#তুমি_প্রেম_হলে_আমি_প্রেমিক
পর্ব: ৭
কলেজ গেটে চিন্তিত মুখে দাঁড়িয়ে ছিলো রুনা। গতকাল প্রিয়তা নিয়াজ মোর্শেদের সাথে কথা বলার পর ওভাবে ছুটে চলে যাওয়ার পর থেকে খুব দুশ্চিন্তায় আছে সে। সে-ও ছুটেছিলো প্রিয়তার পিছু পিছু। কিন্তু কিছুদূর যেয়েই হারিয়ে গেলো ও ভিড়ের মধ্যে। আর খুঁজে পেলো না মেয়েটাকে। নিয়াজ মোর্শেদ কি ওর পূর্ব পরিচিত? কি কথা হয়েছিলো ওদের মধ্যে কাল? আর প্রিয়তাই বা কেনো ওভাবে ছুটে চলে গেলো? উত্তরগুলো না পাওয়া পর্যন্ত শান্তিই হচ্ছে না রুনার।
মিনিট পাঁচেক পর প্রিয়তাকে দেখেই রুনা চমকে ওঠে। এভাবে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছে কেনো ও? এক নি:শ্বাসে ছুটে ওর সামনে যেয়ে দাঁড়ায় রুনা।
“কি হয়েছে তোর?”
প্রিয়তা শুষ্ক ঠোঁটে হাসে।
রুনা চোখ বড় বড় করে বললো,”পায়ে কি হয়েছে তোর? ইশ, পা টা ফুলেও তো গেছে বেশ অনেকটা।”
প্রিয়তা চাপা গলায় বললো,”তেমন কিছু হয়নি। চল ক্লাসের দেরি হয়ে যাচ্ছে তো।”
“তুই এই অবস্থায় ক্লাসে কেনো এলি? আমাকে বললে তো আমি ক্লাস লেকচারগুলো তোর বাড়িতে পৌঁছে দিতাম।”
প্রিয়তা ঈষৎ হেসে বললো,”আর আমার নাচের রিহার্সালের কি হতো? ওটাও বুঝি তুই আমার বাড়িতে যেয়ে শিখিয়ে দিয়ে আসতি?”
রুনা অবাক হয়ে বললো,”তুই পায়ের এই অবস্থায় নাচের রিহার্সাল করবি?”
প্রিয়তা রুনার হাত চেপে ধরে হাঁটতে থাকে ক্লাসের দিকে। রুনা প্রিয়তার ভাবগতিক কিছুই বুঝতে পারেনা।
“হেঁয়ালি না করে দয়া করে বলবি আমাকে সবটা?”
প্রিয়তা বেঞ্চে বসে দেয়ালে হেলান দেয়। অনেকটা হেঁটে আসায় পায়ের ব্যথাটা বেশ বেড়েছে তার।
রুনার দিকে শান্ত চোখে তাকিয়ে প্রিয়তা বললো,”কি জানতে চাচ্ছিস?”
রুনা চারদিক ভালো করে দেখে গলা নামিয়ে বললো,”তুই নিয়াজ মোর্শেদকে চিনিস?”
প্রিয়তা ছোট্ট করে একটা শ্বাস ফেলে আস্তে করে মাথা নাড়ে।
রুনা আরো অবাক হয়ে বললো,”কীভাবে চিনিস?”
প্রিয়তা ব্যাগ থেকে বইখাতা বের করতে করতে বললো,”উনি আর উনার পরিবার আমাকে দেখতে গিয়েছিলো গত পরশুদিন। এজন্যই ওদিন আমি কলেজে আসতে পারিনি।”
রুনা হতবাক হয়ে বললো,”সে কি রে? উনি তোকে দেখতে গিয়েছিলো? বিয়েটা কি হচ্ছে তোদের?”
প্রিয়তা ম্লান হেসে বললো,”না হচ্ছে না।”
“তার মানে? তোকে উনাদের পছন্দ হয়নি?”
প্রিয়তা ভ্রু কুঁচকে বললো,”আমাকে উনার পছন্দ হয়েছি নাকি অপছন্দ হয়েছে এটা আমার কাছে বড় কোনো ব্যাপার নয়। আমার উনাকে পছন্দ হয়নি, আমার বাবারও হয়নি। তাই আমাদের বাড়ি থেকে না করে দেওয়া হয়েছে এই বিয়েতে।”
রুনার মুখ ঝুলে গেছে। যেনো এমন আশ্চর্যজনক কথা সে আগে কখনো শোনেনি। মফস্বল শহরের একটা অতি সাধারণ ঘরের মেয়ে, যে কিনা আহামরি সুন্দরীও নয় সে কিনা শহরের নামকরা ব্যবসায়ী নিয়াজ মোর্শেদকে ফিরিয়ে দিয়েছে? তাও কি কখনো সম্ভব?
“উনার মতো একজন ফেরেশতা তুল্য মানুষকে তোরা না করে দিলি?”
প্রিয়তা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে রুনার দিকে তাকায়।
“তোর কেনো মনে হলো উনি ফেরেশতা তুল্য একজন মানুষ?”
“কেনো মনে হবে না? আমাদের কলেজে উনি কতো ডোনেশন দেয় তোর কোনো ধারণা আছে? এছাড়াও বিনা স্বার্থে উনি অনেক মানুষকে সাহায্য করেন শুনেছি। দু:স্থ বাচ্চাদের জামাকাপড় দেয়, পড়াশোনার খরচ দেয়। তো এমন একজন মানুষকে ফেরেশতা তুল্য বলবো না তো কাকে বলবো?”
প্রিয়তা বই বন্ধ করে ধীর দৃষ্টিতে তাকায় রুনার দিকে। রুনার অবাক দৃষ্টি তার উপরে।
“উপর থেকে একজনকে বিচার করা কতোটুকু যুক্তিযুক্ত তোর কাছে? হ্যা বাইরে হয়তো উনি অনেক ভালো একজন মানুষ। কিন্তু ব্যক্তি হিসেবে উনি যে চরম অসভ্য কেউ হবে না এই নিশ্চয়তা দিতে পারবি তুই?”
রুনা কিছুটা থতমত খেয়ে যায়। আসলেই তো, এমন একজন মানুষকে কেনো না করবে প্রিয়তার পরিবার? নিশ্চয়ই কোনো ঘাপলা আছে।
“তার মানে তুই বলতে চাচ্ছিস…..”
রুনাকে থামিয়ে দিয়ে প্রিয়তা বললো,”আমি বলতে চাচ্ছি না, বলছি। উনার সাথে আমার খুবই অল্প কিছু সময় সাক্ষাৎ হয়েছে। উনি সামান্য কিছু কথা বলেছে আমাকে। আমি তাতেই বুঝতে পেরেছি উনি বা উনার পরিবার আসলে বউ হিসেবে কোনো রক্ত-মাংসের মানুষ নয়, বরং চাবি ঘোরানো পুতুল চায়। যে বিয়ের পর থেকে নিজের জীবন শুধু তাদের জন্য উৎসর্গ করবে। তার নিজস্বতা বলে কিছু থাকবে না। তারা যখন যেভাবে নাচাবে, বউকেও সেভাবে নাচতে হবে। যদি কারো স্ত্রী হয়ে ভুলেই যেতে হয় যে, আমিও একজন মানুষ, আমারও নিজস্বতা বলে কিছু আছে তাহলে এতো প্রাচুর্যতা, টাকাপয়সা দিয়ে কি হবে? বাইরের মানুষ জানবে, এমন অসাধারণ একজন মানুষের স্ত্রী, অথচ শুধু ঘরের ভিতরের মানুষটাই জানবে একই ছাদের নিচে, চার দেওয়ালের মধ্যে কাকে নিয়ে বসবাস। আমি আমার বাবাকে দেখে শিখেছি, প্রাচুর্যতার থেকে ভালোবাসা বেশি প্রয়োজন জীবনে।”
প্রিয়তা থামে। তার পায়ের যন্ত্রণাটা বেশ বেড়েছে। কান্না পাচ্ছে তার ভীষণ। সে সত্যিই নাচতে পারবে তো?
রুনা কিছুক্ষণ প্রিয়তার দিকে তাকিয়ে বললো,”তাহলে তোর কি মনে হয়? ভালোবাসা কেমন? এইযে মিরাজ স্যারকে দেখার পর আমার মন, শরীর কেমন অস্থির হয়ে ওঠে, দিনে একবার দেখা না হলে জীবনটাই বরবাদ মনে হয়, যার হাসি দেখলে চিত্ত নেচে ওঠে এটাই কি ভালোবাসা? আমি কি ভালোবাসি মিরাজ স্যারকে?”
প্রিয়তা কুটকুট করে হাসে রুনার কথা শুনে। রুনা লাজুক মুখে মাথা নিচু করে। রুনা মেয়েটা মারাত্মক সুন্দরী। লজ্জা পেলে ফর্সা গাল দু’টো টমেটোর মতো লাল হয়ে যায়। বেশ দেখতে লাগে তখন ওকে।
“এখনো বলা যাচ্ছে না এটা ভালোবাসা কিনা। তুই এখন উনাকে রোজ দেখতে পাচ্ছিস, এজন্য হয়তো উনাকে তুই ভুলতে পারছিস না। কিন্তু যখন আর কয়েক মাস পর কলেজ ছেড়ে চলে যাবি, চোখের দেখাটুকুও দেখতে পারবি না৷ তখন বোঝা যাবে তুই উনাকে সত্যিই ভালোবাসিস কিনা।”
“সেইটা কীভাবে?”
“যদি দেখিস চোখের আড়াল হওয়ার সাথে সাথে মনের আড়ালও হয়ে গেছে, তবে মনে করবি ওটা কখনো ভালোবাসাই ছিলো না, ছিলো সাময়িক মোহ। কিন্তু সত্যিই যদি উনাকে দিনের পর দিন না দেখেও উনার কথা ভুলতে না পারিস, প্রতিনিয়ত তাকে দেখতে মন চায় তবে ধরে নিবি আসলেই তুই উনাকে ভালোবাসিস। কারণ ভালোবাসা মানে চোখের আড়াল হলেও, মনের আড়াল না হওয়া। সহস্র বছর পরেও মানুষটার জন্য একই অনুভূতি থাকা। যে অনুভূতি কখনো ফিকে হয়না, বরং দিন দিন আরো প্রখর হয়, রঙীন হয়।”
রুনা অবাক হয়ে প্রিয়তার কথা শোনে। মেয়েটা সুন্দর করে গুছিয়ে কথা বলে এটা সে জানে। এতো সুন্দর করে কবিতা আবৃত্তি করে, শুনলেই নেশা ধরে যায়। প্রিয়তা তার বাবা কবির শাহের এই গুণটা ভালো ভাবেই আয়ত্ত্ব করেছে।
রুনা বাঁকা চোখে প্রিয়তার দিকে তাকিয়ে বললো,”এতো যে অনুভূতি তোর, প্রেমে পড়েছিস নাকি কারো?”
প্রিয়তা আনমনে কথাগুলো বলে যাচ্ছিলো। রুনার কথা শুনে বেশ চমকে ওঠে সে। রুনার দিকে তাকাতেই দেখে রুনা মিটমিট করে হেসেই যাচ্ছে।
“আরে না, এসব কি বলছিস?”
রুনা আরো কিছুক্ষণ চাপাচাপি করছিলো, এর মধ্যে ক্লাস শুরু হয়ে যাওয়ায় ওখানেই তাদের আলোচনা থামাতে হলো। কিন্তু প্রিয়তার মনের ভিতরের খচখচানিটা কমেনা। সে কীভাবে অবলীলায় এই কথাগুলো বলে দিলো। তবে কি উচ্ছ্বাস ভাইয়ের সাথে চোখের আড়াল হলে, তার মানুষটার জন্য আকুতিও কমে যাবে? তবে কি এটা শুধুই মোহ? নাকি সে-ও বছরের পর বছর চোখের দেখা না হলেও মানুষটার স্মৃতি বুকে চেপে রাখবে? সে কি মানুষটাকে ভালোবাসে আদৌ? এর উত্তর কে দিবে?
রিহার্সাল শেষ করে বাড়ি ফিরতে ফিরতে বেশ সন্ধ্যা হয়ে যায় প্রিয়তার। বুকটা দুরুদুরু করছে তার। সে ভেবেছিলো সে বুঝি রিহার্সাল করতেই পারবে না পায়ের এই অবস্থায়। এবারের পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠান আয়োজন করেছে কলেজের ডিগ্রীতে পড়া ছেলেমেয়েগুলো। মেয়েদের নাচটা দেখছে কয়েকজন মেয়ে। গতবার অনুষ্ঠানে প্রিয়তার নাচ দেখে সবাই অবাক হয়ে গিয়েছিলো। তাই এবার সবার আগে নাচে ওর নামটাই লেখা হয়েছে। কিন্তু আজ নাচের ঘরে যেয়ে প্রিয়তা ভেবেছিলো মেয়েগুলো হয়তো তাকে তাড়িয়েই দিবে। এবার বোধহয় আর তার নাচা হবে না। কিন্তু অবাক বিষয়, মেয়েগুলো প্রিয়তাকে অনেক সাহায্য করেছে। খুব বেশি শিখতে না পারলেও কিছুটা নাচ সে সুন্দর তুলে ফেলেছে। এসব করতে করতে কখন যে বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা নেমেছে ও খেয়ালই করেনি।
সন্ধ্যা মিলিয়ে যাওয়ার পরও মেয়েরা বাড়ির বাইরে থাকবে এটা মার্জিয়া বেগমের পছন্দ না। ভয়ে কলিজাটা শুকিয়ে আসে প্রিয়তার। এমনিতেই তার মা এসব নাচ গান পছন্দ করেনা। বাবার অনুপ্রেরণায় এতোদূর এসেছে। কিন্তু আজ তো মনে হচ্ছে বাবাও তাকে বাঁচাতে পারবে না।
গলির মুখে আসতেই বুকটা ধক করে ওঠে প্রিয়তার। ফাঁকা গলির মুখে প্রায় আট/দশটা কুকুর কুন্ডলী পাকিয়ে শুয়ে আছে। ছোটবেলা থেকে কুকুর খুব ভয় পায় প্রিয়তা। খুব ছোট থাকতে একবার কুকুরের কামড়ও খেয়েছে। তখন থেকেই দারুণ কুকুরভীতি ওর।
আশেপাশে তাকায় প্রিয়তা। সন্ধ্যার এই সময়ে এই গলি মোটামুটি ফাঁকা থাকে। পুরুষেরা বেশিরভাগ মসজিদে ঢোকে। কাঁপা কাঁপা পায়ে এগিয়ে যেতে থাকে প্রিয়তার। তার চোখ কুকুরগুলোর উপর নিবদ্ধ।
কিন্তু শেষ রক্ষা আর হয়না। হঠাৎ করে দুইটা কুকুর ওকে দেখে ভয়ংকরভাবে ডাকা শুরু করে। দুইটা কুকুরের ডাক শুনে বাকিগুলোও তারস্বরে চিৎকার করতে থাকে। হতবিহ্বল হয়ে পড়ে প্রিয়তা। তার বাবা শিখিয়েছে কুকুর দেখলে না দৌড়াতে। স্থিরভাবে হেঁটে যেতে। তাছাড়া তার পায়ের যে অবস্থা সে চাইলেও দৌড়াতে পারবে না। কিন্তু ভয়ে তার পুরো শরীর কাঁপছে থরথর করে।
আচমকে তিনটা কুকুর তার দিকে এগিয়ে আসতেই প্রিয়তা সব ভুলে কাঁধের ব্যাগটা বুকে চেপে ধরে এক নি:শ্বাসে দৌড়াতে থাকে। পায়ের যন্ত্রণায় চোখে দিয়ে পানি চলে আসে তার। কিন্তু সে থামতে পারে না, কারণ পিছন পিছন সবগুলো কুকুর একযোগে দৌঁড়াচ্ছে তার সাথে।
যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে পা চেপে বসে পড়ে সে। সামনেই দেখে আটটা কুকুর তার দিকে ক্ষিপ্রভাবে ছুটে আসছে। প্রিয়তা চিৎকার করে চোখ বন্ধ করে ফেলে।
কয়েক সেকেন্ডের জন্য প্রিয়তার মনে হয়েছে সে শুন্যে ভাসছে। ভয়ে চোখ মেলে তাকাতেও ভয় করছে তার। এক চোখ বন্ধ রেখে এক চোখ খোলে সে কোনোমতে। তাকাতেই হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসে তার। উচ্ছ্বাস তাকে কোলে তুলে নিয়েছে। সামনেই কুকুরগুলো গড়গড় করে শব্দ করছে।
উচ্ছ্বাস কয়েকটা বিস্কুটের প্যাকেট ছুঁড়ে দেয় ওদের দিকে। ওরা প্যাকেটগুলো টানাটানি করতে করতে দৌড়ে চলে যায় অন্যদিকে।
উচ্ছ্বাস প্রিয়তার দিকে না তাকিয়েই ওকে কোল থেকে ধপ করে নামিয়ে দেয়। প্রিয়তা কোনোরকমে টাল সামলে দাঁড়ায়।
“এই মেয়ে তোমার সমস্যা কি? প্রতিবার তোমার বিপদের সময় তুমি আমার সামনে কেনো পড়ো? নাকি ইচ্ছা করে আমার সামনে এসে এসব করো?”
প্রিয়তা চোখ কটমট করে উচ্ছ্বাসের দিকে তাকায়। ভেবেছিলো গতকালের সবকিছু ভুলে এতো বড় উপকারের জন্য উচ্ছ্বাসকে একটা ধন্যবাদ দিবে। কিন্তু কিসের কি? এই লোক শোধরাবার না।
প্রিয়তা কিছু বলতে যাবে তার আগেই উচ্ছ্বাস হাত উঁচু করে তাকে থামিয়ে দেয়।
“আচ্ছা আচ্ছা ঠিক আছে। আমি জানি তুমি এখন কি বলবে। আপনি আজ না থাকলে আমার যে কি হতো, আমি তো মরেই যেতাম। কি বলে যে আপনাকে ধন্যবাদ দিবো। এসব আমি জানি, মেয়েরা এমন সিনেমাটিক সংলাপ দিতে পছন্দ করে।”
প্রিয়তা দাঁতে দাঁত চেপে বললো,”জ্বি না, আমি তেমন কিছুই বলবো না।”
উচ্ছ্বাস অবাক হয়ে বললো,”বলবে না? তাহলে কি বলবে?”
প্রিয়তা কিছুটা ঝাঁঝিয়ে ওঠে।
“নিজেকে ভাবেনটা কি আপনি? একটা মেয়েকে বিপদ থেকে বাঁচিয়ে নিজেকে মহাপুরুষ ভেবে নিয়েছেন নাকি? যদি ভেবে থাকেন, তাহলে শুনে রাখুন, আপনি কোনো মহাপুরুষ না। আর কি যেনো বললেন? আপনার সামনে নাকি আমি ইচ্ছা করে বিপদে পড়ি? আমার তো উল্টোটা মনে হচ্ছে। আপনিই হয়তো আমাকে ছায়ার মতো অনুসরণ করছেন, এজন্য আমার বিপদ আসলেই কোথা থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ে আমাকে উদ্ধার করছেন, নিজেকে উচ্চমার্গের কেউ প্রমাণ করতে। পরের বার থেকে যদি দেখেনও আমাকে কোনো বিপদে পড়তে, নিরাপদ দূরত্ব বজায় চলবেন।”
উচ্ছ্বাস হতবাক হয়ে প্রিয়তার দিকে তাকিয়ে আছে। মেয়েটা এতো কথা বলতে জানে? কই দেখলে তো মনে হয়না।
প্রিয়তা কথা শেষ করে উল্টোদিক ফিরে হাঁটতে গেলেই পায়ের ভিতর যন্ত্রণা চিলিক দিয়ে ওঠে। প্রিয়তা থমকে দাঁড়ায়। উচ্ছ্বাস ভ্রু কুঁচকে তাকায় তার দিকে। সাথে সাথে তার চোখ যায় প্রিয়তার পায়ের দিকে। নিটোল পা’টা নীল হয়ে ফুলে আছে।
“পায়ে কি হয়েছে তোমার?”
প্রিয়তা রক্তলাল চোখে উচ্ছ্বাসের দিকে তাকিয়ে বললো,”আপনার না জানলেও চলবে।”
পা টানতে টানতে প্রিয়তা চলে যায়। উচ্ছ্বাসের হঠাৎ খুব খারাপ লাগে মেয়েটার জন্য। বুকের কোথাও একটা ওই সরল শ্যামবর্ণা মেয়েটার জন্য একটা গভীর মায়া টের পায়। মায়াটা ক্ষতের মতো খচখচ করছে প্রতিনিয়ত। কিন্তু উচ্ছ্বাস নিজের জীবনটা আর কোনো মায়ায় জড়াতে চায়না। এ জীবন যে ক্ষণস্থায়ী। কেনো মেয়েটাকে শুধু শুধু কষ্ট দিবে সে? এ অধিকার তো নেই তার। উচ্ছ্বাস মুচকি হেসে প্রিয়তার দিক থেকে চোখ সরিয়ে নেয়।
বাড়ির কাছে আসতেই বড় খালার গাড়ি দেখে আরো ভয় পেয়ে যায় প্রিয়তা। উনি আবার কেনো এসেছেন? ওদিনের ঘটনার পর প্রিয়তার মনে হয়েছিলো খালা বোধহয় বেশ কিছুদিন আর এ বাড়ি মুখো হবে না। কিন্তু ওই যে কথায় আছে, যেখানেই বাঘের ভয়, সেখানেই সন্ধ্যে হয়।
প্রিয়তা বুকে ফুঁ দিয়ে ঘরে ঢুকতেই পাথরের মতো দাঁড়িয়ে যায়। বসার ঘরে সবাই থমথমে মুখে বসে আছে। এমনকি বাবাও সেখানে উপস্থিত। তার মুখটাও গম্ভীর।
পেখম পর্দার ফাঁকা দিয়ে ভয়ে ভয়ে বাকিদের দিকে তাকাচ্ছে। মর্জিনা বেগম বাঁকা ঠোঁটে হেসে কবির শাহের দিকে তাকিয়ে আছে। আর মার্জিয়া বেগম চিন্তিত মুখে বসে আছে একপাশে।
“দেখেছিস মার্জিয়া, এই হলো তোর মেয়ের অবস্থা। তোর বর তো আবার মেয়েদের বিদ্বান বানাতে চায়। মুখে চুনকালি ঘষার আগে বিয়েটা দিতে বলেছিলাম। তাতেই আমাকে যেভাবে অপমান করা হলো। নেহাৎ মেয়েগুলোকে মায়া করি বলে রাগ করতে পারিনা। নাহলে তোর বরের ওদিনের ব্যবহারের পর পা রাখতাম না এ বাড়ি।”
কবির শাহ কিছুটা বিরক্ত হয়ে বললো,”আপা আমার মেয়েটা আগে বাড়ি ফিরুক, তারপর নাহয় ওর কাছ থেকেই শোনা যাবে ও কেনো দেরি করেছে। তাছাড়া সামনে পহেলা বৈশাখ। ওদের কলেজ থেকে প্রতি বছর এই দিনে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়। মেয়েটা নাচতে পছন্দ করে। হয়তো ওখানেই দেরি হচ্ছে।”
মর্জিনা বেগম হায় হায় করে ওঠে।
“সে কি রে মার্জিয়া, এই বয়সেও মেয়েকে ধেইধেই করে নাচতে পাঠাচ্ছিস? তোকে আর মানুষ বানাতে পারলাম না আমি।”
কবির শাহ কিছু বলতে যাবে তার আগেই মার্জিয়া বেগম মাথা চেপে ধরে বললো,”তোমরা দুইজন চুপ করো দয়া করে। আমার মেয়েটা কখনো এতো দেরি করেনা। এখনো ফিরতে পারলো না, তোমরা ঝগড়া শুরু করে দিলে?”
মর্জিনা বেগম কিছুক্ষণ থেমে ভ্রু কুঁচকে ওদিক ওদিক তাকায়।
“হ্যা রে পেখম, তোদের বাড়িতে আশ্রিত থাকে যে ছেলেটা, ও কোথায়? বাড়িতে নেই নাকি?”
মার্জিয়া বেগম সাথে সাথে লাফ দিয়ে বসে।
“হ্যা তাই তো, ছেলেটাও তো বেরিয়েছে বেশ অনেকক্ষণ। আচ্ছা ওরা আবার একসাথে নেই তো?”
কবির শাহ স্ত্রীর দিকে হতবাক হয়ে তাকিয়ে বললো,”ছি ছি মার্জিয়া, এসব কি বলছো তুমি? মাথা ঠিক আছে তোমার?”
মার্জিয়া বেগম উঁচু গলায় বললো,”একদম চুপ করো তুমি। যা কিছু হচ্ছে সব তোমার জন্য। তুমি মেয়ে দু’টোকে আহ্লাদ দিয়ে অসভ্য বানিয়েছো। সেই সাথে একটা রাস্তার ছেলেকে এনে তুলেছো বাড়িতে। তোমাকে একটা কথা বলে রাখি প্রিয়তার বাবা, আমার মেয়েদের কোনো সর্বনাশ হলে তোমাকে দেখে নিবো আমি।”
কবির শাহ চুপ করে যায়। এই সময়ে মার্জিয়াকে কিছুই বলা যাবে না। তার মাথা তেতে আছে এখন।
প্রিয়তা মায়ের দিকে তাকিয়ে কাঁপা গলায় বললো,”মা।”
বসার ঘরের সবাই একযোগে প্রিয়তার দিকে তাকায়। মাথা নিচু করে অপরাধী মুখে দাঁড়িয়ে আছে প্রিয়তা সবার সামনে।
মুখটা বিষিয়ে আছে প্রিয়তার। আজ পায়ের উপর অনেক অত্যাচার গেছে। একে তো নাচের রিহার্সাল তার উপর কুকুর দেখে দৌড়ানো। এতো যন্ত্রণা হয়নি তখন। রাত বাড়ার সাথে পা’টা মনে হচ্ছে শরীর থেকে আলাদা হয়ে যাবে যন্ত্রণায়।
পেখম ভয়ে ভয়ে আপার দিকে তাকিয়ে বললো,”আপা মা কে জানানো উচিত না এবার? আমার তো মনে হচ্ছে তোর হাড় ভেঙেছে।”
প্রিয়তা চিঁচিঁ করে বললো,”তুই বরফ দিতে থাক, কথা কম বল।”
পেখম অসহিষ্ণু হয়ে বললো,”না আপা, আমি চুপ থাকবো না। এই বরফ দিয়ে কিচ্ছু হবে না। মা কে না বলিস, অন্তত বাবাকে বলা উচিত না? ওষুধ না খেলে এ ব্যথা আরো বাড়বে।”
প্রিয়তা ঠোঁট কামড়ে তাকায় পেখমের দিকে। আজ সন্ধ্যায় তার উপর দিয়ে একচোট ঝড় গেছে। সে আদৌ জানেনা সে এবার নাচতে পারবে কিনা। পায়ের এই অবস্থা জানলে তো একদমই আটকে রাখবে ঘরে। কিন্তু ওষুধ না খেলেও তো আর চলছে না। পায়ে হাত দিয়ে প্রিয়তা ঝরঝর করে কেঁদে দেয় হঠাৎ। পেখম অস্থির চোখে বোনের দিকে তাকিয়ে থাকে।
দরজায় ঠকঠক আওয়াজ শুনে প্রিয়তা তাড়াতাড়ি চোখে মোছে। রাত বাজে বারোটা, এখন কে আসবে তাদের ঘরে? বাবা নাকি মা?
পেখম চাপা গলায় বললো,”কে?”
একটা ভারী কণ্ঠস্বর ভেসে আসে দরজার ওপাশ থেকে।
“পেখম, একটু বাইরে আসবে?”
প্রিয়তা আর পেখম চমকে উঠে একে অন্যের দিকে তাকায়। উচ্ছ্বাস এসেছে তাদের দরজায়? তাও আবার এতো রাতে?
“আপা কি করবো?”
প্রিয়তা ঘাড় ঘুরিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে বললো,”সে আমি কি জানি তুই কি করবি। তোকে ডেকেছে তুই জানিস।”
পেখম কিছু বলার আগে আবারও দরজায় শব্দ হয়। প্রিয়তা মুক বাঁকিয়ে অন্যদিকে তাকায়। পেখম অসহায় চোখে তার দিকে আপার দিকে একবার তাকিয়ে ভয়ে ভয়ে উঠে যায়।
“উচ্ছ্বাস ভাই আপনি?”
“দরজা খুলতেই তো রাত পার করে দিচ্ছো তোমরা? আমি কি বাঘ না ভাল্লুক যে দরজা খুললেই মেরে ফেলবো তোমাদের?”
পেখম ফিক করে হেসে দেয়। মানুষটা কঠিন মুখে এমন হাসির কথা বলতে পারে।
“ভিতরে আসুননা উচ্ছ্বাস ভাই।”
কথাটা বলেই পেখম অস্বস্তি বোধ করে। সৌজন্যতার খাতিরে ভিতরে আসতে বলা। যদি সত্যি সত্যি ভিতরে ঢোকে উনি? মা জানলে তো তুলকালাম বাঁধাবে।
উচ্ছ্বাস বাঁকা ঠোঁটে হাসে।
“ভয়ে পেতে হবে না তোমাকে। আমি ভিতরে যাবো না। তোমাদের সাথে বসে গল্পে মশগুল হতেও আসিনি।”
পেখম কাচুমাচু হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।
প্রিয়তা কান খাঁড়া করে রাখে এদিকে। হঠাৎ এতো রাতে উনি এখানে কেনো?
হাতে থাকা একটা প্যাকেট এগিয়ে দেয় উচ্ছ্বাস পেখমের দিকে।
“এটা ধরো।”
“এটা কি উচ্ছ্বাস ভাই?”
“কিছু ব্যথার ওষুধ আছে। তোমার বোনকে খেতে দিবে। কখন কোনটা খেতে হবে সব লেখা আছে। একদম যেনো বাদ দেওয়া না হয়। পায়ের যা অবস্থা উনার। চিকিৎসা না করলে সারাজীবন ঠ্যাং খোঁড়া অবস্থায় ঘরে বসে থাকতে হবে।”
অদ্ভুত একটা প্রশান্তিতে সারা শরীর তন্ময় হয়ে ওঠে প্রিয়তার। কি ভীষণ ভালো লাগছে তার হঠাৎ করে। মানুষটা তার এতো খেয়াল রাখে? সে কষ্ট পাচ্ছে বলে ওষুধ এনেছে তা জন্য? সব রাগ, অভিমান যেনো এক নিমিষেই ভুলে যায় সে।
পেখম অবাক হয়ে একবার ঘরের ভিতরে তাকায় আরেকবার উচ্ছ্বাসের দিকে তাকায়।
“আর তোমার অতি সাহসী এবং বীর আপাকে বলে দিও, একটা গাধাও জানে কুকুর আর পাগল দেখলে দৌড়াতে হয়না। একটা গাধা হয়ে যা জানে, তোমার মাথা সরু আপা তা জানেনা, আফসোস।”
পেখম উত্তর দেয়না। মুখ টিপে হাসতে থাকে। অন্য সময় হলে প্রিয়তার রাগ হতো, কিন্তু এখন হয়না। সবকিছু এতো সুন্দর, এতো রঙিন লাগছে কেনো?
“যাও এভাবে হাঁ করে দাঁড়িয়ে না থেকে, ওষুধ গুলো মাথা সরু মহারানীকে দিয়ে এসো। আর একটা কথা, উনাকে বলে দিবে শুধু নাচলেই হবে না। ওজনের দিকেও নজর রাখা দরকার।”
উচ্ছ্বাস পেখমকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে চলে যায়। পেখম শেষ কথাটা বুঝতে পারেনা। তার রোগা পাতলা আপাটা আবার ওজন বাড়ালো কবে?
কিন্তু প্রিয়তা ঠিক বুঝে যায় উচ্ছ্বাসের কথা। লজ্জায় কান লাল হয়ে যায় তার। কোলে তুলেছিলো বলে এই কথা বললো লোকটা? কি অসভ্য, কি বাজে!
প্রিয়তা মাথা নিচু করে হেসে দেয় শব্দ করে।
“কোথায় গিয়েছিলে ওদিকে?”
উচ্ছ্বাস চমকে উঠে তাকায়। সামনে কবির শাহ শ্রান্ত চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে। তার অতি গম্ভীর কণ্ঠে উচ্ছ্বাস থমকে যায় সহসা।
(চলবে…)