#তুমি_প্রেম_হলে_আমি_প্রেমিক
পর্ব: ৫
মার্জিয়া বেগম সরু চোখে তাকিয়ে আছে প্রিয়তার দিকে। প্রিয়তার বুকটা অজানা আশঙ্কায় ধকধক করছে। শুকনো ঢোক গিলে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে সে।
মার্জিয়া বেগম ধীর পায়ে হেঁটে প্রিয়তার কাছে এসে দাঁড়ায়।
“ভিজেছিস কেনো এভাবে?”
প্রিয়তা ঈষৎ কেঁপে ওঠে। মায়ের দিকে তাকাতেও ভয় করছে তার এখন।
“কি রে উত্তর দে, এভাবে ভিজেছিস কেনো?”
মার্জিয়া বেগমের কণ্ঠ অত্যন্ত শীতল। সে ধমকে কথা বলছে না। অথচ প্রিয়তার মনে হচ্ছে মা ধমক দিলেই বোধ হয় বেশি ভালো হতো।
“মা আসলে আমার খুব মন খারাপ লাগছিলো, তাই ছাদে গিয়েছিলাম। হঠাৎ করে বৃষ্টি এলো। তাই ইচ্ছা হলো বৃষ্টিতে ভিজি।”
মার্জিয়া বেগম ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মেয়ের চোখের দিকে তাকায়। এই বয়সটা সে-ও পার করে এসেছে। মেয়ের অন্তরে ওঠা ঝড় তার চোখের তারায় স্পষ্ট সে তাও বুঝতে পারছে। কার জন্য এমন করছে সে? ওই ভবঘুরে বাউন্ডুলে ছেলেটার জন্য নয় তো আবার?
“ভিজে জামাকাপড় বেশিক্ষণ গায়ে দিয়ে রাখিস না। শাড়িটা মেলে দে, শুকিয়ে যাক।”
প্রিয়তা ঘাড় কাত করে চলে যাচ্ছিলো।
পিছন থেকে মার্জিয়া বেগম আবার ঠান্ডা গলায় বলে ওঠে,”বিয়েটা আপাতত হচ্ছেনা তোর। এখন বোধহয় তোর মনটা ভালো হবে।”
প্রিয়তা বাঁকা চোখে মায়ের দিকে তাকিয়ে তার মনোভাব বোঝার চেষ্টা করে। বিয়েটা ভাঙায় মা কি রেগে আছে খুব? তাকে দেখে তো তেমন মনে হচ্ছে না। অদ্ভুত রকম শান্ত ব্যবহার করছে সে। মায়ের এমন রূপের সাথে প্রিয়তা পরিচিত না। বেশ ভয় করতে থাকে প্রিয়তার।
“এখন যা নিজের ঘরে।”
প্রিয়তা কিছুটা ইতস্তত করে সেখান থেকে চলে যায়। মার্জিয়া বেগম একবার সিঁড়ির দিকে তাকিয়ে নিজের কাজে চলে যায়।
ঘরে ফিরেই উশখুশ করতে থাকে প্রিয়তা। সে যে চা চেয়েছে তার কাছে। এখন কীভাবে চা বানিয়ে ছাদে যাবে সে? মা তো ওখানেই খুঁটি পেতে আছে মনে হয়। রান্নাঘর থেকে চা বানিয়ে ছাদে গেলে তো নির্ঘাত সন্দেহ করবে। কিন্তু এই প্রথম মানুষটা মুখ ফুটে তার কাছে কিছু চেয়েছে। আর সে দিতে পারবে না?
খাটের উপর বসে ছটফট করতে থাকে প্রিয়তা।
পেখম কোথা থেকে দৌড়ে আসে। এসেই আপার গায়ের উপর আহ্লাদে ঢলে পড়ে। প্রিয়তা খানিকটা বিরক্ত হয়, কিছু বলেনা।
“আপা সুখবর পেয়েছিস তো? টাকলাকে আজীবনের মতো বিদায় দিয়েছে বাবা। বাবা একদম ফাটিয়ে দিয়েছে জানিস তো। আমাদের জন্য বাবা হলো সুপার ম্যান। যতোই বড় খালা হাঙ্গামা করুক না কেনো, শেষে বাবা ছক্কা মেরে জিতে গেলো।”
প্রিয়তা শুকনো ঠোঁটে হাসে। তার মন পড়ে আছে এখন ছাদে। এখনো নিশ্চয়ই অপেক্ষা করে আছে তার চায়ের জন্য।
পেখম ভ্রু কুঁচকে আপার দিকে তাকায়।
“কি রে আপা? তুই মুখটা এমন বাংলার পাঁচের মতো করে রেখেছিস কেনো বল তো? তুই আবার মনে মনে ওই টাকলাকে পছন্দ করে ফেলিসনি তো? দেখ, আমি কিন্তু দুলাভাই হিসেবে ওই বেটাকে কোনোভাবে মানতে পারবো না, নেভার। আমার বান্ধবীরা আমাকে ক্ষেপাবে, তোর দুলাভাই টাক। আমি এসব মানতে পারবো না।”
প্রিয়তা ঝাঁঝের সাথে পেখমের দিকে তাকিয়ে বললো,”দয়া করে একটু চুপ করবি? এতো কথা কীভাবে বলতে পারিস তুই? মাথা ধরিয়ে দিচ্ছিস একদম।”
পেখম কিছুটা দমে যায়। নিশ্চয়ই আপার কিছু হয়েছে। নাহলে এতো বড় একটা খুশির খবরেও এমন করছে কেনো?
পেখম প্রিয়তার হাতের উপর হাত রেখে নরম গলায় বললো,”কি হয়েছে আপা তোর? আমাকে বল। মা কিছু বলেছে?”
প্রিয়তা ঠোঁট কামড়ে না-সূচক মাথা নাড়ে।
পরক্ষণেই পেখমের দিকে তাকিয়ে বললো,”একটা উপকার করতে পারবি?”
“কি উপকার আপা?”
“দৌড়ে যা তো, দেখে আয় মা কোথায়।”
“কিন্তু কেনো?”
প্রিয়তা কিঞ্চিৎ বিরক্ত হয়ে বললো,”যা বলছি তাই কর। কিন্তু সাবধান, এমন ভাবে যাবি যেনো মা বুঝতে না পারে তুই তাকে দেখতে গিয়েছিস। মায়ের কিন্তু অনেক বুদ্ধি।”
পেখম আপার কোনো কথা বুঝতে পারেনা। অগত্যা উঠে দাঁড়ায়।
পেখম ফিরে আসে মিনিট দুই পরেই। তাকে দেখেই প্রিয়তা উত্তেজিত হয়ে বললো,”মা কোথায়?”
পেখম ঠোঁট বাঁকিয়ে বললো,”ওদিকে তো কোথাও দেখলাম না। মনে হয় নিজের ঘরে।”
প্রিয়তা একটা ছোট্ট শ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ায়। এটাই সুযোগ, যা করতে হবে খুব দ্রুত আর খুব সাবধানে।
“আপা কোথায় যাচ্ছিস?”
প্রিয়তা গায়ের উপর ওড়না টেনে নেয়। পেখমের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বেরিয়ে যায় ঘর থেকে।
মশার প্রকোপ বেশ বেড়েছে বৃষ্টি কমার পর। বেশ ঠান্ডাও লাগছে। গুমোট গরমের পর আরামদায়ক আবহাওয়া। উচ্ছ্বাসের ইচ্ছা করছে ছাদের উপরই শুয়ে পড়তে। উচ্ছ্বাস কখনো নিজের ইচ্ছাকে মাটিচাপা দেয়না। একটাই তো জীবন, তাও ছন্নছাড়া। কি হবে এতো নিয়ম কাননের বাঁধাজালে জীবন বেঁধে রেখে?
পকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে ধরায় সে। এরপর শুয়ে পড়ে ছাদের উপরই। পানিতে থইথই করছে ছাদ। পিঠের নিচে পানি পড়তেই ঠান্ডা অনুভূতি হয়। সিগারেট টেনে ধোঁয়া ছাড়তে থাকে উপরে। নিচে ঠান্ডা পানি, উপরে বিকট গন্ধের ধোঁয়া। বেশ ভালো লাগে উচ্ছ্বাসের।
নিজের উপর নিজেই মাঝে মাঝে অবাক হয়ে যায় সে। আস্তে আস্তে তবে চেইন স্মোকারই হয়ে গেলো সে? অথচ এমনটা তো হওয়ার কথা ছিলো না। নিতান্ত ভদ্র, চুপচাপ একটা তরুণ ছিলো সে। বন্ধুদের আড্ডায় কতো অনুরোধ করা হয়েছে একটা টান দিতে ধূম্রশলাকায়। কোনোদিন মনের ভুলেও এ কাজ করেনি সে। তার মা সবসময় বলতো,’ওসব বাজে ছেলেরা খায়। একদম যেনো ওসব কখনো না শুনি।’
উচ্ছ্বাস মিষ্টি করে হেসে বলতো,’মা আমি তো তোমার ভালো ছেলে।’
উচ্ছ্বাসের মা সুন্দর করে হেসে ছেলের কপালে চুমু এঁকে দিতো।
চোখ বন্ধ করে ফেলে উচ্ছ্বাস। যতোবার মায়ের মুখটা মনে পড়ে ততবার বুকের ভিতরটা হু হু করে ওঠে তার।
সবচেয়ে উজ্জ্বল তারাটার দিকে তাকিয়ে উচ্ছ্বাস মুচকি হেসে বললো,”মা গো, আজ সেই বাজে ছেলেটা হলাম আমি। এই শহরে আমার মতো বাজে কেউ নেই। তুমি চেয়েছিলে তোমার ছেলে যেনো বাজে না হয়। কিন্তু তোমার খু নের প্রতিশোধ নিতে আমি বাজে হবো মা, হবোই।”
কবির শাহ বাদে এ বাড়ির সবাই জানে উচ্ছ্বাসের বাবা মা একটা সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায়। কিন্তু আসল সত্যটা এখনো কেউ জানেনা। কবির শাহ বলতে নিষেধ করেছে।
উচ্ছ্বাসের গলার রগ ফুলে ওঠে সাথে সাথে। ঘন ঘন শ্বাস পড়তে থাকে তার। ওই ঘটনা চোখের সামনে ভেসে উঠলেই নিজেকে সংযত করতে পারে না সে। সাথে সাথে শোয়া থেকে উঠে বসে। হাত মুষ্টিবদ্ধ করে ছাদের উপর ঘু’ষি দিতে যাবে তার আগেই কারো মিষ্টি গলার স্বর শুনে থমকে যায় সে। নিজেকে সামলায় কষ্ট করে।
“আপনার চা।”
উচ্ছ্বাস ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায়। প্রিয়তা ইতোমধ্যে শাড়ি পালটে ফেলেছে। হালকা নীল আর গোলাপির মিশেলে সুন্দর একটা সালোয়ার কামিজ পরেছে। অনেক বেশি চিকন লাগছে তাকে এখন। কিন্তু কেনো যেনো একটু বেশি-ই মায়াবী লাগছে।
উচ্ছ্বাস চোখ ফিরিয়ে নেয় তার দিকে থেকে।
“আপনি চা চেয়েছিলেন।”
উচ্ছ্বাস থমথমে গলায় বললো,”চা লাগবে না, নিয়ে যাও।”
প্রিয়তা অবাক হয়ে বললো,”কিন্তু আপনি যে একটু আগেই চাইলেন।”
উচ্ছ্বাস হালকা চিৎকার করে বললো,”বললাম না লাগবে না? নিয়ে যাও এক্ষুনি।”
উচ্ছ্বাসের চিৎকারে কিছুটা ভয় পেয়ে যায় প্রিয়তা। কি হলো এতোটুকু সময়ের মধ্যে? মাত্রই তো কতো সুন্দর করে কথা বললো। আচ্ছা চা আনতে দেরি হয়েছে বলে কি এমন করছে?
প্রিয়তা মৃদু স্বরে বললো,”আসলে একটু দেরি হয়ে গেলো। ভেজা শাড়ি পালটে আসতে যেয়েই এমন দেরিটা হলো।”
উচ্ছ্বাস উঠে দাঁড়ায়। প্রিয়তার চোখের দিকে কড়া দৃষ্টিতে তাকায়। প্রিয়তা থতমত খেয়ে যায়।
“একদম আমার সামনে আসবে না তুমি। আমি মানুষটা ভালো না বুঝলে? আমি অত্যন্ত খারাপ একটা মানুষ। তোমরা অনেক ভালো একজন বাবার আদরের রাজকন্যা। তাই যতোদিন এই বাড়িতে আছি তুমি বা তোমার বোন কেউ আমার ছায়া মাড়াবে না, বোঝা গেছে?”
হাতের সিগারেটটা আবারও নিজের হাতের সাথে পিষে ফেলে উচ্ছ্বাস। প্রিয়তাকে একা রেখেই হনহন করে সিঁড়ি বেয়ে নেমে যায় সে।
হতভম্ব হয়ে চায়ের কাপ হাতে দাঁড়িয়ে থাকে প্রিয়তা। কিছুটা রাগ তারও হচ্ছে। শান্ত মানুষের রাগ ভয়ংকর।
চায়ের কাপ থেকে পুরোটা চা প্রিয়তা ছাদে ঢেলে দেয়। অসম্ভব রাগ হলে প্রিয়তার কান্না পায়। কিন্তু এখন সে ঠিক করেছে সে কাঁদবে না।
“কি ভাবে কি উনি নিজেকে? কোন দেশের রাজপুত্র হয়েছেন উনি? অসভ্য লোক একটা। কেনো বললেন আমাকে চা বানিয়ে আনতে? সস্তা ভেবেছেন আমাকে? আমি এতোটাই সস্তা হয়ে পড়েছি? আমার নামও প্রিয়তা। দেখি কতোদিন এই জিদ আপনার থাকে।”
চা ফেলেও শান্তি হয়না প্রিয়তার। ইচ্ছা করছে কাপটাই ছুড়ে ফেলে ভেঙে দিতে। কিন্তু না, তার বাবা তাদের শিখিয়েছে জিনিসপত্র ভেঙে রাগ কমানোর মধ্যে কোনো মাহাত্ম্য নেই। বরং চেষ্টা করতে হবে রাগ ভাঙানোর।
কবির শাহ সবসময় মেয়েদের বলেন,”একেকজনের রাগ ভাঙার উপায় একেকরকম। কেউ ব্লে’ড দিয়ে হাত-পা কেটে রাগ কমায়, কেউ জিনিসপত্র ভাঙচুর করে, আবার কেউ চিৎকার করে। তোমাকে খুঁজে বের করতে হবে তোমার রাগ কিসে কমে। তবে নিজেকে কষ্ট দিয়ে বা জিনিসপত্র নষ্ট করে রাগ কমানো ক্ষণস্থায়ী। তাই এমনভাবে রাগটা বশীকরণ করতে হবে যেনো সাপও না মরে, লাঠিও না ভাঙে।”
প্রিয়তার মাঝে মাঝে ভয়ানক রাগ ওঠে। ইচ্ছা হয় আশেপাশের সবকিছু ভেঙে ফেলতে। কিন্তু পরক্ষণেই তার বাবার কথা মনে পড়ে।
সে অনেকবার বাবাকে জিজ্ঞেস করেছে,”বাবা আর কি উপায়ে রাগ নিয়ন্ত্রণ করা যায়?”
কবির শাহ মুচকি হেসে বলেছেন,”তোমার রাগ কিসে কমে তা তোমাকেই খুঁজে বের করতে হবে।”
প্রিয়তা অনেক খুঁজে পেয়েছে, সে যদি উল্টো করে সংখ্যা পড়তে থাকে তাহলে কাজে দেয়।
চোখ বন্ধ করে রাগে কাঁপতে কাঁপতে প্রিয়তা পড়া শুরু করে,
নিরানব্বই, আটানব্বই, সাতানব্বই……
রাগ কমে না কোনোভাবেই। এতে কাজ হবে না। আজ সে ভীষণ রেগে গেছে বদরাগী ছেলেটার উপর। মাথায় ঠান্ডা পানি ঢালতে হবে, নাহলে শান্তি নেই।
ঘরে ঢুকতেই ভূত দেখার মতো চমকে উঠলো উচ্ছ্বাস। মার্জিয়া বেগম শান্তভাবে বসে আছে তার খাটের উপর। তার টেবিলে একটা ক্রিমি’নাল অফেন্সের বই। সেটাই উল্টেপাল্টে দেখছিলো মার্জিয়া বেগম।
উচ্ছ্বাসের শরীর ভেজা, চুলগুলো থেকে পানি পড়ছে টপটপ করে।
“তুমি এসেছো?”
মার্জিয়া বেগম ছোট্ট একটা হাসি দিয়ে তার দিকে তাকায়।
উচ্ছ্বাস যন্ত্রের মতো বললো,”মামি কিছু বলবেন?”
মার্জিয়া বেগম বইটা রেখে উঠে দাঁড়ায়।
“খুব বই পড়ো মনে হচ্ছে? তবে এসব কি খু নীদের গল্প পড়ো? শরৎচন্দ্র, বঙ্কিমচন্দ্র, রবি ঠাকুর উনাদের বই পড়বে। তোমাদের বয়সটাই তো ওসব পড়ার। এসব ছাঁইপাশ পড়ে কি হবে?”
উচ্ছ্বাস কিছুই বুঝতে পারেনা। এই ভদ্রমহিলা কখনোই তার সাথে এভাবে কথা বলেননি। সবসময় কটু কথা শুনিয়েছে, আজ হঠাৎ কি হলো?
“আপনি কি আমাকে কিছু বলতে চান মামি?”
“বলতে তো চাই। কিন্তু তুমি তো ভিজে চুপসে আছো একদম। মনে হয় খুব ভিজলে বৃষ্টিতে তাইনা?”
উচ্ছ্বাস উত্তর দেয়না।
“বেশ তুমি ভেজা কাপড় পালটে নাও, আমি বাইরে অপেক্ষা করছি। হয়ে গেলে আমাকে ডেকে নিও।”
উচ্ছ্বাস মৃদু হেসে বললো,”তার প্রয়োজন হবে না মামি। আমাদের এটুকুতে কিছু হয়না। আপনি কি বলতে চান বলতে পারেন।”
মার্জিয়া বেগম আবার হাসে। উচ্ছ্বাস অবাক হয়ে দেখে মা-মেয়ের হাসিতে কি মিল। দুইজনই হাসলে বাম গালে টোল পড়ে। পরক্ষণেই নিজের চিন্তায় নিজেই বিরক্ত হয়। কেনো সে বারবার ওই মেয়েটার চিন্তা করে? না চাইতেও মস্তিষ্ক কেনো ওই মুখশ্রীটা চোখের সামনে মেলে ধরে?
“এ ধরণের কথায় মেয়েরা খুব ভালো মুগ্ধ হয়ে যায় জানো? একদম বরশি গিলে ফেলার মতো।”
উচ্ছ্বাস ভ্রু কুঁচকে বললো,”আপনার কথা ঠিক বুঝলাম না মামি।”
“খুব সাধারণ ভাবেই বলছি। মেয়ে পটানো যায় দুই ভাবে। প্রথমত খুব মিষ্টি করে কথা বলে, সারাক্ষণ তার রূপের প্রশংসা করে। কিন্তু এই প্রক্রিয়ায় মেয়ে পটে যাওয়ার সম্ভাবনা অতোটাও বেশি নয়। দ্বিতীয় যে উপায়, তা হলো নিজেকে একটা শক্ত প্রাচীরের মধ্যে আবদ্ধ করার নাটক। মেয়েটা চাইলেও সেই প্রাচীরের মধ্যে ঢুকতে পারবে না। ছেলেটা এমন ভাব করবে যেনো সে মেয়েটাকে সহ্যই করতে পারছে না, কিংবা তাকে খেয়ালই করছে না। এই প্রক্রিয়াটা খুবই কার্যকরী। শতকরা নব্বই ভাগ মেয়ে বিশেষ করে কিশোরী বা তরুণীরা এতে পটে যায়। তারা সেই পুরুষটিকে মহাপুরুষ ধরণের কিছু ভেবে বসে। ফলে সহজেই মেয়েটা ছেলেটার প্রেমে হাবুডুবু খেতে থাকে। ছেলেটাও ফায়দা নিতে থাকে।”
উচ্ছ্বাস একরকম হতবাক হয়ে তাকিয়ে আছে মার্জিয়া বেগমের দিকে। প্রচন্ড বুদ্ধিমান উচ্ছ্বাস সহজেই বুঝে যায় মার্জিয়া বেগমের ইঙ্গিত। তবে কি সে তাকে দ্বিতীয় ক্যাটাগরির কেউ মনে করলো?
“কি ব্যাপার চুপ করে আছো যে?”
উচ্ছ্বাস দাঁতে দাঁত চেপে বললো,”কিছু বলার মতো ভাষা পাচ্ছিনা তাই চুপ করে আছি।”
মার্জিয়া বেগম হঠাৎ হাসি থামিয়ে চুপ করে যায়। কঠিন মুখে উচ্ছ্বাসের অনেকটা কাছে এসে তার চোখের দিকে তাকিয়ে বললো,”একটা কুমারী মেয়ের সাথে একা ছাদে বৃষ্টিতে ভিজতে লজ্জা করলো না একটুও?”
উচ্ছ্বাস হতবিহ্বল হয়ে মার্জিয়া বেগমের দিকে তাকায়। কোনো কথা সরে না মুখ দিয়ে তার।
“যখনই শুনলে ওর বিয়েটা ভেঙে গেছে, তখনই ছাদে একসাথে বৃষ্টিতে ভিজতে চলে গেলে তাইনা? বোকা মেয়েটাকে তো ভালোই নিজের আয়ত্তে নিয়েছো।”
উচ্ছ্বাস মার্জিয়া বেগমের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে বললো,”মামি এসব কি বলছেন আপনি? আপনি যা ভাবছেন তা না।”
মার্জিয়া বেগম হাত তুলে থামিয়ে দেয় উচ্ছ্বাসকে।
“চুপ করো, একদম চুপ। আর একটা কথাও তুমি বলবে না।”
“আমাকে সুযোগটা তো দিন কিছু বলার।”
“তোমার কোনো কথা শোনার মতো ইচ্ছা বা ধৈর্য্য আমার নেই। শুধু কিছু কথা বলতে এসেছি। চুপচাপ শুনবে। যতো তাড়াতাড়ি কথাগুলো মাথায় ঢুকিয়ে নিবে ততই তোমার জন্য মঙ্গলের।”
উচ্ছ্বাস বুঝতে পারে তার রাগের পারদ তরতর করে উঠে যাচ্ছে। নিজেকে সংযত করার চেষ্টা করে সে, কোনোভাবেই পারে না।
রাগে ছুটতে ছুটতে ঘরে ঢোকে প্রিয়তা। মুখ লাল টকটকে হয়ে আছে তার। ইচ্ছা করছে বাড়ি থেকে দূরে কোথাও যেয়ে ঘুরে আসতে। যদিও সে বুঝতে পারছে এতো রাগ করার কিছু হয়নি। সে তো মেনেই নিয়েছিলো ওই মানুষটার এমন নিষ্ঠুর ব্যবহার। তবে আজ কেনো এতো রাগ হচ্ছে তার?
তার একটাই কারণ, কেনো সন্ধ্যায় এতো ভালো ব্যবহার করলো সে তার সাথে? সে কি চেয়েছিলো এতো সহানুভূতি? কে বড় বড় লেকচার দিতে বলেছিলো তার মন খারাপের সময়? আবার চা খেতেও চাইলো প্রিয়তার হাতের। কিন্তু চা নিয়ে যাওয়ার পর আবার সেই কুৎসিত মানুষটা বেরিয়ে এলো তার ভিতর থেকে।
ঘরে ঢুকতেই বাবাকে দেখে একটু চমকে যায় প্রিয়তা। কবির শাহ হাসিমুখে তার দিকে তাকিয়ে আছে।
“বাবা তুমি এখানে?”
“কেনো রে আমি তোর ঘরে আসতে পারিনা বুঝি?”
প্রিয়তা ক্ষীণ গলায় বললো,”অবশ্যই পারো বাবা, একশ বার পারো।”
“তা তোর পড়াশোনা কেমন চলছে রে মা?”
“ভালো বাবা।”
প্রিয়তা মাথা নিচু করে দাঁড়ায়। সে বুঝতে পারে আস্তে আস্তে তার রাগ কমে যাচ্ছে। বাবা মানুষটাই এমন। তার সাথে দুই মিনিট কথা বললে রাগ কমতে বাধ্য।
কবির শাহ এগিয়ে এসে মেয়ের মাথায় হাত রাখে। পরম শান্তিতে চোখ বুঁজে প্রিয়তা। বাবাদের হাতে এতো কি প্রশান্তি থাকে যে মাথায় রাখলেই সব কষ্ট, রাগ উধাও হয়ে যায়?
“মা রে, তোদের দুই বোনকে নিয়ে আমার অনেক স্বপ্ন রে। পেখমের জন্মের পর সবাই বলেছিলো কবিরের তো ছেলে হলো না। কি হবে ওর স্বপ্নের? ও যে সন্তানদের অনেক বড় পর্যায়ে নিতে চায়, মানুষের মতো মানুষ করতে চায়। আমি তাদের দিকে তাকিয়ে শুধু হেসেছিলাম, কিচ্ছু বলিনি। আমি সেদিনই শপথ নিয়েছিলাম, আমার মেয়েদের আমি অনেক বড় করবো, মানুষের মতো মানুষ বানাবো। একটা ছেলেকে যে যে সুযোগ-সুবিধা দেওয়া যায়, আমি তোদের তাই দিবো। পড়াশোনা করে নিজের পায়ে দাঁড়াবি তোরা একদিন সেই স্বপ্ন দেখি আমি। কেউ যেনো বলতে না পারে, ওরা মেয়ে তাই পারেনি। তোদের আমি শীর্ষে ওঠার সেই সুযোগটা দিতে চেয়েছি আজীবন। আর আমি খুশি, তোদের পড়ার উপর ঝোঁকও আছে। সবসময় ভালো ফলাফল করেছিস তোরা দুই বোন। তাই তোদের উপর কোনো ঝড় আমি কখনো আসতে দিবো না। যে তোদের ডানা ছেঁটে দিতে চাইবে, সে যে-ই হোক আমি রুখে দাঁড়াবোই। আমার মেয়েদের ভালো থাকার সাথে আমি কোনো আপোষ করবো না।”
প্রিয়তার হঠাৎ কেমন কান্না পেয়ে যায়। বাবার কথাগুলো একদম তীরের ফলার মতো বুকে যেয়ে লাগে তার। তার বাবা তাদের কতোটা ভালোবাসে। তারা কি পারবে বাবার মুখ উজ্জ্বল করতে? ঠোঁট কামড়ে কান্না আটকানোর চেষ্টা করে প্রিয়তা।
“আমি যে চাইনা তুমি এখানে থাকো, তুমি তা ভালো করেই বুঝতে পারছো। মধ্যবিত্ত সংসারে হুট করে একজন আগন্তুক এসে উপস্থিত হলে যে কেউ-ই মেনে নিতে পারবে না। তাও আবার আপন কেউ নও তুমি। প্রিয়তার বাবার বেশ দু:সম্পর্কের আত্মীয় তুমি। আমি না চাইতেও শুধুমাত্র প্রিয়তার বাবার জন্য তুমি এখানে থাকতে পারছো। আমি তাও মেনে নিয়েছিলাম কোনোমতে। কিন্তু ঘটনা যখন আমার মেয়েদের নিয়ে তখন তো আমি চুপ থাকতে পারিনা। আমার ঘরে দুইটা প্রাপ্তবয়স্কা মেয়ে। আর তাদের বয়সটাও ভুল করার। যদি ধরেও নিই, তুমি ধোয়া তুলসীপাতা তবুও আমি দুশ্চিন্তা করবো। কারণ আমার মেয়েরা তো অবুঝ। ভুল করার বয়সে ভুল করবেই তারা আর এটাই স্বাভাবিক।”
উচ্ছ্বাস মার্জিয়া বেগমের দিকে তাকিয়ে জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেলতে থাকে। এসব কি ইঙ্গিত দিচ্ছেন উনি? এ কি কোনোদিনও সম্ভব?
“আসলে আমি সরাসরি কথা বলতে পছন্দ করি। আমি চাচ্ছিনা তুমি এখানে থাকো। মন থেকেই বলছি। বেশ কিছুদিনই তো হলো, এবার নিজের চিন্তাটা করো। যতোদূর জানি তুমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলে। তুমি মেধাবী, সেই সাথে বুদ্ধিমান। একটু চাইলেই ভালো একটা চাকরি পেয়ে যাবে। ততদিন পর্যন্ত তুমি এখানে থাকতে পারো। কিন্তু তাও খুব বেশিদিনের জন্য নয়। আর ততদিন আমার মেয়েদের থেকে শত হাত দূরে থাকবে তুমি। আমি চাইনা ওদের ছায়াটুকুও দেখো তুমি। ওরা নরম কাদার মতো এখন। ওদের যেভাবে গড়া হবে, ওরা সেভাবেই আকৃতি নিবে। আমি আমার মেয়েদের জীবন নষ্ট হতে দিবো না। তুমি প্রখর বুদ্ধিমান, তোমাকে নিশ্চয়ই এরচেয়ে বেশি কিছু বলতে হবে না।”
উচ্ছ্বাস শুন্যের দিকে তাকিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। এখানে সে আসতে চায়নি। ওর নিজেরও প্রাণের ঝুঁকি ছিলো। তাই তার দু:সম্পর্কের মামা, যাকে কিনা তার বাবা মা এক সময় অনেক সাহায্য করেছিলো, সে তাকে সবার আড়ালে তার বাড়িতে এনে তুলেছে। তার বাবা মায়ের মৃ ত্যুর আসলে কারণও বাড়ির কাউকে জানায়নি।
তবে এবার উচ্ছ্বাসের মনে হচ্ছে আর নয়। এবার এখান থেকে চলে যেতেই হবে। নিজেকে আর অপমানিত করতে চায়না সে। এমনিতেই এক আকাশ সমান কষ্টে তার বুকটা পরিপূর্ণ হয়ে আছে। নতুন করে আর কোনো কষ্ট সে নিজেকে দিতে চায়না।
“তুমি নিজের ঘরেই খাওয়া দাওয়া করবে। তোমার মামা ডাকতে এলেও টেবিলে যাওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। আমি তোমার খাবারটা এখানেই দিয়ে যাচ্ছি।”
মার্জিয়া বেগম চলে যেতে যেতে আবার পিছন ঘুরে তাকায়।
“আমার কথাগুলো মনে রাখবে। কোনোরকম যেনো নড়চড় না হয়। আমি রেগে গেলে অন্য মানুষ হয়ে যাই, হয়তো এখনো জানো না তুমি।”
উচ্ছ্বাসকে আর কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে মার্জিয়া বেগম বেরিয়ে যায় ঘর থেকে। উচ্ছ্বাস টালমাটাল পায়ে হেঁটে ধপ করে বিছানার উপর বসে পড়ে। অসহ্য যন্ত্রণা করছে মাথায়। ওই ঘটনার পর থেকে এমন মাথা যন্ত্রণা শুরু হয়েছে তার। যখন যন্ত্রণাটা বাড়ে সে হতবিহ্বল হয়ে যায়। মনে হয় কেউ বুঝি ধারালো করাত দিয়ে তার মাথার শিরাগুলো কেটে দিচ্ছে।
দুই হাতে চুল চেপে ধরে উচ্ছ্বাস বসে থাকে। লাল হয়ে যায় তার ফর্সামুখটা।
(চলবে…..)