#তুমি_প্রেম_হলে_আমি_প্রেমিক
পর্ব: ৮
উচ্ছ্বাস কিছুটা আমতা আমতা করে বললো,”মামা আমি আসলে….”
কবির শাহ ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলে বললো,”তোমার ঘরে এসো, কথা আছে।”
উচ্ছ্বাস কিছুটা ঘাবড়ে যায়। ভয় না ঠিক, কেমন অস্বস্তি হতে থাকে। কবির শাহও কি তবে মার্জিয়া বেগমের মতো ভুল বুঝবে তাকে? এ বাড়িতে থাকতে সে কখনোই চায়না। কবির শাহের জোরাজোরিতেই থাকা। যদি এখান থেকে চলে যেতেই হয়, কোনো অসম্মান নিয়ে যেনো এ বাড়ি ছাড়তে না হয়।
“দাঁড়িয়ে থেকো না, বসো আমার পাশে।”
উচ্ছ্বাস মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। তার মাথার মধ্যে একটা চিন্তাই ঘুরপাক খাচ্ছে। কবির শাহ তাকে ভুল বুঝেছে? সত্যিটা বললে বিশ্বাস করবে তো?
কবির শাহ কিছুক্ষণ থেমে আস্তে আস্তে বললো,”বাবা তুমি কি জানো তোমাকে আমি কতোটা স্নেহ করি?”
উচ্ছ্বাস মাথা তুলে তাকায় তার দিকে। এতো সুন্দর করে ‘বাবা’ তাকে দুইটা মানুষ ডাকতো। যে মানুষ দু’টো পৃথিবীতে নেই আজ। বুকটা কেমন দুমড়ে মুচড়ে ওঠে তার।
উচ্ছ্বাস উত্তর দেয়না।
“জানিনা বিশ্বাস করবে কিনা, তোমাকে আমি নিজের ছেলের মতোই ভালোবাসি। প্রিয়তা, পেখমের চেয়ে আলাদা করে দেখিনা।”
উচ্ছ্বাস ধীর গলায় বললো,”জানি মামা, এজন্যই তো এভাবে পড়ে আছি এখানে।”
“এভাবে বলো না বাবা। আমি জানি প্রিয়তার মায়ের ব্যবহারে তুমি কষ্ট পাও। আমি লজ্জিত হই। তবে তুমি বিশ্বাস করো, ও আসলে এতোটা কঠোর না। ওর ভিতরটা একদম অন্যরকম। যেদিন ও তোমাকে ভালোবাসা শুরু করবে সেদিন তুমি ওর মধ্যে তোমার মাতৃছায়া দেখতে পারবে।”
উচ্ছ্বাস মুচকি হেসে বললো,”আমি মামির ব্যবহারে কিছু মনে করিনা মামা। উনি যা করেন তা স্বাভাবিক। এই পরিস্থিতিতে যে কেউ এমনটা করবে। আর তাছাড়া আমি আমার জীবনের এমন একটা পর্যায়ে দাঁড়িয়ে আছি, কারো ব্যবহারেই আমার আর মন খারাপ হয়না।”
কবির শাহ উঠে দাঁড়ায়। উচ্ছ্বাসের কাছে এসে ফিসফিস করে বললো,”ওরা হন্যে হয়ে তোমাকে খুঁজছে। ওই ঘটনার প্রত্যক্ষ সাক্ষী শুধু তুমি। ওরা টাকা দিয়ে কেসটা ধামাচাপা দিলেও তুমি একমাত্র আছো, যে নিজের চোখে সবটা দেখেছো। ওরা তোমাকেও শেষ করে দিতে চায়।”
উচ্ছ্বাসের মুখের শিরাগুলো শক্ত হয়ে ফুলে ওঠে। দুই হাত মুষ্টিবদ্ধ করে দাঁড়ায়। এখনো জ্বলজ্বল করে সেই রাতটা। সেই রাতে মা গরম ভাতের সাথে বেগুন ভর্তা আর মরিচ পোড়া করেছিলো। মায়ের হাতের বেগুন ভর্তা অমৃত লাগতো উচ্ছ্বাসের। বাবার সাথে একসাথে খাওয়া দাওয়া করে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়েছিলো ওরা। রাত তিনটার দিকে দরজা ধাক্কানোর শব্দে ধড়ফড় করে উঠে বসে সে। মা ডাকছে।
“খোকা একটু আয় তো এদিকে।”
মায়ের উৎকণ্ঠা দেখে উচ্ছ্বাস তাড়াতাড়ি করে দরজা খুলে দেয়।
“কি হয়েছে মা? এতো রাতে ডাকছো যে?”
“বাবা রে, আমার কেমন ভয় করছে। এতো রাতে তোর চাচারা এসেছে তোর বাবার কাছে। খুব ঝগড়া চলছে ওদের মধ্যে। তুই একটু যা তো বাবা।”
উচ্ছ্বাস হতবাক হয়ে ঘড়ির দিকে তাকায়। রাত বাজে তিনটা দশ। এতো রাতে চাচাদের বাবার সাথে কি দরকার হতে পারে?
“আমাকে আগে ডাকবে না?”
এই বলে উচ্ছ্বাস ছুটে যায় বাইরের ঘরে। যেয়ে দেখে তার সেজো চাচা কলার করে রেখেছে তার বাবার। উচ্ছ্বাস হতভম্ব হয়ে যায় দেখে।
“কি হচ্ছে কি চাচা? আপনার এতো বড় সাহস, আপনার বড় ভাইয়ের কলারে হাত দিয়েছেন।”
“তুই চুপ কর। বাবাকে বাঁচাতে চাইলে এই দলিলে সই করে দিতে বল এক্ষুনি।”
উচ্ছ্বাস রাতে হতবিহ্বল হয়ে যায়। দৌড়ে এসে বাবাকে ছাড়াতে গেলেই বাকি দুই চাচা তাকে টেনে পিছিয়ে আনে।
“কি করছেন কি আপনারা? এসব কি হচ্ছে?”
উচ্ছ্বাসের বাবা কাঁপা কাঁপা গলায় বললো,”এই সম্পদ শুধুমাত্র আমার একার। আমি নিজের র ক্ত জল করে একটু একটু করে এগুলো বানিয়েছি। এগুলো আমাদের বাবার নয়। আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করি তোমাদের সাহায্য করার জন্য। তাই বলে আমার এতো কষ্টের সম্পদ আমি তোমাদের দিবো না।”
উচ্ছ্বাস চাচাদের দিকে তাকিয়ে বললো,”এসব কি অন্যায় আবদার করছেন আপনারা? সম্পদের জন্য আপনার বড় ভাইয়ের গায়ে হাত দিবেন আপনারা? আর আমাকে এভাবে ধরে রেখেছেন কেনো? ছাড়ুন আমাকে, ছাড়ুন।”
তাদের মধ্যে একজন উচ্ছ্বাসের কথা পাত্তা না দিয়ে উচ্ছ্বাসের বাবার দিকে তাকিয়ে বললো,”ভাইজান আপনি শেষবারের মতো ভেবে বলুন। সোজা আঙ্গুলে ঘি না উঠলে আঙ্গুল বাঁকাতে হবে আমাদের।”
“কি ব্যবস্থা করবে তোমরা?”
হঠাৎ উচ্ছ্বাস দরজায় ছয়জনের ছায়ামূর্তি দেখতে পায়। তাদের মধ্যে দুইজনের হাতে ধাতব অ স্ত্র। উচ্ছ্বাস নিজের শরীরের সর্বশক্তি দিয়ে নিজেকে ছাড়িয়ে নেয়। সাথে সাথে ওর মাথায় কেউ শক্ত কিছু দিয়ে আঘাত করে। ও লুটিয়ে পড়ে মেঝেতে। উচ্ছ্বাসের না চিৎকার করতে করতে ছুটে আসে। এক নারকীয় পরিবেশ তখন ঘরের মধ্যে। জ্ঞান হারানোর আগ মুহূর্তে উচ্ছ্বাস তার জীবনের সবচেয়ে নৃ শংস দৃশ্যটা দেখে।
উচ্ছ্বাস চোখ বন্ধ করে কাঁপতে থাকে। কবির শাহ হঠাৎ ওকে এই অবস্থায় দেখে অবাক হয়।
“বাবা ঠিক আছো তুমি?”
কবির শাহের হাতের ছোঁয়ায় ধাতস্থ হয়ে উচ্ছ্বাস। জোরে জোরে নিঃশ্বাস পড়তে থাকে তার।
“মামা আমি ওদের ছাড়বো না, ছাড়বো না।”
কবির শাহ আঁৎকে উঠে বললো,”কাদের ছাড়বে না?”
“আমার সামনে যারা আমার বাবাকে, আমার মা কে শেষ করেছে আমি ওদের উচিত শাস্তি দিবো। আমি নিজে হাতে ওদের শাস্তি দিবো।”
টকটকে লাল হয়ে আছে উচ্ছ্বাসের চোখ। তার কণ্ঠ কাঁপছে রাগে, উত্তেজনায়।
“শান্ত হও বাবা। তুমি কি বলছো তুমি নিজেও জানো না।”
“আমি জানি মামা। আমি এটাও জানি আমাকে কি করতে হবে। আমি চুপ করে আছি মানে এটা নয় যে, আমি ভয় পেয়েছি। ওরা আমাকে সেদিন মারেনি। ওরা ভেবেছিলো আমি ভয় পেয়ে যাবো। তবে ওরা জানেনা ওরা সেদিন আমাকে না মেরে নিজেদের বিপদ ডেকে এনেছে। আমি নিজেকে সময় দিচ্ছি। এই সময়ে আসলে আমি নিজেকে তৈরি করছি উপযুক্ত সময়ের জন্য। একেক করে আমি প্রতিশোধ নিবো, একেক করে।”
কবির শাহ ভ্রু কুঁচকে বললো,”উচ্ছ্বাস তোমাকে আমি আবারও বলছি মাথা ঠান্ডা করো। তুমি মেধাবী ছেলে। তোমার সামনে একটা উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ। এভাবে মাথা গরম করে সেইটা নষ্ট করে দিও না। আইনের উপর বিশ্বাস রাখো।”
উচ্ছ্বাস ম্লান হাসে। সেই হাসিতে একরাশ বিষাদ মাখা।
“ওদের অনেক টাকা মামা, অনেক। ওরা যেভাবেই হোক নিজেদের বাঁচাবে। আমি সেই সুযোগ ওদের দিবো না।”
“বাবা রে, জীবনটা এতো ঠুনকো নয়। জীবন আরো বড়, অনেক বড়। তোমার অবস্থা আমি বুঝতে পারছি। কিন্তু তুমি যা করতে চাচ্ছো, তা একেবারেই ভুল।”
উচ্ছ্বাস চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে।
কবির শাহ উচ্ছ্বাসের কাঁধে হাত রেখে বললো,”ওরা এখনো জানেনা তুমি এখানে আছো। জানিনা কতোদিন তোমাকে লুকিয়ে রাখতে পারবো। সবসময় সাবধানে থাকবে।”
“অন্যায় করলো ওরা, আর লুকিয়ে থাকতে হবে আমাকে? এটাই দুনিয়ার বিচার মামা?”
কবির শাহ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। উত্তর দিতে পারে না।
“অনেক রাত হয়েছে মামা। আপনি ঘরে যান, নাহলে মামি দুশ্চিন্তা করবে।”
কবির শাহ ছোট্ট করে মাথা নাড়ে। সে উচ্ছ্বাসের মধ্যে সুপ্ত আগ্নেয়গিরি দেখতে পাচ্ছে। আহত সিংহ কতোটা ভয়াবহ হতে পারে সে জানে। যে কোনো সময় ছেলেটা বিস্ফোরণ করবে। সেই দুশ্চিন্তাই তাকে ঘুমাতে দিচ্ছে না। সে কি পারবে ছেলেটাকে রক্ষা করতে?
“ঘুমিয়ে পড়ো, রাত করোনা।”
উচ্ছ্বাস মাথা নাড়ে।
যেতে যেতে কবির শাহ আবার পিছনে ঘুরে তাকায়।
“একটা অনুরোধ করবো বাবা, রাখবে?”
উচ্ছ্বাস অবাক হয়ে বললো,”অনুরোধ বলছেন কেনো মামা? অবশ্যই রাখবো।”
“আমার বড় মেয়েটা কুকুর ভয় পায় ভীষণ। পহেলা বৈশাখের আগের কিছুদিন ওর বাড়ি ফিরতে সন্ধ্যা হবে আজকের মতো। জানো তো, মেয়েটা আমার দারুণ নাচে। সেই ছোটবেলা থেকে নাচতে ভালোবাসে ও। আমি ওকে সুযোগ দিয়েছি। ওর মা যদিও আপত্তি করে। আমি ভাবি, ও যদি পছন্দ করে কিছু করতে চায় ক্ষতি কি? কলেজের অনুষ্ঠানে ও নাচবে। রিহার্সাল থেকে ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে যাবে এ কয়দিন। আমার আবার ওই সময় টিউশন থাকে। আমি চাইলেও ওকে বাড়ি পৌঁছে দিতে পারছি না। তুমি কি এই কয়দিন ওকে সন্ধ্যায় কলেজ থেকে বাড়িতে নিয়ে আসতে পারবে? যদি তোমার কোনো অসুবিধা না থাকে?”
উচ্ছ্বাসের ঠোঁটের কোণে একটা ছোট্ট হাসি ফুটে ওঠে। সাথে সাথে হাসিটা মুছে বললো,”কিন্তু মামি?”
“ওকে নিয়ে ভেবো না, আমি বুঝিয়ে বলবো।”
“আমার সমস্যা নেই মামা।”
কবির শাহ স্মিত হেসে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।
উচ্ছ্বাস খাটের উপর বসে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। তার কি উচিত হবে একটা শুদ্ধতম মায়াবতীর মায়ায় জড়ানো? কখনোই না, কোনোদিন না।
সকাল সকাল মনটা ফুরফুরে হয়ে আছে প্রিয়তার। গত রাতের পর থেকে মনটা অস্বাভাবিক ভাবে ভালো হওয়া শুরু হয়েছে। উচ্ছ্বাস ভাইয়ের এনে দেওয়া ওষুধ খাওয়ার পর ব্যথা বেশ কমে গেছে। ফোলাটা যদিও খুব বেশি কমেনি। তবে হাড় যে ভাঙেনি এটাই ভাগ্যের বিষয়।
“ইশ আজ এতো ভালো লাগছে কেনো? সকালটা কি অসাধারণ সুন্দর আজ, বল পেখম?”
পেখম মুখ টিপে হাসে। সে তো বুঝতে পারছে আপার কেনো এতো ভালো লাগছে।
“আপা তোকে দেখতেও আজ খুব সুন্দর লাগছে জানিস? কি ভীষণ স্নিগ্ধ যে লাগছে!”
প্রিয়তা লাজুক মুখে হাসে। তার মন বলছে সব কিছু ভালো হতে চলেছে। তার জীবনের সেরা নাচটা এবার নাচবে সে।
নাশতার টেবিলে মেয়েকে খুশি খুশি দেখে মার্জিয়া বেগম ভ্রু কুঁচকে তাকায় তার দিকে। আশেপাশে তাকিয়ে উচ্ছ্বাসকে খোঁজে সে। কোথাও দেখতে না পেয়ে কিছুটা স্বস্তি হয়।
“মা তোমার লাল পেড়ে সাদা জামদানী যে শাড়িটা আছে, ওটা আজ বের করে রোদে দিও মনে করে। রোদ না খাওয়ালে জামদানী শাড়িগুলো কেমন প্রাণহীন দেখতে মনে হয়।”
মার্জিয়া বেগম কিছুটা অবাক হয়ে বললো,”ওই শাড়ি দিয়ে কি করবি তুই?”
প্রিয়তা মিটমিট করে হেসে বললো,”মা তুমি তো জানোই না। এবার অনুষ্ঠানে আমি দুইটা নাচ করবো। একটা একক, আরেকটা দলীয়। দলীয় নাচে আমি আবার লিডে থাকবো। আমাকে সবচেয়ে সুন্দর ভাবে সাজতে হবে। নীলু আপা বলেছে এবার অনুষ্ঠানের প্রধান আকর্ষণই নাকি থাকবে আমার নাচ। আমাকে এতো সুন্দর করে শেখাচ্ছেন উনি। আর ওই শাড়িটাতেই আমাকে সবচেয়ে ভালো লাগে মা। পহেলা বৈশাখ বলে কথা, লাল সাদা তো পড়তেই হবে।”
প্রিয়তা এতোগুলো কথা কখনো একসাথে বলেনা। হড়বড় করে বলেই যাচ্ছ সে। কবির শাহ মনে মনে হাসে। বোঝাই যাচ্ছে মেয়েটার মন আজ কতোটা ভালো। মেয়েটাকে প্রাণবন্ত দেখতেও ভালো লাগে। ছোট থেকেই নাচের অনুষ্ঠান গুলোর আগে এমন খুশিতে ছটফট করতো ও।
মার্জিয়া বেগম চুপ করে থাকে।
প্রিয়তা অসহিষ্ণু হয়ে বললো,”ও মা শুনছো কি বলছি? আজ কলেজ থেকে এসে ওটা পরে দেখবো আবার। ভুলে যেও না কিন্তু রোদে মেলে দিতে।”
মার্জিয়া বেগম আমতা আমতা করে বললো,”তুই অন্য কোনো শাড়ি পরিস। ওটা পরা লাগবে না।”
প্রিয়তা অবাক হয়ে বললো,”কি বলছো মা? পহেলা বৈশাখের দিন লাল সাদাই তো পরতে হয়। তোমার তো লাল সাদা আর কোনো শাড়ি নেই। ওটা পরতে কি সমস্যা?”
মার্জিয়া বেগম কিছুটা ইতস্তত করে বললো,”ওটা তোর বড় খালা নিয়ে গেছে গতকাল। পহেলা বৈশাখে তার কোন প্রোগ্রাম আছে, ওখানে পরে যাবে।”
প্রিয়তা হতবাক হয়ে উঠে দাঁড়ায় খাওয়া ছেড়ে। কবির শাহ-ও দারুণ অবাক হয়।
“কি বলছো মা এসব? উনি চাইলো আর তুমি দিয়ে দিলে? উনার কি কম আছে?”
“এভাবে বলছিস কেনো তুই? শাড়িটা আপার পছন্দ হয়েছে, নিয়ে গেছে। তাছাড়া আমি জানতাম নাকি ওটা তোর লাগবে?”
প্রিয়তা কিছুটা গলা চড়িয়ে বললো,”উনি তো সারাদিন প্রচুর গল্প দেয় মা। উনার আলমারি ভর্তি এতো শাড়ি আছে যে উনি গুণেও শেষ করতে পারে না। এক শাড়ি নাকি উনি একদিনের বেশি দুইদিন পরে না। কথায় কথায় তোমাকে শোনায় তোমার ভালো কোনো শাড়ি নেই, বাবা তোমাকে কিছুই কিনে দিতে পারেনা। উনার কি এমন দরকার হলো যে, এতো গরীব বোনের পুরোনো শাড়ি পরে প্রোগ্রামে যেতে হবে? উনি নিজে একটা লাল সাদা শাড়ি কিনে নিতে পারেনি এতো বড়লোক হয়ে?”
কথা শেষ করে হাঁপাতে থাকে প্রিয়তা। মুহুর্তেই সুন্দর মনটা ভেঙে যায় তার। তার বাবার সামর্থ্য এতোটাও ভালো নয় যে, এখন একটা নতুন শাড়ি কিনে দিবে তাকে। আর বড় খালা যখন একবার নিয়েছে পহেলা বৈশাখের এক সপ্তাহ পর ছাড়া ওই শাড়ি পাওয়া যাবে না।”
মার্জিয়া বেগম দাঁতে দাঁত চেপে বললো,”এ কি অসভ্যতা প্রিয়তা? উনি তোমাদের কোনোদিন কোনো সাহায্য করেনি? আজ একটা শাড়ি নিয়েছে বলে এভাবে বলবে তুমি? লজ্জা করছে না বলতে?”
রাগে দু:খে চোখে পানি চলে আসে প্রিয়তার। ইচ্ছা করছে হাত-পা ছড়িয়ে কাঁদতে। কতো আশা করেছিলো এবারের অনুষ্ঠানে সুন্দর করে সেজে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিবে। নাচের সাথে শাড়িটা কি যে সুন্দর লাগতো!
কবির শাহ উঠে এসে মেয়ের মাথায় হাত রাখে।
“শান্ত হও মা আমার। আমি দেখছি কি করা যায়। তুমি একদম ভেবো না।”
মার্জিয়া বেগম হালকা চিৎকার করে বললো,”দেখো আহ্লাদ দিয়ে কেমন বেয়াদব বানিয়েছো মেয়েকে। বড় খালা কতো কি করে ওদের জন্য। আর আজ সে একটা শাড়ি ধার নিয়েছে বলে কীভাবে কথা বলছে। দাও দাও আরো আহ্লাদ দাও।”
কবির শাহ মেয়ের দিকে তাকিয়ে ছোট্ট করে হেসে বললো,”খাবারটা শেষ করে কলেজে বেরিয়ে যাও সোনা মা আমার। দেরি হয়ে যাবে।”
প্রিয়তা কাঁপা গলায় বললো,”আমার খিদে নেই, আমি বেরোলাম।”
কাউকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে প্রিয়তা ছুটে চলে যায় সেখান থেকে। পেখমও কিছু না বলে আপার পিছনে চলে যায়।
কবির শাহ কিছুক্ষণ চুপ থেকে স্ত্রীর দিকে তাকায়। মার্জিয়া বেগম এখনো রাগী চোখে তাকিয়ে আছে।
‘মার্জিয়া, আমি জানি বোনের জিনিস বোন নিবে এতে কোনো অসুবিধা নেই। প্রিয়তা যে শাড়িটা পরতে পারবে না এতেও আমার কোনো সমস্যা নেই। ওটা না পরুক, অন্যটা পরবে। আমার মেয়ে যথেষ্ট মায়াবতী। ও যা পরেই নাচবে ওকে মোহনীয় লাগবে। কিন্তু কথা সেখানে নয়। তোমার বোন প্রতিনিয়ত তোমাকে খোঁটা দেয়, আমি তোমাকে কিছুই দিতে পারিনা। আমার সংসারে এসে তুমি অসুখী। নতুন শাড়ি কিনেই তোমাকে দেখাতে ছুটে আসে। রসিয়ে বসিয়ে তোমাকে জানায় শাড়িটার কতো দাম, কতো সুন্দর। তোমার সারাদিন মন ভার হয়ে থাকে সেদিন। এটা যে তোমার স্বামীর জন্য কতোটা কষ্টের তুমি বোঝার চেষ্টা করোনা। আমি এটাও জানি, উনি ইচ্ছা করেই এমনটা করেন, যেনো তুমি সুখী থাকতে না পারো।”
মার্জিয়া বেগম আস্তে আস্তে বললো,”এতে আপার লাভ?”
“লাভ লোকসানের কিছু নেই। কিছু মানুষ আছে, যারা অন্যদের সুখী দেখতে পারে না। সে তার আপন মায়ের পেটের বোন হলেও না। সবসময় নিজে সুখী এটাই বোঝাতে চায়। এতেই তাদের শান্তি। তুমি কষ্ট পেয়ো না, তোমার বোন এই শ্রেনীর একজন মানুষ। উনার এতো থাকতেও উনি তোমার জিনিসটা নিতে এসেছে। এতে দোষের কিছু না, কিন্তু উনার প্রাচুর্যতা দেখে তোমার মন খারাপ হওয়াটা আমার কাছে খঞ্জরের আঘাতের চেয়েও যন্ত্রণাদায়ক। একটা পুরুষ হলে বুঝতে, শখের নারীকে তার শখের জিনিসটা দিতে না পারার কি কষ্ট।”
মার্জিয়া বেগম মাথা নিচু করে বললো,”তাহলে কি আমি আপার কাছ থেকে চেয়ে আনবো শাড়িটা?”
কবির শাহ হাত ধুয়ে এগিয়ে যেতে যেতে বললো,”এতোটা ছোট তোমাকে হতে দিবো না আমি, এটা ভালো করেই জানো তুমি। মেয়েটা যখন আমার, আমি দেখি কি ব্যবস্থা করতে পারি।”
মার্জিয়া বেগম আর কিছু বলার সুযোগ পায়না। কবির শাহ বেরিয়ে যায় ঘর থেকে। হতাশ মুখে মার্জিয়া বেগম তাকিয়ে থাকে স্বামীর দিকে।
‘একটা পুরুষ হলে বুঝতে, শখের নারীকে তার শখের জিনিসটা দিতে না পারার কি কষ্ট।’ এই কথাটা আর বুকে যেয়ে লেগেছে। মনটা কেমন খচখচ করতে থাকে তার। সে কি মনের অজান্তে মানুষটাকে অনেক বেশি কষ্ট দিয়ে ফেলেছে? কিন্তু তার কি দোষ? সে যখন দেখে, তার আপন বোনের আলমারি ভর্তি দামী শাড়ির বাহার, কোনোটার দামই পাঁচ/ছয় হাজারের কমে না, তখন সে না চাইতেও কষ্ট পায়। সে না চাইতেও মানুষটাকে কষ্ট দিয়ে ফেলে। কিন্তু তার এতো থাকতেও, গরীব বোনের শাড়িই কিনা শেষমেশ দরকার হলো? বোনের উপর এই প্রথম কিছুটা রাগ ওঠে মার্জিয়া বেগমের।
কলেজ প্রাঙ্গনে প্রায় পনেরো মিনিট ধরে দাঁড়িয়ে আছে উচ্ছ্বাস। এখনো রিহার্সাল শেষ হয়নি মহারানীর। এদিকে সিগারেটের তেষ্টায় গলা শুকিয়ে এসেছে তার। কলেজে ধূমপান নিষেধ, তাই চাইলেও সিগারেট ধরাতে পারছে না। কপালে ঘাম জমতে থাকে উচ্ছ্বাসের। রাগে, বিরক্তিতে ভ্রু কুঁচকে আসে তার।
সে যেখানে দাঁড়িয়েছে তার পাশের একটা ঘর থেকেই ঘুঙুরের আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। তার মানে এখানেই হচ্ছে নাচের রিহার্সাল। উচ্ছ্বাস প্রথমে ভাবে এখান থেকে দূরে যেয়ে দাঁড়াবে।
হঠাৎ কি মনে করে দাঁড়িয়ে যায় সে। তার মন খুব টানছে ঘরটার দিকে। এখন কি ওই মেয়েটা নাচছে? সে কি জানালা দিয়ে উঁকি দিবে? খুব বেশি অন্যায় হয়ে যাবে?
কোনোভাবেই নিজের অবাধ্য মনটাকে আটকাতে পারে না সে। ঠোঁট কামড়ে কিছুক্ষণ ভেবে জানালায় চোখ রাখতেই চোখ দু’টো শীতল হয়ে ওঠে তার।
সাদা কামিজ, সাদা চুড়িদার আর লাল ওড়না সুন্দর করে পেঁচানো শরীরে, লম্বা কোঁকড়া চুলগুলো বেণী হয়ে ছড়িয়ে আছে পিঠে। অবাধ্য কিছু চুল ঘামে লেপ্টে কপালে, ঘাড়ে মিশে আছে। কাজলটাও মুছে গেছে অনেকটা চোখ থেকে।
সামান্য এটুকুই কি যথেষ্ট একটা বাঙালি শ্যামবর্ণা তরুণীকে বহুগুণে মোহনীয় করে তোলার জন্য? এতোটা রূপবতী কেনো লাগছে তাকে? কেনো, কেনো, কেনো?
নীল- অঞ্জনঘন পুঞ্জছায়ায় সম্বৃত অম্বর হে গম্ভীর!
বনলক্ষ্মীর কম্পিত কায়, চঞ্চল অন্তর–
ঝঙ্কৃত তার ঝিল্লির মঞ্জীর হে গম্ভীর॥
বর্ষণগীত হল মুখরিত মেঘমন্দ্রিত ছন্দে,
কদম্ববন গভীর মগন আনন্দঘন গন্ধে–
নন্দিত তব উৎসবমন্দির হে গম্ভীর॥
দহনশয়নে তপ্ত ধরণী পড়েছিল পিপাসার্তা,
পাঠালে তাহারে ইন্দ্রলোকের অমৃতবারির বার্তা।
মাটির কঠিন বাধা হল ক্ষীণ, দিকে দিকে হল দীর্ণ–
নব অঙ্কুর-জয়পতাকায় ধরাতল সমাকীর্ণ–
ছিন্ন হয়েছে বন্ধন বন্দীর হে গম্ভীর॥
প্রিয়তা নাচছে গানের তালে তালে। মুগ্ধ হয়ে সেদিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে উচ্ছ্বাস। এই গানে একক নৃত্য হবে প্রিয়তার। উপস্থিত সবাই মুগ্ধ প্রিয়তার নাচে। গানটা বোধহয় ওকেই শুধু মানায় নাচের জন্য। উচ্ছ্বাসের ভ্রম হতে থাকে প্রিয়তার মুদ্রা তাল দেখে।
ঘরে ফিরতেই প্রিয়তা ব্যাগটা ছুড়ে বিছানায় ফেলে। পেখম চুপ করে বসে আছে পড়ার টেবিলে।
“ইশ কি ঢং, আমাকে এগিয়ে আনতে গেছে আবার। আমি কি ছোট মানুষ, একা আসতে পারিনা আমি? উনি আগে আগে হাঁটছেন, আমি দৌড়াতে পারি উনার সাথে?”
পেখম হাসি চেপে বললো,”খুব বড় হয়েছিস তাইনা? গত রাতে তো দেখলাম, কেমন বড় হয়েছিস। কুকুরের দাবড়ানি খেয়ে অবস্থা কাহিল। উচ্ছ্বাস ভাই না থাকলে তো বারোটা বেজে যেতো। মানুষটাকে একটা ধন্যবাদ দিবি, তা না। বদনাম করে যাচ্ছিস তার।”
প্রিয়তা কপট রাগ করে পেখমকে কিছু বলতে যাবে তার আগেই খাটের উপর একটা ব্যাগ দেখে কিছুটা অবাক হয়ে যায়।
“এতে কি আছে রে পেখম?”
পেখম ইতিউতি তাকিয়ে গলা নামিয়ে বললো,”নিজের দেখ কি আছে, ওটা তোর।”
প্রিয়তা চোখমুখ কুঁচকে পেখমের দিকে একবার তাকিয়ে ব্যাগটা হাতে নেয়।
খুলতেই চোখ কপালে ওঠে প্রিয়তার। এটা কোথা থেকে এলো? এতো সুন্দর শাড়ি তার ঘরে?
সাদা জমিনের উপর লাল কল্কা আঁকা একটা তাঁতের শাড়ি। পাড়টাতেও কি সুন্দর লাল নকশা করা। এতো সুন্দর একটা শাড়ি পরলে যে কাউকে তো একদম প্রজাপতির মতো লাগবে।
প্রিয়তা শাড়িটা গায়ের উপর ফেলে আয়নার সামনে দাঁড়াতেই মনটা শতগুণে ভালো হয়ে যায়। একদম একটা জলপরীর মতো লাগছে তাকে। যদি সত্যি শাড়িটা তার হয়ে থাকে, পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠানে তো এটাই পরে যাবে। তাকেই দেখবে সবাই নিশ্চিত।
প্রিয়তার মুখটা হাসি হাসি হয়ে ওঠে।
“বাবা কিনেছে তাইনা রে পেখম? বাবার পছন্দ তো এতো ভালো ছিলো না। মায়ের কাছে সবসময় বাবা বকা খেতো নিজে নিজে পছন্দ করে হাবিজাবি শাড়ি আনার জন্য। মা দেখলে তো অবাক হয়ে যাবে এই শাড়িটা।”
পেখম ঠোঁটের কোণে বাঁকা হাসি ঝুলিয়ে বললো,”বাবা কিনেনি এটা।”
প্রিয়তা মুখ ঘুরিয়ে বললো,”তাহলে কে কিনেছে? মা?”
পেখম উঠে এসে আপার পিছনে দাঁড়ায়। পিছন থেকে প্রিয়তাকে হালকা চেপে ধরে ওর কাঁধে থুতনি দিয়ে বললো,”সেই মানুষটা কিনেছে যে তোর পছন্দ খুব ভালো করে বুঝে গেছে।”
প্রিয়তা হতবাক হয়ে বললো,”কার কথা বলছিস?”
পেখম আপাকে আরো জোরে জড়িয়ে ধরে নিজের মুখটা আপার কানের কাছে নিয়ে ফিসফিস করে বললো,”উচ্ছ্বাস ভাই তোর জন্য কিনে এনেছে এটা বিকেলে।”
(চলবে……)