#তুমি_প্রেম_হলে_আমি_প্রেমিক
পর্ব: ৯
দূর থেকে উচ্ছ্বাসকে একদৃষ্টিতে দেখতে থাকে প্রিয়তা। সে ভালো করেই জানে এখন উনাকে কোথায় পাওয়া যাবে। সে এটাও জানে, এখানে আসায় তাকে কতোগুলো কথা শুনতে হবে উচ্ছ্বাসের কাছ থেকে। মা জানতে পারলে তো কথাই নেই। কিন্তু এতোটা সাহস কে আজ কীভাবে সঞ্চয় করেছে সে নিজেও জানেনা। সেই তাকে বিরক্ত করার জন্য খারাপ ছেলেগুলোকে মারার পর থেকে উচ্ছ্বাসের উপর তার মায়া বহুগুণে বেড়ে গেছে। যদিও অভিমান হয়েছে, বারবার সরে এসেছে সে নিজের মনের সাথে যুদ্ধ করে। কিন্তু আজ তার মনে হয়েছে এই এলোমেলো, উড়নচণ্ডী মানুষটার ভিতরটা একদম অন্যরকম। আজ সকালে শাড়ি নিয়ে মন খারাপ করায়, ঠিক সে শাড়ি এনে রেখেছে তার জন্য। সে কীভাবে বুঝলো এই শাড়িটা আর এতো পছন্দ হবে?
প্রিয়তা পা টিপে টিপে উচ্ছ্বাসের পিছনে যেয়ে দাঁড়াতেই উচ্ছ্বাস পিছনে না ঘুরেই বললো,”আমি জানি তুমি এখানে কেনো এসেছো।”
প্রিয়তা কাঠের মতো দাঁড়িয়ে থাকে। এই মানুষটার অদ্ভুত একটা স্বভাব আছে। পিছন না ঘুরেই বুঝতে পারে কে দাঁড়িয়ে তার পিছে।
প্রিয়তা ধীর গলায় বললো,”কি জানেন আপনি?”
উচ্ছ্বাস মুচকি হেসে উঠে দাঁড়ায়। সে আজ ইচ্ছা করেই সিগারেট ধয়ায়নি। তবে কি তার মন বলছিলো প্রিয়তা আসবে? মেয়েটা সিগারেটের গন্ধ সহ্য করতে পারে না সে বুঝতে পেরেছে। মনের অজান্তেই কি সে মেয়েটার অসুবিধার কথা ভেবে নিজের কষ্ট হওয়া সত্ত্বেও সিগারেট না ধরিয়ে বসে ছিলো? নিজের এমন আচরণে উচ্ছ্বাস কিছুটা বিরক্ত হয়।
“তুমি আমাকে ধন্যবাদ দিতে এসেছো শাড়িটার জন্য। আর এটাও বলতে এসেছো যে শাড়িটা তোমার খুব পছন্দ হয়েছে।”
প্রিয়তা কি মনে করে ফিক করে হেসে দেয়। উচ্ছ্বাসের বুকে একটা ছোট্ট ধাক্কা লাগে। নিজেকে সামলাতে সে অন্য দিকে তাকায়।
“আপনি জ্যোতিষী হলে খুব ভালো হতো। আচ্ছা আমাকে দেখে আর কি কি বুঝতে পারেন আপনি? আমার চোখ দেখে কিছুই বুঝতে পারেননা?”
উচ্ছ্বাস স্মিত হেসে বললো,”আমি জ্যোতিষীও নই, চোখের ডাক্তারও নই। তোমার চোখে সমস্যা হলে ডাক্তারের কাছে যাও। ভারী ফ্রেমের চশমায় একদম হাইস্কুলের বয়স্ক ম্যাডামগুলোর মতো লাগবে তোমাকে।”
প্রিয়তা ভ্রু কুঁচকে তাকায়। নাহ, এই লোক শোধরাবার নয়। সে নিজেকে কিছুটা সংযত করে। এসেছে ভালো মন নিয়ে, কোনোভাবেই একটা ভাঙা মন নিয়ে ঘরে যেতে চায়না সে।
“শোনো মেয়ে, আমাকে ধন্যবাদ দেওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। ধন্যবাদ যদি দিতেই হতো তবে একজনকে দিতে পারতে। তবে আফসোস সে আর নেই।”
প্রিয়তা উচ্ছ্বাসের কথা কিছু বুঝতে পারে না। শাড়ি এনে দিয়েছে উচ্ছ্বাস, আরেকজনকে কেনো ধন্যবাদ দিবে সে?
“কার কথা বলছেন?”
“এই শাড়িটা যার।”
প্রিয়তা অবাক হয়ে বললো,”এই শাড়িটা নতুন নয়?”
উচ্ছ্বাস গম্ভীর গলায় বললো,”কেনো নতুন না হলে পরবে না বুঝি? সেইটা তোমার ব্যাপার অবশ্য।”
“আমি তা বলিনি। কিন্তু শাড়িটা আসলে কার? আর সে নেই মানে? কোথায় গেছে সে?”
উচ্ছ্বাস কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। তার নীরবতায় অস্বস্তি লাগে প্রিয়তার।
“কি হলো চুপ করে আছেন যে? উত্তরটা দিলেন না আমার?”
উচ্ছ্বাস একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,”শাড়িটা আমার মায়ের।”
প্রিয়তা চমকে ওঠে হঠাৎ। উচ্ছ্বাসের মা কে সে দেখেছে অনেক ছোট থাকতে। ভালো করে মনেও নেই মুখের আদলটা। শুধু মনে আছে ভীষণ মিষ্টি একজন মানুষ ছিলেন। ছোটখাটো, গোলগাল আর খুব ফর্সা একজন ভদ্রমহিলা। ভিন্ন শহরে থাকায় সেভাবে আর দেখা হয়নি উনার সাথে। সে শুনেছে একটা সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছে উনি আর উনার স্বামী। খুব কষ্ট পেয়েছিলো প্রিয়তা খবরটা শুনে।
“আপনার মায়ের শাড়ি?”
উচ্ছ্বাস আস্তে আস্তে মাথা নাড়ে।
প্রিয়তা বুঝতে পারে উচ্ছ্বাসের মন ভার হয়ে আসছে।
সে পরিস্থিতি সামলাতে হেসে বললো,”এতো সুন্দর শাড়ি, বেশ রুচি ছিলো তো উনার। আমি একদমই বুঝতে পারিনি এটা পুরোনো। আমি ভেবেছি নতুন।”
উচ্ছ্বাস থমথমে মুখে প্রিয়তার দিকে তাকাতেই ও থেমে যায়।
“এই শাড়িটা প্রায় সাত বছর আগের। আমার মায়ের খুব প্রিয় ছিলো এটা। মা সবসময় এটা পরতো না। শুধুমাত্র বছরে একদিন পরতো, পহেলা বৈশাখে।”
প্রিয়তা বিস্মিত হয়ে বললো,”বাহ, উনি খুব রুচিশীল ছিলেন বোঝাই যাচ্ছে।”
উচ্ছ্বাস ছাদের একদম কিনারায় যেয়ে দাঁড়ায়। সেখান থেকেই খোলা গলায় বললো,”আমার মা বিয়ের আগে নাচতে ভালোবাসতো। ঠিক তোমার মতো। রবীন্দ্র সঙ্গীতেই বেশি নাচতো মা। অনেক পুরস্কারও ছিলো মায়ের। আমি বড় হয়ে দেখেছি।”
“বিয়ের আগে বলছেন কেনো? বিয়ের পর কি নাচ ছেড়ে দিয়েছিলেন উনি?”
“নিজে থেকে ছাড়েনি, ছাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিলো। আমার বাবা সৎ মায়ের ঘরে বড় হয়েছে। তার আপন মা, বাবা ছোট থাকতেই মারা যায়। যদিও আমার বাবা তার ওই মা কেই অনেক ভালোবাসতো। মায়ের বিয়ের পর বাবার ওই সৎমা মাকে নাচ ছাড়াতে বাধ্য করে। বাবা সামান্য প্রতিবাদ করেছিলো, কিন্তু মায়ের উপর কথা বলতে কোনোদিনই সে পারতো না। তার কয়েক বছর পরই আমার দাদী মারা যান। বাবা তখন মা কে আবারও নাচ চালিয়ে যেতে বলে। কিন্তু ততদিনে মা পুরোদস্তুর গৃহিণী। আমিও এসেছি মায়ের কোলে তখন। মা আর নাচতে চাননি। তবে আমি জানি, মায়ের মনে তখন অভিমানের স্তূপ জমা হয়েছে। সেই অভিমান থেকেই মা তার প্রিয় শখকে জলাঞ্জলী দিয়েছে। তবে শুধুমাত্র পহেলা বৈশাখের দিনটায় মা হারিয়ে যেতো তার ফেলে আসা দিনগুলোয়। লাল পেড়ে সাদা শাড়ি পরে ঘরের মধ্যেই সেদিন নাচতো মা। আমি মুগ্ধ হয়ে দেখতাম মায়ের নাচ। সাত বছর আগে বাবা মায়ের জন্য এই শাড়িটা কিনে এনেছিলো। বয়স হয়ে যাওয়ায় আগের মতো আর নাচতো না মা। তবুও শাড়িটা এতোটাই পছন্দ হয়েছিলো যে প্রতি পহেলা বৈশাখে সে শাড়িটা পরতো। আবার সুন্দর করে ভাঁজ করে রেখে দিতো নতুনের মতো। বাড়ি ছাড়ার আগে স্মৃতি বলতে এই শাড়িটাই আমি সাথে এনেছিলাম। এখনো যে শাড়িটায় আমার মায়ের গায়ের গন্ধ লেগে আছে।”
উচ্ছ্বাস থামে। তার গলায় স্পষ্ট কান্না। প্রিয়তা হতবাক হয়ে দেখে এই কঠিন মানুষটার চোখ দিয়ে এভাবে দরদর করে পানি পড়ছে। প্রিয়তার নিজের চোখও ভিজে ওঠে। মানুষটার জন্য অদ্ভুত একটা মায়া টের পাচ্ছে সে ভিতরে। কি নাম এই মায়ার? কি অর্থ এই অনুভূতির?
“অনুমতি না নিয়েই আজ আমি রিহার্সাল রুমে লুকিয়ে তোমার নাচ দেখেছি। আমি হতবাক হয়ে গিয়েছি তোমার নাচ দেখে। সেই তাল, সেই মুদ্রা।”
প্রিয়তা মাথা নিচু করে দাঁড়ায়।
উচ্ছ্বাস চোখ মুছে প্রিয়তার দিকে তাকায়। হালকা হেসে বললো,”তোমার কি খুব অসুবিধা হবে পুরোনো শাড়ি পরে অনুষ্ঠানে নাচতে?”
প্রিয়তা পূর্ণ দৃষ্টি মেলে তাকায় উচ্ছ্বাসের দিকে। সেই পরিচিত বাউন্ডুলে ছেলেটা কোথায় আজ? কে বলবে এই মায়াভরা মুখটা ওই ছন্নছাড়া যুবকটার, যে কথায় কথায় তাকে কষ্ট দিয়ে কথা বলে। আচ্ছা, মায়াবতীর কোনো পুরুষবাচক শব্দ হয়না কেনো? যদি হতো তবে সে নিশ্চিত, সেই শব্দটা শুধু এই মানুষটার জন্যই হতো।
প্রিয়তা ফিসফিস করে বললো,”আমি এই শাড়িটাই পরবো। তবে আমার একটা শর্ত আছে।”
উচ্ছ্বাস ভ্রু কুঁচকে বললো,”এখানে আবার শর্তের কি আছে?”
“আছে, আগে বলুন রাখবেন।”
উচ্ছ্বাস চোখমুখ কুঁচকে দাঁড়ায়। এই অষ্টাদশী কিশোরী গুলো ভীষণ ভয়ংকর হয়। এরা ঢংঢাং করে ঢেঁকি গেলানোর মতো কাজ করিয়ে নিতে চেষ্টা করে।
“কি শর্ত?”
প্রিয়তা লাজুক মুখে হেসে বললো,”অনুষ্ঠানে আপনাকে যেতে হবে। একদম প্রথম সারিতে বসে আমার নাচ দেখতে হবে। তবেই শাড়িটা পরবো আমি।”
উচ্ছ্বাস শব্দ করে হেসে দেয়। প্রিয়তা মুগ্ধ হয়ে দেখে। একজন পুরুষের হাসি এতো সুন্দর হবে কেনো? তার হিংসা হচ্ছে খুব।
“হাসছেন যে?”
“না ভাবছি, যদি দেখো আমি অনুষ্ঠানে যাইনি। তবে কি শাড়িটা ওখানেই খুলে ফেলবে?”
প্রিয়তার কান লাল হয়ে যায় লজ্জায়। কি অসভ্য লোকটা। কথা বলাই ভুল হয়েছে এই বাজে লোকটার সাথে।
“আমি আসছি।”
উচ্ছ্বাস উত্তর দেয়না। তার সিগারেটের তৃষ্ণা পেয়েছে। না না, ঠিক সিগারেট না। তার অদ্ভুত একটা তৃষ্ণা লাগছে কি হতে পারে সেটা? তবে কি তার অবচেতন মন চাচ্ছে এই মায়াবতীটা আর কিছুক্ষণ, না না আরো অনেকক্ষণ তার সামনে থাকুক? সে কেনো চাচ্ছে এমনটা? তার জীবন তো অনিশ্চিত এখন। সে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ এই ভবঘুরে অনিশ্চিত জীবনের সঙ্গী সে কাউকে বানাবে না। আচ্ছা, মনের উপর কি এতো জুলুম চলে? মন, সে তো এক আজব কারখানা। সে না মানবে কারো বারণ না কোনো বাঁধা। শুধু অঝোর অনুভূতিতে প্লাবিত করবে।
উচ্ছ্বাস যন্ত্রের মতো মাথা নাড়ে। বোকা মেয়েটা ভেবেছে অসামান্য মানবীর চোখের ভাষা সে বুঝতে পারেনি। ভুল, সে ভুল।
প্রিয়তা যেতে যেতে আবার পিছন ঘুরে তাকায়। উচ্ছ্বাস এখনো ভাবলেশহীন চোখে তাকিয়ে আছে তার দিকে। কি অদ্ভুত, উনি এমন করছেন কেনো আজ? প্রিয়তার বুকটা কষ্টে পরিপূর্ণ হয়ে যাচ্ছে কেনো মুখটা দেখে।
গুমোট গরম ছিলো আজ দুপুরের পর থেকে। সন্ধ্যার পর পশ্চিম আকাশে সাদা মেঘ জমেছে। উচ্ছ্বাসের মা সবসময় বলতো, ‘সাদা মেঘে বেশ বৃষ্টি হবে, খিচুড়ি খাবি নাকি বাবা?’
উচ্ছ্বাস ঠিক করে আজ সে বৃষ্টিতে ভিজবে। যতো রাতেই বৃষ্টি শুরু হোক না কেনো সে ছাদে বসে অপেক্ষা করবে। মাত্র তো কিছুদিন। এরপরেই হয়তো তাকে জেলখানার চার দেওয়ালে বন্দী হতে হবে। হয়তো ফাঁ সি হয়ে যাবে তার। জীবনের শেষ ক’টা দিন সে ইচ্ছা মতো জীবনটাকে উপভোগ করবে নিজের মতো করে, যা ইচ্ছা করবে।
মুখটা বিষিয়ে ওঠে তার। পকেট থেকে সিগারেট বের করে ধরায় সে। আজ পুরো প্যাকেট একসাথে শেষ করবে সে। সারারাত বৃষ্টিতে ভিজে, ছাদেই শুয়ে পড়বে। ইচ্ছা হলে চিৎকার করে কাঁদবে কিংবা হাসবে। মন আজ যা যা চায় সে করবে। সময় তো নেই আর বেশি।
“ঘুমিয়ে পড়েছিস মা?”
বাবার ডাক শুনে প্রিয়তা উঠে বসে। মাত্রই বঙ্কিমচন্দ্রের ‘মৃণালিনী’ উপন্যাসটা নিয়ে বসেছে। বইটা আজ রুনার কাছ থেকে ধার নিয়ে এসেছে। উপন্যাস পড়ার সময় ধ্যানজ্ঞান সব সেদিকেই থাকে প্রিয়তার।
বইটা বালিশের নিচে ঠেলে দিয়ে প্রিয়তা শব্দ করে বললো,”না না বাবা, তুমি এসো তো।”
কবির শাহ এক গাল হেসে ঘরে ঢোকে। ছোট্ট একটা লাইট জ্বলছে প্রিয়তার মাথার কাছে। কবির শাহ হাসে, সে বুঝতে পারে মেয়ে নির্ঘাত গল্পের বই পড়ছিলো।
“বিরক্ত করলাম নাকি তোকে?”
প্রিয়তা স্মিত হেসে বাবার গলা জড়িয়ে ধরে।
“বাবা তুমি আমার ঘরে আসায় যদি সেইটা বিরক্ত হয়, তবে আমি সারাজীবন এমন বিরক্ত হতে চাই।”
কবির শাহ মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। মেয়েটা সবসময় এতো মায়া করে কথা বলে যে কবির শাহের চোখে পানি এসে যায়।
“কি বই পড়ছিলি?”
প্রিয়তা আড়ালে জিভ কামড়ায়, ধরা পড়েই গেলো বাবার কাছে।
আস্তে আস্তে বইটা বাবার হাতে তুলে দেয় সে।
“বেশ বেশ, এটা আমারও ভীষণ প্রিয়। তবে সাবধানে, অল্প আলোতে বই পড়ে চোখটা নষ্ট করোনা অকালে।”
প্রিয়তার মুখে হাসি ফুটে ওঠে। এইজন্য বাবাকে এতো ভালোবাসে সে। বাবা যেনো সবকিছু বুঝে যায় সহজে।
“তোর নাচের রিহার্সাল কেমন চলছে রে?”
প্রিয়তার মুখে যেনো আলো জ্বলে ওঠে।
“খুব ভালো হচ্ছে বাবা। একক নাচে আমি ‘হে গম্ভীর’ নাচটা করবো। সবাই অনেক প্রশংসা করছে জানো তো বাবা? সবাই বলছে এবারের অনুষ্ঠানের সেরা নাচ হবে আমারটা। ও বাবা, তুমি কিন্তু অবশ্যই আমার নাচ দেখতে যাবে।”
কবির শাহ আপন মনে হাসতে থাকে।
“বাবা হাসছো কেনো?”
কবির শাহ একটা ছোট্ট শ্বাস ফেলে বললো,”এই গানটার সাথে অনেক স্মৃতি মিশে আছে। তুই হয়তো জানিস না, উচ্ছ্বাসের মা নীলিমা অনেক সুন্দর নাচ করতো বিয়ের আগে। আমি আর ও একই কলেজে ছিলাম। ওর এক ব্যাচ সিনিয়র ছিলাম আমি। সেবার পহেলা বৈশাখে ও ‘হে গম্ভীর’ গানে নেচেছিলো। কলেজের সবাই মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলো সেই নাচ দেখে। ভেবেছিলাম নাচ দিয়েই অনেক দূরে যাবে ও। কিন্তু বিয়ের পরেই হঠাৎ নাচ আর পড়াশোনা দুইটাই বাদ দিয়ে দেয়। আমিও অন্য শহরে চলে যাই পড়াশোনার জন্য। বহু বছর আর যোগাযোগ ছিলো না আমাদের। আজ হঠাৎ এই গানটা শুনে ওর কথা খুব মনে পড়ছে।”
কবির শাহ চশমা খুলে পাঞ্জাবির কোণা দিয়ে কাঁচ মোছে।
প্রিয়তা বাবার কাঁধে হাত রেখে বললো,”সত্যি বলছো বাবা? উনিও এই গানে নাচ করেছিলেন?”
কবির শাহ মাথা নাড়ে।
“এই গানটা অনেক ভালোবাসতো ও।”
প্রিয়তার মুখ অন্ধকার দেখে কবির শাহ নিজেকে সামলে তার মাথায় হাত রাখে।
“আমি নিশ্চয়ই যাবো মা তোর নাচ দেখতে। তোর মা কেও নিয়ে যাবো জোর করে।”
প্রিয়তা মৃদু হাসে।
“কাল তোর রিহার্সালের পর তোকে নিয়ে একটু বেরোবো।”
প্রিয়তা কিছুটা অবাক হয়ে বললো,”কোথায় যাবো বাবা?”
“তোরা তো জানিস আমার পছন্দ অতোটা ভালো না। তাই নিজে থেকে শাড়িটা কিনতে পারলাম না। তুই আমার সাথে যাবি, নিজের পছন্দ মতো একটা শাড়ি কিনবি।”
প্রিয়তা কিছুটা ইতস্তত করে। সে কি বাবাকে জানাবে উচ্ছ্বাস ভাই তাকে শাড়ি দিয়েছে, তাও আবার তার মায়ের? যদিও বাবা তার বন্ধুর মতো। তবুও কোথায় যেনো একটা বাঁধা কাজ করে।
“বাবা আমার শাড়ি লাগবে না।”
কবির শাহ হেসে মেয়ের মাথায় হাত দিয়ে বললো,”রাগ করেছিস মায়ের উপর? রাগ করিস না মা আমার। তোর মা আসলে খুব ভালো একজন মানুষ। হয়তো তোদের একটু বকাবকি করে, রাগারাগি করে কিন্তু বিশ্বাস কর তার মতো খাঁটি মানুষ এ দুনিয়ায় খুব কম আছে।”
প্রিয়তা অবাক হয়ে বাবার দিকে তাকায়। মা এই মানুষটাকে কতো কষ্ট দেয়। সবসময় খোঁটা দেয় কিছু দিতে না পারার জন্য। আর বাবা কিনা তারই এতো গুণগান করছে? তার বাবা আসলে এই পৃথিবীর সবচেয়ে শুদ্ধতম একজন মানুষ।
প্রিয়তা বাবার বুকে মাথা রেখে চাপা গলায় বললো,”বাবা তুমি মায়ের সব ভুলগুলো ক্ষমা করে দাও। আচ্ছা বাবা, আমিও যদি কখনো কোনো অন্যায় করে ফেলি তুমি ক্ষমা করে দিবে?”
কবির শাহ মেয়ের কথা শুনে চমকে যায়, কিন্তু বাইরে প্রকাশ করেনা।
“তুই কখনো ভুল করতে পারবি না, কেনো জানিস?”
“কেনো বাবা?”
“কারণ তুই বুঝতেই পারছিস ওটা ভুল। কেউ যদি জানে যে সে ভুল করতে যাচ্ছে, সে শেষমেশ ভুলটা করতে পারেনা। ভুল তারাই করে যারা জানেনা সে ভুল করতে যাচ্ছে।”
প্রিয়তার বুকটা কেঁপে ওঠে বাবার কথা শুনে। ভীষণ কান্না পায়।
“এরপরেও যদি তুই কোনো ভুল করে থাকিস আমি তোকে ক্ষমা করে দিবো। আমি যে একজন বাবা। সন্তান ভুল করলে বাবারা অভিমান করে হয়তো, কিন্তু রাগ করে থাকতে পারে না।”
কবির শাহ টের পায় তার বুকের কাছ থেকে পাঞ্জাবি ভিজে যাচ্ছে। তার মানে তার মেয়েটা কাঁদছে? ঈষৎ কেঁপে ওঠে সে। কি এমন কষ্ট মেয়েটার? সে বাবা হয়ে জানতে পারেনি এখনো মেয়েটার মনের অবস্থা? সে কি জিজ্ঞেস করবে মেয়েকে? কিন্তু মেয়ে জীবনের এমন একটা পর্যায়ে দাঁড়িয়ে আছে, সে চাইলেও তার অনুভূতির প্রাচীর ভেদ করে ভিতরে ঢুকতে পারবে না, যতক্ষণ না মেয়ে নিজে চায়। এই বয়সটা ভুল করার বয়স। এই বয়সে মেয়েদের মনের হঠাৎ পরিবর্তন আসে। তারা কারণ ছাড়াই হাসে আবার কারণ ছাড়াই কাঁদে। মেয়ে কি সত্যিই কোনো ভুল করে ফেললো?
“আচ্ছা বাবা।”
“হ্যা মা বল।”
“কেনো হঠাৎ বড় হয়ে গেলাম বলো তো? সেই যে ছোটবেলায় তোমার কাঁধে চড়ে স্কুলে যেতাম, সেইদিন গুলো এতো তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে গেলো কেনো?”
কবির শাহ মেয়ের চুলে হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো,”সে তুই এখনো আমার কাঁধে চড়তে পারবি। যে হাওয়াই মিঠাই এর মতো শরীর তোর। সেই তুলনায় আমি শক্ত আছি।”
প্রিয়তা কপট রাগ করে বললো,”ভালো হবে না কিন্তু বাবা।”
কবির শাহ শব্দ করে হাসতে থাকে, প্রিয়তাও কিছুক্ষণ রাগ করে থেকে খিলখিল করে হেসে দেয়। দূর থেকে বাবা-মেয়ের হাসাহাসির শব্দ শোনা যায়। কিছুক্ষণ আগেই ঝমঝম করে বৃষ্টি নেমেছে। এবার গ্রীষ্মের আগেই চৈত্রে বেশ বৃষ্টি হচ্ছে রাতের দিকে। তুমুল বৃষ্টির শব্দের সাথে এক অষ্টাদশী কিশোরীর হাসির শব্দ মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। ঠিক এমন সময় এক বুক যন্ত্রণা নিয়ে এক ভগ্ন হৃদয়ের যুবক হাউমাউ করে কাঁদছে। মায়ের গায়ের গন্ধ পাওয়ার জন্য বুকটা খা খা করছে তার। বাবার সাথে বসে গল্প করার জন্য বুকটা ছটফট করছে তার। কেনো সব এমনটা হয়ে গেলো? কি এমন হতো সব ঠিক থাকলে? আচ্ছা, এটা কি কোনো দু:স্বপ্ন হতে পারে না? জেগে উঠলেই দেখবে সবটাই স্বপ্ন ছিলো, অতি জঘন্য কোনো স্বপ্ন।
গীটারটা হাতে তুলে নেয় উচ্ছ্বাস। বৃষ্টির অজস্র ফোঁটাগুলো টপটপ করে পড়তে থাকে চুল বেয়ে।
সেই অবস্থায় টুংটাং করে গীটারে সুর তোলে সে।
‘এই রুপালি গিটার ফেলে
একদিন চলে যাব দুরে, বহুদূরে
সেদিন চোখে অশ্রু তুমি রেখো
গোপন করে।
এই রুপালি গিটার ফেলে
একদিন চলে যাব দুরে, বহুদূরে
সেদিন চোখে অশ্রু তুমি রেখো
গোপন করে।
মনে রেখো তুমি
কত রাত কত দিন
শুনিয়েছি গান আমি, ক্লান্তিবিহীন
অধরে তোমার ফোঁটাতে হাসি
চলে গেছি শুধু
সুর থেকে কত সুরে।
এই রুপালি গিটার ফেলে
একদিন চলে যাব দুরে, বহুদূরে
সেদিন চোখে অশ্রু তুমি রেখো
গোপন করে।’
(চলবে…..)