তুমি_প্রেম_হলে_আমি_প্রেমিক পর্ব-৩০ এবং শেষ পর্ব

0
5

#তুমি_প্রেম_হলে_আমি_প্রেমিক

পর্ব: ৩০ (অন্তিম পর্ব)

মাঝরাতে কলিং বেলের আওয়াজ শুনে ভীষণ ভয় পেয়ে যায় মর্জিনা বেগম। সাধারণত এতো রাতে তার বাড়িতে কেউ আসেনা। মেয়েটা অনেকদিন যাবৎ বলছে জামাই নাকি তাকে খুব অত্যা’চার করছে ইদানীং, ও আর সহ্য করতে পারছে না। মর্জিনা বেগম কিছু বলতে পারেনি। তার স্বামী রফিকুলের কথা, মেয়ে বউ হয়ে ও বাড়িতে গেছে, যদি আসতে হয় মৃত লা’শ হয়ে আসতে হবে। মা হয়ে মেয়ের কষ্টে পাশে থাকতে না পারার যে কষ্ট মর্জিনা বেগম হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। অনুশোচনায় এতোটুকু হয়ে নিজের মধ্যে গুটিয়ে পড়ছে সে। আজ কবির শাহের মনে কতো আনন্দ, মার্জিয়ার মনেও অহংকার। আজ বাদে কাল তাদের মেয়ে ডাক্তার হবে। অথচ এককালে তাদেরই টাকা কম বলে কতোই না খোঁটা দিয়েছে সে। আজ তারা কম টাকার মধ্যেও অসম্ভব সুখী আর সে নিজে বিশাল বিত্ততার মাঝেও চরম অসুখী। পাপের শাস্তি বোধহয় একেই বলে।

মেয়ের বিপদের আশঙ্কায় বুকটা ধড়ফড় করে ওঠে তার। কোনো বিপদ হয়েছে ওর? খারাপ কিছু হয়েছে? পা দু’টো যেনো আর চলছে না দরজা পর্যন্ত। দরজা খুলে কি দেখবে সে? কি খবর শুনবে? আদৌ তার মেয়েটা বেঁচে আছে তো? নিজের ভাবনায় নিজেই শিউরে ওঠে মর্জিনা বেগম। আলুথালু পায়ে ছোটার চেষ্টা করে।

“তুমি এতো রাতে?”
সেতারা বাবার সামনে দাঁড়িয়ে আছে মাথা নিচু করে। ঈষৎ কাঁপছে সে একটু পর পর। বাচ্চা দু’টো কোলেই ঘুমিয়ে গেছে। তাদের সোফায় শুইয়ে দেয় সেতারা আস্তে করে।
“কি হলো কথা বলছো না কেনো? রাত বাজে আড়াইটা। এ সময়ের কোনো ভদ্র বাড়ির মেয়ে বা ভদ্র বাড়ির বউ রাস্তায় নামে?”
সেতারা এবার একটু হাসে, শব্দ করেই।
“এতো রাতে বুঝি ভদ্র বাড়ির ছেলে স্ত্রীকে মেরে লা’শ বানিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করে বাবা?”
সেতারা মুখ তুলে তাকায়। সাথে সাথেই শিউরে ওঠে মর্জিনা বেগম। মেয়ের কপাল চুঁইয়ে র’ক্ত পড়ছে, সারা মুখে অসংখ্য দাগ। কে বলবে এই সেই চাপা ফুলের মতো রূপবতী মেয়েটা তার? এ কি অবস্থা হয়েছে ওর?
হাহাকার করতে করতে মর্জিনা ছুটে যায় মেয়ের কাছে। সেতারার মাথাটা বুকে চেপে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে দেয় সে।
“মা রে এ কি হয়ে গেলো তোর? আমাকে ক্ষমা করে দে মা, আমি তোর ব্যর্থ মা। অপদার্থ আমি কিচ্ছু করতে পারলাম না তোর জন্য। নিজেও ভালো ভাবে পড়াশোনা করলাম না, তোকেও করাতে পারলাম না। মা হয়ে আমি মেয়ের জীবন নষ্ট করে দিলাম। আমাকে তুই শাস্তি দে মা, ভয়ংকর শাস্তি দে।”
সেতারা ম্লান হেসে বললো,”শাস্তি তো তুমি পেয়েছো মা। ছোট খালাকে তুমি বলতে সবসময়, মেয়ে যখন গাড়ি থেকে নেমে এসে জড়িয়ে ধরবে, লক্ষ লক্ষ টাকার সোনার গহনা গায়ে থাকবে সেদিন বুঝবি সুখ কাকে বলে। মা দেখো, আজ আমিও গাড়িতে এসেছি। আমাকে তাড়ানোর জন্য ওদের এতো ব্যস্ততা ছিলো যে, এতো রাতে কোনো গাড়ি পাবো না রাস্তায় তাই নিজেদের গাড়িটাই দিয়ে দিয়েছে আসার জন্য। সকাল পর্যন্ত অপেক্ষাও করতে দেয়নি। দেখো মা, আমার শরীরে এখনো দামী শাড়ি, গহনা। এগুলো কিচ্ছু রেখে দেয়নি ওরা। এদিক থেকে ওরা অনেক ভালো মা। আমাকে তাড়ানোর ব্যস্ততায় এগুলো নেওয়ার সময় পায়নি আমার কাছ থেকে। এইযে আমি গাড়ি থেকে নেমে এসে জড়িয়ে ধরলাম তোমাকে। তোমার সুখ হচ্ছে না মা? শান্তি পাচ্ছো না?”
মর্জিনা বেগম উত্তর দেয়না। সেতারার একটা কথাও তো মিথ্যা না। আসলেই সে এগুলো করেছে, বলেছে। কিন্তু সে এই মুহুর্তে বুঝতে পারছে একটা অসহায় মায়ের কাছে এ দৃশ্য কতোটা কষ্টের, কতোটা যন্ত্রণার। নিজেকে এই সময় পৃথিবীর সবচেয়ে দু:খী মানুষটা মনে হচ্ছে।

রফিকুল বিরক্ত হয়ে এসব দেখছিলো এতোক্ষণ। পাশে তাকাতেই দেখে বিশাল এক স্যুটকেস সেতারার পায়ের কাছে।
রফিকুল ভ্রু কুঁচকে বললো,”তুমি কি অনেকদিন থাকবে ভাবছো?”
মর্জিনা হতবাক হয়ে বললো,”ও কি বললো তুমি শুনতে পাও নি? ওর অবস্থা দেখতে পারছো না? মেরে তোমার মেয়েটাকে আধমরা বানিয়ে দিয়েছে পাষণ্ডগুলো। দূর দূর করে তাড়িয়ে দিয়েছে বাড়ি থেকে। এরপরও তুমি বাবা হয়ে কীভাবে বলছো এই কথা?”
“আমি এতো কিছু জানিনা। অনেক টাকা খরচ করে বড় বাড়িতে মেয়ের বিয়ে দিয়েছি। সংসার জীবনে অনেক কিছুই হয় স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে। তার জন্য সংসার ছাড়তে হবে এমন তো কোনো কথা নেই। তাছাড়া এখন বাচ্চা আছে ওর দু’টো। এই অবস্থায় ফিরে আসলে মানুষ কি বলবে? কোন সোসাইটির সাথে আমার ওঠাবসা তুমি জানো না?”
মর্জিনা বেগম যেনো অবাক হওয়ার মাত্রাও ছাড়িয়ে গেছে। কথা বের হচ্ছে না মুখ দিয়ে তার। শ্বাসকষ্ট হতে থাকে তার।
“তুমি কি ওর নিজের বাবা? নিজের সোসাইটির কথা ভাবছো, মানুষ কি বলবে ভাবছো। একটাবার নিজের মেয়ের কথা ভাবছো না?”
“তোমার সাথে আমার ঝামেলা হয়নি? তার জন্য তুমি কি চলে গেছো? ঠিকই মাটি কামড়ে এ বাড়িতে পড়ে আছো। তাহলে ওর ওখানে থাকতে সমস্যা কি? ওটা ওর নিজের বাড়ি, ওখানেই ওর ঘর-সংসার।”
“আমি যেতে পারিনি কারণ আমাকে আশ্রয় দেওয়ার মতো কেউ ছিলোনা। একটা ছোট বোন, আমি গেলে মাথায় করে রাখে। কিন্তু তাদেরই আর্থিক কষ্ট, আমি যেয়ে কীভাবে থাকি? কিন্তু সেতারা? ওর তো মাথা গোঁজার ঠাঁই আছে। শুধু ঠাঁই বলছি কেনো, শিল্পপতি রফিকুল চৌধুরীর একমাত্র মেয়ে সে। কোনোকিছুরই অভাব নেই। সে কেনো স্বামীর সংসারে অত্যাচারিত হয়েও সেখানে পড়ে থাকবে? আমি মা হয়ে এটা কোনোভাবেই মানবো না।”
“তুমি মানতে পারবে কি পারবে না আমি জানতে চাইনা। না মানতে পারলে দরজা খোলা আছে। তোমাকে কোনোদিন আটকে রাখিনি আমি, আজও রাখবো না।”
মর্জিনা কিছু বলতে যাবে তার আগেই সেতারা চিৎকার করে তাকে থামায়।
“মা অনেক হয়েছে, এবার তোমরা থামো। এতোক্ষণ তোমরা বলেছো আমি শুনেছি। এবার আমি বলবো তোমরা শুনবে। কেউ একটা কথাও বলবে না।”
রফিকুল অবাক হয়ে তাকায়। মেয়ে তো এভাবে চিৎকার করে কথা বলার সাহস পায়নি আগে, এখন কীভাবে এ সাহস পেলো? কে দিচ্ছে তাকে এই সাহস?
সেতারা ধীর পায়ে হেঁটে রফিকুলের সামনে এসে দাঁড়ায়। মুচকি হাসে বাবার দিকে তাকিয়ে।

“মা কি যেনো বলছিলে তুমি? আমি বাবার একমাত্র মেয়ে? কেনো মা তুমি জানো না, বাবার রক্ষি’তার ঘরে যে আরো দুইটা সন্তান আছে? যাদের দায়িত্ব বাবার উপর, শুধু সমাজে তাদের স্বীকৃতি দিতে পারেনা?”
রফিকুল চিৎকার করে সেতারার দিকে রক্তচক্ষু দিয়ে তাকিয়ে হাত ওঠাতে যায়। সেতারা শান্ত চোখে তাকায় বাবার দিকে। কিন্তু সেই শান্ত চোখেও এমন কিছু ছিলো রফিকুল থমকে যায়। মর্জিনা বেগম মুখে আঁচল চাপা দিয়ে ডুকরে কেঁদে ওঠে।
“কি হলো বাবা থামলে যে? সত্য সবসময় তিতা হয় বাবা। তিতা কথা কেউ হজম করতে পারেনা।”
রফিকুল রাগে থরথর করে কাঁপতে থাকে৷
“শোনো বাবা, আমি তোমার এই সুবিশাল অট্টালিকায় থাকতে আসিনি। সাথে আনা ব্যাগ দেখে এতো ভয়ে পেয়ো না। তোমার সোসাইটি কিচ্ছু জানবে না। এতো বড় ঘটনা যখন তুমি চাপা দিতে পেরেছো, এই সামান্য ঘটনাও পারবে।”
মর্জিনা মেয়ের বাহু ধরে ঝাঁকি দিয়ে বললো,”এখানে থাকবি না তো কোথায় যাবি? ওই নরকের মধ্যে তোকে আর যেতে দিবো না আমি।”
“মা কে বললো আমি ও বাড়িতে ফিরে যাবো? আমি ওখান থেকে বের হয়েছি ফিরে যাওয়ার জন্য না।”
“তাহলে কোথায় যাবি তুই? কি বলছিস এসব?”
রফিকুল রাগে কাঁপতে কাঁপতে বললো,”নিজেকে বিক্রি করবে তুমি এখন?”
মর্জিনা রাগান্বিত হয়ে কিছু বলতে গেলেই সেতারা আবার থামায় দেয় তাকে। সে ভীষণ শান্ত, শীতল হয়ে আছে আজ।
“বলতে দাও মা। যার চরিত্র যেমন, সে অন্যকে তেমনই ভাববে। বাবাদের কতো রূপ হয়। উনাকে না দেখলে বুঝতেই পারতাম না। ছোট খালুও পুরুষ, উনিও পুরুষ। অথচ দুইজনের মধ্যে কতো যোজন যোজন ফারাক। এক লেখকের লেখায় পড়েছিলাম, পৃথিবীতে অসংখ্য খারাপ মানুষ আছে কিন্তু একটাও খারাপ বাবা নেই। কিন্তু না, সেই লেখা ভুল। আমি নিজের জীবন দিয়ে বুঝতে পারছি সেই লেখায় চরম ভুল। এই দুনিয়ায় অসংখ্য খারাপ বাবা-ও আছে। তার মধ্যে এইযে উনি একজন।”
সেতারা থামে। রফিকুল থমথমে মুখে দাঁড়িয়ে থাকে। তার মতো বিশাল শিল্পপতির সঙ্গে কিনা একজন সাধারণ স্কুল শিক্ষকের তুলনা করা হচ্ছে? এটাও তাকে সহ্য করতে হবে?

“তোমাকে আমার বাবা বলে স্বীকার করতেও ঘৃণা হচ্ছে বাবা।”
“দয়া করে স্বীকার করোনা। যাও তোমার অতি প্রিয় খালু, কবির শাহ-কে বাবা বলে স্বীকার করো।”
“যদি সেইটা পারতাম না বাবা? তাহলে আমি পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষটা হতাম। সত্যিই যদি প্রিয়তা আর পেখমের মতো আমিও ওরকম একটা বটবৃক্ষের ছায়ায় নিজেকে আশ্রয় দিতে পারতাম, আমার আর কিচ্ছু চাওয়ার থাকতো না বাবা। কিন্তু ভাগ্য আমার সহায় ছিলোনা। বাবা, তুমি ভীষণ গরীব জানো তো? তোমার কাছে টাকা ছাড়া আর কিছুই নেই।”
রফিকুল উত্তর দেয়না। চরম অপমানিত বোধ করতে থাকে।

মর্জিনা আবারও সেতারার হাত ধরে এসে।
“তুই একটু বোস মা, কীভাবে র’ক্ত পড়ছে কপাল থেকে। একটু ওষুধ লাগিয়ে দিই। কিছু তো মনে হয় খাওয়াও হয়নি, কিছু খাইয়ে দিই আমি?”
“না মা, এখানে বসতে বা খেতে আসিনি আমি। তোমরা আমার বাবা মা। আমার দায়িত্ব তোমাদের জানানো তাই জানাতে এসেছি। আমি একটা চাকরি পেয়েছি মা।”
মর্জিনা বেগম হতভম্ব হয়ে যায়, অবাক হয় রফিকুলও। সেতারার পড়াশোনা বেশি না, ও কীভাবে চাকরি পাবে?
“তুই চাকরি পেয়েছিস মানে?”
“হ্যা মা, আমি একটা কিন্ডারগার্টেন স্কুলে শিক্ষকতার চাকরি পেয়েছি। চাকরিটা আমাকে ছোট খালু ব্যবস্থা করে দিয়েছে। সেই সাথে কিছু বাচ্চাদের টিউশনেরও ব্যবস্থা করে দিয়েছে উনি।”
“কবির তোকে চাকরি খুঁজে দিয়েছে?”
“হ্যা মা। আমি-ই উনাকে কাউকে কিছু বলতে মানা করেছিলাম। আমি অনেক আগে থেকেই উনার সাথে যোগাযোগ করছি। ওখানে থাকা আমার জন্য অসম্ভব হয়ে উঠছিলো দিনদিন। আমি একটা সাবলেট বাসাও খুঁজেছি। খালু-ই সব ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। জানো মা, আমি আবারও পড়াশোনা শুরু করবো। খালু আমাকে কলেজে ভর্তি করিয়ে দিবে বলেছে। একটু কষ্ট হবে মা, অনেকদিন পড়াশোনা থেকে দূরে আছি। তবে মা আমি পারবো জানো তো? খালু সব রকম সাহায্য করবেন আমাকে।”
রফিকুল আর চুপ থাকতে পারেনা। উন্মাদের মতো চেচিয়ে বললো,”নিজের মেয়েদের ন’ষ্টামি শিখিয়ে ক্ষান্ত হয়নি অসভ্যটা? এখন আমার মেয়ের পিছে পড়ে তার সংসার ভাঙার পায়তারা করছে? ওকে আমি দেখে নিবো।”
সেতারা ম্লান হেসে বললো,”কেউ আমার সংসার ভাঙার পায়তারা করেনি বাবা। যে সংসারটা ভাঙাই ছিলো, তা অন্য কেউ কীভাবে আবার ভাঙবে? খালু তার মেয়েদের কোনো ন’ষ্টামি শেখায়নি, বরং এই সমাজে অন্যায়ের সাথে আপোষ না করে মাথা উঁচু বাঁচতে শিখিয়েছে। আমি খুব গর্ববোধ করছি আমি দেরিতে হলেও তার সান্নিধ্যে যেতে পেরেছি। আর কি বললে বাবা, তোমার মেয়ে? যে বাবা মেয়েকে জোর করে নরকে ঠেলে দেয়, নোংরা কথা বলতে দুইবার ভাবে না, সে বাবা? বাবা তুমি আমার?”
রফিকুল মাথা নিচু করে জোরে জোরে তপ্ত শ্বাস ফেলতে থাকে।
মর্জিনা স্তম্ভিত হয়ে মেয়ের দিকে তাকিয়ে আছে। এ কি তার সেই শান্ত মেয়েটা? সত্যি সে নতুন করে সব শুরু করতে যাচ্ছে? সত্যি এমন কিছু হবে?

“আমি যাচ্ছি মা। বেঁচে থাকলে আবার দেখা হবে। তবে ওই মানুষটার সাথে যেনো আর দেখা না হয়। এই চাওয়া টুকু সৃষ্টিকর্তা যেনো পূরণ করেন আমার।”
রফিকুল চিৎকার করে বললো,”যাও যাও, বাইরে যেয়ে দেখো জীবন কেমন। সবকিছু এতো সহজ না। যখন বিপদে পড়বে, কোনো মামা কোনো খালু বাঁচাতে আসবে না।”
সেতারা স্মিত হেসে বললো,”সমুদ্রে পেতেছি শয্যা, শিশিরে কি ভয়? আমাকে নাহয় বিপদে পড়েই শিখতে দাও বাবা। তবে ভয় নেই, বিপদে পড়ে তোমার কাছে আর ফিরে আসবো না।”
অপমানে জর্জরিত মুখে রফিকুল মেয়ের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।

সেতারা বাচ্চাদের কোলে তুলে নেয়। ব্যাগটাও হাতে নেয়। মর্জিনা বেগম অবাক হয়ে এক যোদ্ধাকে দেখে। যে সন্তানের জন্য, নিজের জন্য ভয়াবহ এক যুদ্ধে নেমেছে।
“আসি মা।”
মর্জিনার দিকে তাকিয়ে একটা সুন্দর হাসি দেয় সেতারা। কি ভীষণ স্নিগ্ধ লাগছে এখন মেয়েটাকে তার।
সেতারা দরজা পর্যন্ত যেতেই মর্জিনা পিছন থেকে ডাক দেয়।
“সেতারা একটু দাঁড়া।”
সেতারা দাঁড়ায়।
“আমিও যাবো তোর সাথে।”
সেতারা অবাক হয়ে মায়ের দিকে তাকায়। রফিকুল হতভম্ব হয়ে বললো,”তুমি যাবে মানে? তুমি কোথায় যাবে?”
“যে মেয়েকে গর্ভে ধারণ করে আমি মাতৃত্বের স্বাদ পেয়েছি, যে মেয়ের মুখে মা ডাক শুনে আমি পৃথিবীর সব সুখ পেয়েছি, তাকে একা ছেড়ে দিবো না আমি। আমাকে এখন দরকার ওর পাশে৷ ওর যুদ্ধে ওর মা ওর পাশে থাকবে।”
সেতারার দুই গাল বেয়ে ঝরঝর করে পানি পড়তে থাকে। এতোক্ষণ শক্ত থাকতে পারলেও এখন আর পারেনা।
“মা……”
“যে কাজটা আমার আরো কয়েক বছর আগে করা উচিত ছিলো সেই কাজটা আমি আজ করবো। বেটার লেট দ্যান নেভার, তাইনা?”
রফিকুল দাঁতে দাঁত চেপে বললো,”চলচ্চিত্র চলছে? পূর্ণদৈর্ঘ্য বাংলা ছায়াছবি? একবার এই বাড়ি থেকে বের হলে তোমার আর তোমার মেয়ের জন্য এই বাড়ির দরজা বন্ধ, আর কোনোদিন খুলবে না।”
“একটা দরজা বন্ধ হলে হাজারটা দরজা খুলবে। তোমাকে ভাবতে হবে না। তুমি চাইলেও আমি আর আসবো না এ বাড়িতে।”
“কবির শাহের বাতাস লেগেছে মা-মেয়ের গায়ে? বুঝবে একদিন, টাকা না থাকলে দুনিয়া অন্ধকার।”
“অন্ধকারের পরেই আলো আসে।”
মর্জিনা এগিয়ে এসে সেতারার হাত থেকে একটা বাচ্চাকে নিজের কোলে তুলে নেয়।
“চল মা।”
“মা তোমার কষ্ট হবে, তুমি পারবে না।”
“মেয়েকে কষ্টে রেখে আমি খুব আরামে থাকবো এখানে তাইনা? ব্যর্থ মা হিসেবে কম তো অনুশোচনায় পুড়িনি। আজ নাহয় তার প্রায়শ্চিত্ত করবো। আমাদের দুইজনের মধ্যেই অসম্ভব মিল আছে রে মা, আমরা দুইজনই আজ থেকে যোদ্ধা মা। চল যাওয়া যাক।”
হতভম্ব রফিকুলকে পিছনে রেখে দুই মা হাত ধরাধরি করে বেরিয়ে পড়ে রাস্তায়। রাতের ফাঁকা রাস্তাটা আজ অসম্ভব সুন্দর লাগছে। চাঁদের আলো যেনো ঠিকরে পড়ছে। সেতারা তাকায় মায়ের দিকে। মা’কে এতো সুন্দর লাগছে কেনো আজ হঠাৎ? ছায়াটা কি দীর্ঘ পড়েছে মায়ের। মনে হচ্ছে এই ছায়াতলেই সে আজীবন শান্তিতে থাকতে পারবে। তার মা তার পাশে আছে, আর কি ভয়?

মাছ কাটছে আর ঘন ঘন চোখের পানি মুছছে মার্জিয়া। চোখটা বারবার ঝাপসা হয়ে উঠছে তার। ভালো করে কাটতেই পারছে না মাছটা। ইচ্ছা করছে কিশোরীদের মতো ভেউ ভেউ করে কাঁদতে, কিন্তু পারছে না। আজ যে তার কোথায় এমন সুখ হচ্ছে সে বোঝাতে পারছে না। এতো আনন্দ কেনো তার এই ছোট্ট ঘরটায়? এই ঘর ছেড়ে, এই ভালোবাসার সংসার ছেড়ে, এই মায়ার দুনিয়া ছেড়ে একদিন চলে যেতে হবে একা এটা ভাবতেই কান্না আটকাতে পারছে না সে।

“চোখের পানে চাহিনু অনিমেষ, বাজিলো বুকে সুখের মতো ব্যথা।”
কবির শাহের গলার আওয়াজ পেয়ে কোনোরকমে চোখ মোছে মার্জিয়া, মাছ কাটতে মন দেয়।
কবির শাহ একটা পিঁড়ি টেনে মার্জিয়ার সামনে বসে। তার স্ত্রীকে চন্দ্রের মতো সুন্দর লাগছে। ফোলা চোখ, হালকা লাল আভা সারামুখ জুড়ে, পরনে সাধারণ সুতি শাড়ি। তাতেই কোনো নারীকে এমন অসামান্য সুন্দরী লাগতে পারে, মার্জিয়াকে না দেখলে কবির শাহ হয়তো বুঝতেই পারতো না।
“কি হলো এখানে এসে বসলে যে?”
“আমার বউটা একা একা কষ্ট করবে, আমি ঘরে আরাম করবো?”
মার্জিয়া লজ্জায় লাল হয়ে বললো,”আজ বাদে কাল মেয়ের বিয়ে হবে, আর তোমার ঢংঢাং কমেনা।”
“কমলে তুমি খুশি হবে?”
“এই তুমি যাও তো, আমাকে আমার কাজ করতে দাও।”
“মার্জিয়া আমার এখন মিষ্টির দোকানে যেতে ইচ্ছা করছে। শহরের সমস্ত মিষ্টি কিনে নিয়ে আসতে ইচ্ছা করছে। একটা মিষ্টির দোকানও যেনো বাদ না যায়। আজ আমার এতো আনন্দ হচ্ছে যে নিজেকে সামলাতে পারছিনা।”
“হ্যা এতো রাতে মিষ্টির দোকানদারদের তো আর খেয়েদেয়ে কাজ নেই। তোমার জন্য দোকান খুলে বসে থাকবে।”
“থাকবে মার্জিয়া থাকবে। কারণ আজ এক পাগলাটে বর আর স্নেহময় বাবা তার পরিবারের জন্য মিষ্টি কিনবে। প্রকৃতিই ব্যবস্থা করে দিবে মার্জিয়া।”
“রক্ষা করো, আর জ্বালাতন করোনা আমাকে। একে তো তোমার ভাগ্নে এতো বছর পর এই রাতে কোথা থেকে মাছ নিয়ে উদয় হলো, কথা নেই বার্তা নেই মামি মাছ ভাজেন। যতোসব পাগল নিয়ে আমার সংসার।”
কবির শাহ গভীর মমতায় মার্জিয়ার দিকে তাকায়। মার্জিয়া মুখে বললো ঠিকই, কিন্তু এটুকু বলতে তার চোখেমুখে যে আনন্দটুকু বয়ে গেলো, তাতে মনে হচ্ছে সে এই পাগলদের পাগলামি দেখে বাকি জীবন অনায়াসে কাটিয়ে দিতে পারবে, আর কিচ্ছু লাগবে না।

“মার্জিয়া।”
“বলো।”
“তোমার আজ কেমন লাগছে?”
“কীভাবে বুঝাই?”
“যেভাবে ইচ্ছা হয় বুঝাও, বুঝে নেওয়ার দায়িত্ব আমার।”
“আমি আজ এতোটাই খুশি যে, আমি যদি কোনোদিন বেহেশতে যাই আর আল্লাহপাক আমাকে যদি জিজ্ঞেস করেন, মার্জিয়া তোর কি লাগবে? আমি বলবো, পৃথিবীতে আজকের মতো একটা রাত যেনো আমি ওখানে পাই, প্রতিনিয়ত পাই। কারণ এরচেয়ে সুখের রাত আমার জীবনে আর কোনোদিন আসেনি। মনে হচ্ছে ঘড়ির কাঁটা যদি থামিয়ে দিয়ে, সময়টা মুঠোবন্দি করতে পারতাম তাহলে কতোই না ভালো হতো। আমার স্বামীর মুখে আনন্দের ছাপ, মেয়ের মুখে পরিতৃপ্তি আর শান্তির বৃষ্টির ধারা আমার আর কি চাই বলো? এক জীবনে একজন নারীর আর কি চাওয়ার থাকতে পারে?”
মার্জিয়া শব্দ করে কেঁদে দেয়। কবির শাহ তাকে থামায় না, কাঁদতে দেয়।
আচমকাই মার্জিয়ার মাথাটা বুকের সাথে চেপে ধরে আলতো করে।
“কি করছো? তোমার গায়ে ময়লা লেগে যাবে তো, মাছ কাটছি।”
“লাগবে না, কিচ্ছু হবেনা। এ শরীর অপবিত্র হলে তুমি আবার পবিত্র করে দিও।”
মার্জিয়া কান্নার মাঝেই মুখ টিপে হাসে।
“আচ্ছা তুমি বললে না তো, তোমার কেমন লাগছে।”
“আমার? আমি যদি বলি পৃথিবীর সব সুখ একদিকে, আর আজকের এই রাতটার সুখ একদিকে। তুমি কি বিশ্বাস করবে?”
“তোমাকে তো অবিশ্বাস করিনি কখনো।”
“সে সুযোগও তোমাকে কখনো দিবো না।”

“ওমা, তোমার হলো? ইলিশ মাছের গন্ধে তো খিদে পেয়ে গেলো আবার। এখনই ভাজা না হলে কিন্তু কাঁচাই খেয়ে নিবো।”
বলতে বলতে রান্নাঘরে ঢুকতেই চমকে ওঠে পেখম। বাবা মায়ের মাথাটা বুকে চেপে কান্নাকাটি করে যাচ্ছে দুইজন মিলে। পেখমকে দেখেই মার্জিয়া লজ্জা পেয়ে ঝট করে মাথা তুলে নেয়। তাড়াতাড়ি হাত চালায় আবার মাছ কাটতে।

“এ বাবা, এসব কি হচ্ছে চারদিকে? আর তো পারা গেলো না।”
মার্জিয়া ঝাঁঝিয়ে উঠে বললো,”কি হয়েছে তোর?”
“চারদিকে প্রেমের গন্ধ, শুধু আমার সর্দিতে নাক বন্ধ।”
মার্জিয়া কপট রেগে কবির শাহের দিকে তাকিয়ে বললো,”দেখলে তুমি, মেয়েটা কেমন দুষ্টু হয়েছে। বাবা মায়ের সাথেও ফাজলামি।”
কবির শাহ মেয়ের কথায় খুব মজা পায়, হা হা করে হাসতে থাকে।
“আয় মা এদিকে আয়, আমার পাশে এসে বোস।”
পেখম বাবার পাশে আরেকটা পিঁড়ি টেনে বসে।
“শোনো মার্জিয়া, সন্তান বড় হলে বাবা মায়ের বন্ধু হয়ে যায়।”
মার্জিয়া মুচকি হাসে, কিছু বলেনা।
“বাবা আমার এসব সহ্য হচ্ছেনা। সবাই প্রেমে ব্যস্ত, এদিকে আমার যে কেউ নেই, আমার যে এসব সহ্য হচ্ছেনা সেদিকে তোমাদের কোনো খেয়ালই নেই।”
“এই পেখম বাবার সামনে এসব কি কথা?”
কবির শাহ রাগ করেনা, বরং আরো মজা পায় মেয়ের কথায়। মেয়ের মাথাটা কোলের উপর রাখে নিজের। মেয়েগুলো এতো বড় হয়ে যাচ্ছে কেনো? আহা! তার কি সাধের দুই কন্যা, তার দুই রাজকুমারী। এ সুখের বাড়ি কোথায়?

চিলেকোঠার দেয়ালে হেলান দিয়ে দুই হাত বুকে বেঁধে উচ্ছ্বাস একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে প্রিয়তার দিকে। প্রিয়তার ঠোঁটটা কেমন নীলচে হয়ে গেছে, একটু পর পর তিরতির করে কাঁপছে ঠোঁট জোড়া। এখনো সে ধাতস্থ হতে পারেনি। অসম্ভব লজ্জা লাগছে তার। ঠিকমতো তাকাতে পারছে না উচ্ছ্বাসের দিকে। সে নিজেও বুঝতে পারছে না এতো লজ্জা লাগছে কেনো। অবশ্য পাঁচটা বছর তো কম সময় না। কৈশোর পেরিয়ে সদ্য যৌবনে পা দেওয়া মেয়েরা যেনো গোলাপের কুঁড়ি থেকে মাত্রই পাপড়ি মেলা শুরু করে। এই সময় তাদের রূপ বহুগুণে বেড়ে যায়। উচ্ছ্বাস একরাশ অপার মুগ্ধতা নিয়ে তাকিয়ে আছে প্রিয়তার দিকে, কোনোভাবে পলক ফেলতে পারছে না। শুক্লপক্ষের চাঁদ উঠেছে, রূপোর মতো জ্যোৎস্না থইথই করছে ছাদে। সেই আলোর একাংশ এসে পড়েছে প্রিয়তার চোখেমুখে। তার ভেজা-ভেজা গালটা চকচক করছে সেই আলোয়। মৃদু বাতাসে কোমর সমান লম্বা চুলগুলো ঈষৎ উড়ছে। উচ্ছ্বাসের মনে হচ্ছে স্বপ্নের কাছাকাছি কোনো জগতে বাস করছে সে। এটা কোনো ভাবে বাস্তব জীবন হতে পারেনা।

“প্রিয়তা।”
প্রিয়তা মৃদু কেঁপে ওঠে, তবুও তাকায় না উচ্ছ্বাসের দিকে।
“আমার দিকে তাকাও, অন্য দিকে তাকিয়ে আছো কেনো? ওদিকে তোমার কোনো প্রেমিক নেই।”
প্রিয়তা উত্তর দেয়না তবুও। জোরে জোরে শ্বাস ফেলতে থাকে।

“আমার বিরানভূমিতে তোমার কোমল ছোঁয়া,
জাগ্রত করেছে কোলাহল।
তোমার পবিত্র চোখের চাহনি ভুলিয়ে দেয় আমার কষ্টকে।
আমি অস্তিত্বে আছো শুধুই তুমি।
আমার অস্তিত্ব জুড়ে ওই জলপরীর অবাধ বিচরণ, আমি চাইলেও দূরে থাকতে পারলাম না।”
উচ্ছ্বাসের গমগমে আওয়াজ শুনে প্রিয়তা পূর্ণ দৃষ্টি মেলে উচ্ছ্বাসের দিকে তাকায়। এই মানুষটাকে এতো সুন্দর লাগছে কেনো? একটা পুরুষ এতো সুন্দর হবে কেনো? জ্বলজ্বল করছে যেনো মুখাবয়বটা। শক্ত প্রাচীরের মতো চোয়ালের মাঝে পুরু ওষ্ঠদ্বয়ের কোণে ফিনকি হাসিটা এতো নজরকাড়াই বা হতে হবে কেনো?

“তাহলে চেয়েছিলেন দূরে থাকতে?”
উচ্ছ্বাস বুকের বাঁ পাশে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে।
“ইশ এতো বছর পর শুকনো মরুভূমিতে প্রবল বর্ষণের আনাগোনা শুরু হলো। খাঁ খাঁ করছিলো যেনো বুকটা। আপনার কণ্ঠের সুধা পেয়ে অমৃত পেলো যেনো হৃদয়টা।”
“জীবনটা এতো কাব্যিক না উচ্ছ্বাস ভাই। আপনি কীভাবে পারলেন? মানুষ আপনি?”
“মানুষ বলেই তো অপেক্ষা করছি সর্বোচ্চ ভালোবাসার জন্য। আর কোনো প্রাণী হলে তো অপেক্ষাটুকুও করতাম না……”
উচ্ছ্বাসের ইঙ্গিত বুঝতে পেরে লজ্জায় লাল হয়ে যায় প্রিয়তা। মুখ টিপে হাসে উচ্ছ্বাস।

আচমকা প্রিয়তা একের পর এক ঘুষি দিতে দিতে থাকে উচ্ছ্বাসের বুকে। পাঁচ বছরের সকল রাগ যেনো আজকেই উপড়ে ফেলবে সে। কোনোভাবেই থামে না রাগ। ঘটনার আকস্মিকতায় কিছুটা হকচকিয়ে গেলেও উচ্ছ্বাস কিছু বলেনা। শান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, একটাবারও থামায় না প্রিয়তাকে।

বেশ কিছুক্ষণ এভাবে যাওয়ার পর প্রিয়তা থামে। হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে হাত মুষ্টিবদ্ধ করে। এতোদিন যতো কষ্ট, যতো রাগ, যতো অভিমান জমা ছিলো ভিতরে সব বের করে দিবে, সব।
“ক্লান্ত হয়ে গেলে এতোটুকুতেই? আমি তো আরো সহ্য করার জন্য প্রস্তুত ছিলাম।”
“জীবনটা কোনো নাটকের অংশ না উচ্ছ্বাস ভাই। জীবন সরলরেখায় চলেনা, কেনো এতো হেলাফেলা করেন সেই জীবনটা নিয়ে?”
“ভীষণ এলোমেলো আমি-কে তুমি নাহয় গুছিয়ে নিও নিজের মতো করে। সব দায়িত্ব দিয়ে দিবো তোমাকে।”
“আমি সত্যিই বোকা ছিলাম। আপনি আমাকে মাথামোটা বলতেন না? একদম ঠিক বলতেন। আর বোকা ছিলাম বলেই এতো অপেক্ষার পরেও পাগলের মতো ভালোবেসেছি আপনাকে, কোনোদিন অন্য কিছু ভাবিনি।”
“তোমাকে অন্য কিছু ভাবতে দিতামও না নন্দিনী। আমি তোমার চারপাশে একটা অদৃশ্য প্রাচীর বানিয়ে রেখেছিলাম, তুমি টেরও পাওনি। তবে হ্যা, তুমি কিন্তু এখনো কিঞ্চিৎ মাথামোটাই আছো।” উচ্ছ্বাসের ঠোঁটের কোণায় দুষ্টু হাসি।
প্রিয়তার রাগ হয়, সে চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই উচ্ছ্বাস খপ করে পিছন থেকে তার হাত ধরে। পুরো শরীরে বৈদ্যুতিক তরঙ্গ বয়ে যায় যেনো প্রিয়তার। বরফশীতল একতা হাতের স্পর্শে রাগের পারদ তরতর করে নামতে থাকে তার। তার বদলে শরীর জুড়ে ভিড় করে অদ্ভুত এক অনুভূতি। ভালোবাসা, ভয়, হৃদয় নিংড়ানো প্রেম সবকিছু মিলিয়ে হওয়া সেই অনুভূতির নাম প্রিয়তা জানেনা।

এক ঝটকা দিয়ে উচ্ছ্বাস কাছে টেনে দেয় প্রিয়তাকে। এই মুহুর্তে উচ্ছ্বাসের প্রতিটা নি:শ্বাসের শব্দ, প্রতিটা হৃৎকম্পনের শব্দ যেনো শুনতে পাচ্ছে সে। প্রিয়তার কানের কাছে মুখ এনে উচ্ছ্বাস ফিসফিস করে বললো,”এই মাথামোটা বোকা মেয়েটার প্রেমেই তো আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে গিয়েছি, সে পালটে গেলে তো কষ্ট পেতাম।”
উচ্ছ্বাসের কণ্ঠে কি মাদকতা ছিলো, প্রিয়তার সারা শরীর শিরশির করে ওঠে।
“এখনো সিগারেট খান?”
“তোমার নেশা ব্যাপকভাবে শুরু হয়ে যাওয়ার পর অন্য নেশা ছেড়ে দিয়েছি। দেখো।”
প্রিয়তা দেখেনা, অন্যদিকে তাকায়।

প্রিয়তার এক হাত টেনে এনে উচ্ছ্বাস নিজের বুকের বাম পাশে রাখে।
“দেখেন তো ডাক্তার ম্যাডাম, কি রোগ হয়েছে আমার।”
“মানে? কি হয়েছে বুকে?”
“কঠিন অসুখ হয়েছে ম্যাডাম। প্রতিটা নি:শ্বাসে শুধু এক মায়াবতীর নাম জপে যাচ্ছে হৃৎপিণ্ডটা। এতো করে বলি আমার খাবি, আমার মধ্যে থাকবি অথচ নাম নিবি আরেকজনের। আপনি ওষুধ দিন তো।”
“যদি তাই হয় এতোদিন একবারও মনে করেননি কেনো?”
“ভুলতেই তো পারিনি দু’দণ্ডের জন্য।”
“হাসাবেন না।”
“কেনো কি বললাম?”
“তাহলে কেনো একটাবারও দেখা দিলেন না? কেনো কোনো খবর নিলেন না? জানেন কীভাবে পাগলের মতো খুঁজেছি আপনাকে? কীভাবে কেটেছে আমার এই পাঁচটা বছর, জানেন কি?”
“যদি বলি জানি?”
“মানে?”
“আমি দূরে ছিলাম না প্রিয়তা। আমি তোমার খুব কাছাকাছি ছিলাম। সবসময় তোমার খবর নিয়েছি। আমি নিজেও এই দিনটার অপেক্ষায় ছিলাম। তোমাকে আমি সময় দিয়েছিলাম। আমার জন্য যেনো তোমার জীবনে কোনো অপূর্ণতা না আসে। আমাকে নিয়েই যেনো পূর্ণ হও তুমি।”
প্রিয়তা অবাক হয়ে তাকায় উচ্ছ্বাসের দিকে। মানুষটার মুখে আগের মতো খোঁচা খোঁচা দাড়ি নেই, তার বদলে একরাশ ঘন কালো দাড়ি। কি যে অপূর্ব লাগছে তাকে।
“আমি নিজেকেও গুছিয়ে নিয়েছি। এক বাবার রাজকন্যাকে রানী বানাতে হলে তো তার জন্য রাজ্য বানাতেই হতো আমাকে।”
“আমার কোনো রাজ্য চাইনা উচ্ছ্বাস ভাই। আমি খুব সাধারণ একটা জীবন চাই। শুধু সেই জীবনে কোনো কষ্ট না আসুক?”
উচ্ছ্বাস ঘোর লাগা দৃষ্টিতে প্রিয়তার দিকে তাকিয়ে বললো,”কোনোই কষ্ট না? যে কষ্টে শান্তি লাগে তাও না?”
“উফফ আপনি…..”
জোর করে নিজেকে ছাড়িয়ে নেয় প্রিয়তা। এই মানুষ শোধরানোর নয়, শোধরাবেও না কোনোকালে।
উচ্ছ্বাস শব্দ করে হেসে বললো,”আমি কি?”
“আপনি একটা অসভ্য।”
“বেশ মেনে নিলাম।”
প্রিয়তা কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। উচ্ছ্বাস গলা থেকে মাফলার খুলে চুল মুছতে থাকে, বেশ ঘেমে গেছে সে। প্রিয়তা নেশাভরা চোখে সেদিকে তাকায়। বেহায়া চোখটা কোনোভাবে ভালো হচ্ছে না যেনো আজকে, একটুও শুনছে না ব্যক্তি প্রিয়তার বারণ।

“কি দেখো?”
প্রিয়তা গাঢ় গলায় বললো,”আমার স্বর্গ।”
উচ্ছ্বাস ভ্রু উঁচু করে চোখ বড় করে তাকায়। এ কি তার সেই ছোট্ট মাথামোটা প্রিয়তা? কবে শিখলো এতো কথা?

কি মনে করে উচ্ছ্বাস মাফলারটা দিয়ে টেনে প্রিয়তাকে একদম নিজের সাথে মিশিয়ে ফেলে। প্রিয়তা অপ্রস্তুত বোধ করে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করতে থাকে। কিন্তু অমন বলিষ্ঠ বেষ্টনী থেকে নিজেকে ছাড়ানোর বৃথা চেষ্টা করে বিশেষ লাভ হয়না তার।
“সুযোগ দিলে স্বর্গ দেখিয়ে আনতে পারি।”
প্রিয়তার কান লাল হয়ে যায়।
“আপনি কি নিচে যাবেন নাকি এখানেই থাকবেন সারারাত?”
“তুমি থাকলে তো আমি গভীর জঙ্গলেও রাত কাটিয়ে দিতে রাজি।”
“কিন্তু তার জন্য তো অপেক্ষা করতে হবে মশাই। নারীর মন তো বহু সাধনার বস্তু। এতো সহজেই পেয়ে যেতে চান?”
“অধিকাংশটা তো পেয়েই গিয়েছি, বাকিটুকুও পেয়ে যাবো। রাজকন্যাকে চেয়ে নিবো তার বাবার থেকে। আমার রাজকুটিরে বন্দি করে নিয়ে যাবো। এরপর পুতুলের মতো সাজিয়ে অপলক দেখবো সেই হরিণ চোখের বন্দিনীকে।”
প্রিয়তা ঠান্ডা গলায় বললো,”আর কতোদিন?”
“তোমার চেয়ে তো আমার তাড়া বেশি, খুব তাড়াতাড়ি-ই।”
“আপনার তাড়া বেশি কেনো?”
“বাহ, স্বর্গ দেখানোর ব্যবস্থা করতে হবে না?”
প্রিয়তা উচ্ছ্বাসকে হালকা ধাক্কা দিয়ে সিঁড়ির কাছে চলে যায়।

“কোথায় যাচ্ছো? আরেকটু থাকো।”
প্রিয়তা মুচকি হেসে বললো,”আসছি এক্ষুনি।”

মিনিট পাঁচেক পর প্রিয়তা ফিরে আসে, হাতে উচ্ছ্বাসের সেই গীটারটা। এতোগুলা বছর আগলে রেখেছে প্রিয়তা ওটাকে।
উচ্ছ্বাস হতবাক হয়ে যায়। গীটারটা প্রিয়তার হাত থেকে নিয়ে হাজারটা চুমু খেতে থাকে তাতে। এটা ওকে ওর মা উপহার দিয়েছিলো। কতো বছর এটাকে দেখেনা। পাগলের মতো জড়িয়ে ধরে ওটাকে। প্রিয়তা হাসিমুখে তাকিয়ে দেখে।

উচ্ছ্বাস প্রিয়তার হাত ধরে। কার্নিশের দিকে এগিয়ে যায় দুইজন। উচ্ছ্বাস পা ছড়িয়ে বসে। পাশেই প্রিয়তা রেলিঙে হেলান দিয়ে দাঁড়ায় তার দিকে তাকিয়ে।

“ভ্রমর কইয়ো গিয়া
শ্রীকৃষ্ণ বিচ্ছেদের অনলে…
অঙ্গ যায় জ্বলিয়া রে ভ্রমর
কইয়ো গিয়া

ও ভ্রমর রে, ও ভ্রমর
কইয়ো কইয়ো কইয়ো রে ভ্রমর
কৃষ্ণরে বুঝাইয়া
কইয়ো কইয়ো কইয়োরে ভ্রমর
কৃষ্ণরে বুঝাইয়া
মুই রাধা মইরা যাইমু
কৃষ্ণ হারা হইয়া রে
ভ্রমর কইয়ো গিয়া

ভ্রমর কইয়ো গিয়া
শ্রীকৃষ্ণ বিচ্ছেদের অনলে
অঙ্গ যায় জ্বলিয়া রে ভ্রমর
কইয়ো গিয়া

ও ভ্রমর রে
আগে যদি জানতাম রে ভ্রমর
যাইবা রে ছাড়িয়া
মাথার কেশর দুই ভাগ কইরা
তোরে বান্ধা রাখতাম রে
ভ্রমর কইয়ো গিয়া

ভ্রমর কইয়ো গিয়া
শ্রীকৃষ্ণ বিচ্ছেদের অনলে
অঙ্গ যায় জ্বলিয়া রে
ভ্রমর কইয়ো গিয়া

ও ভ্রমর রে
ভাইবে রাধারমণ বলে
“শোনো রে কালিয়া”
ভাইবে রাধারমণ বলে
“শোনো রে কালিয়া
নিভা ছিলো মনের আগুন রে
কে দিলা জ্বালাইয়া রে
ভ্রমর কইয়ো গিয়া”

ভ্রমর কইয়ো গিয়া
শ্রীকৃষ্ণ বিচ্ছেদের অনলে
ও ভ্রমর
অঙ্গ যায় জ্বলিয়া রে
ভ্রমর কইয়ো গিয়া
ভ্রমর কইয়ো গিয়া
ভ্রমর কইয়ো গিয়া।”

উচ্ছ্বাস থামে। প্রিয়তা থমকে যায় এতো দরদমাখা সুরে। পুরো পরিবেশটা আবেশিত হয়ে যায় যেনো। উচ্ছ্বাসের দুই গাল ভেজা। চিবুক বেয়ে ফোঁটায় ফোঁটায় অশ্রু নামতে থাকে।

নিজেদের ঘর থেকে গানটা চুপ করে বসে শোনে কবির শাহ আর মার্জিয়া। মার্জিয়ার মাথা কবির শাহের কাঁধে। সে পরম যত্নে স্ত্রীর চুলে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। মার্জিয়া বুঝতে পারছে ছেলেটা কোন জাদুবলে তার শান্তশিষ্ট মেয়েটাকে পাগল করেছে। এতো মায়াভরা এক সুপুরুষকে কি কেউ অস্বীকার করতে পারে?
“মার্জিয়া কি ভাবছো?”
“কিছু না, কিচ্ছু না।”
চোখ মুছে স্বামীকে জড়িয়ে ধরে মার্জিয়া।

প্রিয়তা ধীর পায়ে হেঁটে উচ্ছ্বাসের পাশে এসে দাঁড়ায়। উচ্ছ্বাস প্রিয়তার বাঁ হাতটা নিজের গালে চেপে ধরে। তার গালের উষ্ণ পানি ভিজিয়ে দেয় প্রিয়তার হাত।

“ভালোবাসি প্রিয়তমা, নিজের সবটুকু দিয়ে তোমাকে ভালোবাসি। এতো পর্যন্ত যতো কষ্ট দিয়েছি, যে কয়টা দিন পৃথিবীতে আছি তা পুষিয়ে দিবো, এই ওয়াদা থাকলো তোমার কাছে তোমার পাগল প্রেমিকের।”
প্রিয়তা মোহ ভরা কণ্ঠে বললো,”আমিও আপনাকে ভালোবাসি, হৃদয়ের সর্বোচ্চ অনুভূতি নিংড়ে আপনাকে ভালোবেসেছি। পুরো দুনিয়া সাক্ষী, আমি আপনাকে উন্মাদের মতো ভালোবেসেছি।”
“নন্দিনী, তুমি যদি প্রেমের নাম হও তাহলেই কেবলমাত্র আমি প্রেমিক। পৃথিবী অবাক হয়ে দেখবে এক প্রেমিক তার প্রেমের জন্য কি করতে পারে।”
প্রিয়তা বরফের মতো আচ্ছাদিত হয়ে যায়। উচ্ছ্বাস চোখ বন্ধ করে হাতটা আরো জোরে চেপে ধরে।
চাঁদটা যেনো ঠিক সেই মুহুর্তে কিরণটা আরো কয়েকগুণ বাড়িয়ে দেয়। সে যে গ্রহের উপগ্রহ, সেই গ্রহেরই এক পাগল প্রেমিক তার প্রিয়তমাকে ভালোবাসা উৎসর্গ করছে, এতোটুকু দায়িত্ব তো চাঁদকে পালন করতেই হতো, তাইনা?

(সমাপ্ত)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে