#তুমি_প্রেম_হলে_আমি_প্রেমিক
পর্ব:৬
ছাত্ররা দুই দলে ভাগ হয়ে মারামারি করে ক্লাস বন্ধ করে দিয়েছে। বাড়ি ফিরতেও ইচ্ছা করছে না প্রিয়তার। কলেজ ক্যান্টিনের পাশেই শান বাঁধানো গাছের বেদীর উপর বসে আছে সে ওর সবচেয়ে কাছের বান্ধবী রুনার সাথে।
তবে প্রিয়তা অন্যদিনের তুলনায় আরো বেশি চুপচাপ। রুনাই বেশি কথা বলে যাচ্ছে।
বেশ কিছুক্ষণ ধরে প্রিয়তাকে চুপ করে থাকতে দেখে রুনা ভ্রু কুঁচকে ওর দিকে তাকায়।
“তুই কি আমার কথা শুনতে পাচ্ছিস প্রিয়তা?”
প্রিয়তা আনমনে ছোট্ট করে ‘হুম’ বলে।
“কি হয়েছে তোর বল তো? এভাবে থম মেরে বসে আছিস কেনো?”
প্রিয়তা ফিসফিস করে বললো,”তেমন কিছু হয়নি।”
“গতকাল কলেজে আসিসনি কেনো? মিরাজ স্যার ক্লাস নিয়েছেন। ইশ, কি যে সুন্দর লাগছিলো কাল তাকে। মেরুন শার্টে একদম নায়ক লাগছিলো।”
প্রিয়তা মুচকি হেসে রুনার দিকে তাকায়। রুনা নতুন আসা মিরাজ স্যারকে খুব পছন্দ করে। মিরাজ স্যার ওদের অ্যাকাউন্টিং ক্লাস নেন। প্রিয়তার হঠাৎ মনটা ভালো হতে থাকে। কোনো কারণ ছাড়াই।
রুনা কিছু বলতে যাবে তার আগেই কলেজের দুইজন নেতা গোছের ছেলে দৌড়ে আসে তাদের কাছে। ওরা ভয়ে ভয়ে উঠে দাঁড়ায়। কিছুক্ষণ আগেই কলেজে ঝামেলা হয়েছে। এই ছেলেগুলো আবার তাদের লোক না তো?
ছেলেদের মধ্যে একজন কর্কশ গলায় বললো,”এই মেয়েরা তোমরা এখানে কি করছো?”
রুনা মিনমিন করে বললো,”কিছু না ভাইয়া। এক্ষুনি চলে যাচ্ছি আমরা।”
“যাবে মানে? এতোক্ষণ যখন যাওনি, তবে এখন যেতে পারবে না।”
প্রিয়তা আর রুনা দুইজনই ভীষণ ভয় পেয়ে যায়।
“এই নাও, এই ফুলের তোড়া আর মালা হাতে রাখো। এক্ষুনি কলেজ গেট থেকে যে গাড়িটা আসবে, সেখান থেকে যে ভদ্রলোক নামবে তাকে এগুলো দিবে।”
প্রিয়তা কাঁপা গলায় বললো,”কে আসবে ভাইয়া?”
ছেলেটা বিরক্ত হয়ে চোখ কুঁচকে বললো,”কে আসবে তা দিয়ে তোমার কি কাজ? তবে মনে রেখো উনি বিশাল মাপের একজন মানুষ। এই কলেজের প্রায় দুই তৃতীয়াংশ ডোনেশন তিনিই দেন। কোনোরকম বেয়াদবি করবে না তার সাথে, মনে থাকবে?”
প্রিয়তা উত্তর দেয়না। কিছুটা রাগ হয় তার। সে কি কারো সাথে বেয়াদবি করে?
হঠাৎ গেটের বাইরে গাড়ির হর্ণ শুনে ছেলে দু’টো হন্তদন্ত হয়ে সেদিকে ছুটে যায়। যাওয়ার আগে প্রিয়তাদের দিকে একবার চোখ পাকিয়ে তাকায়। যার অর্থ, কোনো ভুল ত্রুটি যেনো না হয়।
মিনিট দুইয়েকের মধ্যে একটা সাদা পাজেরো এসে থামে ওদের কিছুটা সামনেই। রুনা ভয়ে ভয়ে প্রিয়তার কাছে এসে গলা নামিয়ে বললো,”আমার ভীষণ ভয় করছে রে প্রিয়তা।”
প্রিয়তা বিরক্ত হয়ে বললো,”ভয়ের কি আছে? উনি বাঘ না ভাল্লুক? ফুলটা উনার হাতে দিয়েই আমরা পগার পার হয়ে যাবো।”
রুনা শান্ত হতে পারে না, অল্পতেই অস্থির হয়ে যাওয়া মেয়ে সে। সেই তুলনায় প্রিয়তা শান্ত।
সাদা পাঞ্জাবি পরা মানুষটাকে দেখে প্রিয়তার শরীরে বিদুৎ খেলে যায়। শরীর শক্ত করে দাঁড়িয়ে থাকে তীক্ষ্ণ চোখে তার দিকে তাকিয়ে।
ছেলে দু’টো তাকে নিয়ে প্রিয়তাদের সামনে আসে।
“উনি নিয়াজ মোর্শেদ, আমাদের কলেজের জন্য ফেরেশতা বলা যায়।”
চোখের ইশারায় ওদের ফুলগুলো দিতে বলে। নিয়াজ নিজেও হতবাক হয়ে তাকিয়ে আছে প্রিয়তার দিকে। সানগ্লাসটা খুলে তাকায় ওর চোখের দিকে।
রুনা কাঁপা কাঁপা হাতে ফুলের তোড়াটা এগিয়ে দেয় নিয়াজের দিকে। নিয়াজ ঠোঁটের কোণে বাঁকা হাসি ঝুলিয়ে ফুলটা হাতে নেয়।
“কি হলো আপনি মালাটা দিবেন না?”
প্রিয়তা হতাশ চোখে তাকায়।
নিয়াজ ছেলেগুলোর দিকে তাকিয়ে হেসে বললো,”উনার মনে হয় আমাকে পছন্দ হয়নি বুঝলে তোমরা? সমস্যা নেই, আমার ফুলের মালা প্রয়োজন নেই।”
ছেলেগুলোর মধ্যে একজন নিয়াজের দিকে তাকিয়ে মেকি হাসি দেয়।
“না না স্যার, কি বলছেন এসব? সমস্যা থাকবে কেনো?”
প্রিয়তার দিকে চোখ পাকিয়ে তাকাতেই প্রিয়তা অন্যদিকে তাকিয়ে মালাটা নিয়াজের হাতে তুলে দেয়।
নিয়াজ মোর্শেদ আহত গলায় বললো,”মালা বুঝি কেউ হাতে দেয়? গলায় পরিয়ে দিতে হয়।”
ছেলে দু’টোও কিছুটা অস্বস্তিবোধ করে। মফস্বল শহরে কলেজ তাদের। একজন বাইরের মানুষকে মালা পরিয়ে দেওয়ার নিয়ম তাদের মেয়েদের নেই।
একজন কিছুটা ইতস্তত করে বললো,”এই মেয়ে তুমি বরং মালাটা স্যারের গলায় পরিয়ে দাও।”
প্রিয়তা যেনো অবাক হওয়ার মাত্রাও অতিক্রম করে ফেলেছে। অসহায় চোখে একবার রুনার দিকে আরেকবার নিয়াজ মোর্শেদের দিকে তাকায়।
রুনা প্রিয়তার কানের কাছে এসে ফিসফিস করে বললো,”চোখ বন্ধ করে মালাটা পরিয়ে দে প্রিয়তা। উনি শুনেছি আমাদের কলেজের জন্য অনেক ডোনেশন দেয়। যদি রাগ হয়ে বন্ধ করে দেন?”
প্রিয়তা বিস্মিত হয়ে তাকায় রুনার দিকে। কি অবাস্তব কথা এসব?
নিয়াজ হাসি মুখে তাকায় থাকে প্রিয়তার দিকে, যেনো খুব মজা পাচ্ছে।
প্রিয়তার রাগে হঠাৎ কান্না পেয়ে যায়। সে চোখ বন্ধ করে উল্টোদিক থেকে সংখ্যা পড়তে থাকে। কিন্তু রাগ কমে না। জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেলতে থাকে সে।
“এই কি হলো? স্যার আর কতোক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবেন?”
প্রিয়তা কাঁপা হাতে মালাটা উপরে তুলে নেয়। তার ইচ্ছা করছে মালাটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে চলে যেতে। কিন্তু কলেজের এই ছেলেগুলো পরবর্তীতে অনেক ঝামেলা করবে। তার জন্য পুরো ক্লাসের উপর ঝামেলা আসতে পারে।
এখনো চোখ বন্ধ করে আছে প্রিয়তা। নিয়াজ মুচকি হাসে ছেলেগুলোর দিকে তাকিয়ে। তারা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে।
“তোমরা সামনে এগিয়ে যাও, আমি আসছি।”
নিয়াজের কথায় ছেলেগুলো একে অপরের দিকে একবার তাকিয়ে চলে যায় সেখান থেকে।
নিয়াজ অনেকটা কাছে চলে আসে প্রিয়তার। রাগে ফোঁসফোঁস করছে এখনো প্রিয়তা। রুনা অবাক হয়ে তাদের দিকে তাকায়।
“শুনলাম তোমাদের বাড়ি থেকে নাকি বিয়ে ভেঙে দিয়েছে? এতোদিন আমি হাজারটা বিয়ে ভেঙেছি। তোমাকে আমার পছন্দ হয়েছিলো। তোমার মতো একটা মেয়ে যাকে আমার হাতের পুতুল বানানো যাবে এমন একটা মেয়েই আমি খুঁজছিলাম। সেই তুমি কিনা আমাকে অপমান করলে?”
প্রিয়তা চোখ গোল গোল করে তাকায় নিয়াজের দিকে।
“ভেবো না, বিয়ে তো আমি তোমাকেই করবো। আজ মালাটা পরে নিলাম। তুমি শুধু অপেক্ষা করতে থাকো।”
ছোট্ট করে হেসে নিয়াজ চশমাটা চোখে পরে চলে যায় সেখান থেকে।
রুনা দৌড়ে এসে প্রিয়তার কাছে দাঁড়ায়।
“তোরা কি পূর্বপরিচিত? কি বললো উনি তোকে?”
প্রিয়তা কোনো কথা না বলে ঝড়ের বেগে কলেজ গেট দিয়ে বেরিয়ে যায়। পুরো শরীর জ্বলে যাচ্ছে তার।
রাস্তায় পাগলের মতো দৌড়াচ্ছে প্রিয়তা। এই বয়সটা আবেগের বয়স। অল্পতেই মন অশান্ত হয়, আবার অল্প খুশিতেই মনটা ভরে ওঠে। সে বুঝতে পারছে নিয়াজ লোকটা এতো সহজে তাকে ছাড়বে না। এমনকি সে আজ জেনেও গেলো সে কোন কলেজে পড়ে। সেই কলেজেরই একজন নামকরা মানুষ সে। এর ফায়দা তো নিয়াজ তুলবেই।
হাবিজাবি অনেক চিন্তা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিলো। এসব ভাবতে ভাবতে সে খেয়ালই করেনি কখন সে বড় রাস্তার একদম মাঝ দিয়ে হাঁটছে। এই রাস্তা দিয়ে বড় বাস, ট্রাকগুলো যায়। কিন্তু প্রিয়তার সেদিকে একদমই মন নেই। তার মন পড়ে আছে কিছুক্ষণ আগের ঘটনায়। কি কুক্ষণেই না সে ক্লাস না থাকা সত্ত্বেও বসে থাকতে গেলো।
প্রচন্ড দাবদাহে রাস্তা যেনো পুড়ছে। ফাল্গুন শেষ হয়ে চৈত্র পড়েছে কিছুদিন। তাতেই এমন গরম? প্রিয়তার গায়ের সাদা কামিজ ঘামে ভিজে জবজব করছে। চোখের কাজল লেপ্টে গেছে পানিতে। সেদিকে খেয়াল নেই ওর। ওর শুধু ইচ্ছা করছে বরফশীতল পানি দিয়ে গোসল করতে।
হঠাৎ ট্রাকের হর্ণের শব্দ শুনে সম্বিত ফিরে পায় সে। আচমকা এতো কাছ থেকে শব্দ শুনে চকিতে তাকাতেই ভীষণ ভয় পেয়ে যায় সে। ট্রাক একদম কাছে চলে এসেছে। হয়তো মাত্র দুই হাতের দূরত্ব। স্থাণূর মতো জমে যায় সে। হিতাহিত জ্ঞানটুকুও যেনো লোপ পেয়েছে। তার সরে যাওয়ার উচিত, এক সেকেন্ডের মধ্যে পিছিয়ে আসা উচিত তার। কিন্তু তার মনে হচ্ছে চুম্বক দ্বারা আটকে রেকেছে কেউ তাকে রাস্তার সাথে। সে বিকট চিৎকার করে কানে হাত দেয়।
হঠাৎ একটা হেঁচকা টান আসে তার বাম বাহুতে। টাল সামলাতে না পেরে হুরমুর করে পড়ে রাস্তার অন্যপাশে। ডান পায়ে প্রচন্ড ব্যথা লাগে পড়ে যেতেই। মনে হয় মচকেই গেলো পা টা। তবে তাকে টান দিয়ে নিয়ে আসা মানুষটা এখনো তার বলশালী শক্ত দু’টো হাত দিয়ে তাকে আঁকড়ে ধরে রেখেছে। তার নি:শ্বাসের ঘন ঘন শব্দ পায় প্রিয়তা খুব কাছে। কিন্তু মাথা তুলে তাকানোর সাহস নেই তার। ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব সে। ভীত হরিণীর মতো কেঁপেই যাচ্ছে একনাগাড়ে। কি হতে যাচ্ছিলো? মানুষটা না এলে এতোক্ষণ কি হয়ে যেতো? ভাবতেই প্রিয়তার শিরদাঁড়া বেয়ে একটা শীতল স্রোত নেমে যায়।
ভয়ে ভয়ে একটা ঢোক চেপে আস্তে আস্তে চোখ দু’টো খুলে উপরের দিকে তাকাতেই তার হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসে। এ কি দেখছে সে? এটা স্বপ্ন নাকি সত্যি? না না, এটা সত্যি হতে পারে না। নির্ঘাৎ স্বপ্ন এটা। এটা একদমই অসম্ভব। এটা অন্য একজন মানুষ। তার অবচেতন মন হয়তো এখানে ওই মানুষটাকে চাচ্ছে, তাই অন্য একজনকেই ওই মানুষের জায়গায় দাঁড় করাচ্ছে। তবে কল্পনা এতো স্পষ্ট হয়?
উচ্ছ্বাস প্রিয়তার দিকে কঠিন লাল চোখে তাকিয়ে তার বাহু ছেড়ে দেয়। ওকে হালকা ধাক্কা দিয়ে এগিয়ে যায় ট্রাকটার দিকে।
“নামেন ট্রাক থেকে, নামেন বলছি।”
উচ্ছ্বাসের সাথে জড়ো হয়েছে আরো কয়েকজন মানুষ। আরেকটু হলে মেয়েটার একটা বড় ধরণের দুর্ঘটনা ঘটে যাচ্ছিলো। বেশ কয়েকজন তামাশা দেখতে দাঁড়িয়ে যায়। মফস্বল শহরে তামাশার অভাব বড় শহরগুলোর মতো। তাই অল্পতেই তারা অতি আগ্রহী হয়ে পড়ে।
এতো মানুষের বহরে বাধ্য হয়ে ট্রাক ড্রাইভার নেমে আসতে বাধ্য হয়। তার চোখেমুখে কিছুটা ভয়।
উচ্ছ্বাস দুই পকেটে হাত ঢুকিয়ে তার সামনে দাঁড়ায়। চোখে চোখ রাখে।
উচ্ছ্বাস উপস্থির মানুষগুলোর দিকে একবার চোখ বুলিয়ে শান্তস্বরে বললো,”একটা মেয়ে ট্রাকের সামনে চলে এসেছে, আর আপনি ট্রাক থামাতে পারেননি? আমি এখানে সময়মতো না এলে কি হয়ে যেতো ভাবতে পারছেন?”
ড্রাইভার কিছু একটা বলতে গেলে উচ্ছ্বাস হাত উঁচু করে তাকে থামায়।
“মা’ল খেয়ে টাল হয়ে ট্রাক চালানোর শাস্তি কি হতে পারে জানেন আপনি?”
ড্রাইভার কিছুটা অবাক হয়ে উচ্ছ্বাসের দিকে তাকিয়ে বললো,”মুখ সামলে কথা বলুন। ওই আপা আপনি দূরে ক্যান? সামনে আসেন, বলেন উনারে। ওই আপা নিজে আমার ট্রাকের সামনে চলে এসেছে। আমি অনেকক্ষণ ধরে হর্ণ বাজাচ্ছি। আপা কানেই শুনছে না। আপা মনে হয় নিজেই মরতে এসেছিলো।”
উচ্ছ্বাস অবাক হয়ে দেখলো উপস্থিত লোকগুলো মুখ টিপে হাসছে ড্রাইভারের কথা শুনে। কেউ কেউ প্রতিবাদের গুঞ্জন তুলেছে, তবে তা খুবই ক্ষীণ।
উচ্ছ্বাস ঘাড় ঘুরিয়ে প্রিয়তার দিকে তাকায়। ভয়ে, লজ্জায়, অপমানে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে ফোঁপাচ্ছে সে। হঠাৎই মেয়েটার জন্য একরাশ মায়া অনুভব করলো সে। মেয়েটাকে এমন বিধ্বস্ত লাগছে কেনো? কি কষ্ট মেয়েটার? সে কি ইচ্ছা করে ট্রাকের সামনে চলে এসেছিলো?
উচ্ছ্বাস ড্রাইভারের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে। ড্রাইভার ভ্রু কুঁচকে তাকায়।
উচ্ছ্বাস ড্রাইভারের কলারটা হালকা করে উঁচু করে ধরে বললো,”সাবধান হয়ে যাও। মেয়েদেরকে নোংরা কথা বলার আগে কয়েকবার ভাববে। ততটুকুই বলবে যতোটুকু তুমি তোমার মা বা বোনের জন্য শুনতে পারবে। যাও এখন।”
উচ্ছ্বাসের কন্ঠস্বর শান্ত, কিন্তু উত্তপ্ত। ড্রাইভার আর বেশি কথা বলার সাহস পায়না। চুপচাপ নিজের ট্রাকে উঠে চলে যায় সে।
উচ্ছ্বাস বাকিদের দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুঁচকে বললো,”তামাশা তো আর বাকি নেই। কি দেখছেন এভাবে দাঁড়িয়ে? মেয়েদের খোঁচা দিয়ে কেউ কথা বললে শুনতে ভালো লাগে তাইনা? যান এখান থেকে, যান বলছি।”
লোকগুলো শুকনো মুখে সেখান থেকে চলে যায়।
উচ্ছ্বাস সেদিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলে ধীর পায়ে হেঁটে আসে প্রিয়তার কাছে।
প্রিয়তা মুখ খোলার আগেই উচ্ছ্বাস তাকে থামিয়ে দিয়ে বললো,”বিয়ে ভাঙার শোকে মরতে ইচ্ছা হয়েছিলো?”
প্রিয়তা ঝট করে মাথা তুলে তাকায় উচ্ছ্বাসের দিকে। বোঝার চেষ্টা করে সে মজা করছে কিনা। কিন্তু তার চোখেমুখে কোনো মজার চিহ্ন নেই।
“এসব কি বলছেন আপনি?”
উচ্ছ্বাস কিছুটা রেগে যায় এবার। প্রিয়তার দুই বাহু শক্ত করে চেপে ধরে। প্রিয়তা চোখ বন্ধ করে ফেলে সাথে সাথে।
“খুব বেশি মরতে ইচ্ছা করলে আজ রাতে বাড়ির ছাদ থেকে লাফ দিও। দিনেদুপুরে ট্রাকের সামনে ঝাঁপ দেওয়া শুধুই লস প্রজেক্ট।”
প্রিয়তা হতবাক হয়ে তাকায় উচ্ছ্বাসের দিকে। চোখে পানি ভরে যায় তার।
“কে বাঁচাতে বলেছিলো তাহলে আমাকে? নিজেকে হিরো প্রমাণ করলেন?”
উচ্ছ্বাস প্রিয়তাকে ছেড়ে দেয়। পকেট থেকে সিগারেট বের করে ধরাতে ধরাতে বললো,”তোমার জায়গায় যে কোনো মেয়ে থাকলেই এমনটা করতাম। নিজেকে এতোটা গুরুত্বপূর্ণ ভাবার কিছু হয়নি। চোখের সামনে পড়েছে, বাঁচিয়েছি। চোখের সামনে পড়বে না, বাঁচানোর প্রয়োজনও মনে করবো না। আর হ্যা, সেদিন তোমার কলেজের সামনে থাকা বদমাশগুলোকেও আমি পিটিয়েছি। সেটা এই কারণে নয় যে, ওরা তোমাকে বিরক্ত করে। কারণটা এটাই ছিলো যে, ওরা শুধুমাত্র তোমাকেই এসব নোংরা কথা বলেনা। ওরা আরো অনেক মেয়েকেই এভাবে বাজে, অশালীন কথা বলে। চিরজীবনের মতো একটা উচিত শিক্ষা ওদের দিয়েছি। যাতে কোনো মেয়ের দিকে চোখ তুলে তাকাতে পর্যন্ত না পারে। তাই তোমাকে বলছি, আকাশকুসুম চিন্তা ভাবা বাদ দাও। দিবাস্বপ্ন যতো কম দেখা যায় ততই ভালো।”
উচ্ছ্বাস প্রিয়তার দিকে আর তাকায় না। ওভাবেই মাঝরাস্তায় ওকে একা ফেলে সে চলে যায়। প্রিয়তা দাঁতে দাঁত চেপে ধরে নিজের অনুভুতিকে ভিতরে আটকে রাখে। এতোটা অপমানিত হওয়ার পরেও তার মনের কোনো এক কোণায় একটু হলেও আশা ছিলো উচ্ছ্বাস তাকে বাড়ি পৌঁছে দিবে। তার পা’টা মচকে গেছে। এই পা নিয়ে বাড়ি পৌঁছানো অসম্ভব মনে হচ্ছে তার। মাঝরাস্তায় দাঁড়িয়ে নিজেকে অসহায় মনে হয় তার ভীষণ। আচ্ছা, উচ্ছ্বাস কি একটা রিকশা ডেকেও দিতে পারতো না?
মিনিট পাঁচেক এমন ঘোরের মধ্যে থেকে প্রিয়তা পিঠ সোজা করে দাঁড়ায়।
‘এতো কিসের দেমাগ উনার? আমাদের বাড়িতেই পড়ে থেকে কিনা, আমার সাথেই এমন বাজে আচরণ? উনি নিজে মেয়েদের সাথে ভালো ব্যবহার করে? কে বলেছিলো সেদিন ওই বখাটেগুলোকে মারতে? আর কে বা বলেছিলো আজ আমাকে বাঁচাতে? আজ আমিও প্রতিজ্ঞা করলাম, এই লোকের জন্য নিজের আর একবিন্দু চোখের পানি আমি নষ্ট করবো না। আমার অনুভূতিগুলো এতোটাও মূল্যহীন নয় যে, একটা অসভ্য ছেলের জন্য তা গলে পড়বে।’
কিছুক্ষণ ঠোঁট ফুলিয়ে আস্তে আস্তে এসব বিড়বিড় করতে থাকে সে। আশেপাশের মানুষগুলো বারবার ঘাড় ঘুরিয়ে তাকে দেখছে। রাস্তার মাঝখানে একটা কমবয়সী মেয়ে পায়ের ব্যথায় হাঁটতে পারছে না, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কান্না আটকানোর চেষ্টা করছে এই দৃশ্যটা যেনো তাদের কাছে খুব মজাদার। প্রিয়তা রাগী চোখে সেদিকে তাকিয়ে একটা রিকশা ডেকে অনেক কষ্টে বাড়ির দিকে রওনা হয়।
“একটা কথা বলবো প্রিয়তার বাবা?”
কবির শাহ ছাত্রদের পরীক্ষার খাতা দেখছে গভীর মনোযোগ দিয়ে। খাতা দেখার সময় সে নিরিবিলিতে থাকতে পছন্দ করে। মার্জিয়া বেগম সব জানে। সে কখনো স্বামীকে বিরক্ত করে না খাতা দেখার সময়। তবে আজ ঘটনা ভিন্ন।
কবির শাহ খাতা থেকে চোখ না তুলেই বললো,”কি বলতে চাও বলো।”
মার্জিয়া বেগম এক কাপ চা বাড়িয়ে দেয় কবির শাহের দিকে। কবির শাহ কিছুটা অবাক হয়ে স্ত্রীর দিকে তাকায়। হঠাৎ এমন ভালো ব্যবহারের কারণ কি? মেয়ের জন্য আবার কোনো সম্বন্ধ আনেনি তো তার বড় বোন?
কবির শাহ খাতা বন্ধ করে চশমা খুলে রাখে। নির্লিপ্ত মুখে চায়ের কাপ হাতে নেয়।
মার্জিয়া বেগম স্বামীর অনেকটা কাছে এসে শান্ত গলায় বললো,”উচ্ছ্বাসের বাবা মা তো একটা সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছে তাইনা?”
কবির শাহ চমকে উঠে তাকায় স্ত্রীর দিকে। হঠাৎ এতোদিন পর এই কথা জিজ্ঞেস করছে কেনো সে?
কবির শাহ নিজেকে সামলে অস্ফুট একটা শব্দ করে।
“শুনেছিলাম ওদের বাড়ির অবস্থাও বেশ স্বচ্ছল। বাবা মায়ের একমাত্র ছেলে। সম্পত্তি তো সব ও পাবে তাইনা?”
কবির শাহ মার্জিয়া বেগমের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে বললো,”হঠাৎ এসব কথা বলছো কেনো?”
“বলছি কারণ, সবকিছু থাকা সত্ত্বেও সেসব ফেলে পরের বাড়িতে কেনো পড়ে আছে ও? দেখো ও যদি গরীব ঘরের সন্তান হতো, আমার ওকে করুণা করতে কোনো অসুবিধা ছিলো না। কিন্তু……”
কবির শাহ স্ত্রীর কথা শেষ করতে দেয়না। তার আগেই থামিয়ে দেয় তাকে।
“তোমাকে আগেও বলেছি মার্জিয়া, বাবা মা চলে যাওয়ার পর থেকে ও একটা মেন্টাল ট্রমার মধ্যে চলে গেছে। আপন বলতে ওর তেমন কেউই নেই। ও অনেকটাই মানসিক রোগী হয়ে গিয়েছিলো তখন। ডাক্তার বলেছে ওকে একা না রেখে কোনো একটা পরিবারের সাথে রাখতে। এজন্যই ওকে এখানে এনেছি আমি। ও সুস্থ হলেই এখান থেকে চলে যাবে। আর পুরোপুরি সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত ও এখানেই থাকবে। আর একটা কথা স্পষ্ট শুনে নাও তুমি। এটা ওর পরের বাড়ি না। তুমি ওকে করুণাও করছো না। গ্রাম থেকে যখন এই শহরে আসি, কেউ ছিলো না আমার পাশে। ভেসেই চলে যাচ্ছিলাম কালের গর্ভে। সেদিন ওর বাবা মা আমাকে টেনে ধরেছিলো। আমি খড়কুটোর মতো আঁকড়ে ধরেছিলাম মানুষ দু’টোকে। আমাকেও ওরা পরম যত্নে ওদের বাড়িতে ঠাঁই দিয়েছিলো। আমি ওই মানুষ দু’টোর বাড়িতেই বছর তিনেক ছিলাম। তারা কেউ আমাকে কোনোদিন বুঝতে দেয়নি ওটা আমার পরের বাড়ি, ওরা আমার অনেক দু:সম্পর্কের আত্মীয়। ওরা কেউ আমাকে সেদিন করুণা করেনি, বরং ভালোবেসেছিলো। আজ তাদের একটা মাত্র কলিজার টুকরো সন্তান যদি আমার আশ্রয়ে কিছুদিন থাকে তাতে তোমার এতো আপত্তি কেনো মার্জিয়া? আমার ইচ্ছের কি কোনো দাম নেই এই সংসারে? ও তো এখানে বছরের পর বছর পড়ে থাকবে না। এটুকু সহ্য কি আমার জন্য করতে পারছো না তুমি?”
কবির শাহ কথা শেষ করে থামে। জোরে জোরে নিঃশ্বাস নেয়। চা শেষ না করেই হনহন করে হেঁটে বারান্দায় চলে যায় সে। মার্জিয়া বেগম অসহিষ্ণু হয়ে মুখ ভোঁতা করে খাটের উপর বসে থাকে।
পেখম বরফের টুকরোগুলো পাতলা সুতি কাপড়ে মুড়ে প্রিয়তার ব্যথার জায়গায় চেপে ধরছে। আর প্রিয়তা সাথে সাথে যন্ত্রণায় নীল হয়ে উঠছে। আপার এমন কষ্টে পেখমেরই ভীষণ খারাপ লাগে। মনে হয় তারই যেনো ব্যথাটা হচ্ছে।
“আপা মা কে না জানানো কি ঠিক হচ্ছে? বাড়াবাড়ি কিছু হয়ে গেলে? যদি হাড় ভেঙে যেয়ে থাকে? তাহলে তো মারাত্মক সমস্যা হবে।”
প্রিয়তা বিরক্ত হয়ে বললো,”যেটা করছিস ঠিকমতো কর। কথা বলিস না বেশি। কিচ্ছু হয়নি, একটু মচকে গেছে শুধু।”
পেখম হতাশ চোখে আপার দিকে তাকিয়ে নিজের কাজ চালিয়ে যায়।
প্রিয়তা গলার আওয়াজ কিছুটা নামিয়ে বললো,”ভুলেও যেনো মা কে এসব বলবি না। ঘূনাক্ষরেও যেনো মা টের না পায় কিছু।”
“কিন্তু মা কে জানালে কি হবে আপা? তুই তো ইচ্ছা করে এমনটা করিস নি যে মা তোকে বকবে।”
প্রিয়তা অন্যদিকে তাকিয়ে বললো,”সামনে পহেলা বৈশাখ। কলেজের অনুষ্ঠানে যে আমাকে নাচতে হবে সে কি ভুলে গিয়েছিস তুই? মা জানতে পারলে আমাকে রিহার্সালে যেতে দিবে?”
পেখম হতবাক হয়ে বললো,”তুই এই অবস্থাতেও রিহার্সাল করবি আপা? তোর কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে?”
“কেনো এখানে মাথা খারাপের কি হলো? সারাবছর এই একটা অনুষ্ঠানের জন্য সেই ছোট্ট থেকে অপেক্ষা করে থাকি আমি। আগে স্কুলে আর এখন কলেজে। এ ছাড়া তো মা আর কোথাও নাচতেই দেয়না আমাকে। কলেজে ওঠার পরেও কি কম আপত্তি করলো গতবার? বাবা নেহাৎ এগিয়ে এসেছিলো বলে। নাহলে তো নাচ জিনিসটাই জীবন থেকে বাদ হয়ে যাচ্ছিলো আমার মা আর বড় খালার জন্য। এবারই কলেজে শেষ বছর। হয়তো জীবনে আর কোনোদিন এই সুযোগ পাবো না। শেষ সুযোগটা আর নষ্ট করতে চাইনা আমি। মা কে কোনোভাবেই জানতে দেওয়া যাবে না পায়ের কথা।”
কথা শেষ করতেই আবার দাঁতে দাঁত চেপে ধরে প্রিয়তা। যন্ত্রণায় চোখে পানি চলে আসছে তার মাঝে মাঝেই।
পেখম আহত গলায় বললো,”কিন্তু আপা পায়ের দিকে একবার তাকা। কীভাবে ফুলে নীল হয়ে আছে। মায়ের চোখ থেকে লুকিয়ে রাখবি কীভাবে? আর তা যদি সম্ভব হয়-ও এই যন্ত্রণা নিয়ে প্রাকটিস করবি কীভাবে তুই?”
প্রিয়তা লম্বা চুলগুলো খোঁপা বাঁধতে বাঁধতে বললো,”এবার মায়ের লাল পেড়ে সাদা জামদানীটা পরবো বুঝলি। আচ্ছা চুলগুলো খোঁপা করবো নাকি ছেড়ে দিবো? কোনটায় আমাকে শাড়ির সাথে বেশি ভালো লাগবে?”
পেখম ক্লান্ত চোখে প্রিয়তার দিকে তাকায়। চোখমুখ খুশির ঝিলিকে চকচক করছে। তার পায়ের দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে পেখম। মনে হচ্ছে আগের চেয়ে আরো একটু বেশি ফুলেছে জায়গাটা।
(চলবে…..)