তুমি_প্রেম_হলে_আমি_প্রেমিক পর্ব-০৪

0
12

#তুমি_প্রেম_হলে_আমি_প্রেমিক

পর্ব:৪

মুখ ভার করে স্ত্রী আর তার বড় বোনের কথা শুনছে কবির শাহ। এখনো নিজে থেকে কিছু বলা শুরু করেনি সে।

মার্জিয়া বেগম খুশিতে ঠিকমতো কথা বলতে পারছে না। কথা বেঁধে যাচ্ছে মুখে। যদিও ছেলেকে তার খুব একটা পছন্দ হয়নি। তার মেয়েটার সাথে একদমই মানায় না। তবুও কি হয়েছে? মেয়ের বাবা তো বয়সকালে অত্যন্ত সুদর্শন ছিলো। তাতে লাভটা কি হয়েছে? সারাজীবন অভাবের সাথে আপোষ করে চলতে হয়েছে।
মর্জিনা বেগম মুখে একটা পান দিয়ে বললো,”শোন মার্জিয়া, সোনার আঙটি বাঁকাও ভালো। ছেলে খুব একটা ভালো দেখতে না। কিন্তু একবার ভেবে দেখ, তোর মেয়েকে রানী বানিয়ে রাখবে। মাথা থেকে পা পর্যন্ত সোনায় মুড়িয়ে দিবে। যখন গাড়ি থেকে নেমে এসে তোকে জড়িয়ে ধরবে তখন বুঝবি সুখ কাকে বলে।”
মার্জিয়া বেগম স্মিত হেসে বললো,”পুরুষ মানুষের চেহারা দিয়ে কি হবে? টাকা থাকলেই হবে।”
কবির শাহ স্ত্রীর দিকে শান্ত চোখে তাকায়। মার্জিয়া বেগম তার উপর থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নেয়।
“তা মার্জিয়া, এখন বল বিয়ের দিন কবে ঠিক করতে চাচ্ছিস?”
মার্জিয়া বেগম মাথা নিচু করে বললো,”আমি আর কি বলবো? ওদের বাবা যা ঠিক করবে তাই হবে।”
কবির শাহ মুচকি হেসে বললো,”তোমার তাহলে মনে আছে যে মেয়েদের বাবা এখনো বেঁচে আছে?”
ঝাঁঝিয়ে ওঠে মর্জিনা বেগম।
“কি বলতে চাচ্ছো তুমি পরিষ্কার করে বলো কবির। সবসময় আমার বোনটার সাথে এভাবে কথা বলো তুমি। কোনোদিন ওকে সুখ-শান্তি দিলে না।”
কবির শাহ মার্জিয়া বেগমের দিকে তাকায়। মার্জিয়া চোখের ইশারায় বোনকে চুপ করতে বলে।
কিন্তু মর্জিনা বেগম চুপ করে না।
“আমি চাই প্রিয়তার বিয়ে এখানেই হবে। আমি ওর জন্য এক সেট সোনার গহনা বানিয়ে রেখেছি। বাদবাকি যা খরচ প্রয়োজন হলে আমিই দিবো। তবুও এমন সম্বন্ধ হাত ছাড়া করা যাবে না।”
কবির শাহ এতোক্ষণ পর উঠে দাঁড়ায়। মর্জিনা বেগমের দিকে তাকিয়ে কড়া গলায় বললো,”আমার মেয়েকে আমি এখানে বিয়ে দিবো না। আপনার বোনের জিদের জন্য আমি রাজি হয়েছিলাম মেয়ে দেখানোর ব্যবস্থা করতে। কিন্তু তার মানে এটা নয়, মেয়েকে আমি সারাজীবনের জন্য দাসী বানিয়ে রাখবো।”
মর্জিনা বেগম অবাক হয়ে বললো,”দাসী বানিয়ে রাখবে মানে?”
“আপনি নিজে কানে শুনলেন না, ওরা কি বললো? ওদের বাড়িতে মেয়েদের বেশি পড়াশোনার কালচার নেই। বিশেষ করে বাড়ির বউদের। তাদের বেশিরভাগ সময় রান্নাঘরেই কাটিয়ে দিতে হয়। দেখুন, আমি রান্না করা বা ঘরের কাজ করাটাকে ছোট করে দেখছি না। প্রত্যেকটা মেয়েই এটা কমবেশি করে। যদি আমার মেয়ে পড়াশোনা না করে ঘর গুছানোতেই মন দিতে চাইতো আমি কখনো মানা করতাম না। কিন্তু আমার মেয়ে পড়তে চায়। ও যতোদূর যেতে চায় পড়াশোনার জন্য, আমি ওকে যেতে দিবো। বাবা হিসেবে এটা আমার কর্তব্য।”
মার্জিয়া বেগম চুপ করে থাকে। সে জানে তার স্বামী সহজে রাগে না। আর একবার অতিরিক্ত রেগে গেলে তাকে থামানো যায়না কোনোভাবেই। সে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে।
মর্জিনা বেগম মুখ বাঁকিয়ে বললো,”বিদুষী বানাবে মেয়েকে? ঘরে বসিয়ে বুড়ি বানাবে?”
কবির শাহ দুই সেকেন্ড চুপ করে দাঁতে দাঁত চেপে বললো,”যদি পড়াশোনা শেষ করতে করতে ওর বুড়ি হয়ে যেতে হয়, তবে তাই হবে।”
“মার্জিয়া ওকে বোঝা, ও ভুল করছে। মেয়েদের ভালো বিয়েটাই সব। এতো পড়াশোনা করে কোনো লাভ নেই।”
কবির শাহ ম্লান হেসে বললো,”তাই নাকি আপা? তাহলে সেতারার চোখের নিচে কালি কেনো? ওকে দেখলে সবসময় কেনো মনে হয় ও খুব কষ্টে আছে? কিসের কষ্ট ওর? বাড়ি, গাড়ি, প্রাচুর্যতা দিয়ে মুড়িয়ে রেখেছে ওর স্বামী ওকে। তবুও ওর সেই সৌন্দর্য হারিয়ে গেলো কেনো? আপনি মা হয়ে বোঝার চেষ্টা করেছেন কখনো?”
মার্জিয়া বেগম ভয়ে ভয়ে কবির শাহের হাত চেপে ধরে বললো,”তুমি চুপ করো।”
“চুপ করেই এতোদিন ছিলাম মার্জিয়া। শুধুমাত্র সংসারে শান্তি বজায় রাখার জন্য এতোদিন তোমার উপর কোনো কথা বলিনি। এই সংসারে কোনো সিদ্ধান্ত তুমি আমাকে নিতে দিয়েছো? মেয়েদের ব্যাপারে সব সিদ্ধান্ত নিয়েছে আপা। ওরা ওদের পছন্দ মতো কিছু কিনতে পর্যন্ত পারেনি কখনো। নেহাৎ আমার মেয়ে দু’টো শান্ত, কোনোদিন তোমার মুখের উপর কিছু বলার সাহস পায়নি বলে চুপচাপ তোমার কথা শুনেছে। আর তোমার কথাই বা বলছি কেনো? তোমাকে সব মন্ত্র তো উনি শিখিয়ে দেয়। তুমিও অক্ষরে অক্ষরে বোনের সব কথা পালন করো। তার একটাই কারণ, উনার অগাধ টাকা আছে। টাকা দিয়ে উনি তোমাকে কিনে রেখেছে৷ সেই সাথে আমার মেয়ে দু’টোকেও কিনতে চায়। কিন্তু আমি বেঁচে থাকতে তা কখনো হতে দিবো না। এতোদিন চুপ করে ছিলাম মানে এটা নয় যে, আমার মেয়ের জীবনের এতো বড় সর্বনাশের সময়ও আমি চুপ করে থাকবো।”
কবির শাহ এবার মর্জিনা বেগমের দিকে তাকিয়ে বললো,”কি যেনো বলছিলেন আপা কিছুক্ষণ আগে? মেয়ে যখন গাড়ি থেকে নেমে এসে জড়িয়ে ধরবে তখন বুঝতে পারবো সুখ কি জিনিস? কিন্তু আমাকে একটা প্রশ্নের উত্তর দিন তো আপা। গাড়ি থেকে নামা মেয়েটার চোখের নিচে যখন একরাশ কালি দেখতে পান, বিষাদে ছেয়ে যাওয়া মুখ খানা দেখতে পান, তখন সুখটা ঠিক ঠাওর করতে পারেন তো?”
মার্জিয়া বেগম কবির শাহের দিকে তাকিয়ে বললো,”তার মানে তুমি বলতে চাচ্ছো বিয়ে করা মানেই মেয়েদের সর্বনাশ হওয়া?”
“কখনোই না। জীবনটা যদি একটা সঠিক মানুষের সাথে মিলে যায়, তবে সেই জীবন সুখ ভরে ওঠে কানায় কানায়। টাকা কম থাক, তবুও মনে শান্তি থাক। আচ্ছা, মার্জিয়া তুমি কখনো বলতে পারবে আমি তোমাকে কোনোদিন কিছু নিয়ে জোর করেছি? বিয়ের আগে থেকেই গল্পের বই পড়ার ঝোঁক ছিলো তোমার প্রিয়তার মতো। এমন কতোদিন গেছে, গল্পের বই পড়তে পড়তে রান্না পুড়ে গেছে। আমি সেই পোড়া খাবার খেয়েছি হাসিমুখে। কোনোদিন তোমাকে রাগ করিনি, কেনো বই পড়েছো। বরং তোমাকে আমি বেতন পাওয়ার পর তোমার পছন্দের বই এনে দিয়েছি। আমি জানতাম, সংসারের চাপ বেড়ে যাওয়ার পর, সন্তান হওয়ার পর তুমি চাইলেও নিজের জন্য এটুকু সময় বের করতে পারবে না। এজন্য কোনোদিন তোমাকে তোমার শখ থেকে দূরে রাখিনি। কিন্তু যে ছেলে, বিয়ের আগেই আমার মেয়ের জীবনের শখ বিসর্জন দিতে বলে, তাকে রান্নাঘরে বন্দী হয়ে যেতে বলে সে কখনো আমার মেয়ের জন্য সঠিক নয়। আর সঠিক মানুষের সাথে জীবন না কাটাতে পারলে তাকে আমি সর্বনাশই বলবো।”
মার্জিয়া বেগম কোনো কথা বলতে পারেনা, চুপ করে যায়। তার স্বামী ভুল কিছু বলেনি। সেই কিশোর বয়স থেকেই গল্পের বইয়ের প্রতি তীব্র ঝোঁক তার। এই স্বভাবের জন্য কতো বকা খেয়েছে সে তার বাবা মায়ের কাছ থেকে। একটাই দোষ গল্পের বই পড়তে বসলে কোনোদিকে হুঁশ থাকতো না তার। এরপর বিয়ে হলো, কতোদিন রান্না পুড়িয়ে ফেলেছে সে গল্পের বই পড়তে যেয়ে। ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে থাকতো, আবার তার স্বামী রাগ করে কিনা। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার, কবির শাহ কোনোদিন রাগ করতো না। বরং মিষ্টি করে হাসতো। আবার এই মানুষটাই বেতন পেয়ে তাকে নতুন গল্পের বই এনে দিতো। পরে প্রিয়তা জন্ম নিলো। আস্তে আস্তে দায়িত্ব বাড়লো। এখন সেই ইচ্ছাটাই আর নেই বই পড়ার। তবে তার বড় মেয়ে তার এই স্বভাবটা ভালোই আয়ত্ত করেছে। মায়ের মতোই নতুন বইয়ের ঘ্রাণে মাতাল হয়ে যায় সে। আর আজ নিয়াজ নিজেই বললো এসব অভ্যাস নাকি ত্যাগ করতে হবে তাকে।
মর্জিনা বেগম রাগে কাঁপতে থাকে। তার চোখমুখ লাল হয়ে উঠেছে।
“মার্জিয়া তুই কি ভাবছিস?”
স্ত্রী কিছু বলার আগেই কবির শাহ ছোট্ট করে হেসে বললো,”প্রিয়তার কথা ভাবার জন্য তার বাবা আছে, মা আছে। বাইরের একজনের এতো না ভাবলেও চলবে। এতোদিন ভেবেছেন এতেই আমরা কৃতজ্ঞ।”
মর্জিনা বেগম হতভম্ব হয়ে বললো,”কি বললে তুমি? আমি বাইরের লোক?”
“আমাকে ভুল বুঝবেন না। নিজের মেয়ের ভালো থাকার সাথে আর কোনো আপোষ করতে আমি রাজি নই।”
মার্জিয়া বেগম ফ্যালফ্যাল করে একবার স্বামীর দিকে আর একবার বড় বোনের দিকে তাকায়। কোনদিকে কথা বলা উচিত সে বুঝতে পারেনা।
মর্জিনা বেগম এবার চিৎকার করে ওঠে।
“যার জন্য চুরি করি সেই বলে চোর। আজ আমি কিনা বাইরের মানুষ হয়ে গেলাম? বলি, আমি কি ওদের খারাপ চাই?”
“দেখুন আপা, আপনি আমাকে ভুল বুঝছেন। আমি সেভাবে বলতে চাইনি…”
“চুপ করো তুমি। তোমার সাথে কোনো কথাই বলতে চাইনা আমি।”
মর্জিনা বেগম কিছুক্ষণ থেমে আবার বললো,”আজ আমাকে এভাবে অপমান করলে তো? যেদিন মেয়ে একটা কেলেংকারী বাঁধাবে সেদিন এসো আমার কাছে। মেয়েকে এভাবে অবাধ স্বাধীনতা দিয়ে মাথায় তোলার পরিণাম একদিন ঠিক বুঝবে তুমি কবির। সেদিন কারো সামনে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবে না। এই দাম্ভিকতা ভেঙে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যাবে। নিয়াজের মতো ছেলে দূরে থাক, মুচি মেথরও পাবে না মেয়েকে বিয়ে দেওয়ার জন্য।”
মার্জিয়া বেগমের বুক কেঁপে ওঠে। ভর সন্ধ্যেবেলা আপা এসব কি বলছে? রাগে হতবিহ্বল হয়ে কি যা নয় তা বলে যাচ্ছে সে খেয়াল আছে তার?
কবির শাহ ভ্রু কুঁচকে বললো,”সেই শিক্ষা আমি আমার মেয়েদের দিইনি আপা। ওরা আমার আদর্শে বড় হয়েছে। আমার বিশ্বাস আছে ওদের উপর। এমন ভুল ওরা কোনোদিন করবে না।”
মর্জিনা বেগম তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললো,”আগুন আর বারুদ পাশাপাশি রাখলে বিস্ফোরণ হবেই কবির। আজ হোক বা কাল, তুমি বুঝতে পারবে। তোমার আদর্শ মাটিতে মিশে যাবে সেদিন, আমার কথা মিলিয়ে নিও। তোমার মেয়ে আগুন, আর বারুদ তুমি নিজে ঘরে ডেকে এনেছো। আমার সাবধান করে দেওয়ার দরকার ছিলো আমি করেছি।”
মর্জিনা বেগম প্রচন্ড রাগে আর কথা এগিয়ে নিয়ে যেতে পারেনা। নিজের মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললো,”চলে আয় সেতারা, এখানে দাঁড়িয়ে থাকার আর কোনো প্রয়োজন নেই।”
সেতারা কবির শাহের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে। এই কঠিন রণমুর্তি যদি তার বাবাও ধারণ করতো, আজ তার জীবনটা এমন হতোনা। একটা মেকি সুখের লেবাস পরে সবার সামনে ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে তাকে ক্লান্ত হতে হতোনা। কবির শাহ যেনো বুঝতে পারে মেয়েটার হাসির মধ্যে লুকিয়ে থাকা বিষাদ।
ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মায়ের সাথে বেরিয়ে যায় সে। মার্জিয়া বেগম আটকাতে যেয়েও পারেনা।
কবির শাহ তাকায় স্ত্রীর দিকে। মার্জিয়া বেগম নির্লিপ্ত চোখে শুন্যের দিকে তাকিয়ে আছে। সেই চোখে না আছে রাগ, না আছে কষ্ট আর না আছে অনুতাপ। স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে একটু কষ্টই হয় কবির শাহের।

সারাদিনটাই গুমোট হয়ে ছিলো পরিবেশটা। বিকালের পর থেকে পশ্চিম আকাশে মেঘ জমেছে। ঘন কালো মেঘে ছেয়ে আছে পুরো আকাশ। মাঝে মাঝে বিজলী চমকে উঠছে। বাতাসে যেনো উড়িয়েই নিবে সবকিছু। প্রশান্তির ঠান্ডা বাতাস, তীব্র গরমের শেষে। সবার মনেই কিছুটা স্বস্তি আসে। শুধু স্বস্তি নেই প্রিয়তার মনে। পাত্রপক্ষের লোকগুলো চলে যেতেই দৌড়ে ছাদে এসেছে সে। বুক ভরে শ্বাস নেওয়ার চেষ্টা করছে, কোনোভাবেই লম্বা শ্বাস নিতে পারছে না। বাবার সাথে তার মা আর বড় খালার কি কথা হচ্ছে সে জানেনা। সে জানে, বাবা একা কিছুই করতে পারবে না। সারাজীবন এমনটাই দেখে এসেছে। বাবা কিছু বলতে গেলেই তার মা চিৎকার করে বাড়ি মাথায় তুলেছে। বাবা বাধ্য হয়ে সব মেনে নিয়েছে। আজও নিশ্চয়ই তাই হবে। হয়তো খুব তাড়াতাড়ি বিয়ে হয়ে যাবে তার ওই লোকটার সাথে। যে তার স্বপ্নগুলোকে প্রতিনিয়ত গলা টিপে মেরে ফেলবে। তার ডানা ছেঁটে একটা খাঁচার মধ্যে বন্দী করে রাখবে।
প্রিয়তার চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছা করে। কিন্তু কেউ যেনো শক্ত করে তার গলাটা আঁকড়ে ধরে রেখেছে। সে চাইলেও কাঁদতে পারছে না। বোবা কান্নাগুলো দলা পাকিয়ে গলার কাছে আটকে থাকে।

মিনিট বিশেক পরই যেনো আকাশের বাঁধ ভাঙে। মেঘ থেকে ভেঙেচুরে প্রবল বর্ষণ নামে। প্রথম বড় বড় ফোঁটায়, এরপর অজস্র জল ফোঁটা ছুঁয়ে দেয় এতোদিন অতৃপ্ত হয়ে থাকা প্রকৃতিকে। ভেসে যায় সব খরা। আকাশ যেনো চিৎকার করে মেঘকে বলছে,”যা মেঘ যা, দেখিয়ে দে তোর ক্ষমতা। পৃথিবীর বুকে একবুক পিপাসা নিয়ে অতৃপ্ত হয়ে থাকা প্রতিটা প্রাণকে তোর অস্তিত্ব জানিয়ে দে। তোকে নিঙড়িয়ে প্রতিটা বারিত বর্ষণ থেকে তৃষ্ণা মিটিয়ে দে ওদের। আজ তোর পরীক্ষার দিন।”
মেঘও সায় দিয়েছে আকাশের কথায়। সামান্য দূরের জিনিসও ঠাওর করা যায়না বৃষ্টির গতিতে।
সেই একই সাথে বাঁধ ভাঙে প্রিয়তারও। হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে সে ছাদের উপর। হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে সে। তার পরনের নীল কাতান শাড়িটা ভিজে জবজবে হয়ে শরীরের সাথে লেপ্টে আছে। কোমর ছাড়ানো লম্বা কোঁকড়া চুলগুলো খোঁপা থেকে আলগা হয়ে নেমে এসেছে কোমর পর্যন্ত। এলোমেলো হয়ে ভেজা চুলগুলো প্রিয়তার ঘাড়, গলা, হাতের বাহু আঁকড়ে ধরেছে।
প্রিয়তা হয়তো কোনোদিন জানতে পারবে না, এই অবস্থায় কতোটা মোহনীয় লাগছে তাকে। লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি বেঁচে থাকলে হয়তো বাঙালি মোনালিসা এঁকে ফেলতেন এই শ্যামবর্ণা বাঙালি তরুণীর মোহনীয় রূপ দেখে।

“এভাবে নিজেকে কষ্ট দিলে কি সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে?”
চমকে উঠে প্রিয়তা তাকায় পিছনের দিকে। দুই হাত বুকে বেঁধে উচ্ছ্বাস তাকিয়ে আছে তার দিকে। তার চুল থেকে পানি গড়িয়ে পড়ছে তার চোখে, চিবুকে, ঠোঁটে। ঘন চাপদাড়ি থেকে যেনো সেই জলের ফোঁটা গুলো মুক্তোর মতো গড়িয়ে পড়ছে। গাঢ় নীল শার্টটা পরনে মানুষটাকে মনে হচ্ছে, এই রঙটা শুধু তার জন্যই বানানো হয়েছে। সুতীক্ষ্ণ চোখজোড়া এতো কাছ থেকে এভাবে কখনো দেখেনি প্রিয়তা।
তিরতির করে ঠোঁট কাঁপতে থাকে প্রিয়তার। তা শীতল বৃষ্টির পানিতে নাকি প্রিয় মানুষটাকে এভাবে দেখে তা সে জানেনা।
“এভাবে তাকিয়ে না থেকে যা জিজ্ঞেস করছি তার উত্তর দাও। এভাবে ভিজছো কেনো?”
প্রিয়তা নির্লিপ্ত গলায় বললো,”আপনিও তো ভিজছেন।”
উচ্ছ্বাস খোলা গলায় হাসে। প্রিয়তা মুগ্ধ হয়ে সেই হাসি দেখে।
“আমাদের কিছু হয়না প্রিয়তা। তোমরা অনেক আদরের, অল্পতেই তোমাদের অসুখ বেঁধে যায়। নিচে চলো।”
প্রিয়তা ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকে। আলুথালু চোখে তাকিয়ে থাকে উচ্ছ্বাসের দিকে।
“কি হলো, নিচে চলো।”
“আপনি যান উচ্ছ্বাস ভাই। আমি যাবো না।”
উচ্ছ্বাস আবার পূর্ণ দৃষ্টি মেলে প্রিয়তার দিকে তাকায়। অঝোর ধারায় বৃষ্টি পড়ছে। সেই বৃষ্টিতে মেয়েটাকে গ্রীক দেবী বলে ভ্রম হয়।
“বাস্তবতা থেকে পালানো যায়না প্রিয়তা। নিজেকে কষ্ট দেওয়ার মধ্যে কোনো মাহাত্ম্য নেই। এই দুনিয়ায় কেউ কারো নয়। তোমার কাছে শুধুমাত্র তুমি-ই আছো। আর কেউ না।”
“এতো কঠিন কথা আমি বুঝিনা উচ্ছ্বাস ভাই। আমি সাধারণ একটা মেয়ে, আমার চিন্তাভাবনাও সাধারণ।”
“তুমি সাধারণ নও, তুমি অসাধারণ একটা মেয়ে। যার এক চোখে সমরেশ মজুমদারের আট কুঠুরি নয় দরজা, অন্য চোখে হুমায়ুন আহমেদের নন্দিত নরকে সেই মেয়ে সাধারণ হতে পারেনা। যে মেয়ের মননে কাজী নজরুল ইসলামের সঞ্চিতা, যার হৃদয়ে রবী ঠাকুরের চোখের বালি, সেই মেয়ে অসাধারণ। তার চিত্তজুড়ে এক জলপরীর অবাধ বিচরণ।”
প্রিয়তা হতবাক হয়ে উচ্ছ্বাসের দিকে তাকায়। তার বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়, এই সেই মানুষটা? যে কথায় কথায় তাকে কষ্ট দেয়, রুক্ষভাষী হয়ে ওঠে তাকে দেখলেই। সেই মানুষটা এতো সুন্দর করে কথা বলতে পারে? কি আসল পরিচয় এই মানুষটার?
সে কিছুদিন পরই এই বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে এজন্যই কি এতো সুন্দর ব্যবহার করছে? প্রিয়তার বুকটা হু হু করে ওঠে।
“আপনি কীভাবে জানেন আমি উপন্যাস পড়তে এতো ভালোবাসি? আর এগুলোই আমার প্রিয় উপন্যাস এটা কীভাবে বুঝলেন?”
“আজ যখন তোমার ঘরে গিয়েছিলাম গীটার নিতে তখন তোমার টেবিলে বইগুলো দেখেছি। আর এই উপন্যাসগুলোর বইয়ের ভিতর বুকমার্ক দেখেছি। বুঝেছি পুরোনো বইগুলোই নতুন করে পড়ছো আবার। পছন্দ বলেই পড়ছো আবার।”
প্রিয়তার অবাক হওয়ার মাত্রাও ছাড়িয়ে যাচ্ছে। কি প্রখর দৃষ্টিশক্তি মানুষটার। একদিকে নিয়াজ তাকে বই পড়ার জন্য সূক্ষ্মভাবে অপমান করলো, আর অন্যদিকে উচ্ছ্বাস বই পড়াটাকে কতো মহানভাবে তুলে ধরলো।
প্রিয়তার চোখের পাতা চুইয়ে বৃষ্টির ফোঁটা পড়তে থাকে।
“নিচে যাও প্রিয়তা। সবাই খুঁজবে তোমাকে।”
“কেউ খুঁজবে না। আমি এভাবেই হারিয়ে যেতে চাই।”
“জীবনটা গল্পের বইয়ের পাতার মতো গোছানো নয় প্রিয়তা। এভাবে হারিয়ে যাওয়া যায়না। যদি যেতো, সবকিছু হারিয়ে আমি এভাবে বেঁচে থাকতে পারতাম না।”
প্রিয়তার ভীষণ কান্না পায় উচ্ছ্বাসের কথা শুনে।
“আর হ্যা, বিয়েটা আপাতত হচ্ছে না তোমার। বিয়ে না হওয়ায় আবার কষ্ট পেয়ো না।”
হতভম্ব হয়ে উচ্ছ্বাসের দিকে তাকায় প্রিয়তা। সে কি মজা করছে?
“কি বললেন আপনি? মজা করছেন আমার সাথে?”
“তোমার মতো বোকা মেয়ের সাথে মজা করাটা দোষের কিছু নয় যদিও। তবুও আমি মজা করছি না। তোমার বাবা বিয়েটা হতে দিচ্ছেন না। এতে যদি কষ্ট পেয়ে থাকো, বাবাকে যেয়ে বলো তুমি বিয়ে করতে চাও।”
প্রিয়তার ইচ্ছা করছে খুশিতে লাফ দিতে। নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারেনা সে।
উচ্ছ্বাস প্রিয়তার দিকে সরু চোখে তাকিয়ে বললো,”এই মেয়ে তোমার টিপটা সরে গেছে, ঠিক করো।”
প্রিয়তা হাত দিয়ে ঠিক করার চেষ্টা করে। কিন্তু আরো বেঁকে যায়। প্রিয়তার ইচ্ছা করে উচ্ছ্বাসকে বলতে,’আপনি ঠিক করে দিননা।”
তার মন বলছিলো উচ্ছ্বাস ঠিক করে দিবে। কিন্তু উচ্ছ্বাস সেদিকে তাকায় না। দুই পকেটে হাত দিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে থাকে।

“জানেন আমার খুব আনন্দ হচ্ছে। আমি বিয়ে করতে চাইনি এখন।”
উচ্ছ্বাস তার দিকে তাকায়। হাত দিয়ে মাথার চুল ঝাড়তে ঝাড়তে বললো,”অনেক রাত হয়েছে, নিচে যাও।”
“আপনি যাবেন না?”
“আমি আরো কিছুক্ষণ ভিজবো।”
প্রিয়তা কিছু সময় চুপ থেকে মাথা নিচু করে ফিসফিস করে বললো,”আপনি তো বললেন সমস্যা মোকাবিলা না করে নিজেকে কষ্ট দেওয়ার মধ্যে কোনো মাহাত্ম্য নেই। আপনি নিজেই সেই কাজ করছেন?”
প্রিয়তা ভেবেছিলো উচ্ছ্বাস রেগে যাবে। কিন্তু তাকে অবাক করে দিয়ে উচ্ছ্বাস হেসে দেয়। এই প্রথম এভাবে হাসতে দেখলো সে মানুষটাকে। একটা পুরুষ মানুষের হাসি এতো সুন্দর কেনো হবে? কেনো কেনো কেনো?
“আমাকে এক কাপ চা বানিয়ে দিও তো। বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে চা খেতে ইচ্ছা করছে।”
প্রিয়তার মনে হচ্ছে পৃথিবীর সব খুশি তার মনে ভিড় করেছে। খুশিতে যদি বাচ্চাদের মতো একটা চিৎকার দিতে পারতো ভালো হতো।
“কি হলো যাও।”
হালকা ধমকে কেঁপে ওঠে প্রিয়তা। আজ কি ভীষণ আনন্দ যে তার লাগছে। পুরো পৃথিবীর আনন্দ একদিকে আর তার বুকের ভিতরের আনন্দ আরেকদিকে। একটু আগ পর্যন্তও তার মনে হয়েছিলো এই পৃথিবীর সবচেয়ে অসুখী মানুষটা হলো সে। আসলেই বৃষ্টির পানির অদ্ভুত ক্ষমতা আছে মানুষের মন ভালো করে দেওয়ার।

ফিরতে ফিরতে প্রিয়তা তাকায় উচ্ছ্বাসের দিকে। দূর থেকে মনে হচ্ছে মানুষটাকে একটা পাহাড়ের মতো মনে হচ্ছে। যে পাহাড় এক নিমিষেই তার মনটা ভালো করে দিলো। পিছন থেকে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছা করে তার উচ্ছ্বাসকে। পরক্ষণেই নিজের চিন্তায় নিজের কান লাল হয়ে যায়। এসব কি ভাবছে সে?
ঝুমঝুম নুপুরের শব্দ করে সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসে সে। ঘরে ঢোকার মুখেই মা কে দেখে কেমন ভয় লেগে যায় তার। শীতল চোখে মার্জিয়া বেগম তাকিয়ে আছে মেয়ের দিকে। সেই চাহনী দেখে হঠাৎ ভয় পেয়ে যায় প্রিয়তা।

(চলবে……)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে