#তুমি_প্রেম_হলে_আমি_প্রেমিক
পর্ব ২৬:
প্রিয়তার জ্ঞান ফিরেছে কিছুক্ষণ আগে। কিন্তু সে কোনো কথা বলছে না তারপর থেকে, কাঁদছেও না। তার মস্তিষ্ক অনুভূতি শূণ্য মনে হচ্ছে। তার মনে হচ্ছে সে কোনো দু:স্বপ্ন দেখছে, ভয়ংকর একটা দু:স্বপ্ন। ঘুম ভাঙলেই আবার সব স্বাভাবিক হয়ে যাবে।
প্রিয়তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে পেখম। তার চোখ দিয়েও অঝোরে পানি পড়ছে। পাশেই চেয়ারে শরীর এলিয়ে দিয়ে কবির শাহ একদৃষ্টিতে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে। মার্জিয়া বেগম তার পাশেই দাঁড়িয়ে আছে। তার মনটাও অসম্ভব খারাপ হয়ে আছে। তার বিশ্বাস ছিলো উচ্ছ্বাস এমন কিছু করবে না, করতে পারেনা।
“প্রিয়তার বাবা।”
কবির শাহ অস্ফুটে সাড়া দেয়।
“তুমি কি এভাবেই চুপচাপ বসে থাকবে?”
কবির শাহ নির্লিপ্ত গলায় বললো,”আমাকে এখন কি করতে বলছো মার্জিয়া?”
“ছেলেটার আমাদের ছাড়া কে আছে? বাবা মা নেই, কাছের লোক বলতে তো আমরাই। আজ ওর এতো বড় বিপদের দিনে তোমার কিছুই করার নেই বলছো?”
কবির শাহ উঠে দাঁড়ায়। আস্তে আস্তে হেঁটে জানালার পাশে যেয়ে দাঁড়ায়। মানুষটাকে দেখে বুকটা ধক করে ওঠে মার্জিয়ার। এমনিতেই সে অসুস্থ, ক্ষত এখনো পুরোপুরি শোকায়নি। সকাল সকাল এমন একটা খবর, মনে হচ্ছে মানুষটার বয়স এক ধাক্কায় কয়েক বছর বেড়ে গেছে। কেমন জবুথবু হয়ে হাঁটছে। উচ্ছ্বাসকে নিজের ছেলের মতোই তো ভালোবাসতো সে।
“যে নিজে থেকে নিজের বিপদ ডেকে আনতে চায়, তাকে কীভাবে আটকাবো মার্জিয়া? আমি কি আমার চেষ্টার কোনো ত্রুটি রেখেছিলাম? আমার বাড়িতে এনে একরকম লুকিয়ে রেখেছিলাম ছেলেটাকে। যাতে কেউ ওর কোনো ক্ষতি করতে না পারে। কিন্তু ওর চোখে যে আমি ভয়ংকর প্রতিশোধের আগুন দেখেছিলাম। সেই আগুন নেভানোর ক্ষমতা আমার কি ছিলো?”
মার্জিয়া বেগম মুখে আঁচল চাপা দিয়ে কেঁদে ওঠে শব্দ করে।
“কেঁদো না মার্জিয়া, কেঁদে কি হবে? এটা হয়তো হওয়ারই ছিলো।”
“আজ আমার জন্য এতোকিছু হলো, আমি দায়ী সবকিছুর জন্য। আমি যদি ছেলেটার সাথে একটু ভালো ব্যবহার করতাম, তাহলে হয়তো ও আমাদের বাড়ি ছেড়ে যেতো না। এই অন্যায়টা ও করতো না তাহলে।”
“এসব ভেবে নিজেকে কষ্ট দিও না এখন।”
“তাই বলে তুমি কিচ্ছু করবে না? চুপচাপ সব দেখবো আমরা?”
“কি করবো আমরা মার্জিয়া? সব প্রমাণ ওর বিরুদ্ধে, তাছাড়া ও পলাতক। কোথায় খুঁজবো ওকে আমরা?”
পেখম ছুটে এসে বাবাকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে। কবির শাহ পরম যত্নে মেয়ের মাথায় হাত রাখে। নিজেও ঠোঁট কামড়ে কান্না আটকানোর চেষ্টা করে। ছোট থেকে পেখমের একটা আফসোস ছিলো। তার কেনো একটা বড় ভাই নেই। থাকলে কতো আবদার মেটাতো ছোট বোনের। উচ্ছ্বাসকে পেয়ে সে ভেবেছিলো একটা বড় ভাই পেয়েছে। তার এতো বড় বিপদে মেয়েটা নিজেকে সামলাতে পারছে না।
“বাবা উচ্ছ্বাস ভাই এটা করেনি, বিশ্বাস করো উনি এটা করতেই পারেনা। আমি জানি উনি যতোই প্রতিশোধ নিতে চাইতো না কেনো, মানুষ খু’ন করার মতো ছেলে উচ্ছ্বাস ভাই নয়।”
“কিন্তু মা সব প্রমাণ তো ওর বিরুদ্ধে। প্রতিটা স্পটে ওর উপস্থিতির প্রমাণ পাওয়া গেছে। তিনটা খু’নের সময়ই কোনো না কোনোভাবে তার উপস্থিতি ছিলো। এমনকি ও পালিয়ে গেছে এরপর। ও যদি সত্যি এগুলো না করতো তাহলে পালিয়ে গেলো কেনো?”
“হয়তো ভয়ে।”
মার্জিয়া বেগম অসহিষ্ণু হয়ে বললো,”তুমি বিশ্বাস করো উচ্ছ্বাস এটা করতে পারে? ছেলেটা একটু রগচটা, তাই বলে খু’ন?”
কবির শাহ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,”আমি বিশ্বাস করতে চাইনা মার্জিয়া। আমি এখনো কোনো মীরাক্কলের অপেক্ষা করছি। হয়তো সত্যি প্রমাণ হয়ে যাবে উচ্ছ্বাস এগুলো করেনি। কিন্তু বাস্তবে এমন মীরাক্কল কাঁহাতক হয়?”
মার্জিয়া বেগম আবার কাঁদে। বুকটা কেমন ভার হয়ে আসছে তার। আজকের সকালটা এমন বিষাদময় কেনো?
“সব আমার জন্য হয়েছে সব।”
“তোমার জন্য নয় মা, যা হয়েছে সব কিছুর জন্য দায়ী আমি। আমার জন্যই এতোকিছু হয়েছে। নাহলে ওই মানুষটা কখনোই এটা করতো না।”
সবাই ঘাড় ঘুরিয়ে প্রিয়তার দিকে তাকায়। এতোক্ষণ পর সে কথা বলছে। কিন্তু তার কণ্ঠ একদম নির্জীব। কেউ যেনো জোর করে তাকে কথা বলতে বাধ্য করছে।
কবির শাহ ছুটে এসে মেয়ের মাথায় হাত রাখে। নিজের মেয়েটার জন্যও উচ্ছ্বাসের পাশাপাশি খুব কষ্ট হচ্ছে তার। অষ্টাদশীর প্রথম প্রেম ভয়ংকর হয়, এটাকে হেলাফেলা করা উচিত নয়।
“তুই এখন এসব কেনো বলছিস মা? তোর শরীর দূর্বল, তুই বিশ্রাম কর।”
“না বাবা, যা সত্যি তাতো সত্যিই। আজ আমার জন্যই এতো কিছু হয়েছে। হাসপাতালে আমি যদি উচ্ছ্বাস ভাইয়ের সাথে খারাপ ব্যবহার না করতাম, উনি হয়তো আবার ফিরে আসতো আমাদের বাড়ি। উনি সবকিছু ভুলে আবারও নতুন করে সব শুরু করতে চেয়েছিলো হয়তো। ঠিক এমন সময় তাকে খুব কঠিন কিছু কথা আমি শুনিয়েছি। আমি ভুল করেছি বাবা।”
কবির শাহ আর মার্জিয়া হতভম্ব হয়ে প্রিয়তার দিকে তাকায়। এমন কিছু শুনতে হবে ভাবতেই পারেনি তারা। পেখম মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে।
কবির শাহ কঠিন গলায় মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললো,”তুমি উচ্ছ্বাসের সাথে খারাপ ব্যবহার করেছো?”
মার্জিয়া রাগান্বিত হয়ে মেয়ের কাছে এসে বললো,”কতোটা নিমকহারাম মেয়ে তুমি প্রিয়তা। যে মানুষটা তোমার বাবার এমন অবস্থায় সবার আগে ছুটে এসেছে। দুই হাতে আগলে রেখেছে আমাদের পরিবারকে অমন কঠিন সময়ে তার সাথে খারাপ ব্যবহার করেছো তুমি? এই শিক্ষা এতোদিন দিয়েছে তোমার বাবা?”
মার্জিয়া রাগে থরথর করে কাঁপতে থাকে। ইচ্ছা করছে মেয়েটাকে মেরে আধমরা করে দিতে। কীভাবে এতোটা অসভ্য হতে পারলো? আজ উচ্ছ্বাস না থাকলে, কি হয়ে যেতো সেদিন? হয়তো বাঁচানোই যেতো না মানুষটাকে। কতো আপনজনই তো ছিলো, কেউ তো আসেনি সেদিন।
“মার্জিয়া আমি কথা বলছি তো। ওকে আমার কাছে বলতেই হবে কেনো ও এই কাজ করেছিলো। তুমি জানো আমি যেমন ভালোবাসতে জানি তেমনই শাসন করতেও জানি।”
প্রিয়তা নির্লিপ্ত গলায় বললো,”ভুল যখন আমি করেছি, এর প্রায়শ্চিত্তও আমিই করবো।”
“কি করতে চাচ্ছো তুমি?”
প্রিয়তা বাবার দিকে তাকায়। মেয়েটার দিকে তাকানো যাচ্ছেনা, চোখ লাল হয়ে ফুলে আছে।
“উনার কিছু হলে আমি নিজেকে শেষ করে দিবো বাবা।”
মার্জিয়া বেগম রাগে ফেটে পড়ে। দৌড়ে এসে মেয়ের গায়ে হাত ওঠাতে গেলেই কবির শাহ তাকে থামায়।
“কতো বড় অসভ্য একবার ভাবো, কতোটা নির্লজ্জ মেয়ের জন্ম দিয়েছো। এতো বড় অন্যায় করেছে তার উপর বাবা মায়ের সামনে কীভাবে বেহায়ার মতো কথা বলছে। ও নিজেকে কি শেষ করবে? আমারই তো ওকে শেষ করে দিতে ইচ্ছা করছে।”
“মার্জিয়া শোনো, আমি বাবা হওয়ার পাশাপাশি একজন শিক্ষক এ কথা ভুলে যেওনা। আমি আমার সন্তানকে কখনো এমন শিক্ষা দিবো না যে এভাবে কথা বলার সাহস সে পাবে বাবা মায়ের সামনে। তবে সবকিছু বলার একটা নির্দিষ্ট সময় আছে। মেয়েটা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। ও স্বাভাবিক হোক, আমি নিজে ওকে শাস্তি দিবো।”
প্রিয়তা হঠাৎ চিৎকার করে বললো,”আমাকে এখনই শাস্তি দাও বাবা। আমার জন্য একটা ফুলের মতো মানুষের জীবন ধ্বংস হয়ে গেলো। আমাকে এখনই শাস্তি দাও তুমি।”
কবির শাহ শীতল গলায় বললো,”হয়তো নিজেকে তুমি যতোটা গুরুত্বপূর্ণ মনে করছো ওর কাছে, ততটা নয়। হয়তো তোমার কোনো কথায় না, নিজে থেকেই ও এই কাজটা করেছে। নিজের দিকে কেনো টেনে নিচ্ছো? তবে এটা ঠিক ওর সাথে হাসপাতালে খারাপ ব্যবহার করে তুমি চরম অন্যায় করেছো। এই শাস্তি তোমাকে পেতেই হবে।”
প্রিয়তা চিৎকার করে কাঁদতে চায়, পারেনা। অদৃশ্য কেউ ওর গলাটা টিপে ধরে আছে যেনো।
কবির শাহ হঠাৎ উঠে দাঁড়ায়। পাঞ্জাবিটা গায়ে চাপাতে চাপাতে বের হতে গেলেই মার্জিয়া ডাকে পেছন থেকে।
“এখন আবার কোথায় যাচ্ছো তুমি? শরীর তো ভীষণ দূর্বল তোমার।”
কবির শাহ মেয়ের দিকে একবার কঠিন দৃষ্টি ফেলে তাকিয়ে মার্জিয়ার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে।
“যে আমার জীবন বাঁচাতে সবার আগে ছুটে এসেছে, আমি একজন বাবা হয়ে ঘরে বসে থাকি কীভাবে মার্জিয়া?”
“তুমি এখন কোথায় খুঁজবে ওকে? খবরের কাগজে যে দেখলাম ও পলাতক।”
“শান্ত হয়ে ঘরে বসে না থেকে কিছু তো করা উচিত। নাহলে ওপাড়ে যদি ওর বাবা মায়ের সাথে দেখা হয়ে যায় আমার। কি জবাব দিবো তাদের মার্জিয়া? ওরা যে আমাকে জিজ্ঞেস করবে, আমার কলিজার টুকরোটাকে বাঁচাতে পারলে না?”
প্রিয়তা তড়িৎগতিতে উঠে দাঁড়ায়।
“বাবা আমিও যাবো, আমাকে নাও।”
কবির শাহ স্মিত হেসে বললো,”প্রয়োজন নেই।”
কাউকে আর কোনো কথা বলতে না দিয়ে কবির শাহ হনহন করে বেরিয়ে যায়। মার্জিয়া বেগমও বেরিয়ে যায় ঘর ছেড়ে। সে ঠিক করেছে সে জায়নামাজে বসবে। উচ্ছ্বাসের বিপদ না কাটা পর্যন্ত জায়নামাজ থেকে উঠবে না সে। একজন মায়ের আকুল চাওয়া সৃষ্টিকর্তা কীভাবে ফেরান তাই দেখবে সে।
সবাই চলে যাওয়ার পর কাঁপা কাঁপা পায়ে প্রিয়তা এসে বসে খাটের উপর। পেখম কিছুটা ইতস্তত করে বোনের কাঁধে হাত রাখে। আচমকাই হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে প্রিয়তা। আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে চিৎকার করতে থাকে সে। পেখম তাকে থামায় না। সে চায় প্রিয়তা কাঁদুক, ভিতরের কষ্টটা বের করে মিশিয়ে দিক বাতাসে। তাতে যদি একটু হালকা হয় সে।
“ভাই।”
“হু।”
“আজ সব খবরের কাগজে ছাপা হয়েছে আপনার ছবি।”
“আরে বাপ রে, হিরো হয়ে গেলাম নাকি?”
রাসেল অবাক হয়ে বললো,”ভাই আপনি এখনো মজা করছেন?”
“কেনো মজা না করার মতো কি কিছু হয়েছে?”
“ভাই পুলিশ হন্যে হয়ে আপনাকে খুঁজছে। তিন তিনটা মার্ডা’র কেসের আসা’মী আপনি।”
“পুলিশের কাজ পুলিশ করছে। এতে এতো অবাক হওয়ার কি আছে?”
“আপনি কি বুঝতে পারছেন আপনি কি বলছেন?”
উচ্ছ্বাস ছোট্ট করে হেসে রাসেলের কাঁধে হাত রাখে। রাসেল অবাক হয়ে দেখে এতোসবের মধ্যেও এই ছেলেটা এতো সুন্দর করে হাসছে কেনো? আর একজন পুরুষ মানুষের হাসি এতো সুন্দর হবে কেনো?
“দেখ রাসেল, আমি জানি আমি এগুলো কিছু করিনি। তাই আমার কোনো ভয় নেই।”
“যদি তাই হবে তাহলে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন কেনো?”
“কোথায় পালিয়েছি? আমি আমার জায়গাতেই আছি। পুলিশ যদি খুঁজে পায়, পাবে।”
রাসেল অসহিষ্ণু হয়ে বললো,”ভাই জীবনটা কোনো থ্রিলার মুভি না আর আপনিও লিওনার্দো ক্যাপ্রিও না। যেসব জায়গায় তিনটা খু’ন হয়েছে সব জায়গায় আপনি গিয়েছেন এবং প্রমাণও ফেলে এসেছেন। কোথাও পায়ের ছাপ তো কোথাও নিজের শার্টের ছেঁড়া অংশ। আপনি কীভাবে প্রমাণ করবেন যে এগুলো আপনি করেননি? শুধুমাত্র তাদের ভয় দিতে গিয়েছিলেন?”
উচ্ছ্বাস এদিক ওদিক তাকায়। কেমন অস্বস্তি তার চোখেমুখে।
“এখন আবার কি খুঁজছেন?”
“সিগারেটের তৃষ্ণা হচ্ছে। শালা সবগুলো শেষ হয়ে গেছে।”
“একটু আগেই তো একটা খেলেন। এখনই তৃষ্ণা পেয়ে গেলো?”
“যেদিন নন্দিনীর সুধা পান করে তৃষ্ণা মিটবে সেদিন থেকে আর খাবো না যা, কথা দিলাম।”
রাসেলের কান লাল হয়ে যায়। লোকটা ভীষণ ঠোঁটকাটা। ছেলে হয়ে রাসেলেরই লজ্জা লাগে।
“কি রে তুই লজ্জা পাচ্ছিস কেনো? তুই কি নন্দিনী নাকি?”
এমন সময়ও কেউ এমন মজা করতে পারে? হাসবে না হাসবে না করেও হেসে দেয় রাসেল, উচ্ছ্বাসও হাসে।
“কিন্তু রাসেল আমি একটা জিনিস এখনো বুঝতে পারছি না।”
“কি ভাই?”
উচ্ছ্বাস চিন্তিত গলায় বললো,”ওই তিন জানো’য়ারের সাথে আর কার শত্রুতা থাকতে পারে? আমি বাদে কে ওদের শেষ করে দিতে চায়?”
রাসেল উত্তর দেয়না, এটা সে-ও ভেবেছে।
“তবে সে যে-ই হোক, আমার উপর তার কড়া নজরদারি আছে এখনো।”
“আপনি কীভাবে বুঝলেন?”
“আমি ঠিক যেদিন যেদিন ওই তিনজনকে ভয় দেখাতে গিয়েছি ঠিক সেদিনেই ওদের খু’ন হয়। তিন ক্ষেত্রেই আমি যাওয়ার আগেই ওরা খু’ন হয়ে ছিলো। যে সত্যিই এই কাজ করেছে, সে কীভাবে জানলো আমি ওদিনই যাবো। আমি না চাইতেও আমার উপস্থিতির প্রমাণ খুব সূক্ষ্মভাবে ওখানে রাখা হয়েছে। কারণ সে জানতো আমি যাবো, আর আমার কাছে মার্ডা’র মোটিভ ছিলো। এই জিনিসটাই সে কাজে লাগিয়েছে।”
রাসেল চিন্তিত মুখে তাকায় উচ্ছ্বাসের দিকে। আসলেই তো, এটা তো সে ভেবে দেখেনি।
“আমার মনে হয় দূরের কেউ না, আমার খুব কাছের কেউ এটা করছে। আমার প্রতিটা গতিবিধি নজরে রাখছে।”
রাসেল কিছুটা অপ্রস্তুত বোধ করে। কারণ দলে উচ্ছ্বাস বাদে যে তিনজন আছে তাদের মধ্যে সে-ও একজন।
উচ্ছ্বাস আচমকা শব্দ করে হেসে দেয়। বুকটা ধকধক করে ওঠে রাসেলের। তবে কি উচ্ছ্বাস তাকে সন্দেহ করছে?
উচ্ছ্বাস হঠাৎ হাসি থামিয়ে ক্রুর চোখে রাসেলের দিকে তাকায়। ডেরার আধো আলোয় সেই দৃষ্টি দেখে ভয় পেয়ে যায় রাসেল।
“তুই ভয় পাচ্ছিস কেনো রাসেল? কাজটা তুই করিসনি তো?”
রাসেল থতমত খেয়ে বললো,”ভাই……”
“এখন সামনে থেকে দূর হয়ে যা। আর হ্যা, গা টা ম্যাজম্যাজ করছে। সিগারেট এনে দে। পকেট থেকে টাকা নিয়ে যা।”
রাসেল কাঁপা কাঁপা পায়ে বেরিয়ে যায়। উচ্ছ্বাস হাসে সেদিকে তাকিয়ে।
এরপর বুকপকেট থেকে একটা ছোট্ট সাদাকালো ছবি বের করে উচ্ছ্বাস। মুচকি হাসে সেদিকে তাকিয়ে।
“প্রিয়তমা খুব কাঁদছো বুঝি? কাঁদো, খুব কাঁদো। আমি মানুষটা ভালো না। আমি প্রতিশোধ নিতে ভালোবাসি। আমার মনের মৃ’ত্যু ঘটাতে চেয়েছো তুমি, তোমাকে যে এই শাস্তিটুকু পেতেই হবে। তবে হ্যা, ভালোবাসায় প্রতিশোধ চলে না। তাই বেশিদিন না, অচিরেই তোমার কান্না বন্ধ হবে। ততদিন একটু কষ্ট করো নন্দিনী।”
ধপ করে মেঝেতে বসে পড়ে উচ্ছ্বাস। নেশাটা মারাত্মকভাবে চেপে ধরেছে তাকে। সিগারেট না পেলে গলা শুকিয়ে আসবে আরো। শরীরে নারকীয় এক যন্ত্রণা ভর করে। এই নেশা সে কাটাতে চায়, সে জানে এই নেশা কীভাবে কাটবে। ছবিটা আরেকবার চোখের সামনে তুলে ধরে উচ্ছ্বাস।
সারারাত তীব্র মাথা যন্ত্রণায় ছটফট করেছে প্রিয়তা। ভোরের দিকে ব্যথা চলে গেছে। ভীষণ খিদা লেগেছিলো তখন। গরম ভাতে চিকন করে ভাজা আলু দিয়ে খেতে ইচ্ছা করছিলো। কিন্তু খেতে বসে একবারও ভাত মুখে নিতে পারেনি, গলা দিয়েই নামেনি। এক অসহ্য যন্ত্রণা পুরো শরীরে বয়ে বেড়াচ্ছিলো, খেতে দেয়নি তাকে একটুও।
সকালের নরম আলোয় মূর্তির মতো মেঝেতে দুই হাঁটুতে মুখ গুঁজে বসে আছে প্রিয়তা। চোখে পানি নেই, তবুও শরীর কাঁপছে কিছুক্ষণ পর পরই গতকালের পর থেকে কবির শাহ বা মার্জিয়া কেউ বড় মেয়ের সাথে কোনো কথা বলেনি। উন্মাদের মতো লাগছে নিজেকে।
“আপা।”
প্রিয়তা তাকায় না পেখমের দিকে।
“আপা একজন দেখা করতে এসেছে তোর সাথে।”
প্রিয়তা আলতো করে চোখ মেলে তাকাতেই দেখে পেখমের পিছনে নীলু দাঁড়িয়ে আছে। তার চোখেমুখে ভয় কিংবা হতাশার চিহ্ন।
প্রিয়তা ভ্রু কুঁচকে তাকায় নীলুর দিকে। ও এখানে এখন কি চায়? কি বলতে এসেছে?
“প্রিয়তা।”
“আপনি এখানে?”
নীলু মাথা নিচু করে পেখমকে বললো,”পেখম ওর সাথে আমার ব্যক্তিগত কিছু কথা আছে।”
পেখম বুঝতে পেরে একবার প্রিয়তার দিকে তাকিয়ে চলে যায় ঘর ছেড়ে। প্রিয়তা তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে আছে নীলুর দিকে। তার সাথে এই মেয়ের কি ব্যক্তিগত কথা থাকতে পারে? কি চায় সে?
পেখম যেতেই নীলু ধীর পায়ে এসে প্রিয়তার পাশেই মেঝেতে বসে পড়ে। প্রিয়তা কিছুটা অপ্রস্তুত বোধ করে।
“প্রিয়তা আমি জানি তোরা কতোটা পেরেশানিতে আছিস। আমি গতকালের খবরের কাগজ পড়েছি।”
প্রিয়তার এখন একদম ইচ্ছা করছে না নীলুর সাথে কোনো কথা বলতে। অসম্ভব বিরক্ত লাগছে মেয়েটাকে তার। কি বলতে চায় সে? যদি জানেই তারা পেরেশানিতে আছে, তবে কেনো এসেছে?
“নীলু আপা আমি বুঝতে পারছি না আপনি কেনো এসেছেন এখানে? আমার সাথে কি ব্যক্তিগত কথা থাকতে পারে আপনার?”
নীলু এদিক ওদিক তাকিয়ে চাপা গলায় ফিসফিস করে বললো,”আমাকে আসলে এখানে নিয়াজ মোর্শেদ পাঠিয়েছে।”
প্রিয়তা ভয়ংকরভাবে চমকে নীলুর দিকে তাকায়। প্রিয়তার দৃষ্টি দেখে ভড়কে যায় নীলু। মুখটা মুহুর্তেই লাল হয়ে উঠেছে প্রিয়তার।
“প্রিয়তা আমার কথা শোন……”
“আপনি বেরিয়ে যান নীলু আপা।”
“প্রিয়তা…”
“শুনতে পাননি আমি কি বলছি? আপনি যদি এখনই বেরিয়ে না যান তাহলে আমি ভুলে যাবো আপনি আমার বড়। আমার মাথা এখন ঠিক নেই। আমি যা ইচ্ছা তাই করতে পারি। নিজের সম্মান নষ্ট করতে না চাইলে ভালোয় ভালোয় আমার সামনে থেকে চলে যান আপনি, এখনই।”
“প্রিয়তা পুরো কথা না শুনেই এমন করছিস কেনো? আগে আমার কথাটা শোন।”
“আমি কোনো কথা শুনতে চাইনা নীলু আপা। ওই অসভ্য লোকটা এখনো কেনো আমার পিছে পড়ে আছে? আর আপনি এসেছেন তার হয়ে আমার কাছে বার্তাবহন করতে। আপনি কি ডাকপিয়ন নাকি?”
নীলু হতাশ মুখে তাকায়। প্রিয়তার এখন ইচ্ছা করছে এই মেয়েটাকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বাড়ি থেকে বের করে দিতে। নর্দমার কীটের মতো লাগছে এখন মেয়েটাকে তার কাছে। মনে হচ্ছে একটা কালো কীট কিলবিল করছে তার সামনে। সহ্য হচ্ছেনা তার একবিন্দু।
“কি হলো এখনো গেলেন না?”
প্রিয়তার গলার উত্তাপ টের পেয়ে উঠে দাঁড়ায় নীলু। কিছুক্ষণ ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থেকে দরজার দিকে এগিয়ে যেতেই কি মনে করে আবার ফিরে আসে সে।
“আপনি আবার এসেছেন? বললাম না আমার ভালো লাগছে না এখন কথা বলতে?”
নীলু কিছুক্ষণ চুপ থেকে একটা ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,”প্রিয়তা আমি যদি তোর মনটা এ মুহুর্তে ভালো করে দিই? আমি জানি আমাকে এসময় যতোটা অসহ্য লাগছে তোর, তখন ততটা লাগবে না।”
প্রিয়তা ভ্রু কুঁচকে বললো,”তার মানে?”
নীলু ম্লান হেসে প্রিয়তার পাশে এসে বসে আবার। প্রিয়তা কোনোভাবেই এই মেয়েটাকে বিশ্বাস করতে পারছে না। যাকে নিয়াজ মোর্শেদের মতো অসভ্য একটা লোক তার কাছে পাঠিয়েছে তার নিশ্চয়ই কোনো অভিসন্ধি আছে।
“নীলু আপা কি বলবেন আপনি?”
“তুই এই মুহুর্তে যা নিয়ে দুশ্চিন্তা করছিস, আমি সেই দুশ্চিন্তা কমিয়ে দিতে পারি।”
“আপনি কীভাবে জানেন আমি কি নিয়ে দুশ্চিন্তা করছি?”
নীলু হাসে, প্রিয়তা এবার নড়েচড়ে বসে। তার সত্যি এবার মনে হচ্ছে নীলু শুধু শুধু এখানে আসেনি। কোনো একটা উদ্দেশ্য আছে তার।
“তুই কি উচ্ছ্বাস ভাইকে প্রচন্ড ভালোবাসিস সেইটা আমি জানি।”
প্রিয়তা উত্তর দেয়না।
“এই মুহুর্তে তোর ভালোবাসার মানুষটাকে পুলিশ খুঁজছে এটাই যে তোর দুশ্চিন্তার কারণ এটাও আমি জানি।”
“আপনি সেই দুশ্চিন্তা কীভাবে কমাবেন?”
“যদি বলি আমি জানি তোর উচ্ছ্বাস ভাই কোথায় আছে?”
এক ঝটকায় উঠে দাঁড়ায় প্রিয়তা। তার শরীর অসম্ভব কাঁপছে। মনে হচ্ছে যে কোনো সময় মাথা ঘুরে পড়ে যাবে। কোনোমতে নিজেকে সামলায় সে।
“নীলু আপা……”
নীলু দরজার দিকে তাকিয়ে প্রিয়তাকে বললো,”আস্তে কথা বল, সবাই শুনবে তো।”
“সবাই শুনলে কি হবে নীলু আপা? আমার বাড়ির সবাই দুশ্চিন্তায় আছে। সবাই খুব খুশি হবে।”
প্রিয়তা হড়বড় করে কথা বলে যায়। খুশিতে মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে তার, যা চোখ এড়ায় না নীলুর।
“তোকে আমি আরেকটা সুখবর দিবো।”
“আপনি আমার জন্য অনেক বড় একটা সুখবর এনেছেন নীলু আপা। এরচেয়ে বড় সুখবর আমার কাছে আর নেই এই মুহুর্তে।”
নীলু উঠে এসে প্রিয়তার পাশে দাঁড়ায়, হাত ধরে তার। নীলু টের পায় প্রিয়তা ক্ষণে ক্ষণে কেঁপে উঠছে।
“আছে প্রিয়তা আছে, এরচেয়েও বড় সুখবর আছে।”
প্রিয়তা অস্থির চোখে তাকায় নীলুর দিকে।
“উচ্ছ্বাস ভাই এই খু’নগুলো করেনি।”
হতবাক হয়ে প্রিয়তা নীলুর দিকে তাকায়। নীলু হাসে তার দিকে তাকিয়ে।
“নীলু আপা আপনি জানেন আপনি কি বলছেন?”
“আমি জানি প্রিয়তা। জানি বলেই এখানে এসেছি।”
প্রিয়তা টালমাটাল পায়ে দূরে ছিটকে আসে কিছুটা। বুকের উপর কয়েক মণের পাথর দীর্ঘক্ষণ চাপা থাকলে হঠাৎ তা সরে গেলে শরীরটা যেমন হালকা লাগে, প্রিয়তারও তাই লাগছে। শরীর ছেড়ে দিয়েছে তার। মনে হচ্ছে যে কোনো মুহুর্তেই মাটিতে পড়ে যাবে শরীরের সব শক্তি হারিয়ে। হৃৎপিণ্ডটা এতোক্ষণে বুঝি একটু শান্তি দিচ্ছে বুকের কোটরটাকে। সে জানেনা নীলু সত্যি বলছে না মিথ্যা। তবে এই সময় যে তার খুব বিশ্বাস করতে ইচ্ছা করছে নীলু যা বলছে সব সত্যি, একবিন্দু মিথ্যা না।
“তাহলে কে করেছে নীলু আপা? কে করেছে এই কাজ?”
নীলু রহস্যময় একটা হাসি দেয় প্রিয়তার দিকে তাকিয়ে।
(চলবে…….)
#তুমি_প্রেম_হলে_আমি_প্রেমিক
পর্ব : ২৭
প্রিয়তা একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে নীলুর দিকে। গভীরভাবে অবলোকন করছে তাকে। বিশ্বাস করবে কি করবে না ভাবছে। অতীতের স্মৃতিগুলো নীলুকে বিশ্বাস করতে বাঁধা দিচ্ছে প্রিয়তাকে। তার উপর নিয়াজ নাকি তাকে পাঠিয়েছে। নিয়াজ লোকটাকে কোনোভাবেই বিশ্বাস করা যায়না, কিন্তু তার পাঠানো নীলুকে কি যায়?
“আমি জানি প্রিয়তা তুই কি ভাবছিস।”
“আমি কি ভাবছি তা জানা আপনার জন্য গুরুত্বপূর্ণ নয় নীলু আপা।”
নীলু হাসে, তবে হাসিটা এবার অতোটা খারাপ লাগেনা প্রিয়তার।
“নীলু আপা আপনি সত্যি জানেন উচ্ছ্বাস ভাই কোথায় আছে?”
নীলু কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে আস্তে আস্তে বললো,”জানি।”
“কীভাবে জানেন?”
“তার জন্য তোকে ধৈর্য্য ধরে আমার পুরো কথাটা শুনতে হবে। আর বিশ্বাস রাখতে হবে আমি তোর খারাপ চাইবো না।”
প্রিয়তা স্মিত হেসে বললো,”কেনো এই বিশ্বাসটা করবো আপনাকে নীলু আপা?”
“অবিশ্বাসই বা কেনো করবি?”
নীলুর কথায় কিছুটা থতমত খেয়ে যায় নীলু, আসলেই তো অবিশ্বাস করবে কেনো? শুরু থেকে নীলুর আসলেই কি কোনো দোষ ছিলো? নীলু তো জানতো না সে উচ্ছ্বাস ভাইকে পছন্দ করে। না জেনেই একজন সুদর্শন যুবকের প্রেমে পড়া কি খুব অস্বাভাবিক কিছু? আর বাকি রইলো নিয়াজের কথা। সেই পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠানে তাকে নিয়াজের কাছে নিয়ে যাওয়া থেকে শুরু করে আর যাই হোক, নিয়াজ সেভাবেই নিজেকে পরিচয় দিয়েছে নীলুর কাছে। নীলু কিছু বোকামি করেছে, তাই বলে একেবারেই অবিশ্বাস করার মতো সে?
“শোন প্রিয়তা, ছোট্ট একটা মফস্বল শহর আমাদের, তার মধ্যে নিতান্তই ছোট একটা কলেজ আমাদের। এখানে কিছু হলে গোপন থাকে না, সবাই সব জানতে পারে। তোর উচ্ছ্বাস ভাই তোর জন্য যে পাগলামি করেছে, কেউ কিছু বুঝতে পারেনি ভেবেছিস? আমরা সবাই আছি তোদের পাশে।”
প্রিয়তা অবিশ্বাসী চোখে নীলুর দিকে তাকায়।
“সবাই মানে?”
“সবাই মানে সবাই। এতো কিছু এখন বলতে পারছি না। তোকে যা বলার জন্য এসেছি, বলে চলে যাবো। বাকিটা তোকে করতে হবে।”
“কি করতে হবে নীলু আপা?”
“প্রথমেই তোকে বলবো নিয়াজ মোর্শেদ আমাকে এখানে কেনো পাঠিয়েছে।”
নীলু কথাটা বলে কিছুক্ষণ চুপ করে প্রিয়তার দিকে তাকিয়ে থাকে। প্রিয়তা অধৈর্য্য হয়ে যায়।
“নিয়াজ জানে এই খু’নগুলো কে করেছে।”
“কি বলছেন নীলু আপা?”
“ওর চাচাতো ভাই, যে কিনা একজন সিরিয়াল কিলা’র তাকে দিয়ে একজন বড় শিল্পপতি এই কাজ করিয়েছে।”
প্রিয়তা আঁৎকে উঠে বললো,”তার সাথে উচ্ছ্বাস ভাইয়ের চাচাদের কি সম্পর্ক?”
“তারা বিজনেস পার্টনার ছিলো। টাকা নিয়ে কিছু একটা সমস্যা চলছিলো। অনেকদিন থেকেই তাদের মারার প্লান করছিলো। কিন্তু যেহেতু তারা বিজনেস পার্টনার ছিলো তাই সব সন্দেহ তার উপরই পড়বে। তাই সে সুযোগ খুঁজছিলো, আর পেয়েও গেলো। উচ্ছ্বাস ভাইকে ব্যবহার করলো দাবার গুটি হিসেবে।”
“নীলু আপা এসব কি বলছেন? উচ্ছ্বাস ভাই এসব করতেই পারেনা। উনার রাগ বেশি, তবে বিশ্বাস করুন উনি মানুষটা মোটেই এমন না। উনাকে কেনো কেউ দাবার গুটি হিসেবে ব্যবহার করতে চাইবে?”
“খুব স্বাভাবিক, যাতে দায়টা তার উপর যেয়ে পড়ে। উচ্ছ্বাস ভাইয়ের বাবা মা’কে খু’ন করা হলে যেনো বিনা মেঘেই বৃষ্টিপাত হয় ওই লোকের। সেই সময় থেকে পুরোটা সময় তার নজর ছিলো উচ্ছ্বাস ভাইয়ের উপর। তার এই বাড়িতে আসা, এ বাড়ি থেকে চলে যাওয়া সবকিছুতে নজরদারি রেখেছে ওই লোক। তোকে ভালোবাসার পর উচ্ছ্বাস ভাই চেয়েছিলো সবকিছু ছেড়েছুড়ে নতুন করে বাঁচবে। কিন্তু এটা হলে তো ওই লোকের সব পরিকল্পনা ভেস্তে যাবে। তাই উচ্ছ্বাস ভাইয়েরই এক কাছের লোককে দিয়ে প্রতিনিয়ত উষ্কে দিয়েছে তাকে। তবুও উচ্ছ্বাস ভাই রাজি হয়নি খু’ন করতে। সে চেয়েছিলো শুধু ভয় দেখাবে তার চাচাদের। কিন্তু তার দলেরই সেই ছেলেটা উচ্ছ্বাস ভাইয়ের পাশে থাকার নাম করে তাকে ফাঁসিয়েছে। তার পায়ের ছাপ, শার্টের ছেঁড়া অংশ সবকিছু ওই ছেলেটা অতি সাবধানে ঘটনাস্থলে রেখে এসেছে। যাতে সব সন্দেহ উচ্ছ্বাস ভাইয়ের উপর যায়। আর সে এই পরিকল্পনায় সফল। পুলিশ এখন হন্যে হয়ে উচ্ছ্বাস ভাইকে খুঁজছে। তবে সত্যিই উনি নির্দোষ রে প্রিয়তা।”
প্রিয়তা কাঁপা কাঁপা পায়ে খাটের উপর ধপ করে বসে। মাথাটা ভীষণ ঘুরছে তার। উচ্ছ্বাস ভাই বুঝতেই পারলো না কতো বড় একটা ট্র্যাপে ফেলানো হয়েছে তাকে। অজান্তেই তাকে ব্যবহার করা হয়েছে। এখন সে কি করবে? কীভাবে বাঁচাবে উচ্ছ্বাস ভাইকে?
“উচ্ছ্বাস ভাই অল্পে রেগে যায়, তাকে রাগিয়ে দেওয়া সহজ। আর তার দূর্বলতাকেই ব্যবহার করেছে তারই কাছের কেউ।”
প্রিয়তা ছুটে এসে নীলুকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে ওঠে। নীলু একহাতে জড়িয়ে ধরে তাকে।
“শান্ত হ প্রিয়তা।”
“আমি এখন উচ্ছ্বাস ভাইকে বাঁচাবো কীভাবে নীলু আপা?”
“এখনো সবকিছু সাধ্যের বাইরে চলে যায়নি। আমাদেরকে পারতেই হবে প্রিয়তা। আমরা সবাই আছি তোর সাথে।”
প্রিয়তা কান্নাভেজা লাল চোখে তাকায় নীলুর দিকে।
“কিন্তু এতো কথা আপনি কীভাবে জানলেন?”
“আজ আমাকে নিয়াজ মোর্শেদ ডেকেছিলো। আমাকে সে একটা প্রস্তাব দিয়েছে। তখনই এগুলো জানতে পারি আমি তার কাছে। যেহেতু ওই শিল্পপতি খু’নী হিসেবে ব্যবহার করেছে নিয়াজের চাচাতো ভাইকে।”
“কিন্তু কি প্রস্তাব নীলু আপা?”
“বলবো, তবে শোনার পর তুই আমাকে ভুল বুঝবি না। এজন্যই এই কথা আমি আগে বলিনি। তাহলে তুই আমাকে ভুল বুঝে বাকি কথাটা হয়তো শুনতে চাইতি না।”
প্রিয়তা ঠোঁট কামড়ে নীলুর দিকে তাকিয়ে থাকে।
নীলু কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললো,”নিয়াজ চায় তুই ওকে বিয়ে করিস। বিনিময়ে সে প্রমাণ করবে উচ্ছ্বাস ভাই নির্দোষ।”
চিৎকার করে ছিটকে দূরে যেয়ে দাঁড়ায় প্রিয়তা। নিয়াজ লোকটার প্রতি ঘৃণায় দমবন্ধ হয়ে আসে প্রিয়তার। কতোটা নির্লজ্জ হতে পারে ওই অসভ্যটা। একজন মানুষ নির্দোষ জানা সত্ত্বেও তাকে নির্দোষ প্রমাণ করার স্বার্থে শর্ত দিয়েছে। অসভ্য নর্দমার কীট একটা।
“নীলু আপা, অসভ্যটা আমার পিছু ছাড়ছে না কেনো? কি পেয়েছে আমার মধ্যে? আমি তো আহামরি সুন্দরীও নই, না আছে আমার বাবার অগাধ টাকা। কেনো আমার পিছনে এভাবে পড়ে আছে সেই শুরু থেকে? একজন মানুষ নির্দোষ, সে যখন জানেই তবে তা প্রমাণ করার জন্য আমাকে বিয়ে করার শর্ত দিয়েছে।”
নীলু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,”নিয়াজ মানুষটা ভালো না, আমি শুনেছি আমার বাবার কাছে। শুধুমাত্র তোর পিছে না, অনেক মেয়ের পিছেই নাকি এভাবে পড়েছিলো। অনেক মেয়ের সর্বনাশও করেছে অসভ্যটা। নারীপিপাসু লোভী একটা মানুষ। এটা জানার পরেই আমি ঠিক করেছি, যেভাবে হোক আমি তোকে বাঁচাবো ওর হাত থেকে, সেই সাথে উচ্ছ্বাস ভাইকেও।”
প্রিয়তা গভীর মমতায় নীলুর দিকে তাকায়। এই মুহুর্তে এই মেয়েটাকে তার নিজের বড় বোন মনে হচ্ছে। নিজের উপর রাগ হচ্ছে এতোক্ষণ তাকে ভুল বুঝে এতোগুলা খারাপ কথা বলার জন্য।
“নীলু আপা।”
“বল প্রিয়তা।”
“আমাকে ক্ষমা করে দিন আপা, আমি খুব খারাপ কাজ করেছি, আপনাকে অসম্মান করেছি। আমাকে শাস্তি দিন।”
“ধুর পাগল! তোর জায়গায় আমি থাকলে আমিও এটাই করতাম। এগুলো নিয়ে এখন ভাবার সময় না। তোকে এখন অনেক দায়িত্ব নিতে হবে, উচ্ছ্বাস ভাইকে বাঁচাতে হবে।”
প্রিয়তা চোখ মুছে নীলুর দিকে তাকায় উদগ্রীব হয়ে।
“আমি কি পারবো নীলু আপা? কি করতে হবে আমাকে?”
“তোকে আমি একটা ঠিকানা দিবো, সেখানে যাবি। তবে সবকিছু করতে হবে খুব সাবধানে। দরকার হয় ছদ্মবেশে যাবি।”
“কোথায় যাবো ছদ্মবেশে?”
“উচ্ছ্বাস ভাইয়ের কাছে।”
প্রিয়তা অবাক হয়ে বললো,”ছদ্মবেশে যাবো কেনো?”
“এখনো আসল অপরাধী শকুনের মতো দৃষ্টি রেখেছে উচ্ছ্বাস ভাইয়ের উপর। তোকে যেতে দেখলে সন্দেহ করবে। আর খালুজান যেনো কোনোভাবেই না যায়। পারলে একাই যাবি তুই।”
“আমি একা যাবো?”
“পারলে তাই যাবি।”
“কিন্তু আমি কি করবো ওখানে যেয়ে?”
“উচ্ছ্বাস ভাইকে বলবি পুলিশের কাছে ধরা দিতে।”
প্রিয়তা আঁৎকে ওঠে নীলুর কথায়।
“ধরা দিতে বলবো?”
“ধরা না দিলে নির্দোষ প্রমাণ হবে কীভাবে? কোর্টে আমি প্রমাণ করবো উনি সম্পূর্ণ নির্দোষ। আসল দোষী কে তা আমি প্রমাণ করবো। আমার কাছে প্রমাণ আছে।”
“কি প্রমাণ?”
“সেসব তোকে না জানলেও চলবে। ভুলে যাস না আমি নিয়াজের বাড়িতে গিয়েছিলাম। কিছু প্রমাণ তো সাথে এনেছি।”
প্রিয়তার কেমন অবিশ্বাস্য লাগতে থাকে সবকিছু। যদি নীলু আপা শেষ পর্যন্ত প্রমাণ না দেয়? তাহলে তো উচ্ছ্বাস ভাইয়ের ফাঁ’সি হয়ে যাবে। না না এটা কীভাবে সম্ভব?
“শোন প্রিয়তা তুই আমাকে এই মুহুর্তে বিশ্বাস করতে পারছিস না আমি জানি। এমনিও উনি এই ছোট্ট শহরে খুব বেশিদিন পালিয়ে থাকতে পারবে না, ধরা উনাকে পড়তেই হবে। তাছাড়া আসল অপরাধী জানেই উনার ঠিকানা। সে চাইলেই ধরিয়ে দিতে পারে, কিন্তু সে কোনো ঝুঁকি নিতে চায়না। সে চায়না কোনো দোষ নিজের উপর আসুক। তাই সে অপেক্ষা করছে পুলিশ কবে উচ্ছ্বাস ভাইকে নিজে থেকে ধরবে।”
প্রিয়তা কি করবে বুঝতে পারেনা। বাবা কে না জানিয়ে সে কি বড় ভুল করবে? কিন্তু বাবাকে জানালে কি সে তাকে একা যেতে দিবে? ছোট্ট মস্তিষ্ক এতো চাপ আর নিতে পারছে না।
“তাহলে কি ঠিকানাটা দিবো আমি তোকে?”
প্রিয়তা ক্ষীণ গলায় বললো,”দিন।”
নীলুর মুখে হাসি ফোটে।
“আমি জানতাম তুই পারবি।”
“ভাই।”
উচ্ছ্বাস সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বললো,”বল।”
রাসেল ভয়ে ভয়ে বললো,”আপনি কি আমাকে ভুল বুঝছেন? আমি এমনটা করতে পারি? কখনোই এমন করবো না আমি। আপনি আমাকে বিশ্বাস করেন না? আমি……..”
উচ্ছ্বাস হাত উঁচু করে থামায় তাকে।
“করলে করেছিস, তাতে কি হয়েছে? টাকার কাছে তো আমরা সবাই গোলাম।”
“কিন্তু ভাই আমি তো করিনি এমন কিছু।”
উচ্ছ্বাস রাসেলের কথার উত্তর না দিয়ে গুণগুণ করে গান ধরে। গীটারটা রয়ে গেছে ও বাড়িতে। গীটারকে খুব মনে পড়ছে।
‘তোমার বাড়ির রঙের মেলায় দেখেছিলাম বায়োস্কোপ, বায়োস্কোপের নেশা আমার ছাড়েনা।’
হঠাৎ গান থামিয়ে উচ্ছ্বাস বললো,”এই রাসেল।”
“জ্বি ভাই আদেশ করুন।”
“গা কুটকুট করছে। সাবান দিয়ে গোসল করতে হবে। যা একটা সাবান কিনে আন। নিজের হাতের শেষ গোসল করে নিই, হয়তো এর পরের গোসলটা করতে হবে পরের হাতে। এরপর অনন্ত কালের যাত্রা। তার আগে সাবান দিয়ে ময়লা সব ফেলে দিই শরীরের, কি বলিস?”
রাসেল আঁৎকে উঠে বললো,”এসব কি বলছেন ভাই? আপনি কিছু করেননি, তাহলে কেনো আপনার শাস্তি হবে?”
উচ্ছ্বাস হাই তোলে। তার মুখে দুশ্চিন্তার কোনো রেশ নেই। সে আবারও গুণগুণ করে ওঠে।
‘এইযে দুনিয়া, কিসেরও লাগিয়া। এতো যত্নে বানাইয়েছেন সাঁই।’
খুব সুন্দর একটা টান দেয় উচ্ছ্বাস। রাসেল মন্ত্রমুগ্ধের মতো শোনে। তার চোখ হঠাৎ ঝাপসা হয়ে ওঠে। শার্টের হাতায় চোখ মোছে সে। এই মানুষটাকে কোনোভাবেই সে শাস্তি পেতে দিবে না। দরকার হয় সব দোষ নিজের কাঁধে নিবে, তাও এই মানুষটার যেনো কোনো শাস্তি না হয়। সবকিছু হারিয়ে এক নন্দিনীকে অসম্ভব ভালোবেসে বসে আছে। সে জীবনটা গুছিয়ে নিক, সে কেনো কিছু না করেও শাস্তি পাবে?
“পুরুষ মানুষের কাঁদতে হয়না রে বেটা, এটা একটা অলিখিত সংবিধান। পুরুষ মানুষের কান্না হলো তার দূর্বলতার প্রতীক। যা কিছু হবে শুধু হাসবি। দুনিয়ার সবচেয়ে বিশ্রী দৃশ্য হলো পুরুষ মানুষের কান্নার দৃশ্য। ফাঁ’সির দড়ি সামনে রেখেও হাসা যায় যদি দিল পরিষ্কার থাকে।”
“এতো কঠিন কথা আমি বুঝিনা ভাই। আমার কাছে এই দুনিয়াটাই সব। এই দুনিয়ার পর আর ফিরে আসবে না এই জীবন। আমি আপনাকে কোনো শাস্তি পেতে দিবো না।”
উচ্ছ্বাস উঠে দাঁড়ায়। অনেকদিন বাইরের বাতাস গায়ে লাগানো হয়না।
“আপনি এখন কই যাচ্ছেন?”
“বাইরে যাই, সাবান কিনে আনি।”
“আপনাকে আমি কোথাও যেতে দিবো না। আমি এনে দিচ্ছি।”
“আমি-ই যাবো। অপরাধী হাসিমুখে ঘুরে বেড়াবে আর আমি ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে থাকবো সেই মানুষ তো আমি নই। আমি কোনো অন্যায় করিনি। আর যদি একান্তই আমাকে লোহার শিকের মধ্যে আটকে রাখে আমি কোনো কষ্ট পাবোনা। চিড়িয়াখানায় দেখিস নি, সিংহ থাকে খাচার মধ্যে, বিড়াল-কুকুর থাকে বাইরে। কারণ মানুষ সিংকে ভয় পায়, বিড়ালকে না।”
“ভাই জীবনটা কোনো উপন্যাস না, বাস্তব আর কল্পনার মধ্যে অনেক পার্থক্য। দোষ না করেই শাস্তি পেতে চান?”
“এই মুহুর্তে তোর এতো প্যাচাল শোনার চেয়ে বড় শাস্তি আর নেই। আমি বাইরে যাচ্ছি, কপালে থাকলে দেখা হবে আবার। নাহলে একবারে ওপারে।”
“ভাই…..”
উচ্ছ্বাস শব্দ করে হাসে। কিছু না বলে বেরিয়ে যায়। হতাশ মুখে সেদিকে তাকিয়ে থাকে রাসেল। এই মানুষটা পাগল, অবশ্যই পাগল।
“দ্রুত পা চালা না পেখম, তোকে আনাই আমার ভুল হয়েছে। এতো আস্তে কেউ হাঁটে?”
পেখম অসহায় গলায় বললো,”এমন উঁচুনিচু ভাঙা রাস্তায় তাড়াতাড়ি হাঁটা যায় নাকি আপা? তুই আস্তে হাঁট না, পড়ে যাবি তো।”
প্রিয়তা উত্তর দেয়না। বরং পায়ের জোর আরেকটু বাড়িয়ে দেয়।
প্রিয়তা একা আসতে পারেনি। নীলুর সব কথা পেখম দরজার বাইরে আড়ি পেতে শুনে ফেলে। নীলু চলে যাওয়ার পরেই পেখম প্রিয়তাকে জানায় সে কোনোভাবেই আপাকে একা যেতে দিবে না। যা হয় হবে, সে সাথে যাবেই। বাধ্য হয়ে প্রিয়তা পেখমকে সাথে নিয়ে এসেছে। সন্ধ্যা মিলিয়েছে বেশ আগে। ভালোই রাত নেমেছে। তাছাড়া রাস্তাটাও বেশ নির্জন। পেখম ভয়ে ভয়ে প্রিয়তার হাত ধরে।
“আপা নীলু আপাকে বিশ্বাস করে বাবাকে না জানিয়ে কি ভুল করলাম? পরে যদি বাবা জানতে পারে খুব রেগে যাবে।”
“কথা বলিস না তো পেখম।”
অস্বস্তি প্রিয়তারও হচ্ছে, কিন্তু সে স্বীকার করছে না। মনোবল হারাতে চায়না সে কোনোভাবেই।
এক ফালি চাঁদ উঠেছে আকাশে। হালকা আলোয় প্রিয়তা আবার কাগজটা বের করে ঠিকানাটা পড়ে। কাছেই চলে এসেছে, আর সামান্যই দূর।
‘বাড়ি নাম্বার ১৯’
“অনেকটাই কাছাকাছি চলে এসেছি পেখম, এটা বাড়ি নাম্বার ১৬। আর দুইটা বাড়ির পরেই ১৯ নাম্বার।”
একটা বড় করে শ্বাস ফেলে প্রিয়তা। ভয়ে হৃৎপিণ্ডটা বুকের কাছে এসে ধকধক করতে থাকে তার। একদিকে দু্শ্চিন্তা, অন্যদিকে ভয় আর আরেকদিকে প্রিয় মানুষটাকে এতোগুলো দিন পর সামনে থেকে এক নজর দেখা। একটা মিশ্র অনুভূতি হচ্ছে প্রিয়তার। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আছে। পেখমের দিকে তাকানো যাচ্ছেনা, দরদর করে ঘামছে সে।
“আচ্ছা আপা যেয়ে যদি দেখি উচ্ছ্বাস ভাই ওখানে নেই? নীলু আপা যদি মিথ্যা কথা বলে?”
প্রিয়তা বিরক্ত হয়ে তাকায় পেখমের দিকে। পেখম চুপ করে যায়। প্রিয়তার মোটেই ভালো লাগছে না এখন। মনে হচ্ছে ফিরে চলে যেতে। এতোক্ষণ একটা ঘোরের মধ্যে ছিলো সে। কিন্তু শেষ সময়ে এসে মনে হচ্ছে আসলেই বড় ভুল করে ফেলেছে সে, বাবা কে জানানোটা আসলেই দরকার ছিলো। আসলেই সবাই ঠিক বলে, তার মাথায় কোনো বুদ্ধি নেই, গোবরে ঠাসা।
তার আবেগ বলছে, যা প্রিয়তা যা। তোর প্রিয় মানুষটাকে একবার চোখের দেখা দেখে আয় আর কিছু না হলেও। কিন্তু তার বিবেক বলছে না, এখন আবেগ দেখানোর সময় না। সময়টা ভালো না, যা কিছু ঘটে যেতে পারে। আবেগ আর বিবেকের মধ্যে ঝুলে আছে সে।
ঠিক সতেরো নাম্বার বাড়ি পেরিয়ে আঠারো নাম্বারের কাছে আসতেই বাঁধে বড় বিপত্তিটা৷ ল্যাম্পপোস্টের নিচে গোল হয়ে প্রায় দশ থেকে বারোটা কুকুর কুন্ডলী পাকিয়ে শুয়ে আছে। ছোট থেকেই প্রিয়তার কুকুরে ভীষণ ভয়। তার কলিজার পানি শুকিয়ে আসে। আশেপাশে তাকিয়ে দেখে কেউ নেই তেমন।
ছদ্মবেশ বলতে বোরকা পরে এসেছে দুইবোন। এখন যদি এই অবস্থায় সে তারা দৌড় দেয় কুকুর তো ধাওয়া করবেই। কুকুর না করলেও মানুষ তো ধরবেই চোর ভেবে। ঢোক চাপে প্রিয়তা, পেখম ভয়ে ভয়ে তাকায় আপার দিকে।
“আপা চল ফিরে যাই।”
প্রিয়তা ঠোঁট কামড়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার চেষ্টা করে। সামনে যাবে নাকি ফিরে যাবে?
“আপা কোনোভাবেই দৌড় দিস না আপা, তোর দোহাই লাগে।”
প্রিয়তা মনে মনে ঠিক করে ফেলে সে দৌড় দিবে না, কিন্তু কোনো এক অজানা কারণে আচমকা প্রিয়তা পেখমের হাত চেপে ধরে উন্মাদের মতো দৌড়াতে থাকে সামনের দিকে। ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব হয়ে যায় পেখম। বুঝতে পারেনা কিছুক্ষণ কি হচ্ছে তার সাথে এটা? ধাতস্থ হতেই টের পায় তার আপা ভোঁ দৌড় দিচ্ছে তার হাত ধরে। পেখম যেনো ভাসছে তুলার মতো।
ভয়ে ভয়ে পিছনে তাকাতেই পেখমের কলিজার শুকিয়ে এতোটুকু হয়ে যায়। ঠিক যা ভয় করেছিলো তাই। সবগুলো কুকুর একত্রে ধাওয়া করা শুরু করেছে তাদের। একেকটার দাঁত দেখে মনে হচ্ছে, আজকেই ছিঁড়ে ফেলবে ওদের দু’জনকে। রাগে, ভয়ে পেখম যেনো বোবা হয়ে যায়।
কতক্ষণ এভাবে গেছে পেখম জানেনা। চোখ বন্ধ করে শুধু দৌড়াতেই থাকে দিকবিদিকশুন্য হয়ে। ঠিক তখনই আচমকাই প্রিয়তার হাতে টান পড়ে। লোহার মতো শক্ত হাতের কেউ হাতটা চেপে ধরে তাদের এক গলির মধ্যে ঢুকিয়ে নেয় কুকুরগুলো বুঝে ওঠার আগেই। ডাকতে ডাকতে কুকুরগুলো সামনের দিকে কিছুটা এগিয়ে যায়। ওদের না পেয়ে আবার দল বেঁধে যেখানে শুয়ে ছিলো সেখানে শুয়ে পড়ে।
কিয়ৎক্ষণের জন্য জ্ঞানশুন্য হয়ে যায় প্রিয়তা আর পেখম দুইজনই। কি হতে যাচ্ছিলো এটা? আজ তো এখানেই মৃত্যু হয়ে যেতো, কেউ জানতেও পারতো না। মাথাটা ভোঁ ভোঁ করে ঘুরাতে থাকে ওদের।
“এই আপনারা কি পাগল নাকি অন্য কিছু? কুকুর দেখে দৌড়াতে হয়না এটা তো একটা ছোট বাচ্চাও জানে। মাথায় কি সাবানের ফেনা ভর্তি হয়ে আছে? কোথা থেকে আমদানি হয়েছে এই নমুনা দু’টো? এই আবার চোরটোর নয় তো?”
ভয়াবহভাবে চমকে প্রিয়তা আর পেখম দুইজনই তাকায় সামনের দিকে। এই গলার আওয়াজ তো অপরিচিত নয়, বরং অনেক দিনের পরিচিত। এই গলার স্বর শোনার জন্য প্রিয়তার উন্মুখ হয়ে থেকেছে কতো দিন, নির্ঘুম কেটেছে কতো রাত। এটা কি সত্যি নাকি বিভ্রম?
হালকা চাঁদের আলো এসে পড়েছে গলির উপর। সেই হালকা আলোয় এক গ্রীক দেবতার মতো রূপবান পুরুষ দৃষ্টিসীমার সামনে আসতেই বরফের মতো জমে যায় দুই বোন। এইতো সেই পুরুষ, সেই তেজী চোখজোড়া যা গভীর কিন্তু জ্বলজ্বলে। সেই খোঁচা খোঁচা দাড়ি, ঠোঁটের কোণায় জ্বলন্ত সিগারেট এই অসম্ভব গরমেও কালো চাদরে আবৃত বিশাল প্রশস্ত বুকের সামনে স্বস্তি পায় ওরা দুইজনই। এখনো ভীত হরিণীর মতো কেঁপে যাচ্ছে দুই বোন।
“কথা বলছেন না কেনো? কোন বাড়িতে এসেছেন? এভাবে দৌড়াচ্ছিলেন কেনো?”
পেখম বিস্মিত গলায় বললো,”উচ্ছ্বাস ভাই।”
উচ্ছ্বাস শান্ত দিঘীর মতো শীতল হয়ে যায়। তার মেরুদণ্ড বেয়ে একটা শীতল স্রোত নেমে যায়। এবার তার চমকানোর পালা। ঠোঁট থেকে সিগারেট আলগোছে নিচে পড়ে যায়, সে টেরও পায়না। ভালো করে তাকায় সে দুইজনের দিকে।
প্রথমে প্রিয়তা এরপর পেখম আস্তে আস্তে নিকাবটা টেনে তোলে উপরে। ভূত দেখার মতো চমকে ওঠে উচ্ছ্বাস। তার কল্পনাতেই কখনো আসেনি এমন দিন কখনো আসতে পারে। কথার খেই হারিয়ে অনড় দাঁড়িয়ে থাকে কিছুক্ষণ সে। এরপর আচমকাই প্রিয়তার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে পরে উচ্ছ্বাস। দুইবোনকে চরম অবাক করে দিয়ে প্রিয়তার হাঁটু জড়িয়ে হাউমাউ করে কেঁদে দেয় সে। প্রথমে আস্তে এরপর ভীষণ জোরে শব্দ করে। সে ভুলে যায় কিছুক্ষণ আগে নিজেই রাসেলকে বলা কথাটা,
‘পৃথিবীর সবচেয়ে বিশ্রী দৃশ্য হলো পুরুষ মানুষের কান্নার দৃশ্য।’ সে নিজেও জানে সে কি করছে।
প্রিয়তা স্থাণুর মতো জমে দাঁড়িয়ে থাকে। যেনো সে হাজারটা কাচের টুকরোর উপর দাঁড়িয়ে আছে, একটু নড়লেই কাঁচ বিঁধে যাবে শরীরে, রক্তাক্ত করে দিবে মুহুর্তের মধ্যে।
“মার্জিয়া, মেয়েরা কোথায়?”
উচ্ছ্বাসের যাওয়ার সম্ভাব্য সব জায়গায় খুঁজে বেরিয়েছে আজ কবির শাহ। অসুস্থ শরীর নিয়ে চষে বেরিয়েছে যেনো। উচ্ছ্বাসের ভীষণ দু:সম্পর্কের কোনো আত্মীয়ের বাড়ি বাকি রাখেনি সে৷ ক্লান্ত শরীরের বাড়ি ফিরেছে সন্ধ্যার পর। এসেই এক গ্লাস পানি খেয়ে বুঁদ হয়ে বসে থাকে চেয়ারের উপর৷ ছেলেটা কি শহর ছেড়েছে? কিচ্ছু বুঝতে পারছে না সে। অসম্ভব কান্না পাচ্ছে তার।
মার্জিয়া নির্লিপ্ত গলায় বললো,”রুনার বাড়িতে গিয়েছে প্রিয়তা, সামনেই পরীক্ষা। অনেকদিন কলেজে যায়না, তাই খাতা আনতে গেছে। সাথে পেখমও গেলো। এতো রাতে প্রিয়তা একা যেতে পারবে না তাই।”
কবির শাহ ভ্রু কুঁচকে তাকায়। যে প্রিয়তা সকালেও বিছানা ছেড়ে উঠতে পারছিলো না, রাত হতেই রুনার বাড়ি ছুটলো খাতা আনতে? রাতেই কেনো? সকালেও তো যেতে পারতো।
“মার্জিয়া টেলিফোনটা আর আমার ডায়রিটা এনে দাও তো।”
“এখন আবার কাকে ফোন করবে? উচ্ছ্বাসের কোনো খবর পেয়েছো?”
মার্জিয়া উদগ্রীব হয়ে তাকায় কবির শাহের দিকে।
“না।”
“তাহলে কাকে ফোন করবে এখন আবার?”
“প্রিয়তার বান্ধবী রুনার বাড়িতে ফোন করবো।”
“সে কি, কেনো?”
“ওরা ঠিকমতো পৌঁছালো কিনা শুনি৷ দরকার হয় আমি ওদের এগিয়ে নিয়ে আসবো।”
মার্জিয়া কিছু না বুঝে টেলিফোন এনে দেয়। মেয়েরা বড় হলে নাকি মায়েরা বন্ধু হয়। কিন্তু এ বাড়িতে উলটো। মেয়েদের সবচেয়ে ভালো চিনে তাদের বাবা। কোন মেয়ে কখন কি করতে পারে তার ভালো করেই জানা আছে।
(চলবে……)