা শুনে সত্যিই যদি কলেজে না যায়।
পেখম মুচকি হেসে বললো,”কিছু হয়নি মা। আপাকে তৈরি করছি আমি।”
মার্জিয়া বেগম ঘড়ির দিকে তাকিয়ে ভ্রু কোঁচকায়।
“কি তৈরি করছিস শুনি? এগারোটায় অনুষ্ঠান শুরু, এখন বাজে দশটার বেশি। কিছুই তো হয়নি এখনো।”
পেখম ভয়ে ভয়ে বললো,”মা দেখো মা, আপা বলছে আপা নাকি যাবেই না আজ কলেজে।”
মার্জিয়া বেগম ধীর পায়ে এগিয়ে আসে। মেঝে থেকে শাড়িটা তুলে হাতে নেয়।
পেখমের দিকে তাকিয়ে চোখ সরু করে জিজ্ঞেস করলো,”এই শাড়িটা কার? এটা তো আগে দেখিনি।”
পেখম আমতা আমতা করে আড় চোখে আপার দিকে তাকায়। প্রিয়তা এখনো ফুঁপিয়ে যাচ্ছে।
উত্তর না পেয়ে মার্জিয়া বেগম একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। মেয়েগুলো দিন দিন তার কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। এই বয়সের মেয়েদের সবচেয়ে কাছের বন্ধু হয় তাদের মা। কিন্তু তার বেলায় ঘটনা ভিন্ন। মেয়েরা বাপ ন্যাওটা। অবশ্য এসবের জন্য সে নিজেই দায়ী তা সে জানে। মেয়েদের ভালোর জন্যই ছোট থেকে অতিরিক্ত শাসনে রেখেছে সে। সে কি শাসনটা অতিরিক্ত করে ফেলেছে? মেয়েদের সাথে তার মনের এই যোজন যোজন দূরত্ব কি কাটানো সম্ভব?
“প্রিয়তা উঠে আয়।”
প্রিয়তা ঘাড় গুঁজে বসে থাকে।
“কি হলো কথা কানে যাচ্ছে না? উঠে আসতে বললাম না?”
মায়ের গম্ভীর আওয়াজে মাথা তুলে তাকায় প্রিয়তা।
“আমি যাবো না মা। আমাকে একটুও ভালো লাগছে না আজ দেখতে। কি ভীষণ কালো লাগছে দেখো আমাকে আজ। আর চুলগুলো দেখে মনে হচ্ছে এক বোতল নারকেল তেল ঢেলেছি। এই সাজে আমাকে দেখলে কেউ আর ফিরেও তাকাবে না আমার নাচের দিকে।”
মার্জিয়া বেগম ছোট্ট করে হেসে এগিয়ে যায়। মেয়ের হাত ধরে টেনে তাকে খাট থেকে নামায়। মায়ের কোমল দৃষ্টির সামনে অসহায় বোধ করে প্রিয়তা। পেখমও অবাক হয়ে দেখে তাদের।
মাত্র দশ মিনিটের মধ্যে মার্জিয়া বেগম ভীষণ সুন্দর করে শাড়ি পরিয়ে দেয় প্রিয়তাকে। গতানুগতিক শাড়ির ভাঁজের থেকে অন্যরকম করে। প্রিয়তা হতবাক হয়ে যায়। মা কীভাবে বুঝলো তার এখন কেমন পছন্দ? মাত্র এতোটুকু সময়ে কীভাবে সম্ভব হলো? আচ্ছা মায়েদের হাতে কি যাদু থাকে?
প্রিয়তার ইচ্ছা হয় শক্ত করে মা কে জড়িয়ে ধরতে। মনের মধ্যে হঠাৎ করেই হাজারটা প্রজাপতি উড়াউড়ি শুরু করেছে। সে ঠিক জানে মা কিছু একটা ব্যবস্থা করেই ফেলবে।
পেখম চোখ বড় বড় করে বললো,”মা তুমি কি অসাধারণ শাড়ি পরালে। আপাকে তো একদম একটা পরীর মতো লাগছে।”
প্রিয়তা লাজুক মুখে হাসে।
মার্জিয়া বেগম পেখমের দিকে তাকিয়ে বললো,”ফুলগুলো নিয়ে আয় তো। চুলটা বেঁধে ফেলি।”
প্রিয়তা কাতর গলায় বললো,”কিন্তু মা….”
“চুপ থাক তুই। খুব বড় হয়ে গেছিস তাইনা? এই কয়দিন আগেও তো আমি সাজিয়ে, চুল বেঁধে দিতাম। এখন এতোটাই বড় হয়ে গেছিস যে মায়ের কাছে আসার প্রয়োজন মনে করিস না।”
প্রিয়তার চোখে পানি টলমল করে ওঠে। মায়ের উপর জমা হওয়া সব অভিমান এক নিমিষে উধাও হয়ে যায় তার।
মার্জিয়া বেগম কি করলো তা সেই জানে শুধু। নেতিয়ে যাওয়া চুলগুলোকে চিরুনি দিয়ে কারুকার্য করে সুন্দর করে ফুলিয়ে দিলো সে। একদম যেনো উত্তাল নদীর ঢেউ।
পেখম শুধু একদৃষ্টিতে দেখেই যাচ্ছে। সে মনে মনে ঠিক করে নেয়, এখন থেকে সব অনুষ্ঠানে সে মায়ের কাছ থেকেই সাজবে।
ফুলটা সুন্দর করে খোঁপার সাথে আটকে দিয়েই মার্জিয়া বেগম প্রিয়তার সামনে এসে দাঁড়ায়। মেয়ের থুতনিতে হাত দিয়ে মুখটা সামনে মেলে ধরেই একটা প্রশান্তির বাতাস বয়ে যায় তার মনে। কে বলেছে তার এই মেয়েটা সুন্দরী নয়? হয়তোবা তথাকথিত সুন্দরী যাকে বলে, দুধে আলতা গায়ের রঙ, সুন্দর স্বাস্থ্য এগুলো তার নেই। কিন্তু তার যে সৌন্দর্য আছে, তা যদি কেউ মনের চোখ দিয়ে দেখে সে অভিভূত হতে বাধ্য এই মেয়ের রূপে। ভূবনভোলানো এক জোড়া টানা কাজল কালো চোখ, টানা নাক, পাতলা ঠোঁট, মাথায় ঘোর অমানিশার মতো একগুচ্ছ চুল। এই মেয়ে রূপবতী নয় তো কে রূপবতী?
“বাকি সাজটা আমি নিজে হাতে করে দিবো?”
প্রিয়তা আস্তে আস্তে মাথা নাড়ে। মায়ের শরীরের গন্ধটা আজ কতো কাছ থেকে পাওয়া যাচ্ছে। প্রিয়তার অদ্ভুত একটা শান্তি হচ্ছে মনে। তার মনে হচ্ছে এই মনোবলটাই আজকের নাচের জন্য দরকার ছিলো তার। মনে মনে হাজারটা ধন্যবাদ দেয় সে মা কে।
সাজের মধ্যে তেমন কিছুই দিলো না মার্জিয়া বেগম। এই গরমে মেয়ে সারাদিন বাইরে থাকবে। সকালে একটা নাচ আবার বিকালে আরেকটা। ভারী সাজে মেয়েটা অস্বস্তি বোধ করবে।
সেই মতোই কাজলটা টেনে দিলো সে প্রিয়তার চোখে। টানা চোখ দু’টো তাতে আরো টানা লাগে। অতিরিক্ত ঘামের জন্য মুখে হালকা পাওডারের ছোঁয়া।
এতোটুকুই যেনো যথেষ্ট ছিলো প্রিয়তার সৌন্দর্য একরাশ বাড়িয়ে দেওয়ার জন্য। মার্জিয়া বেগম মুগ্ধ হয়ে মেয়ের দিক্র তাকায়। সাথে সাথেই চোখ সরিয়ে নেয়। বাবা মায়ের নজর সন্তানের বেশি লাগে, সেই ভয়ে।
পেখম যন্ত্রের মতো প্রিয়তার দিকে তাকিয়ে বললো,”আপা রে, আয়নার সামনে একবার আয়।”
প্রিয়তার ভীষণ লজ্জা করে হঠাৎ। পেখম তার হাত ধরে টেনে এনে আয়নার সামনে দাঁড় করায়।
সেদিকে এক নজর পড়তেই মূর্তির মতো স্তব্ধ হয়ে যায় সে। সামান্য সাজে এতো অপূর্ব লাগে তাকে? এটা কি সত্যিই সে? নাকি ঝিলে থাকা একটা সদ্য ফোঁটা পদ্ম?
পেখম দুই হাত ভর্তি লাল চুড়ি পরিয়ে দেয় আপার হাতে। চুড়ির রুনঝুন শব্দে মুখর হয়ে ওঠে ওর ছোট্ট ঘরটা।
প্রিয়তা আস্তে করে হেঁটে মায়ের সামনে এসে দাঁড়ায়। মার্জিয়া বেগম আড়ালে চোখের পানি মোছে। কি স্নিগ্ধ, কি মিষ্টি লাগছে মেয়েটাকে তার। এটা যে তার সেই ছোট্ট মেয়েটা ভাবতেই অবাক লাগছে।
“মা।”
“বল শুনছি।”
“একটা অনুরোধ করবো মা, রাখবে তুমি?”
মার্জিয়া বেগম পূর্ণ দৃষ্টি মেলে মেয়ের দিকে তাকায়। এমন আকুতি ভরা চোখে মেয়ে যা চাইবে সে তো তা উজাড় করে দিতে পারে। তার এই দূর্বলতা কি মেয়ে কোনোভাবে বুঝে ফেলেছে।
“কি বলবি বল।”
প্রিয়তা কিছুক্ষণ থেমে মাথা নিচু করে বললো,”তোমাকে ভয়ে বলতে পারিনি মা। হঠাৎ করে আমার পা’টা সেদিন মচকে গিয়েছিলো। ভীষণ যন্ত্রণা হয়েছিলো জানো? আমি তা সত্ত্বেও নাচের রিহার্সাল চালিয়ে গিয়েছি। হয়তো কলেজের গন্ডি পেরোনোর পর তুমি আমাকে আর নাচতে দিবে না। হতে পারে এটাই আমার জীবনের শেষ মঞ্চ নাচ। তাই আমি মন প্রাণ ঢেলে নাচটা শিখেছি। সবাই বলছে এবার আমার নাচেই সবাই মুগ্ধ হয়ে যাবে। তাই বলছিলাম, তোমার মেয়েটার নাচ দেখতে যাবে তুমি আজ?”
মার্জিয়া বেগম ছলছল চোখে মেয়ের দিকে তাকায়। মেয়ে স্কুলে থাকতে একবার নাচের পর এক বখাটে ছেলে শিষ দিয়েছিলো তাকে দেখে। তখন থেকেই মার্জিয়া বেগমের মাথায় আগুন ধরে যায়। প্রিয়তাকে নিষেধ করে নাচতে। কিন্তু জেদী মেয়েটা নিজের শখকে বিসর্জন দিতে চায়না। সেই রাগে মার্জিয়া বেগমও আর মেয়ের নাচ দেখতে যায়নি তারপর থেকে।
পেখম এসেও মায়ের এক হাত ধরে।
“ওমা চলো না, বাবাও যাবে।”
মার্জিয়া বেগম মুখ বাঁকিয়ে বললো,”বাবা গেলে মা কে আর দরকার কি? তোমরা তো বাবা পেয়ারী কন্যা। বাবা যাচ্ছে তাতেই হবে।”
প্রিয়তা হঠাৎ এসে মায়ের হাত চেপে ধরে বললো,”আমার যে দুইজনকেই চাই মা।”
মার্জিয়া বেগম কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। সে সারাজীবন মেয়েদের সামনে নিজের রুদ্রমূর্তি দেখাতে চেয়েছে। যাতে করে মেয়েরা তাকে ভয় পায়। তাদের বাবা তো শাসন করবে না। তার ধারণা যে কোনো একজন কঠিন না হলে মেয়েরা বিগড়ে যাবে।
কিছুটা ইতস্তত করে মার্জিয়া বেগম অন্যদিকে তাকিয়ে বললো,”তোমাদের বাবা যে রাতে পান্তা-ইলিশ খেতে চেয়েছে। আমি বাড়িতে না থাকলে সেসবের যোগাড় করবে কে?”
প্রিয়তা মুখ টিপে হেসে বললো,”সে আমরা বাড়ি ফিরে তোমার হাতে হাতে সব করে দিবো মা।”
মার্জিয়া বেগম ঠোঁট উলটে বললো,”কি যে সাহায্য করবে তোমরা আমার জানা আছে।”
পেখম চিৎকার করে বললো,”তার মানে মা যাচ্ছে? কি মজা।”
দুই মেয়ের হইচইতে কান পাতা দায় হয়ে যায় মার্জিয়া বেগমের। আচমকা দুই মেয়েকে হাসতে দেখে কলিজাটা নাড়া দিয়ে ওঠে তার। আর ক’টা দিন পরেই ঘর অন্ধকার করে মেয়ে দু’টো চলে যাবে পরের ঘরে। আর এভাবে হৈহল্লা করবে না। সে কি শাসনের নামে একটু বেশি-ই কঠোর হয়ে গেলো তবে? এ দূরত্ব কি তবে কমবে না আর?
কলেজ গেটের সামনে অক্লান্ত পায়ে ছোটাছুটি করছে রুনা। একবার হাতঘড়ির দিকে তাকাচ্ছে আরেকবার গেটের দিকে। অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার একদমই সময় নেই। শুরুতেই প্রিয়তার নাচ। আর এখনো পৌঁছাতে পারলো না ও? উত্তেজনায় ঘামতে থাকে সে।
গেট দিয়ে ঢোকার মুখেও ইতিউতি তাকাতে থাকে প্রিয়তা বারবার। তার মন বলছিলো উচ্ছ্বাস ভাই আসবে আজকে। সে যতো কঠিন মানবই হোক না কেনো, তার অনুরোধ সে ফেলতে পারবে না। কিন্তু না, কোথাও সে নেই। তার মনের কোনো এক কোণায় সুপ্ত আকাঙ্ক্ষা ছিলো, মানুষটা আসবেই।
পেখম আপার দিকে তাকিয়ে ঠোঁট টিপে হেসে বললো,”কাউকে খুঁজছিস আপা?”
প্রিয়তা ম্লান হেসে পেখমের দিকে তাকায়। খুব কষ্ট হতে থাকে তার।
কবির শাহ আর মার্জিয়া বেগম পাশাপাশি বসেছে। নিতান্তই সাদামাটা, সাধারণ একরঙা একটা শাড়ি পরে এসেছে মার্জিয়া বেগম। তাতেই যেনো অসামান্য সুন্দর লাগছে তাকে কবির শাহের দিকে। সে বার বার আড়চোখে বউকে দেখছে।
ঘটনা বুঝতে পেরে মার্জিয়া বেগম চাপা গলায় বললো,”বুড়ো বয়সে হচ্ছেটা কি এসব? চারপাশে হাঁটুর বয়সী ছেলেমেয়ে। দেখে নিলে মান ইজ্জত থাকবে কিছু?”
কবির শাহ এক গাল হেসে বললো,”অন্যের বউকে দেখলে মান সম্মান থাকতো না হয়তো। বোঝোই তো শিক্ষক মানুষ আমি।”
“আচ্ছা তাই নাকি? শিক্ষক না হলে বুঝি দেখতে অন্যের বউকে?”
“ভেবে দেখতে দোষ কি?”
মার্জিয়া বেগম চোখ পাকিয়ে তার দিকে তাকাতেই শব্দ করে হেসে দেয় কবির শাহ।
“একটা কথা বলবো মার্জিয়া?”
“বলো।”
“অসম্ভব সুন্দর লাগছে তোমাকে আজ।”
মার্জিয়া বেগম লাজুক গলায় বললো,”বুড়ো বয়সে ভীমরতি শুরু হয়েছে।”
কবির শাহ উত্তর না দিয়ে হাতের মুঠোটা এগিয়ে দেয় মার্জিয়া বেগমের দিকে।
মার্জিয়া জিজ্ঞাসু চোখে তাকায়।
“এটা খুলো, এর মধ্যে যা আছে তোমার।”
“কি আছে এতে?”
“খুলেই দেখো।”
খুশিতে চোখের কোণে পানি চিকচিক করে ওঠে মার্জিয়া বেগমের। মানুষটা তার জন্য বেলী ফুলের মালা এনেছে? তার যে বেলী ফুলের মালা পছন্দ মনে আছে তার?
“খোঁপায় পরো, আরো সুন্দর লাগবে তোমাকে।”
মার্জিয়া বেগম গাঢ় গলায় বললো,”পাগল হয়েছো তুমি? মানুষ কি বলবে? এসব কম বয়সী ছেলেমেয়েগুলোর অনুষ্ঠানে এক মাঝবয়েসী মহিলা খোঁপায় ফুল লাগিয়ে ঘুরছে।”
“মানুষের কথা দিয়ে কি এসে যায় মার্জিয়া? তুমি চাইলে আমি পরিয়ে দিতে পারি তোমার খোঁপায়।”
লজ্জায় লাল হয়ে যায় মার্জিয়া বেগম।
“অনেক হয়েছে, এবার থামো। হয়েছে কি তোমার আজ?”
কবির শাহ হাসি হাসি মুখে মালাটা এগিয়ে দেয়। দোমনা করে আশেপাশে তাকিয়ে মালাটা হাতে তুলে নেয় মার্জিয়া। বার বার সতর্ক হয় কেউ দেখে নিয়েছে কিনা। বিশেষ করে মেয়ে দু’টোর চোখে পড়লে শেষ! কি লজ্জা কি লজ্জা।
ঠিক এমন সময় মঞ্চে কে যেনো গেয়ে উঠলো,
প্রেমের জোয়ারে ভাসাবে দোঁহারে– বাঁধন খুলে দাও, দাও দাও দাও।
ভুলিব ভাবনা, পিছনে চাব না,– পাল তুলে দাও, দাও দাও দাও॥
প্রবল পবনে তরঙ্গ তুলিল, হৃদয় দুলিল, দুলিল দুলিল–
পাগল হে নাবিক, ভুলাও দিগ্বিদিক,– পাল তুলে দাও, দাও দাও দাও॥
মার্জিয়া বেগমের হঠাৎ করে নিজেকে পৃথিবীর সবেচেয়ে সুখী মানুষটা মনে হতে থাকে। কে বলেছে সে ধনী নয়? যে নারীর কাছে তার স্বামীর এমন নি:স্বার্থ এক মহাকাশ পরিমাণ ভালোবাসা আছে, সে যে পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী নারী। আর কি চাই? এইতো জীবন, এইতো জীবনের সৌন্দর্য। মাথা নিচু করে বসে থাকে মার্জিয়া। তার চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়তে থাকে। কবির শাহ শক্ত করে স্ত্রীর বাম হাতটা নিজের মুঠোর মধ্যে চেপে ধরে।
প্রিয়তার নাম ঘোষণা করা হয়েছে। কাঁপা কাঁপা পায়ে মঞ্চের দিকে এগোচ্ছে সে। তার চোখ দু’টো এখনো দর্শক সারির দিকে। এতো মানুষের ভীড়ে কোথাও খুঁজে পাচ্ছে না ওই চোখজোড়া। যে চোখজোড়া মুগ্ধ হয়ে তাকে দেখলে সে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী হতে পারতো। তবে কি সে একটু বেশি চেয়ে ফেলেছে মানুষটার কাছে? বড় অন্যায় হয়ে গেছে। ভিতরটা দুমড়েমুচড়ে যায় প্রিয়তার।
দর্শক সারির সবাই তাকিয়ে দেখছে এক সুদর্শন যুবককে। কেউ অবাক হয়ে আবার কেউ বিরক্ত হয়ে। ভীড় ঠেলে হন্তদন্ত হয়ে যুবকটা সামনের দিকে যাচ্ছে। তার চোখমুখ অশান্ত হয়ে আছে।
“আরে কে আপনি? এভাবে ঠেলাঠেলি করছেন কেনো?”
উচ্ছ্বাস ফিরে তাকায় না। তার গন্তব্য সামনের দিকে। একদম সামনের সারিতে পৌঁছাতে হবে তাকে। জায়গা না পেলেও দাঁড়িয়ে থাকবে, তবুও সামনেই যেতে হবে তার। এক শ্যামবর্ণা ক্লিওপেট্রা তাকে অনুরোধ করেছে যে। পছন্দের কোনো মায়াবতীর অনুরোধ উপেক্ষা করার মতো ক্ষমতা সৃষ্টিকর্তা যে কোনো যুবককে দেননি। উচ্ছ্বাস কীভাবে প্রকৃতির নিয়মের বাইরে যাবে?
তার হাতে এক গুচ্ছ গোলাপ। সে জানেনা এগুলো সে কেনো কিনেছে। তার মা গোলাপ পছন্দ করতো খুব। পহেলা বৈশাখের দিনগুলোতে উচ্ছ্বাস তার মা কে একশো একটা তাজা গোলাপ দিতো। মায়ের মুখটা সাথে সাথে উজ্জ্বল হয়ে যেতো। উচ্ছ্বাস প্রতিবারের মতো এবারও কিনেছে। এতোগুলো যোগাড় করতে দেরি হয়ে যাওয়ায় এভাবে ছুটছে সে। কিন্তু সে বুঝতে পারছে না নিজের এসব পাগলামির মানে। তার মা তো আর নেই। সে কাকে দিবে এগুলো?
নাচ শুরুর কয়েক সেকেন্ড আগে প্রিয়তার পা দু’টো হঠাৎ অনড় হয়ে যায়। এতো মানুষের মধ্যে যেনো আচমকাই এক জোড়া চোখে চোখে আটকে গেছে তার। যেই চোখজোড়ার গভীরতায় সে বারবার খেই হারিয়ে ফেলে। ঠোঁটজোড়া কাঁপতে থাকে তার তিরতির করে।
টকটকে লাল পাঞ্জাবিতে অত্যন্ত সুদর্শন সেই যুবকটার হাতে একগুচ্ছ গোলাপ। প্রিয়তার মাথা নষ্ট হওয়ার জন্য বোধহয় এটুকু যথেষ্ট ছিলো।
সামনে দাঁড়িয়ে দম ফেলে উচ্ছ্বাস। তার চোখ দু’টো মঞ্চে আটকে গেছে। কি একটা অপরূপা তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। সে চাইলেও চোখ দু’টো সরাতে পারছেনা।
অদ্ভুত একটা অনুভূতি হচ্ছে উচ্ছ্বাসের দেহজুড়ে। অসহ্য সুখময় ব্যথা হচ্ছে ঠিক বুকের বাঁ পাশটায়। সে জানেনা এই অনুভূতির উৎস। কবিগুরু বুঝি এমন হৃদয়ের অধিকারীদের কথা চিন্তা করে লিখেছিলো,’চোখের পানে চাহিনু অনিমেষ, বাজিলো বুকে সুখের মতো ব্যথা।’
শাড়িটায় এভাবে মেয়েটাকে মানিয়ে যাবে উচ্ছ্বাস ভাবতে পারেনি। সামান্য সাজে অষ্টাদশী তরুণীটিকে অসামান্য লাগছে। আর কোনো কিছুই তাকে আকর্ষিত করতে পারছে না।
উচ্ছ্বাস নিজের উপর জিদ করে গোলাপগুলো জোরে চেপে ধরে হাতের সাথে। হঠাৎ কাঁটাগুলো বিঁধে যায় তার মুঠোর মধ্যে। কাঁটাগুলোর আঘাতে জর্জরিত হয়ে ওঠে মুঠো তার। চোখ বন্ধ করে জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেলতে থাকে সে। ঠিক তখনই একটা প্রজাপতি মঞ্চে হাওয়ায় দুলে নাচছে।
সেখান থেকে ভেসে আসছে ‘ নীল অঞ্জন ঘন পুঞ্জ ছায়ায় সম্বৃত অম্বর, হে গম্ভীর।’
চোখ তুলে সেদিকে তাকাতেই মোহনীয় তালে মুগ্ধ হয়ে যায় উচ্ছ্বাস। ঘোর লাগা চোখে একদৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে থাকে সে। দুই/এক ফোঁটা র ক্ত টপটপ করে হাত থেকে নিচে পড়ছে সেদিকে কোনো খেয়াল নেই তার।
(চলবে…..)