তুমি_প্রেম_হলে_আমি_প্রেমিক পর্ব-২৮+২৯

0
3

#তুমি_প্রেম_হলে_আমি_প্রেমিক

পর্ব: ২৮

প্রিয়তা বরফ শীতল গলায় বললো,”কি করছেন উচ্ছ্বাস ভাই? আপনি পায়ের কাছে বসে আছেন কেনো?”
পেখম অপ্রস্তুত হয়ে এদিক ওদিক তাকায়। পাশেই একটা মসজিদ, এশার নামাজ শুরু হয়ে গেছে সেখানে। নামাজ শেষে সবাই বের হবে। এমন অবস্থায় দেখলে কি না কি ভাববে সবাই। ছোট শহরে বিনোদনের ভীষণ অভাব, এমন বিনোদন পেলে কেউ আর নড়তে চাইবে না এখান থেকে।

উচ্ছ্বাসের কোনোদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই। সে চিৎকার করে কাঁদছে। সে জানেনা সে কেনো কাঁদছে। সারাজীবন নিজের কষ্ট চেপে নিজেকে একটা শক্ত আবরণের মধ্যে বন্দী করে রেখেছে সে। আর সেই প্রাচীর আরো শক্ত হয়েছে চোখের সামনে বাবা-মায়ের খু’নের হতে দেখার পর। আজ অনেক অনেক দিন পর এভাবে মন খুলে কাঁদছে সে। মনে হচ্ছে বুকের উপর থেকে বড় একটা পাথর নেমে যাচ্ছে তার প্রতিটা পানির ফোঁটায় একটু একটু করে।

প্রিয়তা নিজেও বসে পড়ে, নিজের হাঁটুর থেকে উচ্ছ্বাসের হাত ছাড়ায়। পুরো মুখ তার চোখের পানিতে ভিজে জবজব করছে। প্রিয়তা কিছুটা ইতস্তত করে কাঁপা হাতে পানিটা মুছে দেয়।
“কি করছেন আপনি এসব উচ্ছ্বাস ভাই? এমন পাগলামির মানে কি?”
উচ্ছ্বাস মুখ হাঁ করে কিছুক্ষণ শ্বাস নেয়, নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করে। প্রিয়তা সেই সময়টুকু দেয় উচ্ছ্বাসকে। পেখম শুধু ইতিউতি দেখেই যাচ্ছে। ভীষণ ভয় করছে তার।

বেশ কিছুক্ষণ পর উচ্ছ্বাস দুই হাতে নিজের চোখমুখ মুছে উঠে দাঁড়ায়। প্রিয়তাও উঠে দাঁড়ায় তার সামনে।

“তোমরা এখানে কেনো এসেছো প্রিয়তা? আমার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না তোমরা আমার সামনে।”
প্রিয়তা মাথা নিচু করে বললো,”আমরা আপনার কাছেই এসেছি উচ্ছ্বাস ভাই।”
উচ্ছ্বাদ কিছুটা অবাক হয়। ভ্রু কুঁচকে বললো,”আমার কাছে এসেছো মানে? তোমরা কীভাবে জানো আমি এখানে থাকি? কে দিয়েছে তোমাদের এই ঠিকানা?”
“সেসব বলার মতো সময় নেই উচ্ছ্বাস ভাই। আপনার সামনে অনেক বিপদ। অনেক বড় একটা ট্র‍্যাপে আপনাকে ফেলা হয়েছে। এখন যেভাবে হোক এই ট্র‍্যাপ থেকে আপনাকে বের হতে হবে।”
উচ্ছ্বাস গম্ভীর গলায় বললো,”ট্র‍্যাপে তো তুমি আমাকে ফেলেছো প্রিয়তা। নাহলে আমার মতো একটা রগচটা ছেলে কারো প্রেমে এমন আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে যেতে পারে?”
প্রিয়তা অসহিষ্ণু হয়ে বললো,”এখন মজা করার সময় না উচ্ছ্বাস ভাই।”
উচ্ছ্বাস দুই হাত বুকের সাথে বেঁধে সটান হয়ে দাঁড়ায় শান্ত মুখে। সে বুঝতে পারছে প্রিয়তা কোনো ভয়, দুশ্চিন্তা আর উত্তেজনার মধ্যে আছে। একটু পর পর ঠোঁট কাঁপছে তার। শান্ত মেয়েগুলো ভীষণ ভয় পেয়ে গেলে কেমন অশান্ত হয়ে যায়। তার মা-ও এমন ছিলো বলে সে বুঝতে পারছে।

“উচ্ছ্বাস ভাই আমি জানি এই খু’নগুলো আপনি করেননি।”
উচ্ছ্বাস কিছু বলেনা, ঠান্ডা চোখে তাকিয়ে থাকে। প্রিয়তাকে তার কথা শেষ করার সময় দেয়।
“আর এটাও জানি এগুলো কে করেছে।”
বেশ অনেকটাই অবাক হয়ে যায় উচ্ছ্বাস। এসব খু’নের ব্যাপারে প্রিয়তা কিছু জানতে পারে এটা তার কল্পনাতেও আসেনি কখনো। এটা কীভাবে সম্ভব?

“প্রিয়তা তুমি কি বলছো তুমি জানো?”
“আমি জানি উচ্ছ্বাস ভাই। আপনি আমাকে বিশ্বাস করতে পারছেন না বুঝতে পারছি। কিন্তু দেখুন আমি কীভাবে তাহলে আপনার গোপন ঠিকানার খোঁজ পেলাম?”
উচ্ছ্বাসের মনে খটকা লাগে৷ এখন মনে হচ্ছে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা অষ্টাদশী তরুণীকে মোটেই হালকা ভাবে নেওয়া ঠিক হচ্ছে না।

প্রিয়তা ক্ষীণ গলায় বললো,”উচ্ছ্বাস ভাই আজ নীলু আপা এসেছিলো আমার বাড়িতে।”
“নীলু আপাটা আবার কে?”
“কেনো ভুলে গেলেন? ওইযে আমার কলেজের সেই আপাটা, আমাদের বাড়িতেও দেখা হয়েছিলো আপনার সাথে। আপনি কলেজেও উনাকে দিয়ে চিঠি পাঠিয়েছিলেন আমার কাছে।”
উচ্ছ্বাস কিছুক্ষণ মনে করার চেষ্টা করে।
“তো উনি এসেছিলো তাতে আমি কি করবো?”
“উনি আমাকে সব তথ্য দিয়েছে। আপনার ঠিকানাও উনি দিলো, তাছাড়া এগুলোর সাথে কে জড়িত তা-ও আমাকে বলেছে।”
“বিলু আপা এগুলো কীভাবে জানলো?”
প্রিয়তা হতাশ গলায় বললো,”বিলু না নীলু।”
“ওই হলো একটা। উনি কি বাই এনি চান্স সিআইডির গোপন এজেন্ট?”
প্রিয়তা এবার কিছুটা রাগান্বিত গলায় বললো,”আপনি কিন্তু এখনো মজা করছেন।”
“আচ্ছা আচ্ছা, কিছু বলছি না। শেষ করো।”
প্রিয়তা এদিক ওদিক তাকায়। পেখম ভরসার দৃষ্টিতে তাকে বুঝায় তুমি নিশ্চিন্তে কথা বলো, আমি এদিকটা দেখছি।

ঝিম ধরে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে উচ্ছ্বাস। প্রিয়তার বলা কথাগুলো অস্বীকার বা অবিশ্বাস করার উপায় নেই। কারণ এগুলোর একটা কথাও মিথ্যা নয়। সত্যিই তার চাচাদের বড় বিজনেস আছে। প্রিয়তা বা নীলুর এগুলো জানার কথা না। নিশ্চয়ই এখানে অন্য কারো হাত আছে।

“এই কথাগুলো তোমার নীলু আপাকে কে জানিয়েছে বললে? তোমার প্রেমে হাবুডুবু খাওয়া সেই নিয়াজ মোর্শেদ?”
প্রিয়তা হতাশ গলায় বললো,”উচ্ছ্বাস ভাই….”
উচ্ছ্বাস আচমকা শব্দ করে হেসে দেয়। প্রিয়তা অবাক হয়ে তাকায়। এখানে হাসির কি হলো?

“প্রিয়তা তুমি বোকা, ভীষণ বোকা।”
“আমি বোকা?”
“শুধু বোকা নও। তোমার ফাঁপা মাথায় গ্যাস ভর্তি। মাঝে মধ্যে আমার মনে হয় এতো গ্যাসের চাপে কবে না তুমি গ্যাস বেলুনের মতো ফুঁস করে উড়ে যাও।”
প্রিয়তা অপমানিত বোধ করে। অদ্ভুত লোক তো, উনারই উপকার করতে এসে অপমানিত হতে হলো উনার কাছেই? উনি কি কোনোদিন শোধরাবে না?

“চলো আমার সাথে।”
“কোথায়?”
“তোমাদের বাসায় পৌঁছে দিই। মামা মামি দুশ্চিন্তা করছে।”
“পৌঁছে দিতে হবে না, আমরা নিজেরা চলে যেতে পারবো।”
উচ্ছ্বাস নির্লিপ্ত চোখে তাকায় প্রিয়তার দিকে, প্রিয়তা চুপ করে যায় সাথে সাথে।

“তোমাদের পৌঁছে দিয়ে আমার অন্য কাজ আছে?”
“অন্য কাজ মানে? কোথায় যাবেন আপনি? পুলিশের কাছে ধরা দিবেন?”
উচ্ছ্বাস ঘোর লাগা চোখে প্রিয়তার দিকে তাকায়। প্রিয়তা থতমত খেয়ে চোখ নামিয়ে নেয়।

“তুমি বললে তো ফাঁ’সির দড়ির সামনেও হাসতে হাসতে পৌঁছে যেতে পারি। তবে এখন যাচ্ছি অন্য হিসাব চুকাতে।”
“কি হিসাব?”
“তোমার সেই মেইন কালপ্রিট, শিল্পপতি চাচাকে হালকার উপর ঝাপসা বার্নিশ করে আসি।”

প্রিয়তা অপমানিত মুখে দাঁড়িয়ে থাকে। মনে মনে ভাবে একটা মানুষ কি সবসময় এমন তেড়া কথা বলতে পছন্দ করে?

“চলো পেখম, আমি তোমাদের পৌঁছে দিই।”
পেখম কান্নাজড়িত ক্ষীণ গলায় বললো,”আমাদের আবার কবে দেখা হবে উচ্ছ্বাস ভাই?”
উচ্ছ্বাস প্রিয়তার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললো,”যেদিন তোমার আপার বউ সাজতে ইচ্ছা করবে।”
লজ্জায় কান লাল হয়ে যায় প্রিয়তার। পেখম কষ্টের মধ্যেও হেসে দেয়।
“জায়গাটা ভালো না, বেরিয়ে পড়তে হবে। আমার অন্য কাজও আছে।”
প্রিয়তা এগোয় না, পেখম বুঝতে পারে সে উচ্ছ্বাসকে গোপনে কিছু বলতে চায়।

“আপা তুই আস্তে আস্তে আয়। আমি এগিয়ে গলির মুখে দাঁড়াচ্ছি।”
প্রিয়তা ম্লান হেসে তাকায় বোনের দিকে, পেখমও বিনিময়ে কিছুটা হেসে বেরিয়ে যায়।
“কি হলো চলো?”
“উচ্ছ্বাস ভাই?”
“হুম বলো।”
প্রিয়তা কিছু বলতে যেয়েও থেমে যায়। নিজেই নিজের উপর রাগ দেখায়। ছিহ, এতোটা নির্লজ্জ হলো কবে থেকে সে?

উচ্ছ্বাস ঠোঁট কামড়ে হাসে প্রিয়তার অবস্থা দেখে।
“এ কি আপনি হাসছেন কেনো শুধু শুধু?”
উচ্ছ্বাস ভিতরের টি শার্টটা রেখে চাদরের নিচ থেকে নিজের শার্টটা খুলে প্রিয়তার হাতে দেয়। প্রিয়তা কিছু না বুঝে তাকায় তার দিকে।

“আমি জানি তুমি চাচ্ছো এখন। আমি যেনো তোমাকে শক্ত করে একবার জড়িয়ে ধরি।”
প্রিয়তা লজ্জায় মাথা নিচু করে। লোকটার লজ্জা শরম আসলেই কিঞ্চিৎ কম, কিঞ্চিৎ না ভালোই কম। কিন্তু সে বুঝলো কীভাবে প্রিয়তা এটাই চাচ্ছিলো? তাহলে সে নিজেও কি সামান্য বেহায়া হয়ে উঠেছে এই মানুষটার সামনে?

“তবে তোমার ইচ্ছা এখন আমি পূরণ করবো না। কিছু ইচ্ছা অপূর্ণ থাক। সব ইচ্ছা পূরণ হয়ে গেলে তুমি যে আমার অপেক্ষায় থাকবে না আর।”
প্রিয়তা সজল চোখে তাকায় উচ্ছ্বাসের দিকে, উচ্ছ্বাস চোখ নামিয়ে নেয়। এই মুহুর্তে এই চোখজোড়া দেখার সাহস তার নেই। সে যতো বীরপুরুষই হোক না কেনো, এই সাহস কোনো পুরুষেরই নেই।

“তবে তার বদলে এই শার্টটা রাখো। তোমরা মেয়েরা আবার শার্টের গন্ধ শুকতে পছন্দ করো। আমি তো ঘামের গন্ধ ছাড়া আর কিছুই পাইনা।”
প্রিয়তা কাঁদতে কাঁদতে হঠাৎ হেসে দেয়। উচ্ছ্বাসও হাসে। প্রিয়তা শার্টটা নিজের মুখের সাথে চেপে ধরে।

“আমাদের আবার কবে দেখা হবে উচ্ছ্বাস ভাই?”
“যেদিন তুমি আমার নামের শেষে আর ভাই যোগ করবে না, সেদিনই দেখা হবে।”
“আপনি আর শোধরাবেন না তাইনা?”
“শোধরালে কি এখনের মতোই ভালোবাসবে? যদি ভালোবাসা আরেকটু বাড়িয়ে দাও, তাহলে ভেবে দেখতে পারি শোধরানো যায় কিনা।”
প্রিয়তার ইচ্ছা করছে না মানুষটাকে ছাড়তে। তার মনে হচ্ছে এখন ছেড়ে দিলে আর কোনোদিন দেখা হবে না তাদের। এমন কেনো মনে হচ্ছে তার? বুকটা কেমন ছটফট করছে। সময়টা এখানেই আরো কিছু সময় থেমে থাকলে কি প্রকৃতির খুব বেশি অসুবিধা হয়ে যাবে?
আজ এতো মায়া মায়া করেই বা কথা বলছে কেনো উনি? পেখম তাহলে ঠিকই বলতো। এই রগচটা, রাগী মানুষটার মুখোশের আড়ালে একটা অসাধারণ মানুষের বসবাস। সে আসলেই বোকা, সে বুঝতে পারেনি। উচ্ছ্বাস শেষ বারের মতো স্মিত একটা হাসি দেয় প্রিয়তার দিকে তাকিয়ে। ভিতরটা ভেঙেচুরে যাওয়ার উপক্রম হয় প্রিয়তার সেই হাসি দেখে। একটা পুরুষ মানুষের হাসি এতো মায়াকাড়া হবে কেনো? আচ্ছা, মায়াবতীর পুরুষবাচক কেনো শব্দ হয়না কেনো? পুরুষদের কি মায়া থাকে না?

“তোমরা কোথায় গিয়েছিলে?”
বাড়ি ঢোকার মুখেই বাবাকে গম্ভীর মুখে বসে থাকতে দেখে দুই বোনই থমকে দাঁড়ায়। বাবার গলার স্বর যদিও শান্ত, কিন্তু কোথায় যেনো একটা ভীতিকর সুর টের পায় দুইজন।

“আমি কিছু জিজ্ঞেস করছি তো, উত্তর দাও।”
ওরা উত্তর দেওয়ার আগেই মার্জিয়া বেগম ছুটে এসে বললো,”ওদের আগে ঘরে ঢুকতে তো দাও। আসতে না আসতেই কি শুরু করলে?”
প্রিয়তা, পেখম দুইজনই অবাক হয়৷ এ চিত্র যে উলটো তাদের বাড়ি। সবসময় মা বকাঝকা করে আর বাবা তাদের বাঁচায়। কি হলো আজ?

“মার্জিয়া আমি যখন আমার মেয়েদের সাথে কথা বলবো তুমি মাঝে থাকবে না।”
মার্জিয়া বেগম কিছু বলতে যেয়েও চুপ করে যায়।
প্রিয়তাই মুখ খোলে প্রথম।
“বাবা, মা বলেনি তোমাকে?”
“হ্যা বলেছে, তোমার মুখেই শুনি।”
প্রিয়তা একবার পেখমের দিকে তাকিয়ে মাথা নিচু করে ফেলে। বাবার চোখের দিকে তাকিয়ে মিথ্যা বলার সাহস তার কোনোদিনই হবে না।

“বাবা আমরা তো রুনাদের বাড়ি গিয়েছিলাম। রুনাকে চিনেছো তো?”
“হ্যা তোমার বান্ধবী।”
“আসলে অনেক দিন কলেজে যাওয়া হয়নি তো। সামনেই পরীক্ষা, তাই ভাবলাম……”
“তাই ভাবলে এই রাতেই সব পড়া শেষ করে আসবে নাকি?”
প্রিয়তা চুপ করে যায়। বাবার কথা স্বাভাবিক মনে হচ্ছে না। বাবা এভাবে খুব একটা কথা বলে না তাদের সাথে, বাবা কি টের পেলো কিছু? ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে যায় প্রিয়তা।
পেখম হালকা হেসে বললো,”বাবা আমরা বেরিয়েছিলাম তো সেই সন্ধ্যার আগেই। ফিরতে ফিরতে দেরি হলো। আসলে রুনা আপার মা আমাদের নাশতা না করিয়ে ছাড়লেনই না।”
“নাশতা করে এসেছো?”
পেখম আস্তে আস্তে মাথা নাড়ে।”
“তবে যাই হোক, তোমাদের একটা ভুল হয়েছে।”
“কি ভুল বাবা?”
“নাশতা করার সময় রুনাকে বলে দিলেই পারতে তোমাদের বাবা ফোন দিলে যেনো মিথ্যা না বলে সত্যটাই বলে যে তোমরা ওখানে আছো।”
দুই বোনের মুখ ঝুলে যায়। তার মানে বাবা রুনাকে ফোন দিয়েছিলো? ইশ, কি ভুলটাই না হয়েছে রুনাকে আগে থেকে সবটা না জানিয়ে। এমন ভুল কেউ করে? উচ্ছ্বাস ভাই ঠিকই বলে, সে বোকা। শুধু বোকা না, বোকার হদ্দ।

“কি হলো? রুনা আমাকে মিথ্যা বললো কেনো যে তোমরা ওখানে যাওনি?”
প্রিয়তা আর পেখম আচমকাই বাবার পায়ে লুটিয়ে পড়ে। চিৎকার করে কেঁদে দেয় দুই বোনই। কবির শাহ বাঁধা দেয়না৷ শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে ঠাঁয়।
“বাবা আমাদের ক্ষমা করে দাও, আর কখনো এমন হবে না।”
“কখনো এমন হবে কি হবে না জানতে চাচ্ছিনা। তোমরা আজ আমাকে নিজের কাছেই ছোট করে দিয়েছো। আমি যে অহংকার সবসময় করেছি, তা হলো তোমাদের নিয়ে, তোমাদের শিক্ষা নিয়ে। তোমাদের আমি সর্বশুদ্ধ মানুষ করার প্রত্যয় নিয়েছিলাম। সবার বিরুদ্ধে যেতেও দুইবার ভাবিনি তোমাদের স্বার্থে। আর যাই হোক, আমার দুই মেয়ে মানুষ হিসেবে খাঁটি হবে এটাই আমার প্রত্যাশা ছিলো। আমি কোনোদিন ভাবিনি তোমরা আমার সামনে মিথ্যা কথা বলবে। পরীক্ষায় খারাপ ফলাফল করায় আমি কোনোদিন তোমাদের রাগ করিনি। তোমার মা করলেও আমি বাঁধা দিয়েছি। মানুষ তৈরির পরীক্ষায় যেনো কখনো খারাপ ফলাফল না দেখি এটাই চেয়েছি সারাজীবন। স্কুল ছুটির পর ক্লান্তিতে হাত-পা অবশ হয়ে আসলেও, আরো কয়টা টিউশন বেশি করিয়ে বাড়ি ফিরেছি। দু’টো টাকা বেশি আসলে যেনো আমি আমার মেয়েদের জন্য কিছু করতে পারি। আমার সর্বোচ্চ দিয়ে চেষ্টা করেছি তোমাদের মুখে হাসি ফোটাতে। কিন্তু আজ মনে হচ্ছে সব ভুল ছিলো, আমি ব্যর্থ একজন বাবা হিসেবে। আমার সব কষ্ট ব্যর্থ।”
মার্জিয়া বেগম থাকতে না পেরে কবির শাহের কাঁধে এসে হাত রাখে।
“তুমি কি লঘু পাপে ওদের গুরুদণ্ড দিচ্ছো না? আগে শোনো ওরা কই গিয়েছে, কেনো মিথ্যা বললো। তুমি জানো তোমাকে মেয়েরা পৃথিবীর সবচেয়ে ভালো মানুষ হিসেবে জানে, ভালোবাসে সবচেয়ে বেশি। ওদের এতো কঠিন কথা কেনো শোনাচ্ছো?”
“ওদের কথা শোনাচ্ছি না মার্জিয়া। বরং ওরা প্রমাণ করে দিলো আমি একজন ব্যর্থ বাবা। আর কি বললে লঘু পাপে গুরুদণ্ড? তুমি যদি বুঝতে পারতে আজ কতোটা কষ্ট পেয়েছি আমি, তাহলে উল্টোটাই বলতে।”
“বাবা আমাদের ক্ষমা করে দাও। বললাম তো আর কোনোদিন এই ভুল হবে না। তুমি যে শাস্তি দিবে তাই আমরা খুশি মনে মেনে নিবো বাবা। তাও আমাদের সাথে এভাবে কথা বলোনা তুমি।”
“পায়ের কাছ থেকে উঠে এসো। তোমাদের মাথা সর্বদা সমুন্নত দেখতে চেয়েছি, এরকম নিচু না।”
“না বাবা তুমি আমাদের ক্ষমা না করলে আমরা উঠবো না। আগে শাস্তি দাও।”
“শাস্তি চাও তোমরা? বেশ উঠে এসো, শাস্তি দিবো।”
প্রিয়তা আর পেখম হাত ধরাধরি করে উঠে দাঁড়ায়, দুইজনের হাতই বরফের মতো ঠান্ডা।

“দেখো তোমরা অনেক বড় হয়ে গিয়েছো। এতোটাই বড় হয়ে গেলে যে আজকাল নিজেদের সিদ্ধান্ত নিজেরাই নেওয়া শুরু করেছো। তাই শাস্তিটাও তেমন হওয়া উচিত তাইনা?”
প্রিয়তা নাক টানতে টানতে বললো,”বাবা তুমি আমাদের মারো।”
“গায়ে হাত তোলা আমার পছন্দ না। তবুও হয়তো রাগে দুই একবার করেছি আমি, আমার ভুল ছিলো আমি রাগ সামলাতে পারিনি। তবে আজ তোমাদের মারবো না।”
কবির শাহ সবার উপরে একবার চোখ বুলিয়ে নেয়।

“যতক্ষণ তোমরা না বলছো তোমরা কোথায় গিয়েছিলে, মিথ্যা বলার-ই বা কি প্রয়োজন হলো। ততক্ষণ তোমরা আমাকে বাবা বলে ডাকবে না। কথাও বলবে না আমার সাথে।”
“বাবা……”
“সময়টা যদি কয়েকদিন বা কয়েক মাসও হয়ে যায় তবুও না। আর যাই হোক, মিথ্যা বলা আমার পছন্দ না। আর আমার মনে হয় এরচেয়ে বড় শাস্তি তোমাদের জন্য আর কিছু না।”
মার্জিয়া দৌড়ে এসে প্রিয়তার হাত ধরে বললো,”বলে দে না বাবাকে, কোথায় গিয়েছিলি।”
প্রিয়তা সজল চোখে তাকায় মায়ের দিকে।
“মার্জিয়া জোর করোনা। ওরা নিজে থেকে যখন বলতে চাইবে তখনই বলুক। এ নিয়ে আর কোনো কথা শুনতে চাইনা। আমার খুব ক্লান্ত লাগছে, আমি ঘরে যাচ্ছি।”
কবির শাহ একটা লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চলে যায়। মার্জিয়া বেগমও কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে চলে যায়।
প্রিয়তা আর পেখম স্তম্ভিত হয়ে দুইজন দুইজনের হাত ধরে দাঁড়িয়ে থাকে।

গেটে কোনো গার্ড না দেখে উচ্ছ্বাস কিছুটা অবাক হয় কিন্তু বিব্রত হয়না। বাঘের গর্তে হাত দেওয়ার আগে যে তাকেও সেইমতোই শক্তিশালী হতে হবে সে জানে। আর তার শক্তি হলো মনোবল। মনোবল ছাড়া এখন তার আর কোনো শক্তি নেই।

বাড়ির সামনের দরজাও খোলা, হালকা আলো আছে সিঁড়ির কাছে। উচ্ছ্বাসের একবার মনে হচ্ছে মানুষটা জানে সে আসবে। আর তাই এভাবে তাকে স্বাগতম জানাচ্ছে। ঠোঁটের কোণায় একটা হাসি ফুটে ওঠে তার।
বিশাল ড্রয়িংরুমটার মধ্যে উচ্ছ্বাস একা দাঁড়িয়ে আছে। চারদিকে নিকষ কালো আঁধার না হলেও তেমন কিছু দেখাও যাচ্ছেনা। অন্ধকারটা চোখ সয়ে নিতে বেশ সময় লাগে।

“উচ্ছ্বাস তুমি এসেছো? আমি জানতাম তুমি আসবে। তোমার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম আমি।”
উচ্ছ্বাস কিছুটা চমকে যায়। এদিক ওদিক তাকিয়ে খোঁজে শব্দের উৎস। সে বুঝতে পারে অন্ধকারের মধ্যে মানুষটা বসে আছে।
“আপনি জানতেন?”
“জানতাম, জানতাম। প্রিয়তা বোকা, কিন্তু তুমি নও।”
উচ্ছ্বাস শব্দ করে হাসে। হঠাৎ হেসে হঠাৎই থামিয়ে দেয়।
“সেই বোকা মেয়েটার পিছে পড়েছেন কেনো এভাবে?”
“দেখো প্রিয়তাকে নিয়ে আমার কোনো মাথাব্যথা নেই। সে এমন কোনো আগুনসুন্দরীও নয় যে তাকে না পেলে মারাই যাবো। আসলে তার পিছে পড়ে থাকার একমাত্র উদ্দেশ্য তুমি।”
“আমি?”
“হ্যা তুমি। আমি সেদিনই বুঝতে পেরেছি, যেদিন ওদের বাড়ি তোমাকে প্রথম দেখেছি। তুমি-ই আমার বিজনেস পার্টনারদের ভাইয়ের ছেলে, যার বাবা-মাকে ওরা খু’ন করেছে। আমার অনেকদিনের নজর ছিলো তোমার উপর। কবির শাহ তোমাকে আশ্রয় না দিলে অনেক আগেই খুঁজে পেতাম। আমি এটাও জানতাম তুমি প্রতিশোধ নিতে চাও।”
“এতোসবের মধ্যে প্রিয়তাকে ব্যবহার করলেন কেনো?”
“ওইযে বললাম ও বোকা, সহজেই আমার ফাঁদে পা দিয়েছে। আমার প্রেডিকশন ছিলো দুইটা। এক তুমি আমার কাছে আসবে নাহয় সত্যিই পুলিশের কাছে ধরা দিবে। তবে তুমি বুদ্ধিমান, তুমি বুঝে গিয়েছো সেই বিজনেস পার্টনার, শিল্পপতি আসলে কে।”
“নীলুকে ব্যবহার করেছেন এজন্যই?”
“নীলু আমার সাথে প্রতারণা করেছে। অসভ্য মেয়েটা আমার সাথে ভালোমানুষির নাটক করেছে তবে বেশি কিছু করার সাহস পায়নি। প্রিয়তাকে বলেনি আমার নাম। তবে ঠিকই কিছু প্রমাণ যোগাড় করেছে আমার বিরুদ্ধে। বোকা মেয়েটা ভেবেছিলো ও কোর্টে প্রমাণ নিয়ে হাজির হবে, আর আমি কিছুই জানতে পারবো না।”
উচ্ছ্বাস মুচকি হেসে বললো,”কোর্টে ও পৌঁছানোর আগেই ওকে আপনি আটকাতেন যেভাবেই হোক আমি জানি। এতে আপনার দুইটা লাভ হতো, আমার উপর সব দায় দিয়ে আমাকে ফাঁ’সির দড়িতে ঝুলাতেন, আপনার কোনো শাস্তি হতো না। আর দ্বিতীয়ত, প্রিয়তাকে পেয়ে যেতেন। ওর বড় ভাই নেই, মাথার উপর ছায়া বলতে বৃদ্ধ বাবা। মেয়ে পাচারের ব্যবসাটা তো ভালোই চলছে, তাইনা?”
শব্দ করে হাসির আওয়াজ আসে। আকাশ পাতাল কাঁপিয়ে হাসার আওয়াজ। উচ্ছ্বাস বিন্দুমাত্র বিভ্রান্ত হয়না, সে জানে তাকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করা হচ্ছে।

“তুমি আসলে অসম্ভব বুদ্ধিমান একজন মানুষ, আমাকে বলতেই হচ্ছে। সুদর্শন রূপের চেয়ে একটা পুরুষ মানুষের যে দিকটা মেয়েরা পছন্দ করে তা হলো তার ক্ষুরধার বুদ্ধি। প্রিয়তা এবং সেই সাথে নীলুও শুধু শুধু তোমার প্রেমে পড়েনি বুঝতে পারছি। তোমার বুদ্ধি আর ব্যক্তিত্বের প্রেমে পড়েছে তারা। আই মাস্ট সে, আমি মেয়ে হলে আমিও বোধহয় তোমার প্রেমে পড়তাম।”
উচ্ছ্বাস ভ্রু কুঁচকে বললো,”আপনি পুরুষ?”
“তার মানে?”
“আমার তো মনে হয় আপনিও মেয়ে। দূর্বল পুরুষ মানুষকে আমার ঠিক পুরুষ মনে হয়না। হতে পারে পুরুষ বা মহিলার মাঝামাঝি কিছু। খাঁটি বাংলা ভাষায় যাদের বলে নপুংসক।”
“হাউ ডেয়ার ইউ।”
বাজখাঁই চিৎকারে মনে হলো পুরো বাড়িটা কেঁপে উঠছে। কিন্তু উচ্ছ্বাস একবিন্দুও ভীত হয়না, বরং ভীষণ শান্ত থাকে।
“আপনার খেলা শেষ নিয়াজ মোর্শেদ। অনেক তো খেললেন, এবার ব্যাটিংটা আমি-ই করি।”
“এই তুই কি করবি? এক্ষুনি আমার লোকেরা তোকে শেষ করে দিতে পারে তুই জানিস? তুই বাড়িতে ঢোকার সাথেই পুরো বাড়ি ঘিরে ফেলেছে ওরা। হয় লা’শ হয়ে বের হবি নাহয় জীবিত অবস্থায় বের হয়ে জেলে ঢুকবি। কয়দিন পরই ফাঁ’সি হয়ে যাবে তোর। কে বাঁচাবে তোকে? সব প্রমাণও তোর বিরুদ্ধে।”
“চিৎকার করলেই পুরুষ হওয়া যায়না রে পাগলা। পুরুষের সাথে লড়তে পুরুষই হওয়া লাগে। আমার তো লজ্জা লাগছে তোর মতো একটা নপুংসকের সাথে লড়তে। এটা আমারই অপমান।”
“আমি কিন্তু এবার আমার লোকদের ডাকবো।”
“ডাক, ডাক না। দেখি কয়জনকে রেখেছিস আমার একার জন্য। তোর আমার পার্থক্যটা দেখলি তো? তুই আমাকে মারতে পুরো বাড়ি ঘিরে রেখেছিস মানুষে, আর আমি তোর স্থানে এসেছি, আর একা এসেছি। ডাক না তাদের, তোর মতো কয়টা হাফ লেডিসের জন্য উচ্ছ্বাস একাই যথেষ্ট।”
হালকা আলোয় মুখোমুখি নিয়াজ-উচ্ছ্বাস। উচ্ছ্বাসের মুখে রহস্যময় হাসি। নিয়াজ কিছুটা পিছিয়ে যায়। তার মনে ভয় ঢুকেছে। উচ্ছ্বাস দাঁত বের করে হাসে। নিয়াজ আরো ভয় পেয়ে যায়। গোঁ গোঁ আওয়াজ বের হতে থাকে মুখ দিয়ে। উচ্ছ্বাস জানে তাকে এখন কি করতে হবে।

“বাবা আসবো?”
কবির শাহ দরজার দিকে না তাকিয়েই উত্তর দেয়,”এসো।”
মার্জিয়া কবির শাহের মাথার কাছে বসে ছিলো, মেয়েদের দেখে উঠে দাঁড়ায়।
“তোমরা কথা বলো, আমি আসছি।”
“মার্জিয়া আমি পৃথিবীতে এমন কোনো গোপন কথা কারো সাথে বলবো না যেখানে তোমার উপস্থিতি থাকতে পারেনা। তুমিও থাকো।”
মার্জিয়া চুপ করে দাঁড়ায়।
প্রিয়তা ভয়ে ভয়ে ঢোক চাপে। পেখমের মুখও ফ্যাকাশে।

“যদি কিছু বলতে এসে থাকো, বলে চলে যেতে পারো। আমি বিশ্রাম করবো। সারাদিন অনেক ধকল গেছে।”
প্রিয়তা আর পেখম হঠাৎ ছুটে আসে। বাবার বুকের উপর আছড়ে পড়ে দুই বোন। তাদের কান্নার শব্দে মার্জিয়াও চোখের পানি মোছে।
“বাবা তুমি আমাদের এমন শাস্তি কেনো দিলে? আমাদের মেরে ফেলো তারচেয়ে, তবুও এই শাস্তি আমাদের দিও না।”
“তোমরা অনেক বড় হয়েছো মায়েরা। এতোটাই বড় হয়েছো যে আমি তোমাদের এরচেয়ে কম শাস্তি দিতে পারলাম না।”
“আমরা বড় হইনি বাবা, আমরা একদম বড় হইনি।”
“নিজেদের সিদ্ধান্ত নিজেরা নিচ্ছো, বাবাকে জানানোর প্রয়োজন মনে করছো না। এখনো ছোট আছো বলছো?”
প্রিয়তা ফোঁপাতে ফোপাঁতে বললো,”তুমি জানলে খুব রাগ করতে বাবা। তাই তোমাকে বলার সাহস পাইনি।”
“সৎপথে থাকলে কাউকে ভয় পেতে নেই এই শিক্ষা কি তোমাদের দিইনি আমি? তাহলে কি তোমরা অসৎ কোনো কাজ করেছো?”
পেখম হতাশ চোখে বাবার দিকে তাকিয়ে বললো,”তোমার তাই মনে হয় বাবা? আমরা এমন কিছু করতে পারি?”
“মনে হয়না। এজন্যই আশা করেছিলাম আমাকে জানাবে তোমরা, ভয় পাবে না।”
পেখম প্রিয়তার দিকে তাকায়। প্রিয়তা একটা লম্বা শ্বাস ফেলে। সে ঠিক করে সে বাবাকে সব বলবে। এখন আর লুকিয়ে কি হবে?

কবির শাহ বরফের মতো ঠান্ডা হয়ে বসে আছে। মার্জিয়া হতবাক হয়ে একবার প্রিয়তার দিকে আরেকবার কবির শাহের দিকে তাকায়। সবকিছু কেমন অস্বাভাবিক লাগছে তার। মনে হচ্ছে সব ঠিক নেই, কিছু তো গন্ডগোল আছেই।
“আর তোমরা এতো বড় একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলে ওই মেয়ের কথা শুনে?”
প্রিয়তা মৃদু গলায় বললো,”বাবা আমার আর কিছু করার ছিলোনা।”
“উচ্ছ্বাস এখন কোথায়? পুলিশের কাছে ধরা দিতে গেছে?”
“জানিনা বাবা। আমরা আর কিচ্ছু জানিনা উনি এখন কোথায়।”
কবির শাহ কম্পিত গলায় মেয়েদের দিকে তাকিয়ে বললো,”এটা তোমরা কি করলে? কি সর্বনাশ করলে তোমরা? উচ্ছ্বাস, আমার উচ্ছ্বাস।”
কবির শাহ বুকে হাত চেপে বসে পড়ে। মার্জিয়া ছুটে আসে তার কাছে। প্রিয়তা আর পেখম ভয়ার্ত চোখে বাবার দিকে তাকিয়ে থাকে৷ আসলেই কি কোনো অন্যায় করে ফেললো তারা? কি করবে এখন?

(চলবে……)

#তুমি_প্রেম_হলে_আমি_প্রেমিক

পর্ব: ২৯

চাপা উত্তেজনায় সারারাত ঘুম হয়নি প্রিয়তার। ভোরের দিকে চোখটা একটু লেগে এসেছিলো। কিন্তু সেই ঘুম বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়নি। সকাল সাতটা বাজতে না বাজতেই ঘুমটা আবার ভেঙে গেছে। ঘুম ভাঙতেই লাফ দিয়ে বিছানায় উঠে বসে। প্রতিটা রেজাল্টের আগেই তার এমন অনুভূতি হয়। শরীর কাঁপে, অবসাদ লাগে সবকিছুতে। এতোগুলো বছরে এতো কিছু বদলে গেলেও এই জিনিসটাই বদলাতে পারলো না এখনো। এখনো রেজাল্টের সময় আসতেই বুক কাঁপতে থাকে তার ধকধক করে। তার বাবা এতো করে বুঝায় তাকে যে যা হওয়ার তাতো হয়েই গেছে, এতো দুশ্চিন্তা করে কি হবে? কিন্তু মন মানতে চায়না কিছুতেই।

তবে আজকের রেজাল্ট মোটেই সামান্য হয়। তার মেডিকেল লাইফের সর্বশেষ প্রফের রেজাল্ট। এতোগুলো বছরের কতোশত রাত জাগা, অসম্ভব পরিশ্রম, চোখের নিচের কালো দাগ সবকিছুর ফলাফল আজ। পাঁচ বছর সে নিজের সবটা দিয়ে চেষ্টা করেছে নিজের অবস্থান পাকাপোক্ত করার, বাবার মুখ উজ্জ্বল করার আর একটা মানুষকে একদম নিজের করে পাওয়ার। আজকের দিনটার উপর অনেক কিছু নির্ভর করছে। আজ পাশ করলে আপাতত কিছুটা চিন্তামুক্ত। এরপর এক বছরের ইন্টার্নশিপ তার পরেই সে ডাক্তার। হ্যা, সে ডাক্তার হবে। এরচেয়ে শান্তির আর কি হতে পারে? তার বাবা তাদের নিয়ে যে অহংকার করতো, সে তার মর্যাদা রাখতে যাচ্ছে। মেয়ে হিসেবে তার আর কিছুই চাওয়ার নেই।

“কি রে এতো সকালে উঠে পড়েছিস যে?”
“মা কলেজে যাবো, তৈরি হতে হবে।”
মার্জিয়া কিছুটা অবাক হয়ে বললো,”তোর মাথা ঠিক আছে? মাত্র সাতটা বাজে। রেজাল্ট দিবে সেই এগারোটায়। এতো তাড়াতাড়ি কলেজে যেয়ে কি করবি তুই?”
ঘড়ির দিকে তাকাতেই মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে যায় প্রিয়তার। আজ সময়টা যাচ্ছেই না কোনোভাবে। আধা ঘন্টা ধরে মনে হচ্ছে ঘড়ির কাঁটা সেই সাতটা দশের ঘরেই পড়ে আছে।
মার্জিয়া হালকা হেসে প্রিয়তার মাথায় হাত রাখে।
“নরম করে পরোটা ভেজেছি, তোর খুব পছন্দ তো। একটু খাইয়ে দিই?”
প্রিয়তা হতাশ মুখে মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো,”মা এখন আমার গলা দিয়ে একটা শস্যদানাও নামবে না।”
“প্রতিটা রেজাল্টের আগে তোর এই দুশ্চিন্তাগুলো দেখলে মনে হয় দুনিয়ায় ভালো রেজাল্টের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আর কিছুই নেই। সবসময় এতো দুশ্চিন্তা করলে সামনে এগোবি কীভাবে?”
প্রিয়তা কথা বাড়ায় না। এখন তার কারো কোনো কথা শুনতে ইচ্ছা করছে না। চুপচাপ দরজা খুলে বাগানে এসে বসে। ইদানীং কবির শাহের শখ হয়েছে বাগান করার। স্কুল থেকে ফেরার পথে রোজই কোনো না কোনো গাছ কিনে আনছে আর মহাসমারোহে সেই গাছ লাগানো হচ্ছে বাড়ির সামনের ছোট্ট জায়গাটায়। কিন্তু এতো গাছ এতোটুকু জায়গায় আর ধরছে না। পেখম তো বলে তার বাবা নাকি বাগান করতে যেয়ে জঙ্গল বানিয়ে দিচ্ছে। প্রিয়তার যদিও খারাপ লাগে। সে ঠিক করেছে সে যখন বড় ডাক্তার হবে, বাবাকে বড় এক খণ্ড জমি কিনে দিবে বাড়ির পাশেই। বাবা সেখানে ইচ্ছামতো গাছ লাগাবে, বাগান করবে। বাবার ইচ্ছাগুলো তারা পূরণ করবে না তো কে করবে?

বাগানে আসতেই মনটা ভালো হয়ে যায় প্রিয়তার। বেশ অনেক ফুল ফুটেছে গাছে। সবচেয়ে বেশি যেটা নজর কাড়ছে তা হলো হলুদ রঙা জবাটা। এই রঙের জবা খুব বেশি দেখা যায়না সচারাচর। তবে তার বাবা কোথা থেকে যেনো যোগাড় করে এনেছে। যেদিন এই ফুল ফোটে সেদিন কবির শাহ যতোটুকু সময় বাড়ি থাকে, একটু পর পর বাগানে উঁকি দেয়। তার ধারণা এই হলুদ জবাটা তার বড় মেয়ে, প্রিয়তা।

“এ কি রে মা, এতো সকালে তুই?”
এটা সত্যি, মেডিকেলে ভর্তির পর থেকে প্রিয়তা সকালে খুব বেশি উঠতে পারেনা। প্রায় রোজই সারারাত জেগে পড়াশোনা করে ফজরের নামাজ পড়ে ঘুমাতে যায়। তারপর উঠেই তড়িঘড়ি করে নাশতা করেই কলেজের উদ্দেশ্যে দৌড়। এভাবেই চলেছে তার বিগত পাঁচটা বছর।

প্রিয়তা সুন্দর করে হাসে বাবার দিকে তাকিয়ে। তার বাবা সকাল সকাল বাগানে চলে এসেছে। আগাছা কাটবে, গাছে পানি দিবে অনেক কাজ তার।
“ভাবতেই অবাক লাগছে রে মা, আমি একজন ডাক্তারের বাবা। কিছু বছর পর, সবাই আমার দিকে আঙ্গুল তুলে বলবে, ওইযে দেখো এতো বড় ডাক্তার প্রিয়তার বাবা উনি। এই এক জীবনে আর কি চাওয়ার আছে আমার?”
প্রিয়তা ম্লান হাসে। সময় যাচ্ছে আর দুশ্চিন্তাও সমানুপাতিক হারে বাড়তেই আছে তার। বাবার কথাগুলো শুনে ভয় আরো বেড়ে যায়। আজ যদি সে পাশ করতে না পারে? অজানা আশঙ্কায় বুকটা কেমন ধড়ফড় করে ওঠে।

“কি রে মা, তুই কি দুশ্চিন্তা করছিস কিছু নিয়ে?”
প্রিয়তা কান্নাভেজা গলায় বললো,”বাবা আমি যদি পাশ করতে না পারি? তাহলে তো সবাই তোমাকে বলবে ফেল্টুস প্রিয়তার বাবা যাচ্ছে দেখো।”
প্রিয়তা কথা শেষ করতেই কেঁদে দেয়। কবির শাহ হো হো করে খানিকক্ষণ হাসে।
“তুই এতো বড় হয়ে গেলি, আজ বাদে কাল ডাক্তার হয়ে যাবি এখনো তোর এই ছিঁচকাঁদুনে স্বভাবটা গেলো না।”
“বাবা সত্যিই আমার খুব ভয় করছে।”
কবির শাহ মিনিট খানিক কি যেনো চিন্তা করে চুপচাপ।

“নদীর ঘাটে যাবি?”
“এখন?”
“চল তো, স্কুলে যাওয়ার আগেই চলে আসবো।”
প্রিয়তা না করতে পারেনা। নদীর ঘাট অসম্ভব প্রিয় জায়গা তার। তার উপর বাবার সাথে সেখানে ঘুরতে যাওয়ার মতো আনন্দ আর হতেই পারে না। প্রিয়তা রাজি হয়ে যায়। অন্তত কিছু সময় তো সব চিন্তা ভুলে থাকা যাবে।

শীত শীত আবহাওয়া, প্রিয়তার ভীষণ ভালো লাগছে এই ঠান্ডা আবহাওয়াটা। নদীর শীতল বাতাস আসছে। প্রিয়তা পাতলা একটা জামা পরেই চলে এসেছে। ওড়নাটা পেচিয়ে নিয়েছিলো ঠান্ডায়। কবির শাহ তাই দেখে নিজের চাদরের মধ্যে মেয়েকে নিয়ে এসেছে। প্রিয়তাও বাবার বুকের কাছে এসে গুটিশুটি মেরে বসে থাকে। এতো ভালো লাগছে ওর। ঠিক যেনো সেই ছোট্ট প্রিয়তা আর কমবয়সী কবির শাহ। এভাবেই শীতের দিনে নিজের চাদরের মধ্যে পেচিয়ে রাখতো মেয়েকে। অদ্ভুত সুন্দর একটা গন্ধ পাওয়া যেতো বাবার শরীর থেকে। প্রিয়তা এখনো সেই গন্ধটা পাচ্ছে। একটু পাল্টায়নি যেনো। কিসের গন্ধ কে জানে!

“প্রিয়তা।”
“বলো বাবা।”
“তুই কি আমার উপর রেগে আছিস?”
“বাবা, তুমি কীভাবে ভাবতে পারো আমি তোমার উপর রাগতে পারি? তুমি তো আমার জীবনের সবটাই বাবা। কেনো রাগ করবো তোমার উপর?”
প্রিয়তার কথায় চোখটা ভিজে আসে কবির শাহের। মেয়েটা এতো মায়া মায়া করে কথা বলে সবসময়।

“আমি উচ্ছ্বাসের কাছে সময় চেয়েছিলাম। আমি ওকে বলেছিলাম তোকে সময় দিতে। তুই আজ যে পর্যন্ত এসেছিস, কোনো সম্পর্কে জড়িয়ে গেলে এ পর্যন্ত আসতে পারতিস কিনা আমি জানিনা। বাবা হিসেবে এটুকু করা কি অন্যায় হয়েছে আমার?”
প্রিয়তা কিছুটা অপ্রস্তুত পড়ে। মাথা নিচু করে গাঢ় গলায় বলে,”বাবা তুমি যা করেছো ঠিকই করেছো। সত্যিই আমি সেসময় আবেগকে প্রশ্রয় দিলে এ পর্যন্ত আসতে পারতাম না। আমার পড়াশোনায়ও ভাটা পড়েছিলো। উচ্চ মাধ্যমিকেও আশানুরূপ ফলাফল করতে পারিনি আমি সেসময়ের হাজারটা টানাপোড়েনের মধ্যে। পরবর্তী সময়টাও এভাবে কেটে গেলে আজকের এই অবস্থায় আমি আসতে পারতাম না বাবা।”
“কিন্তু উচ্ছ্বাস যে তার পর থেকে একটা বারও এলো না, খোঁজ নিলো না আমাদের। ও কি অনেক বেশি রেগে আছে আমার উপর? আমার সিদ্ধান্তে কি ও খুশি হতে পারেনি?”
প্রিয়তার চোখ জ্বালা করে ওঠে। সে ভেবেছিলো উচ্ছ্বাস ভাই তার সেই কম বয়সের আবেগ। যাকে হয়তো কিছুদিন চোখের সামনে না দেখলে ভুলে যাবে, প্রেম আর থাকবে না। কিন্তু না, সে ভুল। উচ্ছ্বাস ভাইয়ের ভাষায় যাকে বলে মাথামোটা, সে তাই। উচ্ছ্বাস ভাই তার কাছে কোনো আবেগের নাম ছিলো না। সে ছিলো তার প্রথম প্রেম, প্রথম ভালোবাসা কিংবা প্রিয়তা নামক অতি সাধারণ মেয়েটার অসাধারণ হৃদয়ের একচ্ছত্র অধিপতি। এই পাঁচটা বছরে এমন কোনো দিন যায়নি, এমন কোনো রাত যায়নি সে উচ্ছ্বাস ভাইকে স্মরণ করেনি। অ্যানাটমি কিংবা ফরেনসিক মেডিসিন বইয়ের মধ্যে রাত দু’টো কিংবা তিনটায় যখন বুঁদ সে, হঠাৎ করেই ওই উজ্জ্বল ফর্সা বরণের পুরুষটার মুখাবয়ব ভেসে উঠতো তার চোখের সামনে, যার মুখভর্তি খোঁচা খোঁচা দাড়ি, ঠোঁটের কোণায় জ্বলন্ত সিগারেট। সে চাইলেও, শত চেষ্টা করেও সরাতে পারতো না মুখটা। এক মগ ধোঁয়া ওঠা কফি নিয়ে রাত চারটায় যখন মাইক্রোবায়োলজি পড়তে পড়তে ক্লান্ত হয়ে জানালার পাশে দাঁড়াতো, তখন ঠিক মনে হতো উচ্ছ্বাস ভাই হয়তো হঠাৎ করে এসে হাজির হবে জানালায়। তাকে নিয়ে ওই রাতেই হাঁটতে যেতে চাইবে সুনসান, নীরব, জনমানবহীন রাস্তায়। কিন্তু না, এই পাঁচ বছরে একটা বারের জন্যও মানুষটা আসেনি তার সামনে। কর্পূরের মতো একরকম যেনো উবে গেছে মানুষটা। শুধু মাত্র কবির শাহের কথায়? নাকি সত্যিই প্রিয়তার জন্য তার মনে কোনো জায়গা তৈরি হয়নি? সবই ছিলো কম বয়সী মেয়েটাকে প্রেমে ফেলার ফাঁদ? সে উত্তর আজও পায়না প্রিয়তা। আজও অধীর আগ্রহে পথ চেয়ে বসে আছে সে। যদি আসে, যদি আসে। একরাশ অভিমান কি তার বুকেও জমেনি? জমেছে, জমেছে। কিন্তু কাউকে কিছু বুঝতে দেয়নি। অনেক প্রেমের প্রস্তাবও পেয়েছে মেডিকেল কলেজে। কাউকে মনে ধরেনি, ভুলেও কাউকে সম্মতি জানাতে ইচ্ছা করেনি। মনের কোণায় কখনো আসেনি এই মনের জমিনে অন্য কোনো পুরুষকে ঠাঁই দিতে। কিন্তু উচ্ছ্বাস? সে কি তবে অন্য কাউকে খুঁজে পেয়েছে? যার মায়ার জালে আটকা পড়ে ভুলেই গেছে তাকে? প্রিয়তা শিউরে ওঠে, আর কিছু ভাবতে পারেনা সে। ভাবলেই বুকটা মোচড় দিয়ে ওঠে তার।

“প্রিয়তা।”
বাবার ডাকে ধাতস্থ হয় প্রিয়তা।
“বলো বাবা।”
“উচ্ছ্বাস কি রাগ করেছে আমার উপর? আমি তো তোদের ভালো চেয়েছি। বাবা হিসেবে এই চাওয়া কি আমার অন্যায় ছিলো?”
“তোমরা কেউ কোনো অন্যায় করোনি বাবা। যদি কোনো অন্যায় করে থাকি, সে আমি। শাস্তি পেলে আমিই পাবো।”
“এসব কি বলছিস তুই? তুই কোনো অন্যায় করতেই পারিস না।”
প্রিয়তা বিষাদমাখা মুখে ম্লান হাসে। কবির শাহের অসম্ভব কষ্ট হয় হাসি দেখে।
“যদি উনি কোনোদিন ফিরে আসে তাহলে মনে করবো আমি ঠিক ছিলাম, আমি ভুল মানুষকে বিশ্বাস করিনি। আর যদি ফিরে না আসে……”
প্রিয়তার গলা ধরে আসে, আর কিছু বলতে পারেনা। চোখের পানি লুকাতে অন্য দিকে তাকায়।
কবির শাহ একরাশ কষ্ট নিয়ে মেয়ের দিকে তাকায়। আজ প্রথম বারের মতো নিজের কোনো সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানাতে পারছে না সে। কিন্তু এ ছাড়া আর কি করার ছিলো? আর কি করতে পারতো সে বাবা হয়ে? কম বয়সী দুইটা ছেলেমেয়ের আবেগকে প্রশ্রয় দিতে ওদেরই ক্ষতি করে ফেলতো? সে তো শুধু একটু সময় চেয়েছিলো, আর কিছু না।

সেই পাঁচ বছর আগের এক মধ্য রাতে রক্তাক্ত অবস্থায় উচ্ছ্বাস যখন হাজির হয় তাদের বাড়িতে, কবির শাহ যেনো উন্মাদ হয়ে গিয়েছিলো। নিয়াজ মোর্শেদের লোক মারতে মারতে ছেলেটাকে আধমরা করে দিয়েছিলো। উচ্ছ্বাস একা ছিলো, কেউ আসেনি তাকে বাঁচাতে। সিংহের মতো একাই লড়ে কোনোরকমে নিজের প্রাণ বাঁচিয়ে আসতে পেরেছিলো উচ্ছ্বাস। কিন্তু সে রাতেই তাকে গ্রেফতার করা হয় কবির শাহের বাড়ি থেকে। কবির শাহ, মার্জিয়া, প্রিয়তা পুলিশের পা ধরেছিলো অন্তত তাকে চিকিৎসা টুকু করাতে দিতে। পুলিশ দেয়নি, ধরে নিয়ে যায় তাকে। এরপর বহু কাঠখড় পোড়ে, সহজ ছিলো না তাকে নির্দোষ প্রমাণ করা। শেষ পর্যন্ত এগিয়ে আসে নীলু, হ্যা সেই প্রিয়তার নীলু আপা। তার দেওয়া প্রমাণে নিয়াজ মোর্শেদ ফেঁসে যায়। যদিও এ যাত্রা মোটেই সহজ ছিলো না তার জন্য। নিয়াজ অনেক অত্যা’চারও করেছে তাকে যেনো কোনোভাবেই কোর্টে কিছু না বলে। কিন্তু সত্য হয়তো এমনই, কোনোদিন চাপা থাকে না। ফাঁ’সিকাষ্ঠের অনেক কাছ থেকে মুক্ত হয় উচ্ছ্বাস।

এতোদিনের সেসব কাহিনী মনে করে একটা বড় দীর্ঘশ্বাস ফেলে কবির শাহ। সেসব দিনের কথা মনে পড়লে এখনো বুকটা কেঁপে ওঠে তার। কি দুর্বিষহ কেটেছে দিনগুলো। তারমধ্যেই ছিলো প্রিয়তার উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা। এতোসবের মধ্যে কবির শাহ তো ভেবেছিলো পাশ করতেই পারবে না মেয়েটা। কিন্তু প্রিয়তা পাশ করে, ভালো ফল করতে না পারলেও পাশ করে। কবির শাহ ভয় পেয়ে যায়। এমন চলতে থাকলে মেয়ে তো নিজের ভবিষ্যৎ গড়তে পারবে না। মেধাবী মেয়েটা হারিয়ে যাবে একসময়। বাবা হয়ে কীভাবে পারতো সে এটা হতে দিতে? শেষ মুহূর্তে ভয়ংকর একটা সিদ্ধান্ত তাকে নিতেই হয়, ওদেরই ভালোর জন্য। উচ্ছ্বাসের কাছে কিছুটা সময় চায় সে। উচ্ছ্বাসও আর কোনো বাক্যব্যয় করেনি, একবাক্যে মেনে নেয় কবির শাহের কথা। সেই পাঁচ বছর যাবৎ কোনো খোঁজ নেই তার। যে ইচ্ছা করে হারাতে চায়, তাকে হয়তো খুঁজে পাওয়া যায়না। কিন্তু এই পাঁচ বছরের প্রতিটা দিন মেয়ের চোখের দিকে তাকাতে পারেনি সে ঠিক করে। বারবার অপরাধবোধে কুঁকড়ে গেছে সে। মনে হয়েছে বাবা হিসেবে আসলেই সে বড় একটা ভুল করে ফেলেছে। মেয়ের ক্যারিয়ারের কথা ভাবতে যেয়ে কি বাবা হয়ে মেয়ের হাসিটুকুই কেড়ে নিয়েছে সে আজীবনের জন্য? কিন্তু যদি তাই হয়, উচ্ছ্বাস কি সত্যি ভালোবেসেছে তবে প্রিয়তাকে? যদি ভালোবাসতোই, কেনো এখনো এলো না একটা বারের জন্যও? তবে কি একপাক্ষিক ভালোবাসায় তার মেয়েটাই হেরে গেলো? বাবা হয়ে মেয়ের এই কষ্ট সহ্য করবে কীভাবে সে? বুকটা কেমন হু হু করে ওঠে কবির শাহের।

কলেজের কোণার এক শান বাঁধানো ঘাটে বসে হাউমাউ করে কাঁদছে প্রিয়তা। কান্নার দমকে বারবার শরীর কেঁপে উঠছে তার। মুখ লাল হয়ে গেছে মুহুর্তেই।

“প্রিয়তা।”
প্রিয়তা চোখ মেলে তাকায় দেখে মেডিকেলের কলেজেরই এক বান্ধবী তিথি দাঁড়িয়ে আছে তার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে।
“প্রিয়তা তুমি ফেইল করেছো? এটা কীভাবে সম্ভব? তোমার মতো মেধাবী ছাত্রী আমাদের ক্লাসে কয়টা আছে? তুমি কীভাবে ফেইল করলে? না না আমরা এগুলো নিয়ে প্রতিবাদ করবো। সব কিছু স্যারদের ইচ্ছামতো হবে নাকি?”
প্রিয়তা বেশ অবাক হয়ে তিথির দিকে তাকায়। এই মেয়েটা অতিরিক্ত বেশি কথা বলে। দাঁড়িকমা ছাড়াই বলে যায়, ওর ডিকশনারিতে দাঁড়িকমা বলে কোনো শব্দ নেই হয়তো।
“ফেইল করেছো বলে কাঁদছো এভাবে? আসলে কাঁদারই কথা। তোমার বাবা মা বোধহয় অনেক বকবে তোমাকে। আমার বাবা মা হলেও বকতো। কি করবে বলো, আবার নাহয় পরীক্ষা দিও। আচ্ছা পাশ না করলে কি তোমাকে বিয়ে দিয়ে দিবে? এজন্যই কাঁদছো?”
প্রিয়তা অবাক হয়ে উঠে দাঁড়ায়। এই মেয়েটা কি বলছে এসব? আগা নেই মাথা নেই।
“তুমি কি বলছো আমি কিছু বুঝতে পারছি না তিথি।”
“থাক মন খারাপ করোনা। বিয়ে করাও খারাপ না। আমিও ইন্টার্নের পরই বিয়ে করে নিবো। তুমি নাহয় একটু আগেই করলে।”
প্রিয়তা ভ্রু কুঁচকে বললো,”আমার জীবনে আমি যতোগুলো বন্ধু পেয়েছি তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি কথা বলো তুমি। সীমান্ত এক্সপ্রেসের মতো ছুটতেই আছো। আমি ফেইল করবো কেনো? আমি পাশ করেছি তো।”
তিথি চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে বললো,”পাশ করলে এভাবে কাঁদছো কেনো?”
“আমি আনন্দে কাঁদছি তিথি। আজ আমার অদ্ভুত একটা আনন্দ হচ্ছে। আমার বাবার অনেক স্বপ্ন ছিলো আমাদের দুই বোনকে নিয়ে। তার স্বপ্ন পূরণের দ্বারপ্রান্তে আজ আমি। এই আনন্দেই এভাবে কাঁদছি আমি, বুঝেছো?”
তিথি সুন্দর করে হেসে দেয়, প্রিয়তাও কান্নার মধ্যে হেসে দেয়৷ সত্যি আজ তাদের বড্ড আনন্দের দিন। ডাক্তার হওয়ার যুদ্ধে আর মাত্র এক ধাপ বাকি, ইন্টার্নশিপ। তারপরেই তারা ডাক্তার, অনেক অনেক রাত জাগা কষ্টের ফসল এই দিনটা তাদের। আজ তারা হাসবে, কাঁদবে যা ইচ্ছা করবে। আজ দিনটা শুধুই তাদের।

মর্জিনা বেগম হতাশ মুখে বসে আছে কবির শাহের সামনে। খুব আফসোস হচ্ছে আজ তার প্রিয়তাকে দেখে। তার মেয়েটাও মেধাবী ছিলো, তার ইচ্ছা ছিলো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বে, বড় চাকরি করবে। কিন্তু ভাগ্যের ফেরে আজ কোথায় সেতারা আর কোথায় প্রিয়তা। আর বছর খানিক পরই প্রিয়তা ডাক্তার হয়ে যাবে, সবাই এক নামে চিনবে তাকে। আর তার সেতারা? স্বামী-শ্বশুরবাড়ির অত্যা’চারে কাটিয়ে দিবে বাকি জীবনটা। বাহ্যিকভাবে সে কতো সুখী। ভরি ভরি স্বর্ণের গহনা, দামী দামী শাড়ি। কিন্তু সেসব গহনার নিচে চওড়া কালশিটে দাগ কি কেউ দেখতে পায়? তবে আজ তার সত্যি আফসোস হচ্ছে, মেয়ের বাবার বিরুদ্ধে যেয়ে যদি একটা বার শক্ত হতে পারতো কবিরের মতো। তাহলে আজও তার মেয়েটা খুব ভালো কিছু কর‍তে পারতো। মেয়ের কথা ভাবতেই চোখটা বারবার ভিজে যাচ্ছে তার।

“তাহলে কবির তুমি জিতেই গেলে বলো শেষমেশ?”
কবির শাহ সুন্দর করে হাসে। হাসিটা মর্জিনা বেগমের বুকে যেয়ে বিঁধে, অপমানিত বোধ করে সে।
“সেতারাকে আমি নিজের মেয়ে ব্যতীত আর কিছু কোনোদিন মনে করিনি আপা। আমার এক মেয়ের সফলতা দেখে আরেক মেয়েকে ভুলে যাই কীভাবে? তার কষ্ট শেষ না হওয়া পর্যন্ত আমি জিতি কীভাবে?”
মর্জিনা বেগম শব্দ করে কেঁদে দেয়। কবির শাহ অপ্রস্তুত বোধ করে। মার্জিয়া দৌড়ে এসে আপাকে জড়িয়ে ধরে।
“মার্জিয়া রে, আমি তোর কাছে সারাজীবন ধরে ক্ষমা চাইলেও মনে হয়না ক্ষমা পাবো।”
“আপা এসব কথা কেনো বারবার বলে নিজে কষ্ট পাও আর আমাকে কষ্ট দাও? আমরা সেসব কথা কিছু মনে রাখিনি।”
“ওই নিয়াজ যে এতো বড় বদমাশ আমি জানতে পারিনি মার্জিয়া। আজ যদি আমার কথা শুনে ওর মতো একটা অসভ্যের সাথে তোরা প্রিয়তাকে বিয়ে দিতি তাহলে ওর জীবনটা এতো সুন্দর হতো না, কষ্টে কেটে যেতো। এ আমি কি করতে যাচ্ছিলাম।”
মার্জিয়া মিষ্টি করে হেসে কবির শাহের দিকে তাকায়, কবিরও তাকায়।
“এমনটা হতোই না আপা। আমি বোকা ছিলাম কিন্তু মেয়েদের যে এক জোড়া শক্ত হাত সর্বদা আগলে রেখেছে। এমন কীভাবেই বা হবে? তাকে দেখতে খুব সরল, সাধারণ একজন মানুষ মনে হলেও তার মেয়েদের জন্য সে একজন অগ্নিপুরুষ। আমি ভুল করতে চাইলেও সে যে ভুল করতে দিতো না।”
কবির শাহ অপার মুগ্ধতা নিয়ে স্ত্রীর দিকে তাকায়। বিয়ের পঁচিশ বছর পেরিয়ে ছাব্বিশ হতে যাচ্ছে, তবুও দিনদিন এই নারীটির উপর প্রেম বেড়েই যাচ্ছে কেনো তার? উত্তর পায়না কবির। মাথা নিচু করে মিটমিট করে হাসতে থাকে শুধু। মনে মনে বলে,’শুধু কি মেয়েদের আগলে রেখেছি? তোমাকে না?’

“আপা।”
কফির নেশাটা ইদানীং বেশ জোড়ালো ভাবে ধরেছে প্রিয়তাকে। চাইলেও কাটাতে পারছে না। কতোভাবে আর খাবে না কিন্তু রাত বাড়তেই কফির নেশায় গলা শুকিয়ে যায় তার।
এক মগ ধোঁয়া ওঠা কফি নিয়ে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে আছে প্রিয়তা, তার দৃষ্টি এলোমেলো। দূর থেকে ঝিঁঝি পোকার আওয়াজ আসছে। রাত যতো বাড়ে ঝিঁঝির আওয়াজও তত বাড়ে।
“বল।”
“তোর কি মনে হয় উচ্ছ্বাস ভাই আর ফিরে আসবে?”
“আমি কীভাবে জানবো?”
“তোর ভালোবাসার উপর কোনোও বিশ্বাস নেই তোর?”
প্রিয়তা স্মিত হাসে। পেখম আপার হাসি দেখে। তার বোনটা দিন দিন অসম্ভব সুন্দর হয়ে উঠছে। চুলগুলো কোমর ছাড়িয়েছে, গায়ের রঙটাও বেশ খুলেছে আগের চেয়ে, মাঝে মধ্যে চোখে কাজল দিলে উপন্যাসের নায়িকাদের মতো মনে হয়।

“আমার ভালোবাসার উপর আমার বিশ্বাস আছে, এজন্যই আমি এতোগুলো বছর পরেও ওই মানুষটা ছাড়া আর কারো কথা ভাবতে পারিনা। তবে…..”
“তবে কি আপা?”
“না কিছু না।”
“আমার কি মনে হয় জানিস আপা? উচ্ছ্বাস ভাই ফিরবে, খুব তাড়াতাড়ি।”
প্রিয়তা পূর্ণ দৃষ্টি মেলে পেখমের দিকে তাকায়।
“কেনো এমন মনে হয় তোর?”
পেখম উঠে এসে আপার কাঁধে মাথা রেখে দাঁড়ায়। আজ মনে হয় পূর্ণিমা। চাঁদের আলো গলে জানালা দিয়ে ঘরে ঢুকে প্রিয়তার মুখে পড়েছে। সেই আলোয় প্রিয়তাকে দেবীর মতো সুন্দর লাগছে। মাখনের মতো নরম গালে মুক্তোর মতো অশ্রুফোঁটা গুলো চাঁদের আলোয় চিকচিক করছে।

“আপা একটা গান করবি?”
“এখন কি গান করার সময়?”
“সময় দিয়ে কি হয় আপা? দুনিয়ার যা কিছু সুন্দর ঘটনা সব হঠাৎ করেই হয়েছে, সময়ের তোয়াক্কা না করেই।”
প্রিয়তা অবাক হয়ে বোনের দিকে তাকায়। কি ভীষণ সুন্দর একটা কথা বললো মেয়েটা। কতো বয়স হবে ওর? এইটুকু বয়সে এতো সুন্দর কথা শিখলো কোথা থেকে?

“গান কি তুই একাই শুনবি পেখম? আমরা শুনবো না?”
প্রিয়তা আর পেখম চমকে উঠে তাকাতেই দেখে মার্জিয়া বেগম দাঁড়িয়ে আছে পিছনে। তার হাতে এক থালা গরম তেলে ভাজা।
“চল ছাদে যাই, একসাথে জ্যোৎস্না বিলাশ চলবে, সাথে প্রিয়তার গান আর গরম গরম তেলে ভাজা।”
পেখম বললো,”আজ সূর্য কোনদিক দিয়ে উঠেছিলো রে আপা?”
“সে তোরা যাই বলিস, আজ আমার আনন্দের দিন। আজ হোক একটু সীমাছাড়া আনন্দ। কি রে প্রিয়তা যাবি নাকি ছাদে? তোর বাবা-ও আছে।”
প্রিয়তার মন টানছিলো না, কিন্তু বাবা, মা খুশি হবে ভেবে না করতে পারলো না। হালকা হেসে সম্মতি জানায়, পেখম খুশি হয়ে আপাকে জড়িয়ে ধরে।

প্রিয়তার গান শেষ হওয়ার পর পেখমও গান ধরে। প্রিয়তার চেয়ে পেখম ভালো গান করে, প্রিয়তা ভালো নাচে। দুই মেয়ের প্রতিভায় কবির শাহ মুগ্ধ। মার্জিয়া বেগম আঁচলে চোখ মুছে বারবার।

‘চাঁদের হাসির বাঁধ ভেঙেছে
উছলে পড়ে আলো
ও রজনীগন্ধা, তোমার গন্ধসুধা ঢালো
চাঁদের হাসির বাঁধ ভেঙেছে।
উছলে পড়ে আলো
ও রজনীগন্ধা, তোমার গন্ধসুধা ঢালো
চাঁদের হাসির বাঁধ ভেঙেছে।’

পেখমের দরদমাখা গলা শুনে সবার চোখেই পানি জমে। প্রিয়তা কাঠের মতো বসে থাকে শূন্যের দিকে তাকিয়ে। বুকটা কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে তার। এতো সব আনন্দের কিছুই যেনো তাকে স্পর্শ করতে পারছে না।
মার্জিয়া প্রিয়তার কাঁধে হাত রাখতেই কেঁপে ওঠে সে।
“মা।”
“প্রিয়তা চুপ কেনো তুই?”
“কই না তো।”
“কিছু তো খাচ্ছিস না।”
“কই মা খাচ্ছি তো।”
মার্জিয়া কবির শাহের দিকে তাকায়। কবির শাহ উদাস হয়ে চাঁদের দিকে তাকিয়ে বসে আছে। মেয়ের দিকে তাকালেই অপরাধবোধ তাকে জেঁকে ধরছে বারবার। এটা ছাড়া আর কিছুই করার ছিলো না তার এই কথাটা দিয়েও নিজেকে স্বান্তনা দিতে পারছে না সে।

মার্জিয়া বেগম একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,”মা রে, জীবন তো এতো ঠুনকো না। জীবনটা অনেকটা একটা বটগাছের মতো। মাটির নিচে শিঁকড় বিস্তৃত থাকে অনেকটা। বাইরের ঝড় যতোই গাছকে উপড়ে ফেলতে চাক না কেনো, শিকড়গুলো ঠিক শক্ত করে ধরে রাখে তাকে। তুই কি জানিস আমাদের জীবনে সেই শিকড়গুলো কি?”
প্রিয়তা নির্লিপ্ত চোখে মায়ের দিকে তাকায়।
“সেই শিকড় হলো বিশ্বাস, ভরসা। যদি কাউকে ভালোবাসিস মন থেকে, তাকে ভালোবাসার আগে বিশ্বাস করবি। এই বিশ্বাসই তোকে ওই গাছের শিকড়গুলোর মতো আঁকড়ে রাখবে শক্ত করে তোর অবস্থানের সাথে। শুনতে খুব সহজ মনে হলেও এটা খুব কঠিন একটা কাজ। আর এই কাজটাই তোকে সারাজীবন সাধনা করে করতে হবে, করে যেতে হবে। বিশ্বাস আটকে রাখা সহজ কাজ নয় রে মা, এ ভারী কঠিন কাজ।”
কবির শাহ মার্জিয়ার ডান হাত চেপে ধরে আলতো করে। প্রিয়তা আর পেখম মায়ের কোলে মাথা রেখে ছাদেই শুয়ে পড়ে। মনে হচ্ছে চাঁদটা থেকে এক টুকরো নেমে তাদের মধ্যে নূর ছড়িয়ে দিয়ে গেলো।

মাঝরাতে দরজার করাঘাত শুনে কবির শাহ আর মার্জিয়া দুইজনই লাফ দিয়ে বিছানায় উঠে বসে। ঘর থেকে সেই আওয়াজ শুনতে পায় প্রিয়তা আর পেখমও। এই অসময়ে কে এলো তাদের বাড়িতে? কোনো বিপদ আপদ নয় তো?
প্রিয়তা ছুটে বসার ঘরে আসতেই দেখে কবির শাহ ইতোমধ্যে সেখানে।
“আমি দেখছি, তোমরা ঘরে যাও।”
“না বাবা তুমি একা দেখবে না। আগে জিজ্ঞেস করো কে এসেছে।”
করাঘাত আরো বাড়তে থাকে। কবির শাহ চোখে চশমাটা পরেই দরজাটা খুলে দেয়। আর সাথে সাথেই ভয়াবহ চমকে ওঠে সে। আচ্ছা সে স্বপ্ন দেখছে না তো?
সবাইকে উপেক্ষা করেই উচ্ছ্বাস ঢোকে ঘরে। তার মুখে একরাশ বিরক্তি। যেনো কিছুই হয়নি, কতো আসা যাওয়া তার এ বাড়িতে!

প্রিয়তা মাথা ঘুরে পড়ে যেতে গেলেই পেখম তার হাত ধরে। মার্জিয়া বেগম চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকে, সে নিশ্চিত সে স্বপ্ন দেখছে।
পেখম বিস্মিত হয়ে বললো,”উচ্ছ্বাস ভাই।”
কবির শাহ কাঁপা কাঁপা গলায় বললো,”বাবা রে তুমি এসেছো? তুমি এসেছো বাবা?”
হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে কবির শাহ, মার্জিয়া ছুটে যেয়ে তাকে ধরে। তার হাত কাঁপছে থরথর করে।
“আচ্ছা কান্নাকাটি পরে করলেও চলবে। মামি মাছটা নেন তো, পুরোটা ভাজবেন। ভীষণ খিদা লেগেছে। পারবেন না?”
মার্জিয়া এতোক্ষণ পর অবাক হয়ে দেখে উচ্ছ্বাসের হাতে বিশাল একটা ইলিশ মাছ।

“আর পেখম ডাক্তার ম্যাডামকে একটু ছাদে পাঠাও তো, মাছ ভাজতে ভাজতে কিছু চিকিৎসা নিবো তার কাছ থেকে। আমার ভীষণ অসুখ করেছে।”
প্রিয়তা বরফের মতো জমে দাঁড়িয়ে থাকে, এক পা নড়ার ক্ষমতা নেই তার। সে শতভাগ নিশ্চিত সে স্বপ্ন দেখছে, তার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর স্বপ্নটা। যদি তাই হয়, এই স্বপ্ন যেনো শেষ না হয়।
পেখম মুখ টিপে হেসে প্রিয়তার কানে কানে এসে বললো,”মনে হচ্ছে একটুও বদলায়নি, আরো বেশি দুষ্টু হয়েছে।”
প্রিয়তার কানে তখন কোনো কথা ঢুকছে না। সে একদৃষ্টিতে উচ্ছ্বাসের দিকে তাকিয়ে আছে। গ্রীক দেবতা জিউসের মতো লাগছে তাকে, পুরুষ মানুষ কি বয়সের সাথে সমানুপাতিক হারে সৌন্দর্য লাভ করতে থাকে? তাকে দেখে তো মনে হচ্ছে না সে অসুস্থ, তবে কি অসুখটা তার অন্য কোথাও?

(চলবে, আগামী পর্বে সমাপ্ত)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে